Saturday 9 July 2016

ফিরিয়ে দাও, আমার প্রেম - আমার ঢাকা



কদিন ধরেই ক্রমাগত যা হয়ে যাচ্ছে দেশে তাতে সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি ফেরা ঘর্ম ক্লান্ত মাঝির মত মন বড্ড ক্লান্ত মনের সেই ক্লান্তি কর্কট রোগের মত এখন দেহেও ছড়িয়ে গেছে বেশ জন বলেছে, “আপনার একটা লেখা আশা করেছিলাম ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলেছি, লেখার মত মন নেই, আগ্রহ বা তাগাদাও অনুভব করি না ভেতর থেকে, লেখাকে তো আসতে হবে তাছাড়া সম্ভাব্য যা যা লেখা যায়, ফেসবুকে মোটামুটি সবাই তা লিখেও ফেলেছেন কিন্তু যে নীল কষ্টটা হৃদয়টাকে আঁকড়ে ধরে আছে সে তো পুরনো প্রেমের মত পিছু ছাড়ে না সকালের পূজোর ফুলের গন্ধে মিশে কিংবা সন্ধ্যার আহ্নিকে কাঁসার ঘন্টিতে ঘুরে ফিরে মনে আসে 

যেখানেই বেড়াতে যাই না কেন, লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, আমাস্টার্ডাম কিংবা ডিজনীল্যান্ড, মনের গহীনে ঘুরে ফিরে সেই কৃষ্ণ নাম, ঢাকা – ঢাকা – ঢাকা ... যেখানে হৃদয় গাঁথা, নাড়ি পোতা।

ঢাকা মানে ধানমন্ডি পাঁচ নম্বর, মহুয়া চটপটি, দিন মিলিয়ে নামা সেই নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায় ... আমরাও পথ হারা ক’টি তরুনী মিলতাম সেখানে, ঝাল, টক, ফুচকা-চটপটির নেশায়। সারাদিনের তাপদাহের পর মাত্র একটু ছায়া নেমেছে, গরম কমেনি তার মধ্যেই ঘেমে নেয় চলেছে আমাদের কাকলী। চারপাশে কি হচ্ছে তা আমরা থোড়াই কেয়ার করছি, আমরা তো ভেসে যাচ্ছি আমাদের সুরে – ছন্দে, আনন্দে – স্বপন কথাকলি ফুটবে কি ফুটবে না সেই ছায়া কাজল চোখে মেখে

বারিকিউ টুয়েন্টি, সাত মসজিদ রোডে ... যেয়ে বসলে আমাদের এনে দিতো তাদের ফুল তোলা থালা। অনেক সময় চারজনের জন্যে দু’রকমের থালা। আমরা থালার ফুলের ডিজাইন নিয়ে হাসতে হাসতে অস্থির হতাম, থালায় লেখাও খুঁজতাম, “যাও পাখি বলো তারে, সে যেনো ভোলে না মোরে” টাইপ কিছু। এমনও হয়েছে হাসির দমকে চেয়ার থেকে পরে ও গেছে কেউ ... সেখানে যারা খাবার পরিবেশন করতেন, কী ভয়ঙ্কর রাগী রাগী চোখের আমাদের দিকে তাকাতেন। তাদের রাগান্বিত ভাব ভঙ্গীতে আমাদের আনন্দ বেড়ে যেতো আরও কয়েক গুন। অন্যান্য টেবল থেকেও অনেকেই তাকাতো এ টেবলের দিকে ... এখানে এসে মিলেছে আজ দুষ্ট ক’টি মেয়ে ... নেহাত ... বের করে দিতে পারত না ... ভালবাসার মানুষেরা এক সাথে সবাই থাকলে কী সে না আনন্দ হয়

রবীন্দ্র সরোবরে নিয়ে মেঘ কে ছেড়ে দিলে, মেঘ দিকবিদ্বিক হারা হরিণ ছানা হয়ে একটা দৌড় দিতো। তার ভাব এমন, ও এসে গেছি আমার জায়গায়। হ্যাঁ, আমার আর মেঘের চিরপরিচিত প্রিয় সেই চত্বর। নাম না জানা কত ছেলে মেয়ে আমার মেঘের গাল টিপে আদর করে গেছে। মেঘের এমন গজগামিনী ভাব, আমাকে তো আদর করবেই। তা দেখে ওরাও হাসতো। সেই নানা বর্ণের ডিজাইন করা ছোট ছোট জুতো পায়ের আমার মেঘ, কত বড় হয়ে গেছে আজ। কিছু স্মৃতি মনে করতে পারে, কিছু পারে না। কিন্তু মায়েরা তো স্মৃতিতেই বাঁচে। রবীন্দ্র সরোবরে ক্লান্ত হয়ে গেলে ফেরার পথে ডিঙ্গি। এক সময় আমি আর মেঘ ছিলাম ডিঙ্গির পরিচিত মুখ। আমাদের দেখলেই সেখানকার লোকেরা এক গাল হাসি দিতেন।

ভাইয়া আম্মির জন্যে “কানের তুলো” বানাতো বড় করে। আব্বু সাভারে ছোট একটু বাগান বানিয়েছে, ছেলে মেয়েদের তাজা সব্জি করে খাওয়াবে বলে। আমরা সাভার যাবো, অনেক জোরে গাড়িতে গান বাজবে, আম্মি যেনো আপত্তি না করতে পারে, তাই ভাইয়ার পূর্ব সতকর্তা। আহা, ঢাকা টু সাভার ... পথ ভর্তি আনন্দ, দু হাতে কুঁড়াতে কুঁড়াতে, বিলাতে বিলাতে যাওয়া। সাভারের বাগানে ঘোরাঘুরি হয়ে গেলে, বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করতো না, মন ভর্তি বাকবাকুমচল যাই, গুলশানে আইসক্রীম খেতে। আমাদের পুরনো মডেলের গুলশানের বাসিন্দাদের তুলনায় কম দামী গাড়ি, ভাইয়া বেপরোয়া চালাতো। নাম দিয়েছিলাম আমরা “ভয় দেখানো” খেলা। আমাদের গাড়ি বদলানোর রাস্তায় পরে আছে, টাকা আর গাড়ির কম্বিনেশান মেলার অপেক্ষায়, কিছু গুঁতো ফুতো লাগলে সমস্যা নেই। গুলশানের নতুন মডেলের, দামী গাড়ির ড্রাইভারদের আতঙ্কগ্রস্ত চেহারা, গাড়ি নিয়ে কোথায় তারা চাপবে, আহা – আমাদের আনন্দ দেখে কে।

ঢাকা মানে বসুন্ধরা, এলোমেলো হাঁটা,
যা মনে চাওয়া-খাওয়া তারপর
অন্তত জলিলের মুভিতে প্রাণ ভরে হাসাহাসি।
পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূল
আর চারুকলা টি।এস।সি।
বাম্ববার কনসার্টে প্রিয় গানে সুর তোলা
হাতে হাত, চোখে চোখ, ভালবাসা-বাসি।
লং ড্রাইভে বাইরে যাওয়া সাথী আন্তাক্ষারী
সুখ সকল স্মৃতি দুহাতে হৃদয় মন ভরি

... এই আতঙ্ক জড়ানো, মৃত্যু শীতল যানজটে পূর্ণ উন্নত ঢাকা আমার মত অনেকের অপরিচিত এখানে সেই মন উড়ানো খোলা বাতাস কোথায় যা দিন কিংবা সন্ধ্যে উড়িয়ে নিয়ে যায় ... তরুন তরুণীদের কল কাকলি কোথায় যা শত না পাওয়ার মাঝেও বাঁচতে শেখায়।

ঢাকা জানি আমি বন্ধুদের সাথে ফুচকার টেবলে, কবিতা উৎসবে, কনসার্টে। ঢাকা জানি আমি রেস্টুরেন্টে বোনদের সাথে খুনসুঁটিতে, ভাইয়ের সাথে নিরাপদে পথ চলায়

ঢাকা বলতে যে ছবি মনে আসে, বাবার ছায়া, মায়ের আদর, ভাইয়ের স্নেহ মাখা প্রশ্রয়, চিরকালের আনন্দ বেদনার সাথী বোনেরা। ঘুড়ি ওড়ানো, বিদ্যুৎহীন গান গাওয়া সন্ধ্যা মাখা যে ঢাকা আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে, তা ফিরিয়ে দাও ... সেই নিরাপদ ঘর, সেই নিরাপত্তা ফিরে চাই ... বার বার। “প্রিয়মান ঢাকা”, তোমাকে সেই বেশ ফিরে চাই ...

০৮-০৭-২০১৬
তানবীরা




Friday 1 July 2016

বুনোলতা ১

তুমি বড্ড ভাগ্যবান শুভঙ্কর।

হঠাৎ এতো উদাস কেনো নীরা?

শুধুমাত্র সৌভাগ্যবানরাই ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়ের গ্রামে জন্মানোর সুযোগ পায়।

যেখানে অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুয়ে,
নির্ভয়ে নীলাকাশ রইবে নুয়ে

নীল আকাশের নীচে অসীম প্রান্ত ধরে দৌড়ে ফড়িং ধরবে, পুকুর বা নদীর অথৈ পানিতে অবাধ্য ঝাপাঝাপি করে সাঁতার কাটবে।

মন উদাস হলে খেয়া নৌকায় বসে বাঁশি বাজিয়ে চলে যাবে কোন গহীন প্রান্তরে, যেখানে গাছের লতা তাকে আড়াল করে রাখবে সারা পৃথিবীর নির্মমতা থেকে। হালকা লিলুয়া বাতাস লজ্জাবতী লতা হয়ে গা ছুঁয়ে যাবে আর বাঁশির করুন সে সুর উন্মনা করে তুলবে না দেখা কোন কিশোরীর শিমূল তুলো সম নরম হৃদয়কে

আমি নিতান্ত শহুরে মেয়ে, বদ্ধ দেয়ালে কেটে গেছে জীবন। খোলা আকাশ দেখেছি, বাড়ির জানালা দিয়ে। সবুজ পাতার সজীবতা ছুঁয়েছি টবে লাগানো গাছে। সাজানো গোছানো সে জীবনে প্রকৃতির উদ্দামতার ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে ...

গ্রামকে পাগলের মত ভালবাসি আমি।

গ্রামের বৃষ্টি কী সুন্দর হয়, জানো নীরা? একটানা মুষল ধারে ঝরে যেতেই থাকে। চারধারে যা ধূলো জমে থাকে তা কেটে প্রকৃতি হয়ে যায় একদম সদ্য জন্মানো শিশুটির মত নিস্পাপ আর পবিত্র। সবুজ পাতা ছুঁয়ে টপ টপ করে পরতে থাকে সেই জল। রাস্তা ঘাট জল কাঁদা মগ্ন। মাটি ছেড়ে উঠে আসে অদ্ভুত নাড়ি ছেড়া এক সোঁদা গন্ধ।

গ্রামের ছেলেরা কী করে জানো? এক সাথে সবাই ফুটবল খেলে। জল – কাঁদা মেখে খেলার সে কী উত্তেজনা। আমরাও খেলতাম মনসা পূজার সময়। গোটা পরিবার পূজো উপলক্ষ্যে এক হতাম।
একবার মনসা পূজায় তোমাকে নিয়ে যাবো আমাদের গ্রামের বাড়িতে। দোতলা বাড়ি, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। তোমার খুব ভাল লাগবে দেখো। কাকিমা – জেঠিমাদের সাথে তুমি উনোনের ধারে থাকবে, পাট ভাঙ্গা শাড়ি আর হাত রাঙা করে চুড়ি পরে। আমি ফুটবল খেলে সারা গায়ে কাঁদা মেখে এসে তোমাকে জড়িয়ে ধরবো .........

উচ্ছসিত শুভঙ্করের বন্য প্রতিশ্রুতিতে নীরা ভাল লাগায় মিশে গেলো। হারিয়ে গেলো সে না দেখা সেই গ্রামের তেপান্তরের মাঠে, বৃষ্টি, কাঁদায়। যেখানে ঝপ ঝপ করে ঝরে পরা বৃষ্টির জল পুকুরের বুকে মিলে মিশে লীন হয়ে যায়।

মধুর সে দৃশ্য কল্পনায় বিভোর নীরা কোন জবাব দিতে পারলো না

এখনো আকাশ যখন সব কিছু হারানোর বেদনায় ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে ... দিন রাত একটানা কান্নায় রাস্তা ঘাট সব প্লাবিত হয়ে যায়, নীরা জানালার গ্রীল, বারান্দার গ্রীল ধরে অপেক্ষা করে থাকে ......

একজন বলেছিলো, গায়ে কাঁদা মেখে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরবে --- সে দিনের অপেক্ষায় আমি আজও আছি

সে ভুলে গেছে ...।

সে ভুলে ভুলুক,
কোটি মন্বন্তরে আমি ভুলিব না,
আমি কভু ভুলিব না ।


তানবীরা
৩০/০৬/২০১৬