Tuesday 11 December 2018

নির্জন প্রবাস ও কিছুটা একাকীত্ব

প্রবাসীদের জীবন ভর্তি হাজারও সমস্যা, ঠিক দেশী মানুষদের মতই, তাই কোনটা ফেলে কোনটা নিয়ে লিখবো তালগোল পাকাচ্ছি।সমস্যা তো হাজারও জানি, কিন্তু সমাধান জানি না একটারও।কলেজে অর্থনীতি ছিলো, অর্থনীতির মধ্যে আবার ছিলো“বাংলাদেশ অর্থনীতি”, নামেই পরিচয়।বাংলাদেশের অর্থনীতি মানেই নানা প্রকার সমস্যা কিন্তু আশা’র কথা হলো, সেখানে সমস্যার পাশাপাশি সমাধানও লেখা ছিলো।অবাক হয়ে টিচারদের জিজ্ঞেস করতাম, সমাধান তো সব বইয়ে লেখা আছে, তাহলে আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না কেন? আমাদের বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে টিচাররা হয়ত মনে মনে হাসত, মুখে বলত, পড়বা, মুখস্থ করবা, পরীক্ষা দিবা, এর চেয়ে বেশী চিন্তা করার দরকার নেই। জীবনে কত থিওরি, এন্টি থিওরি, ইউটিলাইজেশান, এক্সেপশান মুখস্থ করলাম, পরীক্ষা দিলাম আবার ভুলেও গেলাম। পৃথিবী তার নিজের গতিতেই চলছে, এসব থিওরি তার কিছুই পরিবর্তন করতে পারে নি। তাই আমিও কোন সমাধানের কথা লিখছি না, আমার দৃষ্টিতে, “সমাধান” শব্দটা খানিকটা প্রতারণা কিংবা দুর্বলকে সান্ত্বনা দেয়াও বলা যেতে পারে।
সব প্রবাসীদের জীবন যেহেতু একই ছন্দে ঘোরে না, সবার সমস্যাও এক রকম না। অর্থনীতির চাকা কোথাও স্থির নেই, ক্রমাগত ঘুরছে, নতুন নতুন ব্যবসা, কর্মসংস্থান, পুরনোকে বাদ দেয়া ইত্যাদি চলছেই। অনেক প্রবাসীর দিন কাটে আতঙ্কে, চাকুরীটা টিকে থাকবে তো, জীবন যাত্রা’র এই মান টিকিয়ে রাখতে পারবো তো? এই বয়সে না আবার কোন ঝামেলায় পড়ি। আবার অনেক প্রবাসীর দিন কাটে পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পাওয়ার টেনশানে, চলে তো এসেছি, এখন টিকে থাকতে পারবো তো? পাসপোর্টটা পাবো তো হাতে।এত মানুষের জায়গা হচ্ছে, শুধু আমাদের কি আর জায়গা হবে না।আবার অনেকেরই আছে টাকা পয়সার টেনশান, ঠিক দেশি কায়দায়।মাস শেষ হলে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে, বাড়ির মানুষ অপেক্ষা করে বসে আছে তার আশায়।এখানে যতটা বাঁচিয়ে চলা যায়, যত বেশি জমাতে পারবে, তত বেশি পাঠাতে পারবে,বাবা-মা পরিজনেরা ভাল মন্দ দু চারটে খেয়ে বাঁচতে পারবে, পরিবার পরিজন আর একটু ভাল থাকতে পারবে।
গ্লোবাল সিটিজেন অর্গানাইজেশান প্রবাসীদের সাতটি সমস্যাকে ক্রমিকনুসারে সাজিয়েছে। তারা অবশ্য তাদের গবেষনার স্থান হিসেবে “এমেরিকা”কে বেছে নিয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এই সমস্যা গুলো সারা পৃথিবীর প্রবাসীদের ক্ষেত্রেই সমান সত্য। তাদের গবেষনায় উঠে এসেছে, ভাষা শেখা এবং বলতে পারা প্রবাসীদের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।  এ সমস্যার মোকাবেলা করতেই প্রবাসীরা হিমশিম খেয়ে যায়। বাচ্চারা অনেক দ্রুত ভাষা শিখতে পারে, মানিয়ে নিতে পারে, তবে বড়দের অনেক সময় লেগে যায়। তারপর আসে বাচ্চা বড় করা, তাদের স্কুলের পড়ায় সাহায্য করা এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করা। অনেক সময় বাচ্চারা স্কুলে অন্য বাচ্চাদের দ্বারা বর্ণ বিদ্বেষ, নানা ধরনের হয়রানীর শিকার হয়, অনেক বাচ্চা ক্লাসে, পরীক্ষায় রেজলাট খারাপ করে, তাদেরকে পিছিয়ে দেয়া হয়, বয়সের তুলনায় তারা ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পরে।  এরপর থাকে কর্মসংস্থানের ব্যাপার। সংসার এবং জীবন বাঁচিয়ে রাখতে অনেকেই যে কাজ পায় তাই দিয়ে জীবন শুরু করে তারপর আস্তে আস্তে উন্নত কাজের সন্ধান করে। সেই কারণেই দেখা যায় আজকে যে ট্যাক্সি চালক সে গতকাল হয়ত কোন স্কুলের টিচার ছিলো কিংবা ইঞ্জিনিয়ার আবার আগামীকালও তাকে অন্য পেশায় দেখা যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রেও প্রবাসীরা বর্ণ বিদ্বেষ এবং নানা ধরনের হয়রানীর শিকার হয়। কিছু কিছু কাজই আছে যেগুলো অন্যরা হয়ত করবে না, সেগুলোর জন্যে প্রবাসীদেরই বাছাই করা হয়ে থাকে।
আছে আবাসন সমস্যা। এ সমস্যাটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আর এমেরিকায় আলাদা রুপে আসে। ইউরপের বিভিন্ন দেশে পরিবারের  সদস্যনুসারে বড় বা ছোট বাড়ি সরকারের তরফ থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়। ভাড়ার অর্ধেকটা ভর্তুকি দেয়া হয়। আবার অনেক জায়গায় প্রবাসীরা নিজেদের সার্মথ্যনুযায়ী বাড়ি ভাড়া করে। এখানে বাড়ি ভাড়া যেহেতু খুব বেশী, অনেক সময় দেখা যায়, ঘিঞ্জি-কোলাহলপূর্ণ এলাকায়, ছোট বাসা ভাড়া করে শুরুর দিকে অনেকেই দিনযাপন করে।  বৈধ কাগজ ছাড়া প্রবাসীরা সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। অনেক সময় ডাক্তার দেখাতে পারে না, সামাজিক কাউন্সিলিংয়ের সুবিধা নিতে পারে না। অন্যান্য মানুষদের দ্বারা নানারকম হয়রানী ও নিপীড়নের শিকার হয়, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাও ঘটে। এ সময়টাতেই অনেক বেশী মানসিক সমর্থণ বা সাহায্যের দরকার হয় যেটা থেকে তারা দিনের পর দিন বঞ্চিত থাকে। ভাষার সমস্যার মত ড্রাইভিং লাইসেন্স ও এখানে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। গাড়ি চালানোর অনুমতি পেতে এখানে লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে হয় এবং বেশীর ভাগ সময়ই এই পরীক্ষাগুলো হয় ইংরেজি কিংবা সে দেশের মাতৃভাষায়। যে অব্ধি ভাষা শেখা সম্পন্ন না হয় সে অব্ধি ড্রাইভিং এর কাগজ থেকে প্রবাসীরাবঞ্চিত থাকে এবং বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়া, কাজে যাওয়া ইত্যাদিতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যায়।  যানবাহন সমস্যার কারণে প্রবাসীদের মধ্যে রাজধানীতে থাকার প্রবণতা অনেক বেশী, যতই শহরতলীর দিকে যাওয়া হবে ততই পাবলিক যানবাহনের সুবিধা কমে যাবে। সেদিকে প্রায় সবাই নিজের গাড়ি নিজে চালিয়ে অভ্যস্ত। অনেকেই নতুন এসে রাস্তা চেনে না, এলাকা চেনে না, ভাষা জানে না বলে অনেক সময় কারো সাহায্যও নিতে পারে না, রাস্তায় বেরোতে বা বাড়ি থেকে বের হতে তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে থাকে।
দেশের মানুষের মতো প্রবাসেও মানুষ হাজারও সমস্যার মধ্যেই বেঁচে থাকে।পার্থক্য হলো, জীবন এখানে আরও নির্মম, আরও সাদা-কালো।মন খারাপের দিনে জড়িয়ে ধরে কাঁদার কেউ নেই, মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার কেউ নেই, বলার নেই কেউ, সব ঠিক হয়ে যাবে,মন খারাপ করিস না।সকল জাগতিক সমস্যার সাথে অনেক মানসিক সমস্যাও থাকে।ফেলে আসা প্রিয়জনদের জন্যে মনটা হু হু করে কাঁদে, শরীরটা থাকে বটে প্রবাসে কিন্তু মন তো ঘুরে বেড়ায় সেই চেনা আঙিনায়। এমনি দিন যদিও কোন রকম কেটে যায়, উৎসব-পার্বেনের দিন গুলোতে দেশকে ভেবে চোখের জল গোপন করে না এমন খুব কম প্রবাসীই আছে। আর তো আছে দুটো ভিন্ন দেশের ভাষা, সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে, পরিবারকে মানিয়ে নেয়ার নিত্য দিনের টানা পোড়েন। “পাস্তা-পিজা”সহজ লভ্য, বানাতেও সোজা, দামেও আরাম, ছেলেমেয়েরা খুব ভালবেসে খেয়ে নেয় কিন্তু তাদের স্বামী-স্ত্রীর একবেলা ভাত না হলে চলেই না। একটু ভর্তা, ভাজি মেখে, ডাল দিয়ে অন্তত দু গ্রাস দু গ্রাস ভাত না খেলে দিনের শেষে মনে হয় দিনের আসল কাজটাই করা হলো না। কেউ কেউ ছেলে মেয়েকে বাংলা গান, নাচ শেখায়, দূর থেকে দূরে যায়, মনে গোপন আশা নিয়ে, ছেলে মেয়েরা বাংলা জানুক, শিখুক, রবীন্দ্রনাথ – নজরুলের পরিচয় অন্তত জানুক। দিনের শেষে সকলেই নাড়ী’র টান খুঁজে বেড়ায়। অনেক সময় বাচ্চারা দুটো সংস্কৃতির টানাপোড়েনের মধ্যে পরে দ্বিধান্বিত হয়ে পরে। স্কুল, বন্ধু, খেলা, দিন যাপন সব হয় এক রকম পরিবেশে কিন্তু বাড়িতে এলে হয়ে যায় অন্য দেশ অন্য সংস্কৃতি আর অন্য পরিবেশ। কোনটা বাস্তব আর কোনটা পরাবাস্তব তাই নিয়ে সমস্যায় পরে যায়। অনেক বাবা-মা চান সন্তান খুব দেশীয় আদব-কায়দা, সংস্কারে বড় হোক, এখানে বাস করলেও অন্তরে যেনো বাংলাদেশ লালন করে, তাদের দৃষ্টিতে তাদের সন্তানরা খুব দ্রুত বিদেশী হয়ে উঠছে, বাচ্চারা এর সাথে তাল মিলিয়ে পারে না, শুরু হয় মত পার্থক্য, মনোমালিন্য। অনেক সময় এই সমস্যা এতটা প্রকট আকার ধারণ করে যে পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনার অনেক ইতিহাস আছে। এ সমস্যাগুলো শুধু যে বাংলাদেশের প্রবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, প্রায় প্রতিটি দেশের প্রবাসীরাই কম বেশি এ সমস্যাগুলোর ভেতর দিয়ে যায়।  শুধু এমেরিকা নয় প্রবাসীদের নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন গবেষনায়ও উঠে এসেছে, ভাষার ভিন্নতা, সংস্কৃতির ভিন্নতা, ফেলে আসা জীবন আর নতুন করে বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আবার জীবন শুরু করার যে মানসিক ধকল সেটাই প্রবাসীদের অনেক বড় সমস্যা (CMAJ)
যারা গান-নাচে আস্থা রাখে না, তারা মসজিদে নিয়ে যায় বাচ্চা, বিদেশে থেকেও যেনো বাচ্চা আল্লাহর নাম জানে, রাসুলের ইতিহাস জানে, দ্বীনের পথে থাকে। মসজিদে দান খয়রাত করে, পরকালের ভাবনা ভাবে। অনেকেই আছে এ দুটোর কোনটাই হয়ত করে না। যতটা সম্ভব যে দেশে থাকে তার সংস্কৃতির সাথেই মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে তারপরও দেখা যাবে, দেশ থেকে বাচ্চাদের জন্যে সুন্দর সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবী কিনিয়ে আনিয়েছে, কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে সেসব পরে সবাই সাজগোজ করে ছবি তুলে, ফেসবুকে বা ইন্সট্রাগ্রামে দিচ্ছে। যতদূরে, যে অবস্থায় থাকে না কেন মানুষ, হৃদয়ে দেশ তো লালন করেই, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হতে পারে কিন্তু ভালবাসা নিরবিচ্ছিন্ন। দেশ কখনও ছেড়ে যায় না, ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মনসতাত্ব্বিক সমস্যা।বিদেশে মানুষ এমনিতেই একাকীত্বে ভোগে, ব্রিটেনে কয় দিন আগে এ সম্বন্ধে মানুষকে সাহায্য দেয়ার জন্যে আলাদা মন্ত্রনালয় খোলা হয়েছে।এখানে জন্ম নেয়া, বড় হওয়া স্থানীয়দেরই যদি এ অবস্থা সে জায়গায় প্রবাসীদের মানসিক কষ্ট বর্ননাতীত।“বিসর্জন” নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “একাকীত্ব কারে বলে? যবে বসে আছি ভরা মনে,দিতে চাই, নিতে কেহ নাই”। এখানে প্রবাসীরা মোটামুটি উন্নত জীবন যাপন করে, ছিমছাম বাড়ি, গাড়ি, সাজানো গোছানো জীবন। কিন্তু এই সুখ ভাগ করে নেয়ার মত পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। একা একা ভালো থাকা, কি নিদারুণ স্বার্থপরতা। ফেসবুকে ছবি আপলোড দিয়ে কিংবা মোবাইলে বাড়িতে ছবি পাঠিয়ে কি একসাথে বসে সবাই খাওয়া দাওয়া করার, গল্প গুজব করার সেই তৃপ্তি আসে?প্রতিদিনের ছোট ছোট দুঃখ সুখ ভাগ করে নেয়ার আনন্দ কি ছবিতে পরিপূর্ণতা পায়, পায় না।দেশ থাকে সব সময় প্রবাসীদের হৃদয়ের গহনে, হারানো প্রেমের মত, কখনো ছেড়ে যায় না।
“একাকীত্ব” ব্যাপারটিকে আমরা যতটা অবহেলার চোখে দেখি আসলে কিন্তু ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এই লক্ষনটি অন্যান্য অনেক অসুস্থতা কিংবা অস্বাভাবিকতা তৈরী করে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক জীবনে।অনেকেই সিজোফ্রেনিয়া’র মত মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে একাকীত্বকে দায়ী করে।একাকীত্বের অনুভূতি থেকে বড় ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যার হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে মন্ত্রী ট্রেসি ক্রাউচ বলেন, “এই ধরণের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি সে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করা উচিত যেভাবে কিনা ধূমপান বা স্থূলতা মোকাবিলা করা হয়।” দুনিয়া কাপানো গায়িকা ম্যাডোনা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ভাগ্যের অন্বেষণে একদা তিনি নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে এসেছিলেন, লন্ডন শহরে তিনি এতটাই একাকীত্বে ভুগছিলেন যে এক বছরের মধ্যে তিনি আবার নিউইর্য়কে ফিরে যান। মনোবিজ্ঞানী মাইক লুহম্যান এবং লুইস.সি.হওকলি সামাজিক অর্থনৈতিক প্যানেল ২০১৩এর প্রতিনিধিত্বমূলক একটি জরিপ চালান। সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলো ১৬,১৩২ জন মানুষ। জরিপের ফলাফল, “বয়স্ক ব্যক্তির একাকীত্বের অন্যতম প্রধান কারণ তাঁদের সামাজিক সম্পর্ক কমে যাওয়া। মাঝেমাঝে আয় কমে যাওয়াও এর একটি কারণ।“ মনোবিজ্ঞানীরা বলেন,“একজন ব্যক্তির অর্থনৈতিক আয় যত বেশি, তার একা হওয়ার সম্ভাবনা তত কম। এই সম্পর্কটি মধ্যবয়সে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মধ্যবয়সে অর্থ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বয়সের প্রভাবটা একাকীত্বের ক্ষেত্রে বেশি থাকে। এর সাথেও স্বাস্থ্য বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারটিও জড়িত।“
একাকীত্ব কাটানোর জন্যে প্রবাসীদের অনেকেই একটা অবলম্বন খোঁজে, এবং তাকে অস্বাভাবিক ভাবে আকড়ে ধরে।অনেকে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে, জীবনের সমস্ত জায়গায় বাড়াবাড়ি রকম ভাবে ধার্মিক রীতি নীতির প্রয়োগ করতে থাকে।কেউ কেউ নেশাজাতীয় দ্রব্যের শরনাপন্ন হন।অনেকের দেখা যায়, বাস্তবতা থেকে দূরে থাকতে অন্তর্জাল আসক্তি বাড়াবাড়ি রকমভাবে বেড়ে যায়।ওপরের এই প্রত্যেকটি কারণকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় অসুস্থতা হিসেবে দেখা হয় যার অন্যতম প্রধাণ কারণ হিসেবে একাকীত্বকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যরকমও আছে, কেউ কেউ সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন,ভলান্টিয়ার সোশ্যাল ওয়ার্ক, তবে বাংলাদেশী প্রবাসীদের মাঝে শেষের ব্যাপারটি কম দেখা যায়। একাকীত্ব বোধের এই যন্ত্রণার জন্যে অনেক সময় আবহাওয়া ও একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। ঠান্ডা, বৃষ্টি, বরফ, তুষার দিনের পর দিন এই বৈরী আবহাওয়া ও মানুষের মনোজগতে বিরাট প্রভাব ফেলে। জন্মস্থান আর প্রবাসের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে মানুষ হিমসিম খেয়ে ওঠে।  তার ওপর বন্ধুহীনতা, আত্মীয়হীনতা, পরিজনহীনতা জীবনকে আরও বেদনাদায়ক করে তোলে।
প্রতিটি মানুষ আলাদা, তার ভাবনা চিন্তা সবই আলাদা।একজনের কাছে যেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, অন্যজনের কাছে সেটা হয়ত কোন সমস্যা না।আবার জীবনের এক স্তরে যেটা অনেক গুরুত্ব বহন করে অন্য পর্যায়ে এসে সেটার আর তেমন গুরুত্ব থাকে না।ধর্ম, সংস্কৃতি, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ইত্যাদি বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের জীবনে।এসকল কারণ আছে বলেই তো দেশ ছেড়ে প্রবাসজীবন গ্রহণ করতে মানুষ বাধ্য হয়। এসব দৃশ্যমান সমস্যার সাথে জড়িয়ে থাকে হাজারও অদৃশ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক সমস্যা। দৃশ্যমান সমস্যা চিহ্নিত থাকে বলে তার কিছু সুরাহা হয়ত হয় কিন্তু অদৃশ্য সমস্যার সমাধান খুঁজতে অনেক বেশী ভেতরে উঁকি দিতে হয়। সেটা হয়ে ওঠে না বলে, সেগুলো থেকে অধরা আর অব্যক্ত। তবে আশার কথা এই যে, অনেকেই এই নিয়ে আজকাল কথা বলছেন, এগুলো এখন ওপরে উঠে আসছে আশাকরছি কখনও এগুলোও নিয়েও অনেক কাজ হবে, কিছু না কিছু আলো বেরিয়ে আসবে।

Tanbira Talukder is an accountant by profession. She is a novelist, reciter and human rights activists based in The Netherlands.

Monday 3 December 2018

ডিপ্রেশন

কবিবর শ্রীজাত বলেছেন,

ডিপ্রেশনের বাংলা নাকি নিম্নচাপ? -
বৃষ্টি এল। সঙ্গে কফি এক-দু' কাপ
কেবল মুঠোয় বন্দি কফির একলা কাপ -
ডিপ্রেশনের বাংলা জানি । মনখারাপ ।

ট্রেনে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয়, মাঝে মাঝেই ট্রেন লেট, কারণ ট্রেনের নীচে কেউ ঝাঁপ দিয়েছে। এখানে বলে, “পাতা ঝরার মুহূর্ত থেকে নতুন পাতা আসার আগের মুহূর্ত” পর্যন্ত মানুষের বিষাদগ্রস্ততা অনেক বেড়ে যায়।

প্রায়ই আজকাল খবর দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের আত্মহত্যা, তরুণ/তরুণীদের আত্মহত্যা।

“বিষাদ-হতাশা” ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতই একটি মারাত্বক রোগ। এর সম্পর্কে প্রচার হওয়া জরুরী। এর চিকিৎসা হওয়া জরুরী, সর্বোপরি সমাজে এ অসুখটি নিয়ে সচেতনতা আরও জরুরী। বিষন্নতা শুধু মানসিক জায়গাতেই আটকে থাকে না। শরীরে এর প্রচন্ড প্রভাব পরে, ঘুম কমে যাওয়া, ঘুমের মধ্যে ঘেমে ওঠা, দুঃস্বপ্ন দেখা, প্রচন্ড পেটে ব্যথা হওয়া, ক্ষিদে না পাওয়া কিংবা অনেক বেশি ক্ষিদে পাওয়া, কাজ করার আগ্রহ এবং শক্তি কমে যাওয়া, দ্রুত রেগে যাওয়া, আবেগতাড়িত আচরন, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া সবই এর লক্ষণ। চুল পরে যাওয়া, শারীরিক লাবন্য কমে যাওয়া সহ বহুবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে। 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও ওষুধ তো আছেই, সাথে ইয়োগা, মেডিটেশান, ব্যায়াম, বিষন্নতাকে নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। বিষন্নতার ওপর প্রচুর গবেষনা হয়েছে এবং হচ্ছে, নেটে বিনামূল্যেই এ নিয়ে বিস্তর তথ্য পাওয়া যায়।


জীবনের মৌলিক ব্যাপার গুলো নিয়ে যারা খুব সচেতন এবং স্পর্শকাতর থাকেন তারা যখন সমকামিতাকে একটি অসুস্থতা কিংবা বিষন্নতা ফ্যাশন ভাবেন তখন খুব বেদনাদায়ক। আপনার ক্যান্সার হয় নি বলে আর একজনের ক্যান্সার কোন উপহাসের বিষয় নয়। এক এক জন এক এক ব্যাপারে স্পর্শকাতর। মানসিক ধকল সবাই এক ভাবে সামলাতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-খ্যাতিহীন ছাত্রের আত্মহত্যা যেমন সত্যি তেমনি খ্যাতির শিখরে থাকা এমেরিকার প্রেসিডেন্টের প্রেমিকা মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যাও ততটাই সত্যি। তাই আসুন “উপহাসে”র পথে না যেয়ে – সাহায্যের পথে যাই। একটি প্রাণ বাঁচলেও বাঁচলো পৃথিবী।

02/12/2018