Monday 30 May 2016

মাছরাঙা টিভি আর জিপিএ কান্ড




ফেসবুকে আজকে সারাদিন গেলো জিপিএ ফাইভের ভিডিও’র তোলপাদেখে। অনেকেই দেশের পড়াশোনার মান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে স্ট্যাটাস লিখেছেন। আবার অনেকেই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, এথিক্স, সাংবাদিকতার নীতিমালা নিয়ে লিখেছেন। আমি ভাবছি সমস্যাটা কী আজকের? নাকি ফেসবুক হওয়াতে সমস্যা ডিটেক্ট করা সহজ হয়েছে আমাদের জন্যে? নাকি সাংবাদিক করাতে কাজটি অন্যায় হয়েছে, নিজেরা করলে ঠিকাছে?

নিজের এস।এস।সি, এইচ।এস।সির এর রেজাল্টের কথা ভাবছি। যেদিন রেজাল্ট বের হতো, কখনো কথা না বলা প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের বাবা মা, বাবা মায়ের বন্ধুরা কে না রেজাল্ট জানতে চাইতো। বেশীর ভাগই যাই রেজাল্ট হোক না কেন, শুভেচ্ছা জানাতেন, অনেকে আবার তার নিজের কে কে আমার থেকে কতো বেশি ভাল করেছে তার লম্বা ফিরিস্তি দিতেন। এ ছাড়া দু চার জন অতিরিক্ত শিক্ষিত, দায়িত্বশীল, পাকনা মুরুব্বী অবশ্যই থাকতেন, যারা এস।এস।সির রেজাল্ট শোনার সাথে পাস কোর্সে পড়ানো হবে, এমন সব ঐতিহাসিক ঘটনার প্রশ্ন, এনসাইক্লোপেডিয়া, এন্টার্কটিকা জাতীয় বানান, ট্রান্সলেশান, বাগধারা, সাধারণ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে দিতেন। মুখের ওপর প্রমান করে দিতে চাইতেন, কত কম জেনে আমরা সত্তর পচাত্তর ভাগ নম্বর নিয়ে পাশ করেছি, আমাদের বয়সে তারা কত বেশী জানতেন। আমি অবশ্য ফাইটার ছিলাম, চিঁ চিঁ গলায় বলার চেষ্টা করতাম, এগুলো তো সিলেবাসে ছিলো না, তখন আর এক দফা অপমান, সিলেবাসের বাইরে বোকা গল্পের বই পড়ে এতো সময় নষ্ট করছি, কাজের বই পড়লে কতো কাজ হতো। আত্মীয়দের অপমান শেষ হলে শুরু হতো বাবা মায়ের রোষ। কেন গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে পরে থাকি, জ্ঞানের বই পড়ি না। আমি জানি, আমার মত এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমাদের সময়ে আরো অনেকেই হয়েছে।

এটাতো আজকের অসুখ না। মুখের ওপর অপমান করা বাংলাদেশীদের চিরন্তন রোগ বরং ওটা না করতে পারলেই তাদের কষ্ট লাগে। সেটা ছেলে মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট হতে পারে, মেয়ের বিয়ে নিয়ে হতে পারে, ছেলের চাকরী কিংবা কোরবানীর গরু নইলে ঈদের জামা। বাড়িতে ঢুকেই প্রথম প্রশ্ন হতো, তোমার রোল নম্বর কত? ক্লাশে কয়জন ছাত্র? আজকে এতো নীতির কপচাকপচি, এতো তাড়াতাড়ি আমরা বদলে যাবো! আমি হলফ করে বলতে পারি, আমাদের জেনারশানের আমরা এ অপমান খেয়েই বড় হয়েছি।


প্রতিবার বইমেলাতেও টিভি ক্যামেরা সাথে নিয়ে এই ফাজলামোটা করা হয়। বেশ অনেক আগেই লিখেছিলাম এই নিয়ে। লেখার লিঙ্ক http://www.amrabondhu.com/tanbira/6355

Thursday 26 May 2016

মানুষ মানুষের জন্যে



বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রয়াত লেখক ডঃ হুমায়ূন আহমেদের লেখা “হিমু” উপন্যাসটা প্রথমে ভাল লাগলেও শেষের দিকে আর সিরিজ গুলো পড়তে কোন আগ্রহ পেতাম না। একই রকম লাগতো অনেক সময় মজার পরিবর্তে কিছুটা ছ্যাবলামোও মনে হতো। তবুও তাতে লেখা একটা বিষয় বারবার মাথায় আসে। “হিমু”র বাবা হিমুকে (হিমালয়) মহামানব তৈরী করতে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন, বইটিতে বার বার ঘুরে ফিরে লেখক লিখেছিলেন। ট্রেনিং দিয়ে কী মহামানব তৈরী করা যায়? আজকাল মনে হয়, মহা মানব তৈরী করা না গেলেও হয়তো, মানুষ অনেকটাই বানানো যায়।

এদেশের বাচ্চাদের কে প্লে স্কুল থেকে হাতে বানানো জিনিস এবং সেবা প্রদানের মাধ্যমে টাকা অর্জন শেখানো হয়। স্কুলে জিনিস বানিয়ে, স্কুলেই বিক্রি করে, স্কুলেই সেই টাকা কোন মহৎ কাজের জন্যে দান করা হয়। সেই দান বেশীর ভাগই সময়ই যায় তৃতীয় বিশ্বের কোন দরিদ্র দেশের কোন সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে। চার বছর বয়স থেকেই তাদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক কাজেও বাধ্যতামূলক ভাবে অংশ গ্রহন করতে হয় বারো বছর বয়স থেকেই শেখানো হয়, পড়াশোনা করছো ভাল কথা, সে তো নিজের জন্যে, মানুষের জন্যে, দেশের জন্যে, দশের জন্যেও কিছু করো জানো, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে নিজের দেশে দরিদ্র, নিপীড়িত, সাহায্য প্রার্থী নেই তাহলে অন্য দেশে যাও কিন্তু জীবনে সত্যি কিছু করো।

ক’দিন আগে আমাদের বাসার কাছের হাই স্কুলের পরিকল্পনা জানলাম, পেরুতে বাড়ি বানাতে হবে, সেখানে অনেকের বাড়ি নেই। প্রথম ক্লাশ থেকে পঞ্চম ক্লাশ পর্যন্ত সবাই সে জন্যে পয়সা যোগাড় করবে। ষষ্ঠ মানে ফাইন্যাল ক্লাশের বাচ্চারা যাবে বাড়ি বানাতে। তারা সত্যি সত্যি ইট, কাঠ জোড়া দিয়ে, নিজেরা গায়ে গতরে খেঁটে বাড়ি বানাবে সেখানকার দুস্থ গরীব লোকদের জন্যে। ফেসবুকে গ্রুপ বানিয়ে সেখানে কর্মরত বাচ্চাদের ছবি, কাজের অগ্রগতি সব জানানো হচ্ছে ছবি দিয়ে, পোস্ট দিয়ে।

টাকা কীভাবে যোগাড় করবে? প্রত্যেক কে  নিম্নে ত্রিশ ইউরো যোগাড় করতে হবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেটি শুরু করবে নিজের পকেট মানি দিয়ে নিজের পকেট মানির পর বাবা মা, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, চেনা জানার মধ্যে থেকে নিতে হবেতার জন্যে ক্লাশে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, কেউ দিতে না চাইলে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না, তাকে বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দিয়ে, মাথা নীচু করে চলে আসতে হবে। টাকা দেয়া প্রত্যেকের ইচ্ছে, কাউকে জোর করা যাবে না। তারপর গ্রুপ করে দেয়া হয়েছে ক্লাশ থেকে, স্কুলের সীমানা থেকে প্রত্যেকটি বাচ্চা একেক দলে ভাগ হয়ে আট দশমিক এক কিলোমিটার হাঁটবে, এই পথের মধ্যে যত বাড়ি, পথচারী পরবে তাদের কাছে তাদের পিগি ব্যাঙ্ক বাড়িয়ে ধরে সাহায্য চাইবে। স্কুলে যেয়ে পিগি ব্যাঙ্ক খুলে টাকা গুনে দেখা হবে।

বারো থেকে আঠারো, প্রতি বছর তাদেরকে একবার এ ধরনের কিছু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও, এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি থাকবে, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে তুমি কী করেছো? যার কারণে দেখা যায়, মেধাবী সব ছেলে মেয়েরা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের অনেক প্রকল্পে, উন্নয়নের কাজে নিজের মেধা আর পরিশ্রম ব্যয় করছে। স্বার্থপরের মত শুধু নোট মুখস্থ করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবে, ভাল চাকরি করে দামী গাড়ি হাঁকাবে এর নামই কী তবে মানব জীবন? সমাজের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, সেটাও জানতে হবে, শিখতে হবে না? কে সে শেখাবে তা? হ্যাঁ রাষ্ট্র ... তার দায়িত্ব নিয়েছে।

মানুষ বানানোর মত আবার স্বার্থপর অমানুষও বানানো যায়। আমাদের দেশের বাচ্চাদের ছোট থেকে শেখানো হয়, বাড়িতেও তোমার কোন কাজের দরকার নেই, তুমি শুধু পড়বে আর রেজাল্ট ভাল করবে কারণ বড় হয়ে তোমাকে অনেক টাকা রোজগার করতে হবে। হয়তো বাড়িতেই সেই বাচ্চাটার সম বয়সী আর একটা বাচ্চা আছে যে তার সব কাজ করে দিচ্ছে। সেই বাচ্চাটিকে অবহেলা করে নিজের কাজে ব্যবহার করতে সেই বয়স থেকেই তাকে শেখানো হয়ে যায়। অন্যেকে টেক্কা দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার এই নিম্ন মনোবৃত্তি নিজ পরিবার থেকেই বাচ্চারা প্রথম শেখে। কাউকে সাহায্য করবে না, খেলা ধূলা, গান বাজনা ইত্যাদি করে সময় নষ্ট করা যাবে না। বি।সি।এস দিতে হবে, বিদেশ যেতে হবে, নিজের ক্যারিয়ার, নিজের ভবিষ্যত সব সব নিজের নিজের নিজের জন্যে

না স্কুলে না পরিবারে না সমাজে বাচ্চাদের কোন সুযোগ আছে, পরের জন্যে কোন কিছু করার। তারা কাউকে করতে দেখে না, তারা জানে না “পরের কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি” কী বস্তুর নাম। এই নেতিবাচক মনোবৃত্তির ফল আজকের এই অস্থির সমাজ। স্বার্থপর সমাজে রোজ নানান ঘটনা ঘটে চলছে, কেউ তা সামাল দিতে পারছে না, নাভিশ্বাস উঠছে সবার। মগজে পচন ধরেছে তাই সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। গত চল্লিশ বছর ধরে যে দিকে সমাজের মানসিকতা দৌড়েছে, আজ তারই ফল সবাই ভোগ করছি। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সবাই শক্ত করে ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। নৈতিকতা তো নেই কোথাও ধর্ম যদি রক্ষা করে এই সমাজকে। ধর্ম না কর্ম মানুষের পরিচয় নির্ধারন করবে?

পাদটীকাঃ ধর্মহীন রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসে কয়েদীর অভাবে কয়েকটি জেল বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকবার নিউজে এসেছে আর বাংলাদেশে যত অপরাধী জেলে আছে তার চেয়ে কয়েক গুন বেশি বাইরে খোলা হাওয়ায় ঘুরছে

পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল !
 মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো
কাজী নজরুল ইসলাম





Thursday 19 May 2016

জার্ণাল মে ২০১৬

১. আজকাল কথায় কথায় লোকে ফতোয়া দিচ্ছে, রাষ্ট্রদোহী-নাস্তিক! নাস্তিকরা কী রাষ্ট্রদোহী? রাস্ট্রের প্রতি আনুগত্য থাকতে হলে কী ধর্মপ্রাণ হতে হবে? নাস্তিকতা কী তাহলে রাষ্ট্রদোহীতার শামিল? কোন প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস না রাখা কী তাহলে বাংলাদেশের সংবিধানে অপরাধ? সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে আছে এটি? বেগম রোকেয়া, রাজা রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমেদ শরীফ, আহমেদ ছফা, হুমায়ূন আজাদ, অজয় রায় তারা কি তবে অপরাধী? তারা দেশদ্রোহী হলে তবে দেশ প্রেমিক কারা?

২. মাইকে ঘোষনা দিয়ে, নামাজ, জানাজা, কিংবা বন্যা দুর্গতদের সাহায্য, ঘূর্ণি ঝড় আক্রান্তদের সাহায্য, আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষকে সাহায্যের জন্যে ডাকা হলে কেউ আসে না। শুধু আসে যেখানে লাঠি সোটার কারবার আছে। অথচ আমি হলফ করে বলতে পারি, আজ যদি এমেরিকা, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানী, নেদারল্যান্ডস বলে, বাংলাদেশ থেকে আমরা নাস্তিক কিংবা হিন্দু – খ্রিস্টানদের নিয়ে আসবো, পাকা পায়খানা মানে রাজনৈতিক আশ্রয় দিবো দেখা যাবে এই সব মাইক ওয়ালা মুমিন বান্দারা, লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরে, বাবা – দাদার পরিচয় বদলে সবার আগে নাস্তিকের সার্টিফিকেট নেয়ার লাইনে এসে দাঁড়াবে ... জান বাজি রেখে নাস্তিক সাজার হুল্লোড় লেগে যাবে। বেহেস্তের মায়া পকেটে রেখে পশ্চিমের মায়ায় দৌড়াতে থাকবে

৩. বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষা করতে শেখ পরিবারের পরে সবচেয়ে যোগ্য হলো ওসমান পরিবার,  তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইসলামের মত দুর্বল বস্তু, আল্লাহ নিজে রক্ষা না করে তাদের হাতেই ছেড়ে দিলেন কেন সেটাও বোধগম্য নয়। ওসমান পরিবারের সাথে শেখ পরিবারের গিরিঙ্গিটা ঠিক কোথায়, পরিস্কার হচ্ছে না। পার্সেন্টেজের সমস্যা? আপায় বিদেশ গেলো আর হুড়মুড় করে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীরা একে একে ন্যায় আর নীতির বাক্য আওরাতে শুরু করলো! ঘটনা কী, এতো দিন এতো নৈতিকতা আর্দশ কোথায় তেল নিতে গেছিলো! পুরাই, ডি।এম।কে।কে কেস

৪.  আইভি আপা কী নারায়নগঞ্জে নাই? ঢাকায় নাই? বাংলাদেশে নাই? পৃথিবীতে নাই? মহাবিশ্বে নাই?

৫.  ধর্ম ব্যবহার তো সবে জমতেছে ...খেলা আর বহুদূর যাবে। নাস্তিকের কল্লার পরও আরো কল্লা আছে ... এই কল্লা  নিয়ে যাবে সেই কল্লার কাছে

২০/০৫/২০১৬


ব্লগারের দুরন্ত চোখে যেভাবে বাঁধা হল লাল কাপড়

প্রবাসের একাকিত্বে তখনও পুরো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি, পরিবার-পরিজন, বন্ধু, আড্ডা, সর্বোপরি ঢাকার দূষিত হাওয়ার অভাব তখনও খুঁজে ফিরছি। অন্তর্জালের আশীর্বাদে এ সময়ের আশ্রয় ছিল পাল টক, দেশি চ্যাট ইত্যাদি ভয়েস আড্ডা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রবাসী আর দেশিরা এক সাথে হয়ে, গান, কবিতা, আড্ডা কী না ছিল সেখানে। 
তখনও ওয়েবজিনে লিখি মাঝে মাঝে, পড়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেন, সেগুলো মেইলে আসে। সে সময় সামহোয়্যার ইন যাকে আমরা সামু বলি নিয়ে এল বিপ্লব। নিজে লিখে নিজেই পোস্ট করা যাবে, অন্যেরা পড়ে তার নিচে সরাসরি মন্তব্য করতে পারবে, কোনো সম্পাদক কিংবা কাটাছেঁড়ার ব্যাপার নেই— যাকে বলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন। ব্লগ শুরু হতে না হতেই বিস্তর ভিড় হল সামুতে। তারপর আস্তে আস্তে সচলায়তন, আমার ব্লগ, চতুর্মাত্রিক, আমরা বন্ধু, নাগরিক, নির্মাণসহ আরও কত কী। ওয়েবজিনের প্যাটার্ন পরিবর্তন করে মুক্তমনা, সদালাপও ব্লগে রূপান্তরিত হল।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঘা বাঘা প্রসিদ্ধ সাংবাদিক লেখকরাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন— ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, প্রয়াত লেখক মুহাম্মদ জুবায়ের, আহমাদ মোস্তফা কামাল, পাপড়ি রহমান, শওকত হোসেন মাসুম ইত্যাদি আরও অনেকে। যখন তারা আমাদের মতো সাধারণদের ব্লগ পড়ে, বানান, বাক্যরীতি, গঠন ইত্যাদি নিয়ে উপদেশ দিয়ে যেতেন, সাত আকাশে উড়ে যাওয়ার আনন্দে ভাসতাম। 
প্রায় সবই ছিল লেখকদের সবার নিজের জীবনে প্রত্যহ ঘটে যাওয়া ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স। বানানো গল্পও নয়, ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়, যা পড়তে ভাল লাগলেও আজকের সময়ে অচল। এ সময়ে ঘটছে, ঘটে যাওয়া রোজ দিনের সব গল্প। সত্য আর বাস্তবের নির্মোহ বিশ্লেষণ ব্লগকে তরুণ প্রজন্মের কাছে এত দ্রুত এত তুমুল জনপ্রিয় করেছে। কত শিখেছি, কত জেনেছি, কত পড়েছি। সেসব বাছাই করা লেখা দিয়ে বানানো হতো ই-বুক। শোভা পেত সে সব ই-বুক নিজের ল্যাপটপের ডেস্কটপের এক কোণায়।
প্রকাশকরাও চোখ রাখতে শুরু  করল ব্লগের পাতায়। বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার সব লেখা লিখছেন একঝাঁক তরুণ মুখ যাদের মধ্যে ভণ্ডামি নেই, নেই মোহ। তারা জয়ের আনন্দেই লিখে চলেছেন। আমাদের মতোই আনকোরা কোনো ব্লগারের বই বের হলে আনন্দে আমাদের মধ্যে শোরগোল পরে যেত। এসএসসি’র সময় পাশের বাসার ভাইয়া ভাল রেজাল্ট করলে যেমন নিজের মধ্যেও পড়াশোনার অদম্য উৎসাহ চলে আসত, অনেকটা সেরকম। সাথে ছিল নানারকম সমাজসেবা ও সচেতনতামূলক কাজ— ব্লগাররা মিলে টাকা উঠিয়ে, শীতার্তদের বস্ত্র বিতরণ, রাজাকারদের বিচারের দাবি, যার সাম্প্রতিক আন্দোলন ছিল গণজাগরণ মঞ্চ। 
সেই একঝাঁক দুরন্ত ব্লগারদের চোখে বাংলাদেশের অযোগ্য শাসকশ্রেণি, আর ক্ষমতালিপ্সু শাসনব্যবস্থা বেঁধে দিল লাল কাপড়। ‘ব্লগার’ শব্দটি এখন ক্ষমতাসীনদের অসীম ক্ষমতার দাপটে, খুব নেতিবাচক কিছু, যাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। অকার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে কেউ লিখছেন শুনলেই অন্যেরা বাঁকা চোখে তাকায়। সেই চোখের তিন রকম অর্থ হয়—
১. ব্লগার নয় তো আবার
২. আপনাকে দেখে তো বোঝা যায় না আপনি ব্লগার
৩. আপনাকে দেখে কোনোদিন বুঝতেই পারিনি, আপনি ব্লগার
রূঢ় বাস্তবতা থেকে বিরাম নিতে যে পরিচয়টি সবচেয়ে ভালবাসার আর আনন্দের ছিল, সেটিই এখন বেদনার নীল ছোঁয়া দিয়ে যায়। 
সমাজে ব্লগারদের দুষ্কৃতকারীর ইমেজ তৈরি করে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাব কী করে? প্রতিকার চেয়ে লাভ নেই সে আমিও জানি। কিন্তু পরিত্রাণ, তাও কি পাবার উপায় নেই?
http://www.banglamail24.com/news/152100
১৮-০৫-২০১৬

Monday 16 May 2016

সরকারী কর্মচারী আর মন্ত্রীদের বেতন কী হালাল

যে কাজ দায়িত্ব নিয়ে করার জন্যে কেউ শপথ গ্রহন করে জনতা আর সৃষ্টিকর্তার কাছে ওয়াদা করে তারপর কাজটি সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন না করে দিনের পর দিন জনতার করের পয়সায় তার বেতন নেয়, সেই বেতন নেয়াটা কি হালাল?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজের তালিকায় কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ন্ত্রণ পরে না? প্রতিদিন দেশ জুড়ে এতো যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে তার দায় কার? অবশ্যই তার। কারণ কে কি কোথায় করেছে, ঘটনাটি ঘটে যাবার পর তা সম্বন্ধে তাৎক্ষনিক ভাবে তিনি আমাদেরকে তথ্য জানিয়ে দেন। সবই যদি তিনি জানেন তাহলে ঠেকান না কেন? পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে যারা এ সকল বিচ্ছিন্ন ঘটনা রোধ করার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে তারপর সেগুলো প্রতিরোধ না করে দায়িত্বহীনের মত নির্লজ্জ বক্তব্য দেন তাদের সম্বন্ধে জনতার কাছে জিজ্ঞাসা, তাদের বেতন কী হালাল? প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী কে ইসলামে কী বলে? জনগনের করের টাকায় বেতন নিয়ে তাদের জানমাল হেফাজত করার ওয়াদা দিয়েছিলেন তারা, একের পর এক খুন হচ্ছে যারা, তাদের টাকায় নেয়া বেতন কী হালাল রুজি?

ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানতদারী মানুষের কল্যাণমুখী গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তা সত্যবাদিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আল কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তির পরিচয় ও গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেন: এবং যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। (সূরা মুমিনুন-৮) নেক বান্দা ও নেক আমলের আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : এবং প্রতিশ্রুতি দিলে তারা পূর্ণ করে। (সূরা বাকারা-১৭৭) ইসলামে প্রতিশ্রুতি পালন বাধ্যতামূলক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন : এবং তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে, প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তোমাদের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা বনি ইসরাইল-৩৪)


নৈতিকতা, বৈধ এ শব্দগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আজ অচল। ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার এ জিনিসগুলো হালাল ধরে নিয়েই বাকীটা জিজ্ঞেস করছি, ওয়াদা করে ওয়াদা পালন  না কারীর রোজগার কী হালাল হয়?


১৬/ ৫/২০১৬

Wednesday 11 May 2016

অনন্ত স্মরণে

রাজীবের পর “অন্ধকারের পানে যাত্রা” মিছিলের শুরু হলো অভিজিৎ রায়কে দিয়ে, তারপর পিপীলিকার সারির মত একজনের পর একজন, একটা ধাক্কা কাটতে না কাটতেই আর একটা, মৃত্যুর মিছিল শেষ বেলার ছায়ার মত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো, প্রতিদিন এখনো মিছিলে নতুন নতুন নাম যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরিচিত মুখ গুলো, ফেসবুকের পোস্ট, ব্লগের মন্তব্য থেকে “রিমেমবারিং” এ চলে যাচ্ছে। আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা প্রতিটি মৃত্যুর জন্যে ঘাতককে নয়, নিহতকেই তার নিজের খুন হবার জন্যে দায়ী করে দিচ্ছে। তাদের পছন্দ মত “হত্যার কারণ” জনগণের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, মৃত্যু গুলোকে জনগণের সহ্য সীমার মধ্যে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যারা হত্যা করছে কারণ তারা বলছে না, বলছে তারা যাদের এই প্রাণ গুলো রক্ষা করার দায়িত্ব ছিলও। নিজের অপারগতা ঢাকতে কী নির্লজ্জতা। একদম যে সফল হচ্ছে না, তাই বা কী করে বলি? এখন কি আগের মত হঠাৎ পানি ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে যাওয়া মাছের মত ছটফট করি? না, শুধু খবরের কাগজ খুলে চুপচাপ জেনে নেই, কে গেলো আর কখন গেলো, এই তো। ঢাকার জ্যাম মানিয়ে নেয়ার মত আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের স্নায়ু, এই নৃশংসতার মধ্যে।  বরং নিজের অজান্তেই যেনো আজকাল অপেক্ষা করি, আজকে ক’জন, কোথায়, কে কে? 

লিখতে চাইছিলাম অনন্তকে নিয়ে, কত কিছুই তো লিখতে চাই কিন্তু লিখতে বসলে নীরব যন্ত্রণায় শব্দ গুলো হারিয়ে যায়। মুক্তমনায় ওয়েব সাইটের বাইরেও যখন ইয়াহু গ্রুপে আমরা আলোচনা করতাম তখন থেকে অনন্তের সাথে পরিচয়। বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা সবাই যার যার মতামত লিখতাম, তর্ক করতাম, যুক্তি দিতাম, ঝগড়াও করতাম। নিজেদের যুক্তির ভুল ত্রুটি, দুর্বলতা সেসব নিয়েও মন্তব্য, প্রতিমন্তব্য চলতো। যদিও কখনো সামনা সামনি বসা হয় নি চায়ের কাঁপে ধোঁয়া উড়িয়ে, তারপরও ...
আজও আমি জলের নীরবতায় কান পাতলে শুনতে পাই, কার্পাস তুলোর মত নরম সে গলা,  মুঠোফোনের ওপার থেকে বলছে, দিদি, দাদা আর মেয়েকে নিয়ে একবার সিলেট ঘুরে যান, প্লিজ। কিংবা ঠিকানাটা দেন দিদি, যুক্তির কয়েকটি কপি পাঠাবো। 
আমি পয়সা কী করে পাঠাবো অন্তত? পয়সা লাগবে না, আপনি ওখানে বিলি করবেন। 

-কার কাছে বিলি করবো অনন্ত! 
-আপনার বন্ধুদের মাঝে
-কেউ যুক্তির কথা শুনতে চায় না অনন্ত 
শুনবে দিদি, শুনবে। আমাদেরকে চেষ্টা করে যেতেই হবে। 
এতো পড়াশোনা, এতো জানতো অথচ কী বিনয়ী, কী নম্র গলা তার। কথা ছিলো, সিলেট গেলে একবার নিশ্চয় দেখা হবে, অনেক অনেক কথার মত, নাদের আলী, এ কথাটিও আমার রাখা হয় নি। রাখা হবে না আর কোন দিন, আমাদের জীবন আমাদেরকে এ সুযোগ আর কখনো দেবে না। 

এই মানুষ গুলো নিজের জীবন তুচ্ছ করে দিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে, একবার নয়, বার বার দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এদের হত্যার প্রতিবাদে সেভাবে ক’জন রাস্তায় নেমেছে? মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে সে সময়ের অসহায়তা  আজ অনুভব করতে পারছি। “ধর্মনিরপেক্ষতা” ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ভিত্তি। সে সময়ও ধর্মের নাম দিয়ে বাঙালিদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে, হত্যা গুলোকে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করার জন্যে বার বার ধর্মের কারণ দেখানো হয়েছে। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ধর্মের নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেছিলো এই ব্লগাররা। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তপ্রাণ মানুষের পরিবারের দাবীর সাথে তারাও গলা মিলিয়েছিলো। আজ যখন তারা বিপদে, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার গুলো থেকে তেমন প্রতিবাদ চোখে পরে কি? অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানই তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় আছে, তাদের বিবেকের দায় কোথায় আজ? যারা দিনের পর দিন খুন হচ্ছে তারা আপনার বাবার মতই যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের কথা ভাবতো, সে কি আপনারা অনুভব করেন? একজন মানুষের মৃত্যুতে প্রতিবাদ করা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান হিসেবে আপনার নৈতিক দায়িত্ব, জেনে রাখুন। এ আপনাদের রক্ত ঋণ তাদের কাছে, পিতৃ দায়। 

অনেক অনেক বিচার না পাওয়া মানুষের নামের সাথে খুব দ্রুত কতগুলো নাম আরো যোগ হলো। সাগর, রুনি, অনন্ত, অভিজিৎ, জুলহাস, তনয় কিংবা তনু। রোজ রোজ এতো নাম এই তালিকায় যোগ হচ্ছে যে, প্রতিবাদ করতে করতে মানুষ ক্লান্ত। এক হত্যার ভীড়ে অন্য হত্যা হারিয়ে যাচ্ছে। ইস্যুর নীচে চাপা পরে যাচ্ছে মানুষ গুলো যাদের এই নীল আকাশের নীচে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়ার কথা ছিলো, লাজুক গলায় কাউকে দেয়া কথা রাখার অঙ্গীকার ছিলো। আমরা ভুলে যাই কিন্তু যার যায় সে কী ভোলে? 

আমার শূন্যতা নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে পথ চেয়ে বসে থাকবে আমার মা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ যখন ধরণী পবিত্র করতে ব্যস্ত থাকবে, অসীম নীলের সাথে শুভ্র জলধারা দিয়ে চেষ্টা করবে এই পৃথিবীর পাপ ধুয়ে দিতে, তখন হয়তো কোন টগবগে তরুণ তার শোবার ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের বাসার ছাদে খোলা চুলে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা লাজুক তরুণীটির দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে বিভোর। অন্য পাশের ফ্ল্যাট থেকে হাঁক শোনা যাবে বৃষ্টির আওয়াজ ভেদ করে, কী, বৃষ্টি দেখেছো আজ? -অফিস যাবো না ভাবছি। একটু খিচুড়ি করো না আজ, সাথে গরম গরম গাওয়া ঘি, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা আর সর্ষের তেলে ইলিশ ভাজা।

এই শুনে আমার মা ডাক ছেড়ে বিলাপ করে কাঁদবেন, অনন্ত আমার অনন্ত! আমার অনন্ত বড্ড বৃষ্টি আর খিচুড়ি ভালবাসতো। দিনের শেষে শুধু সেই মনে রাখে যার ঘর শূন্য হয়, বুক শূন্য হয়, কোল শূন্য হয়।


http://www.sylhettoday24.com/opinion/details/8/461

Sunday 8 May 2016

মা দিবসটি কেমন করে মায়েদের হলো

বছর ঘুরে আবার এলো মে মাস। এ মাসের দ্বিতীয় রোবাবারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটা করে পালিত হবে "মা দিবস' । এ দিবসকে উপলক্ষ্য করে দোকানীরা তাদের পশরা সাজাতে ব্যস্ত এখন, "মা দিবস' এর বিশেষ মগ, চকলেট, লকেট, শোপিস, টিশার্ট আরো কতো কি। তাদের গায়ে লেখা থাকে "মা তুমি কতো মিষ্টি", কিংবা "তুমিই সবচেয়ে লক্ষ্মী মা", "মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি" ইত্যাদি নানা রকম মিষ্টি মধুর কথা। ছেলেমেয়েদের মনের কথাই দোকানীরা তুলে রেখেছে তাদের পন্যের গায়ে। যে কথাটা হাজারো কাজের ভীড়ে দিনে হয়তো লক্ষ বার মনে পড়ে কিন্তু বলি বলি করেও মাকে বলা হয়ে উঠে না, সেটিই তখন মগ কিংবা চকলেটের মধ্যে দিয়ে মায়ের কাছে পৌছে দেই আমরা।
ইতিহাস থেকে জানা যায় ‘মা দিবসের’ প্রচলন শুরু হয় প্রথম প্রাচীন গ্রীসে। সেখানে প্রতি বসন্তকালে একটি দিন দেবতাদের মা ‘রিয়া’ যিনি ক্রোনাসের সহধর্মিনী তার উদ্দেশ্য উদযাপন করা হতো। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ‘মা দিবস’ পালিত হতো বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে। রোমানরা পালন করতেন ১৫ মার্চ থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে, তারা দিনটিকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘জুনো’র প্রতি। ষোলশ শতাব্দী থেকে এই দিনটি যুক্তরাজ্যেও উদযাপন করা হতো ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে। ইষ্টার সানডের ঠিক তিন সপ্তাহ আগের রোববারে এটি পালন করেন তারা। নরওয়েতে ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় রোববারে, সৌদি আরব, বাহরাইন, মিশর, লেবাননে বসন্তের প্রথম দিন অর্থ্যাৎ ২১শে মার্চে এই দিনটি উদযাপিত হয়। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে এই যে বনার্ঢ্য ‘মা দিবস’ এর উদযাপন, এটি আসে মূলত এ্যামেরিকানদের থেকে। ১৮৭০ সালে সমাজসেবী জুলিয়া ওয়ার্ড হো এ্যামেরিকার নারীদেরকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান, সাথে এই দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের কাছে প্রচুর লেখালেখি করেন। তার ঘোষনাপত্রে লেখা ছিল,
As men have often forsaken the plough and the anvil at the summons of war, Let women now leave all that may be left of home For a great and earnest day of counsel. Let them meet first, as women, to bewail and commemorate the dead.
যদিও এটা হো’র মৌলিক পরিকল্পনা ছিল না, তিনি ১৮৫৮ সালে শান্তিকর্মী এ্যান জার্ভিসের শুরু করা প্রচেষ্টাকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এ্যান জার্ভিস যুদ্ধ বিধ্বস্ত এ্যামেরিকার নারীদের নিয়ে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারীতা নিয়ে প্রচার ও কাজ শুরু করেছিলেন। ১৮৬৮ সালে তিনি নারীদের সংঘবদ্ধ করেন এবং এ্যামেরিকার কিছু কিছু জায়গায় প্রচারনা চালান টম্যেটোর চারা যেনো সবাই ‘মা দিবসে’র পরেই রোপন করেন তার আগে নয়। এ্যান জার্ভিস দিনটির সরকারী অনুমোদন পাওয়ার জন্য বিভিন্নধরনের চেষ্টা চালাতে থাকেন, কিন্তু সফলকাম হতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে এ্যানা জার্ভিস মায়ের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরনের কাজে হাত দেয়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন একটি বিশেষ দিন ঠিক করে ‘মা দিবস’টি উদযাপন করার জন্য। সেই লক্ষ্যেই ১৯০৮ সালের ১০ইমে তিনি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফিটন শহরের সেই চার্চে, যেখানে তার মা এ্যান জার্ভিস রোববারে পড়াতেন সেখানে প্রথমবারের মতো দিনটি উদযাপন করলেন। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে এটি বিস্তার হতে থাকে চারিধারে এবং এক সময় এ্যামেরিকার ৪৫টি অঙ্গরাজ্যে এই দিনটি পালন হতে থাকে। ১৯১২ সালে সর্বপ্রথম এইদিনকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারী ছুটি ঘোষনা করা হয় এ্যামেরিকার কিছু কিছু অঙ্গরাজ্যে। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ১৯১৪ সালে দেশব্যাপী সরকারী ছুটি ও জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দেন এই দিনটিকে। সে সমস্ত মায়েরদের সম্মানে দেশব্যাপী পতাকা অর্ধনিমিত রাখা হতো যাদের পুত্ররা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এরও নয় বছর পর থেকে আজকের মতো ব্যবসায়িক আঙ্গিকে ‘মা দিবসে’র উদযাপন শুরু হয়েছে। যাতে এ্যানা জার্ভিস স্বয়ং ভীষন আহত ও ক্ষুবধ হয়েছিলেন। ‘মা দিবসে’র গাম্ভীর্য ও মর্যাদা তার মতে এতে ব্যাহত হবে।
কিন্তু তবুও আজ অবধি মা দিবস যথেষ্ঠ ভালোবাসা ও উৎসাহের সাথে বিশ্বব্যাপী উদযাপন হয়ে আসছে। যান্ত্রিক জীবন আর অপরিসীম ব্যস্ততা যা আজকাল মানুষের পারিবারিক জীবনের অনেকটা সময় কেড়ে নেয়, যার কারণে প্রিয়জনদের মধ্যে অনেকটা অকারন দূরত্বও তৈরী হয়, সে সমস্ত দূরত্ব কাটিয়ে নৈকট্য নিয়ে আসতে ‘মা দিবসে’র তুলনা নেই। বিশেষ করে বিভিন্ন কারণে যারা মায়ের কাছ থেকে দূরে অবস্থান করেন পশ্চিমে তাদের কাছে এইদিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। সে জন্যই হয়তো পশ্চিমের দেশ গুলোতে এটি রোববারে উদযাপন করা হয়। বেশীর ভাগ লোকদেরই সেদিন ছুটি থাকে, দেখা যায় তারা মায়ের পছন্দের ফুল, চকলেট, কিংবা পারফিউম উপহার নিয়ে চলে যায় মায়ের কাছে। সারাদিন মায়ের কাছে তারা দিনটি কাটান। বিভিন্ন ভাইবোন বিভিন্ন জায়গায় থাকার কারণে রীতিমতো দেখা - সাক্ষাত যাদের মধ্যে সম্ভব হয় না, সেদিন দেখা যায়, সবাই মাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসে একে অপরকে পেয়ে আহলাদিত হয়ে উঠেন। জমে উঠে পারিবারিক উৎসব। অনেক সময় এ উৎসব আরো বড়ো আকারে নানা বাড়িতেও উদযাপন হয়ে থাকে। মা চলে যান তার নিজের মাকে শুভেচ্ছা জানাতে, সেখানে তখন জড়ো হোন পুরো পরিবার, মামা - খালা, তাদের সন্তানরা। যাদের মধ্যে হয়তো সারা বৎসর কোন যোগাযোগ থাকে না, এই একটি দিনে তারা কাছাকাছি চলে আসেন। সেসব দিক দিয়ে এই দিনটির গুরুত্ব অনেক। তবে যারা মায়ের কাছেই থাকেন, যেমন শিশুরা, তারা সাধারণত সেদিন মাকে বিছানায় ফুল নিয়ে যেয়ে ঘুম ভাঙ্গান, গিফট দেন, ছোট ছোট শিশু হাতে নাস্তা সাজিয়ে দেন, মাকে সেদিনের তার রুটিনের অনেক কাজ থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মাকে ঘিরে চলে সারাদিনব্যাপী উৎসব।
পরিবারের সুখ - সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখতে যেয়ে, প্রতিদিন নিজের আরাম নষ্ট করে, নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, সন্তানদের পৃথিবীতে চলার যোগ্য তৈরী করে দেন যিনি, তিনি মা। সেই নমস্যা ‘মা’ কে বছরে একটি দিনও যদি আনন্দ দিতে পারি, জানাতে পারি বিশেষভাবে তোমার তুলনা তুমিই ‘মা’, সেটাই কম কিসে?

Monday 2 May 2016

জবাই বৃত্তান্ত

ছোটবেলায় মুরগীর মাংস খুব পছন্দ ছিলো। বিশেষ করে মুরগীর রান, একটু বড় হতে হতে পছন্দ বদলালো, তখন রানের বদলে বুকের জাহাজ টুকরোটা বেশি পছন্দ ছিলো। কিন্তু মুরগী যখন জবাই করা হতো, কাছে পিঠে থাকলে, চোখে পরলে ছোট বেলায় খুব কষ্ট হতো। মুরগীটার  গলা কেটে ছেড়ে দিলে, ছটফট করে লাফাতে লাফাতে এদিক ওদিক পরতো তারপর এক সময় সব শেষ। আমি মনে মনে ভাবতাম, মুরগীটার আম্মু আছে হয়তো, আব্বু আছে, ভাই বোন আছে, তারা নিশ্চয় খুঁজছে, বাবা মায়ের কথা শোনেনি, মুরগী ধরার হাতে ধরা পরেছে, এখন ওকে আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, আমরা কেটে খেয়ে ফেললাম, ওদের পরিবার ওকে খুঁজছে, কিছুই জানতে পারছে না।

যখন অনেকটা বড় হলাম, দুপুরের ভাত ঘুম থেকে উঠে বিকেলটা তেমন কিছু করার থাকতো না কিংবা করতে ইচ্ছে করতো না। উদাস উদাস মন নিয়ে কখনো ছাঁদে যেয়ে কিংবা বারান্দায় এদিকে ওদিকে হেঁটে বাকি সময়টা পার করে দিতাম। মাঝে মাঝেই সেই সন্ধ্যা লাগো লাগো সময়ে বারান্দায় বসে বই পড়তাম। বাবা অনেক বাজার টাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন। শুরু হতো নীচে মুরগী জবাইয়ের পালা। গৃহ কর্মে সাহায্য করতে যেসব পুরুষকর্মীরা ছিলেন তারা নীচে মুরগী জবাই করতেন, একটার পর একটা। কিন্তু ততো দিনে চোখ এবং মন দুইই রক্তে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, কষ্ট লাগতো না। নেহাত আজাইরা বসে থাকতাম বলেই, বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীচের মুরগী জবাই এর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, দেখতাম। হয়তো সাথে ভাবতামও কোনটায় রোস্ট হবে আর কোনটায় কোর্মা।

গ্রামের বাড়িতে সবাই কোরবানীর ঈদ করতে যেতাম। পিকনিক আমেজ পুরো পরিবার জুড়ে। কতোদিন আগে থেকে চাল গুঁড়ো করে, মসলা গুঁড়ো করে দাদু সেই প্রস্তূতি নিতেন, সবাই বাড়ি আসবে। ঈদের ঠিক দু’ তিন দিন আগে হয়তো, মুরুব্বীরা বাড়ি আসতেন তারপর গরু কেনা হতো। বাড়িতে বছর জুড়ে যারা থাকতো, কাজ কর্ম দেখতো তাদের ওপরেই ভার পরতো গরু-ছাগল গুলো দেখাশোনা করার। আমরাও পাশে পাশে থাকতাম, ভাল লাগতো। “আমাদের গরু” কী গর্বই না লাগতো। যদিও ছাগল বেশি কিউট লাগতো, হাতে ধরে ধরে কাঁঠাল পাতা খাওয়াতাম আর গরুকে একটু ভয় পেতাম শিং দিয়ে গুঁতো দেবে, সেই ভয়। গরুর চোখ গুলোর দিকে তাকালে মায়া লাগতো, আহা, কাঁদছে, বুঝতে পারছে যে ওকে আমরা কোরবানী করবো। তুঁতো ভাইবোনেরা সেসব বলাবলিও করতাম।

ছোট বেলায় ঈদের নামাজ পরে এসে যখন গরু গুলোকে শুইয়ে ফেলার ভীষণ যে প্রচেষ্টা শুরু হতো, কী কান্নাই পেতো, কী মায়াই না লাগতো। প্রাণ ভয়ে গরু গুলো কত ভাবে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করতো, সেগুলোও আমাদের গল্পের খোরাক থাকতো সারাদিন। কিন্তু তারপর বিরিয়ানি, নেহারী, ঝুড়া মাংসের আড়ালে সেই কান্না কান্না গরুর চোখ হারিয়ে যেতো। বড় হয়ে তো গল্প আরো ভিন্ন, কার গরু কত দাম, কোন প্রজাতি মানে কত কুলীন সেটাও একটা ইস্যু ছিলো। গরুর রক্ত আর চোখের জলে তখন আমাদের অনেকেরই শরীর মন, অভ্যস্ত।

এদেশে রাস্তা ঘাটে কোথাও প্রকাশ্যে মুরগী, গরু কিছু কাটা হয় না। সাধারণত হাটে মাছের মাথা কাটা হয় তাও বরফে ডুবানো থাকা মাছ। এদেশের মানুষ তাজা রক্তের উষ্ণতার মধ্যে তার গন্ধের মধ্যে নৃংশসতা খুঁজে পায়। খুব কাতর গলায় জিজ্ঞেস করে, এরকম রক্ত দেখে তোমরা স্বাভাবিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করতে পারো? তোমরা ঘুমাও কী করে? ঘুম আসে? একজন মানুষের এতোটা রক্ত তো অন্যদের মানসিক ভারসাম্যহীন করে তোলার কথা ......


আসলে আমরা মুরগী কাটা থেকে গরু কাটা তারপর মানুষ কাটায় এতো নিরিবিলি পৌঁছে যাই যে আমাদের ভেতরের পাকিস্তানি আর্মির নৃংশসতা আমরা নিজেরাও অনুভব করতে পারি না। রক্তের গন্ধে আমাদের দেহ,মন, চোখ এত অভ্যস্ত যে কয় সাগর রক্ত পেরোলে এ আঁধার কাটবে, আমরা নিজেরাও জানি না আজ ...............হয়তো নিজেদের অজান্তেই তালেবানী অভ্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করতে শুরু করে দিবো, আজ কয় জন, কোথায় কিংবা আজ হয় নি! কারণ কী! ......