Thursday 29 November 2018

BLOCKADE

টেলিফোনের ওপারে বাবার গলা শুনতে পেয়ে উদ্বিগ্ন সুলতানা আকুল গলায় জিজ্ঞেস করলো, বাবা তোমরা কেমন আছো? ওদিকের কি খবর? সুলতানার প্রশ্ন শুনে বাবা আরও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ফোনটা দিলেন সুলতানা’র মায়ের হাতে। সুলতানা মা’কেও একই কথা জিজ্ঞেস করলো, মা ওদিকে কি খবর? মা’ও নিরুত্তর। সুলতানা টের পাচ্ছে, ফোন আবার হাত বদল হচ্ছে। চারবার ফোন হাত বদল হওয়া পর, সুলতানার মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, চুপ করো তুমি, এই নিয়ে কোন কথা নেই। সুলতানা মায়ের অসহায়ত্ব টের পেলো। পঁচিশে মার্চের ভয়াল খবর পেনিসিলভিনিয়াতে পৌঁছলো উনিত্রিশে মার্চ। এক সন্তানের জননী সুলতানা টিভিতে, অসহায় না খেতে পাওয়া, মৃত্যু ভয়ে ভীত বাচ্চাদের মুখ দেখতে দেখতে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলো, বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে এই অন্যায়ের কথা, এ হয় না, এ হতে দেয়া যায় না। বিভিন্ন জায়গায় তিনি রোজ “একশ”টি ফোন করবেন এই ছিলো তার প্রতিজ্ঞা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তার এই প্রতিজ্ঞা অনেক মানুষের জীবন রক্ষা’র কাজে এলো।

পি।এইচ।ডি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষিকা সুলতানা আলম চেষ্টা করতে লাগলেন প্রবাসী বাঙালি, অবাঙালি বন্ধুদের মধ্যে খবর পৌঁছে দিতে, সচেতনতা তৈরী করতে, তাদের করনীয় ঠিক করতে। অবশেষে জনা পনের মানুষ এক সন্ধ্যায় পেনিসিলভিনিয়ার এক বাড়িতে একসাথে হয়ে শুরু করলেন তাদের যুদ্ধ। প্রথমে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে প্রটেষ্ট, মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা। দেখলেন ব্যানারে তেমন কাজ হচ্ছে না, তারা টিভিতে যেমন দেখেছিলেন, সেরকম জামা কাপড় পরে, সে সব অসহায় ভঙ্গীতে এই ঠান্ডায় রাস্তায়, ঘাসের ওপর শুয়ে থাকলেন। তাতে কিছুটা কাজ হলো। তারপর ঠিক করলেন, হোয়াইট হাউজের সামনে কাগজ দিয়ে সুয়ারেজ পাইপের আদলে বানিয়ে তাতে বসবাস করবেন। যেমন ভাবা ঠিক তেমনই কাজ। ঠান্ডার মধ্যে দুই দিন কয়েকটি পরিবার কাগজের সুয়ারেজ পাইপে থাকার পর হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র তাদের ডাকলেন। মিডিয়া’র অনেকের নজরে আসলো। নিক্সন সরকার, দুইবার করে তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে বাধ্য হলেন। এপ্রিলে একবার তারা জানালেন, পঁচিশে মার্চের পর পাকিস্তানের কাছে তারা কোন অস্ত্র বিক্রি করে নি। জুনে আবার জানালেন, পঁচিশে মার্চের পর তারা পাকিস্তানকে কোন ধরনের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে নি। যদিও কিসিঞ্জার তখন চীন সফর করে চীনকে হাতে রাখতে ব্যস্ত ছিলেন, চীন বরাবরই পাকিস্তানের ভাল বন্ধু।

Quackers ধর্মে বিশ্বাসী রিচার্ড টেয়লার বলেন, যদি সত্যিকারের কোয়েকার হতে চাও, তাহলে তোমাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। ফিলিস টেয়লার আর রিচার্ড টেয়লার দম্পত্তি করাচী বন্দর থেকে যেসব জাহাজ ছেড়েছে বাঙালি আর পাকিস্তানী নাবিকদের নিয়ে, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর জাহাজে অবস্থান করা বাঙালি নাবিকরা ভীত সন্ত্রস্ত দিন যাপন করছিলো। জাহাজ এমেরিকায় এসে নোঙর করার পর ভীত বাংলাদেশি নাবিকরা স্থানীয় মানুষদের কাছে সাহায্য প্রার্থণা করে। এক ব্যাঙ্ক থেকে তাদেরকে টেয়লার দম্পত্তির ফোন নম্বর দেয়া হয়। টেয়লার দম্পত্তি তাদের আরও বন্ধুদের সাথে নিয়ে এক একবার ছয় গাড়ি পযর্ন্ত মানুষদের উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, নিজের হাতে রুটি বানিয়ে, পরিবেশন করেছেন। অনেক নাবিকদের তারা এখান থেকে টিকেট কেটে দেশে পাঠিয়েছেন। নাবিকরা নিরাপদে দেশে ফিরে চিঠি লিখে জানিয়েছেন পরিবারের সাথে তাদের সেসব বেদনাবিধুর আর মধুর মিলন দৃশ্যের কথা। পরিবার ধরেই নিয়েছিলো তারা আর বেঁচে নেই, পাকিস্তানীরা জাহাজেই হয়ত তাদের হত্যা করেছে।

এরকম অমূল্য অনেক বাস্তব ঘটনার সমন্বয়ে আরিফ ইউসুফ তৈরী করেছেন, দু-হাজার সতেরো’র TWIFF এওয়ার্ড বিজয়ী ডকুমেন্টরী “BLOCKADE”. ডকুমেন্টারীর সবকিছু নিয়ে বিশদে লিখতে গেলে, আয়তন অনেক বড় হবে, ফেসবুক-টুইটারের এই অনু-পরমানু গল্পের যুগে কারই বা ধৈর্য্য আছে এত বড় একটা লেখা পড়ার। ধারনা দেয়ার মত করে খুব ছোট পরিসরে এই লেখার অবতারণা। যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ঝরে গেছে সত্যি কিন্তু বিদেশে থাকা অনেক প্রবাসীদের অক্লান্ত চেষ্টায় ও অনেক বিদেশীদের মানবিক সাহায্যে রক্ষা পেয়েছে অন্তত আরও বিশ লক্ষ প্রাণ। বাংলাদেশ অবশ্য এসকল বন্ধুদের মনে রেখেছে এবং তাদেরকে অবদানকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দান করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

আরিফ ইউসুফ যিনি পেশায় একজন আই।টি স্পেশালিস্ট, নিউ জার্সিতে বাস করলেও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশে আই-টি সেক্টরের প্রসারেও কাজ করছেন। পেশাগত কাজের বাইরে তার সময় যায় সত্যের পেছনের সত্যকে খুঁজে বের করতে, তাকে তুলে ধরতে। এই ডকুমেন্টারীটি তৈরী করতে তাঁর সময় লেগেছে আট থেকে নয় বছর। এবং তিনি জানিয়েছেন, এটি তার কাজের শুরু, শেষ নয়। আরও এমন অনেক জানা -অজানা তথ্যের সমন্বয়ে তার নতুন নতুন কাজ দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা। অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো তার জন্যে।

নেদারল্যান্ডসে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রদূত শেখ মোহামম্মদ বেলালকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই তথ্যচিত্রটি আমাদের কাছে তুলে ধরার জন্যে। শীতের এই নিসস্তব্ধতা ভেঙে গরম চা-কফি’র সাথে ছোলা-পেঁয়াজু আর পায়েসের কোলাহল ও আড্ডামুখর একটি অপরাহ্ন উপহার দেয়ার জন্যে দূতাবাসের সকল কূটনীতিক কর্মকর্তাদের ও অশেষ ধন্যবাদ।

২৯/১১/২০১৮

স্ট্যাপহোর্স্ট---দ্যা_আননোউন_স্টোরি

“নেদারল্যান্ডস”– যাদের নিয়ে প্রবাদ আছে, “গড ক্রিয়েটেড দ্যা আর্থ, বাট দ্যা ডাচ ক্রিয়েটেড দ্যা নেদারল্যান্ডস”। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে, সমুদ্র থেকে দেশ রক্ষাই করে নি শুধু, একের পর এক পোল্ডার তৈরী করেছে। পানি সরিয়ে, ভূমি বের করে নতুন নতুন শহর বানিয়ে চলছে, আজও কাজ চলছে, শেষ হয় নি। মানুষ বাড়ছে, সমুদ্র থেকে ভূমি বেশি প্রয়োজনীয়, তারা ভূমি বাড়িয় চলছে। সমুদ্রের পাশের ঐদিক গুলোতে ড্রাইভে গেলে এত ভাল লাগে, মানুষের জয়, বিজ্ঞানের জয়, প্রযুক্তির জয়, হার মানে নি মানুষ প্রকৃতির কাছে, নিয়তি বা ভাগ্য বলে মেনে নেয় নি, থেমে যায় নি তারা।

ছোট এই দেশটিতে হাজার হাজার “এক্সপার্ট” এর আনাগোনা। যদিও এখানে কারখানা বলতে তেমন কিছু নেই, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন, রুটি, ডিম, দুধ, মাংস এগুলো বাদ দিয়ে দিলে ধরতে গেলে বাকি সব আমদানী করা হয় বাইরে থেকে। প্রায় সব ধরনের শিল্প-কারখানাই নিম্ন মজুরীর দেশ, এশিয়া, আফ্রিকা, সাউথ এমেরিকাতে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সাথে সরিয়ে দেয়া হয়েছে আইটি ফার্ম, ফাইন্যান্স এগুলোও। ব্যাঙ্গলোর, পুনে, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড কোথায় নয়, একমাত্র শ্লোগান “খরচ বাঁচাও”। তাহলে এত এক্সপার্ট এখানে কি করে? শুধুই রয়ে গেছে, “রিসার্চ এন্ড ডেভেলাপমেন্ট”, নতুন নতুন প্রযুক্তির পেছনে মরিয়া। তারপরও বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত মজবুত ছোট এই দেশটি যাদেরকে মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া ভার।

এখন কেউ যদি বলে, নেদারল্যান্ডসে একটি শহরতলী আছে যেখানে আজও মানুষ ঔষধে বিশ্বাস করে না, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে না, ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাকে তাদের জীবন চলে। শহরতলী’র গন্ডী ছেড়ে অনেকেই বাইরে বের হয় না। ওর মধ্যেই জীবন কাটায়, কাজ করে, বেঁচে থাকে। আধুনিক সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওরা নিজেদের রাজ্যে নিজেরা আছে নিজেদের মতো। বিশ্বাস করা যায়? গল্পের মতো শোনালেও, গল্প নয়, সত্যি। 

স্টাপহোর্স্ট – একটি গ্রামের নাম যেখানে লোকজন “ঘৃণা করতে ভালবাসে”, তারা তাদের শেকড় আকড়ে ধরে থাকতে পছন্দ করে। আধুনিক ডাচ সমাজ হয়ত তাদের বিভিন্ন রকম সামাজিক ভাতা, সেক্স আর ড্রাগস এর প্রতি উদার মনোভাবের জন্য বিখ্যাত কিন্তু আমস্টার্ডাম থেকে আশি মাইল উত্তরপূর্বে কেউ যদি যায়-সেখানে এক অন্য পৃথিবী। এখানের লোকজন সব ধরনের বীমা, সামাজিক ভাতা আর তাদের ভাগ্যের ওপর হস্তক্ষেপ করাকে প্রত্যাখান করে। টেলিভিশন দেখাকে অধর্মীয় মনে করে, এড়িয়ে চলে।

এই গ্রামের মুখপাত্র ইয়ান উইলিয়াম স্টক বলেন, গোটা নেদারল্যান্ডস জুড়ে স্টাপহোর্স্ট এর এমন একটা ছবি যে সবাইকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। পুরো ডাচ জাতি, সমকামিতা, যন্ত্রণাহীন মৃত্যু, গর্ভপাত সব কিছুর প্রতি উদার শুধু স্টাপহোর্স্ট বাদে। আধুনিক সংশোধিত ডাচ সমাজ থেকে দূরে তিনশ হাজার মানুষ নিয়ে, দ্যা বাইবেল বেল্ট গোষ্ঠী উত্তর ওস্টব্রুঘ এর উর্ক শহরে, দক্ষিন পশ্চিম থেকে একশ বিশ মাইল দূরে, আলাদা একটি সমাজ গঠন করেছিলো। চৌদ্দ হাজার অধিবাসী নিয়ে প্রোটেস্টান্ট ধর্মে অগাধ আস্থা রাখা একটি কৃষিকাজ ভিত্তিক গ্রামের নাম “স্টাপহোর্স্ট”। নেদারল্যান্ডসে বাইবেলে অবিচল আস্থা রাখা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি তারা। এখনো মেয়েদেরকে চাষীদের ঐতিহ্যবাহী লম্বা স্কার্ট, ফুল ছাপা ব্লাউজ পরে মাথায় টুপি লাগিয়ে গ্রামের সাতটি চার্চের সামনে প্রতি রোববারে তাদের ঘরের পুরুষদের সাথে হাঁটতে দেখা যায়।

পনেরশ বাষট্টি সালে একজন খুব ধার্মিক ব্যক্তি লুথেরানিজাম (Lutheranism) এবং কালভিনিজাম (Calvinism) বিশ্বাস এর মাঝামাঝিতে একটি মিশ্র ধর্ম আবিস্কার করেন, যার মূল কথা ছিলো, নিয়তিকে মেনে নিতে হবে, বিশ্বাসীকে ভুগে ভুগে তার সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। আর এই বিশ্বাসের নাম “হাইডেলবার্গ ক্যাটেসিজাম” – যা নিয়ে স্টাপহোর্স্ট এর মানুষ বেঁচে আছে। অন্যান্য দেশের মত ডাচ রাজনীতিতেও ধর্ম বিরাট ভূমিকা রাখে। ডাচ রাজনীতিতে একটি শব্দ আছে “স্টাপহোর্স্ট ফ্যাক্টর”। কট্টরবাদী বিশ্বাসীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদে সবসময় পাঁচ ভাগ আসনে জয়ী হয়। 

স্টক বলেন, বহু বছর আগে অনেক অনেক ডাচ গ্রাম এই রকম ছিলো, এখানে ঐতিহ্য অনেক দিন ধরে চালু রয়েছে কারণ এই গ্রামের অধিবাসীরা সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। গ্রামের বেশীর ভাগ অধিবাসীই পুরনো ঐতিহ্যের কারণে, সরকারের সামাজিক ভাতা নিতে অনিচ্ছুক, সরকারকে কর প্রদানেও তাদের অনীহা। তারা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্যে নিজেরাই অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে। কারো বাড়ি পুড়ে গেলে, প্রতিবেশীরা নতুন বাড়ি বানিয়ে দেয়। কেউ মারা গেলে আত্মীয়রা তার কফিন বানিয়ে দেয়। স্টাপহোর্স্ট এর ঐতিহ্য হলো, একজন কৃষক মারা গেলে তার জমি ছেলেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যেসব ছেলেরা উত্তরাধিকার সূত্রে জমি পাবে না, সে অন্যদের জমির পেছনে নিজের খামার বাড়ি বানিয়ে নেবে। এই কারনে সেখানকার চাষের জমি গুলো খুব সরু আর লম্বা – পনেরশ বাই চল্লিশ মিটার। আদিতে এগুলো একশ পঁচিশ মিটার প্রশস্ত ছিল। এ অঞ্চলের কৃষকেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী লো স্যাক্সন এর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এই গ্রামের বাড়ির জানালা-দরজা সব সবুজ। এখন যে বাড়ি গুলো দেখা যায় তার বেশীর ভাগই আঠারশো পঞ্চাশ সাল থেকে উনিশো দশ সালের মধ্যে তৈরী করা হয়েছিল।

এ গ্রামের অনেক অধিবাসীই ওষুধ খায় না এমন কি টিকাও নেয় না। তারা বিশ্বাস করে অসুস্থতা হলো ঈশ্বরের শাস্তি আর সুস্থতা তার পুরস্কার। উনিশো একাত্তর সালে পোলিও মহামারীর সময় স্টাপহোর্স্ট বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। উনচল্লিশ জন পোলিও আক্রান্ত হয়েছিল যাদের বেশীর ভাগই শিশু। অনেকেই প্রতিষেধক নিতে অস্বীকার করে, পাঁচ জন মারা যায় আর তের জন শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। শতকরা বিশ জন টিকা ছাড়াই রয়ে যায়। WHO স্টাপহোর্স্ট এবং নেদারল্যান্ডসের এ ধরনের কয়েকটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে ঘোষনা করে। ইউরোপের মধ্যে জন্মহার এখানে সবচেয়ে বেশী। মোট উর্বরতার হার (total fertility rate, TFR) এখানে দুই দশমিক সাত, দুই হাজার তিন সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটা চতুর্থ সর্বোচ্চ।

অন্যান্য বাইবেল আশ্রয়ী গ্রামের মত স্টাপহোর্স্ট ও এখন রুপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এই ছবির মত সুন্দর গ্রামের দৃশ্যটি ক্রমশঃ পরিবর্তন হচ্ছে। জমি আস্তে আস্তে দুর্লভ হয়ে উঠছে আর যতই দিন যাচ্ছে তরুণ – তরুণীরা শহরের কল কারখানায় কাজের সন্ধান করছে। দু’বছর আগে গ্রামে একটা চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে, ধর্মীয় শিক্ষা ক্রম হ্রাসমান, এখন বড়রা বাড়িতে ছোটদের এই শিক্ষা দিচ্ছে। চাষীদের ঐতিহ্যবাহী জামা আজকাল কেউ পরে না বললেই চলে। গরমের সময় পর্যটকদের এড়াতে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা থেকে নিজেদের বিরত রাখে। স্টক এর ভাষায়, অন্যান্য সাধারণ গ্রামের মত আমরা এখন শুধুই একটি গ্রাম। শতকরা মাত্র চল্লিশ ভাগ অধিবাসী এখন কৃষক। দীর্ঘ দিনের অধিবাসী শতকরা ষাট জন, আর শতকরা তিন ভাগেরও কম মানুষ এখন অতিরিক্ত ধর্ম বিশ্বাস করে। কিন্তু গ্রামটিকে এখনও ঐতিহ্যই শাসন করে।

উনিশ বছরের কার্লো স্পাইক যে এ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে বড় হয়েছে, তার মতে, একজন প্রকৃত স্টাপহোর্স্টার হতে হলে, তোমার দাদা এবং পর দাদাকেও এই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করতে হবে, নইলে তুমি প্রকৃত স্টাপহোর্স্টার নও। গ্রামের অনেকেই কার্লোকে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আজও অনেক মান্যগন্য করে।


তথ্যসূত্রঃ অন্তর্জাল

বিপ্লব

সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয়,
এই চান্দের রাইতে তোমার হইছে গো সময়
আজ চল্লিশ দিন হয়ে গেলো, এভাবেই দিন গড়াবে মাসে আর মাস গড়াবে বছরে ।
আমাদের মধ্যে তুই প্রথম। হয়ত অনেক ব্যাপারেই তুই প্রথম ছিলি, এম-এস-এন, ইয়াহু। হারিয়ে গিয়েও যে সবার মধ্যে এখনও কিছুটা যোগাযোগ রয়েছে তার কারণটাও অনেক ক্ষেত্রে তুই। একে ফোন দেয়া, তাকে ডাকা, তুইই তো করতি, আমরাও জানতাম তুই করবি।
জীবনটা তারপর অগোছালো হয়ে গেলো, অবশ্য সে আমাদের সবারই। কে আর ঠিকমতো গোছাতে পারলাম বল, গোছানোর চেষ্টা করতে করতে যাওয়ার সময় হয়ে এলো কিন্তু ঠিকমত গোছানোই হয়ে উঠলো না। ওপারে কোন জীবন থাকলে আশাকরি ভাল থাকবি, অন্তত চেষ্টা করিস গুছিয়ে নিতে, ভাল থাকতে।
একসাথে আমরা ষোলজন এস।এস।সি দিলাম, সারা পাড়া গরম, বায়োলজি খাতা আঁকা, নোট দেয়া নেয়া, সাজেশান, কোচিং। নিজের মেয়ের এস।এস।সি দেয়ার সময় হয়ে এলো, অথচ মনে হয়, এই সেদিনের কথা। তোর গাঢ় লাল সোয়েটার, জীন্স এর প্যান্ট, কেডস, সদ্য উঁকি দেয়া গোঁফ। তখন খুব ব্যান্ডের যুগ, ব্যান্ড বানালি, ঐ দূর পাহাড়ে ---- লোকালয় থেকে দূরে ------
অনেকদিন পর তোর চলে যাওয়া উপলক্ষ্যে আমরা বন্ধুরা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বললাম, এমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া। তোকে নিয়ে কথা হলো, নিজেদের কথাও হলো, অসংখ্য উচ্চারণ করা শব্দের মধ্যে যে শব্দগুলো অনুচ্চারিত থাকলো, তা হলো, কাউন্ট ডাউন হ্যাজ স্টারটেড, উই আর অন আওয়া ওয়ে
যারা চলে যায় তারা চলে যায়, পেছনের কথা ভাবে না, যেমন তুই ও ভাবিস নি, তোকে ছাড়া চাচা-চাচী’র দিনগুলো কতটা লম্বা হবে। মেঘকে নিয়ে তোদের বাড়ি গেলে, চাচা দরজা খুলেই হাসি মুখে বলতে থাকতো, মেয়েতো আমার পছন্দ হয়ে গেছে স্বাতী, আমিতো মেয়ে রেখে দেবো। মেঘ এসব রসিকতার কিছুই বুঝতো না, সে শুধু জানতো এই বাড়িতে তার অধিকার অনেক। সে তার ছোট ছোট পা ফেলে, ডাইনীং থেকে খাবার তুলতো, নির্দ্বিধায় ফ্রীজ খুলে দেখতো আর কি কি নেয়া যায়। দিন বাড়ি যায় – চড়ে পাখির ডানায়
দেখা হবে বন্ধু, হয়ত কিছুদিনের অপেক্ষা, চলে যাওয়াই নিয়তি, তবে তোর মত যেনো এক শটে চলে যেতে পারি, কেউ লক্ষ্য করার আগেই, দশ থেকে পনর সেকেন্ডের মধ্যে। তুই চিরদিনই বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা ভালবাসতি, শেষ বিদায়ে সবাইকে পাশে পেয়েছিস, তোর শেষ যাত্রা ছিলো রাজকীয় কিন্তু আমরা যাবো একা একা – কেউ থাকবে না শেষ যাত্রায়
একদিন এই পৃথিবীর কোথাও কোন অস্তিত্ব থাকবে না জেনেও যে রোজ এই বেঁচে থাকা, এর নামই কি জীবন!

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ফুলের মেলা

নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বব্যাপী ‘টিউলিপের দেশ’ বলা হয়, যদিও এই ফুলটি ওদের নিজেদের নয়। এমন নয় যে ডাচরা এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়, ফুলের জন্য ভালোবাসা ওদের হৃদয়ের অনেক গভীরে অবস্থান করে।
এটাকে বিশদভাবে ব্যাখা করতে গেলে প্রথমে আমাদের সতেরশো শতাব্দীর আমাস্টার্ডামের খালের পাশের একটি বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে হবে। একজন ধনী সওদাগর একটি চেয়ারে বসে আছেন, তন্ময় হয়ে আছেন তার ভাবনায়। না, তার ভাবনায় ফুলেল ডিজাইনের কোন দেয়ালপেপার ছিলো না, ছিলো ফুলদানিভর্তি ফুল। যদিও আমরা এখন যে ফুলদানিটা দেখতে পাই সেটির সঙ্গে কিন্তু আগের সেই ফুলদানির কোনো মিল নেই।
যেটাতে ফুল থাকে সেটাতে একটি ফুটো থাকে, রঙ ও ছাঁদে প্রতিটিই আলাদা। আমরা যদি হরেক রঙের মিশ্রণে একটি রঙিন ফুলের তোড়া বলি, সতেরশো শতাব্দীতে এটিই ছিলো সর্বোচ্চ প্রশংসার জিনিস।
তখন থেকে, ফুলের প্রতি গভীর আবেগ ডাচ সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে উঠলো। অনেক ডাচ নাগরিক বাড়িতে টেবিলের ওপর এক গোছা ফুল না থাকলে সে বাড়িটিকে বসবাসের যোগ্য বলে ভাবেন না, এবং অনেকেই বসন্তে আর গ্রীষ্মে বাগানের ফুলের রঙ দিয়ে দঙ্গল না বাঁধিয়ে বিশ্রাম নেন না।
এমনকি কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে, এক গোছা ফুল নিয়ে যাওয়া ডাচদের রীতি, শুধু অনুষ্ঠানে বা জন্মদিনই নয়, ফুল এখানে প্রথাগত, খুবই নৈমিত্তিক ব্যাপার। ডাচরা ফুল নিয়ে একথাটি খুবই বলে, ফুলের বিজ্ঞাপনেও এই স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়।
ফুলচাষের এই নেশাকে অনুশীলন করতে অগুনিত ফুলের দোকানের প্রয়োজন। শুধু ফুলের জন্য এখানে আলাদা বিশেষ বাজার আছে, যদিও আমস্টার্ডামের বাজারটাই পৃথিবীবিখ্যাত কিন্তু উইটরেক্ট বাজারের পরিবেশ ভালো।
বসার ঘরে সাজিয়ে রাখার চেয়ে ফুলচাষের এই সংস্কৃতিতে তাদের উৎপাদন ও ব্যবসায়ী মনোভাব বেশি পরলক্ষিত হয়। ফুলের রাজ্য শাসনকারী উদীয়মান ব্যবসায়ী ও সওদাগররা নিজেরাও বিরাট পুষ্পপ্রেমিক। বিলিয়ন ইউরোর ওপরে ফুল ও ফুলের বীচি চাষের এই বাজারে প্রতি হাজার জনে দশ জন ডাচ নাগরিক জীবিকা নির্বাহ করেন। বেশির ভাগ উৎপাদনের লক্ষ্যই থাকে দেশের বাইরে রপ্তানি। প্রায় পাঁচ দশমিক চার মিলিয়ন ইউরো প্রতি বছর ফুল আর ফুলের চারা বিক্রি করে আয় হয়।
ফ্লোরাহল্যান্ড এর নিলাম হলো এই ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র, এটি ফুলের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিলাম কেন্দ্র। বিশ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় ফুল ও চারার নিলাম হয় এখানে, পাঁচ হাজার চাষীর হাতে উৎপন্ন প্রায় সাড়ে বারো হাজার বিলিয়ন চারা আর ফুল হাতবদল হয় এখানে। বড় স্তুপটি চলে যায় দেশের বাইরে। বলা হয়ে থাকে, সারা পৃথিবীতে যত ফুল ও ফুলের গাছ কাটা হয় তার অর্ধেক কাটা হয় হল্যান্ডে।
আলসমেয়ার এর ফ্লোরাহল্যান্ড হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল বাণিজ্যকেন্দ্র। পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, ফুলের গেঁড় এর মাঠ দেখতে যাওয়া। ষোলশ শতাব্দীর শেষ থেকে নেদারল্যান্ডসে ফুলের গেঁড় উৎপন্ন করা হচ্ছে। পঁচিশ হাজার হেক্টরের বিশাল প্রান্তর রঙ-বেরঙের ফুলের গেঁড় দিয়ে যেনো মোজাইক করা আছে।
সবচেয়ে বেশি ফুলের গেঁড় করা হয় টিউলিপ, লিলি, নার্সিসাস, গ্ল্যাডোলিয়া আর হিয়াসিন্ট দিয়ে। ফুলগুলো ফুটে গেলে, ফুলের মাথাটা যান্ত্রিকভাবে কেটে ফেলা হয়, তাতে করে গেঁড়গুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফুলের গেঁড় রপ্তানি করে প্রায় সাতশো মিলিয়ন ইউরো আয় করা হয়। উত্তর আলকামার শহরের হার্লেম আর লাইডেন হলো গেঁড় চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
সাম্প্রতিক কোইকেনহোফ বাড়িটি- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান। প্রতি বছর মিলিয়নের ওপর পর্যটক আসেন ওখানে। ব্লুমকোরসোতে ফুল দিয়ে নতুন ধরনের বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন প্রতিকৃতি তৈরি করে কার্নিভাল এর মতো শোভাযাত্রা করে নর্ডওয়াইক থেকে হার্লেম যাওয়া এখানের প্রচলিত প্রথা। এধরনের ফুলের শোভাযাত্রা অবশ্য পুরো বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হতে থাকে। ওয়েস্টল্যান্ড- যেটা গ্রীন হাউজ চাষের কেন্দ্র ‘গ্লাস-সিটি’ বলে পরিচিত, সেখানে প্রতি গ্রীষ্মের ‘ভাসমান শোভাযাত্রা’ খুবই প্রশংসিত।
সবোর্পরি, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সারা বিশ্বে নেদারল্যান্ডস ফুলের জন্যে বিখ্যাত। বিশেষ করে টিউলিপ নেদারল্যান্ডসের সবকিছুরই প্রতীক। উনিশো আশি আর নব্বই দশকের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ফুটবলার রুড গুলিত, মার্কো ভান বাস্টেন আর ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড যারা এসি মিলানে খেলতো, তাদেরকে ইটালিতে ‘টিউলিপানি’ কিংবা ‘টিউলিপ্স’ নামে ডাকা হতো।
টিউলিপের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের এই একাত্বতাকে মূলধন করে ডাচ ব্যবসায়ীরা বিশ্বে আধিপত্য গড়তে চান, যেমন বিশ্বজুড়ে হোটেল গোল্ডেন টিউলিপের চেইন খোলা হয়েছে। যদিও, ডাচরা অন্যের আকর্ষণ নিজেরা জাঁকালো ভাবে প্রদর্শন করছে, কারণ টিউলিপ ওদের নিজেদের দেশিয় গাছ নয়, ষোলশ শতাব্দীতে তুর্কীর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে এটি আমদানি করা হয়েছিল।
এমনকি টিউলিপ শব্দটিও টার্কিস টুলব্যান্ড (টারবান) শব্দের অপভ্রংশ হয়ে আমদানি করা হয়েছে। ঘটনাক্রমে, আমদানিকৃত ফুল থেকে ডাচেরা সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নতুন ধরনের টিউলিপের চাষ করেন, যেগুলো সতেরশো শতাব্দীতে টার্কিতে খুব প্রশংসিত হয়।
নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ সত্যিকার অর্থেই প্রাণবন্ত ব্যবসার প্রতিকৃতি হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ষোলশ ছত্রিশ আর ষোলশ সাইত্রিশ সালে এত বেশি গেঁড় উৎপাদিত হয়েছিল যে অনেক মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছিলো এসব করতে গিয়ে। দুর্লভ গেঁড় এর চাহিদা অবশ্য আমর্স্টাডামের খালের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পুরো পৃথিবীজুড়েই আছে।
অনেকের মধ্যে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ইয়ান ফান গোয়েন যিনি চিত্রশিল্পী ইয়ান স্টেইন এবং পোলাশ পোটারের শিক্ষক ছিলেন, তিনিও কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান। এখন আর ডাচেরা এত ঝুঁকির মধ্যে নেই, কারণ পৃথিবীর কোথাও এই সবচেয়ে বড় বাজারের চেয়ে সুলভ দামে ফুল বিক্রি হয় না।  
*মূল প্রবন্ধটি মারটাইন ড্যা রোই এর লেখা ‘দ্য ডাচ আই প্রিজ্যুম’ বই থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে। লেখাটি গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন লেখক। 

বনফুল

১.


আজকাল আমরা “অনুগল্প” কিংবা “পরমানু” গল্পতে খুব অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সময় কোথা আমাদের অনেক বেশি পড়বার? কত কি করার আছে, সময় বড্ড কম। আমরা অনেকে ভাবি ব্লগ কিংবা ফেসবুক আধুনিক সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই ঝরঝরে মেদহীন বর্ননায়, টু দ্যা পয়েন্ট লেখার প্রচলন করেছে। আসলে কি তাই? একটু পেছনে তাকালে ইতিহাস কিন্তু অন্যকথা বলে। বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প পড়তে পড়তে ভাবছি, অধুনা “অনুগল্প” এর পথ প্রদশর্ক তিনি কি? “লিপিকা”য় গ্রন্থিত করা কবিতা গুলো’র জন্যে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “গদ্য কবিতা”র পথ প্রদর্শক বলা হয় তাহলে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নিসন্দেহে “অনুগল্প” এর দিক দিশারী।
আয়তনে হয়ত অধুনা অনুগল্পের কাছাকাছি কিন্তু বিষয়, বর্ননা আর তার শান দেয়া ধার, তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা যেগুলো আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে আজও চরম বাস্তব। অনুগল্পের চেয়ে আয়তনে বড় নয় বটে – এত স্বল্প পরিসরে এত কঠিন বক্তব্য কিংবা বিদ্রুপ বা হাস্যরস অবিশ্বাস্য। আমরা আজকাল এত লেখা পড়ি, হোমফীড ভরা স্ট্যাটাস, নোট, বিভিন্ন সাহিত্যের গ্রুপ কিংবা দৈনিক পত্রিকা গুলোর সাহিত্য পাতাগুলোই ধরি না কেন, রাতে যখন ঘুমোতে যাই, কটা লেখা আমাদের পুরোপুরি মনে থাকে? কিন্তু বনফুল আপনার মাথায় ঘুরবে, ঘুরেই যাবে, আপনাকেও ঘোরাবে, বিশ্বাস হয় না? পড়ে দেখুন তবে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প নিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্যের আলোচনা।
[[[স্বপ্নে আর বাস্তবে, মানুষের আশা আর প্রাপ্তিতে যে অসামঞ্জস্য এবং সেই অসামঞ্জস্য সত্বেও মানুষ যে ভাবী জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলেছে, জীবন-দার্শনিকের কাছ তাও কম হাসির বিষয় নয়। “সুলেখার ক্রন্দনে”র কথা মনে পড়ছে। জ্যোৎস্নামদির গভীর রাত্রে স্বপ্নময় আবেষ্টনীর মধ্যে দুগ্ধফেননিভশয্যায় একটি ষোড়শী তণ্বীকে কাঁদতে দেখে কবিকল্পনায় প্রশ্ন জেগেছে, কেন এ ক্রন্দন? – পুত্রশোক? সিনেমায় না যেতে পারার অভিমান? শাড়ির পাড় পছন্দ করা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মতভেদের পরিণাম? না কুমারী-জীবনের মধুর পূর্ব-রাগের স্মৃতিমথিত বেদনা? অমন চাঁদনীরাতে কৈশোরের সেই অর্ধ-প্রস্ফুটিত প্রণয়-প্রস্থান সহসা পূর্ণ- প্রস্ফুটিত হতে পারে না কি? দূরে “চোখ-গেল” পাখি অশ্রান্ত সুরে ডেকে চলেছে। সম্মুখের বাগানে রজনীগন্ধাগুলি স্বপ্নবিহবল-চারিদিকে জ্যোৎস্নার পাথার! এমন দুর্লভক্ষণে হারানো প্রেমের কথা মনে হওয়া কি অসম্ভব, না অপরাধ? কাল্পনিক যখন এমনি কল্পনার জাল বুনে চলেছেন তখন সুলেখার ক্রন্দনের সত্য কারণটি আবিস্কৃত হল। সুলেখা কাঁদছে দাঁতের ব্যথায়। - কল্পিত সত্যের সঙ্গে বাস্তব সত্যের কত তফাত!]]]


২.

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ, কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক-দাঁত ভাল থাকে। হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এল। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলে শুধু।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষী বউটির ঠিক এই দশা।
বনফুলের “নিমগাছ” গল্পটি পড়তে পড়তে বহুকাল আগে দেখা অর্পণা সেনের সিনেমা, “পরমা” চোখের পাতায় ভেসে উঠল। বলাই থেকে অপর্ণা, বদলায় নি কিছুই, জীবনের কঠিন বাস্তবতার কাছে, সব বিপ্লব কেমন যেনো হার মেনে যায়

Thursday 1 November 2018

মীটু


পৃথিবী জুড়ে ছুটে চলা “মী টু” এর ধাক্কা অবশেষে বাংলাদেশেও লেগেছে। সাহসী কেউ কেউ লিখছেন, তাদের এতো দিনের বয়ে চলা যন্ত্রণার কথা। মেয়ে মাত্রই আমরা জানি, সেসব স্পর্শ, চাহনী, নিপীড়ন, নিগ্রহের কথা। এটা বৈশ্বিক সমস্যা, বাংলাদেশের একার নয়। ছোট সে বয়সে বিশ্ব জুড়ে মেয়েরা, অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেরা এই নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যায় বলেই, এত “এওয়ারনেস” ভিডিও, প্রবন্ধ সমস্ত লেখা হয়, প্রচারণা চালানো হয়। মানুষের মধ্যে বিবেক এবং চেতনা জাগরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ছোটবেলায়, মা ভীষণ পাহারা দিতেন, বকা দিতেন, এদিক গেলি কেন? ও ডাকলেই যেতে হবে, তখন বিরক্ত হতাম, মা এত সন্দেহ করে, পাহারা দেয়, আজ জানি, বিশ্ব জুড়ে মা মাত্রই পাহারা দেয়, সবাই সন্তানের “ওয়েলবিং” নিয়ে কনসার্ণ। বহু বছর আগে এই নিয়ে লিখেছিলাম “সাবধানতাঃ সন্তানের জন্যে”, ফেসবুক ও ব্লগের কল্যানে তখন এই লেখাটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু হায়, এত সাবধানতার পরেও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

প্রতিবার যা হয়, এবারও তাই হচ্ছে, “মী টু” নিয়ে বাংলাদেশে দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে, এক পক্ষ ভিক্টিমদের পাশে আর অন্য পক্ষ ভিক্টিমদের ব্যবচ্ছেদ করছে, তাদের জামা-কাপড়, চাল-চালন, কেনো গেছিলো, এত দিন পরে কেন, এত বছর কোথায় ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ বলছেন, “মী টু” ধরতে গেলে, কারো, বাবা-চাচা-দাদা ও বাদ যাবে না। এই পয়েন্টটাতে অবশ্য আমিও একমত। “মী টু” এই জেনারেশনই থাকা ভাল, বাবা-চাচা-দাদা’দের ধরলে “মী টু-টু দ্যা পাওয়ার টেন” এ চলে যাবে। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি এর সাক্ষী, আমাদের ইতিহাস, যৌতুকের কারণে বউ পুড়িয়ে মারার ইতিহাস, তালাক দেয়ার ইতিহাস, একাধিক বিয়ে করার ইতিহাস, সতীদাহের ইতিহাস। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, কেশব চন্দ্র সেন এরকম হাতের আঙুলে গোনা দু’চার জনকে ছেড়ে দিলে পূর্ব পুরুষদের কারো ইতিহাসই উইম্যান ফ্রেন্ডলি নয়। ধর্মের কাহিনী গুলোও যদি ধরি, সীতার বনবাস, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, দ্রৌপদী’র বস্ত্রহরণ, বিবি মরিয়মের নিগ্রহ, কিংবা বিবি আয়েশা’র (রাঃ) সত্বীত্বের পরীক্ষা কোনটাতেই নারীর গৌরবের কিছু নেই, সবই অবমাননার ইতিহাস।

পয়ত্রিশ বছর আগে পৃথিবীতে “মী টু” কনসেপ্ট ছিলো না। কেউ মুখ খুলতো না। এখনও মুখ খুলে কেউ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। নেদারল্যান্ডসের বেস্ট সেলার লেখক, সাস্কিয়া নোর্ট তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “স্ট্রমবলি”তে তের বছর বয়সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া “মী টু” লিখেছে ২০১৭ সালে। তাতে তার ছেলে তাকে রোজ অপমান করে, মা তাকে ধিক্কার দেয়, কেন লিখতে গেলো এতদিন পরে আবার এসব। পয়ত্রিশ বছর পরে মুখ খুলে যে মানুষটা চরিত্র ব্যবচ্ছেদের সম্মুখীন হচ্ছে দিনরাত, পয়ত্রিশ বছর আগের কথাটা ভাবুন, প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষের বিরুদ্ধে নিতান্ত একজন নাবালিকা যার ধরতে গেলে কোন সহায়-সম্বল কিংবা পরিচয় নেই। বাঘা বাঘা মানুষেরা আজ তাকে যেভাবে পেড়ে ফেলছে তখনকার পরিস্থিতি ভাবুন।

এখন কথা হলো, এত দিন হয়েছে বলে, চির জীবনই একই থাকবে, বদলাতে দেবো না কিছু? বাবা-চাচা-দাদা’রা অন্যায় করেছেন বলে, সব অন্যায় জায়েজ হয়ে যাবে! প্রতিবাদ হবে না? পরিবর্তন চাইবো না? তাহলে আদিম যুগে ন্যাংটো হয়ে থাকা, শিকার করে পশু পুড়িয়ে খাওয়া থেকে, আজ এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ফেসবুকে তর্ক করা কি, পরিবর্তন, বদল না সেই সনাতনতা? “মী টু” বাংলাদেশের জন্যে না, যারা বলছেন, তারা কোন সোশ্যাল প্যারামিটারে সেটা মেপে বলছেন, সেটা অবশ্য জানাননি। আইফোন টেন এক্স, বিএমডব্লু গাড়ি, লিভাইস এর জীন্স, কেভিন ক্লাইন এর টি শার্ট, মাইকেল কোরস এর পার্স সবই বাংলাদেশের জন্যে শুধু সামাজিক কোন পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্যে নয়! মজার তো বটেই। সামাজিক পরিবর্তন বাংলাদেশের বাইরের সারা পৃথিবীর জন্যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের মত বাংলাদেশ যে কোন পরিবর্তনের আওতামুক্ত থাকবে।

আলোচিত “শাজনীন” হত্যা’র ঘটনা হয়ত আমরা অনেকেই ভুলে যাই নি। গুলশানে নিজের বাসায়, নিজের ঘরে খুন হয়েছে শাজনীন। শাজনীন রাত পোশাকেও ছিলো না, বাইরেও যায় নি কাউকে প্রলুব্ধ করতে, যারা মেয়েদের চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করতে ব্যস্ত, দয়া করে জানান, শাজনীন এর “মী টু’ এর ব্যাখা কি হতে পারে? তাসলিমা মুন শেখ তার “পাথরনদী কথন” বইতে লিখেছেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার সময়, পরিচিত এক পরিবারকে রূপাদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়, তাদের মেয়েটির পরীক্ষা, তাদের কোথাও থাকার জায়গা নেই এই কারনে। রূপা’র সাথেই মেয়েটি রাতে শুয়েছে, সেই বিছানায়, আশ্রিত সেই মেয়েটির ভাই, বোনের পাশে শুয়ে থাকা, ঘুমন্ত রূপার গায়ে হাত দেয়। এই “মী টু”র ব্যাখা জানতে চাই। রূপা সালোয়ার-কামিজ পরেই শুয়েছিলো, কোন উত্তেজক রাত পোশাকে নয়। কুঙ থ্যাঙ লিখেছেন, তার পরিচিত বোনটি এপেন্ডিসিটাইস এর অপারেশনে বিছানায় শুয়ে, স্যালাইন হাতে, প্রতি রাতে তাকে ইন্টার্নী ডাক্তারদের হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে হাসপাতালে, সেই অসুস্থ মেয়েটি কি কি পন্থা অবলম্বন করে ইন্টার্নী ডাক্তারদের তার দিকে আমন্ত্রণ করেছিলো কে জানে। “মী টু” এর ব্যবচ্ছেদকারীরা এর ব্যাখা দিতে পারবেন। অজস্র এরকম উদারহণ লিখতে পারবো, কিন্তু দরকার আছে কি? আমরা কি নিজেরাই জানি না, নিজেদের কথা?

“মী টু” এর দরকার আছে কি নেই, সেটা সময় বলে দেবে। এক সময় পৃথিবীর কোন প্রান্তেই মেয়েরা স্কুলে যেতো না, চাকুরী করতো না, দশ চড়ে রা করতো না, কিন্তু প্রয়োজন সব বদলে দেয়। “মী টু” এর চেয়েও শক্ত কোন ঝড় সময়ের প্রয়োজনেই হয়ত তৈরী হবে। আমরা চাই কিবা না চাই। তাই বরং সমস্যাকে ঢেকে না রেখে, চলুন সেটাকে স্বীকার করে নিয়ে, সমাধানের দিকে কিংবা নিদেনপক্ষে পুনরাবৃত্তি রোধের কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সেই দিকে সবাই হাতে হাত ধরে আগাই। কথায় আছে, “সমস্যা চিহ্নিতকরণ” সমাধানের দিকে আগানোর প্রথম পদক্ষেপ।

সবশেষেঃ বাংলা ব্যাকরণ পড়েছিলাম, “যিনি রাজা তিনিই ঋষি” – এই লাইনটির সাথে অবশ্য চলমান “SAD” বিতর্কের কোন সম্পর্ক নেই।


তানবীরা
০১/১১/২০১৮