https://www.bhorerkagoj.com/2019/02/16/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%BE-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE-%E0%A6%97%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9/?fbclid=IwAR3Y4cnE01EgVf78lD9qyKb2XwqyjkWIuhBG8t6qsXUSu--u59qbwYMyW8A
বাংলাদেশের প্রথা ভাঙা গদ্যসাহিত্য
তানবীরা তালুকদার
স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের রাজনীতির নিদারুন
পতন-উত্থান, বেল বটম প্যান্ট আর বড় ঘড়ি
পরার ফ্যাশন, ফেরদৌস ওয়াহিদ, আজম খান, ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ এর আধুনিক ঢং এর বাংলা গান, নায়ক রাজ রাজ্জাকের রংবাজ, সালাউদ্দিন জাকী’র ঘুড্ডি, আলমগীর কবির এর
সীমানা পেরিয়ে-নতুন নিরীক্ষায় ঢাকার বাংলা সিনেমা, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দেওয়ান গাজীর কিসসা, কথা ৭১ এর মত সাড়া জাগানো মঞ্চ নাটক, সুর্বণা-আফজাল এর পারলে না রুমকী, বুলবুল আহমেদ অভিনীত ইডিয়ট, বরফ গলা নদীতে মিতা চৌধুরি, ফেরদৌসী মজুমদার এর
কালো স্যুটকেস মত টিভি নাটকের আধুনিকতার ছোঁয়ায় চারদিকে প্রথা ভাঙার বা নতুনের জয়
কেতনের ওড়ানোর সময় চলছিল। এর থেকে বাদ যায় নি বাংলা সাহিত্যও। সাহিত্যের শাখা অনেক
বিস্তৃত, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কি নয়। কবিতায় রাজত্ব করেছেন, শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, হুমায়ূন আজাদ, শহীদ কাদরী প্রমুখ। জহির রায়হান, শহীদুল্লা কায়সার,
আনোয়ার
পাশা, মুনীর চৌধুরিদের অনুপস্থিতিতে
বাংলা উপন্যাসকে সামনে এগিয়ে নিতে এসেছেন সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,
সেলিনা
হোসেন, শওকত ওসমান, আহমদ ছফা, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ।
এখানে শুধু কয়েকটা গদ্য নিয়ে আলোচনা করবো,
সাহিত্যের
সব শাখা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে একটা বড় উপন্যাসের চেয়েও বড় হয়ে যাবে লেখা।
স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল
হকের হাত ধরে সম্ভবত প্রথম নেতিবাচক চরিত্রের নায়কের আগমন ঘটে বাংলাদেশের বাংলা
সাহিত্যে। “খেলারাম খেলে যা” উপন্যাসের নায়ক বাবর আলী টেলিভিশনের জনপ্রিয় একজন উপস্থাপক
যিনি একা থাকেন ঢাকার একটি ফ্ল্যাটে। তিনি সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ তরুণীদের সাথে সঙ্গমে
প্রবল আগ্রহ বোধ করেন। বাংলা সাহিত্যে এই উপন্যাসটিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা
হয়েছে বরাবর কিন্তু উপন্যাসে বাবর আলীর চরিত্রের অন্যান্য দিক গুলো কেমন করেই যেনো
অনেক পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। আত্মদহন,
মনের
গভীর গোপন দুঃখ শরীরের উত্তাপে শীতল করে বেঁচে থাকতে চাইতো বাবর আলী। এই
উপন্যাসটিই সম্ভবত বাংলাদেশের পাঠককূলের দ্বারা সবচেয়ে ভুল দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা
উপন্যাস। লেখকের নিজের ভাষাতে,
‘রচনার প্রায় কুড়ি বছর
পরও এর জন্যে আমাকে আমার অন্যান্য রচনার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়।… আমি খুব কম পাঠককে জানি, যিনি উপন্যাসের একেবারে শেষ বাক্যটি লক্ষ্য
করেছেন। আমার বিশ্বাস, এই শেষ বাক্যটিতে দাঁড়িয়ে
কেউ এ উপন্যাসের জন্যে আমাকে তিরস্কার করতে পারবেন না।’
সর্বদা অস্থিরতায় ভোগা এক মানুষ বাবর, যে মাঝে-মাঝেই আক্রান্ত হয় একাকীত্বে। উপন্যাসে সেই প্রসঙ্গ
বারবার ফিরে ফিরে আসে। তাকে যেন ঠিক চেনা যায় না, জগৎ যে চেনে, যার নিজস্ব কিছু
দার্শনিক চিন্তা মাঝে-মাঝে চমকে দিয়ে যাচ্ছে পাঠককে। বাবর আলীর কিছু ভাবনা যা
আমাকে ছুঁয়ে গেছে,
“তুমি আছ অতীত ভবিষ্যতের
মাঝখানে, আগেও যেখানে ছিলে, পরেও সেখানে থাকবে।“
কিংবা
“যা ভাল লাগে তা ধরে
রাখা বোকামি। মানুষ ধরে রাখতে চায় বলেই দুঃখ পায়। আসলে সব কিছুই একটা স্রোতের মত।
সুখ, ঐর্শ্বয, জীবন, আকাশ, বিশ্ব, মহাবিশ্ব, ছায়াপথ, তারকাপুঞ্জ, সব কিছু। সমস্ত কিছু মিলে আমার কাছে প্রবল শুভ্র জ্বলন্ত
একটা মহাস্রোত মনে হয়। দুঃসহ কষ্ট হয় তখন। আমার জীবনে যদি একটা কোন কষ্ট থাকে
তাহলে তা এই। এই মহাস্রোতের সম্মুখে আমি অসহায় তুচ্ছ, আমার অপেক্ষা সে রাখেন না। তুমি আমি এই শহর, মহানগর, সভ্যতা সব অর্থহীন
বলে মনে হয়। আমি কি করলাম, তুমি কি করলে, ন্যায়-অন্যায় পাপ-পূণ্য, মনে হয় সবই এক, সব ঠিক আছে – কারণ সবই কত ক্ষুদ্র।“
এসব ভাবনায় কি আমরা আসলে আলাদা বাবর আলীকে দেখতে
পাই না? আমরা দেখি, বাবর আলী চট্টগ্রামে দুপুরে ঘুমিয়ে তার বাবাকে স্বপ্ন
দেখেছে আর রাতে ফেরার পথে বিমানে বসে রাতের ঢাকাকে ‘ছেলেবেলার জোনাক জ্বলা বনের মত’ লাগছে। ‘জোনাক জ্বলা বন’
আর ‘কাজলা দিদি’ যেন বাঙালির
শৈশব-কৈশোরের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপন্যাসের শেষে দেখি বাবর জাহেদা নয় হাসনুকেই উদ্ধার করেছে। কৈশোরে বোনকে
রেখে পালিয়ে আসার ফলে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল সীমাহীন গ্লানি, অপরাধবোধ, যন্ত্রণা ও অনুতাপ; এসব ভুলে থাকার জন্য সে বেছে নিয়েছিল প্রতারণা ও লাম্পট্যের
পথ, আর নিজের পরস্পবিরোধী এই দুটো
চরিত্র তাকে করে তুলেছিলো দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ।
“চিলেকোঠার সেপাই” আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা বাংলা সাহিত্যের আর একটি মাইলফলক। মেদহীন লেখা, কল্পনার রামধনুতে ভর করে হেঁটেছেন তিনি ভিন্ন পথে। রাজনৈতিক
উপন্যাস লিখতে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি থাকে। সমসাময়িক ঘটনার বাস্তবতা আর লেখাতে যদি
অমিল থাকে তাহলে সাথে সাথে পাঠকের সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। খেঁটে খাওয়া শ্রমিক
শ্রেণি, বস্তিবাসী, গ্রামের সাধারণ মানুষরাই তার উপন্যাসের চরিত্র, কোন নামকরা, বিখ্যাত মানুষজনদের
তার উপন্যাসে রাখেন নি। উপন্যাসের নায়ক আসলে উনিশো উনসত্তর সাল। এ সময়টিকে ধারণ
করে আছে তৎকালীন পূর্ববাংলার ঐতিহাসিক গণজাগরণ। ইতিহাসের এ সময়কে চিত্রিত করতে
আন্দোলিত সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে অনেক চরিত্রকে তুলে ধরেছেন লেখক। তাই সে সময়ের
অনুষঙ্গ হিসেবে দুটি বিষয় এসেছে এ উপন্যাসে- মিছিল ও রাজনীতি।গল্পের প্রধান চরিত্র
রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনোয়ার
আর আলতাফ। সাথে আছে রিকশা চালক খিজির। আলতাফ ডানপন্থী আর আনোয়ার বামপন্থী। এই দুই
বন্ধুর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে লেখক সে সময়ের মানুষের দুই ধরনের রাজনৈতক চিন্তা
ভাবনার সাথে আমাদেরকে বিশদ ভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন। ঢাকার এক সস্তার গলিতে
ওসমানের বাসা, এক অফিসের সাধারণ চাকুরে সে, তার বাড়িওয়ালা পাকিস্তনাপ্রেমী রহমতউল্লাহ। রহমতউল্লার এর
কাছে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে খিজির, এখন তার রিকশা চালায়, তার গ্যারাজেই থাকে।
উপন্যাসে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দুটি প্রধান
আঙ্গিক হলো ব্যক্তি ও সমষ্টি। ওসমান যে কোন ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি এড়িয়ে চলে, আত্মকেন্দ্রিক চরিত্রের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে চিলেকোঠার
ব্যক্তিমানস। সমষ্টি তথা শোষিত শ্রেণির মানুষরা এসেছে মিছিলের রূপে, সংগ্রামী ঐক্যতান নিয়ে। উনিশো উনসত্তরের মিছিল বর্ণনায়
লেখকের ভাবাবেগ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎসারণ, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নিষ্পেষণ থেকে হাজার বছরের বাঙালি
অস্তিত্ব রক্ষাই ছিল এ মিছিলের মূল উদ্দেশ্য। তাইতো এ মিছিলের উত্তাপ, অস্তিত্ব-বিচ্ছিন্ন ওসমান চরিত্রটিকেও কাছে টেনে নিতে
পেরেছিলো।
পুরান ঢাকার খিস্তি খেউড় তুলে ধরা
আখতারুজ্জামানের লেখনীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। অনেক পাঠক সাবলীল এ খিস্তি খেউড়কে
অশালীন বলে মন্তব্য করেন। চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরতে সাবলীল ভাষার
ব্যবহার আর উপমার কোন বিকল্প নেই। আর এ দু জায়গাতেই তিনি ছিলেন অনায়াস।
আবু ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসটি বাংলা
সাহিত্যে দিয়েছে নতুন মাত্রা। উপন্যাসটিতে দেখানো হয়েছে মানুষের আলো-অন্ধকার পথ।
কুসংস্কারের ভেতর প্রবেশ করে নগ্ন করে দেখানো হয়েছে কুসংস্কারের প্রকৃত মূর্তি।
উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু ছিল উনিশো তেতাল্লিশ সালের দুর্ভিক্ষ, উনিশো সাতচল্লিশ
সালের দেশভাগ, নবগঠিত পাকিস্তান নিয়ে বাংলার
মানুষের আশাভঙ্গ, গ্রামীণ সমাজের কুসংস্কার, মোড়ল শ্রেণির মানুষের ষড়যন্ত্র, সর্বোপরি গ্রামীণ
নারীর জীবন সংগ্রাম ও প্রতিবাদী চেতনা। বইটি স্বাধীনতার আগের প্রকাশনা হলেও সদ্য
স্বাধীন বাংলাদেশের সমসাময়িক পরিস্থিতির সাথে সামান্য সূতা সম পার্থক্য ছিলো না।
নিতান্ত বাঁচার আশায় স্বামী পরিত্যক্ত জয়গুন এক বুক আশা ও চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে
ছেলেমেয়েকে সঙ্গে করে শহরে যায় কাজ ও খাদ্যের সন্ধানে। শহরের মজুতদারের গুদামে
চালের প্রাচুর্য, হোটেলে খাবারের
সমারোহ তাদের আকৃষ্ট করেছিল শহরে যেতে।
শহরের অলীক বা মিথ্যা হাতছানি তাদের শহরের বুকে ঠাঁই দেয়নি, বরং দূর করে দিয়েছে গলাধাক্কা দিয়ে। অসহায়ের সহায় তখন
একমাত্র থাকে গ্রামের পরিত্যক্ত অপয়া ভিটে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’। জীবিকার
তাগিদে সে চাল ফেরি করার কাজ নেয়। গ্রামের মাতব্বর মৌলবিরা জয়গুনকে ধর্মের শৃঙ্খলে
বন্দি করতে চেয়েও পারে না বলে প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকে সবসময়। জয়গুন তোবা না
করলে মৌলবী তার মেয়ের বিয়ে পড়াতে পারবে না বলে গ্রামের মাতব্বর রায় দিলে তার
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে সে বলে,
“তোবা আমি করতাম না।
আমি কোন গোনা করি নাই। মৌলবী সা’ব বিয়া না পড়াইলে না
পড়াউক। আমার মায়মুনের বিয়া দিমু না।”
কিন্তু প্রতিবাদকণ্ঠী জয়গুনকে বাস্তবতার কাছে
পরাস্ত হতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক বলয়ের ভেতর দাঁড়িয়ে একজন প্রতিবাদী নারীকে তার
মেয়ের ভবিষ্যৎ-জীবনের কথা ভেবে মিথ্যে অপবাদ গায়ে মেখে হার স্বীকার করে নিতে হয়।
জয়গুন সকলের সামনে তওবা করে। এত কিছুর পরও অভাবের তাড়নায় গ্রামে আর টিকতে পারে না
জয়গুন। বিভিন্ন ঘটনা পরস্পরায় আবার জয়গুনের প্রতি মমতা জাগে প্রাক্তন স্বামী করিম
বকশের। জয়গুনকে রক্ষা করতে যেয়ে নিহত হয় সে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’র তালগাছের তলায়। গ্রামের লোক ছুটে আসে দেখতে। সকলেইএকমত,‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’র ভূত তার গলা টিপে
মেরেছে।”
এ ঘটনার পর জয়গুন আর এক মুহূর্ত থাকতে চায়নি
সেখানে। তার ভেতরের সকল শক্তি যেন খান খান হয়ে যায় এক দমকায়। আবার সেই অজানার পথে
পা বাড়ায় জয়গুন। ছেলেমেয়ের হাত ধরে জয়গুন ও শফির মা বেড়িয়ে পড়ে। তাদের একমাত্র
ভরসা এই আল্লাহর বিশাল দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও একটু জায়গা তাদের ঠিকঠাক মিলে যাবে।
অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা এই বইটি ধরে রেখেছে অনেক
গভীরতা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক হুয়ামূন
আহমেদ। প্রথম উপন্যাসেই নজর কেড়েছিলেন সুধীজনদের।
ড. আহমদ শরীফ বলেছিলেন, “হুমায়ুন আহমেদ বয়সে তরুন, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন রসিক,স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকায়। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট
জীবনশিল্পী হবেন-এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।“
আমাদের নিরাশ করেন নি তিনি। জীবন্ত কিংবদন্তি
ছিলেন তিনি, তরুণ সমাজের ক্রেজ। “নন্দিত নরকে” ঢাকার মধ্যবিত্ত
জনগনের আশা, নিরাশা, প্রেম, হতাশার যেনো এক
শিল্পিত প্রামান্যচিত্র। উত্তম পুরুষে লেখা এই উপন্যাসে প্রথা মেনে কোন নায়ক
নায়িকা নেই। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সুন্দরী মেয়ে রাবেয়া বড়, তার এক বছরের ছোট খোকা, বাবার প্রথম পক্ষের সন্তান মন্টু,আর পরিবারের সবচেয়ে
ছোট কিশোরী রুনু। এছাড়া পরিবারটির সাথে থাকে ছেলে-মেয়েদের গৃহশিক্ষক মাস্টার।
একদিন চৈত্র মাসের দুপুরে রাবেয়া হারিয়ে যায়, অবশেষে মাস্টার কাকা তাকে খুঁজে আনে,
এবং বলে
সে নাকি তার স্কুলের পাশে গিয়েছিলো। তার কিছুদিন পরেই রাবেয়ার প্রেগনেন্সি ধরা
পড়ে। মা,খোকা সবাই রাবেয়ার কাছে জানতে
চায় দুর্ঘটনার কারণ কিন্তু মানসিক ভাবে অসুস্থ রাবেয়া কিছুই বলতে পারে না,বুঝতেও পারে না।বাবা তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হয়
না। এর মধ্যে শারিরীক লক্ষণ ধরা পড়ে রাবেয়ার শরীরে এবং শেষে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে
মারা যায় সে। এই ঘটনায় মন্টু মাস্টারকে দায়ী করে ও কুপিয়ে মেরে ফেলে। আদালতের রায়ে
ঠান্ডা মাথার খুনের অপরাধে মন্টুর ফাঁসি হয়।
বইয়ের শেষ লাইনগুলো, "ভোর হয়ে আসছে।দেখলাম চাঁদ ডুবে গেছে। বিস্তীর্ণ
মাঠের উপরে চাদরের মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই।" একটি পরিবারের
অসহায়ত্ব আর করুণ চিত্রের যেনো এক বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি।
“কল্পবিজ্ঞান” সাহিত্যের এই ধারাটি বাংলাদেশে প্রায় উপেক্ষিত ছিলো যতদিন
না মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এসে কিশোর কিশোরীদের কথা ভাবলেন। তার লেখা অসংখ্য কল্প
বৈজ্ঞানিক গল্প উপন্যাসের মধ্যে “কপোট্রনিকের সুখ দুঃখ” বেশ জনপ্রিয়। তিনিও তার প্রথম লেখা দিয়েই পাঠক কূলের মন জয়
করতে সমর্থ হন। এই গল্প গুলো লেখেন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে। গল্প গুলো
মূলত একটি একটির সাথে যুক্ত, তাই পড়তে গেলে একটি
কাহিনী বলেই মনে হয়। একজন খেয়ালি বিজ্ঞানীর নানা কর্মকান্ড নিয়ে গল্প গুলো লেখা।
স্ত্রী বুলার সাথে তার প্রেম, বিয়ে আর সন্তান
টোপনের জন্মের মধ্যে দিয়ে গল্প গুলো বিস্তৃত হয়েছে। সময়ানুসারে গল্প গুলো সাজানো
হয়েছে বইতে। মানুষ ও রোবটের সম্পর্ক নিয়ে গল্প গুলো। সময়ের সাথে সেই সম্পর্ক জটিল
থেকে জটিলতর হয়েছে। প্রমিথিউস নামে একটা রোবট তৈরি করেছিলেন। সেটি ছিল পৃথিবীর
প্রথম মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট, কিন্তু সে নিয়ে গর্ব
করার কোন সুযোগ হয় নি। রোবটটি তার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছিল এবং হাস্যকরভাবে
কপোট্রনের কন্ট্রোল টিউবে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিল। আইজ্যাক আসিমভের তিনটি
রোবোটিক্স সূত্রের কথাই সম্ভবত জাফর ইকবাল এখানে বলতে চেয়েছেন। যদিও রোবটের মানবিক
ব্যবহার, সময় ভ্রমণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমতা প্রতিটি গল্পেই বারবার উঠে এসেছে। কল্প
কাহিনী ভালবাসে এমন যেকোন বয়সী পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে এই বইটি।
উপন্যাস নয় কিন্তু বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতে
কিংবা কোন একটা নির্দিষ্ট সমাজ বা সময়কে সঠিক ভাবে ধরে রেখেছে এমন কয়েকটি বইয়ের
কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আজও বাঙালির সবচেয়ে অর্জন বলতে আমরা মুক্তিযুদ্ধকেই জানি।
সেই যুদ্ধদিনের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তারিখ দিয়ে লিখে রেখেছিলেন শহীদ জননী
জাহানারা ইমাম তার “একাত্তরের দিনগুলি” বইটিতে। যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে
সঠিকভাবে জানতে চাইলে এটি একটি দলিল হিসেবে কাজ করবে। আশির দশকের শেষ দিকটা কিংবা
নব্বই এর প্রথম দিকে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থানের সাদা কালো দিকটা
কিছুটা তুলে ধরেছে তসলিমা নাসরিনের “নির্বাচিত কলাম”। বইটি
একদিকে যেমন ব্যাপক নিন্দিত হয়েছে তেমনি নন্দিত হয়েছে, সমালোচনা যতই থাকুক,
একই
সাথে সারসত্যও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি বিরাট
ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ছিলেন আমাদের বীরাঙ্গনারা। তিন লাখ বীরাঙ্গনা যেনো সমাজ থেকে এক
লহমায় নাই হয়ে গেলেন। তাদের পরিবার পরিজন,
সমাজ
কোথাও তাদের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। কোথায় গেলেন তারা, কি ঘটেছিল তাদের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশে? নীলিমা ইব্রাহিমের,
আমি
বীরাঙ্গনা বলছি বইটি লিখে রেখেছে সেই দুঃখ গাঁথা।
এই লেখায় আলোচনা করা হয় নি কিন্তু অনায়াসে আলোচনা
করা যায় এমন কিছু উপন্যাসের নাম উল্লেখ না করলে এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
উদাহরণস্বরূপঃ আনিসুল হকের মা, শহীদুল জহিরের সে
রাতে পূর্ণিমা ছিল, নাসরীন জাহানের
উড়ুক্কু, জাকির তালুকদারের মুসলমানমঙ্গল,
শাহরিয়ার কবিরের একাত্তরের যীশু, মাহমুদুল হকের খেলাঘর, সেলিম আল দীনের চাকা,
রিজিয়া
রহমানের বং থেকে বাংলা, হুমায়ূন আজাদের
শুভব্রত ও তার সম্পর্কিত সুসমাচার, আহমদা ছফার আত্মজীবনীমূলক
উপন্যাস অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, হাসান আজিজুল হকের
আগুনপাখি, শওকত আলীর দক্ষিণায়নের দিন, শওকত ওসমানের জননী, রশীদ করিমের আয়েশা, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর
নিন্দিত নন্দন, ইমদাদুল হক মিলনের নূরজাহান, সেলিনা হোসেনের হাঙর
নদী গ্রেনেড, আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ
নং চলচিত্র, আনোয়ার পাশা’র রাইফেল রোটি আওরাত,
রাবেয়া
খাতুনের মধুমতি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
08/02/2019