মাঝে মাঝেই কিছু বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রশ্নটা হয়তো
যথার্থ কিন্তু বিব্রত হয়ে যাই আমি।
“আপনার
প্রিয় শিল্পী কে?
প্রিয়
লেখক কিংবা কবি কে?
প্রিয়
গান বা সিনেমা কোনটি?” ইত্যাদি ইত্যাদি যখন
কেউ বেশ আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করেন।
এতো
এতো গান, এক এক সময় এক একটাতে বুঁদ হয়ে থাকি, তাতে একজনকে প্রিয় শিল্পী কিংবা
কয়েকজনকে প্রিয় শিল্পী বলাও কষ্টকর। একসময় ফরিদা পারভীন টানেন তো অন্যসময় ফাল্গুনী
পাঠক, একবার সুবীর নন্দী ভাল লাগেতো কদিন পর আর ফিল কলিন্স। সময়ের সাথে, মানসিক
অবস্থার সাথে, বয়সের সাথেও রুচি, পছন্দ, মন বদলাতে থাকে। দস্যু বনহুরে একসময় ডুবে
থাকলেও পরে সেটা বড্ড পানসে হয়ে মাসুদ রানা আকর্ষণীয় হয়ে গেলো। কিরীটী রায়ের জায়গা
নিয়ে নিলেন ফেলুদা। প্রিয় খাবার কিংবা নিজের শাড়ির সংগ্রহ থেকে প্রিয় দশটি শাড়ি
বের করতে বললেও আমার জন্যে কষ্টকর হবে। প্রত্যেকটি শাড়িই কখনো না কখনো নিজেই পছন্দ
করে কিনেছি। প্রিয় বই আর লেখকের কথাতো বাদই দিলাম কারণ যতোদিন যাচ্ছে ততোই না পড়া
বইয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে, কতো কী জানি না, পড়া হয়নি কিংবা হবে না
তার হতাশা জাপটে ধরছে ক্রমশ।
সম্প্রতি
ফেসবুকের দশটি বইয়ের নাম উল্লেখের ট্যাগ হওয়ার ঘটনা থেকে উৎপত্তি এই লেখাটির। যদিও আমাকে
রাসেল, জাহিদ ভাই আর অয়না বাদে কেউ ট্যাগ করে নি, তাতে অবশ্য মান সম্মান বেঁচে
গেছে। কতো কিছু পড়িনি তার সবটা সবাই জানলো না (ইগনোরেন্স মালুম নেহি হুয়া)। তবে আমি
ভেবেছি প্রথম সুযোগে মনে আসা দশটি বইয়ের কথা নিজের জন্যেই লিখে রাখবো যেগুলো পড়ে
আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত হয়েছি। প্রিয় বইয়ের কথা বা পছন্দের বইয়ের লিস্ট দশে আঁটবে
না।
প্রিয়
অনেক কিছুই। বরং দিনে দিনে প্রিয় থেকে প্রিয়তর হওয়ার তালিকা আরো দীর্ঘ হচ্ছে।
১.
নির্বাচিত কলামঃ তসলিমা নাসরিন
বইটি
ঠিক এস.এস.সি. পরীক্ষার পরপরই হাতে পাই। তখন বইটি নিয়ে আশেপাশে ব্যাপক
আলোচনা-সমালোচনা। বেশ আগ্রহ নিয়েই বইটি পড়তে শুরু করে প্রথমে বেশ একটা বড়সড় ধাক্কা
খেলাম।
কিশোরী
থেকে তখন তরুণীর দিকে যাত্রা করেছে শরীর, মন। সে-বয়েসে ঢাকায় বড় হতে-থাকা একটা
সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়ে যেসব যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে, আমি বা আমরাও
তারমধ্যে দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সে বয়সেই কঠোরভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়েছে,
“এসব যন্ত্রণা মেয়েদের জন্যে খুব সাধারণ ব্যাপার, এগুলো নিয়ে আলোচনা বা প্রতিবাদ
করার কিছু নেই। ভদ্র মেয়েরা সব সহ্য করে রাস্তায় মাথা নীচু করে হেঁটে চলে আসে।
প্রতিবাদ করতে গেলে অন্যেরা যদি শুনে ফেলে তবে মেয়েদেরই অপমান, লজ্জা, দোষ। ছেলেদের
জন্যে ব্যাপার না, আটকে যায় মেয়েরাই।” আর, আমরাও সেসব মুরুব্বিদের বাণী চিরন্তনী
প্রাণ দিয়ে মেনে চলে স্কুল, কোচিং, স্যারের বাসা সেরে মাথা নীচু করে বাসায় ঢুকে পড়ি।
এই বই
পড়ার পর প্রথম জানতে পারি, যে অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আমি যাচ্ছি বা আমরা যাচ্ছি সেই
অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আরো অনেকে যান। ঠিক আমাদের মতোই তাঁরাও অপমানিত অনুভব করেন। আমরা
যেরকম যেরকম ভাবি, নিজের মধ্যে ফুঁসি, গুমরে মরি, সেরকম আরো অনেকেই আছেন। এগুলো
প্রকাশ করা, কাউকে চ্যালেঞ্জ করা লজ্জার বা অপমানের বিষয় নয়, অধিকারের বিষয়। নিজের
অধিকারের প্রতি সচেতনতা তৈরিতে, নিজেকে মানুষ ভেবে লড়তে এই বইটির অসামান্য অবদান
আছে জীবনে। আমাদের সময় নিজের অধিকার কিংবা সচেতনতা নিয়ে কোন বিষয়ে প্রতিবাদী হলে,
অনেকেই অপমান করার উদ্দেশ্যে যে বাক্যটি বলতেন সেটি হলো, “তসলিমা নাসরিন হইছো
নাকি?” সহজ ভাষায়, উপমা-অলঙ্করণ বাদে নিজের কথা লিখে যাওয়ার প্রেরণাও ‘নির্বাচিত
কলাম’ দিয়েছে। কল্পনাশক্তি বাদ দিয়ে, গল্প বলার চেষ্টা বাদ দিয়ে, নিখাদ নিভাঁজ
সত্যি আমি প্রথমে ‘নির্বাচিত কলাম’-এই পড়েছি। আজকাল আমরা যারা ব্লগ লিখি ইন্টারনেট
দিয়ে, তার সূচনা বোধ হয় অনেকটা নির্বাচিত কলাম শুরু করেছে, অন্তত নারীদের হৃদয়খোলা
সাবলীলতার তো বটেই।
২. শুভব্রত, তার
সম্পর্কিত সুসমাচারঃ হুমায়ুন আজাদ
টিএসসিতে
আবৃত্তি-কণ্ঠশীলনের সাথে যুক্ত হয়ে পরিচয় হয় হুমায়ুন আজাদের
দুর্দান্ত সব কবিতার সাথে। তারপর আস্তে আস্তে তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ। জ্বলো চিতাবাঘ, নারী, রাজনীতিবিদগণ পড়ার পর হাতে আসে “শুভব্রত,
তার সম্পর্কিত সুসমাচার”। প্রতিটি বইয়েই তাঁর সুস্পষ্ট একটি বক্তব্য থাকতো তাঁর
পাঠকদের জন্যে কিন্তু এই বইটির বক্তব্যের মতো এতো প্রাঞ্জল খুব কমই যেনো লেগেছে।
হয়তো পিছনের গল্পটি পরিষ্কার ধরতে পেরেছি তাই কিংবা পটভূমিটা ভীষণ পরিচিত সেজন্যে।
নিজের চিন্তাচেতনার পিছনের যে যুক্তিগুলো হাতড়ে বেড়াতাম, এই বইটি সেই যুক্তিগুলোর
যোগান দিয়েছিলো, সমর্থন দিয়েছিলো।
৩.
সত্যের সন্ধানেঃ আরজ আলী মাতুব্বর
ধর্মীয় মৌলবাদ
ও কুসংস্কারবিরোধিতার এবং সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে উঠার পেছনে এই বইটির অনেক অবদান
ছিলো। নিজের মনে সারাবেলা যে প্রশ্নগুলো খেলা করতো, যার উত্তর নিরন্তর
সন্ধান করে বেড়াতাম, সেসব উত্তর না-জানা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম এই বইটিতে।
বইটির যুক্তিগুলো হৃদয়ে গেঁথেছিলো। অনেকের সাথেই আরজ আলীর যুক্তি নিয়ে কথা বলতে
গেলে, তাঁরা আটকে গিয়ে বলতেন, “বেয়াদব, বয়স কম, বয়স হলে বুঝবি”। আমিও তেড়ে
বলতাম, “আমার না হয় বয়স হয় নি কিন্তু যিনি
লিখেছেন, তিনিতো বয়স্ক মানুষ, বুঝেই লিখেছেন, তাঁর বেলা?” বরিশাল জেলায় জন্ম-নেয়া, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন একজন
প্রায় গ্রাম্য দরিদ্র মানুষ এতো যৌক্তিক ভাবনা কী করে ধারণ করেন ভাবলে আজো আমার বিস্ময়
কমে না! অথচ, চোখের সামনে দেখছি পাশ্চাত্যে কুড়ি বছর কাটিয়ে দেয়া অনেক মানুষই নানা
ধরনের কল্প কাহিনীকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
৪. মৈত্রেয় জাতকঃ বাণী বসু
দুই
পর্বের এই বইটি প্রথম আমাকে মুগ্ধ করে এর ভাষাশৈলীতে। বাংলা ভাষা এতো অলঙ্করণময়,
এতো মিষ্টি সাথে এতোটাই যে দুর্বোধ্য হতে পারে তার প্রথম অনুভূতি আনে এই বইটি। এর
আগে বঙ্কিম, শরৎ কিংবা তারাশঙ্করের বই পড়তে গিয়ে অনেক সময় সাধু ভাষার কারণে
খানিকটা অত্যাচারিত অনুভব করেছিলাম কিন্তু মৈত্রেয় জাতক ছিলো সব ছাড়িয়ে। নিজের
ভাষা কতো কম জানি তার অনুভূতিও সর্বপ্রথম এই বইটি পড়েই হয়েছে। সাথে এও ভেবেছি এরকম
একটা ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস রচনা করতে লেখিকাকে কী পরিমাণ পড়াশুনো-গবেষণা করতে
হয়েছে!
মনীষীদের
নিয়ে সাধারণের কৌতূহল চিরদিনের। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে ইতিহাস
আশ্রিত এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে গান্ধার-মদ্র-কুরু-পাঞ্চালের
জায়গায় কৌশল-বৈশালী-মগধের পটভূমিতে। ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট বলে খ্যাত বিম্বিসার, কোশলপতি প্রসেনজিৎ, নানান
ধুরন্ধর রাজপুরুষবর্গ, আরো আছেন তক্ষশিলার বিদগ্ধ যুবক চণক,
গান্ধারের বিদুষী নটী জিতসোমা, তসাকেতের
সন্ধিৎসু রাজকুমার তিষ্য। যাঁদের
নিয়ে টুকরোটাকরা
গল্প কিংবা গল্পের ছোঁয়া পৌরাণিক কাহিনি নানা নাটকে দেখেছি বা বইয়ে পড়েছিলাম, তাঁদের
সম্বন্ধে বিশদভাবে কৌতূহল মেটানোর সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছিলো এই বইটি।
৫. প্রথম
প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুলকথাঃ আশাপূর্ণা
দেবী
খুব
ঘরোয়া কিংবা আটপৌরে জীবনকে জীবন্ত করে তুলে ধরতে আশাপূর্ণা দেবীর জুড়ি নেই। তিনি
সবসময়ের আমার খুব পছন্দের লেখিকা। তাহলে এই তিনটি বইয়ের সিরিজটির কথাই কেন?
খুব
ছোটবেলায় পড়াশুনোর জন্যে যখন বাবা-মা বকতেন নিজেদের কথা বলে কিংবা দাদির কাছে গল্প
শুনতাম, কতো কষ্ট করে কয়েক ক্রোশ হেঁটে তারা স্কুলে যেতেন। পালকিতে পর্দা জড়িয়ে
স্কুলে নামানো ওঠানো হতো, সেসব গল্পের কিছু বিশ্বাস হতো, কিছুটা হতো না। দৃশ্যটা
কল্পনা করার চেষ্টা করলে রূপকথার মতো লাগতো অনেকটা। তাঁরা অনুযোগ করতেন, আমরা সব
এতো সহজে পেয়ে সুযোগের অপব্যবহার করছি, উচ্ছন্নে যাচ্ছি। তাঁদের গল্প আর আমাদের
জীবন অনেকটাই যেনো এই সিরিজটাতে বেশ মোহহীনভাবে আঁকা হয়েছে। সত্যবতীর সংগ্রাম থেকে
জন্ম সুবর্ণলতা আর তার পরিনতি কি তবে বকুলকথা? কী চেয়েছিলেন তার আর বাস্তবে কী
ঘটছে? ভেবেছি কি অনেক প্রপিতামহী মাতামহীদের সংগ্রামের ঋণ কিভাবে শোধ করে যাচ্ছি
আমরা এই প্রিভিলেইজড জেনারেশান, কিংবা আদৌ যাচ্ছি কিনা?
৬.
গর্ভধারিণী আর সাতকাহনঃ সমরেশ মজুমদার
অনির
ছেলেবেলা, উত্তরাধিকার, কালপুরুষ, কালবেলা পড়ে উত্তরবঙ্গ তথা জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির
মুগ্ধ ভক্ত হয়ে যাই নি এমন খুব কম কিশোর-কিশোরীই তখন ছিলাম। তারপর হাতে এলো
গর্ভধারিণী আর প্রায় কাছাকাছি সময়েই সাতকাহন। আমরাও তখন
সদ্য স্কুল পাশ দিয়ে কলেজে আসছি, সমাজ পরিবর্তনের, সবকিছু বদলে দেয়ার অভিপ্রায়
আমাদের নিজেদের মনে, রক্তে। একবার নিজেকে ‘গর্ভধারিণী’-এর জয়িতা মনে হয় তো আর
একবার সাতকাহন-এর ‘দীপাবলী’-র সাথে একাত্মতা অনুভব করি। সেসব দিনে আমাদের মতো
অনেকের মনকে চিন্তার খোরাক আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এই দুটো উপন্যাস। বিপ্লবস্পন্দিত
বুকে মনে হতো আমিই হবো সেই সকালবেলার পাখি যে ডেকে উঠবে সবার আগে কুসুমবাগে,
শতবর্ষের নিস্তরঙ্গ সমাজের ভাঙাবো ঘুম।
হায়,
সোনার শেকলে বাঁধা পড়ে আজ মাঝেমাঝে ছটফটাই। কিন্তু, জয়িতা আর দীপাবলীরা আমার কাছে
থেকে চিরঅধরা দূরত্বেই থেকে গেলো। গেলো সেই অপ্রাপনীয় জীবনও।
৭. সূর্য
দীঘল বাড়িঃ আবু ইসহাক
খুব
ছোটবেলায় বিটিভি ছাড়া যখন বাংলাদেশে অন্য কোন চ্যানেল নেই তখন এই উপন্যাসটি অবলম্বন
করে একটি সিনেমা দেখানো হয়েছিল। আমরা কচিকাঁচারা সেই সিনেমার কোন স্বাদ পাই নি
বিধায় আমরা ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। খুব হেলাফেলায় এই বইটি হাতে নিয়েছিলাম স্কুলের শেষের
দিকে। হয়তো হরতাল আন্দোলন কিংবা বন্যার কারণে স্কুল বন্ধ, হাতের কাছে যা পাচ্ছি
তাই গোগ্রাসে গিলে সময় পার করছি টাইপ অবস্থা ছিলো। কিন্তু একবার বইটি হাতে নেয়ার
পর, শেষ না করে ছাড়তে পারি নি। কখন ডুবে গিয়েছিলাম এর মধ্যে নিজেও টের পাই নি।
উপন্যাসটি বিশেষ বড় নয়, এটি বাদে এই লেখকের আর কোন লেখা পড়েছি কিনা তাও মনে নেই।
শুধু মনে আছে সহজ ভাষার বইটিতে জটিল কোন কাহিনি নেই,
গ্রাম বাংলার চিরন্তন ঘটনাপ্রবাহ, অভাব অভিযোগ আছে, মানবিক সম্পর্কের জটিলতা আছে, কুসংস্কার আছে,
ষড়যন্ত্র আছে, বেঁচে-থাকার লড়াই আছে। সূর্য
দীঘল বাড়ি নামটিও চমৎকার লেগেছিলো, এর মানে কী, অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেউ
বলতে পারে নি।
৮. চৌরঙ্গীঃ
শংকর
মাটি ও
মানুষকে কাছ থেকে দেখে লেখায় শংকরের জুড়ি নেই। নিছক কল্পনার আশ্রয় থেকে নয়, নিজের
বারোয়ারি জীবনের অভিজ্ঞতাকে তিনি তার সাহিত্যে উপন্যাসে বারবার টেনে এনেছেন।
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে খুব অল্প বয়স থেকেই তাঁকে জীবন সংগ্রামে নামতে হয়। নানা
পেশায় নিযুক্ত হন টিকে-থাকার এই লড়াইয়ে। তারই একটা সময়ের উপাখ্যান চৌরঙ্গী।
আত্মজীবনী আমার বরাবরই প্রিয়, সত্যকে আঁধার করে-লেখা আরো প্রিয়। সেদিক থেকে
চৌরঙ্গী পড়তে যেয়ে, সমাজের পর্দার বাইরের ও আড়ালের মানুষের নানা কাহিনি আমায় ভীষণভাবে
আকর্ষণ করেছিল। লেখকের সহজ সাবলীল ভাষা নিয়ে খুব বেশী কিছু না বললেও চলে। কোথাও না
আটকে তরতর করে লেখকের সাথে এই পাতা থেকে ঐ পাতায় পৌঁছে যেতে বেশি সময় লাগে না। তাঁর
জীবনঘনিষ্ঠ আরো অনেক উপন্যাস আছে কিন্তু সবগুলোর মধ্যেও চৌরঙ্গী অনেকটা উজ্জ্বল। এই
বই নিয়ে তৈরি ছবিতে উত্তমকুমার - শুভেন্দু আছেন বলে
জানি, কিন্তু কেন যেন ছবিটা দেখার তেমন ইচ্ছে জাগে নি। তবে, এই ছবিতে মান্না দে-র
গান “মেঘের ভেলায় আকাশ পারে” পছন্দের।
৯. নন্দিত
নরকেঃ হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন
আহমেদের উপন্যাস কিংবা নাটকের জাদুতে মুগ্ধ হন নি এমন বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর
হবে, বিশেষ করে আশির দশকের শেষের দিকে, কিংবা নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে। স্কুলের
লিটিস পিটিস বয়সেই আমরা তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’-র মুগ্ধ দর্শক। আমার পড়া প্রথম
উপন্যাস তাঁর ‘ফেরা’। তাতে মুগ্ধতা ছিলো। এরপর পড়েছিলাম পেপারব্যাক রহস্যপোন্যাস ‘দেবী’,
সেটা পড়েও মুগ্ধ হয়েছিলাম। তারপর ‘নন্দিত নরকে’। নন্দিত নরকে
পড়ার সময় যেনো পাশের বাড়ির খোকা, মন্টু, রাবেয়া-কে চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছিলাম।
রাবেয়ার মৃত্যুতে, মন্টুর ফাঁসিতে অঝোর ধারায় কেঁদেছি। একাত্মতা এসে গেছিলো সেই
মধ্যবিত্ত পরিবারটির সাথে। আমাদের খুব চেনা পরিচিত গণ্ডি সেটা, যেখানে বইয়ের
মানুষেরা আমাদের মতো ভাষায় কথা বলে, চাকরি পায় না, বেকার রাস্তায় ঘোরে, অবলীলায়
বাজারের পয়সা চুরি করে, মিথ্যে বলে, চা খায় সেসব জীবনের জলছবির টুকরো তাঁর বইয়ে
এতো সহজে উঠে এসেছে যে, মনেই হতো না বই পড়ছি। বইয়ের চরিত্র মানেই সুশীল বা ইউনিক
কিছু যে নয়, সেটাও তাঁর উপন্যাস থেকেই প্রথমে জানতে পারি।
অনেক
অনেকদিন সেই মুগ্ধতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন সেই জাদুকর। শঙ্খনীল কারাগার, মিসির আলী
সমগ্র, প্রিয়তমেষু, জনম জনম, অপালা যখন যেই উপন্যাস পড়েছি সেটার মধ্যেই মিশে
গেছিলাম। বইগুলো পড়তে পড়তে বাজিতো বুকে সুখের মত ব্যথা। আজো, এই বেলাঅবেলাকালবেলাতেও সেই অচিন রাগিণী যেন বুক কাঁপিয়ে
দেয় জন্মান্তরের অসহ আনন্দ নামের বেদনায় বা বেদনা নামের আনন্দে।
১০. শ্বেত
পাথরের থালাঃ বাণী বসু
কিশোরীকালে
পড়া আর এক মুগ্ধতার মাস্টারপিস। সমাজের নিয়ম কেনো সব মেয়েদের বেলায়? একটি আধুনিকা শিক্ষিতা মেয়ের একটি বনেদি সনাতন চিন্তাধারার
পরিবারে বিয়ে হয়। বিয়ের পর এক
রকম ভালই চলে যাচ্ছিলো স্বামীর সাথে, বাড়ির বাকিদের সাথে গোঁজামিল দিয়ে। হঠাৎ স্বামী মারা গেলে তার বৈধব্য জীবন আর আত্মসম্মানের
লড়াইয়ের মধ্যে শুরু হয় চিরদিনের সেই প্রভু–দাস নামের সামন্তযুগের খেলা শ্বশুরবাড়ির সাথে। শেষে নিজের অস্তিত্বের তাগিদে ছেলেকে নিয়ে বাধ্য হয়ে
আলাদা হয়ে যান তিনি। সমাজের অনেক
বিরূপতা সহ্য করে একা ছেলে মানুষ করলেন, ছেলে নিজের বান্ধবী, নিজের জীবন খুঁজে পেয়ে পরে মায়ের
দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ
মায়ের কাছে তার জীবনের দাবি অনেকবারই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো কিন্তু মা ছেলেকে বড় করতে, সমাজের ভ্রূকুটি থেকে বাঁচাতে এতোটাই বদ্ধপরিকর
ছিলেন যে নিজের জীবনের দিকে তাকানোর কথা মনেই আনেন নি, ফিরিয়ে
দিয়েছেন সেসব সুখের প্রলোভন।
‘মা’ আসলে কী হন? ‘মা’ শুধু ‘মা’-ই হন।
একজন
একলা নারীর আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে নিরন্তর যুদ্ধ করে যাওয়ার এই উপন্যাস আমাকে
অনেক টেনেছে।
অর্পনা, দীপঙ্কর, সব্যসাচী অভিনীত প্রভাত রায়ের
বানানো সিনেমাটা দেখেও আমি সমান মুগ্ধ হয়েছি যদিও আমি বরাবরই ভাবি একটি সমগ্র
উপন্যাসকে তিন ঘন্টার সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা প্রায় অসাধ্য একটি কাজ।
১১.
সোনার হরিণ নেইঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
একটা
সময় আশুতোষের প্রতিটি উপন্যাসের সাথে মিশে থাকতাম। তাঁর উপন্যাসের নায়িকারা
প্রথাগত সুন্দরী নয়, পড়াশোনায় স্ট্রাগল আছে, ঘাড় ত্যাড়া হতো অনেকদিকে। আপোষহীন, জেদি
মেয়েদের দেখা যেতো প্রেমের জন্যে অনেক বড় ছাড় দিচ্ছে। স্কুল জীবনের শেষের দিকটা
ছিলো আমার আশুতোষময়। খুব কম উপন্যাস আছে তাঁর যেটা আমার পড়া হয় নি। সবগুলো বইয়ের
মধ্যে ‘সোনার হরিণ নেই’ সবচেয়ে বেশী মনে দাগ কেটেছে। সেই
বয়সে ‘প্রেম’ জিনিসটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ধরা হতো। কে কতো বেশী
আত্মত্যাগ করেছ সেজন্য তাতে তাকে আরো মহান মনে হতো। বানরজুলির
জংগলে এই উপন্যাসের বিস্তৃতি, কাঠের ব্যবসার সাথে। কিন্তু শেষ অব্ধি সেই উপলব্ধি
দেয়ার চেষ্টা করা হয়, অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি প্রেমের কাছে এসব কিছুই না। প্রেমই
সবচেয়ে মহান বিষয় জীবনের। ছোটবেলায় মুগ্ধ হওয়ার মতো অনেক উপাদান এই বইয়ে ছিলো।
অবসরের
সঙ্গী ছিলো বই, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিনোদন ছিল সেই সময় বই পড়া কিংবা গান
শোনা, মাঝে মাঝে আলো বাতাসের সাথে সম্পর্ক রাখতে ছাদে একটু বেরিয়ে-আসা। অবসরে
বাংলায় বই পড়তেই বেশি ভাল লাগতো, তার মধ্যেও টুকরোটাকরা ইংরেজি বই যে একেবারে পড়া
হয়নি তা নয়। প্রবাসিনী হওয়ার কারণে ঝুম্পা লাহিড়ীর নেমসেক খুব টেনেছে, খালেদ
হোসাইনীর কাইট রানার-এর আমির আর হোসেইন-এর দ্বন্দ্ব আর ভালবাসা দুটোই মনে দাগ
কেটেছে, হামিদা লাখোর ভেরবরখেন ট্রেইলস যেমন অনেক কাঁদিয়েছে আবার খুব ছোটবেলায় পড়া
টমাস হার্ডির প্রেমের উপন্যাস আ পেয়ার অফ ব্লু আইজ ভাল লেগেছিলো। ড্যান ব্রাউনের
উপন্যাসগুলোর অনুবাদ থেকে ‘দ্যা ভিঞ্চি কোড’ আর ‘দ্যা লস্ট সিম্বল’ পড়েছি। কেনো যেনো
খুব টানে নি, জোর করে পড়ে কষ্ট করে শেষ করতে হয়েছিলো। ‘এঞ্জেলস এন্ড ডেমন্স’
সিনেমাটা দেখে ফেলাতে আর বইটি পড়ি নি, যদিও কেউ কেউ বলেছেন বইটা অনেক বেশি থ্রিলিং।
আবারো বলি সেই পুরনো কথা, বই তো পড়ে শেষ হয় নি, হয় না। তবু্ও অনেক মুগ্ধতার সঙ্গী, অনেক ভালোলাগা প্রহরের
উপহারদাতা, অনেক আবেগের ঈশ্বর বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জানাই। জানাই মনের মাধুরীতে অনেক কৃতজ্ঞতা আর অনেক প্রণতি। সাথে যাঁরা বই লেখেন আর বই খুব ভালোবেসে পড়েন, তাঁদেরও। আবার বই আমার দীর্ঘশ্বাসেরও নাম। আমার ফেলে-আসা সময় আর পরিবেশের স্মৃতির
ছাপ রয়ে যাওয়া বই আজো আমার মনে মনকেমন-করা হাওয়া বইয়ে দেয়,
উদাস আকুল করে তোলে। জীবনের হয়তো
এইই পরিণতি।
তানবীরা
০৪/০৯/২০১৪