Friday 29 October 2010

মিলিনিয়াম দশকের ঢাকা-------- প্রবাসীনির চোখে

২০০০ সালে নতুন দশকের সাথে সূচনা হয় নতুন সহস্রাবব্দের। সারা পৃথিবী জুড়ে এনিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নিরানব্বই – দুই হাজারে বাংলাদেশের অনেক দোকান পাটের নাম হয় এই অনুসারে। ঢাকার নিউমার্কেটে চলে আসে “মিলিনিয়াম বিরানী হাউজ”। নামকরনের এই ব্যাপারটি বাংলাদেশে ইউনিক। চায়নীজ রেষ্টুরেন্টের নাম ‘ম্যাকডোনাল্ডস”, চুল কাটার দোকানের নাম “কাসাব্লাংকা হেয়ার কাটিং”, জিগাতলায় আছে “সুনামী রেষ্টুরেন্ট”। যেকোন জিনিস যেকারনেই আলোচিত তার দ্বারাই কিছু না কিছু দেশে নামাংকিত। বুশ আর সাদ্দামের যুদ্ধের কারনে সে সময়কার জন্মানো প্রচুর ছেলে শিশুর নাম “সাদ্দাম”। আর একটি জিনিস আমার বাংলাদেশের খুব মনে ধরে রাস্তার দুপাশে মনোরম সব বিলবোর্ড। এ জিনিসটি আমি খুব একটা বাইরে দেখিনি দক্ষিন এশিয়া বাদে। পশ্চিমে থাকে খুবই ছোট সাইজের সামান্য বিজ্ঞাপন, কিন্তু প্রকট রঙ ব্যবহার করে, পেল্লায় সাইজের এই বিলবোর্ড একান্তই দক্ষিন এশিয়ার গৌরব।

এই গৌরবজ্জল সহস্রাবব্দের সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে খুবই কলঙ্কজনকভাবে। থার্টি ফার্ষ্ট নাইট উদযাপন করতে অনেক ছেলেদের পাশাপাশি কিছু মেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বের হয়েছিল। সেখানে “বাঁধন” নামে এক তরুনীকে প্রকাশ্যে লান্থিত করা হয়। যার কারনে তার ব্যক্তিগত জীবন প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, তার সেই সময়ের বাগদত্তা তাদের বাগদান ভেঙ্গে দেন। ২০১০ সালে অপরাধ প্রমানিত না হওয়ায় সেইদিনের সব অপরাধীকে আদালত মুক্তি দেন। সমন জারী করা সত্বেও একদিনও বাঁধন আদালতে আসেননি, শুনানীতে কিংব সাক্ষ্য গ্রহনে অংশগ্রহন করেননি। পৃথিবী জুড়ে যে সহস্রাবব্ধের সূচনা হয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে, সেখানে বাঁধন নিজের ওপর হয়ে যাওয়া অন্যায়টুকুর প্রতিবাদ করার সাহস পাননি নিজ দেশে।

এই দশকে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে তার ডাবল হ্যাট্রিক অর্জন করে বিশ্বজোড়া অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন থাকে। মধ্যবিত্তের জীবন ধারায় প্রভূত পরিবর্তন ও উন্নতি দেখা যায়। প্রায় বাড়িতেই রঙীন টিভি, ডীপ ফ্রিজ, এসির মতো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী সাধারন ঘটনায় পরিনত হয়। প্রায় সবার হাতে হাতেই মোবাইল। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার মোবাইল – টিভি এগুলো তখন মধ্যবিত্ত নয় নিম্নবিত্তের হাতে পৌঁছে গেছে। প্রায় প্রতি মধ্যবিত্ত ঘরেই কম্পিউটার বর্তমান। এবং আধুনিক জেনারেশন ব্যাপকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহারও করছেন। আগের মতো সিদ্ধ করে পানি ছেঁকে ঢালার পরিবর্তে বাড়িতে বাড়িতে ফিল্টার মেশিনের প্রচলন হয়। ঢাকায় বসুন্ধরা - শর্পাস ওয়ার্ল্ড এর মতো শপিং মল এসেছে মধ্যবিত্তের জীবনে। সারা গুলশান – ধানমন্ডি ভরে গেছে বাহারী ইংরেজী, বাংলা নামের আধুনিক ও অভিজাত রেষ্টুরেন্টে। বিশ্ববিখ্যাত ফার্ষ্ট ফুড চেইন কেন্টোকী ফ্রাইড চিকেন, পিজা হাট তাদের বাংলাদেশের প্রথম দোকান খুলেন গুলশানে। বুমারস এর মতো রেষ্টুরেন্ট ছাত্র ছাত্রীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিংস বেকারী ব্রাউন ব্রেড নিয়ে আসেন ঢাকার বাজারে। আগে মাছওয়ালা, মুরগীওয়ালা শুধু বিক্রি করেই চলে যেতেন। এখন তারাও বাড়তি সেবা প্রদানে মনোযোগী হয়েছেন। বিক্রির পর মাছ – মুরগী কেটে দিয়ে যান। সারা দেশ জুড়েই ফার্মের মুরগী খাওয়ার প্রচলন হয় দেশি মুরগীর পাশাপাশি।

এই দশকে আবারো জলপাই রঙধারীরা প্রায় দুবছর দেশ শাসন করেন। বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট আকার ধারন করে এই দশকে। বিদ্যুৎ সমস্যা, পানির সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, অসহ্য যানজট নিয়ে চলেছে এই দশকের মধ্যবিত্তের জীবন। বিদ্যুৎ সমস্যার আপাত সমাধান বের করেন মধ্যবিত্তরা আইপিএসের মাধ্যমে। শনির আখড়ায় ২০০৬ সালে অতিষ্ঠ এলাকাবাসি তাদের জনপ্রতিনিধিকে ধাওয়া করেন এক পর্যায়ে। বাংলা ভাই নামের এক সন্ত্রাসীর উত্থান ঘটে এবং হাজার নাটকের মাধ্যমে তাকে সরকার গ্রেফতার দেখিয়ে এই নাটকের আই ওয়াশ সমাপ্তি ঘটান। একযোগে ৬৩টি জেলায় বোমা বিস্ফোরনের ঘটনাও এদশকেই ঘটে। ২১শে আগষ্ট ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ঘটনার তদন্ত কাজ চলছিল। তবে এই দশকে বংগবন্ধু হত্যা মামলার আসামীদের সাজা হয় আর জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়। রমনা বটমূলে নতুন বছরের প্রথম প্রহরে সন্ত্রাসীরা বোমা হামলা করে। বোমা বিস্ফোরন, বিল্ডিং ধ্বসে মৃত্যু, অগ্নিকান্ডে মৃত্যু, হত্যা সর্বোপরি অপমৃত্যুর হার এই দশকে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়ায়। যারই অপমৃত্যু হোক না কেনো, যেকোন কারনে তার সুবিচার পাওয়া বাংলাদেশে অসম্ভব এটাও এই দশকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

আনিসুল হকের লেখা আর মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী এর পরিচালনায় ব্যাচেলর নামক ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয় মধ্যবিত্ত দর্শকদের কাছে। ব্যাচেলর সিনেমার ভাষারীতির দ্বারা তরুন সমাজ ব্যাপক প্রভাবিত হন। প্রমিত ভাষার পরিবর্তে উঠতি লেখকরাও ফারুকী ভাষা ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। নগর জীবনে, স্কুল কলেজে, নাটকে, সিনেমায় এই ভাষাটির প্রচলন শুরু হয়। সুশীল সমাজে এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের জীবনের কোথাও এই ভাষারীতিটি রয়ে যায়। তিশা, শ্রাবন্তী, তিন্নি, প্রভা, অপূর্ব, শাহেদ, হাসান মাসুদ, অপি করিম এরা এসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রী। আনিসুল হকের লেখা ধারাবাহিক ৬৯, ৫১, দৈনিক তোলপাড় মধ্যবিত্তের কাছে ব্যাপক প্রশংসা পায়। সেই সময় নাটকেরও গ্রুপ তৈরী হয়। হুমায়ূন আহমদের গ্রুপ, সালাহউদ্দিন লাভলু গ্রুপ, আনিসুল হক গ্রুপ ইত্যাদি। প্রত্যেক গ্রুপের কিছু ফিক্সড অভিনেতা অভিনেত্রী ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ মানেই শাওন, সালাহউদ্দিন লাভলু মানেই তানিয়া আর ফারুকী মানেই তিশা। এ সময়ের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক ছিল ৪২০, লাবন্যপ্রভা, রঙের মানুষ।

লেখালেখির জন্য ব্লগ মাধ্যমটিও ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সামহোয়ারইন নামক বাংলা ব্লগটি প্রথম বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতিষ্ঠিত ব্লগ। অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক সাংবাদিক প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি অন্তর্জালেও লেখালেখি শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, হাই ফাইভ, অর্কুট, টুইটার, গুগল বাজ এগুলোর বিশদ ব্যবহার ঢাকাবাসী শুরু করেন। মোবাইলের মাধ্যমে অন্তর্জাল ব্যবহার করাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এসময়। মিলা, তিশমা, আনুশেহ, শাহরিয়ার জয়, অর্নব, বাপ্পা, পার্থ, হাবিব, বালাম, তপু, তাহসান এরা সেসময়ের জনপ্রিয় গায়ক গায়িকা। দেশি কাপড় ব্যবহার করে দেশে তৈরী পোশাক তখন তারকাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। ফ্যাশন হাউজ রঙ, ড্রেসিড্যাল, ইনফিনিটি, স্মার্টেক্স, বাংলার মেলা, মায়াসীর, দর্জি, মান্ত্রা এরা নিজেদের ডিজাইনের স্বাতন্ত্র্যের কারনে মধ্যবিত্তের মন কাড়েন। মধ্যবিত্তকে ভারত থেকে বাংলাদেশমুখী করে তুলেন এই ফ্যাশন হাউজগুলো। অনে্কে বিয়ের উৎসবের জন্যেও দেশি ফ্যাশন হাউজের ওপর নির্ভর করতে লাগলেন। পাটিয়ালা সালোয়ার নামক অনেক কুচি দেয়া পাঞ্জাবী সালোয়ার ২০০৪ – ২০০৫ এর দিকে খুব জনপ্রিয় ছিল। আবার সেই সময় ওপরে কলার তোলা বান্টি বাবলী কামিজের ডিজাইনও হট কেক ছিল। যদিও বিভিন্ন সময় ভীর জারা থ্রীপিস, লাক্ষৌ চিকেনের কাজ করা থ্রীপিস, চুন্দরী থ্রীপিস, কটকী থ্রীপিস ঘুরে ঘুরে ফ্যাশনে ছিলো। এ সময়ে কিশোরী তরুনীদের কাছে জীন্স ফতুয়া বেশ জনপ্রিয় ছিল। আধুনিক ছেলেরা অলঙ্কার পরা শুরু করেন এ দশকে। হাতে নানা ধরনের ব্রেসলেট, গলায় মালা সহ অনেককেই দেখা যেতো। অনেক ছেলেই রঙীন পাঞ্জাবী ও ফতুয়া পরতেন।

গয়নায়ও আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। হাল ফ্যাশনের গয়নার পরিবর্তে আগের দিনের ভারী ভারী সেকেলে গয়নার ডিজাইন বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রুপোর গয়নায় সোনার জল দিয়ে তাতে নানা রঙের ম্যাচিং পাথর বসিয়ে মেয়েরা পরতে লাগলো। সোনার বদলে রুপো হয়ে ওঠলো মধ্যবিত্তের অলংকার। বিয়ের সাজেও আগের মতো প্রচুর ফেস পেন্টিং বাদ গেলো। হাত ভর্তি করে কনুই পর্যন্ত মেহেদী দেয়া হতো বিয়ের কণেদের। অনেকে পায়েও দিতেন। কনেরা লালের পাশাপাশি অন্য রঙের কাপড়ের ব্যবহার শুরু করলেন বিয়েতে। অনেক সময়ই দেখা যেতো বর কনে রঙের সামঞ্জস্য করেই কাপড় পরেছেন। বরদের শেরোয়ানী, পাগড়ী প্রভৃতিতে মুম্বাইয়ের লেটেষ্ট মডেলের ছাপ দেখা যেতো। বিয়েতে আলাদা আলাদা কোনে ছেলে মেয়েকে আলাদা করে বসানোর পরিবর্তে, বরকনেকে পাশাপাশি চেয়ারে বসানোর রেওয়াজ শুরু হলো। গায়ে হলুদে গান নাচের প্রচলন হয় ব্যাপক ভাবে। মধ্যবিত্ত মেয়েরা প্রচন্ড ত্বক, রুপ সচেতন হয়ে ওঠে সে সময়। প্রায় প্রতি পাড়ায় মোড়ে বিউটি পার্লার দেখা যেতো এসময়টায়। অনেক মধ্যবিত্ত মেয়েরা নিজেরাও এ ব্যবসার প্রশিক্ষন নিয়ে বিউটি পার্লার চালাতে উদ্যেগী হন, তাতে করে বিউটি পার্লার মানেই চায়নীজ কিংবা হংকং এ ধারনাটা পালটে যায়। ক্লান্তিময় নগরজীবন থেকে অব্যহতি পেতে অনেকেই ঈদের ছুটি ছাটায় সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা কিংবা সুন্দরবনে বেড়াতে যেতেন।

মোবাইলের ব্যবহারের কারনে কিংবা অন্তর্জালের সহজ লভ্যতার জন্যেই হোক আশঙ্কাজনকভাবে পরকীয়া প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। এজন্য অনেকে সন্তানের জীবন নিতেও পিছপা হননি। সাহসী কিছু ছেলে মেয়ে এসময় লিভ টুগেদার করতেন। ইভ টিজিং এর ঘটনায় মেয়েদের আত্মহত্যার হার যেকোন দেশের যেকোন কালের রেকর্ড ছাড়ায়। কিন্তু সবচেয়ে আর্শ্চয্যের ব্যাপার হলো এনিয়ে সুশীল সমাজ বিশেষ করে মহিলা মহল একে বারেই চুপচাপ ছিলেন। তাদেরকে কোন ধরনের মানব বন্ধন, প্রতিবাদ সভা, নিদেন পক্ষে পত্রিকায় দু একটা কলাম লিখতেও দেখা যায়নি।

২০১০ সালের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টে পূর্ববর্তী সরকার থেকে পাওয়া ১৬৮ কাঠা আয়তনের সুরম্য প্রাসাদ থেকে সেনাবাহিনী বের করে দেন। জননেত্রী কেনো সেনাবাসে থাকবেন এবং প্রচন্ড ধনী হওয়া সত্বেও কেনো তিনি সরকারী সম্পদ এখনো ভোগ দখল করবেন এই ছিল তখনকার সবার যুক্তি। ২৯শে নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ে তিনি আইনি লড়াইয়েও হেরে যান এবং বাড়িটির দাবী তাকে আপাতত ছাড়তে হয়।

তানবীরা

৩০।১০।২০১০

Thursday 21 October 2010

৯০ এর ঢাকা ---- মধ্যবিত্তের চোখে

নব্বইয়ের ঢাকায় বাচ্চারা স্কুলে টিফিনে খেতো বোম্বে সুইটসের রিং চিপস, বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া ফুজি নুডুলস, কিংবা কেনা বার্গার। নানাধরনের উন্নত মিল্ক চকোলেট, ক্যাডবেরীও তখন বাচ্চাদের মেনুতে খুব জনপ্রিয়। সেসময় ঢাকায় মধ্যবিত্তদের কাছে আসে পিজা, শর্মা, হেলভেসিয়া মানে ফ্রাইড চিকেন। এর আগে বাইরে খেতে যাওয়া মানে ছিলো চায়নীজ কিংবা কাবাব। সেই সময় চায়নীজ রেষ্টুরেন্টের লোকেরা সিচুয়ান ষ্টাইল, থাই এগুলো নিয়ে আসেন। যদিও এখনো আমি ঢাকার চায়নীজ, সিচুয়ান ষ্টাইল আর থাই রান্নার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য করতে পারি না। ডলসি ভিটার আইসক্রীম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ এগুলো জনপ্রিয়তা পায়। ছোট ছোট আইসক্রীম পার্লার, ফাষ্ট ফুডের দোকান গজিয়ে ওঠার সময় সেটা। গুলশানে একটি ফাষ্ট ফুডের দোকান হলো তখন “হট হাট” যাতে সেই সময়ের হট গার্লস আর বয়েসরা যেতেন। আর ধানমন্ডিতে ছিলো “খাই খাই”। ওয়েষ্টার্ন গ্রীলের জনপ্রিয়তাও তখন বেশ তুঙ্গে। উত্তরাতে লেকের মধ্যে বোটিং আর তারপর কাবাব খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। লিটার কোকের বোতল এবং লিটার বক্সের আইসক্রীম মধ্যবিত্তের ডাইনীং এ তখন অনেক স্বাভাবিক একটি ঘটনা। নিউমার্কেট গাওছিয়া্র খাবারের দোকানের কল্যানে অনেক মহিলারাই তখন বীফরোল, চিকেন প্যাটিস, জ্যামরোল, ভেজিটেবল রোল এগুলো শিখতে আগ্রহী হলেন। প্রায়ই নানা জায়গায় রান্নার কোর্স দেয়া শুরু হলো। আগ্রহী অনেক মহিলাই তখন এধরনের খাবার দোকানে সাপ্লাই দিয়ে সংসারের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়েছেন।

ক্রিকেট তখন খুবই জনপ্রিয় খেলা বাংলাদেশে। বিরানব্বই সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলা টিভিতে দেখানো হচ্ছিল। পাকিস্তানী খেলোয়ার ইনজামামুল হক সেসময় তার আনপ্রেডিকটেবল ব্যাটিং এর জন্য খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মধ্যবিত্তের কাছে ভারতীয় – পাকিস্তানী ক্রিকেট খেলোয়াররা সবসময়ই জনপ্রিয়তার দিক থেকে অষ্ট্রেলিয়ান ইংলিশদের থেকে এগিয়ে। সেসময় থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিকেও খেলোয়ারদের নজর পরতে থাকে। ৯৭ এর আইসিসি ট্রফি জয়ের মতো উৎসবমুখর মুহূর্ত বোধহয় দেশে কম এসেছে। এবং নিরানব্বই সালে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহন করে। ক্রিকেটের পরে ফুটবলতো ছিলই। আবাহনী আর মোহামেডান ক্রেজ তখনও মধ্যবিত্তের হৃদয়ে। আজকাল যেমন ক্রিকেট ছাড়া অন্যকোন খেলা নিয়ে ঢাকায় আলোচনা হয় না সেরকম দুরবস্থা তখনো ফুটবলের হয়নি। আশির দশক থেকে অনেক দিন নিয়াজ মোর্শেদ বাংলাদেশের দাবাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংগনে তুলে রাখেন। সাতার আর শ্যুটিং নিয়েও তখন অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রাংগনে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

বাংলাদেশের সিনেমার বেহাল দশাকে ঠিক করতে তখন কেউ কেউ আর্ট ফ্লিমের সাথে সাথে মূলধারা সিনেমাতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই আগ্রহের সূত্র ধরেই তখন জনপ্রিয় ভারতীয় সিনেমা কেয়ামত সে কেয়ামত তাক এর বাংলা অনুবাদ তৈরী হয়, কেয়ামত থেকে কেয়ামত। মৌসুমী ও সালমান শাহ এর মতো সুন্দর, স্মার্ট ও গুনী শিল্পীর অভিষেক হয় আমাদের দেশের চলচিত্রশিল্পে। হাস্যকর মেকাপ, ড্রেসাপ, চুলের ষ্টাইলের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করেন এই দুই অভিনেতা অভিনেত্রী। প্রচুর মধ্যবিত্ত দর্শক সিনেমা হলে ফিরে যান এছবিটি দেখার জন্য। অনেক শিক্ষিত ছেলে মেয়ে সিনেমাকে পেশা হিসেবে নেয়ার চিন্তা করেন। মৌসুমী আর সালমান পরিনত হন সকল কিশোর – যুবতীর হার্টথ্রবে। ছিয়ানব্বই সালে অপ্রকাশিত কোন কারনে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেন, তিনি তখন এতোটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তার মৃত্যুর দুঃখ সইতে না পেরে তার ভক্তও আত্মহত্যা করেন। সালমান মৌসুমীর পরেই ফেরোদৌস রিয়াজ এদের অভিষেক ঘটে। বাংলা সিনেমা যা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো তা শেষ থেকে আবার শুরুর দিকে হাটতে শুরু করে।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে ক্যাবল টিভির আগমন ঘটে। অনেকের বাসার ছাদেই তখন খুব সুন্দর বড় ডিশ এন্টিনা দেখা যেতো। অনেক সময় ছাদে কাউকে এন্টিনা ঘোরাতেও দেখা যেতো। তবে যাদের এন্টিনা ছিলো না তাদের জন্য বিটিভির মাধ্যমে প্রথমে সিএনএন তার সস্প্রচার শুরু করে। মধ্যবিত্তের জন্য আসে অন্যধরনের সমাধান। ভিডিও ক্লাবগুলো নিজেরা বিশাল ক্যাপাসিটির এন্টিনা কিনে বাসায় বাসায় মাসিক একটা মাসোহারা ঠিক করে ক্যাবল টিভির লাইন দিতে লাগলেন। এরপর ভারতীয় টিভি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, ডিস্কোভারী, কার্টুন নেটওয়ার্ক সবই মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে চলে এলো। এর প্রচন্ড প্রভাব পরলো মধ্যবিত্তের জীবন যাত্রায় বিশেষ করে পোষাক শিল্পে। শাড়ির মার্কেট আর পোষাকের ডিজাইন ভারতীয় টিভিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে লাগলো সাথে সাথে মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে জীন্স, টিশার্ট, স্কার্ট, লংড্রেস অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেলো। যারা বাইরে যেতেন শপিং করতে তাদের বাদে মধ্যবিত্ত বাকি সবাই বংগবাজার, দোজা ইত্যাদি মার্কেট থেকে তাদের চাহিদা মেটাতেন। মুম্বাই টিভির কারনে হেয়ার স্টাইলে ডায়ানা-কাট, মাধুরী-কাট ছিল দেখার মতোন বেশি, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে সামনে ছোট কিন্তু ঘাড় ছাড়াইয়ে চুল রাখা যা কিনা সঞ্জয় দত্তের স্টাইল ছিল অনেক দেখা যেত, ৯২-৯৩এর দিকে ছেলেরা জিনস আর কেডসের সাথে ব্যাপকহারে চুলে রাহুল কাট প্রয়োগ শুরু করে। মেয়েদের প্রসাধন ও রূপচর্চা একটা টপিক্যাল বিষয়ে পরিণত হয়। দশকের শেষদিকে চ্যানেল আই শুরু হলে কানিজ আলমাস আর ফারজানা শাকিল টিভিতে রুপচর্চার ব্যাপারে প্রচুর অনুষ্ঠান করেন।

ভারতীয় শাড়ি আর থ্রীপিসের সাথে প্রতিযোগিতা করে তখন দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। ভারতীয় কাপড় মানেই স্ট্যাটাস আর স্টাইল এধারনাটা কিছুটা তখন মার খায়। শুধু মেয়েদের জামা কাপড়ই নয় ফ্যাশন হাউজগুলো তখন ছেলেদের জন্যও ভালো ভালো পাঞ্জাবী তৈরী করছেন। তাদের তৈরী বিভিন্ন ফ্যাশনের গয়না, জুতো, ঘর সাজানোর জন্য বিভিন্ন রকমের কাঁথা স্টীচের, এপ্লিকের, বাটিকের চাদর, কুশন কভার তখন মধ্যবিত্তের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। বিবিয়ানা, আড়ং, নিপুন, ভূষন, ভুবন, প্রবর্তনা এরা সেসময়ের উদাহরন। বিভিন্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো তখন ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। তাদের এই আয়োজন ও পুরস্কার বিতরন ফ্যাশন হাউজগুলোর ঈদের বিক্রিকে অনেকটাই প্রভাবিত করতো।

সেই ক্যাবল টিভির যুগেও হুমায়ূন আহমেদের “কোথাও কেউ নেই” ধারাবাহিক নাটকটি মধ্যবিত্ত দর্শকদের প্রচন্ডভাবে আকর্ষন করে। এই নাটকটি নিয়ে মিছিল পর্যন্ত হয় ঢাকায়। বাকের ভাইয়ের চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর আর মুনা চরিত্রের সুর্বনা তখন ঢাকায় খুব জনপ্রিয়তা পান। পাড়ায় পাড়ায় বাকের ভাইদের মধ্যে লাল শার্ট পরার একটা প্রবনতা চোখে পরে সাথে চোখে কালো রোদচশমা আর হাতে নানা ধরনের ব্রেসলেট। নব্বইয়ের দশকে জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, তৌকির নতুন প্রজন্মের প্রতীক ও আর্দশ ছিলেন। নোবেল- ফয়সা্লের বিজ্ঞাপন নিয়ে হৈহুল্লোড় শুরু হয়। তখনই হঠাৎ করে এক পর্বের নাটকের বদলে খন্ড নাটক বানানোর হিড়িক পরে। নাটক নিয়ে অকারনেই বাইরের লোকেশনে যাওয়া, নাটকে গান ঢুকিয়ে দেয়া এগুলোর শুরু হয়। বিটিভি ডিশের প্রভাবে প্যাকেজ প্রোগ্রাম নামের রেডিমেড কিছু কিনতে শুরু করে। তবে সে সময় ঢাকায় খুব ভালো ভালো মঞ্চ নাটক হতো। জাহিদ হাসান অভিনীত “বিচ্ছু” দেখার জন্য টিকিট পাওয়া মুশকিল ছিলো। হুমায়ূন আহমেদের লেখা “মহাপুরুষ”, তারিক আনামের পরিচালনায় “কঞ্জুস”, হাতহদাই, রক্তকরবী ইত্যাদি নাটকগুলো তখন মহিলা সমিতি আর গাইড হাউজে মঞ্চায়িত হতো। সে সময় টিভিতে ইংলিশ সিরিয়ালের পাশাপাশি এশিয়ান সিরিয়াল দেখানো শুরু হয়। এরমধ্যে অনেকগুলো খুবই দর্শক নন্দিত হয়েছিলো। একটির নাম মনে পড়ছে “এগেইনষ্ট দ্যা উইন্ড”। এর হিরোর নাম ছিল সম্ভবত, “ক্যানি”। আমার আর আমার ছোট বোনের দুইজনের হিরো। আমরা দুইবোন রোজ, ও আমার ও আমার বলে ঝগড়া করতাম, আমি গানও গাইতাম ক্যানি আমার ক্যানি, আমার প্রিয় ক্যানি, ক্যানি আমার চাই। আমার দাদু তেড়ে ওঠতেন তার নামাজের বিছানা থেকে, তোর লজ্জা নাই বলে। চশমা পরা দুঃখী দুঃখী চেহারার শুটকো হিরো ছিল “ক্যানি”। নব্বইয়ের দশক থেকেই বিটিভি তাদের সারাদিনের সম্প্রচার কাজ শুরু করেন। , ঈদে একটানা তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান দেখানো তখন থেকেই শুরু হয়। টিভিতে বাংলায় ডাবিং করা সিরিয়াল প্রচারের সূচনা হয় এ দশকে। প্রথমে সোর্ড অফ টিপু সুলতান।লাইন ধরে বিচিত্র বাংলায় ডাবড হয়ে আসতে থাকে ডার্ক জাস্টিস, আকবর দ্য গ্রেট, থিফ অফ বাগদাদ, সিন্দাবাদ, রবিন হুড ইত্যাদি। সিন্দাবাদের মিভ আর রবিন হুডের মেরিঅ্যানের পোশাকের নেকলাইন বিটিভি-নির্ভর মধ্যবিত্ত চোখকে বড় ধরণের ঝাঁকুনি দেয়। তবে মূলত গৃহকর্মীদের কারণে সবাই যেটা দেখতে বাধ্য ছিলেন তার নাম অ্যারাবিয়ান নাইটস বা আলিফ লায়লা। জাপানি সিরিয়াল "ওশিন" তুমুল হিট ছিল তখন।

টিভি তখন মধ্যবিত্তজীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে। অভিনেতা শাহরুখ খান থেকে ক্রিকেটার ইমরান খান, মাধুরী দীক্ষিত থেকে জেনিফার লোপেজ এর ছবি তখন নিউমার্কেটে ত্রিশ টাকা দরে বিক্রি হতে শুরু করে। কারো বাড়িতে গেলে কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজ়ন নেই কে তোমার পছন্দের হিরো কিংবা খেলোয়ার। দেয়াল ভর্তি ভর্তি সাটা আছে টম ক্রুজ কিংবা রিকি মার্টিন। মধ্য নব্বইয়ে ওয়াকিটকির মতো বিশাল সাইজের মোবাইল ফোন তখন ঢাকার কিছু মধ্যবিত্তের হাতে ঘুরছে। যদিও নেটওয়ার্ক বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তখন মোবাইলের জন্য খুবই অপ্রতুল কিন্তু অনেকটা শোঅফ বা স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে মোবাইল যন্ত্রটি কারো কারো হাতে ঘুরতো। নব্বইয়ের শেষ দিকে অবশ্য অনেকেই মোবাইল ব্যবহার করতে শুরু করেন। ভ্যালেইন্টাইন ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, পহেলা ফাল্গুন এধরনের দিনগুলো উৎসব রূপে ঢাকায় নব্বই এর দশকেই জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশের একমাত্র ছুটি কাটানোর জায়গা কক্সবাজার সেসময় মধ্যবিত্তের কাছে ধরা দিলো। বিভিন্ন কারনে – অকারনে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘট ঘট কক্সবাজার ছোটা তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। নব্বই দশক থেকে ফ্ল্যাট কালচারের প্রচলন শুরু হয়, মার্কেট কালচারেরও। নিজেদের বাড়িঘর ভেঙ্গে ফ্ল্যাট বানানো আর রাস্তার পাশে বাড়ি হলে তাকে মার্কেট বানানো। প্রথমে ফ্ল্যাট মধ্যবিত্তদের ব্যাপার থাকলেও পরে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীতে এটা মহামারীরুপ নেয়। ফ্ল্যাটের কল্যানেই অনেক উচ্চ মধ্যবিত্ত তাদের আবাসস্থান পরিবর্তন করে গুলশান ধানমন্ডিতে নিজেদের আবাসিত করেন।

ঢাকায় বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তখন খুব ওপেন এয়ার কনসার্ট হতো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে নবীন বরন উৎসব, ইডেনের নবীন বরন উৎসব, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি উৎসবগুলো ছিল মূখ্য। ছেলেদের কলেজে মেয়েদের যাওয়া মানা হলেও ছেলেরা মেয়েদের কলেজের কনসার্টের সময় আশপাশে ঘুরঘুর করতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিল, একবার বি।এন।পি থেকে নবীন বরন দেয়া হতো, একবার আওয়ামীলীগ থেকে আর একবার থাকতো নিজস্ব বিভাগের তরফ থেকে। আওয়ামী আর বি।এন।পির মধ্যে আবার একটা প্রতিযোগিতা থাকতো কারা কতো দামী ব্যান্ডকে আনতে পারে। আমাদের সময় নিজস্ব নবীন বরন ছাড়াও পরস্ব নবীন বরনের কনসার্ট উপভোগ করার একটা রেওয়াজ চালু ছিলো। সেসুবাদে কোচিংমেট, কলেজমেট, স্কুলমেট, পাড়ামেট কে কোথায় ভর্তি হলো তার একটা খোঁজ পাওয়া যেতো। মাগনায় নির্মল বিনোদনের এরচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় আমাদের তখন জানা ছিল না। সংবাদপত্র জগতে বিষয়বৈচিত্র্য, রুচি সবকিছু মিলে ব্যাপক নতুনত্ব দেখতে পায় পাঠক। প্রিন্ট মিডিয়ায় কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগের ব্যাপারটির সঙ্গেও আমাদের পরিচিতি ঘটে এই দশকে। পত্রপত্রিকার পাঠক সংগঠনগুলো সৃজনশীলতা চর্চা শুরু করেন।

সেই সময় সারা ঢাকা শহর জুড়ে ব্যাঙ এর ছাতার মতো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পাশাপাশি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও গজাতে শুরু করলো। বড়লোকের ছেলেমেয়েরা বিদেশি লেটেষ্ট মডেলের গাড়িতে চড়ে ব্যাঙ্কক সিঙ্গাপুরী ব্র্যান্ডের সানগ্লাস চোখে দিয়ে সেখানে পড়াশোনা শুরু করে দিল। আমাদের যাদের মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সামর্থ্য নেই, তারা ষোল থেকে বিশ হাজার ছাত্র ছাত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উলটা ভাব নেয়ার চেষ্টায় থাকি, ঢাকাতে যারা কৃতকার্য হয় না তারাই প্রাইভেটে পড়তে যায়। বলাতো যায় না রোজ বিশ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচানোর জন্য ইউনিভার্সিটির বাসে করে বাড়িতে চলে আসি আর সেই টাকায় টি।এস।সিতে দুপুরে একপিস ছোট মাংসের টুকরা দেয়া তেহারী আর কোক খেয়ে পাবলিক লাইব্রেরীতে গুলতানি করি। তখনই আন্ডারগ্রাডদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার ট্রেন্ড শুরু হয়। আগে জানতাম লোকে পি।এইচ।ডি, এম, এস, পোষ্ট ডক করতে বিদেশে পড়তে যায়। কিন্তু সাধারন অনার্স, বিবিএ, কম্পিউটার সাইন্স মার্কা সাবজেক্টে অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, লন্ডন, এ্যামেরিকা নিদেন পক্ষে ইন্ডিয়া যাওয়ার চলও সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এম সি কিউ পদ্ধতি চালু হয় বিরানব্বইল সাল থেকে।

নব্বই দশকের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো ঢাকার জন্য “এরশাদ সরকারের পতন”। প্রতিবার ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে এরকম একটা হরতাল, আন্দোলন, কার্ফিউ এর ঘটনা ঘটতো। এটা শীতকালে স্বাভাবিক বলে আমরা তখন জানতাম। ঢাকায় বন্যা আর হরতালের কারনে স্কুলে বিরাট ছুটি পাওয়া যেতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করবে, কেউ কেউ মারা যাবে, ছাত্ররা বাস পুড়িয়ে দিবে, এরশাদ মানুষের মিছিলে ট্রাক তুলে দিবে। তখন কিছুদিন স্কুল বন্ধ থাকবে, পরীক্ষার ডেট চেঞ্জ হবে, আব্বুরা বাসায় থাকবে আমরা ইচ্ছেমতো দুষ্টামী করতে পারবো না, কিন্তু আব্বু বাসায় থাকা উপলক্ষ্যে ভিডিও ক্লাব থেকে ভালো ভালো সিনেমা আনা হবে, পড়তে হবে না কারন পরীক্ষা অনিশ্চিত। আর আম্মি ভালো ভালো রান্না করবেন। যেকোন সময় যেকোন এ্যাডভাঞ্চার প্রিয় মেহমানও আসতে পারেন এই গলি, সেই গলির চিপা দিয়ে হরতালকারী আর পুলিশের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে। আব্বুরা হয়তো তাসের আড্ডা বসাবেন। সিটি কলেজের সামনে, কিংবা নিউমার্কেটের সামনে নীলক্ষেতে টোকাইদের দিয়ে নেতারা টায়ার পুড়াবেন। সেই পোড়া গন্ধ কলাবাগান, শুক্রাবাদ পর্যন্ত আসবে। আমরা সবাই ছাদে দৌড়ে যাবো, সেই সময় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ সেখানে যাবে যাতে সাইরেনের আওয়াজ পেয়ে টায়ার পুড়ানেওয়ালারা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু সেবার যে এরশাদ সত্যিই সত্যিই ক্ষমতা ত্যাগ করবেন, দুই নেত্রীকে গৃহবন্দী করা বাদ দিয়ে সেটা ছিল অপ্রত্যাশিত। বাংলাদেশ একানব্বইতে সত্যি সত্যি স্বৈরাচারমুক্ত হলো, আসলেই কি? দৈনন্দিন জীবনে এরশাদ পরবর্তী সরকারদের সাথে আমি এরশাদ সরকারের খুব একটা অমিল পাই না।

আমরা যারা যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম, যুদ্ধ – রায়ট যাদের কাছে ইতিহাসের বই, টিভির নাটক কিংবা সিনেমা মাত্র ছিল। তারা বিরানব্বইয়ে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার কল্যানে সেটা স্বচোখে দেখলাম। প্বার্শবর্তী দেশের তান্ডব আমাদের দেশকেও কিছুটা ছুঁয়ে গেলো। সারাদেশে কিংবা ঢাকায় কার্ফিউ ছিল তখন। বিটিভি সিএনএনের রায়টের সংবাদের সময় সেন্সর করে সিএনএন পযর্ন্ত অচল করে রাখতো। ধর্মের নামে মানুষ মারা কোন প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা নয়। এটা এখনো ঘটে জানলাম তখন নতুন করে। খালেদা জিয়ার আমল তখন, তিনি আগের দিনের সাদা সূতীর শাড়ি বদলে নতুন ফ্রেঞ্চ ফ্যাশনে টিভিতে আসেন সাথে একটা ম্যাচিং ওড়না। খালেদা জিয়ার এই ওড়না ফ্যাশন তখন মধ্যবিত্ত খালাম্মাদের আক্রান্ত করে ফেললো। ম্যাডামের মতো ফ্রেঞ্চ না পাক তাতে কি, সূতী, সিল্ক, ম্যাচিং, কন্ট্রাষ্ট যে ধরনেরই হোক ওড়না তাদের শাড়ির ওপর শোভা পেতে লাগলো। সেই সময় আনন্দ বিচিত্রা একটি জরিপ চালায় তারকাদের মধ্যে, কাকে তারা সবচেয়ে সুবেশী মনে করেন। ষোলজন সম্ভবত খালেদা জিয়ার নাম করেন, এই ষোলজনের মধ্যে তারকা সুর্বনা ও চম্পা ছিলেন সম্ভবত যারা খালেদা জিয়াকে সবচেয়ে সুবেশী মনে করতেন। ৯১ সালের (সম্ভবতঃ) সবচেয়ে আলোচনাকারী ঘটনা ছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে "ঘাতক দালাল নিমূর্ল কমিটি" গঠন করে গন আদালতের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। আন্দোলন তৈরী করা।

এই দশকেই যায় যায় দিন সাপ্তাহিকের নির্বাচিত কলামের লেখিকা তাসলিমা নাসরিনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। তিনি বির্তকিত ছিলেন তার ব্যাক্তিগত জীবন সাথে তার লেখার জন্য। আজো তার নির্বাসন জীবনের অবসান ঘটেনি। মৌলবাদী শক্তিকে রুখার বদলে সব সরকারই তাদের সাথে আঁতাত রাখেন। একজন নিরস্ত্র ভদ্রমহিলা যিনি লেখিকা, তাকে লেখা দিয়ে বধার বদলে শক্তিশালী পুরুষরা সবাই লাঠি সোটা দা নিয়ে ঢাকা কাঁপিয়ে মিছিল করেছেন। আমাদের অসহায় পুলিশ বাহিনী তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখেছে, কিছুই করতে পারেনি। সারা বিশ্ব এই বর্বর দৃশ্যটি দেখেছেন। কিন্তু আজো তিনি যা যা বলেছেন তার বিপক্ষে কোন যুক্তি নিয়ে এসে তার লেখাকে কেউ খন্ডন করেনি। ৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যায় সারাদেশ ডুবে যায়। সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ আবার তার অসহায়তার জন্য কভারেজ পায়। নব্বইয়ের দশকে কম্পিউটার মধ্যবিত্তের ঘরে আসে। গেম খেলা চলতো তখন ভীষন ভাবে। অনেক শৌখিন ব্যবহারকারী তখন উচ্চমূল্যে অন্তর্জাল ব্যবহার করতেন। অর্ন্তজাল ব্যবহারের মধ্যে একটা জিনিস তখন প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিল তাহলো চ্যাটিং। এম।এস।এন কিংবা ইয়াহুর মাধ্যমে চ্যাটিং।

তানবীরা
২১.১০.১০

এই লেখাটা লিখতে যেয়ে মনে হলো বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা দিচ্ছি। সব গ্লোবাল পড়া আছে, মুখস্থ নাই কিছু। এখন নিজের কেদরানী দিয়া কি করে বিলাসীর চরিত্র অঙ্কন করা যায়। ইস্মৃতিতো বহু আগে থেকেই প্রতারনা করছে। এতোদিন ভরসা ছিল “গুগল”। কিন্তু ডিজ়িটাল বাংলাদেশের কোন সেক্টরের কোন তথ্য গুগল করে পাওয়া!!!!

কৃতজ্ঞতাঃ নুশেরা + জেবীন + নড়বড়ে

Tuesday 19 October 2010

শুধুই গল্প নয়

আজকে ভাঙ্গা পেন্সিলের লেখা “দাস” পোষ্টটা পড়তে পড়তে বহুদিন আগে শোনা একটা গল্প মনে পরে গেলো। তখন গল্প হিসেবে শুনলেও এখন মনে হচ্ছে সবকিছু কেনো গল্পই হতে হবে? গল্পকে সত্যি করার দায়িত্বতো আমাদেরই। গতবছর হল্যান্ডে বাংলাদেশ সার্পোট গ্রুপের www.basug.nl রেমিট্যান্স বিষয়ের একদিনের একটি ওয়ার্কশপে আমি অংশগ্রহন করেছিলাম আরো অনেকের সাথে। ওয়ার্কশপের মূল বিষয় ছিল, আমরা প্রবাসীরা যে পয়সা দেশে পাঠাই সেটা কোন খাতে আমাদের পরিবার পরিজনরা ব্যবহার করছে সেটার প্রতি প্রবাসীদের সচেতনতা তৈরী করা। প্রয়োজনবোধে দেশে পরিবারকে শিক্ষিত ও সচেতন করা যে শুধু ভোগ বিলাসে পয়সা না খরচা করে বিনিয়োগ করার জন্য। ইনাফী INAFI (The International Network of Alternative Financial Institutions ) দেশে যারা রেমিট্যান্স ভোগ করেন এমন কিছু পরিবারের ওপর এবিষয়ে জরিপ চালিয়ে যে ডাটা কালেক্ট করে নিয়ে এসেছেন সেটির ফলাফল আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ। প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বেশির ভাগ অংশ যায় কাঁচা বাজার, বড় নার্সিং হোম, শপিং মল আর বিলাস বহুল যানবাহনে। বিনিয়োগের চেয়ে আমাদের রেমিট্যান্স ভোগে বেশি ব্যয় হয়।

বাসুগ একই সাথে আরো রেমিট্যান্স ব্যবহারকারী দেশের লোকদের আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে জানানোর জন্য, কিভাবে রেমিট্যান্সের উপযুক্ত ব্যবহার করে তারা আজ তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। এমনই একজন ছিলেন ফিলিপিনের। তার নামটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না, কিছু পুরনো মেইল জিমেইল থেকে ডিলিট হয়ে গেছে। ভাবছি তার নামের চেয়েও তার কথাগুলো গুরুত্বপূর্ন সেগুলো স্মৃতি থেকে তুলে দেই। এশিয়ার ফিলিপিনের অবস্থা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে খুব ভালো ছিলো না। ফিলিপিনের প্রচুর লোক বাইরে খাটেন। মধ্যপ্রাচ্যের গৃহকর্মীর কাজটি একেবারে ফিলিপিনো মেয়েদের জন্য বাধা ছিল এক সময়। যে ভদ্রমহিলা এখন নেদারল্যান্ডসে থাকেন, কাজ করেন তিনিও এসেছিলেন খুব দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। কিন্তু তার পরিবারে কেউ একজন কখনো স্কুলে গিয়েছিলেন। এবং পরিবারের লোকদেরকে তিনি বোঝাতে সর্মথ হয়েছিলেন যে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু তাদের টাকা ছিলো না যে সবাই একসাথে পড়াশোনা করবেন।

তখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রথম জন প্রথম পড়াশুনা করবেন। তার পড়াশুনা শেষ হলে তিনি যখন অর্থ উপার্জন করবেন তিনি দ্বিতীয় জনকে পড়াশোনা করাবেন। দ্বিতীয়জন করাবেন তৃতীয়জনকে। পড়াশোনার জন্য যেহেতু বয়স কোন বাধা নয় তাই এভাবেই তারা এগিয়ে যাবেন। সবচেয়ে ছোট যে জন সে পড়াশোনার খরচ দিবেন দ্বিতীয় জেনারেশনের প্রথম জনকে। বাড়ির মেয়েদের প্রতি নির্দেশ ছিল গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগে কেউ গর্ভধারন করতে পারবে না। এখন তিনি গর্বিতভাবে তার অভিজ্ঞতার কথা আমাদের জানালেন। দীর্ঘ আঠারো বছর তিনি তার পরিবারের পড়াশোনার জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। এখন তিনি দায়িত্ব থেকে মুক্ত। কখনো কোন উৎসবে উপহার পাঠাতে ইচ্ছে হলে তিনি পাঠান নতুবা পাঠাননা। পরিবার এখন স্বয়ংসম্পূর্ন। তার টাকার আশায় আর কেউ নেই, এ চিন্তাটা তাকে মানসিক স্বস্ত্বিও দেয় যেটা তার আগে ছিলো না।

এধরনের কিছু কি আমাদের দেশে একেবারেই অসম্ভব? আমরাই কি কেউ শুরু করতে পারি না? বোঝাতে পারি না আমাদের আশে পাশের লোকজনদেরকে শিক্ষার গুরুত্ব? আমাদের অনেকের বাড়িতেই অল্পবয়সী গৃহকর্মী আছে, তাদের দিয়েই কি শুরু করতে পারি না? এরকম কোন ওয়ার্কশপে আমাদের দেশের কেউই হয়তো তার সাফল্যের গর্বিত উদাহরন অন্যদের জানাবেন। হয়তো এটা শুধুই আমার একটা আবেগতাড়িত ভাবনা কিন্তু সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করলো। কে জানে কোথাও যদি কোন দীপ জ্বলে?

তানবীরা
২০.১০.১০

Monday 11 October 2010

৮০ এর ঢাকা ---- মধ্যবিত্তের চোখে

যা হারিয়ে যায় জীবন থেকে তা চিরতরেই হারিয়ে যায়। এলেবেলে শৈশব, আড়ি দেয়া সেই সব বন্ধুরা, প্রেমময় সেইসব মুহূর্ত, প্রেমিকের ঘামে ভেজা উষ্ণ হাত, বলা না বলা কথার সেই ক্ষন, চিরচেনা শহর, ঝিম ধরা দুপুর, মন কেমন করা গোধূলি বেলা, মন উদাস করা বৃষ্টি, সূর্য তারা সব। পরে থাকে পাহাড়সম স্মৃতি আর এক বুক ব্যাথা। এক সময় জীবন হয়ে ওঠে স্মৃতির রেলগাড়ি।

আশির দশকে আমরা স্কুলে টিফিন খেতাম ক্রীমরোল, বাটারবন, বনরুটি ইত্যাদি। ক্রীমরোল খেতে খুবই ভালো ছিল। আমি এখনো ঢাকাতে গেলে ক্রীমরোল খাই। নিউমার্কেট আর পান্থ পথের সুইস বেকারীতে পাওয়া যায়। বাটারবন আমার কোনদিনও পছন্দ ছিল না, খাচ্ছি খাচ্ছি কিন্তু শেষ হতো না। রঙীন কাগজে মোড়া টফি পাওয়া যেতো যেটা সম্ভবত চকলেটের চেয়ে দাম বেশি ছিল। টফির গায়ে ঘর ঘর ডিজাইন কাটা থাকতো। আজ অব্ধি আমার প্রিয় মিল্ক ভিটা চকলেট দুধ আশিতেই বোধহয় প্রথম ঢাকার মার্কেটে আসে। মিমি চকলেট খুব খেতাম কিন্তু সেটা কি আশির দশকে প্রথম এসেছিলো? নিউমার্কেটে তখন একটা দুটো করে খাবারের দোকান খোলা হচ্ছিল। আজকের মতো এতো রোল আর বার্গার তখন ছিল না, তখন ছিল ফুচকা, চটপটি, লাচ্ছি, জিলিপী, পেষ্ট্রি জাতীয় খাবার আর কাঁচের বোতলের কোক। আশির দশকের মধ্যভাগে যোগ হয় পোলার আইসক্রীম। আমরা আগে যে চকবার খেতাম তার উন্নত মডেল। পোলারের আগে ছিল মিল্ক ভিটার ইগলু ।

তবে আশির দশকের প্রথম দিকে তিতাসের কিংবা ছায়ানীড়ের কেক, বিস্কিট, বাটার, আর শেষদিকে কুপারসের কেক ও স্ন্যাকস বেশ জনপ্রিয় ছিল। আর ছিল স্নো হোয়াইটের কোন আইসক্রীম। ভ্যানিলা আর চকলেট ফ্লেভারে পাওয়া যেতো। বাড়ি থেকে সব সময় ভেবে যেতাম যেভাবেই হোক দুটো খাবো, কিন্তু এতো বড়ো থাকতোযে একটাই শেষ করতে পারতাম না। কোন আইসক্রীম খেতে যাওয়া তখন এক ধরনের আউটিং এর মধ্যে পরতো। অনেক ধরনের আনন্দ জীবনে ছিল যেগুলো আজকের ছেলে পেলের কাছে হাস্যকর মনে হবে। রানী এলিজাবেথ একবার বাংলাদেশে আসবেন দুদিনের জন্য। তার খাবার আসবে সিঙ্গাপুর থেকে, আরো কি কি সব ব্যাপার। সারাক্ষন ইত্তেফাক পেপার আর টিভিতে এই নিয়ে খবর হচ্ছে। আমাদেরকে যে খবর আকর্ষিত করলো তাহলো রানী আসা উপলক্ষ্যে সমস্ত রাস্তা কার্পেটিং করা হবে। রাস্তা কার্পেটিং কি বস্তু তখন আমরা জানি না। কিন্তু রানী আসবেন। নার্সারী রাইমস মনে পরে সারাক্ষন, পুষি ক্যাট পুষি ক্যাট হোয়ার হ্যাভ ইউ বীন? আই হ্যাভ বীন টু লান্ডান টু লুক এট দা কুইন। আমাদের প্যাচরা প্যাচরীতে বিরক্ত হয়ে রাতের দশটায় আব্বু গাড়ি বের করে আমাদের নিয়ে এয়ারপোর্ট রওয়ানা হলেন কার্পেটিং দেখাতে। আমরা পুরো পরিবার মানে আম্মি, আব্বু, তখনের আমরা তিন ভাইবোন, সাথে আমার দুই খালাতো বোন এক খালাতো ভাই আর খালাম্মা। আমরা সবাই ঐ টয়োটা করোলা ডিলাক্সের মধ্যে কোথায় জায়গা হয়েছিলাম এখনো আমি তার হদিস পাই না। তখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। জীবন তখন খুবই সহজ সরল ছিল। আমরা সারা রাস্তা লাল কার্পেট খুঁজতে খুঁজতে এয়ারপোর্টের খুব কাছ থেকে মনঃক্ষুন্ন হয়ে ফিরে এলাম। যতোই আব্বু বুঝান আসলে কার্পেটিং মানে কি আমাদেরতো মন মানে না।

ইত্তেফাক তখন খুবই নামকরা প্রতাপশালী পত্রিকা ছিল। ছোটদের আকর্ষন ছিল দাদুভাইয়ের রোববারের পাতা। তবে সামরিকজান্তার বিপক্ষে প্রথম যায় যায় দিন বেশ চলেছিল। তখন যায় যায় দিন সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। শিশু বলে মাসিক একটি পত্রিকা বের হতো, নবারুন ছিল। আর ছিল সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক রহস্য পত্রিকা, কিশোর পত্রিকা। মায়েদের ছিল বেগম নামের একটি মাসিক পত্রিকা। সিনেমা কিংবা অন্যান্য আইটেমের বাহার ছিল বিচিত্রা নামক সাপ্তাহিকটিতে। আশির দশকের শেষের দিকে আনন্দ বিচিত্রা বের হতো পাক্ষিক, তারা প্রথমে ফটো সুন্দরী আইডিয়াটি নিয়ে কাজ করেন, যাতে নুসরাত ইয়াসমিন টিসা প্রথম ফটো সুন্দরী হন। আমাদের হাতে হাতে ঘুরতো রুশ দেশের উপকথা, সিন্দাবাদের বানিজ্য যাত্রা, নন্টে ফন্টের কীর্তি টাইপ জিনিসগুলো। সাধারন জ্ঞান বাড়ানোর জন্য তখন বাচ্চাদের আর একটা জিনিস গিলানো হতো তার নাম ছিল বাংলাদেশ ও বিশ্বের ডায়েরী ভবেশ রায় সম্পাদিত। সাতটি আশ্চর্যের নাম, সাতটি উপমহাদেশ কিংবা পাঁচটি মহাসাগরের নাম এগুলো থাকতো সেই বইয়ে। উন্মাদ তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল।

আশির দশক পুরোটাই ধরতে গেলে ছিল সামরিক শাসন। জিয়া – এরশাদ। যদিও আমি মাত্র দুই দশক বাংলাদেশের বাস করেছি। সামরিক আর অসামরিক শাসনের কোন তফাৎ আমার জীবন যাত্রায় আমি অনুভব করি নাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাহা বাহান্ন তাহাই কেমন করে যেনো পয়ষট্টি হয়ে যায়। বিটিভিতে শুধু সেট বদলায়। প্রথম ছিল এরশাদ – রওশন সেট, তারপর এলো খালেদা সেট আবার হাসিনা সেট। তবে সেসময় বাংলাদেশে ইসলামীকরন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধানে ইসলাম আসে, সাপ্তাহিক ছুটি শনি রবিবার বদলে শুক্রবার করা হয়। একটাই আনন্দ ছিল অল্প কিছুদিন পর পর হ্যা ভোট না ভোট, এই নির্বাচন সেই নির্বাচন হতো। আর সেই উপলক্ষ্যে টিভিতে সারা রাত ভরে ভালো ভালো অনুষ্ঠান হতো। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় এরশাদের স্বেচ্ছাচার শিশুকিশোরের মনেও প্রভাব রেখেছিলো। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এরশাদবিরোধী মিছিল সংস্কৃতিতে সামিল হয়েছিলো গুডবয় ধরণের কিশোরতরুণও। সামরিক শাসকদের আরো একটি বড় অবদান ছিল সার্ক আর সাফ গেমস। সার্ক উপলক্ষ্যে ভালো ভালো ভিনদেশি সিনেমা দেখতে পেতাম, গান শুনতে পেতাম।

খেলাধূলার সামগ্রীতেও আসে তখন বেশ পরিবর্তন। তিতাসে তখন ছয়শ – আটশ টাকায় বড় বড় পুতুল পাওয়া যেতো। যার মুখ থেকে চুষনী বের করে নিলে ওয়া ওয়া শব্দে কাঁদতো সেই পুতুল। ব্যাটারীতে চলতো সেসব খেলনা। চাবি ঘুরালে বাঁদর ঢোল বাজায়, ট্রেনের লাইন পেতে ব্যাটারীতে চলা ট্রেন ইত্যাদি, গেমস ওয়াচ। যদিও ক্যারাম, লুডু তখনো প্রধান খেলনা। আবার অনেক বাড়িতেই তখন এক্যুরিয়াম পেতে মাছ পোষা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বস্তুবাদের চর্চা বোধহয় তখন থেকেই মধ্যবিত্তকে আক্রমন করছিলো। আবাহানী আর মোহামেডানের ফুটবল ছিল মধ্যবিত্তের একমাত্র বিলাস। বাড়িতে বাড়িতে পতাকা টানানো হতো দুদলের। সর্মথকদের মারামারি ঠেকাতে ষ্টেডিয়ামে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হতো। ঢাকায় ফাইন্যাল খেলার দিন সাজ সাজ রব পরে যেতো। সালাহউদ্দিন তখন তারকা, লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপনে তাকে দেখা যেতো।। সবাইকে আমরা জিজ্ঞেস করতাম, আবাহানী না মোহামেডান?

আশির দশক থেকে আমরা আস্তে আস্তে স্মার্ট হতে শুরু করি। আমাদের গান বাজনায় আসে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন, সুরে ছন্দে গায়কীতে। বিদেশি সাংস্কৃতিকেও সাদরে আমন্ত্রন জানিয়ে ঘরে নিয়ে আসি। নাজিয়া জোহেবের ডিস্কো দিওয়ানে শুনিনি কিংবা মুগ্ধ হইনি এমন শিশু আমরা খুব কমই ছিলাম। স্কুলের পিকনিকে নাচিনি এই গানে সেই প্রজাতিও বোধহয় বিরল। এটা বোধহয় আশির প্রথম দিকের ঘটনা, মাঝের দিকে মাইকেল জ্যাকসন আসেন ঢাকায় তার জাষ্ট বীট ইট, জাষ্ট বীট ইট নিয়ে। তাতে ভাইয়াদের ব্রেক ড্যান্স করার কসরত দেখেছি। তবে সেই সময় শোয়েব – কুমার বিশ্বজিত, তপন চৌধুরী আর শুভ্র দেবও খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। আজ থেকে বারোটি বছর, তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে, মন শুধু মন ছুঁয়েছে কিংবা কৃষ্ণচূড়ার ছায়ে ছায়ে নির্জন পূর্নিমা রাতে ক্যাসেটে, টিভির ফিলারে সারাক্ষন বাজতো। আর অনেক মেয়েরাও তখন বোধ হয় রুনা লায়লাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতেন, নেচে নেচে আধুনিক গান গাইতেন। পিলু মমতাজ আর সাবা পন্নীর কথা এখনো মনে পরে। একদিনতো চলে যাবো গানটি কিংবা বন্ধু আমার ওগো প্রিয় তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল। সাবা পন্নী অবশ্য তার অত্যাধুনিক সাজের জন্যও আলোচনায় আসতেন বার বার। ফীডব্যাক, সোলস এদের কনসার্ট মধ্য আশির পরে অভিজাত হোটেলের বাইরে সাধারন জনগনের কাছে আসতে শুরু করলো বাংলা গানের মাধ্যমে। প্রথম দিকে তারা বোধহয় ইংরেজী গানই শুধু গাইতেন। তবে আশির শেষের দিকে ব্যান্ড সংগীতের চূড়ান্ত বিস্ফোরন ঘটে বাংলাদেশে। যার যা ছিল তাই নিয়েই নেমে পরেছিলেন ব্যান্ড বাজাতে।

আমাদের চলচিত্রও তখন পিছিয়ে নেই। সাদাকালোর পরিবর্তে রঙীন ছবি চলে তখন প্রেক্ষাগৃহে। শাবানা, ববিতাকে পাশ কাটিয়ে তখন আছেন চোখে তিন খানা পাপড়ি শুদ্ধ অঞ্জু ঘোষ, ফাইভ ষ্টার হোটেলের ওয়েটারদের ড্রেস পরা ওয়াসিম। আধুনিক ক্যারাটে নিয়ে রুবেল। গাড়ি পোড়ানো কিংবা ওপর থেকে লাফ দেয়া ইংলিশ টাইপ সিনেমার জন্য ববিতা, সোহেল রানা। মিষ্টি মেয়ে সুচরিতা কিংবা দুষ্ট ছেলে ইলিয়াস কাঞ্চন। সিনেমা দেখার জন্য তখন কতো কেঁদেছি কেটেছি। কিন্তু সবাই এক ধমক মেরে অঙ্ক বই কিংবা ইংলিশ গ্রামার বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছে কিন্তু সিনেমা আজো দেখা হয়নি। একবার এক সিনেমা এলো দূরদেশ, সবাই দেখলো আর আমরা কতো কাঁদলাম কিন্তু হায়……। অনেক কিছু মনে করতে পারি না আজকাল তাই ভেবেছিলাম ছোটবেলার কথা এখন ততো মনে নেই কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সিনেমা পার্টটা বেশ মনে আছে। বিটিভির ছায়াছন্দের কল্যানে গানগুলোতো দেখতাম। গোগ্রাসে গিলতাম। আজো মনে পড়ে চ্যালেঞ্জ নামে একটা সিনেমায় ম্যাক্সি পরা ববিতার হ্যাল্লো হ্যাল্লো হ্যাল্লো একটা গানের কথা, সুচুরিতার আঁখি মিলন সিনেমার আমার গরুর গাড়ি গানের কথা্……।। আশির শুরুর দিকে ছুটির ঘন্টা, পুরস্কার, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী সিনেমাগুলো মধ্যবিত্ত দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আর শেষের দিকে বেদের মেয়ে জ্যোস্না বোধহয় ব্যবসায়িক সাফল্যের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে।

ঢাকায় তখন আস্তে আস্তে মধ্যবিত্তের ড্রইং রুমে রঙীন টিভি, ভিসিআর ঢুকছে। বাংলা সিনেমা দেখতে যাওয়া নিষেধ বটে কিন্তু বাসায় হিন্দী ফ্লিম দেখা হচ্ছে। ওয়াসিম দেখা নিষেধ কিন্তু জিতেন্দ্র ওপেন। অঞ্জু ঘোষ থার্ড রেট কিন্তু জয়াপ্রদা বা শ্রীদেবী চালু। নাগ – নাগিনী টাইপ সিনেমা ভদ্রলোকেরা দেখে না কিন্তু নাগিন দেখে। মাওয়ালি আমার ছোটবেলায় দেখা প্রিয় সিনেমা ছিল। জিতু আঙ্কেল আমার প্রথম ক্রাশ। কতো টিফিনের ঝালমুড়ির পয়সা আমার গিয়েছে জিতু আঙ্কেলের ভিউকার্ডের পিছনে। জাষ্টিস চৌধুরী মামনিয়া পম পম গানটা আহা। কিংবা তোফা বা সংযোগ। এমনিতে সিনেমা দেখা নিষেধ হলেও গ্রাম থেকে কেউ আসলে কোন কাজে তারা শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানার সাথে সাথে একটু ভি।সি আরও দেখতে চাইতো। আর আমরা থাকতাম এই অপেক্ষায়। ভুজুং ভাজুং দিয়ে মাওয়ালি কিংবা ডিস্কো ড্যান্সার লাগিয়ে দিতাম। কিংবা কখনো কুলীর লাম্বুজী লাম্বুজী বলো টিংকুজী।

বিটিভিও তখন দারুন ফর্মে ছিল। দুর্দান্ত জনপ্রিয় সব ধারাবাহিক নাটক হতো টিভিতে প্রতি মংগলবার বাংলা খবরের পরে। ঢাকায় থাকি, সকাল সন্ধ্যা, এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি সবই আশির দশকের ফসল। হুমায়ূন আহমেদ নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান তখন। আগে ঈদে ছিল সবসময় আমজাদ হোসেনের লেখা ও অভিনীত নাটক স্পেশাল। সে সিংহাসনও তার কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদ কেড়ে নেন। ঈদের নাটক চলে যায় হুমায়ূন আহমেদের দখলে। আমজাদ হোসেনের ভাড়ামি শেষ হয়ে শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদের ভাড়ামি যদিও প্রথম দিকে প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু একই অস্ত্র ব্যবহার করে করে যক্ষতিতা করে ছেড়েছেন তারা দর্শকদেরকে। সে সময় একটি এ্যাড হতো টিভিতে, যতো সম্ভব এ্যাডটি আফজাল হোসেনের বানানো ছিলো, পিয়ারসন্স এর এ্যাড। রু রু রু মিউজিকের তালে একদল সাদা ঘোড়া দৌড়াত। আজো স্মৃতিতে সেই ভালো লাগার রেশ রয়ে গেছে। ফজলে লোহানী পরিচালিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান “যদি কিছু মনে না করেন” এর হাত ধরে আসে “ইত্যাদি”। দ্যা ফল গাই, ম্যাকগাইভার আর থান্ডার ক্যাটস ছিল আমাদের সেই সময়ের আরো কিছু উজ্জল মাইল ফলক। চার্লিস এঞ্জেলস হতো বোধহয় সোমবারে, আমরা অনেকেই তখন তাদের মতো নিজেদেরকে ভাবতে চাইতাম, সাব্রিনা, ফারাহ ফসেট, তাদের চুলের স্টাইল তখন ঢাকায় বেশ জনপ্রিয়। মুভি অফ দ্যা উইকে আসতো ভালো ভালো সব ইংরেজি সিনেমা। ছোটদের জন্য ডাবল ডেকার, থ্রী স্টুজেস, বিল কসবি শো ছিল দারুন উপভোগ্য। শুক্রবার সকালের ফ্যামিলি টাইজ ছিলো দুর্দান্ত আকর্ষণ। মাইকেল ডগলাস ছিলেন আকর্ষনের একটা উল্লেখযোগ্য উৎস।

ঢাকায় তখন মেয়েরা বেশ ফ্যাশন সচেতেন হয়ে উঠছেন। নতুন নতুন বেশ পার্লার খোলা হচ্ছে। উৎসবে হাল ফ্যাশনের চুল কাটা, চুল বাঁধা চলতো। রেখা তখন অনেক মেয়েদেরই হার্ট থ্রব। রেখার মতো জামা বানানো, চুল বাঁধা, হাতে চুড়ি পরা কিংবা জয়াপ্রদার ব্লাউজের ডিজাইন দিয়ে ব্লাউজ বানানো তখন ঢাকাতেও বেশ চালু ছিল। আশির দশকের শুরুতে ছেলেরা তখনও বেলবটম পরতো, মেয়েরা ছোট চিপা কামিজ বিশাল ঢোলা সালোয়ার। ছিয়াশি সাতাশির দিকে ব্যাগি স্টাইল গ্রাস করে নেয়া পুরো দেশ। ঢাকার পুরো বাজার ভারতীয় কাপড়ে তখন সয়লাব থাকা সত্বেও কিছু কিছু সাহসী দেশ প্রেমিক দেশীয় কাপড় ব্যবহার করে নিজেরা ফ্যাশন হাউজ করার উদ্যোগ নেন। মধ্য আশিতে পুরো ধানমন্ডি জুড়ে ইষ্ট ওয়েষ্ট ডিসপ্লে, পুষ্প, বো-মোনড, পার্বনী, বুননের পদচারনা ছিল যা দেশের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখে সাথে সাথে দেশীয় ফ্যাশনকে মধ্যবিত্তের দরজায় আনে ও জনপ্রিয় করে তুলে। এ সমস্ত ফ্যাশন হাউজের মধ্যে আড়ং সবচেয়ে সফল আর সর্ববৃহৎ বলা চলে।

সমস্ত সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকায় তখন রুপচর্চার টিপস দেয়া শুরু হলো। আটা, ময়দা, বেসন, লেবু, মধু, টমেটো, শসা সব কিছু দেয়া থাকতো মুখে মাখার জন্য। চোখ বড় হলে আর চোখ ছোট হলে কোথা থেক কাজল আঁকতে হবে সেগুলোও লিখে দেয়া শুরু করলেন এক্সপার্টরা। সমস্ত ঢাকা জুড়ে তখন চার তলা, পাঁচতলা বাড়ি ওঠার হিড়িক লেগে গেলো। বাড়ির সামনের পিছনের বাগান ছেটে দিয়ে সেখানে গ্যারাজ তৈরী হলো। বিকেলে ছাঁদে বেড়ানোর কিংবা ঘুড়ি ওড়ানোর একটা রেওয়াজ হলো। যেটাকে অনেকে আবার অশুদ্ধ ভাষায় টাংকি নামেও ডেকে থাকেন। তখন টেলিফোনে কলার আইডির যন্ত্রনা ছিল না, মাঝেই মাঝেই ফোনের উৎপাত হতো। উৎপাত দু তরফ থেকেই হতো। এটা একটা চালু মজার গেম ছিল। বান্ধবীরা একসাথে হলেই আমরাও ফোন টেনে এনে হাবিজাবি সব নাম্বারে ফোন করে উল্টোপাল্টা সব কথা বলতাম। নিজেদের পছন্দের তারকা, খেলোয়ারদের রঙীন সব ভিউকার্ড জমানোর তখন রেওয়াজ ছিল। আজাদ প্রোডাক্টস এর ঈদকার্ড ও অন্যান্য গ্রীটিংস কার্ড তখন বাজারে বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বন্ধু বান্ধবকে কার্ড দেয়া তখন একটা ফ্যাশন হয়ে ওঠল।

তানবীরা
১২.১০.১০

Tuesday 5 October 2010

৭০ এর ঢাকা ---- মধ্যবিত্তের চোখে

আজকাল মনে হয় পুরো দস্তুর প্রবাসী হয়ে গেছি। সারাক্ষন পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই ঢাকা গেলে। পরিবর্তন কাঁদায়, নতুন জিনিস বিরক্ত লাগে। বাড়ি গেলে এঘর ওঘর ঘুরে ভাইজির স্তুপ করা খেলনার মাঝে নিজের শৈশব খুঁজে ফিরি। চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি পরা দাদু বসে থাকতেন সারা বেলা জায়নামাজের ওপর, পাবো না জেনেও তার মমতা খুঁজি, আমার নিজের হাতে লাগানো মানিপ্ল্যান্টের চারাটাকে খুঁজে বেড়াই যেটা কখনো আমার পড়ার টেবিলের ওপর কখনোবা শুধুই জানালার ওপর ঝুলতো। কারন আমার দুমাস পর পর ঘরের আসবাবপত্র টানাটানি না করলে কেমন যেনো বন্দী বন্দী লাগতো। কখনো খুঁজে ফিরি মায়ের কাছে বাতিল হয়ে যাওয়া সেই পুরনো দিনের শোকেসটা। পুরো কাঠ আর কাঁচের সম্বনয়ে চার তাকের জিনিসটি যেটি আমার বই রাখার সম্পত্তি ছিল বহুদিন। বই কিনে আমার নাম লিখে তাতে মালিকানার ছাপ লাগিয়ে তারপর পড়ে কাঁচের মধ্যে সাজিয়ে রাখা। দস্যু বনহুর থেকে সাতকাহন, মেমসাহেব থেকে শেষের কবিতা কি না ছিলো তাতে, কতো গর্বিত ভঙ্গীতে সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। কালের বিবর্তনে সেসব কালের গর্ভে।

সেই সময় অনেকক্ষন দাদুর হাত পা টিপে দিলে মাঝে মাঝে চার আনা পয়সা পাওয়া যেতো। হাত পা টিপতে টিপতে সেই পঁচিশ পয়সায় মাকে ফাঁকি দিয়ে নিষিদ্ধ দ্রব্য কি কি খাওয়া যাবে তার স্বপ্ন দেখতাম। মুদি দোকানে প্লাষ্টিকের প্যাকেটে ঝোলানো পাঁচ পয়সার হজমী, কালো রঙের এক রকমের ঝাঝালো পাউডার যেটা মুখে নিলে এক ধরনের অম্ল ঝাঝা স্বাদ পাওয়া যেতো। কাঁচের বোয়ামের মুখ শক্ত করে আটকানো টিনের ঢাকনা দিয়ে আর তাতে লাল গুড়ের সন্দেশ, আর সাদা গুড়ো দুধের কিছু একটা পাওয়া যেতো যার নামও সন্দেশ ছিল, যার ডানার যতো সম্ভব পাঁচটি বুটি দেয়া থাকতো। আরেকটি বস্তু ছিল নানা বর্ণের মানে রঙ করা, ছোট ছোট বল বল মিষ্টি খেতে যাকে বলতাম আমরা টিকটিকির ডিম।

দুপুরে মা চাচীদের ঘুমের সময় আসতো কটকটিওয়ালা। লোহার বা টিনের বাক্সে থাকতো সেই পদার্থ। খালি হরলিক্সের বোয়াম কিংবা আচারের বোয়াম দিয়ে হলুদ রঙের একটা আপাতঃ শক্ত পদার্থ পাওয়া যেতো মিষ্টি স্বাদের। গরমে ছিল লাল, কমলা কিংবা সবুজ রঙের পানি আইসক্রীম যা খেলে জীহবা, ঠোঁট সব রঙীন হয়ে যেতো। আর বাবা চাচাদের সাথে বেড়াতে গেলে দামী বেবী আইসক্রীম যা দুধ আর চিনি দিয়ে বানানো হতো।

ভট ভট শব্দের একটি খেলনা বাজিয়ে আসতো খেলনাওয়ালা। তার কাঁধে বাঁশের মাচার মতো কিছুতে খেলনাগুলো ঢুকিয়ে নিয়ে। সিলভারের হাড়ি পাতিলের সেট, প্লাষ্টিকের পুতুল মেয়েদের জন্যে। ছেলেদের জন্যে প্লাষ্টিকের পিস্তল, নানারকমের মুখোশ, আর থাকতো প্লাষ্টিকের এক ধরনের ফুল যা হাতে নিয়ে দৌড় দিলে বনবন ঘুরতো। সেই ছিলো মধ্যবিত্ত বাচ্চাদের খেলার জিনিস। এছাড়া কিছু খেলাধূলা ছিলো যেগুলো খেলতে সেই অর্থে কোন উপকরনের দরকার হতো না। খোলা একটা উঠোন হলেই হয়ে যেতো। ছোয়াঁছুয়ি, বরফপানি, সাতচারা, বউচি, গোল্লাছুট, কানামাছি, রুমালচোর, টিলু এক্সপ্রেস, বিউকুইক প্রভৃতি।

বাংলা সিনেমায় তখন যতোসম্ভব বিউটি কুইন শাবানা, ববিতা, কবরীর দাপট যাচ্ছিল সাথে নায়ক রাজ রাজ্জাক কিংবা এ্যাংগরী ইয়াংম্যান ফারুক, উজ্জল ছিলেন। সাদাকালো সিনেমার যুগ তখন। নয়নমনি, অবুঝমন, রংবাজ এর মতো সিনেমার যুগ তখন। বিটিভিতে তখন মাসে একটা বাংলা সিনেমা দেখানো হতো, সেদিন পাড়া জুড়ে সাজ সাজ রব থাকতো। যাদের বাড়িতে টিভি আছে তাদের বাড়ি সেদিন আলাদা ঝাড়পোচ করা হতো রাতের শো’র জন্য।বাচ্চারা দিনে ঘুমিয়ে নিতো যাতে রাত জেগে সিনেমা দেখতে পারে। কিন্তু টিভি কতৃপক্ষ বেশি রাতে সিনেমা শুরু করে, মাঝে খবর আর বিজ্ঞাপন দিয়ে সিনেমা এতো দেরীতে শেষ করতো যে বাচ্চাদের পক্ষে সিনেমা শেষ করা সম্ভব হতো না কখনোই। তবে সন্ধ্যে বেলায় তখন বাচ্চাদের জন্য “সেজান”, “কুমকুম” টাইপ কার্টুন সিনেমা ছিলো।

তখন টিভি চলতো বিকেল পাঁচটা থেকে রাত বারোটা অব্ধি। বিটিভিতে সপ্তাহে একটি নাটক প্রচার হতো আর হতো মাসে একটি বিশেষ নাটক, যেটিকে বলা হতো এ মাসের নাটক। সুর্বনা – আফজাল, মিতা – আল মনসুর, ফেরদৌসী মজুমদার – আবদুল্লাহ আল মামুন এরা ছিলেন সে সময়ের হার্টথ্রব। তবে সুর্বনা আফজালের চেয়ে জনপ্রিয় কোন জুটি সেসময় ছিল না। কালো স্যুটকেস, রক্তের আঙ্গুরলতা, রক্ত করবী নাটকগুলো সে সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ইংরেজী সিরিয়ালও ছিল তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক উম্যান, হাওয়াই ফাইভও দেখার জন্য সবাই সোমবার, মংগলবার গুনে গুনে অপেক্ষা করতেন।

বাংলা গানের মেইন স্ট্রিমের দখলে ছিলেন তখন সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশীদ আলম, আব্দুল জব্বার, বশির হোসেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ছিল বিধায় তখন দেশাত্ববোধক গান খুবই জনপ্রিয় ছিল। ফ্যাশন কুইন রুনা লায়লা গাইতেন নদীর মাঝি বলে এসো নবীন কিংবা লক্ষ প্রানের বিনিময়ে এনেছি সোনার বাংলাদেশ। সাবিনা ইয়াসমিন আসতেন ও আমার সাত কোটি ফুল দেখোগো মালি কিংবা মাঝি নাও ছাইরা দেরে মাঝি পাল উড়াইয়া দে নিয়ে। তবে রুনা লায়লার গাওয়া চটুল গান “বাড়ির মানুষ কয় আমায় তাবিজ করেছে” ও প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সে সময়। পপ গানে ছিলেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাজমা জামান প্রমুখ। সে সময়ের কিছু জনপ্রিয় গান, এমন একটা মা দেনা, মামনিয়া মামনিয়া, চুমকী চলেছে একা পথে, হৈ হৈ রঙীলা রঙীলা রে, অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায় প্রভৃতি।

আরো ছিলেন গাটরী কাঁধে লেইসফিতা, কাঁচের বাক্স কোমড়ে কাঁচের চুড়িওয়ালী আর ঝাঁপি হাতের বেদেনী। যাদের কখনো বাড়িতে ডাকা নিষেধ ছিল। ওরা যাদু মন্ত্র করে বাড়ি থেকে সব নিয়ে যায়। বেদেনীরা শিঙ্গা লাগাতো, কাজটা কি আমি জানি না কিন্তু এই বলেই শব্দ করে ডাকতো। মা – চাচীরা ঘুমিয়ে গেলে দুপুরে গেটের বাইরে গৃহকর্মীরা চুড়িওয়ালী থামাতেন, বাছাবাছি করতেন, সেই চুড়ির ঝুড়ির দিকে কতো দিন তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থেকেছি।

সারা ঢাকা জুড়ে মধ্যবিত্ত এলাকায় টিনশেড একতলা বাড়ির ছড়াছড়ি ছিল। আর বাড়ি ভর্তি ফুল আর ফলের গাছ। প্রতিটি বাড়ির আশে পাশে চড়ে বেড়াচ্ছে হাঁস – মুরগী। বাড়ির সামনের দিকে টিনের চালে বোগেনভিলিয়া আর পেছন দিকে পুঁই – লাউ লতিয়ে থাকতো। অনেক বসার ঘরে একটি সাদা কালো টিভি, কারো কারো বাড়িতে ল্যান্ড লাইনের ফোন যার নাম ছিল তখন টিন্ডটি আর কারো কারো ডাইনীং এ ছিল একটি মাঝারী সাইজের ফ্রীজ যার ওপরটা ডীপ আর নীচের অংশ টুকু নরম্যাল। স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের প্রতিচ্ছবি।

তানবীরা

০৫.১০.০১০

আপডেট

০৬.১০.১০

কৃতজ্ঞতাঃ টুটুল ভাই

Saturday 2 October 2010

জীবন থেকে নেয়া (টুকটাক)

অনেকদিন আগে এই নামে একটিা সিরিজ লিখতাম। মাঝখানে নানা কারনে লেখা হয়ে ওঠেনি, বহুদিন পর আবার জীবন থেকে নেয়া সিরিজটি লিখছি। শেষ কবে লিখেছিলাম তার সঠিক তারিখটি যদিও মনে নেই তবে একবছরতো হবেই। এ পর্বের নাম দিলাম

টুকটাক

১. এদেশে মাদার্স ডে নিয়ে বেশ একটু মাতামাতি আছে। প্রাইমারী স্কুলে তাদের রেগুলার কারিকুলামে মার্দাস ডে’র জন্য টাইম রাখে। মাদার্স ডে উপলক্ষ্যে বাচ্চাদেরকে জিনিসপত্র দেয়া হয় মায়ের জন্য নিজ হাতে কিছু বানানোর জন্য। টীচাররা হেল্প করে আর বাচ্চারা রোজ তাদের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মায়ের উপহারে কাজ করে। আমার মেয়ে রোজই বাবার কানে ফিস ফিস করে আপডেট জানায় আজকে স্কুলে তারা মায়ের গিফটে কি দিয়ে কি করলো। এতো জোরে ফিস ফিস হয়যে আমি ঘরের যেকোন প্রান্ত থেকে তা শুনতে পাই। আবার মেয়ে এসে চেক করে যায় শুনছি নাতো। অবশেষে এলো সেই শুভদিন। মেয়ে স্কুলে থেকে শেখানো গান গেয়ে আমাকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করলো আমি কি খেতে চাই নাশতায়? সে নাস্তা বানাবে কিন্তু চা বানাতে পারবে না তার হাতে গরম লাগবে। ডিমও পোঁচ করতে পারবে না তাতে হাত পুড়ে যাবে। আমাকে শুধু বলতে হবে রুটি কি জ্যাম দিয়ে খাবো না পিনাট বাটার দিয়ে ঃ)। তারপর এলো গিফট নিয়ে। নিজ হাতে বানানো একখানা শিল্পকর্মের সাথে আছে একখানা কার্ড। কার্ডে লিখতে হবে মাকে সে কেন ভালোবাসে। তিনি লিখেছেন, তার মা ভালো রান্না করতে পারে তাই তিনি তার মাকে ভালোবাসে।

ডিং ডং !!!! জীবনে এতো কিছু করলাম নাচ, নাটক, আবৃত্তি, লেখাপড়া কোন কিছুরই কিছু হলো না। সব জায়গায় সবার কাছে একটাই পরিচিতি হলো, রান্না ভালো করি। মেয়ের কাছে পর্যন্ত তাই

২. বাংলাদেশে মেয়ে খুবই আনন্দ পায়। নানাবাড়িতে সবার বড় আর দাদাবাড়িতে সবার ছোট হওয়ার সম্পূর্ন সুযোগ নিতে নিতে সে অভ্যস্ত। অবাধ সে দুষ্টামিতে বাধ সাধতে আসে শুধু এ ডাইনী মা। তারস্বরে চেঁচিয়ে কেঁদে কেটে সে মায়ের নামে নালিশ করে সবার কাছে। বাসায় অন্যদের ভাইরাল হওয়ার সুবাদে একদিন রাতে আমার কাছে সে শুতে এলো। অনেক গল্প করার পর আমি বল্লাম, আমাকে যখন তোমার পছন্দ না, তুমি আব্বুকে বলো, তুমি আর আব্বু মিলে একটা লক্ষী মা নিয়ে নাও। মেয়ে প্রথমে অবাক হলো এ সমস্যা সমাধানের এ ধরনের সহজ সম্ভাবনা কেনো তার মাথায় আগে খেলেনি বোধহয় এই ভেবে। আমি কি করবো, কোথায় থাকবো খুবই গম্ভীরভাবে মনোযোগ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। আমি বল্লাম, আমি থেকে যাবো বাংলাদেশে আমার বাবা মায়ের কাছে, এখানেই অন্যদের মতো আমিও চাকরী করবো। তারপর গভীরভাবে ভেবে সে বললো, একটু দুষ্ট হলেও মা হিসেবে তুমিই থাকো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেনো? গম্ভীর মুখে প্র্যাকটিক্যাল বাবার মেয়ে প্র্যাকটিক্যাল উত্তর দিলো, কারন, তুমি ডাচ আর বাংলা দুটোই জানো। অন্যরাতো জানে না।

ডিং ডং!!! দুটো ভাষা জানায় আমি মা হিসেবে কোয়ালিফাই করলাম

৩. আমি এবার বাংলাদেশে গিয়ে আমার সাধের “বিরিশিরি” বেড়াতে গেলাম। ছিলাম আমরা “ওয়াই।এম।সি।এর হোষ্টেলে। আমি এই পুরো বিল্ডিংয়ের একমাত্র কমোড শুদ্ধ বাথরুমওয়ালা রুমটা ঢাকা থেকে বুকিং দিয়ে গিয়েছি। আমার মেয়ে কমোড ছাড়া বসতে পারে না, বাস্তব সমস্যা। সারা ওয়াই, এম, সি, এতে আমরা ছাড়া কেউ নেই। একদম ফাঁকা যাকে বলে ভি।আই, পি ব্যবস্থা। গরম, বৃষ্টি আর রোজায় এটাই স্বাভাবিক। দিনের বেড়ানো শেষে সন্ধ্যায় আমি তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকলাম। আমাকে গোসল দিতে হবে। আমি মোটাসোটা মানুষ, গরমে আমার চর্বি সারাক্ষন গলতে থাকে। আমাকে কম করে হলেও ঢাকায় তিনবার গোসল করতে হয়। বাথরুম ছোট, অন্য সমস্ত ব্যবস্থা খুবই সাধারনের চেয়ে সাধারন হলেও তাতে টয়লেট পেপার দেয়া আছে, এ আনন্দে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। মেয়েকে টয়লেটে বসিয়ে দিয়ে মাত্র টয়লেট পেপারের রোল টেনেছি, তৎক্ষনাত এতো বড় পেটওয়ালা এক মাকড়সা তার থেকে বেড়িয়ে এলো। কতো বছর বাদে মাকড়সা দেখেছি কে জানে তাও আবার গর্ভবতী। আমি এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে বাথরুমের বাইরে। আমার অনভ্যস্ত শরীর আর অপ্রস্তূত মন ঘৃনায় রি রি করতে লাগলো। মফস্বলের সেই স্বল্পালোকিত বাথরুমে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে কি ঘটনা ঘটে গেলো, আপাতঃ দৃষ্টিতে গুন্ডা কিসিমের মা কেনো এতো বড় চিৎকার দিলো, আমার মেয়ে তার কিছুই বুঝতে না পেরে সমানে জিজ্ঞেস করছে আম্মি কি হলো, আম্মি কি হলো?

চিৎকারের শব্দে ভাইয়া তার রুম থেকে বেড়িয়ে ধমাধম আমাদের দরজায় মারছে কি হলো কি হলো, দরজা খোল। আমি মোটামুটি গোসলের জন্য প্রস্তূত তাই দরজাও খুলতে পারছি না। কোন রকমে সব গুছিয়ে দরজা খুলে মেয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হলাম। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম পার্মানেন্টলী, থাক গর্ভবতী মাকড়সা থাক তার স্বস্তি নিয়ে। ভাইয়ার বাথরুমে যেয়ে দেখি কড়াই থেকে উনুন। দুটো তেলাপোকা পেট উলটে সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তারপরও সেখানে গোসল সেরে কাপড় টাপড় জড়িয়ে নিজের ঘরে ফেরত এলাম। আমার চিন্তা চেতনায় আছে যতো দ্রুত মশারি টানিয়ে তার নীচে আশ্রয় নেয়া যায় এই পোকা মাকড়ের ঘরবসতির কাছ থেকে। সেই লক্ষ্যে আমি দ্রুত হাত চালাচ্ছি আর সব গোছাচ্ছি। আর একটি ভয়ও আছে এরমধ্যে বিজলী চলে গেলেতো যাকে বলে “সোনায় সোহাগা”। আমার ছোট বোন যে এখনো এধরনের পরিবেশে একেবারে অনভ্যস্ত হয়ে যায়নি সে রিলাক্স গলায় আমাকে বললো, বাইরের গান শুনতে পাচ্ছো?

আমি অবাক হলাম কিসের গান? বাইরে কোন শব্দ হচ্ছিলো কীনা সেটাতে মনোযোগ দেয়ার মতো মনের অবস্থা তখন আমার ছিলো না। বোন বলাতে প্রথম শুনলাম যদিও বুঝলাম না গান না চিৎকার না অন্যকিছু। আমি বল্লাম বিরক্ত গলায় কে গান গায়? সে সময় আমার মনে যে ভয়ার্ত অবস্থা বিরাজ করছিলো তাতে কোন শিল্পকর্মের রস নেয়ার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। বোন বললো, নীচে যে ছেলেগুলোকে দেখলাম মনে হয় সেগুলো। বাংলাদেশের সব ইনস্টিউটে যেমন কতোগুলো আজাইরা ছেলেপুলে ঘোরাফেরা করে, এটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আমি আরো বিরক্ত গলায় বল্লাম, কার জন্যে গায়? বোন আরোই নিস্পৃহ গলায় বললো, হোষ্টেলেতো আমরা ছাড়া আর কেউ নেই, তাহলেতো মনে হয় আমাদের জন্যই গায়। আমি খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে বল্লাম, আমার জন্য না। বোন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি করে বুঝলে? আমি বল্লাম, আমি মেয়ের মা, আমার জন্য গান গাইতে কার ঠেকা পড়েছে? বোন বিরক্ত হয়ে বললো, ওরা কি করে জানবে কে মেয়ের মা আর কে মেয়ের খালা?( এ প্রসংগে একটা কথা বলতে হবে, নইলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে না। আমি কেনাকাটা করতে বেড়োই বাসা থেকে কাউকে নিয়ে। কিন্তু কিছু পছন্দ করতে গেলেই সমস্যা হয়। আমার ধারনা সব জামা কাপড় আমাকে মানাবে না কারন আমি আর এখন কলেজ গোয়িং কেউ না। তারাও আমাকে পালটা বুঝায়, যতো বুড়িভাব আমি ধরার চেষ্টা করি, ততো বুড়িও আমি আবার না।)গল্পে ফিরে আসি। আমি খুবই বিজয়ীর ভঙ্গীতে বল্লাম, মেঘ যখন নীচে দৌড়াদৌড়ি করছিলো আমার সাথে খেলছিলো তখনতো সবাই দেখতেই পেয়েছে। আমার বোন তার চেয়ে ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, তো, তাতে যারা গান গাইছে তাদের কি “ফারাক” পড়লো?

ডিং ডং!!!!

৪. “বিরিশিরি” থেকে আসার পথে ময়মনসিংহ এসে এসি বাসের টিকিট কিনে বসে আছি। বাস কখন ছাড়বে তার ঠিক নেই, কখন পৌঁছবে তারও ঠিক নেই। বিরক্তিতে আমার মাথা ঘুরছে। ক্লান্তি ঘুমে আমি জেরবার। এমন সময় আমার ফিচলা ছোট বোন আমাকে বললো, একটা ছেলে নাকি আমার দৃষ্টি আকর্ষন করার খুব চেষ্টা করছে। আমি বোনের নির্দেশিত পথে তাকাতেই দেখলাম, শার্ট – প্যান্ট, ঘড়ি - সানগ্লাস পরা এক যুবক খুবই ভাব নিয়ে বাস যেখানে থেমে আছে তার সামনের দোকানটায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক মতো মোঁচ দাড়ি গজিয়েছে কি না কে জানে। আমি বোনকে কড়া গলায় ধমক দিলাম, আবার যদি ঘুম থেকে ডাকবি তোর পিত্ত আমি গেলে দিবো। ফিচলা বোন বললো, আহা কি মজাদার ভাবভঙ্গী করছে, ঘুমাইলে দেখবা কি করে? আমি নিরাসক্ত গলায় বল্লাম, যে ছেলেকে ময়মনসিংহ থেকে পাজেরো বাদে বাসে ঢাকা যেতে হয় তার কোন ভাবভঙ্গীতে আমি আগ্রহী না। বোন অবাক গলায় বললো, তুমি নিজে যে যাইতেসো, তার বেলায়। আমি তখন নিরুপায় গলায় বল্লাম, তারপরও না।

ডিং ডং!!!!

৫. ২০০৮ সালে ভ্যালেন্টাইন ডেতে বইমেলায় গেলাম। সেদিন বইমেলায় বেশ ভীড়। আমরা ঘোরাঘুরি করে, সেখানে এলাম যেখানে লেখকদের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়।(জায়গাটার নাম এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না)। কারো বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠান হচ্ছিল তখন সেখানে দেখলাম বেশ অনেক ছবি টবি তোলা হচ্ছে। আমরাও তাড়াতাড়ি লাইনে দাড়ালাম। বিখ্যাত কারো সাথে ছবি তোলার চান্স মিস করতে আমরা রাজি ছিলাম না। আমরা চারবোন প্লাস আমাদের ভাবি। কবি বা লেখক সাহেব আহ্লাদে গলিত হয়ে আমাদেরকে সবার আগে ডেকে নিলেন ওনার সাথে ছবি তুলতে। আমরা দন্তবিকশিত হাসি দিয়ে ফটো তুলে ষ্টেজ থেকে নামছি আর একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করছি ওনি কি কবি না লেখক? ওনার নাম কি, পরিচয় কি? কেউ জানে না কেউ জানে না শুধু ………। একবার ভাবলাম যাই, যেয়ে জিজ্ঞেস করি, ভাই আপ্নে কে, কি আপনার পরিচয়? কিন্তু ভীড় ভাট্টা দেখে আর সে সাহস হয়নি। আজো জানি না তিনি কে ছিলেন?

ডিং ডং!!!!

তানবীরা
৩০.০৯.১০