Sunday 24 June 2018

গুন্ডা কিংবা গুন্ডে


জ্যাকি স্রফের “হিরো” সিনেমা থেকে নাকি মিঠুন চক্রবর্তী’র কোন সিনেমা থেকে আদব-কায়দা সম্পন্ন, দয়ালু, মানবিক ও মানবতায় ভরপুর, দারুন রোমান্টিক গুন্ডার আবির্ভাব দেশে সেটা গবেষনা সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু আমরা “রাম-লক্ষন”, “ওয়ান-টু-কা-ফোর-ফোর-টু-কা-ওয়ান, তেজাব, সাড়াক ইত্যাদি সিনেমায় দেখতে পাই এরা গুন্ডা হলেও আসলে মহামানব, পঁচা বড়লোকের টাকা ছিনতাই, নেকলেস ছিনতাই, ব্যাঙ্ক ডাকাতি ইত্যাদি করে সেগুলো নিয়ে যেয়ে বস্তির গরীব বাচ্চাদের মধ্যে কোকোলা চকলেট কিনে বিলিয়ে দিয়ে মহান মানবতার সেবা করেআর ভাববেন না, এরা নিজেরা ইচ্ছে করে, শখ করে গুন্ডা হয়েছে, স্কুলের “এইম ইন লাইফ” রচনায় এদেরও কারো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট ইত্যাদি হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু জীবনের নির্মমতায় এরা গুন্ডে হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে যদিও আপনি বাড়িতে শুনে বড় হয়েছেন, আপনার বাবা, চাচা, মামা পয়সার অভাবে, কলেজের অভাবে কিংবা অন্য কোন কারণে মার্স্টাস শেষ করতে পারেনি তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে মফস্বলের কলেজের শিক্ষক হয়েছে। কিংবা কবিতায় পড়েছেন, অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি , অন্ধকার ছাপা খানায় কাজ করে কিন্তু এদের কথা আলাদা। এদেরকে আপনি তাদের সাথে মেলাতে যাবেন না, প্লিজ। তবে দিনের শেষে এরা লাইনে চলে আসে। এ ধারায় বাংলাদেশে কিংবদন্তী ছিলেন জনাব বাকের ভাই।


ইয়ে বলতে দ্বিধা নেই, সেই স্কুল-কলেজের লাইফে যখন মাত্র বোধ হয় হয়েছে,  অনুভব করতে পারলাম, ফুচকা খেতে যতই ভাল লাগুক, ফুচকাওয়ালাকে বিয়ে করে ফেলাটা ঠিক হবে না তখন কিন্তু মনে মনে এরকম হ্যান্ডশাম, নাচ গান জানা, পরোপকারী গুন্ডার কথা ভাবতাম  আমাদের সময় ট্রেন্ড ছিলো ভিসিআরে সিনেমা দেখা, গ্রাম থেকে কেউ এলেই বায়না ধরতো, মুভি দেখবে আর আমরাও তাদের পটিয়ে পটিয়ে আমাদের পছন্দের সিনেমা আনাতাম তখনও মানবতা-মানবধিকার ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে পরিচিতি হই নি তাই জিতু আঙ্কেলকে খুব ভাল লাগতো বারবার, প্রতিবার কাউকে পেলেই মাওয়ালী, জাস্টিস চৌধুরী ইত্যাদি সিনেমা দেখতাম


এছাড়া আছে শক্তি কাপুর, ডিপজল, আমজাদ খান, অমরেশপুরী, মিশা সওদাগর টাইপের গুন্ডে। এরা মন্দ গুন্ডে, জন্ম থেকেই গুন্ডে, হাজার হাজার সুযোগ সুবিধা থাকা’র পরেও এরা মানুষজনকে ক্যালাতে, ফেলাতে, ট্যালাতে ভালবাসে। দেখতে হয় বদখত, শাবাব চৌধুরী টাইপের হ্যান্ডশাম হয় না, তবে এরাও টাকা দিয়ে মানুষের জীবনের দাম পরিশোধ করে ফেলতে চায় এরা সাধারণতঃ যে কোন আবহাওয়াতে স্যুট-টাই কিংবা সুপারম্যান টাইপের অদ্ভূদ জামা কাপড় পরে কোন একটা বিটকেল চেম্বারে টেলিফোন নিয়ে বসে থাকে।  আর সারাবেলা সারা পৃথিবীকে তছনছ করে দেয়ার স্বপ্ন লালন করে, অধুনা – এভেঞ্জার্স – দ্যা ইনফিনিটি ওয়ারকেও উদাহরণ হিসেবে নিতে পারেন। তবে এরা শেষ পর্যন্ত জেতে না, মার খায় ও একদম মরে যায়, বেঁচে উঠে আবার কি করবে এর রিস্ক কেউ শেষ পর্যন্ত নেয় না তাই এদের মেরে দেয়া হয়। এরশাদ শিকদার এর একটি উদাহরণ। তবে কেউ কেউ পালিয়ে হজ্ব করতে সৌদি চলে যায়, যেমন ইয়াবা বদি আবার সব ম্যানেজ হয়ে গেলে ফিরে আসে  

আর এক শ্রেণী’র গুন্ডাকে ফিসফাস করে বলা হয়, সরকারী গুন্ডা।  কেউ গাড়ি চাপা পরলে সেই দৃশ্য কেউ মোবাইল ফোনে তুলে রেখে সেই ভিডিও থানায় যেয়ে দেখালেও তারা আসামী চেনে না। একজন সচেতেন নাগরিক নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে এতদূর আগায়। তারপরও এদের ইয়াদদাশ হামেশাই খোয়ী র‍্যাহতে হ্যায়। জনগনের করের টাকায় বেতন নেয়, ঘুষ নেয় কিন্তু তারপরও তাদেরকে কি সেবা দেয় সেটা উচ্চারণ করে বলা যাবে না, বললে গর্দান থাকবে না। তবে সিনেমায় এদের কোন রোল থাকে না, শুধু শেষ দৃশ্যে এদের উপস্থিতি মোটামুটি অবশ্যম্ভাবী, তারা এসে ব্রিটিশ আমলের পিস্তল উঁচিয়ে ধরে বলে, “আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না”, কারণ আইন তাদের মামা বাড়ির কাঁঠাল, আইন তাদের পকেটে থাকে, তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি। যখন ইচ্ছে তারা আইন তুলবে, ক্রসফায়ার করবে, পা কেটে দেবে, কাউকে বাড়ি থেকে তুলে নেবে, অপরাধী কাউকে চিনবে না, কাউকে খুঁজে পাবে না তাদের এই রানীর রাজত্ব্যে। এরা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ফসল, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এরা একই থাকে, কখনো পরিবর্তন হয় না কারণ রাষ্ট্র তাদের পরিবর্তন হওয়ার কোন সুযোগ দেয় না।  

আর এক শ্রেণীর গুন্ডে অক্সিজেনের মত বিরাজ করে এরা সবসময় পর্দার অন্তরালে থাকে, জন সম্মুখে এদের কখনও দেখতে পাওয়া যায় না। এদেরকে ডন বা ভাই বলা হয় এদের জীবন নিয়ে বই লেখা হয়, সিনেমা বানানো হয় তবে মাঝে মাঝে বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা, খেলোয়ার, অভিনেতা এদের সাথে তাদের ছবি দেখতে পাওয়া যায় এরা নিজেরা কখনো বাইরে আসে না, বরং এসব বড় মানুষরাই আমন্ত্রিত হয়ে তাদের কাছে যায়  

২১/০৬/২০১৮

Friday 22 June 2018

দ্যা সিক্রেট বাঙ্কার



http://www.banglatribune.com/lifestyle/news/335481/%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A6%AC-%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF



শীত কেটে গিয়ে সূর্য উঠলে শুরু হয় ইউরোপে বসন্ত। আমরাও শীতনিদ্রা থেকে বের হয়ে শুরু করি ইতি উতি ঘোরাঘুরি। বন্ধুদের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম পাশের দেশ জার্মানীর সবচেয়ে গোপনতম বাঙ্কারটি দেখতে যার অফিসিয়াল নাম  "Dokumentationsstätte Regierungsbunker"  জার্মানী'র বন শহর থেকে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দক্ষিনে আহর (AHR) পাহাড়ের উপত্যাকায় Ahrweiler এবং Dernau এই দুই শহরের মাঝখানে এর অবস্থান। "কোল্ড ওয়ার" এর সময় এটি নির্মিত হয়, জার্মান সরকার, সংসদ সদস্য, উচ্চ পদস্থা সরকারী কর্মকর্তা'রা যেন জরুরী অবস্থায় কাজ চালিয়ে যেতে পারে সে উদ্দেশ্যে জার্মানীর সর্বকালের গোপনতম এই বাঙ্কারটি তৈরী। গোটা পৃথিবীর কাছে জার্মানী’র লুকিয়ে রাখা একটি গোপনতম সত্যি ছিলো এটি।

ন্যাটো এবং ওয়ার্শাও প্যাক এর বিরোধিতায় আনবিক যুদ্ধ যখন আসন্ন, রাজধানী বন হতে পারে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল তখন আনবিক বোমার ভয়ে জার্মান'রা পরিকল্পনা করলো আনবিক বোমা থেকে বাঁচার জন্যে আশ্রয়স্থল  নির্মান করবে। সেখান থেকে বাকি রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনা করবে। উনিশো পঞ্চাশ সালের দিকে বাঙ্কারটি তৈরীর পরিকল্পনা শুরু হয়। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী কর্নাড আডেনাওয়ার আর জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এই পরিকল্পনা করেছিল। বছর ধরে একটা ভাল আর উপযুক্ত জায়গা খোঁজাখুঁজি করার পর বনের খুব কাছেই কিন্তু আবার শহর নয়, উপশহরও ঠিক নয় Bad Neuenahr এর কাছে Ahrweiler এই  Ahrtal এই জায়গাটি তাদের পছন্দ হয়। তারা ভাবলো শত্রুরা কখনো এত পল্লী জায়গায় বোমা ফেলার কথা ভাববে না। কখনো কাজ শেষ না হওয়া দুটো রেললাইন ছিলো এই বাঙ্কারটি তৈরীর প্রাথমিক উপাদান। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না বলে রেললাইনটি কখনো চালু করা হয় নি। প্রথমে এতে মাশরুম চাষ হয়েছিল পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে কিছু অস্ত্র তৈরীর কারখানা এই টানেলটি দখল করে তারও পরে Lager Rebstock (Camp Vine) এই কোড নাম দিয়ে রাজনৈতিক বন্দীদের দিয়ে জোর করে এর রক্ষনাবেক্ষণের কাজ করানো হত।  

রেললাইন থেকে শুরু করে একশ দশ মিটার মাটির নীচে আসে বাঙ্কারটি'র প্রবেশ পথ। উনিশো বাষট্টি সালে কাজ শুরু হয়ে, টানা নয় বছর চলে রিগিয়ারুংস বাঙ্কারটি'র কাজ, উনিশো একাত্তর সালে এটি সম্পূর্ণ হয়। সতের দশমিক তিন কিলোমিটার দৈঘ্য'র এই বাঙ্কারটিতে স্বাভাবিকভাবে নয়শ ছত্রিশ জনের ঘুমের ব্যবস্থা আর আটশো সাতানব্বইটি অফিস রুম আছে, দরজা’র সংখ্যা পঁচিশ হাজার। জরুরী অবস্থায় বাইরের পৃথিবী’র সাহায্য ছাড়া তিন হাজার মানুষ যেনো অন্তত ত্রিশ দিন বেঁচে থাকতে পারে সেরকম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভারী স্টিলের পাত দিয়ে বানানো দরজাগুলো মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেনো পৃথিবী থেকে বাঙ্কারটিকে আলাদা করে ফেলতে পারে সেভাবেই এটি তৈরী। তাজা বাতাস, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা সহ এই বাঙ্কারটি তৈরীর ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন বিলিয়ন ডয়েচ মার্ক যদিও শেষ পর্যন্ত কত খরচ হয়েছিলো প্রচন্ড গোপনীয়তার কারণে কেউ তা আজও জানতে পারে নি   
মানুষজন যেনো মাটির নীচে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে কাজকর্ম করতে পারে ও বসবাস করতে পারে তার জন্যে যত ধরনের সুযোগ সুবিধা দরকার তার সব কিছু'র ব্যবস্থাই এখানে আছে। ডাক্তার চেম্বার ও রোগী দেখার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, দাঁতের ডাক্তার, চুল কাটার সেলুন, বিয়ার খাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরাট এই স্থাপনা হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে আমরা বেশ ক্লান্ত হলাম বাইরে তাপমাত্রা বিশের ঘরে থাকলেও বাঙ্কারটি'র তাপমাত্রা সবসময় বারো ডিগ্রী সেলসিয়াসে রাখা হয়, হালকা জ্যাকেট গায়ে রেখেও বেশ শীত শীত লাগছিলো।

শীতল যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক দিন পর পর্যন্তও এই বাঙ্কারটির কথা জনগনকে জানানো হয় নি। তিন শিফটে পালা করে একশ আশি জন কর্মী বাঙ্কারটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করত। হিরোশিমা’র সমপরিমান মানে বিশ কিলোটন বোম ব্যবহার করলে এটি ধ্বংস করা যেতো। এটি জানা সত্বেও রাজনৈতিক কারণে এটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যখন জার্মানরা মোটামুটি যুদ্ধের আর প্রয়োজন হবে না বলে নিশ্চিত হলো তখন তারা জনসম্মুখে বাঙ্কারটি'র কথা প্রকাশ করলো। দুই হাজার এক সাল থেকে দুই হাজার ছয় পর্যন্ত আস্তে আস্তে বাঙ্কারটি ধ্বংস করতে শুরু করলো তারা। তাদের যুদ্ধ দিনের আশ্রয়স্থলের একটি অংশকে তারা যাদুঘরে রুপান্তর করেছে, যার নাম Dokumentationsstätte Regierungsbunker এক পাশের খুব সামান্য অংশই খোলা হয়েছে জনগনের জন্যে বাকি কিছুটা পরিত্যক্ত আর অনেকটাই সীল মোহর করে দেয়া হয়েছে। তাই চাইলেও পুরো সত্য জানার উপায়  কারো নেই।

দুই হাজার আট সালে রিগিয়ারুংস বাঙ্কারটি জনসাধারণের দেখার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। জার্মানীর ইতিহাসের সবচেয়ে গোপনতম বাঙ্কারটি হয়ে উঠলো দর্শনার্থীদের ঐতিহাসিক দর্শন স্থান। জার্মানীতে এটি বেশ  চিত্তাকষর্ক দর্শনীয় স্থান। একটি বিপুলাকৃতির স্থাপনা, যার অসংখ্য প্রবেশদ্বার, অসংখ্য যন্ত্রপাতি, নানা ধরনের বৈদ্যুতিক কার্য কলাপ, বের হবার দরজা কি নেই সেখানে। সব কিছু দেখতে পাওয়া যাবে এক জায়গাতেই। অবাক বিস্ময়ে দেখতে হয় আনবিক যুদ্ধের সময় নিজেদেরকে বাঁচাবার র যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জার্মান সরকারের কি বিশাল প্রস্তূতি ছিলো।

গাইডের মুখে শুনতে পেলাম, বার্থ ডে পার্টি, পিজামা পার্টি, অফিসিয়াল ডিনার, কনফারেন্স এর কাজে এখন বাঙ্কারটিকে ভাড়া দেয়া হয়।

বাঙ্কারের পাশেই দর্শনার্থীদের জন্যে চা,কফি, বিয়ার কিংবা ছোটখাট স্ন্যাক্স খাওয়ার জন্যে ফ্রাইস, হট ডগ ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। ঠান্ডা থেকে বের হয়েই সাথে সাথে গরম গরম জার্মান ফ্রাইস আর কফি খেলাম তার সাথে বন্ধুরা মিলে আড্ডা তো আছেই।

বাঙ্কারটি দেখা শেষ কিন্তু ফিরে আসবো? কিছুতেই নয়। ভ্যালিটি অত্যন্ত মনোরম, হেঁটে চলার পথের সাথে আছে গাড়ি চলার পথও। বেশির ভাগ পর্যটকই অবশ্য হেঁটে চলার পথটি দিয়ে আঙ্গুর বাগান, আপেল বাগানের মাঝ দিয়ে একদম চূড়োতে চলে যান, সাথে আছে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, চোখ ফেরানো দায়। আমরাও হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। অনেক ওয়াইন কোম্পানী তাদের লোগো বসিয়ে রেখেছে আঙুর বাগানে আবার অনেক  আপেল কোম্পানী তাদের প্যাকেট সাজিয়ে রেখেছে তাদের আপেল বাগানে, হাঁটতেই হাঁটতেই দেখতে পেলাম যে কোম্পানীর জুস খাই তার আপেল কোথা থেকে আসে।

ভ্যালি'র ওপর থেকেই দেখতে পাওয়া যায় সুন্দরতম Ahrweiler শহর,  Ahr নদী'র কিছু অংশ আর অপরূপ কারুকাজ করা Ahrweiler এর টাউন হল, চার্চ ইত্যাদি। না দেখে ফিরে আসা মহা অপরাধ সমতূল্য। পুরো একটি দিন ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম বন্ধুদের নতুন কেনা ডেরায়। সারা সন্ধ্যে তুমুল আড্ডা আর গান-কবিতার আসরের মাঝেও বার বার মনে উঁকি দিয়ে গেলো “দ্যা সিক্রেট বাঙ্কার”

তথ্যসূত্রঃ অন্তর্জাল



Saturday 16 June 2018

আব্বু দ্যা বস (কার্ড)




কার্ড খেলা শিখেছিলাম আব্বুর কাছে বেশ ছোট বয়সে তবে প্রথমে আব্বুকে “প্রমিজ” করতে হয়েছিলো, কখনো কোথাও টাকা দিয়ে কার্ড খেলবো না। আমাদের স্কুল-কলেজ তথা পুরো ছাত্র জীবনই কেটেছে, হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও এর মাঝে। শহুরে মধ্যবিত্তের মাথায় তখনও এপার্টম্যান্ট ব্যাপারটি সেভাবে গেঁথে যায় নি, তাই এই শহরে তখনও ইট কাঠের দালান ভেদ করে ঐ আকাশ দেখা যেতো ঢাকা’র সেন্টার পয়েন্টে বাড়ি বলে ছাদে উঠলেই ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজের ছাত্রদের রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, টিয়ার শেল মারা, কি তুমুল উত্তেজনা, সবই শুধু চোখে দেখা যেতো। একমাত্র বিনোদন ছিলো বোকা সরকারী টিভিতে ফিল্টার করা খবর, ভিসিআর আর পরে এসে ডিশ যোগ হলো আর এর বাইরে ছিলো বইরাস্তার পরিস্থিতি সব সময় বাসা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া’র অনুকূলে থাকতো না বলে কার্ড খেলা শিখিয়ে দিয়ে আব্বু’র তেমন কিছু লস হয় নি। আব্বুরও সময় আমাদের সাথে ভালই কাটতো

আমাদের সময় গড়পড়তা মধ্যবিত্ত জীবনে “মেয়ে মাইনষের কার্ড” খেলাকে যারপর নাই ঘৃণা’র এবং তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হত। একদল কাজিন খেলতো আর একদল কঠোর “গুনাহ” এর দৃষ্টিতে দেখতো। আমাদেরকেও ঠারে ঠুরে কথা শুনতে হয়েছে, কি জানি (একটা লম্বা নিশ্বাসের পজ হবে) তারপর এখনই কেয়ামত হয়ে মাথায় আকশ ভেঙে পরবে এই রকম উদাসি সুরে টেনে টেনে খানিকটা নাকে আর খানিকটা গলা দিয়ে বলা হতো, “কিয়ের জানি কি দিনকাল পরছে, কি জমানা আইছে গো, মাইয়ারা বলে টাসটুস খেলে”। এই কথাগুলো শুনেছি আমরা পরিবারের একান্ত আপনজনদের কাছ থেকে, এক হাত দূরত্বের মাঝে থেকে শুধুমাত্র স্বয়ং আব্বু আর ভাইয়া এতে সরাসরি জড়িত ছিলো বলে আমাকে বা আমাদেরকে “ক্রসফায়ার”এ দেয়া হয় নি। আমি আজও ভেবে পাই না, আমাদের সংস্কৃতিতে মেয়েদের যেহেতু বাসা থেকে বেরোনো’র সমস্যা, কার্ডের মত একটা বুদ্ধির খেলায় তাদের এত নেতিবাচক মনোভাব কেন? এরমধ্যে পাপপুণ্য কোথায় জড়িত? অল্প টাকায় আর অল্প জায়গায় যে কোন জায়গায় লুডু’র মত এটিও খেলা যায়। তবে অনুমান করতে পারি, ক্লাব ব্যাপারটা আমাদের দেশে খুব নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপণ হয় নাটক, সিনেমা কিংবা মিডিয়াতে, ক্লাব মানেই এলকোহল আর কার্ড, সুতরাং এ জিনিস মানষের চেতনায় খারাপ ভাবে আঁকা হতে বাধ্য। বাজে দিকও অবশ্য আছে, যখন প্রথম দিকে খেলার খুব নেশা, বান্ধবীরা মিলে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে খেলতাম, প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কাছে ধরাও খেয়েছি, সেসব কত কথা

বাসায় সবাই মিলে যখন খেলতে বসতাম, মানে, আমি, আব্বু, ভাইয়া আর সুমি তখন দুটো খেলা বেশি খেলতাম, স্প্রেডসট্রাম বা কল ব্রীজ আর ব্রে কল ব্রীজে চ্যালেঞ্জ কম, ক্রিকেটের মত, ভাল কার্ড হাতে এলে ছক্কা মারা যায় আর মন্দ কার্ড হাতে এলে পিটিয়ে খেলে এক দুই রান যা তোলা যায় আর কি। ব্রে হলো একটু চ্যালেঞ্জিং, ফুটবলের মত, গোল খেলেই হারলে, যত গোল খেলাম মানে পয়েন্ট পেলাম ততই ব্রে হলাম পয়েন্ট পাওয়া মানেই বোকা। হাতের কার্ড যত ফেলে দেয়া যায় মানে যত অন্যকে গছিয়ে দেয়া যায় সেটা হলো এই খেলার মুন্সীয়ানা কার্ড খেলা মোটামুটি আয়ত্বে এসে গেছে, কি করে কার্ড গুনতে হয়, কার হাতে কি কার্ড আছে কি করে ধারনা করা যায়, কে কিভাবে সাজাচ্ছে অনুমান করতে শিখে গেছি,  দেখা যেতো অনেক সময় ভাগ্যই অনুকূল থাকতো না। এমন সব কার্ডই হাতে এমন আসতো যে সব বুঝেও হার মেনে নেয়া ছাড়া কিংবা খেলার দিক পরিবর্তন করার কোন সুযোগই আসতো না। বাস্তব জীবনে বহু পরিস্থিতি, আমাকে এই কার্ড খেলা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে, পরিবেশের কাছে মাঝে মাঝে আমরা কতটা অসহায়। সব জেনে বুঝেও ধৈর্য্য ধরে খেলাটা খেলে যেতে হয়, সময়ের অপেক্ষায়। আবার এমনও হয়েছে উচ্চাভিলাষী হয়ে কিংবা আনমনে দুটো দান ভুল খেলেছি, সেই যে গেইমটা হাত থেকে চলে গেলো, আর কিছুতেই রিকভার করতে বা সামাল দিতে পারলাম না। যা হারালো তা হারালোই, ফিরে পাওয়া গেলো না।

এরকম সময়ে খুব সর্তক হয়ে যেতাম, বার বার ভাবতাম, কার্ড দিতে খুব হিসেব করতাম, সময় নিতাম। আব্বু মজা করে বলতো, এত দেরী কর কেন, খেলো খেলো, খেললেই পাবে, চাললেই পাবে। খুব রাগ হত, অনেক রেগে যেতাম, আমি হেরে যাচ্ছি আর আব্বু মজা পাচ্ছে। এখনও সে আগেরই মত জীবন ভর নানা খেলায় শুধু আমি হেরেই যাচ্ছি, কত ভুল হয়ত বুঝতে পারি কিন্তু সংশোধনের সুযোগ জীবন আর দেয় না। তবুও টিকে থাকার লড়াইয়ে খেলে যেতে হয়, হরদম খেলে যেতে হয়। আব্বু’র মজা করে, হেসে, দুষ্টুমি করে বলা কথা গুলোও এখন কত গভীর অর্থ নিয়ে ধরা দেয়।  

তবে, আব্বুর একটি কথা আজও রেখেছি, পয়সা দিয়ে কখনো কারো সাথে কার্ড খেলিনি। বড় কারণ অবশ্য কেউ কখনো অফারই করেনি, তাই নিজেকে পরীক্ষা করাই হয়ে ওঠেনি।

বাবা দিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আব্বু, লাভিউ আব্বু (সামনাসামনি তো কখনো বলে উঠতে পারি না, লেখা পড়েই আপনি জেনে নিন)  

পৃথিবীর সব ভাল বাবা, দুষ্ট বাবা, মিষ্টি বাবা, পঁচা বাবাদেরকও বাবা দিবসের অনেক অনেক অভিনন্দন। আর যে সকল মায়েরা বাবা এবং মায়ের দুটো দায়িত্ব বিপুল বিক্রমে পালন করছো সে সব কমরেডদের লাল স্যালুট।

০৬/০৬/২০১৮