বৈদেহীঃ নাসরীন জাহান
নাসরীন জাহান-এর বৈদেহী পড়লাম। একটি
চমৎকার বিষয় নিয়ে বইটি লেখা হয়েছে। মূল
আখ্যায়িকায় বলা, সংবেদনশীলতা আর
আমাদের শৈশবের
শিক্ষা আমাদের পরবর্তী জীবন আর মানসিকতার ওপর কী প্রভাব ফেলে। কিন্তু লেখিকার লেখার
মুন্সিয়ানার অভাবের কাছে
মার খেয়ে গেছে অনেকটাই লেখাটি। উপন্যাসটি আরো ভাল হতেই পারতো। বানান ভুলগুলোও দেখা
দরকার ছিলো।
আমাদের ঘরে ঘরে এমন নিরালা আছে। যারা
জানেই না তারা নিজেরা জীবনে কী চায়। তাদের জীবনের ঘড়ি আবর্তিত হয় স্বামীর ইচ্ছের সাথে। স্বামী কী খেতে ভালবাসে কী বাসে
না ভাবতে ভাবতে নিজের কিছু চাহিদা ছিলো কিনা
তাই ভাবতে ভুলে যায়। শৈশবের শিক্ষার কারণেই জুজু তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় জীবনভর।
ধর্মের জুজু, স্বামীর জুজু, পরকালের জুজু আর এই লোকভয় প্রোথিত করে গুরুজনেরা। ধর্ম হলো
কাউকে শাসনে রাখার বড় হাতিয়ার। একবারও কোন মেয়ে প্রশ্ন করতে সাহস পায় না, ধর্ম
শুধু মেয়েদের প্রতি এতো কঠিন কেন? মেয়ে হয়ে জন্মানো কেন তবে? ধর্ম কী তাহলে ইচ্ছে করে সমস্যা তৈরী করতে ভালবাসে?
মেয়েদের না তৈরী করলে কী হতো না? কিংবা শুধু নারী দেহ তৈরী করতে পারতো, ব্রেইন না
দিলেও সমস্যা ছিলো না। কিংবা গৃহস্থালী কাজ করার জন্যে যতটুকু মগজের দরকার তার বেশী
না দিলেই হতো। সর্বশক্তিমান কী এইটুকু শক্তি বা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করতে পারতেন না?
আশা করছি, এই বিষয়টার ওপরে ভবিষ্যতে
আরো অনেকেই কাজ করবেন। মেয়েরাই বোধ হয় সবচেয়ে ভাল কাজ উপহার দিতে পারবেন কারণ
ভুক্তভোগী ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাদেরই বেশি এই স্থানটিতে।
জীবনের
যাতনার বিষে নীল হতে হতে, নিজেকে নারী দূরে থাক এমনকি মানুষ হিসেবেও অগ্রাহ্য করতে
করতে ভার্জিনিয়া উলফের সেই দীর্ঘশ্বাস মনে পড়ে, নিজের একটা ঘর!
উপন্যাস
থেকে তুলে ধরি নিরালার
কিছু তেতো নোনা অভিজ্ঞতা:
দাদীআম্মার জীবনে প্রাণের চেয়েও মূল্যবান শব্দ
সতীত্ব। এই বিষয়ে তাঁর আবেগ এমনই প্রবল, তিনি হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে মূল্যবান এবং
পবিত্র বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেন একসময়ের সহমরণকে। সীতা দাদীআম্মার জীবনের প্রধান
এক আদর্শ। তিনি চোখমুখে আলো জ্বেলে গল্প করতেন, কি করে রাবণ রাক্ষসের মতো লম্পটের
কাছে গিয়ে সেই বৈদেহী নিজেকে সতী রেখেছিল-বলতেন, তুই হবি তা-ই। কেউ তোকে যদি এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করে, ধরণীকে
নির্দ্বিধায় বলবি, দু ফাঁক হতে। আগুনকে বলবি, তোকে আশ্রয় দিতে।
নিরালার মনে তার দাদীকে নিয়ে প্রশ্ন জাগে কিন্তু
তা প্রশ্রয় পায় না নানামুখি চাপে ও তাপে:
শিক্ষা তাঁকে বিচিত্র করেছে। কিন্তু আলোকিত করতে
পারে নি। যেহেতু পরকালই মানুষের জীবনের অনন্ত জীবন, সেহেতু এই স্বল্পকালীন জীবনের
ভুল-ভ্রান্তির জন্য অন্ধকার কবরে গিয়ে ফেরেশতাদের দেয়া কঠিন যন্ত্রণা যাতে ভোগ
করতে না হয়, এই বিষয়ে ছিল তাঁর সচেতন দৃষ্টি। ত্যাগ আর তিতিক্ষাই তিনি করেছিলেন জীবনের প্রধান ধর্ম। এই বিষয়ে সুরে
গান রচনা করতেন তিনি-“এই দুনিয়া ঘোরের বাজার, সুন্দরী পাপ হাজার হাজার, সেই ভুলে
পা দিও না গো বেহেশতরেই পাখি, মোহের খেলা বন্ধ হবে, বন্ধ হলে আঁখি।” সৃষ্টিকর্তার
পরই যেহেতু ইহদুনিয়ায় স্বামীর স্থান, স্বামীকে তিনি গুরুত্ব দিতেন পয়গম্বরেরও অধিক
হিসেবে।
নিরালার স্বামী হাসানের হতাশ অভিজ্ঞতা:
নীরার সাথে এই একটি জায়গাতেই আমার প্রবল মিল,
আমরা দুজনেই খুব কুণ্ঠিত, নির্জন, চাপা
স্বভাবের। এক ঘন্টা এক সঙ্গে আছি, হয়ত দেখা যাচ্ছে দুজনের মধ্যে কোনো কথাই হচ্ছে
না, কিন্তু উভয়েই এতে প্রাণের উত্তাপের কোন ঘাটতি অনুভব করছি না। তবে ওকে কেন্দ্র
করে আমার একটাই শূন্য দিক, ও আমাকে বড়
জ্ঞান করে, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে, এক সমান্তরালে দাঁড়ানো বন্ধু মনে করতে পারে না। ও
দুঃখে, প্রেমে, ক্রুদ্ধতায় সবকিছুতেই আমার কাছে নত। ওর এই স্বভাব যতটা না অনুভব
থেকে উঠে আসে তার চেয়েও বেশি আসে তার আজন্ম শিক্ষা থেকে। এই বিষয়ে ও এমনভাবে
নির্মিত, আমি এই একটি বিষয়কেই চেঁছে কোনো নতুন রূপ দিতে পারি নি।
মুসলিম পরিবারে জন্মেছি তাও বাংলাদেশে। নেহাত
নিরালা হতে হতে হয়ে ওঠা হয়নি কারণটা হয়তো শহরে জন্মানো আর বড় হওয়ার কারণে। যৌথ পরিবারে
বাবা কাকারা জীবিকার তাগিদে বাইরে বাইরে থাকতেন সারাদিন। মা, চাচীরা, দাদীর কাছ
থেকে এই শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। মেয়েদের কী করতে আছে আর কী করতে নেই। জোরে হাঁটতে,
লাফাতে নেই মাটি ব্যথা পাবে, ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করাটা ঠিক না সমান সমান কারণ ভাই
ছেলে তার অধিকার বেশি, সেইতো বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা আমি বা আমরাতো অস্থায়ী।
মেয়েদের জোরে কথা বলা নিষেধ, যখন তখন ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। দাদু বলতেন, এমন করে
চলতে হবে যাতে অন্য পুরুষ টের না পায়, পৃথিবীতে যে একজন অন্য নারী আছে, এটা অবশ্য
দাদুর নিজের কথা নয়, হাদীসের কথা।
গা ঢাকো, পা ঢাকো, মাথা ঢাকো শেখাতে শেখাতে
ছোটবেলা থেকেই মেয়েগুলোকে এমন করে তুলে যে জীবন কেটে যায় ঢাকতে ঢাকতে। মন আর
অন্যদিকে দেয়ার সময় পায় না। নিজেকে সবার সমকক্ষ ভাবার বীজ অঙ্কুর হওয়ার আগেই মিশে
যায়। ধর্মের বলি থেকে তখন হয়ে ওঠে ধর্মের রক্ষক। নিজের জীবনে যা পেয়েছে তাই বংশ
পরিক্রমায় বিলাতে থাকে। আজকাল চারপাশে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির এই মানসিকতা
শিশুরা বাইরে কোথাও থেকে আহরন করেনি। দাদী, মা, নিরালাই
নিয়ে এসেছে ধীরে ধীরে ......
সব মিলিয়ে বৈদেহী আমার কাছে কিছু রেখে গেলো।
তানবীরা
২২/০৩/২০১৫