Wednesday 25 May 2011

আমাদের এই ভালবাসা

আমাদের এই ভালবাসা
ছয় লক্ষ আত্মঘাতী ঝগড়া
চারকোটি ভিজে চুমু ঠোঁটে
আবেশে হাতে হাত রাখা
অনুভবে দুজনে ছুঁয়ে থাকা
এলোমেলো চিঠি লেখা
খুচরো খাচরা ফোন করা
টুকরো টাকরা মেঘে ভেজা

আমাদের এই ভালোবাসা
কতো বলা না বলা কথা
অজানা সুখে ডুবে থাকা
কিছু চাওয়া কিছু না পাওয়া
কিছু পেয়ে তা হারিয়ে ফেলা
কিছু স্বপ্ন প্রজাপতির পাখা
কিছু আদর তুলোয় মাখা
চোখে তার নামের কাজল আঁকা

তানবীরা
২৪.০৫.২০১১

উৎসর্গঃ অদেখা কিন্তু অনেক চেনা অনুজা “জেবীন”কে। যে খুব ভালো পায়েস রাঁধে। প্রবল ভালোবাসা নিয়ে মাঝে মাঝেই সে আমার বিষন্ন নিঃসংগ সময়গুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

Friday 20 May 2011

ছুঁয়েছে এ গান আমার কান্নার সাত সুর

If you love something, set it free; if it comes backs it's yours, if it doesn't, it never was. রিচার্ড বাক’এর এই উক্তিটিকে মন্ত্র করে তিতলি সারাক্ষণ মনে মনে আউরাতে থাকে। নিজেকে শক্তি দিতে চেষ্টা করে। দশ বারের মধ্যে আট বার সে হেরে যায় নিজের কাছে আবার দু’বার জিতেও যায়। সে অপেক্ষা করে থাকবে সায়ানের ফিরে আসার। সায়ানতো তার নিজের অংশ, পথ ভুলে যায় না লোকে? সায়ান পথ হারিয়ে ফেলেছে, পথ খুঁজে ফিরে এসে তার সায়ান তাকে খুঁজবে তিতলি জানে। তিতলি তার সমস্ত দরজা, জানালা, ঘুলঘুলি খুলে দিয়ে সায়ানের ফেরার অপেক্ষায় রইলো। কতদিন করবে অপেক্ষা? দশ বছর? বিশ বছর? পুরো জন্ম কিংবা জন্মান্তর? কিন্তু তাকে যে অপেক্ষা করতেই হবে। কোন একদিন সায়ান যখন খুব ক্লান্ত হবে তিতলির কথা তার নিশ্চয়ই মনে পড়বে। তখন তিতলির দরজায় এসে যেনো দরজা বন্ধ না পায় তারজন্যে সব খুলে রাখবে সে। ক্লান্ত সায়ানের মুখ মুছিয়ে দিবে নিজের ওড়না দিয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে দিবে। মগ ভর্তি গরম কফি নিয়ে দুজনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোস্ন্যা দেখবে আর সায়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রিয় কবিতার প্রিয় লাইনগুলো গুন গুন করবে। হাত নেড়ে নেড়ে অনেক গল্প করবে সেদিন তিতলি সায়ানের সাথে, অর্থহীন সব গল্প, যার আসলে কোন মানেই নেই। সায়ানের ভাল না লাগলেও সেসব শুনতে হবে। ওর কোন চয়েস থাকবে না তখন তিতলির কাছে। এটাই হবে তার শাস্তি। চুপ কর, বক বক শুনে মাথা ব্যাথা করছে বললেও তিতলি থামবে না। কাতুকুতু দিয়ে আরো খোঁচাবে সে সায়ানকে। সে অপেক্ষা করে আর স্বপ্নের জাল বুনে যায়, সায়ানের ফিরে আসা বা না আসা হলো তার নিয়তি। আবার এটাও ভাবে তার কাছেই সায়ানের ফিরে আসাটা বড় কথা নয়। সায়ান যেখানেই থাকুক, যার কাছে থাকুক আনন্দে থাকুক আর ভালো থাকুক সেটা বড় কথা। সে শুধুতো সায়ানের সুখ চায়।

যার জন্যে তিতলি জগত জুড়ে এতো চুরি করেছে, সে যখন চোর বানিয়ে তার হাত ছেড়ে দিল, মানসিকভাবে তিতলি একদম একা হয়ে গেলো। তার দিনরাতের সব কাজের বাইরে বাকি সময়টা জুড়ে শুধু সায়ান ছিল। এখন নিজের মনে সে একলা থাকে, ফাঁকা অবসর। কোথাও আর সেই প্রিয় মুখ সেই হাসি নিয়ে উঁকি দেয় না। সেই মায়াভরা চোখ নিয়ে কেউ তাকানোর নেই। সেই হাত আর তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিবে না। কেউ আর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার চুলের গন্ধ নিবে না ভাবলেই তার এক এক সময় কষ্টে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কি করে লোকে সব ভুলে যেতে পারে? কিন্তু তিতলি কিছুতেই হেরে যাবে না, নিজের কাছে সে নিজে এই প্রতিজ্ঞা নিল। এই যুদ্ধে তাকে জয়ী হতেই হবে। যতোই অস্থির লাগুক, নিঃশ্বাস বন্ধ হোক, মন কেমন করে করুক, চোখের পানিতে গাল ভিজেতো ভিজুক সায়ানের কাছে আর নিজেকে সে ছোট করবে না। ভালবাসাতো বেঁধে রাখার জিনিস নয়। হাত ছেড়ে যে চলে গেছে ফিরে তাকেই আসতে হবে। পৃথিবীর কারো কাছেই সে দুর্বল হবে না, ভেঙ্গে পড়বে না। নিজের আগুনে সে নিজে জ্বলবে। এতো জ্বলবে যে চোখের পানিকে সে বাস্প করে আকাশে উড়িয়ে দিবে। যেটা মেঘ হয়ে উড়ে গিয়ে ঝরে পড়বে সায়ানের বুকে। শুধু সায়ান জানতে পারবে না এই উড়ো মেঘের নাম কি ছিল।

মুরগী কেঁটে ছেড়ে দিলে যেমন ছটফট করতে করতে একসময় নিথর হয়ে যায়। কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করে করে একদিন সেও নিথর হয়ে যাবে এটুকু তিতলি জেনে গেল। কষ্ট হলে লোকে কষ্ট পায়, কিন্তু মরে যায় না, এটাই নিদারুন সত্যি। যদিও মরে গেলেই হয়তো কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যেতো। তারপরও মনে ক্ষীণ আশা খেলা করে তার, কখনও ক্লান্ত মুহূর্তে সায়ান যখন একা থাকে, আনমনে জানালা গলিয়ে তার দৃষ্টি বাইরে দেয়, হয়তো তখন তার মনের নীল আকাশেও ভেসে ওঠে তিতলির মুখ। তিতলির জীবনের কাছে চাওয়ার বেশি কিছু নেই। নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে ধরা যায় শুধু এমন দুখানি হাত ছাড়া। আজ মনে হয় আনকন্ডিশনাল আসলে পৃথিবীতে কিছু নেই। আনমনে বকে যাওয়ার মতো বন্ধুও কেউ হয় না এ পৃথিবীতে। এগুলো সব আসলে কথার কথা। শুধু কবিতার জন্যে এগুলো বলা হয়। ইদানীং আনমনে যখন বকতে ইচ্ছে করে, সায়ানের হাত ধরে যখন উড়ে যেতে ইচ্ছে করে, সায়ানের ঘাড়ে নাক ঘষে দিতে ইচ্ছে করে, তিতলি সায়ানের নামের উইন্ডো খুলে সেগুলো টপটপ লিখে ফেলে। কিন্তু সে চিঠি কখনো সে সেন্ড বাটনে চাপ দিয়ে সায়ান পর্যন্ত পাঠায় না। সায়ান কোনদিন জানতেও পারবে না তিতলির এই খেলার কথা।

শেষের দিকে যখন কথা হত, সায়ান তিতলির দোষ ছাড়া আর কিছুই বলতো না। আপন মনেই হাসে তিতলি। তার চারপাশের সবাই তাকে এতদিন ধরে সহ্য করছে,ছোটখাট সমস্যা হলেও সেটা কখনো তার সাথে লোকে থাকতে পারবে না, সে পর্যায়ের নয়। কিন্তু যে তার একান্ত আপন, তার সবচেয়ে ভালোবাসার লোক পৃথিবীতে তার স্বভাব মেনে নিতে পারলো না। হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। কোন এক দুর্বল মুহূর্তে তিতলি সায়ানকে ম্যাসেঞ্জারে গ্রীন দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।
জিজ্ঞেস করে ফেললো, আমাকে কোন দোষে তুই ছেড়ে গেলি যদি একবার বলতি
সায়ান তার স্বভাবসুলভ ইগো নিয়ে বললো, তোর কোন কিছুই আমার মনের মতো নারে। তুই কখনো ইনফ্যাক্ট আমার মনের মতো হতেও পারবি না।
কি লাভ? তাই ............ আসলে কি জানিস তুই কখনো আমার মনের মতো ছিলিও না।
তুই ছিলি আমার মনের এক সময়ের ঘোর লাগা বিভ্রান্তি মাত্র।

আপন মনে হাসে তিতলি, তার মন মজেছে অন্য জায়গায় কিন্তু সে দূরে গেল তিতলির দোষ দেখিয়ে। কেন সায়ান তাকে বলতে পারলো না, তার অন্য কাউকে চাই এখন? এটুকু সৎ সাহস দেখালে সে তিতলির কাছে ছোট হত না। তিতলি কি টের পাচ্ছে না আসলে সায়ানের পৃথিবী কেনো দুলছে? সেদিনও দেখলো ফেসবুকে সায়ান অনেক ছবি আপলোড করেছে তার ডিপার্টমেন্ট এর আউটিং এর। এক ছবিতে মেরুন রঙের টপস পড়া এক স্বর্নকেশির খুব কাছে সায়ান দাঁড়ানো, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সায়ানের এ হাসি যে তিতলির চিরচেনা। আগে এ হাসি শুধুমাত্র তার জন্যে হাসতো সায়ান। তিতলি অনুভব করতে পারে, অনেক দূর থেকে এতো কঠিন হওয়া আসলে সোজা। দুজন মানুষ যখন কাছে থাকে, একজনের দৃষ্টি অন্যজনকে ছুঁয়ে যায়, একজনের স্পর্শ আর অন্যজনের হৃদয় ভিজিয়ে দেয়। ঠোঁট ঠোঁটকে আবেশে চেপে ধরে তখন এতো কঠিন হওয়া যায় না একজনের প্রতি। তিতলিকে চাবুক দিয়ে কেউ আঘাত করলেও হয়তো সে এতোটা কষ্ট পেতো না। চোখের জল মুছে সে প্রতিজ্ঞা করলো, কারো মনের মতো হওয়ার চেষ্টা সে করবে না আর, যথেষ্ঠ করেছে। বরং যে তাকে পেতে চাইবে, তাকেই তিতলির মনের মতো হতে হবে। দুঃখকে সে আস্তে আস্তে শক্তিতে বদলে দিবে। একদিন অবাক হয়ে তিতলি লক্ষ্য করলো, সায়ানের ম্যাসেঞ্জার - ফেসবুক যেসব জায়গায় তিতলির অবাধ বিচরণ ছিল, সায়ান তাকে বিতারিত করে দিয়েছে অবলীলায়। সে হতবাক হয়ে গেলো সায়ানের এই ক্ষুদ্রতায়, সে সায়ানের জান হয়তো নয় আর কিন্তু বন্ধুও কি নয়? আর দশটা সাধারণ বন্ধুর মতো সে কি সায়ান কেমন আছে এটুকু জানতে পারে না? সে অধিকারও কেড়ে নিতে হলো তার কাছ থেকে? কিন্তু পরে সে সায়ানকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে লাগলো এজন্যে। অতীতকে মুছে সামনে যাওয়া এখন তিতলির জন্যেও সহজ হবে। যদিও জানে তিতলি তার চুলের গন্ধ পেলে, তার চোখের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পেলে, তার আঙ্গুল সায়ানের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলে এতো তাড়াতাড়ি সায়ান তাকে মুছতে পারতো না সবকিছু থেকে। তবুও তিতলি নিজেকে টেনে তুললো হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ভঙ্গুর স্তুপ থেকে। ফিরে দাড়ালো কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে আজ থেকে গানের সাধনায়, ছবি আঁকায় আর পড়াশোনায় নিজেকে আকন্ঠ ডুবিয়ে দিবে সে। হাঁটবে একা, বাঁচবে একা, হারিয়ে যাবে না কিছুতেই।

তানবীরা
২০.০৫.২০১১

উৎসর্গঃ আমাদের সবার আদরের “ছোটমা’কে”
লুকিয়ে ভালবাসবো তারে জানতে দিব না

Wednesday 18 May 2011

ছোটমা’র জন্যে একরাশ ভালোবাসা

দেশে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম তখন এক আড্ডায় বান্ধবীরা একটু অনুযোগ করলো আমার কাছে, এতো গল্প লিখি কিন্তু স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি লাইফের কোন গল্প মানে বান্ধবীদের নিয়ে গল্প কেনো লিখিনি এখনো। কি দুর্দান্ত দিন ছিলো আমাদের। সবসময় পড়াশোনায় ভালো কিন্তু দুষ্টমীতে ওস্তাদ হিসেবে আমাদের বান্ধবীগ্রুপের নাম ছিল সব ইন্সটিটিউটে। আমিও ভাবলাম তাইতো কেনো লেখা হয়নি সেগুলো এখনো? আমাদেরকে রীতিমতো ভয় খেতো অন্য মেয়েরা। এমন কায়দায় পঁচাতাম অন্যদেরকে কিন্তু এখনো হয়নি লেখা সেই গল্পগুলো এটাই সত্য। আজ কদিন ধরে ভাবছি প্রিয় মানুষরা যারা আমাকে শুধু আমি বলেই ভালোবাসে, আমার কাছে কোন প্রত্যাশা না রেখে তাদের নিয়েও কোনদিন কিছু লিখিনি এমনকি আমার কোন লেখা কোনদিন তাদেরকে উৎসর্গও করিনি। অক্সিজেন সারাবেলা ঘিরে রাখে বলে, তাকে টেকেন ফর গ্রান্টেডে রেখে দিয়েছি, খুলে দেখিনি ঝাঁপি তার। ছোটমাকে দিয়ে আজ শুরু করলাম। আমার সাথে তার বয়সের ব্যবধান এক যুগেরও বেশি। আমার অনেক পরে সে এই পৃথিবীর আলো বাতাস দেখেছে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, সহ্য, স্যাক্রিফাইস আর সবাইকে দেয়ার ক্ষমতায় সে অনেক অনেক অনেক আগেই আমাকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে।

এক হরতাল মুখর ভোরে তার জন্ম। পুরো নার্সিং হোমে খবর হয়েছিল ফুটফুটে এতো সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে জন্মেছে। আমাদের কোলে আর কেউ দেয় না। অন্য রোগীদের আত্মীয় স্বজনের কোলে কোলে সে ঘুরছে। আমি আর ভাইয়া নিরুপায় এক কোনায় দাঁড়িয়ে। তখন আব্বু নার্সকে অনুরোধ করলেন আমাদেরকে যেনো দেয় দেখতে। নার্স এসে বিশাল হাসি দিয়ে ভাইয়ার কোলে তুলে দিলেন। বললেন, চারবোনের এক ভাই তুমি, তোমার বিশাল দায়িত্ব। এতো সুন্দর বোন সহসা হয় না কারো, দেখে রেখো। ভাইয়া নার্সের কথার মর্যাদা রেখেছেন। আমাদের সবাইকে ভাইয়া ভালোবাসেন কিন্তু ভাইয়ার নিঃশ্বাসের এক পাশে লেখা আছে ছোটমার নাম। আর এ নাম আমি নির্দ্বিধায় বলবো, শুধুমাত্র সৌর্ন্দয দিয়ে ছোটমা পাননি। অনেক ত্যাগ দিয়ে পেয়েছেন, ওয়েল ডিজার্ভাড। কিন্তু ছোটমার আগমনে আমি মোটেও হ্যাপি ছিলাম না তখন। আগে আমি আর ভাইয়া, দুই ভাইবোন, দাদু আর বাবা মা, এই ছিল আমাদের সংসার। তখনো ঢাকার জমি এতো দামি ছিল না। আমাদের বাড়ির ঘাড়ে লাগিয়ে লাগিয়ে অন্যেরা বাড়ি তুলেননি। চার বেডরুমের সেই বাড়িতে আমরা অনেক আনন্দে ছিলাম। কিন্তু লিটিস পিটিস ভাইবোন আসাতে, রুম দখল হতে লাগল, সাথে টিভি, সাথে মা। আগে মধ্যবিত্ত বাড়িতে সাধারণত একটা টিভি থাকতো। মা আমাকে আর আগের মতো সময় দিতেন না, দিতে লাগলেন ওদের। সেই রাগে আমি ছোট দুটোকে ছুঁতেও চাইতাম না। এখনো আমি বলি, তোকে আমি কোলে নিতাম না জানিস, ছোটমা হাসতে হাসতে আমার গায়ে গড়িয়ে পরে আর বলে এখনতো নাও।

আমি আর ছোটমা কন্সট্যান্ট ঝগড়া করতাম। মা বলতেন এটা কি করে সম্ভব? এতো গ্যাপের দুজনের মধ্যে এতো ঝগড়া। আবার আমিই দুবেলা মুখে তুলে খাইয়ে দিতাম। বিকেলে সাজিয়ে ঘুরতে পাঠাতাম। বেড়াতে গেলে সাজিয়ে নিয়ে যেতাম সাথে করে। তার চুল কেঁটে আমি পার্লার পার্লার প্র্যাক্টিস করতাম। তিলের খাজা ছিল তখন তার প্রিয় খাদ্য। টিভিতে নাটকের সিরিয়ালের সবাই ছিল তার আত্মীয়। বহুব্রীহি নাটকের মিলি ছিল, মিলি আন্টি, সোবহান সাহেব দাদা। তিনি তার কমন সেন্স খাটিয়ে পোষাক আর বয়স দেখে তাদের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক করে নিতেন। যেমন চাঁদনী ফিল্মের ঋষি কাপুর ছিলেন তার রোহিত আঙ্কেল আর শ্রীদেবী ছিলেন চাঁদনী আন্টি। আমাকে ছাড়া আর সবার সাথে তার ভাব ছিল। আব্বু বাড়ি এলে আমার নামে নালিশ দিতো। আব্বু হাসতো আর বলতো, তোর সাথে ঝগড়া করে, দাড়া ওকে বিয়ে দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দিবো। তখন ওনিও নেচে নেচে আমাকে বলতেন, বিদেশে পাঠাবো বিয়ে দিয়ে, এই হবে আমার সাথে ঝগড়া করার তোমার উচিৎ শাস্তি। সুখের দিন ঝগড়াঝাটি আর মারামারিতে অনেক দ্রুত ফুরিয়ে গেলো। তখন বুঝিনি যে সেগুলো সুখের দিন ছিল। উচিৎ শাস্তি পেয়ে আমি আজ অনেক দূরে। আমার বিয়েতে সবাই এতো উত্তেজিত ছিল যে আমি, আব্বু আর ছোটমা ছাড়া কেউ আমার বিদায় বেলায় কাঁদেনি। কিন্তু সেই থেকে আমার প্রত্যেক বিদায়ে ছোটমা অশ্রুসজল হয়েছে। আমি প্লেনে ওঠার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে আমার গায়ের ঘ্রানের জন্যে আকঁড়ে থাকে সে ছোটমা।

এক সময়ের সবার আলহাদের ছোটমা কখন যে সবার আশ্রয় হয়ে গেলো তা আমরা সজ্ঞানে টেরই পাইনি। আব্বুর হার্ট এ্যাটার্ক হলো, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আলোচনা থাক এখানে। তিনবার ঢাকার নামী হাসপাতালে ওপেন হার্ট করে শেষ পর্যন্ত ভারতের দ্বারস্থ হতেই হলো। তিনবার এই অপারেশনের মাঝের যে সময়টা প্রায় দেড় বছর, আব্বু রাতে ঘুমাতে পারে না। সারা রাত ব্যথায় কাতরায়। আমি মেয়ে নিয়ে জেরবার, ঘুম কাতুরে, জাগতে পারি না। ছোটমা কিচ্ছু করতে পারে না কিন্তু আব্বু কাতরালে সে কি করে ঘুমায়? সারারাত আব্বু সোফার পাশে বসে থাকতো সে আব্বুকে ধরে চুপ করে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। যখনও সে শুতে আসতো, তখন হয়তো মেঘ জেগে গেলো ঘুম থেকে। এসব মিলিয়ে তার রেজাল্টকে কম্প্রোমাইজ করতে সে বাধ্য হল। ঢাকা ভার্সিটিতে তার মনমতো সাবজেক্ট সে পেলো না। অথচ তার মেধার কোন কমতি ছিল না আমরা সবাই জানি। তার শিক্ষরাও অবাক হলেন কি করে সে জিপিএ ফাইভ পেলো না। আমরা জানি কি করে পেলো না। কিন্তু আমরা কি করবো? আমাদের সবার তখন চাকরী আছে, সংসার আছে শুধু ছোটমা ছাড়া তাই সব স্যাক্রিফাইস তাকেই করতে হবে যে। তাই সে সাধের ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার আশা বাদ দিয়ে বিদেশী ইউনিতে ভর্তি হলো।

মেঘকে কেউ জিজ্ঞেস যদি করে, কে তোমার মা? সে চোখ বন্ধ করে জবাব দেয় ছোটমা। প্রথমে ভাবা হয়েছিল ছোটমার পরে বাড়িতে মেঘ প্রথম। তাই বুঝি দুজনের এতো টান। কিন্তু না, আমাদের তিন বোনের তিন বাচ্চারই মা হলো ছোটমা। আর এখনতো ভাইয়ের মেয়েটা স্কুল থেকে এসে প্রজাপতির মতো ওর গায়ে ঝাপিয়ে পড়ে। সব বাচ্চাদের আবদার কে মিটাবে, ছোটমা। স্বর্নের এতো দাম। কিন্তু ছোটমা সব ছেলেমেয়েদেরকে সোনার লকেট, দুল, আংটি গিফট দেন তাদের জন্মদিনে। অথচ আমরা এখনও নিজেকে বাদ দিয়ে অন্যের কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু ছোটমা নিজের টাকাটা পুরোটাই সন্তানদের দিয়ে দেন। এতো ব্যস্ততার মাঝেও টিউশিনি করে। চাকরীও করতো, অফিসে এসি নেই, এই কষ্টে চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। যদিও বস এসি লাগিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তার বন্ধু বান্ধব প্রায় নেই বললেই চলে। বানিজ্য মেলায়, ক্রিকেট খেলায় যায় ভাইয়ার সাথে। কে।এফ।সি খায় বাচ্চাদের নিয়ে। মাদার্স ডেতে সিনেমা দেখতে যায় মাকে নিয়ে। মার্কেটে ঘুরে বোনকে নিয়ে। ফ্রেন্ডরা অনেক উলটা পালটা মজা করে যা ওর ভালো লাগে না তাই ফেসবুকের মধ্যেই ফ্রেন্ডশীপ সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। মাঝে মাঝে হারমোনিয়ামের ধূলো ঝেড়ে কিন্নরী কন্ঠে যখন গায়,

চৈতালী চাঁদিনী রাতে, নব মালতীর কুঁড়ি

মুকুলও নয়ন মেলি সাথী জাগে আমারি সাথে

তখন গান বাজনা নিয়ে নাঁক সিটকানো লোকও তার পাশে বসতে বাধ্য হয়।

রাতে আমি, ছোটমা আর মেঘ একসাথে ঘুমাই বেশিরভাগ দিন। আসলে ঘুমাই না ছোটমা আর আমি রাত জেগে প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় কূটনামি, গালগল্প করি আর হি হি হি করি। অনেক সময় হিহিহি করতে করতে গড়াতে গড়াতে বিছানা থেকে নীচে পড়ে যাই। তখন ভয় লাগে নীচ তলার ভাড়াটে না কাল সকালে আব্বুকে কিংবা ভাইয়াকে নালিশ করে। রাত তিনটায় পঞ্চাশ কেজি ওজনের কি পড়ে তাদের মাথায়। আমাদের সে গালগল্পে পাশের বাসার নতুন ভাড়াটে ছেলে, যে নিজেকে আজকাল বেশ হিরো ভাবছে তার থেকে শুরু করে রোজ বাসায় যে মাছ দেয় সেও বিষয় হতে পারে। দেশে এলে জীহবা সামলাতে পারি না। রাস্তায় মাস্তায় যা দেখি খেয়ে ফেলি লোভে পড়ে। স্টমাক আপসেট কিংবা ফুড পয়জনিং টাইপ কিছু হবেই হবে দু একবার। ছোটমা হয়তো সারাদিন বোনের সাথে মার্কেট ঘুরে, বোনের বাচ্চাদের গোসল দিয়ে খাইয়ে, নিদারুন ক্লান্ত হয়ে একটু চোখ বুঝেছে। রাত তিনটায় আমি ওয়াক করা মাত্র সে, সেই গভীর রাত্রিতে সে ছুটবে বালতি আনতে, পানি আনতে। তাকে ঘুম থেকে ডাকতে হবে না, বলতে হবে না কিছু আর সময় লাগবে মাত্র এক সেকেন্ড। বমির তোড়ে যখন মনে হবে বেসিন ভেঙ্গে নিয়ে পড়ছি তখন এমন করে জড়িয়ে থাকবে যে পৃথিবী যাহয় হোক, সে আমাকে ছাড়বে না।

মা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর সবার আশ্রয় এখন সেই ছোটমা। আমাদেরকে দেখে, মেঘের কি সালোয়ার কামিজ লাগবে, আমি কি বই খুঁজতে বললাম, ব্যাঙ্কের হিসাব সব ছোটমা। মা বাবাকে দেখে, তাদের ঔষধ, প্রেশার, ডাক্তার সব ছোটমা। আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে দেখে, তাদের স্কুলে থেকে আনতে হবে, রাখতে হবে, সিনেমায় নিতে হবে কে ছোটমা। ভাড়াটিয়ারা কমপ্লেইন করবে কার কাছে, তো তার কাছেইতো। কাজের লোকের ঝামেলা, তাও ছোটমা। সংসারে ছোট হয়ে জন্মেছেন তিনি, কিন্তু সব দায়িত্ব হাসিমুখে মেনে নিয়ে শুধু দুহাত উজাড় করে দিয়েই যাচ্ছেন। নিচ্ছেন না কিছুই।

ছোটমা আমরা অনেক স্বার্থপর বটে কিন্তু তোমায় নিঃস্বার্থ ভালোবাসি জেনে রেখো।

তানবীরা

১৯.০৫.২০১১