পুতুলবাজি ও ঘোর অথবা অনন্ত তৃষার গল্প
সুলেখক ও ভদ্রলোক মাহবুব আজীজ ভাইয়ের সাথে পরিচয় অনেকদিন,
টুকটাক লেখার সূত্র ধরে, কিন্তু কখনো দেখা হয় নি। এবার আসা যাওয়ার পথে দশ থেকে হয়ত
পনের মিনিটের মত দেখা সমকালের অফিসে। আমাদের তিন বাচ্চা নিয়ে আমি হাজির হলাম, ফোনে
ঠিক করা সময়ে, ঈদের ফাঁকা ঢাকাতে। আমাদের বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে সেলফ কনফিডেন্ট আর
খানিকটা ওভার স্মার্ট আমাদের রাজা বেটা, অবশ্যই আমাদের আদরে কিছুটা বাদর। আমাকে জিজ্ঞেস
করলো, আমরা কেন যাচ্ছি ওখানে, আমি ঠিক করে গুছিয়ে বলার আগেই, আমাদের আর এক মেয়ে বললো,
জানো না বোকা, মিষ্টি মা এবার বুক ফেয়ারে যে একটা বুক পেয়েছে, তাই যাচ্ছে। এর মধ্যেই
আমরা সমকাল অফিসে পৌঁছে মাহবুব আজীজ ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম, তখন নাক উঁচিয়ে রাজা বললো,
আমিও স্টোরি লিখেছি, পাপা অফিস থেকে প্রিন্ট করে বুক বানিয়ে দিয়েছে, আম্মু আলমারীতে
রেখে দিয়েছে। মানে হলো, আমি হেলাফেলার কেউ নই হে। মাহবুব আজীজ ভাই যখন পেপারে লেখা
পাব্লিশ হওয়ার গুরুত্ব বোঝালো, তখন সে অতি উৎসাহে সেখানে বসেই, মাহবুব আজীজ ভাইয়ের
মেইল এড্রেস, ফোন নম্বর নেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি তার প্রোফাইল পিকচার আর ম্যাসেঞ্জার
ও চেয়েছে। খুব ভালবেসেই সব তিনি দিয়েছেন আমাদের রাজাকে। বাড়ি এসেই আমাদের রাজা বেটা,
নতুন খাতা নিয়ে, নতুন উদ্যেম্ নতুন স্টোরি লিখতে বসে গেলো, তারপর এলো আমার কাছে, মিষ্টি
মা, আমি তো ইংরেজিতে লিখছি, কিন্তু আঙ্কেলের ওখানে যে বাংলা লাগবে, আমি বললাম, তুমি
ইংরেজিই লেখো, আমি বাংলা করে দেবো। এখন অবশ্য লেখালেখি শিকেয় তুলে তিনি “টবলা” বাজাচ্ছেন
আর স্মুলেতে গান গাচ্ছেন, তুমি যাকে ভালবাসো
মনে হচ্ছে, ধান বানতে শিবের গীত? হয়ত খানিকটা হয়ত নয়।
যে মানুষটা দশ মিনিটে একটা বাচ্চাকে এতটা প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন, তিনি অবশ্যই
তার লেখা দ্বারা পাঠকদের বিরাট প্রভাবিত করার ক্ষমত রাখেন বই কি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
কোন বই দেবেন, গল্প না উপন্যাস? আমি বললাম, উপন্যাস দেন, আমি পড়তে ভালবাসি, সংশয়ে ছিলেন
যদিও, পড়বো কীনা, তারপর দোনামোনা করে দুটো বইই দিলেন আর আমি প্রায় একটানে দুটো বইই
শেষ করলাম। অবশ্য এই প্রথম যে তার লেখা পড়লাম তা নয়, ফেসবুকে আমি অবশ্যই মাঝে মাঝে
তার লেখা দারুন দারুন কবিতা ও কাব্যিক স্ট্যাটাস পরে থাকি। লেখার কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ
না করলেই নয়, হুমায়ূন আহমেদের মত, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার মানুষ তিনি, অসাধারণ ঝরঝরে সহজ
বাংলা ভাষা, অকারণে জটিল করার কিংবা অলংকার দেয়ার কোন চেষ্টাই তিনি করেন নি। লেখাগুলো
প্রচন্ডভাবে এই সময়ের, সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। কোথাও পড়েছিলাম, যে লেখা সময়কে ধারণ
করে না সে কোন সাহিত্যই নয়। একশো বছর পর যদি কেউ এই গল্পগুলো পড়ে, জানবে, দু হাজার
আঠারো-উনিশে বাংলাদেশে কি হচ্ছিলো কিংবা হয়েছিলো। সাংবাদিকতা যে লেখার কত বস্তুনিষ্ঠ
উপকরণ হতে পারে, এই লেখাগুলো তার আকাট্য দলিল।
প্রথমে, উপন্যাস “পুতুলবাজি”, মূল চরিত্র চারটি, মঞ্জু,
মুনা, ফয়সাল আর আইআর খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করা মঞ্জু এ সময়ের একজন তরুণ যার
চোখ ভর্তি নানা স্বপ্ন আর এই স্বপ্ন পূরনের জন্যে মরিয়া সে। বেছে নেয় সামনে যা আসে
তাই, এর ভাল-মন্দ বিচার করতে সে নারাজ। তার ধারনা তার আপাতত টার্গেট পূরণ হলেই সে অন্যকিছু
বেছে নিয়ে থিতু হবে, শুধু সে জানে না টার্গেটের কোন শেষ নেই জীবনে। আর এ সুযোগগুলো
কাজে লাগায় আইআর খানের মত ব্যবসায়ীরা, রিয়েল এস্টেট, চোরাবাজারী এ ধরনের ব্যবসার কাজে
এসব তরুণদের জীবন উৎসর্গ করে দেন তারা, যখন মঞ্জুরা ফেরত আসতে চায় এই চোরাবালি থেকে
তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। সামাজিক অবস্থানে দুর্বল মঞ্জুর এর পাশে পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
ফয়সালকে বড্ড নির্দয়ভাবে আঁকা হয়েছে, লেখক একটু দয়ালু হতে পারতেন এই ক্ষেত্রে। সাধারণভাবেই
মেয়েরা স্থিতিশীলতা ভালবাসে আর যুগে যুগে বাংলার মেয়েরা দেবদাসকে ভালবেসে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে
ভুবন চৌধুরীর গলায় মালা দেয় বইকি। বইটি পড়তে পড়তে একবারও মনে হবে না কোন বই পড়ছি, ফেসবুক,
ম্যাসেঞ্জার, অফলাইন, অনলাইন, গুম, খুন, সব এভাবে এখানে আনা হয়েছে, এতটা বাস্তবতার
ওপর দাঁড় করানো কাহিনী, মনে হবে সবাই আমাদের চেনা, দেখতে পাচ্ছি এদেরকে আমাদের চোখের
ওপরে। আইআর খানের চরিত্রটি খানিকটা বিভ্রান্তকর লেগেছে, এ ধরনের মনোবৃত্তি আর অস্থিরতা
নিয়ে আসলেই কি অনেকদূর আসা যায়?
এবার, ছোট গল্পের বই, “ঘোর অথবা অনন্ত তৃষার গল্প”, এগারোটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের
আকর্ষনীয় গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে এই বইটি, একবার শুরু করলে হাত থেকে রাখা দুস্কর। আবারও
বলছি সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা পেশাটা অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যায়। মার মার কাট কাট
গল্প চারপাশে ঘোরে, শুধু লেখনীর দক্ষতায় গেঁথে ফেলতে হবে। বইয়ের দ্বিতীয় গল্প “নদীর
পাড়ে বসে থাকি শুধু”, মনিকা বেড়াতে যায় অফিসের কলিগ কাম প্রেমিকের সাথে। তারপর সেখানকার
স্থানীয় নেতাদের হাতে পরে, প্রেমিককে আটকে রেখে, মনিকাকে নির্যাতন করতে করতে তার মৃত্যু।
এরপর স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সব ম্যানেজ করার, প্রেমিককে ফাসিয়ে দেয়ার সেই চিরপরিচিত
গল্প যা বাংলাদেশে আজকাল হয়েই থাকে। কিংবা তৃতীয় গল্প “নিশি”, হিন্দু পরিবার, মফস্বলে
থাকে, প্রথমে স্থানীয় মাস্তানদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয় মেয়েটি তথা পরিবার আর
তারপর যাদের সাহায্যের জন্যে বিশ্বাস করে ডাকা হয়েছিলো তাদের কুৎসিত কদাকার লোভী চেহারার
দর্শন, এ গল্পটাও খুব পরিচিত আমাদের তাই না? এরপর নয় নম্বর গল্পটি ধরি, “কাল ভোরে যখন
কলিংবেল বেজে উঠবে” দরিদ্র নিম্ন মধ্যবিত্ত তার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে হিমশিম খাচ্ছে।
গ্রাম থেকে শেষ সম্বল বিধবা মায়ের বেঁচে থাকার আশাটুকু বিক্রি করে, এ পৃথিবীতে যাকে
সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে তার হাতে তুলে দিয়েছে। এবং সে সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে ফাঁকি দিয়ে
চলে গেছে। তাই হয়ে আসছে চিরদিন আর তাই হয়। বিশ্বাসঘাতকতা সেই করতে পারে যাকে কেউ বিশ্বাস
করেছিলো। এরকম সব হৃদয় নিংড়ানো কাহিনী নিয়ে “ঘোর অথবা অনন্ত তৃষার গল্প”।
সবচেয়ে বেশি টেনেছে আমাকে বইয়ের উৎসর্গ পর্বটি। মা’কে
নিয়ে আমরা অনেকেই লেখি কিন্তু এ ধরনের মন জুড়ানো কাঁচামিঠা সত্যির স্বাদ একেবারেই আলাদা।
কেউ পড়তে চাইলে জানাবেন, আমি ছবি তুলে এই লেখার সাথে যোগ করে দেবো।
যারা চিন্তাশীল পাঠক, যারা নিজের চিন্তা বই পড়ে শান দিয়ে নিতে চান ; এ বই দুটো তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। সত্যের ভেতর যে নির্মমতা লুকিয়ে আছে, এই লেখক হাসতে হাসতে তা আমাদের জানিয়ে দেন। আমরা চমকে উঠি! সত্য এত কঠিন! "।
পার্ফেক্ট জেন্টেলম্যান মাহবুব আজিজ ভাই তার মেহমানদের শুধু উবার ডেকে দিয়ে ক্ষান্ত হন নি, নীচে নেমে এসে গাড়িতে বসিয়ে মেহমান বিদায় করেছেন।
পার্ফেক্ট জেন্টেলম্যান মাহবুব আজিজ ভাই তার মেহমানদের শুধু উবার ডেকে দিয়ে ক্ষান্ত হন নি, নীচে নেমে এসে গাড়িতে বসিয়ে মেহমান বিদায় করেছেন।
২৯/১০/২০১৯