Sunday 7 September 2014

বইপড়া

মাঝে মাঝেই কিছু বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রশ্নটা হয়তো যথার্থ কিন্তু বিব্রত হয়ে যাই আমি।
“আপনার প্রিয় শিল্পী কে?

প্রিয় লেখক কিংবা কবি কে?

প্রিয় গান বা সিনেমা কোনটি?”  ইত্যাদি ইত্যাদি যখন কেউ বেশ আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করেন।


এতো এতো গান, এক এক সময় এক একটাতে বুঁদ হয়ে থাকি, তাতে একজনকে প্রিয় শিল্পী কিংবা কয়েকজনকে প্রিয় শিল্পী বলাও কষ্টকর। একসময় ফরিদা পারভীন টানেন তো অন্যসময় ফাল্গুনী পাঠক, একবার সুবীর নন্দী ভাল লাগেতো কদিন পর আর ফিল কলিন্স। সময়ের সাথে, মানসিক অবস্থার সাথে, বয়সের সাথেও রুচি, পছন্দ, মন বদলাতে থাকে। দস্যু বনহুরে একসময় ডুবে থাকলেও পরে সেটা বড্ড পানসে হয়ে মাসুদ রানা আকর্ষণীয় হয়ে গেলো। কিরীটী রায়ের জায়গা নিয়ে নিলেন ফেলুদা। প্রিয় খাবার কিংবা নিজের শাড়ির সংগ্রহ থেকে প্রিয় দশটি শাড়ি বের করতে বললেও আমার জন্যে কষ্টকর হবে। প্রত্যেকটি শাড়িই কখনো না কখনো নিজেই পছন্দ করে কিনেছি। প্রিয় বই আর লেখকের কথাতো বাদই দিলাম কারণ যতোদিন যাচ্ছে ততোই না পড়া বইয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে, কতো কী জানি না, পড়া হয়নি কিংবা হবে না তার হতাশা জাপটে ধরছে ক্রমশ।


সম্প্রতি ফেসবুকের দশটি বইয়ের নাম উল্লেখের ট্যাগ হওয়ার ঘটনা থেকে উৎপত্তি এই লেখাটিরযদিও আমাকে রাসেল, জাহিদ ভাই আর অয়না বাদে কেউ ট্যাগ করে নি, তাতে অবশ্য মান সম্মান বেঁচে গেছে। কতো কিছু পড়িনি তার সবটা সবাই জানলো না (ইগনোরেন্স মালুম নেহি হুয়া)তবে আমি ভেবেছি প্রথম সুযোগে মনে আসা দশটি বইয়ের কথা নিজের জন্যেই লিখে রাখবো যেগুলো পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত হয়েছি। প্রিয় বইয়ের কথা বা পছন্দের বইয়ের লিস্ট দশে আঁটবে না।
প্রিয় অনেক কিছুইবরং দিনে দিনে প্রিয় থেকে প্রিয়তর হওয়ার তালিকা আরো দীর্ঘ হচ্ছে।


১. নির্বাচিত কলামঃ তসলিমা নাসরিন 

বইটি ঠিক এস.এস.সি. পরীক্ষার পরপরই হাতে পাই। তখন বইটি নিয়ে আশেপাশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। বেশ আগ্রহ নিয়েই বইটি পড়তে শুরু করে প্রথমে বেশ একটা বড়সড় ধাক্কা খেলাম।
কিশোরী থেকে তখন তরুণীর দিকে যাত্রা করেছে শরীর, মন। সে-বয়েসে ঢাকায় বড় হতে-থাকা একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়ে যেসব যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে, আমি বা আমরাও তারমধ্যে দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সে বয়সেই কঠোরভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়েছে, “এসব যন্ত্রণা মেয়েদের জন্যে খুব সাধারণ ব্যাপার, এগুলো নিয়ে আলোচনা বা প্রতিবাদ করার কিছু নেই। ভদ্র মেয়েরা সব সহ্য করে রাস্তায় মাথা নীচু করে হেঁটে চলে আসে। প্রতিবাদ করতে গেলে অন্যেরা যদি শুনে ফেলে তবে মেয়েদেরই অপমান, লজ্জা, দোষ। ছেলেদের জন্যে ব্যাপার না, আটকে যায় মেয়েরাই।” আর, আমরাও সেসব মুরুব্বিদের বাণী চিরন্তনী প্রাণ দিয়ে মেনে চলে স্কুল, কোচিং, স্যারের বাসা সেরে মাথা নীচু করে বাসায় ঢুকে পড়ি


এই বই পড়ার পর প্রথম জানতে পারি, যে অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আমি যাচ্ছি বা আমরা যাচ্ছি সেই অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আরো অনেকে যান। ঠিক আমাদের মতোই তাঁরাও অপমানিত অনুভব করেন। আমরা যেরকম যেরকম ভাবি, নিজের মধ্যে ফুঁসি, গুমরে মরি, সেরকম আরো অনেকেই আছেন। এগুলো প্রকাশ করা, কাউকে চ্যালেঞ্জ করা লজ্জার বা অপমানের বিষয় নয়, অধিকারের বিষয়। নিজের অধিকারের প্রতি সচেতনতা তৈরিতে, নিজেকে মানুষ ভেবে লড়তে এই বইটির অসামান্য অবদান আছে জীবনে। আমাদের সময় নিজের অধিকার কিংবা সচেতনতা নিয়ে কোন বিষয়ে প্রতিবাদী হলে, অনেকেই অপমান করার উদ্দেশ্যে যে বাক্যটি বলতেন সেটি হলো, “তসলিমা নাসরিন হইছো নাকি?” সহজ ভাষায়, উপমা-অলঙ্করণ বাদে নিজের কথা লিখে যাওয়ার প্রেরণাও ‘নির্বাচিত কলাম’ দিয়েছে। কল্পনাশক্তি বাদ দিয়ে, গল্প বলার চেষ্টা বাদ দিয়ে, নিখাদ নিভাঁজ সত্যি আমি প্রথমে ‘নির্বাচিত কলাম’-এই পড়েছি। আজকাল আমরা যারা ব্লগ লিখি ইন্টারনেট দিয়ে, তার সূচনা বোধ হয় অনেকটা নির্বাচিত কলাম শুরু করেছে, অন্তত নারীদের হৃদয়খোলা সাবলীলতার তো বটেই।  

২. শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচারঃ হুমায়ুন আজাদ 

 

টিএসসিতে আবৃত্তি-কণ্ঠশীলনের সাথে যুক্ত হয়ে পরিচয় হয় হুমায়ুন আজাদের দুর্দান্ত সব কবিতার সাথে। তারপর আস্তে আস্তে তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধজ্বলো চিতাবাঘ, নারী, রাজনীতিবিদগণ পড়ার পর হাতে আসে “শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার”। প্রতিটি বইয়েই তাঁর সুস্পষ্ট একটি বক্তব্য থাকতো তাঁর পাঠকদের জন্যে কিন্তু এই বইটির বক্তব্যের মতো এতো প্রাঞ্জল খুব কমই যেনো লেগেছে। হয়তো পিছনের গল্পটি পরিষ্কার ধরতে পেরেছি তাই কিংবা পটভূমিটা ভীষণ পরিচিত সেজন্যে। নিজের চিন্তাচেতনার পিছনের যে যুক্তিগুলো হাতড়ে বেড়াতাম, এই বইটি সেই যুক্তিগুলোর যোগান দিয়েছিলো, সমর্থন দিয়েছিলো।

                        
৩. সত্যের সন্ধানেঃ আরজ আলী মাতুব্বর

ধর্মীয় মৌলবাদ ও কুসংস্কারবিরোধিতার এবং সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে উঠার পেছনে এই বইটির অনেক অবদান ছিলো নিজের মনে সারাবেলা যে প্রশ্নগুলো খেলা করতো, যার উত্তর নিরন্তর সন্ধান করে বেড়াতাম, সেসব উত্তর না-জানা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম এই বইটিতে। বইটির যুক্তিগুলো হৃদয়ে গেঁথেছিলো। অনেকের সাথেই আরজ আলীর যুক্তি নিয়ে কথা বলতে গেলে, তাঁরা আটকে গিয়ে বলতেন, “বেয়াদব, বয়স কম, বয়স হলে বুঝবি”আমিও তেড়ে বলতাম, “আমার না হয় বয়স হয় নি কিন্তু যিনি লিখেছেন, তিনিতো বয়স্ক মানুষ, বুঝেই লিখেছেন, তাঁর বেলা?” বরিশাল জেলায় জন্ম-নেয়া, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন একজন প্রায় গ্রাম্য দরিদ্র মানুষ এতো যৌক্তিক ভাবনা কী করে ধারণ করেন ভাবলে আজো আমার বিস্ময় কমে না! অথচ, চোখের সামনে দেখছি পাশ্চাত্যে কুড়ি বছর কাটিয়ে দেয়া অনেক মানুষই নানা ধরনের কল্প কাহিনীকে আঁকড়ে ধরে আছেন।

৪. মৈত্রেয় জাতকঃ বাণী বসু

দুই পর্বের এই বইটি প্রথম আমাকে মুগ্ধ করে এর ভাষাশৈলীতে। বাংলা ভাষা এতো অলঙ্করণময়, এতো মিষ্টি সাথে এতোটাই যে দুর্বোধ্য হতে পারে তার প্রথম অনুভূতি আনে এই বইটি। এর আগে বঙ্কিম, শরৎ কিংবা তারাশঙ্করের বই পড়তে গিয়ে অনেক সময় সাধু ভাষার কারণে খানিকটা অত্যাচারিত অনুভব করেছিলাম কিন্তু মৈত্রেয় জাতক ছিলো সব ছাড়িয়ে। নিজের ভাষা কতো কম জানি তার অনুভূতিও সর্বপ্রথম এই বইটি পড়েই হয়েছে। সাথে এও ভেবেছি এরকম একটা ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস রচনা করতে লেখিকাকে কী পরিমাণ পড়াশুনো-গবেষণা করতে হয়েছে!
মনীষীদের নিয়ে সাধারণের কৌতূহল চিরদিনের। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে ইতিহাস আশ্রিত এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে গান্ধার-মদ্র-কুরু-পাঞ্চালের জায়গায় কৌশল-বৈশালী-মগধের পটভূমিতে। ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট বলে খ্যাত বিম্বিসার, কোশলপতি প্রসেনজিৎ, নানান ধুরন্ধর রাজপুরুষবর্গ, আরো আছেন তক্ষশিলার বিদগ্ধ যুবক চণক, গান্ধারের বিদুষী নটী জিতসোমা, তসাকেতের সন্ধিৎসু রাজকুমার তিষ্য যাঁদের নিয়ে টুকরোটাকরা গল্প কিংবা গল্পের ছোঁয়া পৌরাণিক কাহিনি নানা নাটকে দেখেছি বা বইয়ে পড়েছিলাম, তাঁদের সম্বন্ধে বিশদভাবে কৌতূহল মেটানোর সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছিলো এই বইটি।

৫. প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুলকথাঃ আশাপূর্ণা দেবী

খুব ঘরোয়া কিংবা আটপৌরে জীবনকে জীবন্ত করে তুলে ধরতে আশাপূর্ণা দেবীর জুড়ি নেই। তিনি সবসময়ের আমার খুব পছন্দের লেখিকা। তাহলে এই তিনটি বইয়ের সিরিজটির কথাই কেন?
খুব ছোটবেলায় পড়াশুনোর জন্যে যখন বাবা-মা বকতেন নিজেদের কথা বলে কিংবা দাদির কাছে গল্প শুনতাম, কতো কষ্ট করে কয়েক ক্রোশ হেঁটে তারা স্কুলে যেতেন। পালকিতে পর্দা জড়িয়ে স্কুলে নামানো ওঠানো হতো, সেসব গল্পের কিছু বিশ্বাস হতো, কিছুটা হতো না। দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলে রূপকথার মতো লাগতো অনেকটা। তাঁরা অনুযোগ করতেন, আমরা সব এতো সহজে পেয়ে সুযোগের অপব্যবহার করছি, উচ্ছন্নে যাচ্ছি। তাঁদের গল্প আর আমাদের জীবন অনেকটাই যেনো এই সিরিজটাতে বেশ মোহহীনভাবে আঁকা হয়েছে। সত্যবতীর সংগ্রাম থেকে জন্ম সুবর্ণলতা আর তার পরিনতি কি তবে বকুলকথা? কী চেয়েছিলেন তার আর বাস্তবে কী ঘটছে? ভেবেছি কি অনেক প্রপিতামহী মাতামহীদের সংগ্রামের ঋণ কিভাবে শোধ করে যাচ্ছি আমরা এই প্রিভিলেইজড জেনারেশান, কিংবা আদৌ যাচ্ছি কিনা?

৬. গর্ভধারিণী আর সাতকাহনঃ সমরেশ মজুমদার

অনির ছেলেবেলা, উত্তরাধিকার, কালপুরুষ, কালবেলা পড়ে উত্তরবঙ্গ তথা জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির মুগ্ধ ভক্ত হয়ে যাই নি এমন খুব কম কিশোর-কিশোরীই তখন ছিলাম। তারপর হাতে এলো গর্ভধারিণী আর প্রায় কাছাকাছি সময়েই সাতকাহন। আমরাও তখন সদ্য স্কুল পাশ দিয়ে কলেজে আসছি, সমাজ পরিবর্তনের, সবকিছু বদলে দেয়ার অভিপ্রায় আমাদের নিজেদের মনে, রক্তে। একবার নিজেকে ‘গর্ভধারিণী’-এর জয়িতা মনে হয় তো আর একবার সাতকাহন-এর ‘দীপাবলী’-র সাথে একাত্মতা অনুভব করি। সেসব দিনে আমাদের মতো অনেকের মনকে চিন্তার খোরাক আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এই দুটো উপন্যাস। বিপ্লবস্পন্দিত বুকে মনে হতো আমিই হবো সেই সকালবেলার পাখি যে ডেকে উঠবে সবার আগে কুসুমবাগে, শতবর্ষের নিস্তরঙ্গ সমাজের ভাঙাবো ঘুম।
হায়, সোনার শেকলে বাঁধা পড়ে আজ মাঝেমাঝে ছটফটাই। কিন্তু, জয়িতা আর দীপাবলীরা আমার কাছে থেকে চিরঅধরা দূরত্বেই থেকে গেলো। গেলো সেই অপ্রাপনীয় জীবনও।

৭. সূর্য দীঘল বাড়িঃ আবু ইসহাক

খুব ছোটবেলায় বিটিভি ছাড়া যখন বাংলাদেশে অন্য কোন চ্যানেল নেই তখন এই উপন্যাসটি অবলম্বন করে একটি সিনেমা দেখানো হয়েছিল। আমরা কচিকাঁচারা সেই সিনেমার কোন স্বাদ পাই নি বিধায় আমরা ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। খুব হেলাফেলায় এই বইটি হাতে নিয়েছিলাম স্কুলের শেষের দিকে। হয়তো হরতাল আন্দোলন কিংবা বন্যার কারণে স্কুল বন্ধ, হাতের কাছে যা পাচ্ছি তাই গোগ্রাসে গিলে সময় পার করছি টাইপ অবস্থা ছিলো। কিন্তু একবার বইটি হাতে নেয়ার পর, শেষ না করে ছাড়তে পারি নি। কখন ডুবে গিয়েছিলাম এর মধ্যে নিজেও টের পাই নি। উপন্যাসটি বিশেষ বড় নয়, এটি বাদে এই লেখকের আর কোন লেখা পড়েছি কিনা তাও মনে নেই। শুধু মনে আছে সহজ ভাষার বইটিতে জটিল কোন কাহিনি নেই, গ্রাম বাংলার চিরন্তন ঘটনাপ্রবাহ, অভাব অভিযোগ আছে, মানবিক সম্পর্কের জটিলতা আছে, কুসংস্কার আছে, ষড়যন্ত্র আছে, বেঁচে-থাকার লড়াই আছে। সূর্য দীঘল বাড়ি নামটিও চমৎকার লেগেছিলো, এর মানে কী, অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেউ বলতে পারে নি 

৮. চৌরঙ্গীঃ শংকর

মাটি ও মানুষকে কাছ থেকে দেখে লেখায় শংকরের জুড়ি নেই। নিছক কল্পনার আশ্রয় থেকে নয়, নিজের বারোয়ারি জীবনের অভিজ্ঞতাকে তিনি তার সাহিত্যে উপন্যাসে বারবার টেনে এনেছেন। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে খুব অল্প বয়স থেকেই তাঁকে জীবন সংগ্রামে নামতে হয়। নানা পেশায় নিযুক্ত হন টিকে-থাকার এই লড়াইয়ে। তারই একটা সময়ের উপাখ্যান চৌরঙ্গী। আত্মজীবনী আমার বরাবরই প্রিয়, সত্যকে আঁধার করে-লেখা আরো প্রিয়। সেদিক থেকে চৌরঙ্গী পড়তে যেয়ে, সমাজের পর্দার বাইরের ও আড়ালের মানুষের নানা কাহিনি আমায় ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল। লেখকের সহজ সাবলীল ভাষা নিয়ে খুব বেশী কিছু না বললেও চলে। কোথাও না আটকে তরতর করে লেখকের সাথে এই পাতা থেকে ঐ পাতায় পৌঁছে যেতে বেশি সময় লাগে না। তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ আরো অনেক উপন্যাস আছে কিন্তু সবগুলোর মধ্যেও চৌরঙ্গী অনেকটা উজ্জ্বল। এই বই নিয়ে তৈরি ছবিতে উত্তমকুমার - শুভেন্দু  আছেন বলে জানি, কিন্তু কেন যেন ছবিটা দেখার তেমন ইচ্ছে জাগে নি। তবে, এই ছবিতে মান্না দে-র গান “মেঘের ভেলায় আকাশ পারে” পছন্দের।

৯. নন্দিত নরকেঃ হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কিংবা নাটকের জাদুতে মুগ্ধ হন নি এমন বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, বিশেষ করে আশির দশকের শেষের দিকে, কিংবা নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে। স্কুলের লিটিস পিটিস বয়সেই আমরা তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’-র মুগ্ধ দর্শক। আমার পড়া প্রথম উপন্যাস তাঁর ‘ফেরা’তাতে মুগ্ধতা ছিলো এরপর পড়েছিলাম পেপারব্যাক রহস্যপোন্যাস ‘দেবী’, সেটা পড়েও মুগ্ধ হয়েছিলাম। তারপর ‘নন্দিত নরকে’নন্দিত নরকে পড়ার সময় যেনো পাশের বাড়ির খোকা, মন্টু, রাবেয়া-কে চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছিলাম। রাবেয়ার মৃত্যুতে, মন্টুর ফাঁসিতে অঝোর ধারায় কেঁদেছি। একাত্মতা এসে গেছিলো সেই মধ্যবিত্ত পরিবারটির সাথে। আমাদের খুব চেনা পরিচিত গণ্ডি সেটা, যেখানে বইয়ের মানুষেরা আমাদের মতো ভাষায় কথা বলে, চাকরি পায় না, বেকার রাস্তায় ঘোরে, অবলীলায় বাজারের পয়সা চুরি করে, মিথ্যে বলে, চা খায় সেসব জীবনের জলছবির টুকরো তাঁর বইয়ে এতো সহজে উঠে এসেছে যে, মনেই হতো না বই পড়ছি। বইয়ের চরিত্র মানেই সুশীল বা ইউনিক কিছু যে নয়, সেটাও তাঁর উপন্যাস থেকেই প্রথমে জানতে পারি।
অনেক অনেকদিন সেই মুগ্ধতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন সেই জাদুকর। শঙ্খনীল কারাগার, মিসির আলী সমগ্র, প্রিয়তমেষু, জনম জনম, অপালা যখন যেই উপন্যাস পড়েছি সেটার মধ্যেই মিশে গেছিলাম। বইগুলো পড়তে পড়তে বাজিতো বুকে সুখের মত ব্যথাআজো, এই বেলাঅবেলাকালবেলাতেও সেই অচিন রাগিণী যেন বুক কাঁপিয়ে দেয় জন্মান্তরের অসহ আনন্দ নামের বেদনায় বা বেদনা নামের আনন্দে।

১০. শ্বেত পাথরের থালাঃ বাণী বসু

কিশোরীকালে পড়া আর এক মুগ্ধতার মাস্টারপিস। সমাজের নিয়ম কেনো সব মেয়েদের বেলায়? একটি আধুনিকা শিক্ষিতা মেয়ের একটি বনেদি সনাতন চিন্তাধারার পরিবারে বিয়ে হয় বিয়ের পর এক রকম ভালই চলে যাচ্ছিলো স্বামীর সাথে, বাড়ির বাকিদের সাথে গোঁজামিল দিয়ে হঠাৎ স্বামী মারা গেলে তার বৈধব্য জীবন আর আত্মসম্মানের লড়াইয়ের মধ্যে শুরু হয় চিরদিনের সেই প্রভুদাস নামের সামন্তযুগের খেলা শ্বশুরবাড়ির সাথে শেষে নিজের অস্তিত্বের তাগিদে ছেলেকে নিয়ে বাধ্য হয়ে আলাদা হয়ে যান তিনি সমাজের অনেক বিরূপতা সহ্য করে একা ছেলে মানুষ করলেন, ছেলে নিজের বান্ধবী, নিজের জীবন খুঁজে পেয়ে পরে মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অথচ মায়ের কাছে তার জীবনের দাবি অনেকবারই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো কিন্তু মা ছেলেকে বড় করতে, সমাজের ভ্রূকুটি থেকে বাঁচাতে এতোটাই বদ্ধপরিকর ছিলেন যে নিজের জীবনের দিকে তাকানোর কথা মনেই আনেন নি, ফিরিয়ে দিয়েছেন সেসব সুখের প্রলোভন

মাআসলে কী হন? ‘মাশুধু মা’-ই হন

একজন একলা নারীর আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে নিরন্তর যুদ্ধ করে যাওয়ার এই উপন্যাস আমাকে অনেক টেনেছে


অর্পনা, দীপঙ্কর, সব্যসাচী অভিনীত প্রভাত রায়ের বানানো সিনেমাটা দেখেও আমি সমান মুগ্ধ হয়েছি যদিও আমি বরাবরই ভাবি একটি সমগ্র উপন্যাসকে তিন ঘন্টার সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা প্রায় অসাধ্য একটি কাজ। 


১১. সোনার হরিণ নেইঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

একটা সময় আশুতোষের প্রতিটি উপন্যাসের সাথে মিশে থাকতাম। তাঁর উপন্যাসের নায়িকারা প্রথাগত সুন্দরী নয়, পড়াশোনায় স্ট্রাগল আছে, ঘাড় ত্যাড়া হতো অনেকদিকে। আপোষহীন, জেদি মেয়েদের দেখা যেতো প্রেমের জন্যে অনেক বড় ছাড় দিচ্ছে। স্কুল জীবনের শেষের দিকটা ছিলো আমার আশুতোষময়। খুব কম উপন্যাস আছে তাঁর যেটা আমার পড়া হয় নি। সবগুলো বইয়ের মধ্যে ‘সোনার হরিণ নেই’ সবচেয়ে বেশী মনে দাগ কেটেছে। সেই বয়সে ‘প্রেম’ জিনিসটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ধরা হতোকে কতো বেশী আত্মত্যাগ করেছ সেজন্য তাতে তাকে আরো মহান মনে হতোবানরজুলির জংগলে এই উপন্যাসের বিস্তৃতি, কাঠের ব্যবসার সাথে। কিন্তু শেষ অব্ধি সেই উপলব্ধি দেয়ার চেষ্টা করা হয়, অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি প্রেমের কাছে এসব কিছুই না। প্রেমই সবচেয়ে মহান বিষয় জীবনের। ছোটবেলায় মুগ্ধ হওয়ার মতো অনেক উপাদান এই বইয়ে ছিলো।


অবসরের সঙ্গী ছিলো বই, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিনোদন ছিল সেই সময় বই পড়া কিংবা গান শোনা, মাঝে মাঝে আলো বাতাসের সাথে সম্পর্ক রাখতে ছাদে একটু বেরিয়ে-আসা। অবসরে বাংলায় বই পড়তেই বেশি ভাল লাগতো, তার মধ্যেও টুকরোটাকরা ইংরেজি বই যে একেবারে পড়া হয়নি তা নয়। প্রবাসিনী হওয়ার কারণে ঝুম্পা লাহিড়ীর নেমসেক খুব টেনেছে, খালেদ হোসাইনীর কাইট রানার-এর আমির আর হোসেইন-এর দ্বন্দ্ব আর ভালবাসা দুটোই মনে দাগ কেটেছে, হামিদা লাখোর ভেরবরখেন ট্রেইলস যেমন অনেক কাঁদিয়েছে আবার খুব ছোটবেলায় পড়া টমাস হার্ডির প্রেমের উপন্যাস আ পেয়ার অফ ব্লু আইজ ভাল লেগেছিলো। ড্যান ব্রাউনের উপন্যাসগুলোর অনুবাদ থেকে ‘দ্যা ভিঞ্চি কোড’ আর ‘দ্যা লস্ট সিম্বল’ পড়েছি কেনো যেনো খুব টানে নি, জোর করে পড়ে কষ্ট করে শেষ করতে হয়েছিলো। ‘এঞ্জেলস এন্ড ডেমন্স’ সিনেমাটা দেখে ফেলাতে আর বইটি পড়ি নি, যদিও কেউ কেউ বলেছেন বইটা অনেক বেশি থ্রিলিং

আবারো বলি সেই পুরনো কথা, বই তো পড়ে শেষ হয় নি, হয় না তবু্ও অনেক মুগ্ধতার সঙ্গী, অনেক ভালোলাগা প্রহরের উপহারদাতা, অনেক আবেগের ঈশ্বর বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জানাই জানাই মনের মাধুরীতে অনেক কৃতজ্ঞতা আর অনেক প্রণতি সাথে যাঁরা বই লেখেন আর বই খুব ভালোবেসে পড়েন, তাঁদেরও আবার বই আমার দীর্ঘশ্বাসেরও নাম আমার ফেলে-আসা সময় আর পরিবেশের স্মৃতির ছাপ রয়ে যাওয়া বই আজো আমার মনে মনকেমন-করা হাওয়া বইয়ে দেয়, উদাস আকুল করে তোলে জীবনের হয়তো এইই পরিণতি

তানবীরা
০৪/০৯/২০১৪



Monday 7 July 2014

ফুটবল ফান


http://www.banglatribune.com/%E0%A6%B9%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A6%AC%E0%A6%B2-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B2/


অনেক আগে ফুটবল নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম...এইখানে তার লিঙ্ক।যখন থেকে জানি “জালে বল জড়ালে গোল বলা হয় তাকে” তখন থেকে আবাহনীর সাপোর্টার। কী বুঝে আবাহনীর সাপোর্টার সেটার কোন বিশদ ব্যাখ্যা নেই। এক বাড়িতে থাকি সবাই, তুতো ভাইবোনদের মধ্যে দলাদলি, একদল আবাহনী আর একদল মোহামেডান। যে দলের সাথে আমার ভাব বেশি, তারা আবাহনী, তাই দলের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা অক্ষুণ্ন রাখতে আবাহনী আমিও। তখন অবশ্য সর্ব সাকুল্যে দলের নামই জানতাম তিনটি, আবাহনী, মোহামেডান আর ব্রাদার্স ইউনিয়ন। ব্রাদার্স ইউনিয়নকে জানতাম স্বাধীনতার স্বপক্ষের দল হিসেবে যারা মাঝে মাঝে বেশ ভাল খেলে বটে কিন্তু কোনদিন ফাইন্যালে পৌঁছে না। আমার মেজো মামাকে আমার খুব পছন্দ আর তাঁর পছন্দের দল ছিলো ব্রাদার্স ইউনিয়ন। টিভি কিংবা রেডিওতে খেলার ধারা বিবরনী শোনার সময় তিনি এতো উত্তেজিত থাকতেন যে, আমাদের ভয় হতো খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত টিভি বা রেডিও খানা আস্ত থাকবেতো। আমরা ম্যাকগাইভার কিংবা ইত্যাদি দেখার সুযোগ পাবোতো। তো সেই না বোঝা বয়স থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে আমি আবাহনী, ববিতা, সোহেল রানা, রেখা, জিতেন্দ্র ইত্যাদি পেয়ে যাই। সেদিন যখন নেদারল্যান্ডস আর মেক্সিকো খেলার সময় ডাচ টেলিভিশনের ধারা বিবরণীতে ভূতপূর্ব বিশ্বকাপ খেলোয়াড়রা উত্তেজনায় চিৎকার করছিলেন, “বল গোলবারের ওপরে নয়, গোলপোস্টের ভিতরে মার”, তখন হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না।
কী চরম হতাশা তাদের কন্ঠে! প্রতিটা শুট মিস হচ্ছে আর তারা টিভিতে খেলা দেখানো বন্ধ করে, কেনো মিস হলো তার গ্রাফ এঁকে টেকনিক্যাল এ্যানালাইসিস শুরু করে দিচ্ছিলো। কতো দূর থেকে কতো ডিগ্রিতে কিভাবে কিক করতে হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। হতাশার চরম বহিঃপ্রকাশ যাকে বলে! এক পর্যায়ে তো পঁচাশি মিনিট পার হওয়ার পর আমরা সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম...তখন .।.।
যখন আমি বাংলাদেশে বাস করি তখন আমাদের শিশু ক্রিকেট টীম মাত্র আন্তর্জাতিক অংগনে পা রেখেছে। তবে অবস্থা আজকেও যা, তখনো তাই ছিল। হারতেই নামতো কখনো সখনো দৈবাত জিতে যেতো। ঝড়ে বক কি মরে না? মাঝে মাঝেতো মরে। দেশের সার্বিক সামাজিক পরিবেশ যা আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের “চুলে খুলে রাস্তায় নেমে” জাতীয় আনন্দ ভাগ করে নেয়ার, উল্লাসে মত্ত হওয়ার সুযোগ দেয়নি তা আমাকে এই অরানিয়া দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাউকে একান্ত নিজের ভেবে পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ আমি এখানে পেয়েছি।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে নেদারল্যান্ডসে মাঠে ঘাটে তেমন কোন উৎসব আমেজ লক্ষ্য করা যায় না। উৎসব যা হয় বাড়ির ভিতরে। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ইষ্টার, ক্রিসমাস এগুলো পারিবারিক মিলনমেলা বলে ধরা হয়। রাষ্ট্রীয় উৎসব হলো রাজার জন্মদিন, থার্টি ফার্স্ট ইভ। এই দুটো দিনে ডাচেরা পথে নামে। রাজার জন্মদিন মানে এলাহী কারবার। আমাদের দেশের পহেলা বৈশাখের আমেজ কিছুটা পাওয়া যায়। আলাদা ট্রাফিক প্ল্যানিং হয় সারা দেশ জুড়ে, নিরাপত্তাও নেয়া হয় কঠোরভাবে। সেদিন কী হবে আর কী হবে না সেটা আগে থেকে কেউ জানে না। অনেকে বাড়ির পুরোন জিনিসপত্র বাড়ির সামনের রাস্তায় বিক্রি করেন, অনেকে খাবার বিক্রি করেন, অনেক দোকান সস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করেন, অনেক কোম্পানী সেদিন কমপ্লিমেন্টারী পণ্য বিলান, চকলেট, আইসক্রীম, ক্যান্ডিফ্লস, টিশার্ট, কলম, চাবির রিং ইত্যাদি ইত্যাদি। আর একটা দিন, না ঠিক দিন নয়, রাত জাগে এই কমলারা একসাথে সেটা হলো থার্টি ফাষ্ট নাইট। বারোটা একমিনিট কখন হবে জানার জন্যে ঘড়ির দরকার নেই, সারা আকাশ আলো হয়ে যখন চারধারে কানে তালা লাগানো শব্দ হবে আমরা জানবো, আমরা আর একটি ইংরেজী ইউনিট নতুন করে শুরু করলাম। সেদিনের ওলন্দাজ আকাশ অসাধারণ মায়াময়, নতুন বউয়ের মতো সেজেগুজে আলহাদী কিংবা আবার সাথে লাজ রাঙা। যে টাকার বাজি পুড়ে তাতে অনেক গরীব দেশের বাৎসরিক বাজেট হতে পারে কিন্তু সেটা আলাদা হিসেব। আমাদের বড্ড ভাল লাগে দেখতে, গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে আর গলায় কানে মাফলার প্যাঁচিয়ে আমরা ঘন্টা ভর রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।
আর চার বছর পর পর আসে ঘুরে এই ফুটবল। ফুটবল উপলক্ষ্যে প্রতিটা পাড়া কমলা রঙের ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়। বাড়ি বাড়িও শোভা পায় জাতীয় পতাকা, কমলা জার্সি ইত্যাদি। দোকানের পর দোকান ছেয়ে যায় কমলা টিশার্ট, ভুভুজেলা, হ্যাটস ইত্যাদি দিয়ে। প্রথমে অনেক চড়া দামে বিক্রি শুরু হয় তারপর আস্তে আস্তে নেদারল্যান্ডস হেরে গেলে কিংবা ফাইন্যালে পৌঁছে গেলে দেখা যায় স্টক খালি করার জন্যে বিনে পয়সায়ও তখন বিতরণ শুরু হয়ে যায়। বেকারিতে কমলা কেক, কমলা জুস, কুকি, চকলেটে কমলা রঙের ছায়া, কোথায় নয়। বড্ড ভাল লাগে তখন রাস্তায় হাঁটতে, ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখতে। সারাদেশ যেন একদল ‘অরানিয়া’। ডাচদের জাতীয় উৎসবের রঙ ‘অরেঞ্জ’ যার ডাচ উচ্চারণ ‘অরানিয়া’। ডাচ ভাষায় ‘জে’ বর্ণটি নেই।
সপ্তাহান্তে যদি খেলা পড়ে, তাহলে শহরে গাড়ি নিয়ে ঢোকাই মুসিবত। আর কী পরিমাণ বিয়ার আর খাবার বিক্রি হয় তার কোন আন্দাজ লাগানোই মুশকিল! ক্যাফে আর রেস্টুরেন্ট মালিকরা বোধহয় এই প্রার্থনাই করেন সব অরানিয়া খেলা যেনো সপ্তাহান্তেই পরে। পুলিশ গাড়ি ঢোকা নিষেধ করে দিলেই কী আর জনতাকে আটকানো যায়? সাইকেল, বাস আর পদযুগল তখন কাজে আসবে তো। এই বিষাদময় আবহাওয়ার দেশে সুজ্জিমামার দেখা পাওয়া যায় জুন-জুলাইতে, স্কুল-ইউনিতে ছুটি পড়ে, এমনিতেই চারধারে উৎসব উৎসব ভাব। তারওপর বিশ্বকাপ আর তাতে যদি নিজের দেশ শক্ত পক্ষ হয় তাহলে আনন্দের কী থাকে সীমানা!
২০১০-এ ফুটবল নিয়ে বিরাট আশা ছিলো অরানিয়াদের। পাঁচটি মিউনিসিপ্যালটি বাছাই করে দুই মানুষ সমান বড় হুন্দাই স্ক্রিন দিয়েছিলো শহরে, যাতে হাজার হাজার মানুষ একসাথে খেলা দেখতে পারে। শহরবাসীরা একসাথে বসে দাঁড়িয়ে খেলা দেখেছে, অনেক জায়গায় প্রায় পাঁচ হাজার লোকও একসাথে দাঁড়ানো। সব ধর্ম, সব বর্ণ, ভাষাভাষীর লোক এক জায়গায়, ব্রাজিল আর নেদারল্যান্ডস খেলছে আর আমরা সবাই একসাথে খেলা দেখছি। একজন ব্রাজিলিয়ান আর ডাচের মধ্যে পাঁচ সেন্টিমিটারও দূরত্ব নেই। যখন ব্রাজিল গোল দিলো জনা ত্রিশেক ব্রাজিলিয়ানের কী উচ্ছ্বাস আর বাকী পাঁচ হাজার ডাচ তখন চুপচাপ তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। ত্রিশের ওপর তাপমাত্রা থাকায় কিছুক্ষণ পর পর আমাদেরকে হোস দিয়ে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেখা হচ্ছিলো যাতে উত্তেজনায় কিংবা গরমে কেউ অসুস্থ হয়ে না পরে। খেলা শেষ হওয়ার পর শুরু হয় আসল উৎসব, সবাই সবাইকে হাগ করছে, হাত মেলাচ্ছে, যাকে বলে উল্লাসে উন্মত্ত। বিদেশীরা কমলা জামা পড়লে, তাদের সাথে উল্লাসে মত্ত হলে তারা খুব খুশী হয়ে ওঠেন।
লাইভ ব্যান্ডও থাকে হাজির। প্রথমে গান শুরু হয় দেশাত্মবোধক দিয়ে, তারপর বেলা বাড়ার সাথে রক এন্ড রোল কিংবা হাউজ মিউজিকে পৌঁছে যেতে বেশি সময় লাগে না।
আর্জেন্টিনার সাথে নেদারল্যান্ডসের খেলা পড়লে কী হবে তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা চললো কদিন। তখনকার রাজপুত্র আর আজকের রাজা বিয়ে করেছে আর্জেন্টিনিয়ান। মাক্সিমা রীতিমত আমৃত্যু নেদারল্যান্ডসের জনগনের পাশে থাকার শপথ নিয়ে রাজ পরিবারের সদস্য হয়েছে।
কিন্তু তিনি এ সময় কী করবেন?
বাবার বাড়িকে পাশ কাটানো, তা কখনো হয় মন থেকে? যা হোক শেষ পর্যন্ত সেই অগ্নিপরীক্ষা সীতাকে দুহাজার দশে দিতে হয়নি। যুগে যুগে এ পরীক্ষা শুধু সীতাদের জন্যেই। দু হাজার চৌদ্দতে আর উপায় নেই। সেমি ফাইন্যালে নয় জুলাই খেলছে ডাচ-আর্জেন্টিনা। আবার সেই একই বৃত্তে আমরা। তবে রয়্যাল ফ্যামিলি তাদের অফিসিয়াল সাইটে জানিয়েছেন, রাজা-রানী দুজনের কেউই এই ম্যাচটি দেখতে সাও পাওলো যাচ্ছেন না। তারা প্রাসাদে বসেই ম্যাচটি উপভোগ করতে চান। আমি বলবো, শুধু রানীকে কটাক্ষ কেনো? রাজারওতো শ্বশুরবাড়ির প্রতি ভদ্রতা আর কর্তব্য আছে। আর্জেন্টিনা হেরে গেলে তিনি কী করে টিভির সামনে উল্লাস করবেন? তাই দুজনই দুজনেই শ্বশুরবাড়ির প্রতি ভদ্রতা রেখে, কিছু কথা থাক না গোপন করেই বাড়িতে খেলা দেখুন।
বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষ্যে প্রায় প্রত্যেক অফিসে, স্কুলে এখানে “ফুটবল পোল” খেলে। এটা অনেকটা লটারী টাইপের গেস-গেম খেলা। ফিফার স্ক্যাজুয়ালটা দেয়া থাকে। প্রথম রাউন্ডের খেলা হবার আগে অনুমান করে, কোন দেশ কটা গোল দিবে, জিতবে সেটা লিখে জমা দেয় সবাই। প্রথম রাউন্ড শেষ হয়ে গেলে, যে সবচেয়ে সঠিক অনুমান করতে পেরেছে সে পুরস্কার পাবে। তারপর দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শুরু হবার আগে আবার সেটা পূরণ করে জমা দিতে হবে। এভাবে ফাইন্যাল অব্ধি যাবে। এতেও চরম উত্তেজনা বিরাজ করে, অফিস, স্কুল সব জায়গায়।
দুইহাজার দশে যখন সাউথ আফ্রিকাতে খেলা চলছিল তখন প্রায়শই এখানে কাজের সময়। অফিসের ক্যান্টিনে, স্কুলের ক্যান্টিনে সব জায়গায় টিভি চালু, খেলা হচ্ছে। যারা অনেকবেশী ফুটবল পাগল তারা বার বারই কফির ছুতো করে খেলা দেখতে চলে যাচ্ছে আবার আসছে আবার যাচ্ছে। একদম পুরো ফাঁকি দেয়ার রেওয়াজ এখানে নেই। তবে নেদারল্যান্ডসের খেলার দিন বস বলতেন, ঠিকাছে, যারা যারা খেলা দেখবে সবাই আধ ঘন্টা আগে চলে যেতে পারো। যারা না দেখবে তারাও চলে যাও। রাস্তায় বেরোলে তখন কী ভালই না লাগতো। দিনের বাজে চারটে কিন্তু চারধার ফাঁকা। একটা পাখিও যেনো নেই আকাশে। সবাই টিভির সামনে সেট। অন্যদিন যে গন্তব্যে পৌঁছতে আধ ঘন্টা সেইন দশ মিনিট ম্যাক্সিমাম।
সব কল্পনা সত্যি করে সেবার নেদারল্যান্ডস ফাইন্যালে। কিন্তু না, এতো কিছু করেও শেষ রক্ষা হলো না, আবার রানার আপ। ফাইন্যাল খেলার দিন রাজা সাউথ আফ্রিকার সেই মাঠে উপস্থিত ছিলেন খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেয়ার জন্যে। নেদারল্যান্ডস হেরে গেলে এক শ্রেণী অপবাদ ছড়ালো, “রাজার উপস্থিতিই অরানিয়ার পরাজয়ের কারণ”। রাজা নীরবে সয়ে নিলেন, রাজা হলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। কুসংস্কার কোথায় নেই? অক্টোপাস পল যুগে যুগে, স্থানে স্থানে।
আমাদের বস ডাচ আর তার স্ত্রী স্প্যানিশ। বস তার পরিবার আর শ্বশুরবাড়ির সবাইকে একসাথে নিয়ে খেলা দেখেছেন। এবং সোমবারে যথারীতি কোন ব্যান্ডেজ ছাড়াই অফিসে এলেন। আমি বেশ অবাক হলাম, আমরা বাংলাদেশীরাতো এমন কিছু ভাবতে পারি না। হয় মরবো না মারবো, আমরাতো এই জানি। তবে ইউরোপের সবাই যে এতো ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা কিন্তু নয়। মার্কেটিং এর ইটালীয়ান সহকর্মীদের দেখতাম আমাদের মতোই উত্তেজিত। ইটালীর খেলার দিন, গালে ইটালীর পতাকা আঁকা, হাতেও ট্যাট্টু। খেলার পোল নিয়ে উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। প্রতিক্রিয়ার এই ধরনের সাথে কী সূর্যের কোন সম্বন্ধ আছে? ইটালীতেও বেশ সূর্যতাপ কড়া। তাই কী তাদের ধরনধারণ, খাওয়াদাওয়া কিছুটা আমাদের মতো!
অরানিয়া জিতে এলে তাদেরকে রাজপরিবারের সাথে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ছিলো, গণসম্বর্ধনা, এটা ওটা আরো কতো কী উৎসবের পরিকল্পনা করা হলো। পশ্চিমা ভাষায় যাকে বলে ‘গালা’ পার্টি। রবিবারে ফাইন্যাল খেলায় জিতলে সোমবারে অনেকেই কাজে আসবে না মানে আসতে পারবে না, তারা সারারাত পার্টি করে কাজে আসার অবস্থায় থাকবে না। তারজন্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল যাতে সোমবার জরুরি বিভাগগুলো যেনো অন্তত চালু থাকে, দেশ যাতে কোলাপস না করে। কিন্তু অরানিয়াতো হেরে গেলো।
এখন কী হবে!
জনরোষ!
শুরু হলো দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়। একজন খেলোয়াড় বছরে কতো টাকা আয় করে, সরকারি দলে খেলে কতো পাচ্ছে, কত টাকা পার সেকেন্ড তাদের আয়। টাকার অঙ্ক নেহাত কম নয় জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের। এরপর গালি, ফাইজলামি পাইছোস? এতো টাকা ট্যাক্স দেই আমরা তা দিয়ে তোরা এই খেলবি! আমাদেরকে কাঁদানোর জন্যে কেনো আমরা এতো টাকা তোদের বেতন দেবো? এর থেকে কম টাকায় আমরাতো আরো ভাল খেলতে পারি। শেষমেষতো হারই হয়। ব্যাঙ্গাত্মক আর আক্রমনাত্মক আলোচনার ঝড় আর স্রোত।
আমাদের পাশের বাড়িতেও ফাইন্যাল খেলাকে উপলক্ষ্য করে বিরাট জাঁকজমকের আয়োজন করা হয়েছিল। গান, বারবিকিউ, সন্ধ্যে থেকেই উৎসব। খেলার সময় একটু নিরিবিলি। নেদারল্যান্ডস হেরে গেলো পরে ভাবলাম যাক এবার তাহলে ঠান্ডা। ওমা, কীসের কী, দেখি একটু পর সব একসাথে আকাশে বাজি ছুঁড়ছে। আমার মন খারাপ আর তার চেয়েও বেশী মেজাজ খারাপ। বাংলাদেশ থেকে নেদারল্যান্ডস কোথাও জয়ের মুখ দেখতে পাই না, সর্বদা হারু পার্টিতেই থাকতে হয়।
আমি বললাম, এগুলো বাজি ফুটায় কোন লজ্জায়? চুল্লু ভার পানি কিধার, ডুব মারনে বোলো।
বাড়ি থেকে বললো, পাগল নাকি? হার মানে কী? দ্বিতীয় হয়েছে আর তাছাড়া বাজি কিনে ফেলেছে এখন না ফাটিয়ে কী পয়সা নষ্ট করবে নাকি?
মনে মনে ভাবলাম, তাও কথা। তারা পয়সা উসুল করুক আমি পর্দা টানিয়ে ঘুমাই।
যেখানে জয়ের আশা সেখানেই পরাজয়ের সম্ভাবনা ছিলো। দেখা গেলো পরাজয়ের সম্ভাবনা মাথায় রেখে সরকারিভাবে প্ল্যান বি-ও তৈরি করা ছিলো। জনগণের রোষ থেকে খেলোয়াড়দের বাঁচাতে রেডিও, টেলিভিশনে, পত্রিকায়, ব্লগে প্ল্যান বি একটিভ করা হলো। বিভিন্ন টকশোতে ফুটবল বোদ্ধারা এলেন নেদারল্যান্ডসের খেলার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিক নিয়ে প্রশংসাসূচক আলোচনা নিয়ে, পত্রিকায়ও একই সুরে সম্পাদকীয় লেখা হলো।
জয় হয় নি মানেই পরাজয় নয়। আমরা প্রথম হইনি কিন্তু দ্বিতীয় হয়েছি। বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় অবস্থান মোটেই হেলাফেলার কিছু নয়। মাত্র সতের মিলিয়ন মানুষ থেকে এমন দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় বেরোনো সোজা কথা নয়। তারা আমাদের প্রচুর আনন্দময় সময় উপহার দিয়েছে, বিশ্বে সম্মান দিয়েছে। অতএব, হে জনগণ, দুঃখ ভুলে শান্ত হও। আবার সামনের বার, লুক ফরোয়ার্ড, উই ক্যান ডু ইট এন্ড উই উইল ডু ইট।
ব্যাপক কড়া নিরাপত্তায় খেলোয়াড়দেরকে বিমানবন্দরে রিসিভ করে একটি মাত্র সম্বর্ধনায় নিয়ে যাওয়া হলো। সম্বর্ধনার ধরনও অনেক কাটছাঁট করা হলো, নো মোর গালা। খেলোয়াড়দের সম্মান দিতে রাজপুত্র সেই সম্বর্ধনায় যোগ দিলেন। আমাস্টরডামে ক্যানালের ওপর বোটে হলো সেই সম্বর্ধনা। বাকি প্রায় সব উৎসব বাতিল করা হলো। হারু পার্টিদের জন্যে আবার এতো কী! যেসব জনতা অভিবাদন জানাতে গিয়েছিলো তারা ক্যানালের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো প্ল্যাকার্ড হাতে। সব কিছু কমলায় ছাওয়া কিন্তু কী ভীষণ কঠোর নিরাপত্তা! টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিলো। সবাইকে বারণ করা হলো কোন ফুল অবদি খেলোয়াড়দের দিকে ছুঁড়ে মারা নিষেধ। খেলা খেলাই, তাতে কারো ক্ষতি যেনো না হয়।
তবে এবার হয়তো খেলা নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন বিরাট প্রত্যাশা ছিলো না। চোখে-পড়ার মতো প্রস্তুতি খুব সামান্যই ছিলো। পাড়া-সাজানোও কম, মিউনিসিপ্যালিটি কোন টিভি দেয়নি এতোদিন বাইরে। হয়তো ভেবেছিলো দুটো খেলা খেলে বাড়ি ফিরে আসবে তার জন্যে এতো হাঙ্গামা কে করবে? কিন্তু সেমি ফাইন্যালে পৌঁছানোর পর এখন সবাই একটু নড়ছে চড়ছে।
স্যাল উই ডু সামথিং এক্সট্রা ফর দেম? এনিথিং স্পেশাল? ক্যান উই কাউন্ট অন দেম দিজ টাইম? দে ওন্ট লেট আস ডাউন, নো? লেটস সি অরানিয়া, লেটস সি। আশা প্রত্যাশায় দুলছে পুরো জাতি। হুপ হল্যান্ড হুপ, নেদারল্যান্ডস ফুটবলের জাতীয় শ্লোগান এখন সবার মুখে মুখে ফিরছে আর ফিরছে ফেসবুকের স্ট্যাটাস হয়ে।
ব্যার্ত ভান মারওয়াইক ছিলেন দুই হাজার দশের কোচ। তিনি দুহাজার বারো অব্ধি নেদারল্যান্ডস জাতীয় ফুটবল দলকে গাইড করেছেন। গতবার বিশ্বকাপ হারার পর খুব ঠান্ডা মাথায় তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, “যারা ভাল খেলেছে তারাই জয়ী হয়েছে”। তিনি খুব সম্মানের সাথে তার হার স্বীকার করেছেন। যেমন অনেক ডাচরাই মেনে নিয়েছিলেন। বড় পর্দায় শহরের মাঝখানে খেলা দেখে অনেক দর্শকই পিনপতন নীরবতায় হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। এই হারের নাম দিয়েছিলো মিডিয়া “হৃদয়ভাঙ্গা হার”। যদিও কোথাও কোথাও ভাংচুর আর গ্রেফতারের ঘটনা তারপরও ঘটেছে। সবাই এই পরাজয়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি। লুইস ভান গাল হলো এখনকার জাতীয় হিরো। তিনি নাকি বলেছিলেন, শ্রেষ্ঠ আট অব্ধি এবার কনফার্ম। এখন নেদারল্যান্ডস শ্রেষ্ঠ চারে আছে। তিনি তার কথার চেয়ে বেশী করেছেন। রোবেন এক সাক্ষাতকারে বলেছেন তারা দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত এবার কনফার্ম ছিলেন। তাই এবার আমরা স্বপ্নের সীমানা ছাড়িয়ে আছি।
অর্থনৈতিক মন্দা আর অপরাধের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদেশীদের ওপর ডাচেরা খুব ক্ষ্যাপা আজকাল। সেদিন যখন বাদামি, কালো খেলোয়াড়গুলো জীবন বাজি রেখে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিলো কমলা জার্সি গায়ে নেদারল্যান্ডসের পতাকার জন্যে, তখন থেকে থেকে একটা কথা মাথায় আসছিলো, এখনো কী চামড়ার রঙ দিয়ে মানুষকে বিচার করবে তোমরা? উনচল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা যেখানে তোমরা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলে না, সেখানেতো তারাই তোমাদের ঢাল হলো। এরপরও কী কোন অঘটন ঘটলে গালি দেবে “এই গরীব বিদেশীগুলো” বলে? যদিও তোমাদের রাজপরিবারে প্রচুর বিদেশী সদস্য আছে কয়েক পুরুষ ধরে, তারপরও গরীব বিদেশীদের প্রতি তোমাদের এই মনোভাব কবে পরিবর্তন হবে কে জানে!
সবকিছুর ওপরে এখন আসছে বুধবার ...নেদারল্যান্ডস বনাম আর্জেন্টিনা।
বুধে কী হয়? নাকি বৃহস্প্রতি তুঙ্গে উঠবে নেদারল্যান্ডস এর? সেটা দেখা যাবে সেদিনেই। কী হবে তখন? আনন্দযজ্ঞ না বিষাদবিমূঢ়তা? জানি নে, জানি নে, জানি নে...
হুপ, হল্যান্ড হুপ!
তানবীরা
৩০/০৬/২০১৪
০৮/০৭/২০১৪

Wednesday 25 June 2014

তুমি আর আমি





আমায় পড়বে মনে
অনেক খেলার বেলায়
অনেক কথার মালায়
কারণে কিংবা অকারণে।

অনেক হাসি-কান্না
রেখে গেলাম জমা
অনেক দুঃখ অন্যায়
করে দিও ক্ষমা।

অলস দুপুর ক্ষণে
ক্লান্ত তুমি শুয়ে
সুর তান বাজবে
একলা ঘরের কোনে।

বৃষ্টির ধারাপাতে
গনগনে রোদে ছাঁদে
তারাজ্বলা আকাশে
আমার গন্ধ মাখা সে।


যতো দূরে রই
পাবে আমার ছোঁয়া
অভিমান ভালবাসা
অশ্রুজলে ধোঁয়া।  


 ২৬/০৬/২০১৪




Sunday 22 June 2014

বৃষ্টি ভেজা পুরনো শহরে একদিন

সেই সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাধারণ দিন বাড়িটা সরগরম থাকে, দাদু, নাতি, নাতনী, চাচা, কাকিদের হৈ চৈ এ। আজ অস্বাভাবিক নিরিবিলি। রান্নাঘরটা একদম বাড়ির পিছনের দিকে। তারপাশেই খাবারের ঘর। বৃষ্টি সাথে আছে অন্ধকার, রান্নাই হয়নি ঠিক করে। তাই আজকের রাতের খাবার একদম সাধাসিদে। বাচ্চাদের সবার জন্যে আলুর ভর্তা, ডিমের কোর্মা আর ডাল। বড়দের জন্যে হয়তো কোন একটা মাছ টাছ কিছু ভাজা টাজা হয়েছে। খাওয়া হওয়া মাত্রই সবাইকে ওপরে যার যার ঘরে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে, নীচে নামা, লাফালাফি দৌড়াদৌড়ি সব কঠিনভাবে নিষেধ। বৃষ্টির ছাঁট লম্বা টানা বারান্দার গ্রীল ভেদ করে এসে সিড়ি, বারান্দা, বারান্দার কাছাকাছি কোন কোন ঘরের কিছু অংশ ভিজিয়ে একদম পিচ্ছিল করে দিয়েছে। বাড়িতে ফুট ফরমাশ খাটার ছোট ছেলেটা যে নুরু, বৃষ্টির ছাঁট আটকানোর জন্যে সব ঘরের জানালা বন্ধ করতে যেয়ে দুবার পা পিছলে আলুর দম হয়েছে। কিন্তু ওদের সেসব ব্যথা পাওয়া কষ্ট পাওয়া অভ্যেস আছে, তাই নুরুর পরে যাওয়া নিয়ে কেউ তেমন ব্যস্ত নয়। ওকে উঠে আবার বাড়ির কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে। কিন্তু বাড়ির বাচ্চাদের সেসব অভ্যেস নেই তাই, তাদের নড়াচড়া বারণ।
ঘর থেকে বৃষ্টি একটানা ঝরে যাওয়ার টুপটাপ শব্দ কানে আসতে থাকে। গাছের পাতা ছুঁয়ে যে জলকণা টুকু ঝরে পরে তার শব্দটা একরকম, আবার ছাদের কার্ণিশের গা বেয়ে যে জলকণাটুকু ঝরে তার শব্দটা অন্যরকম। খোলা আকাশ থেকে যারা ঝরে যাচ্ছেন তাদের ধ্বনিতে আছে আবার কাউকে ছুঁতে না পারার বেদনা। এই নিকষ কালো অন্ধকার, নড়াচড়া বারণ সময়ে সব তুতো ভাইবোনরা মিলে বানানো কিন্তু সত্যিকারের ভূতের গল্প বলে শুনে এক একজনকে তাক লাগিয়ে দেয়া কিংবা বোকা বানিয়ে দেয়ার একটা প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। কখনো কখনো হারিকেনের মৃদ্যু ভুতুড়ে আলো পাশের দেয়ালে তাদের ছায়া বানিয়ে দেয়। নিজেদের ছায়ার ওপর চোখ পড়ে গেলে মনের অজান্তেই একটা গা ছমছমানো ভাব এসে যেয়ে সেই অতিপ্রাকৃতিক গল্পগুলোকে সেসময় খানিকটা সত্যি করে দেয়। তারপর আস্তে আস্তে ঘুম নামে এই বৃষ্টি ভেজা শহরের কোনায় একটি প্রায় নিঃশব্দ নিঝুম বাড়িতে।
সকাল হয় খুব ঢিমে লয়ে। রোদ নেই, সেই থেমে থেমে আকাশের একটানা ক্রন্দন। কাকগুলো ভিজে একশা কিন্ত নিয়মভংগ করতে পারেনি আজো, তাই বারান্দার কার্নিশে বসে ক্ষুধার্ত ক্লান্ত গলায় কেঁদে জানিয়ে যাচ্ছে “ভোর হলো দোর খোল”। বাচ্চাদের সেই ওপরে আটকে থাকতে হবে। সারারাত একটানা বর্ষণে রাস্তায় পানি জমে গেছে, রিক্সা গাড়ি সব বন্ধ, নিঃস্তব্ধ এই পারাপার। বাড়ির উঠোনে পানি, চার সিড়ি পার করে উঠতে হয় যে একতলার বারান্দা, সেটাও প্রায় ছুঁই ছুঁই অবস্থা। সেই পানিতে রাজ্যের পোকা মাকড়, বিচ্ছা, ছ্যাঙ্গা, চ্যালা, বিষ পিঁপড়া, গুবরে পোকা, গাছের মরা পাতা, পুরনো ময়লা কাগজ, লজেন্সে খেয়ে ফেলে দেয়া লাল মোড়কটা, টফির রাংতা, বাতাসে অন্য জায়গা থেকে উড়ে এসে উঠোনের ঘাসের মাঝে সারা বছর এলেমেলো সগর্বে লুকিয়ে থাকা আর কতো টুকিটাকি। যেগুলো আজ ভেসে উঠে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। খাতার কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে বারান্দার গ্রীল গলিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেলার প্রতিযোগিতায় শিশুরা, নীচে নামার বারণ, বড়দের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করা হচ্ছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে একটানা বর্ষণে ক্লান্ত আকাশ মাঝে মাঝে দম নেবার জন্যে যেন থামে। কিছুটা সময় আকাশ থম ধরে আছে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উঠোনের পানি একটু একটু শুকাতে শুরু করেছে। বাজার নেই, কেউ ঘর থেকেই বের হয়নি আজ এই বৃষ্টিতে। সকালের নাস্তা ছিল খিচুড়ী ডিম ভাজা, এখন দুপুরে কী হবে তাই দেখছে দাদী আর কাকীরা। বৃষ্টি উপলক্ষ্যে বাড়ির পুরুষরা আজ বাড়ি আছে তাই ফ্রিজ খুঁজে ভালো কিছুতো বের করতেই হবে। সাধারণতঃ এই বাড়ীর পুরষরা দুপুরে বাড়ীতে খান না।
হঠাৎ নুরুর চিৎকারে প্রায় নিঃশব্দ বাড়িটিতে একটু জেগে উঠলো। উঠোনে দুটো সাপ নড়ছে। হলুদ আর কালো ডোরা কাটা। খুব বড় নয় মাঝারী কিন্তু সাপ বলে কথা। উঠোনের একপাশে একটি পুরনো কুয়া আছে, যেটাতে এখন তেমন পানি নেই, বাচ্চারা খেলতে কিংবা দুষ্টমী করতে যেয়ে কুয়োতে পরে যেতে পারে বলে ওটার মুখটাকে খুব ভাল করে পুরনো টিনের টুকরো, কাঠের টুকরো দিয়ে বন্ধ করে দেয়া আছে যদিও কিন্তু তবুও ধারনা করা হচ্ছে, সাপ সেই উৎস হতেই বৃষ্টিতে উঠোনে উঠে এসেছে। বাড়িতে থাকে অন্যেরা যারা আছে, দারোয়ান ড্রাইভার সবাই মিলে বিশাল উত্তেজনায় সো-উৎসাহে সাপ দুটোকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মারলো। বাড়ির বৌ ঝিয়েরা আর বাচ্চারা নীচের আর ওপরের বারান্দা থেকে সেই নৃশ্বঃস দৃশ্য অবলোকন করলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সাপের জন্যে কেউ ততো মমতা বোধ করছিল বলে মনে হয় না কিন্তু নিরিবিলি বৈচিত্র্যহীন এ জীবনে ফর আ চেঞ্জ এই ব্রেকটুকুই মন্দ কী। সাপগুলো নিজেদের প্রতি কতোটুকু মমতাবোধ করছিল কে জানে। বেশী নড়াচড়া করে প্রতিবাদ করতে তাদের দেখা যায়নি, বরং অনেকটা পিঠ পেতে চুপচাপ মার খেয়েই নীরবে মরে গেলো তারা। আবার যাতে কিছুক্ষণ পর টম এন্ড জেরী হয়ে গা ঝাড়া না দিয়ে ওঠে বসে সেই কারণে। অনেকক্ষণ ধরে নানা পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া হলো। তারপর তাদের মৃত দেহ কী করে সৎকার করা হবে তা নিয়ে বিরাট আলোচনা হলো, কুয়োর মাঝেই ফেলে দিবে নাকি কবর দিবে, নাকি বাইরে কোথাও ব্যবস্থা করা হবে। শেষ পর্যন্ত বাইরে ফেলে দেয়াই চূড়ান্ত হলে, নুরু যখন সাপগুলোকে কাঠিতে ঝুলিয়ে বাইরের রাস্তায় ময়লা ফেলার ডাষ্টবিনের দিকে যাচ্ছিলো তখন অনেকেই বাড়ির বারান্দা ছেড়ে আবার ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
ফের আকাশ মুখ গোমড়া করে টিপটিপ কান্না ঝরাতে লাগলো। কেন আকাশ মুখ গোমড়া করছো, পৃথিবীর এ সমস্ত অনাচার অনাসৃষ্টি দেখে। আর কত কাঁদবে তুমি এই দেখে, এ পাপাচার যে এখন পৃথিবীর নিয়মে পরিনত হয়ে গেছে। কতদিন কত জল ঝরিয়ে তুমি এর প্রতিবাদ করবে? এক সপ্তাহ দু সপ্তাহ নাকি দুমাস .........
তানবীরা
২৫/০২/২০১৪
২২/০৬/১৪

Sunday 15 June 2014

একদিন অহনার অভিবাসন ------ অন্যান্য প্রতিক্রিয়া

রাত এগারোটায় সারাদিনের কাজ গুছিয়ে ক্লান্ত আমি বসেছি ফেসবুক নিয়ে।ক্রিং ক্রিং ফোন বেজে উঠলো।

হ্যালো স্লামালিকুম

ওয়ালাইকুম, তুই আমাকে একটা বই লিখে দিবি।

আমি আমতা আমতা কিছুই বুঝতে পারছি না, কোন কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ হুকুম বই লিখে দে।

কী হয়েছে আপা?

কিছু হয় নাই। নীলা বললো, তুই একটা বই লিখেছিস, বই পড়ে সে চোখের পানি আটকাতে পারে নাই। আমারেও লিখে দিবি একটা।

আমি আবারো আমতা আমতা, কী হয়েছে? দুলাভাইয়ের সাথে ঝগড়া করেছো?

একটু ঝেঁঝেঁ উঠে এবার, ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে আমার জীবনটা এই প্রবাসে এসে ঝাঁঝরা। তুই আমার সব কথা গুছিয়ে লিখে দে, কতো কষ্ট করেছি, কতো যন্ত্রণা গেছে জীবনের ওপর দিয়ে। এ শহর থেকে ঐ শহর, এই চাকরী থেকে ঐ চাকরী। ছেলেমেয়েরা তার কী জানে? টাকা বাঁচানোর জন্যে ভাত না খেয়ে রুটি খেয়ে থেকেছি। মেট্রো না চড়ে হেঁটে গেছি বরফের মধ্যে দিয়ে। একা একা স্টেশনে বসে কেঁদে কেঁদে বেলা পার করেছি।

আমি মিনমিন, আচ্ছা দিবো।

******************

এক অনুষ্ঠানে ফর্ম্যাল দেখা একজন স্বল্প পরিচিতার সাথে। কথা হচ্ছে, বাচ্চাদের স্কুল, সংসার, প্রবাস সাধারণ সমস্ত বিষয় নিয়ে। সংসার সামলানোর ঝক্কির আলোচনার এক ফাঁকে তিনি বলে উঠলেন, আপনার বইয়ের কথা শুনেছি আপা। সংসারের ঝামেলায় এখনো পড়ে উঠতে পারিনি।

আমি মৃদ্যু হেসে, ওহ

আমারো অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছে আপা। ইউরোপে এসে ভাষার জন্যে অনেক যন্ত্রনা সহ্য করেছি।

আমি হু মাথা নাড়লাম চুপচাপ।

আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পার করেছি আপা। কেউ সাহায্য করে নাই।

চুপচাপ শুনে যাচ্ছি 

চোখ ছলছল, ধরা গলায়, ছোট বয়সেই বাচ্চা হয়ে গেলো, কাউকে চিনি না, ভাষা জানি না। স্বামী সারাদিন কাজের জন্যে বাইরে বাইরে থাকে। আমি একা একা কী করে দিন পার করেছি আমি জানি আপা।

কিছু বলার নেই, তাই চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। বুকের ভিতর কোথাও কিছু দ্রিম দ্রিম আওয়াজ করছে।

সারাদিন কারো সাথে একটা কথা বলতে পারি নাই আপা। শুধু টিভির সামনে বাচ্চা নিয়ে বসে সময় কাটিয়েছি কয়েক বছর। দেশে শ্বশুর বাড়িতে ছোট ছোট দেবর ননদ, সবার দায়িত্ব তার ওপর, টাকা পয়সার টানাটানি চাইলেও বাইরে যেতে পারি না।

আর আর ..................... আমার সব কথা শুনলে আপা আপনি চোখের পানি আটকাতে পারবেন না, একটা বই হয়ে যাবে আপা, দুঃখের বই যেমন আপনি লিখেছেন, শুনছি 

Sunday 18 May 2014

মার্দাসডে বনাম ওল্ডহোম

মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার প্রায় সারা বিশ্বব্যাপী মাদার্স ডে উদযাপিত হয়। স্কুলে-পড়া বাচ্চাদের উৎসাহ আর উচ্ছ্বাস আর নানা গিফটশপের দোকানগুলোর সাজসজ্জা আর প্রতিযোগিতা হলো এই উৎসবের লক্ষ্যণীয় ব্যাপার। যাঁদের বাড়িতে স্কুলগোয়িং বাচ্চা আছে তাঁরা অনেকটা ঈদ-ক্রিসমাস-পূজার স্বাদ পেয়ে থাকেন এরমধ্যে। রাত জেগে কার্ড-বানানো, ছবি-আঁকা, ফুল-লুকানো, উপহার-লুকানো, সর্তক চলাফেরা, ফিসফাস। বলাই বাহুল্য, এ-উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় নিবন্ধ আসে, ব্লগ লেখা হয় আর ফেসবুক টুইটারতো আছে। আমাদের লোকদের ফেসবুকের অনেক শুভেচ্ছা কিংবা ব্লগের মন্তব্যে প্রতি বছর একটি বিষয় প্রায় ঘুরেফিরে আসে যে, পশ্চিমারা বাবা-মাকে ওল্ডহোমে রেখে দিয়ে মাদার্স ডের ভড়ং করে বছরে একদিন, সারা বৎসর বাবা মায়ের খোঁজ নেয় না। তাহলেতো রোজই মাদার্সডে হতো আর এই পোশাকি ভালবাসার দরকার হতো না।


সৃষ্টির আদিকালে মেয়েরাই কৃষিকাজ, ব্যবসা কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে শিকার সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন। সংসার, সন্তান, আয় কী না তারা করেছেন। এখনো আদিবাসী পরিবারে অনেকসময় তাই ‘মা’-ই সংসারের প্রধান, যাকে আমরা বলি মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। স্বাভাবিক; যিনি পরিকল্পনা করেন, নিয়ন্ত্রণ তাঁর কাছেই থাকবে। নেপালের চিতোর, পোখরা, থাইল্যান্ডের পাতাইয়ার দিকেও দেখেছি মেয়েরা একসঙ্গে কয়েকটি কাজ করছেন, পুরুষেরা দিনভর ঘুমান আর রাতভর চলে আড্ডাবাজি। কিন্তু সভ্য বলে আমরা যাঁরা নিজেদের দাবি করি, তাঁরা আগুন জ্বালানো শেখার সাথে সাথে প্রাকৃতিকভাবেই শিকার বা কৃষিকাজে দৈহিক শক্তির প্রয়োজনের কারণে মেয়েরা একসময় ঘরে অন্তরীণ আর পুরুষেরা বাইরে চারণ শুরু করেন। অবস্থা অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, আয় উপার্জন পুরুষের কাজ, সংসার বাচ্চা মেয়েদের কাজ। গর্ভধারণ ও সন্তানলালনের প্রাকৃতিক ফাঁদটাই অবশ্য সবার চাইতে বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায় নারীদের।


সভ্যতা কোথাও এক জায়গায় স্থির থাকে না, পরিবর্তনের নামই বেঁচে-থাকা। নানা কারণে দেখা গেলো মেয়েরা কিছু পড়াশোনা শিখলে ক্ষতির কিছু নেই, অবশ্য পুরুষদের তৃপ্তির জন্য যট্টুক দরকার। আস্তে আস্তে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে দেখা গেলো, একজনের আয়ে অনেক সময় সংসারের শৌখিনতা অকুলান। মেয়েরা চাকরি করলে মন্দ না, স্বাচ্ছন্দ্য কার না ভাল লাগে? কিন্তু সংসার, রান্নাবান্না? তাহলে বুড়ো বাবা মা যাবেন কোথায়, আচ্ছা বাবা মায়ের ভাবনা পরে ভাবলাম, বাচ্চাগুলোকে কী করবো? মা কাজে গেলে এতো আদরের সোনামনি কোথায় থাকবে আমাদের? বাইরের কারো সাহায্য নেবো? পশ্চিমে যেকোন কাজের জন্যে বয়স ও অভিজ্ঞতানুপাতে বাজারদর মিলিয়ে ন্যূনতম মজুরি সরকারের তরফ থেকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, প্রতি ঘন্টা হিসেবে মজুরি নির্ধারণ করা হয়। মজুরির ওপর শতকরা হিসেবে আসবে আয়কর, সামাজিক কর, পেনশনের প্রিমিয়াম, স্বাস্থ্যবীমা যেগুলো কর্মদাতাকে পরিশোধ করতে হবে। ধরা যাক, কারো মজুরি প্রতি ঘন্টায় দশ ইউরো কিন্তু মালিককে পরিশোধ করতে হয় প্রায় আঠারো ইউরো। দশটাকা মজুরি কর্মচারীর জন্যে আর বাকি সব প্রাপ্য যাদের তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। এই অবস্থায় বাসায় দিন রাতের গৃহকর্মী কিংবা রোজদিনের ঠিক ঝি অনেকেই এফোর্ড করতে পারেন না বলে সাধারণ মধ্যবিত্তরা যাঁরা একটু সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখেন তারা নিজেদের কাজ নিজেরাই করার চেষ্টা করেন। তেমন বড় দরকার হলে, যেমন, বাড়ি বদলানো কিংবা বাড়ি রঙ করা ইত্যাদি, হয়তো বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নেন।


আমরা সকলেই জানি, প্রয়োজনই নতুন কিছুর উদ্ভাবক। সেই প্রয়োজন থেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, মেয়েদেরকে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ দিতে শুরু হলো, চাইল্ড কেয়ার কিংবা ডে কেয়ার সেন্টারের। সম্ভবত ১৮৪০ সালে ফ্রান্সে প্রথম ডে কেয়ার সার্ভিস চালু হয় ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে যেটা ১৮৬৯ সালে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ১৮৫০ সালের দিক থেকে লন্ডন, নিউইয়র্কের দিকে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ডে কেয়ার সার্ভিস চালু হতে থাকে। আস্তে আস্তে সোনামনিদের জন্যে একটু করে নিজেদের আপন নিবাস হতে থাকে, ঘরের বাইরে ঘর। কিন্তু তাহলে বাবা মা? তাদেরওতো যত্নআত্তি দরকার, তাদের জন্যে? ১৮২৩ সালে মতান্তরে ১৮৫০ সাল থেকে ইউরোপে ওল্ডহোম বা বৃদ্ধাশ্রমের উৎপত্তি। এর কারণ সন্তানদের অবহেলা বলে না ইতিহাস। বলে, একই চিন্তাধারা, মনমানসিকতা ও ধর্মের সমবয়সীরা একই বাড়িতে, একসাথে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে, নিজেদের চিন্তাভাবনার আদান প্রদান করে অনেক খুশি থাকেন। ছেলেমেয়ের সংসারে একাকিত্বে ভোগেন। প্রথমে যেভাবে আর যে ধারনা নিয়ে ওল্ডহোমের যাত্রা শুরু হয়েছিলো যেমন চরিত্রের সনদপত্র লাগতো তাতে নাম লেখাতে, এন্ট্রি ফি ছিলো বেশ মোটা একটা টাকা, ওল্ডহোমের জনপ্রিয়তার কারণে সেসব আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে শুরু হলো। প্রথমে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে শুরু হলেও উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে সরকার এর মধ্যে জড়িত হতে থাকে আর আস্তে আস্তে শুরু হয় এখানেও ব্যাপক পরিবর্তন।


                                                                  ***********


এখনকার সময় পশ্চিমের মধ্যবিত্তদের প্রায় সব বাড়িতেই দুজনকে চাকরি করতে হয়। সাথে সামলাতে হয় ঘর সংসার, অনেক সময় পড়াশোনা, বাজার ঘাট, সামাজিকতা। বরং নিজের বাচ্চাকে বড় করতে বাইরের সাহায্যের দরকার হয়, সে ডে কেয়ার হতে পারে কিংবা ন্যানি। সেখানে রোজ রোজ বাবা মাকে নিয়ে ডাক্তার, হাসপাতাল, রক্তপরীক্ষা, তাদেরকে সঙ্গ দেয়া, তাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, এ কাজ গুলো ম্যানেজ করে-ওঠা আসলেই বেশ কঠিন। বাচ্চাকে নিয়ে যেতে হবে হয়তো পার্কে, বাবা মা যেতে চাইছেন হয়তো চার্চে। একটাই রোববার সপ্তাহে, সংসারের হাজার কাজের সাথে নিজের বিশ্রামটুকুও জরুরি। রাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই নাগরিকদের জন্যে ব্যবস্থা করেছে। জনগণের করের টাকায় চলে এই বৃদ্ধাশ্রম। যখন বৃদ্ধাশ্রমে বাবা মা অসুস্থ হন কিংবা তাদের প্রয়োজন হয়, ছেলেমেয়ে ঠিকই ছুটে যায়, ঠিক আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদেরই মতোন। বাবা মা রোগ যন্ত্রনায় কষ্ট পেলে তারাও কাঁদে, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে যত্ন করে, বিষণ্নতায়  ভোগে। ঠিক যেমন আমাদের দেশে শহরে চাকরী করা ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের রোগ ব্যাধিতে, কিংবা ঈদ পূজোর পার্বণে কিংবা ভাইবোনের বিয়ে বা আকিকায় প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান তেমনি করে। আমরাতো শহরবাসী ভাইবোনদের বলতে পারি না, তারা বাবা মাকে ফেলে চলে গেছে, তাদের ভালবাসে না কিংবা তাদের দায়িত্ব নেয় না। এখানেও আবার সবাই বাৎসরিক ছুটিতে একসাথে বেড়াতে যায়, সপ্তাহান্তে মুভি দেখা কিংবা অন্য কিছুতে জড়ায়-যাকে বলে আনন্দময় পারিবারিক আবহাওয়া।


বৃদ্ধাশ্রমের সমবয়সীরা একসাথে থাকেন, ঘুরতে যান, গল্প করেন, খেলেন, নাটক করেন, গান করেন আরো কত কী। এতো জেলখানা নয় যে, ধরে এনে আটকে রাখে। শেষ বয়সে তাদের যা করলে মন ও শরীর ভাল থাকবে তার ব্যবস্থা রাখতে সরকার ও কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কোন কমতি থাকে না। লোকের সমবয়সী বন্ধুবান্ধব ছেড়ে সারাক্ষণ একা বাড়িতে দাদি দাদু হয়ে বসে থাকতে কতক্ষণ আর ভাল লাগতে পারে। কিংবা দিনের পর দিন নাতিনাতনির দেখাশোনাই কি আনন্দায়ক কিছু? ওল্ডহোম রীতিমতো তাদের গ্রাহকদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করে। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা ফাইল থাকে, তাদের আগ্রহ, ভাল লাগা, মন্দ লাগা ইত্যাদি সব আলাদাভাবে নোট করে সেভাবে তাদেরকে ট্রিট করা হয়। কেউ বিষণ্ন হলে কেন বা কী তা নিয়ে আলাদা সেশান। দেশে কদিন কটা ছেলেমেয়ে সংসার সামলে যেতে পারে তার বাবা মায়ের মনের দুঃখের খোঁজ নিতে কিংবা তার প্রতিকার এর চেষ্টা করতে? বৃদ্ধাশ্রমে প্রত্যকের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি তাঁদের সাথে দেখা করতে আসতে পারেন। তাঁরাও তাঁদের পরিবার পরিজনদের কাছে যেতে পারেন। “বাবা মায়ের যত্ন না নিয়ে পশ্চিমারা কুকুর পালন করে” পশ্চিমের মানুষের সম্পর্কে এমন অপবাদ আসলে কতটুকু সত্যি বা তথ্য নির্ভর তা আমার জানা নেই। হ্যাঁ, পারিবারিক অশান্তি মনোমালিন্য এখানেও আছে, কিন্তু সেটা পৃথিবীর কোথায় না থাকে? কখনো কখনো এখানেও পরিবারের লোকজনদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক থাকে বটে। সেক্ষেত্রে আমি বলবো, এখানে প্রত্যেকে স্বনির্ভরশীল থেকে নিজের সম্পর্ক আর মর্যাদা নিয়ে আলাদা থাকার সুযোগ পান যেটা আমাদের দেশে নেই। দিনের পর দিন ক্লিশে সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে হয় কোন উপায় থাকে না বলে। বাবা মা অসম্মান আর অমর্যাদা ক্ষেত্রবিশেষে সইতে না পেরে ছেলেমেয়েকে শাপ শাপান্ত করেন। একবার এই নিয়ে একটি সিনেমাও হয়েছিলে ভারতে, রাজেশ খান্না আর শাবানা আজমীরের অভিনয়ে “অবতার” যেখানে ওল্ডহোমের প্রয়োজনীয় ধারণা ভারতীয় প্রেক্ষাপট থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল।


এই চিন্তাকে মাথায় রেখে সনাতন যুগে বাড়ির বউ মেয়েদের আশীর্বাদ করা হতো, “সাত পুত্রের জননী হও” কিংবা “পুত্র সন্তানের জননী হও”। কারণটা হয়তো পুরোই বৈষয়িক ও কিছুটা স্বার্থপরতাও ছিল। মেয়েরা প্রথমে বাবার ওপর তারপর স্বামীর ওপর আর বুড়ো বয়সে ছেলে মাকে দেখাশোনা করবে এরকম একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার ব্যাপার ছিল। পুত্রসন্তানকে ভালবাসার মাঝে একটা স্বার্থপরতাও কাজ করতো। কারণ কন্যারা বিয়ে হয়ে পরের বাড়ি চলে গেলে ‘ভদ্রমহিলা’-কে দেখবে কে? সে যুগে বয়সের বেশ একটা ব্যবধানে বিয়ে হতো বলে অনেক সময়ই দেখা যেতো বিধবা মা পুত্র সন্তান বা পরিবারের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে আছেন। গলগ্রহ হোক আর যাই হোক পুত্র থাকলে নিদেন পক্ষে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইতো নিশ্চিত থাকে। এই চিন্তাটাকে কিন্তু অনেকটা বৃদ্ধাশ্রমের বিকল্প হিসেবেই ধরা যায়।


পশ্চিম আসলে কী, তাদের সংস্কৃতি কী রকম? ডলার, পাউন্ড, ইউরো, ফ্রাঙ্ক কিংবা ক্রোন? নাকি  বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড,  ফ্রি সেক্স, ডিভোর্স, লিভ টুগেদার আর ওল্ড হোম? এ ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আমরা যা শুনি দূর থেকে ব্যাপারগুলো কী আসলেই সেরকম কিছু নাকি ভিন্ন? ভাল জিনিস এখানে তাহলে কিছুই নেই?  সন্তানের প্রতি মাতৃস্নেহ কাজ করে না, বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসা,  প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে প্রেম কিংবা গুরুজনদের প্রতি সম্মান? তাহলে, কোন কাগজে সই না করে দুজন মানুষ আজীবন কিসের বাঁধনে বেঁধে থাকেন? কোন সেই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে?  এখানেতো মেয়েদেরকে স্বামীর ভরণ পোষনের ওপর নির্ভর করতে হয় না যে স্বামী না দেখলে কে দেখবে। আজো কেনো বিয়েকে সম্মানের চোখে দেখা হয় আর লিভ টুগেদার থেকে বিয়ের হার অনেক বেশি? সমাজে ও রাষ্ট্রে অনেক খুঁটিনাটি ছোট ছোট জিনিস আছে যা এখানকার মানুষ জীবন চলার পথের প্র্যাক্টিসে পরিনত করেছে। যেগুলো অনুকরণীয় ও অনুসরণ করার মতো। জানি না কেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই এটা ধরে নেন  এদের মধ্যে মানবিক অনুভূতির ঘাটতি রয়েছে। কোন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা আচরণ কিংবা ভিন্ন প্রেক্ষাপটের একটা রেওয়াজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বা মতামত চাপিয়ে দেয়ার আগে তার সংস্কৃতি প্রেক্ষাপট কিংবা পটভূমি জানাওতো জরুরি।


একবার অনেক আগে পয়সা বাঁচানোর উদ্দেশ্যে প্রমোশোনাল ট্যুরে স্পেন গিয়েছিলাম বেড়াতে। বাস ভর্তি শুধু দাদা, দাদী-নানা, নানী বয়সের লোক ছিলো আর আমরা দুজন তরুণ-তরুণী। তখন সেভাবে জানতাম না যে অফ সিজনে হোটেল রিসোর্ট খালি থাকার কারণে বাস কোম্পানির সাথে মিলে তারা কম খরচে এসব প্রমোশোনাল ট্যুরের আয়োজন করে। তাদের লক্ষ্য থাকে এসব পেনশানভুক্ত সিনিয়র সিটিজেনরা। আমরা দুই একলা তরুণ তরুণীকে দাদু নানুরা দু’তিন দিন পর তাদের গ্রুপে নিয়ে নিলেন। আমরা তখন সেভাবে ডাচ জানি না, দাদু নানুরাও ইংলিশ জানেন না কিন্তু তাতে কম্যুনিকেশানে কোন সমস্যা হয়নি। সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে কিংবা ডিস্কোতে সালসা নাচতে ভার্বাল ল্যাঙ্গুয়েজ জরুরি কিছুতো নয়। তাদের পিকনিক পিকনিক আনন্দ উল্লাস দেখে বারবার নিজের বিধবা দাদুর মুখটি চোখে ভেসে উঠতো। সারাদিন তাসবীহ হাতে বসে থাকতেন, বেলায় বেলায় নামাজ, নাতিনাতনিদের একটু আধটু দেখাশোনা কিংবা কখনোসখনো ছেলেরা তাড়াতাড়ি ফিরলে তাদের সাথে গল্পগুজব। অন্ধের যষ্টি ছেলেদের আর চোখের মনি নাতিনাতনিদের করেছিলেন বিধবা জীবনের অবলম্বন। যদিও ছেলেরা তাঁকে মাথায় করে রাখতেন কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ কিংবা আনন্দ বেদনার কাব্য? এটাই কী জীবন? আনন্দ! তীর্থ করতে যাও নয়তো হজ্জ করতে এর বেশি আবার কী! চল্লিশ পঞ্চাশ জন বন্ধু-বান্ধব দলে বেঁধে বেড়িয়ে পরে, সাইট সিয়িং, সাঁতার-কাটা, নাচ গান হৈ হুল্লোড় জানে কী আমাদের দেশের মরচে পড়ে-যাওয়া বুড়োর দল না তারা সে সুযোগ পায়?  আমাদের দেশের ওল্ডহোমগুলো যদি পশ্চিমাদের কনসেপ্ট থেকে ধারণা নিয়ে, শুধু বাড়িতে জায়গা নেই বলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা টাইপ না রেখে এখানকার মতো বয়সনুযায়ী সাথে নিজেদের সংস্কৃতি ও পরিবেশ অনুযায়ী আনন্দ উৎসব বা চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রেখে তাদের বৃদ্ধাশ্রমের কারিকুলাম তৈরি করে সেই অনুযায়ী তাদের প্রতিষ্ঠান ঢেলে সাজাতেন তাহলে সাধারণ জনগণের হয়তো বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে এই ধারণায় পরিবর্তন আসতো কিংবা আসার সুযোগ হতো। পুরনো ধ্যান ধারনাকে আকড়ে ধরে না থেকে, বাস্তব অবস্থা এবং আজকের সময়কে উপলব্ধি করে নিজেদের ধ্যান ধারনাকে তার সাথে খাপ খাওয়ানো দরকার। শিশুরা যেমন শিশু পার্কের জন্যে উন্মুখ থাকে তেমনি থাকেন বৃদ্ধরা বৃদ্ধাশ্রমের জন্যে। নচিকেতার গানের আবেগ সব সংসারের বাস্তবতা নয়


পরিশেষেঃ


কিউরিসিটি থেকে অনেক বৃদ্ধলোকের সাথে আলাপ করে যা জেনেছিঃ আমি মনে মনে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার জন্যে প্রস্তূত হয়ে আছি। সমবয়সীদের সাথে হাঁটতে বের হবো, ঘুরতে বের হবো, পিং পং খেলবো। অসুস্থ হলে আছে হাসপাতাল আর ডাক্তার। ছেলে মেয়ে আসবে যাবে, এসএমএস করবে, ফোন করবে। আমিও যাবো ছেলেমেয়ের বাড়ি বেড়াতে, নাতিনাতনিদের সাথে খেলতে, পিকনিক করতে। চাই না কারো ওপর বোঝা হয়ে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা কাটাতে। আমার কারণে যদি ছেলেমেয়ের ঝামেলা হয়, আমায় ডাক্তার হাসপাতাল করিয়ে ছেলেমেয়ের যদি চাকরি চলে যায়, তাদের সংসার, সন্তান যদি অসুবিধায় পরে তাহলে তাদের ঘাড়ে চেপে বসে আমি কী শান্তি পাবো!


মা বাবাকে নিয়ে একদিন হৈ হুল্লোড় করা, জীবিকার কারণে দূর দূর শহরে বসবাস করা ভাইবোন সব একসাথে হয়ে উপহার আদান প্রদান করার মধ্যে মন্দ কী আছে। বছরে একবার এইদিনটি আসে বলেই এটি বিশেষ, রোজ হলেতো প্রাত্যহিকতার বোরডোমে এটি তার বিশেষত্ব হারাতো। আমাদের বাড়িতে রোজই মা দিবস থাকে, একদিন একটু বেশি বেশি উৎসব হয় যা আমাদের পরিপূর্ণতার স্বাদ দেয়, আনন্দ দেয়।


তানবীরা
১৪/০৫/২০১৪