Friday 14 June 2013

প্রসংগ হিন্দী ভাষা কিংবা ভিন্ন সংস্কৃতি




আজকাল বেশ একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছে দেশের আধুনিক ছেলেমেয়েদের মধ্যে “হিন্দী ভাষা”কে ঘৃনা করি টাইপ কথা বলার। যদিও “ঘৃনা” শব্দটা খুবই শক্ত, কোন কিছুকে নিয়ে মন্তব্য করার জন্যে, “অপছন্দ করি” কথাটা হয়তো তাও চলে যায়। যারা এধরনের ঘৃনা শব্দগুলো উচ্চারন করেন তারা কিন্তু অবলীলায় ইংরেজি, আরবী, চায়নীজ কিংবা ফ্রেঞ্চ গান, সিনেমা, বই পড়ছেন - উপভোগ করছেন। একশ কোটির বেশি মানুষ যে ভাষায় কাঁদেন, হাসেন, প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করেন, রাত জেগে বই লিখেন, আবেগে কেঁপে কবিতা লিখেন সেই ভাষাকে আমরা কেনো ঘৃনা করি? তার কি কারণ? এতোগুলো মানুষের আবেগ প্রকাশের মাধ্যম কি করে অন্যদের ঘৃনার উদ্রেক করতে পারে? অনেকেই বলতে আসেন, তারা আমাদের সাংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিচ্ছে, তাই ঘৃনা করি। তাই কি? নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে অন্যকে ঘৃনা করাই সার? তারা এসে চড়ে বসেছে আমাদের ওপর? বাধ্য করেছে আমাদেরকে তাদের সিরিয়াল দেখতে, শাড়ি পড়তে, তাদের গরু, পেয়াজ খেতে?

তাই যদি হয় তাহলে আমাদের ছোটবেলার “খোদা হাফেজ” যে এখন “আল্লাহ হাফেজ” কেড়ে নিচ্ছে, মাথায় মাথায় নানা ঢংয়ের হিজাব বসছে, দাঁড়িতে মেহেন্দী আঁকা হচ্ছে, তার বেলায়? এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিচ্ছে না? কথায় কথায় ওহ মাই গড, কুল, অসাম এগুলোওতো হরদম সবাই ব্যবহার করছে। নাকি ইংরেজী দ্বারা, আরবী দ্বারা গ্রাসিত হলে সমস্যা নেই সমস্যা হলো শুধু হিন্দীর বেলায়? আমাদের দেশটা এতো ছোট আর এর মধ্যে ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, পোশাক, খাবার দাবারের বৈচিত্র্য এতো কম যে, ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি যে সহনশীলতা বা শ্রদ্ধা তা লোকজন শিখেইনি। সেদিন কোন একটি সংবাদপত্র বিদেশের কোন একটি জরিপের উদাহরন টেনে সংবাদ ছেপেছিলেন, “অসহনশীল” দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম বিশ্বের মধ্যে দু’নম্বরে আছে। এরচেয়ে সত্যি খবর বোধ হয় আর হতে পারে না। সর্ব ব্যাপারে উগ্রতা আর মৌলবাদ। ভাগ্যিস বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ একই ধারায় চিন্তা করে না। তাইতো বিদেশের বুকে আমরা তাদের সামাজিক অনুদানের সাহায্য নিয়ে, নিজেদের নববর্ষ, ঈদের নামাজ, মসজিদে প্রতি শুক্রবারে জুম্মা পড়া, রোববারে বাচ্চাদের কোরান পড়া, দুর্গাপূজা, দিওয়ালী এগুলো উদযাপন করতে পারছি। নিজেদের সংস্কৃতি নিজেদের ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি। শুধু টাকাই দেন না তারা, মেয়র আসেন, বক্তৃতা দেন, অনুষ্ঠান ভাল লাগুক আর মন্দ লাগুক দেখেন, খাবার টেষ্ট করেন। শুধুমাত্র গরীব বিদেশী যারা আছে বিদেশে তাদেরকে সাহস দিতে যে আমরা আছি তোমাদের পাশে। বাংলাদেশে বোধহয় এধরনের ঘটনা কল্পনাও করা যায় না।   

সহনশীলতা অবশ্য জাতিগত ভাবেই নাই, কোনদিন ছিলোও না। যারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সম্মান দেখিয়ে জাতিকে শিখাবেন সবাইকে পথ দেখাবেন তারা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন কামড়াকামড়ি করতে। বরং তাদেরতো আরোই নাই। সংসদ অধিবেশনের অর্ধেকের বেশি যায় দুই পক্ষের ডার্টি লন্ড্রী টানাটানি করতে করতে। জনগন বরং এটা শিখে যে যতো উগ্র সে ততো বড় বীর, ততো তাড়াতাড়ি সবার আলোচনায় আসবেন আর বিখ্যাত হবেন, চলে উগ্রতার চর্চা যার যার সামর্থ্যনুযায়ী। কারো জামা কাপড়ে মৌলবাদ প্রকাশ পায় তো কারো সিনেমা গানে। রাহাত ফাতেহ আলী খান, জাগজিত সিং, মেহেদী হাসান, আদনান সামী, গুলাম আলী এদের গান ভালো লাগলে কি করবো? বরং মাইকেল জ্যাকসান কিংবা জর্জ মাইকেল থেকে এরা বেশি মনপ্রাণ ছুঁয়ে যান। ধর্মের দোহাই দিয়ে? বর্ডারের দোহাই দিয়ে কান বন্ধ করে দিবো? কোন যুক্তিতে? ভারতীয়রা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করেন আর আমেরিকানরা আরবরা আমাদেরকে ভালো পান? আসলেই তাই কি? ভালো পান নাকি তারা আমদেরকে? কোন দিক দিয়ে? বর্ডারে বিনা বিচারে যেমন ফেলানী মারা যায় তেমন গরীবের বেতনের পয়সা মেরে দিয়ে, মেয়েদেরকে অত্যাচারকে আরবী ভাইয়েরাও কম কষ্ট দেন না আমাদেরকে। গরীব যেদিকে চায় ...... আরব আমেরিকা ভারত সব শুকাইয়া যায়।

তাই যদি বর্জন করতে হয় একযোগে সব বর্জন। আর ভারত বর্জন করলে শুধু সিনেমা টিভি না, গরুর মাংস, পেয়াজ, ঔষধ, ডাক্তার, কাপড়, মাছ সব বর্জন করতে হবে। আর নইলে সহনশীলতার মাত্রা বাড়ানো, ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকা, ভালোবাসা থাকা একান্ত কাম্য। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মূলটা উপভোগ করে কিভাবে তার থেকে নিজেদের সংস্কৃতিকে আরো মজবুত বানানো যায় সেটা শিখে নিতে হবে। তাই একজন রবি শংকর সারা বছর আমেরিকার ট্যুর করে গেছেন। আমেরিকানরা রবি শংকরকে ভারতীয় বলে অবহেলা করেননি বরং তার গুনের জন্যে বুকে করে রেখেছেন। যেমন করেন ভারতীয়রা জেমসকে বাংলাদেশ থেকে ডেকে নিয়ে যান, রাহাত ফাতেহ আলী খানকে পাকিস্তান থেকে ডেকে নিয়ে আসেন। ভালোটা গ্রহন করতে শিখা জানতে হবে। নিজেদের অজ্ঞানতা ও অক্ষমতার দোষ কি অন্যকে ঘৃনা করে ঢাকা যাবে, মনে হয় না, কোনদিনই না।

তানবীরা
১৫/০৬/২০১৩

Tuesday 4 June 2013

যতোটা দূরে গেলে ভুলে থাকা যায়

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=ab370b1b126f971f334346994af22f6e&nttl=20130604070931201331


ফোন বেজে যাচ্ছে ক্রিং ক্রিং, ল্যান্ডফোন। সারা বাড়িতে এক মৃত্যু শীতল নীরবতা। অপালা ঠায় মূর্তির মতো বসে ফোনের রিং শুনছে। এক একবার বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম মাদল বেজে উঠছে, এক একবার বিশাল শূন্যতা গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে, তবুও কান ভরে প্রাণ ভরে সে ফোনের শব্দ শুনে যায় প্রায় রোজই। সে যেমন জানে ফোনের অপর প্রান্তে কে আছে, বাড়ির অন্যরাও জানে, এই ফোন কার জন্যে বেজে যাচ্ছে। চোখে বাধ না মানা অশ্রুর বন্যা, গাল বেয়ে আরো নীচে নামতে থাকে। যখন নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারে না তখন বাথরুমে যেয়ে কল ছেড়ে দেয় তারপর তোয়ালেতে মুখ ডুবিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদে। তাতেও যদি বুকের ব্যথা একটু কমে, সারাবেলা বুকে চাপ চাপ ব্যথা। কি এক নীল কষ্ট জমে আছে সেখানে, যা তাকে দিনভর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। দুদণ্ড আরামে খেতে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না। সবকিছু এতো ফাঁকা লাগে এতো অর্থহীন মনে হয়। একজনের পাশে থাকা না থাকায় বৃষ্টির মানে বদলে যায়, জ্যোৎস্নার মানে বদলে যায়, কবিতার মানে বদলে যায় যেমন যায় জীবনের মানে বদলে।

অপালার বাবা মায়ের ইচ্ছের সম্মান দিতে গিয়ে দুজনেই ঠিক করেছে আর এতো কাছে আসবে না দুজন কখনো। ঠিক যতোটা কাছে এলে আগুনের তাপে মোম গলে যায়, হৃদয়ের উত্তাপ ভালোবাসাকে নিংড়ায়। কিন্তু বন্ধু থাকবে আজীবন দুজন দুজনের। ভাবা আর প্রতিজ্ঞা করা যতো সোজা তাকে অন্তরে ধারণ করে নেয়া কি ততোটাই সোজা? যে কথাগুলো দুজন দুজনকে বলেছে, আর যে কথাগুলো বলবে ভেবেছিলো, বলা হয়নি কিন্তু দুজনের অন্তর জেনে গেছে, সে সব স্বপ্ন থেকে কি এক ঝটকায় মুক্তি পাওয়া যায়? না যায় না, তাই আপাতত বিরহ পালা চলছে শুধু তারা দুজনেই জানে এ বিরহ চিরদিনের বিচ্ছেদ, মধুমিলনে বদলে যাওয়ার নয়। নিজেদেরকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গুছিয়ে নেয়ার মানিয়ে নেয়ার সময় দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরেও ক্ষণে ক্ষণে ফোন বেজে উঠে। যে মানুষটির কথা চব্বিশটি ঘণ্টা ভাবতো, যাকে ভেবে এতো গল্প কবিতা, কপালে নীল টিপ আঁকা, শাড়ি পড়া, গায়ে সুগন্ধী মাখা তাকে চাইলেই কি এক মুহূর্তে ফুলস্টপ দিয়ে আজ থেকে আর তার কথা ভাববো না, বললেই হয়ে যায়!!!

যাবে না যাবে না করেও কতো বেলা কোচিং-এ চলে গেছে অপালা, তার কোন ক্লাস নেই, কাজ নেই তবুও গেছে, বুকের মধ্যে রিনিক ঝিনিক সুরের কাঁপন অনুভব করতো, যদি সে থাকে। একি কথা কি তার বেলায়ও নয়? হয়তো অন্য অনেক জরুরি কাজ ফেলে রেখে, বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে কোচিং-এ যদি অপালা এসে থাকে। হয়তো কোন কথা বিনিময়ও হবে না তাদের মধ্যে, শুধু একটু চোখের দেখা কিংবা সামান্য দৃষ্টি বিনিময় অথবা দূর থেকে এক চিলতে হাসি। শেষের দিকে এটা অবশ্য রুটিনে পৌঁছে গেছিলো যতো কাজই থাকুক, কোচিং-এ নির্দিষ্ট সময়ে তাদেরকে ঢু মারতেই হবে।

হেসে বলতো সে, চার্জ হতে আসি। এইটুকু তোকে না দেখলে সারাদিনে কোন কাজের উৎসাহ পাই না, চলার হাসার কোন মানে থাকে না আমার। তুই হলি আমার সকল শক্তির উৎস, সকল কাজের প্রেরণা।

সে উৎসকে হারিয়ে থাকতে হবে সারা জীবনের জন্যে, সে প্রেরণাকে মুছে দিতে হবে সব কর্মযজ্ঞ থেকে। কাঁদছে দুজন দুপুর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যার যার বিছানায় মুখ ঢেকে, দুজনেই জানে দুজনের চাওয়াতে কোন পাপ ছিলো না, মিথ্যে ছিলো না তাদের এই চাওয়া, ফাঁকি নেই কোথাও। প্রকৃতি তাদের দুজনকে কাছে নিয়ে এসেছিলো প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই। কিন্তু নিয়তি নিয়ে এলো বিচ্ছেদ।

কতো দুপুর কেটেছে তাদের একসাথে গান শুনে বা শুনিয়ে, কবিতা শুনে বা শুনিয়ে, বই নিয়ে, সিনেমা নিয়ে গল্প করে। ভাববো না আজ থেকে তোকে আর বলতেই পারে কিন্তু যেই মুহূর্তগুলো একসাথে কেটেছে স্বপ্ন বুনে সেগুলো কি করে মুছে যাবে? কোথায় হারাবে সেগুলো? যখন সেই গান আবার বাজবে কোথাও, পা থেমে আসবে না, মনে পড়বে না কখনই কিছু? মনে পড়বে না, এই গান আমার ছিলো কিংবা আমাদের ছিলো, ঐ মুহূর্ত আমাদের ছিলো, ঐ চাঁদ আমাদের ছিলো, ঐ ফুল আমাদের ছিলো শুধু আমাদের। দুমড়ে মুচড়ে বিদ্রোহ করে ওঠে অপালার মন, কেন সে অপালার বাবা মায়ের কথা মেনে নিলো? কেন সে অপালার হাত ধরতে ব্যাকুল হলো না। তীব্র অভিমানের বিষে অপালার সারা শরীর নীল হয়ে থাকে সারাবেলা। ধরবো না ফোন তোর, কখ্‌খনো না, কিছুতেই না। আমি কষ্ট পাচ্ছি, তুইও পা। প্রতিশোধের নেশা ব্যাকুল করে তোলে অপালাকে সারাবেলা। কিন্তু কোন একটা শাস্তিও অপালা খুঁজে পায় না যেটাতে ও কষ্ট পেলে অপালাও কষ্ট পাবে না। সব শাস্তিই প্রথমে তাকে ভোগ করতে হবে তারপরতো তার কাছে যাবে। কোথাও গেলে যদি তার সাথে দেখা হয়ে যায় এজন্যে বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিলো অপালা, জানে তাকে একবার চোখে দেখার জন্যে বাড়ির আশেপাশেই কোথাও থাকবে সে। কিন্তু অপালার চোখও যে সারাবেলা তাকে খুঁজে ফেরে। আঠারো বছরের সদ্য যুবতী, নিজেকে সারাবেলা সামলে রাখে, ধরে রাখে কি অবর্ণনীয় কষ্ট। যখন ইচ্ছে করছে প্রেমিক পুরুষের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নখের আঁচড়ে দাঁতের কামড়ে রক্তাক্ত করতে, তখন সারাবেলা সে তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সামলাচ্ছে নিজের আবেগকে।

যেটুকু না পাওয়া তা না পাওয়াই থাক, সব পেলে নষ্ট জীবন? তাই কি? না পেলেই জীবন আর কতোটুকু সার্থক? সবই মিছে সান্ত্বনা। তাই যদি হবে তবে এই পালিয়ে বেড়ানো খেলায় অপালা আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে কেনো? মানসিক এই চাপ শুধু তার পড়াশোনাকেই বিধস্ত করছে না, সাথে তার রূপ লাবণ্যও নষ্ট করে দিচ্ছে।

পুরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে আস্তে আস্তে, খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। কি এক নাম না জানা অস্থিরতা সারাবেলা তাকে তাড়া করে ফিরে। এক সময়ের সব প্রিয় জিনিস আজ সাপে কাটার ভয় নিয়ে আসে তার কাছে। কি করে সব এভাবে বদলে যায়? সব যদি বদলায় সে বদলাচ্ছে না কেনো?

Saturday 1 June 2013

চৌধুরী আলমের গল্পখানা (৫ম পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=c6818bf727a5e052517e1fd9e1dcc7ff&nttl=20130519033242197402

এইবার আল্লাহতায়ালা চৌধুরী আলম আর তাহার পত্নীকে বিমুখ করিলেন না। আল্ট্রাসনোর দ্বারা খবর আসিয়া গেলো ঘর আলো করিয়া এইবার চৌধুরী জানে আলম আসিবেন। আনন্দের পরিসীমা নাই, ডাক্তার এর নিকট হইতে ফিরিয়া সাথে সাথে ওজু করিয়া দুই রাকাত নফল নামাজ নিজে পড়িলেন আর তাগাদা দিয়া স্ত্রীকেও পড়াইলেন। বাড়িতে টেলিফোন করিয়া বাবা মাকে এই সুসংবাদ জানাইলেন। তাহারাও অত্যন্ত খুশি হইয়া খোদার দরবারে শোকরিয়া আদায় করিতে লাগিলেন। আনন্দের জোয়ারে ঘর ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

চৌধুরী আলমপত্নী গর্ভজনিত নানা কারণে অসুস্থ থাকিতে লাগিলেন। রান্নাবান্নাসহ গৃহকর্ম করিবার মতো শারীরিক সুস্থতা তাহার নাই। ইহাও তেমন সমস্যা না। চৌধুরী আলম ঘরকন্না সামলাইবার মতো যথেষ্ঠই পটু, অনেক বছরের অভিজ্ঞতা, তাহার ওপর স্ত্রী এইবার পুত্র সন্তানের মা হইবেন আনন্দের সহিতই তিনি সব করিতে চাহেন। কিন্তু অবাক হইয়া চৌধুরী আলম দেখিলেন আশেপাশের বাসার ভাবীদের নিকট হইতে বহু খাবারদাবার রান্নাসহ অন্যান্য সাহায্য আসিতেছে। তাহার রান্নাবান্না করিবার বিশেষ প্রয়োজনই পড়িতেছে না। তিনি একা এইখানে বহু বছর নিজে রান্নাবান্না করিয়া, অসুখ বিসুখে কাটাইয়াছেন, সেইভাবে কেহ তাহার খোঁজ নেয় নাই, তিনিও নেন নাই অন্যদের কিন্তু এইবারের ব্যাপারটা যেনো অন্যরকম।

আরো একখানা ব্যাপার তিনি হঠাৎ করিয়াই খেয়াল করিলেন, তিনি এতোদিন এইখানে থাকিয়া যতোটা না সখ্যতা গড়িতে পারিয়াছিলেন সবার সহিত, বউ মাত্র কয়দিন না আসিয়াই তাহার চাইতে অনেকগুন বেশি সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়িয়া তুলিয়াছেন। সারাদিনই টেলিফোন কানে লাগাইয়া গুটুরমুটুর করে। এই বাসার ভাবী ঐ বাসার ভাবী সবার সাথেই সবাই। ধরিতে গেলে সপ্তায় সপ্তায় তাহাদের কাহারো না কাহারো বাসায় কোন না কোন উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করিয়া দেখা হইয়া থাকে তাহারপরও কি কথা তাহাদের সারাদিন একজন একজনের সহিত টেলিফোনে তাহা তিনি বুঝিয়া পান না। সেইভাবে কিছু স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করিতে পারেন না মুখ ঝামটার ভয়ে। এই যে তাহারা সারাদিন টেলিফোনে এতো গল্প করিয়া থাকেন, সামনাসামনি দেখা হইলে একজন আর একজনের গায়ে হাসিয়া লুটাইয়া পড়েন, তাহা দেখিয়া যে কেহ ভ্রমে থাকিতে পারেন, একজনের সহিত অন্যজনের কতো না ভাব, কতো না বন্ধু বটে তাহারা। আদপে সেইরকম কিছু নহে, প্রায়শই তাহারা দেখা যায় একজন একজনকে পছন্দ করেন না, প্রায় প্রত্যকেই প্রত্যেকের অগোচরে নানান কথা কহিয়া থাকেন। তবে আজকাল স্ত্রীর নিকট হইতে বহুবিধ খবর পাইয়া কিংবা বলা চলে গোপন খবর পাইয়া তাহার পিলে চমকাইয়া উঠে। এইখানে এতো বছর থাকার পরও তিনি যাহা জানিতেন না, স্ত্রী আসিয়া ছয়মাস না গড়াইতেই তাহার চাইতে অনেকবেশি জানেন।

কে কে এখানে সরকারের ঘরে অফিসিয়ালি ডিভোর্স দেখাইয়া আলাদা আলাদা স্বামী স্ত্রী দুইগুন ভাতা – বাড়িভাড়া আদায় করিয়া থাকেন, একবাড়ি আবার অন্যকাহারো কাছে ভাড়া দিয়া, সেই ভাড়ার টাকা দিয়া ঢাকার বিলাসবহুল এলাকাতে ফ্ল্যাট কিনিয়াছেন তাহা স্ত্রী না জানাইলে হয়তো সারাজীবন তাহার অজানা থাকিতো। আবার সেইদিন শুনিলেন আলিম ভাই নাকি বিবাহিত আর তিন সন্তানের পিতা হিসেবে কেইস করিয়াছিলেন। সন্তানদের জন্যে যেই ভাতা তিনি সরকারের ঘর হইতে এতোদিন পাইয়াছেন তাহা জমাইয়া জমাইয়া নিজেদের জেলা শহরে জমি কিনিয়া আলিশান বাড়ি করিয়াছেন। আশেপাশে এলাকার বহুলোক শুধু বাড়িটাকে এক নজর দেখিতেই সেই এলাকায় আসেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধিল যখন তিনি নিজে সত্যিকারের বিবাহ করিয়া স্ত্রীর জন্যে ভিসা চাহিতে গেলেন। নকল স্ত্রী, ডিভোর্স পেপার ইত্যাদি লইয়া এম্বেসীর সহিত তাহাকে বিস্তর হাঙ্গামা পোহাইতে হইয়াছিল। প্রায় ফাঁসিয়া গিয়াছিলেন গিয়াছিলেন অবস্থা হইতে তিনি উদ্ধার পাইয়াছিলেন। এই সমস্ত গল্পের সহিত আজকাল জোটে স্ত্রীর গঞ্জনা। তিনি নিতান্তই বেকুব কিসিমের জীবন যাপন করিয়াছেন জার্মান দেশে। এইদেশে এতো সুযোগ সুবিধা তিনি বুদ্ধি করিয়া কিছুই ভোগ দখল করিতে পারেন নাই তাই তাহাদের আজ এতো কষ্ট। নহিলে কি এইখানে টাকা পয়সা কোন ব্যাপার? তাহাদেরকে এতো সাধারণ জীবন যাপন করিতে হয়? টাকা রোজগারের পথতো জানিতেন না এখন পারেন শুধু স্ত্রী কন্যার সহিত কলহ করিতে, খরচ কমাও খরচ কমাও।

আগে চৌধুরী আলম সামাজিকতায় এতোটা জড়িত ছিলেন না। নিজের মতো নিজের কাজ লইয়া থাকিতেন। মাঝে সাঝে ঈদের কিংবা জুম্মার নামাজ পড়িতেন, ঈদের সেমাই খাইতে এর তাহার বাসায় কদাচিৎ যাইতেন। বউ আসিবার পর হইতে তাহার সামাজিক কাজের গতিবিধি ব্যাপক দ্রুততায় বিরাট বাড়িয়া গেলো। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে এইদিক সেইদিক দাওয়াত লাগিয়াই থাকে। নইলে নিজের বাড়িতে ডাকিয়া খাওয়ান। দুইহাতে খরচ হইতে লাগিল কিন্তু কি আর করা। বউ মেয়েরা বাঙ্গালী, সামাজিকতা সান্নিধ্য ছাড়া থাকিতে পারেন না, তাহাদের লোক দরকার। এদিকে বাবা মায়ের প্রতি সংসার খরচা পাঠানোতে টান পড়িতে লাগিলো কিন্তু সাহস করে সহসা মুখ খুলিয়া তাহা বলিতে পারেন না, স্ত্রী কন্যা ঝাঝিয়া ফেলিবে তাহাকে। একেইতো অন্যদের তুলনায় তিনি অর্থনৈতিকভাবে এতো দুর্বল তাহার ওপর তিনি যাহা রোজগার করেন সবই বাবা মা ভাইবোনের পিছনে উড়াইয়া দিয়াছেন কিংবা দেন, রাবনের গুষ্টি টানিয়া নিয়া যাচ্ছেন, এই খোঁটা অহরহ শুনিতে হয়। টাকা পয়সার ব্যাপারে সবাই তাহার ওপর অসন্তুষ্ট, না তিনি বাবা মায়ের কাছে এই ব্যাপারে জায়গা পান, না স্ত্রী কন্যা তাহা বুঝিবার চেষ্টা করে। একপক্ষ মুখ ফিরাইয়া লইয়াছেন আগের মতো পুত্র তাহার দায়িত্ব পালন করিতেছেন না বলিয়া আর অন্যপক্ষ ঝাজিয়া থাকে সব লুটাইয়া দিয়াছেন বলিয়া।

এই অবস্থার মধ্যেই সেই সুখের দিন আসিয়া গেলো। প্রসব ব্যথায় কাতর স্ত্রীকে লইয়া তিনি হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা হইলেন। হাসপাতালে যাইয়া স্ত্রীকে ভর্তিতো করাইয়া দিলেন কিন্তু আবার এক নতুন সমস্যার সম্মুখে পড়িতে হইলো তাকে। স্ত্রী এক বর্ণ জার্মান কহিতে বুঝিতে পারেন না, ইংরেজিও একই অবস্থা। অন্যান্য ভাবীরা যাহাদের সহিত তাহাদের দিনরাতের ওঠাবসা তাহাদেরও অবস্থা প্রায় কাছাকাছি। কেউ কেউ ভুলভাল উচ্চারণে ভাঙা ভাঙা জার্মান কহিয়া থাকেন বটে কিন্তু এই সময় চৌধুরী আলম আর ভাঙা ভাঙা জার্মান ভাষার ওপর ভরসা রাখিতে পারিতেছেন না। কি করিবেন কি করিবেন ভাবিয়া উতলা হইতেছিলেন। হঠাৎ তাহার টিচার আপার কথা মনে পড়িল। টিচার আপা বাংলাদেশেরই মানুষ, মাঝে সাঝে তাহাদের দোকানে দেশি মাছ, সব্জি, মশলা কিনিতে আসেন। ভাই একটা জার্মান কোম্পানিতে চাকুরি করেন আর আপা স্থানীয় একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ান। আপা অনর্গল জামার্ন কহিতে পারেন, অবিকল জার্মানিদের মতো। অনেকেই ভাষা সংক্রান্ত দরকারে তাহাদের বাটিতে যাইয়া থাকেন। সহসা তাহারা কাউকে ফিরান না এই গুণ তাহাদের আছে। এমনিতে যদিও খুব একটা যাওয়া আসা তাহাদের সহিত হয় না, সবাই বাংলাদেশী হইলেও দেখা যায়, চাকুরীজীবীরা নিজেদের মধ্যে আবার ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে মিলামিশাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

কিন্তু কপাল ঠুকিয়া চৌধুরী আলম আর একজনের কাছ হইতে নম্বর যোগাড় করিয়া টিচার আপাকে ফোন করিয়া তাহার প্রয়োজনের কথা জানাইলেন। আপা জানাইলেন তিনি শীঘ্রই হাসপাতালে আসিয়া উপস্থিত হইতেছেন। ইহা শুনিয়া চৌধুরী আলম হাফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন যেনো। আপা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হাসপাতালে আসিয়া তাহার স্ত্রীর পাশে দাঁড়াইলেন। কোন জটিলতা ছাড়াই স্ত্রী যথাসময়ে ফুটফুটে স্বাস্থ্যবান এক পুত্রের জন্ম দিলেন। ভাষাগত ব্যাপারগুলি আপা সামলাইয়া দিলেন। নার্স যাহা যাহা কহিতেছিলো তিনি বাংলায় চৌধুরী আলমের স্ত্রীকে বুঝাইয়া দিতে ছিলেন। বিরাট কোন সমস্যা হয় নাই। চৌধুরী আলম নাড়ি কাটিয়া দিতেই নার্স তোয়ালে মুড়াইয়া পুত্র সন্তানকে তাহার কোলে দিলেন। তিনি সম্বিত ফিরিয়া পাইয়া পুত্রের কানে আজান দিয়া আল্লাহর নাম শুনাইলেন। টেলিফোনে চৌধুরী আলমের মাতা বারবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যেনো পুত্রের কানে আজান দিয়া আল্লাহর নাম জানাইতে ভুল না হয়। স্ত্রীও মোটামুটি সুস্থ আছেন। দিন দুই হাসপাতালে কাটাইয়া স্ত্রী পুত্র নিয়া তিনি বাটিতে ফিরিলেন। আশেপাশের ভাবীরা এই উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করিয়া ছোটখাটো আয়োজন করিয়া, বাড়িঘর সাজাইয়া দিয়াছেন নীল রঙের সামগ্রী দিয়া। পুত্র হইয়াছে তাই নীল।

আনন্দে ভাসিয়া যাইতে লাগলো সুখের সংসার। সকলকে তিনি অকাতরে মিষ্টি বিতরণ করিলেন। কিন্তু সকলেই জানাইলো শুধু মিষ্টিতে তাহারা সন্তুষ্ট না কাচ্চি চাই। যদিও দেশে তিনি একবার ছেলের আকিকার জন্যে বাবা মায়ের নিকট টাকা পয়সা পাঠাইয়া দিয়াছেন, কিন্তু এখানে সকলের অনুরোধে তিনি পুত্রের নাম করিয়া আবার ছোটখাটো একখানা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করিলেন। প্রবাসীরা সাধারণত খুবই ধর্মভীরু হইয়া থাকেন। যেকোন উপলক্ষ্যেই তাহারা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করিয়া আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করিয়া থাকেন। হালাল দোকান হইতে বাজার সদাই করিয়া থাকেন। হালাল খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপারেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া থাকেন। দৈনন্দিন জীবনে ইসলামি রীতিনীতি বজায় রাখিতে তাহাদের চেষ্টার সীমা পরিসীমা থাকে না। সেই কারণে দেখা যায় অনেকে জার্মান দেশে বসবাস করিয়াও, জার্মানিদের সহিত বন্ধুত্ব করাতে অনাগ্রহী থাকেন। যদিও এইসব খ্রিষ্টান নাসারাদের দেশে ধর্ম পালন করা কোন সহজ কথা না তবুও চেষ্টা না চালাইলে শেষ দিন আল্লাহকে কি জবাব দিবেন? সে কারণেই হয়তো বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মিলাদ মাহফিল করার প্রবণতা প্রবাসীদের বেশি। সৃষ্টিকর্তাকে জানানো, যেখানেই থাকুন না কেনো তাহারা, সর্বদা অন্তরে আল্লাহর নাম। কিংবা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সবর্দা সৎ পথ অবলম্বন করেন না বলিয়া মনের পাপবোধ কাটাইতেও এইরকম করিয়া থাকিতে পারেন, কে জানে। অনেক সময় দেখা যায় পয়সা রোজগারের জন্য হেন কোন অন্যায় নাই যাহা প্রবাসীরা করিয়া থাকেন না। বহু দরিদ্র দেশের নাগরিকরাই এই দোষে দূষিত।

স্ত্রী ও তিনি পুত্র পালন লইয়া মহাব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। এইদিকে কন্যার ভাষা শিক্ষার স্কুল আরম্ভ হইয়া গেলো, কোন বাহানা দিয়াই আর কোনভাবেই তাহার স্কুলে পাঠানো ঠ্যাকাইয়া রাখা গেলো না। কন্যাও নিজের একখানা জগত পাইয়া আনন্দিত। সে তাহার নিজের জগতে ডুবিয়া যাইতে চাইলেও প্রতিনিয়ত বাবা মায়ের সহিত এই নিয়া বচসা বাঁধিয়া যাইতে লাগিলো। স্কুলে সে তাহার অন্যান্য সহপাঠী বন্ধুদের ন্যায় কাপড় চোপড় পরিধান করিতে চায়, সাজগোজ করিতে চায়। কখনো কখনো অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সহিত সিনেমা, পিকনিক কিংবা এইদিকে ঐদিকে বেড়াইতে যাইতে চায়। যে বয়সের যাহা। ধর্মভীরু, রক্ষনশীল মানসিকতার বাবা মায়ের কাছে এইগুলো সবই বাড়াবাড়ি। সব ছেলেমেয়ে সাইকেল চালাইয়া স্কুলে গেলেও তাহাকে যাইতে হবে হাঁটিয়া কিংবা বাসে কারণ তাহার বাবা মায়ের চোখে ইহা বেপর্দা কাজ জাতীয় কিছু। কন্যা বুঝিয়া পায় না সাইকেলের সহিত পর্দার কি সম্পর্ক! প্রায় প্রত্যেকটি জার্মান ছেলেমেয়ে এবং অন্যান্য বিদে‍শিরাও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে কলেজে আসা যাওয়া করে, ইহা এই দেশের একটি চরম স্বাভাবিক ঘটনা।

ইহাতেই শুধু শেষ নয়। নিজের ইচ্ছামতো দুইটা বড় ফ্যাশনের কানের দুলও সে কিনিতে পারে না। বাবার চোখে তাহা ফিরিঙ্গিপনা,
বাবা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করিলেন, কানে এইগুলা কি পড়িয়াছো?
সে মিনমিন গলায় জবাব দিলো, এইগুলা এইখানে সবাই পরে।
বাবা বলেন, সবাই পড়ুক, সবাইতো আর চৌধুরী বাড়ির কন্যা না। তুমি বংশের সম্মানের দিকে খেয়াল রাখবা না। সবসময় চলাবলায় তোমাকে খেয়াল রাখিতে হইবে তুমি কোন বংশের সন্তান,  তাহাছাড়া তুমি একজন মুসলমান। নাছারাদিগোর মতো সাজগোজ তোমাকে মানায় না। খোল এইগুলা খোল। কেমন দেখায়।

সে মুখ কালো করিয়া আস্তে আস্তে খুলিয়া ফেলিয়া বাবার সামনে হইতে সরিয়া যায়।

চৌধুরী আলম গলা হাকাইয়া গিন্নীকে কহেন, তাহাকে চৌধুরী বাড়ির ইজ্জতের সহিত মিলে এইরকম গয়নাগাটি পরা শিখাইতে ও কিনিয়া দিতে। আর ধর্মীয় শিক্ষা দিতে, অন্তরে যাহাতে আল্লাহর ডর থাকে।

তাহাকে মায়ের সহিত দোকানে যাইয়া বাছিয়া বাছিয়া পুরাতন ফ্যাশনের ছোট ছোট দুল কিনিতে হয়, মাথায় হিজাব বাঁধিতে হয়। কিছুতেই সে নিজেকে ক্লাশের আর সকলের মতো করিয়া তুলিতে পারিতেছিল না। ক্লাশে তাহাকে লইয়া মাঝে মাঝে হাসাহাসি হয়, লজ্জায় তাহার মাথা কাটা যায়। তাহার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী জুটিল সোমালিয়ান, সেও কম বেশি একই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়া যাইতেছিল, সে তখন তাহাকে উপায় বাতলাইয়া দিলো। বাটি হইতে বাহির হইবার সময় বাবা মায়ের পছন্দমতো সাজিয়া বাহির হইবে কিন্তু হাল ফ্যাশনের সব কাপড় গয়না মেকাপ তাহার স্কুল ব্যাগে লইয়া বাহির হইবে। স্কুলে আসিয়া সরাসরি ক্লাশে না ঢুকিয়া লেডিস রুমে চলিয়া গেলেই হইলো। সেইখানে ইচ্ছামতো সাজিয়া গুজিয়া ক্লাশে আসিলেই চলিবে। শুধু একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে আসিলেই ল্যাঠা চুকিয়া যাইবে। কিন্তু হাল ফ্যাশনের সাজের  জিনিসপত্র সে পাইবে কোথায়? এই দুঃশ্চিন্তার কথা তাহার বান্ধবীকে জানাইতেই সে সমাধান করিয়া দিলো। স্কুল ছুটি হইলে তাহারা দুইজনে বাটিতে না ফিরিয়া দোকানে যাইবে। একদিনেতো আর সব কিনিতে পারিবে না, আস্তে আস্তে কিনিলেই হইবে। তাহাতে স্কুলের পর বাইরে বেশি দেরিও হইবে না, বাটিতে জানিবেও না।

কিন্তু টাকা? ইহারও উপায় পাওয়া গেলো। আস্তে আস্তে পিতার মানিব্যাগ বা মাতার ভ্যানিটি ব্যাগ হইতে সরাইতে হইবে। একদিনে বেশি সরাইলে ধরা পড়িয়া যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, তাই প্রতিদিন দুই টাকা পাঁচ টাকা সরাইলেই চলিবে। চৌধুরী আলমের কন্যাও দেখিলো ইহা একটি উৎকৃষ্ট পন্থা সবদিক রক্ষা করিবার। আপাতত সে এই রাস্তা অবলম্বন করিয়াই গৃহ শান্তি বজায় রাখিবে মনস্থ করিলো। বাবা মা ছোট ভাইটিকে লইয়া যে পরিমাণ আহ্লাদিত আর ব্যস্ত, সহসা ইহা তাহারা টের পাইবেন না, সেই ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিন্ত ছিলো। ধর্ম সংস্কৃতি সময় সর্বোপরি সার্বিক পরিবেশের কারণে কন্যা আস্তে আস্তে পিতামাতা হইতে অনেক দূরে সরিতে ছিলো, অধিক শাসনে মনোযোগী পিতামাতা তাহা কিছুই লক্ষ্য করিলেন না।



চৌধুরী আলমের গল্পখানা (চতুর্থ পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=f26126351f269a9a4f38d76bb2ffd7f9&nttl=160468

কিন্তু ঘর ভাসিয়া যাইতেছিল সুখ আর আনন্দে। চৌধুরী আলমের স্ত্রী ও কন্যা জার্মান দেশে যাহা দেখিতেজার্মানি আসিয়া প্রথম কিছুদিন কাটিয়া গেলো নিজেদেরকে একটু সুস্থির করিতে। বিভিন্ন অফিসে বিভিন্ন রকমের দৌড়াদৌড়ি, বীমা, সরকারের বিভিন্ন খাতায় স্ত্রী কন্যার নাম উঠানো ইত্যাদি প্রভৃতি ঝামেলা লইয়া। পাইতেছেন তাহাতেই মুগ্ধ হইয়া যাইতেছেন। আর সারাক্ষণ মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, কি পাষাণ লোক চৌধুরী আলম, এই সুখ স্বাচ্ছন্দ হইতে এতোদিন তিনি তাহাদেরকে বঞ্চিত করিয়াছেন। একটু ধূলা নাই বালি নাই, মেশিনখানা টিপিয়া ধরিলেই ঘর পরিষ্কার হইয়া যায়, কল টিপিলেই গরম পানি – ঠাণ্ডা পানি, মেশিন ঘুরালেই ঘর গরম হইয়া উঠে, সুইচ টিপিলেই আগুন বাহির হয়। আহা, বেহেস্তে কি ইহা হইতে বেশি আরাম? গাড়ি চড়িয়া এদিক সেদিক যাইতেছেন, ট্রলি ঠেলিয়া বাজার করিয়া আনিতেছেন, ঠিক যেমন সিনেমায় বড়লোকেরা করিয়া থাকেন। কোন আক্কেলে চৌধুরী তাহাদেরকে কহিতেছিল, বিদেশ মানে নানাবিধ যন্ত্রণা? তাহারা তো এইখানে যন্ত্রণার লেশমাত্রও পাইতেছেন না, বরং এতো সুখ দুনিয়ায় লুকাইয়া আছে তাহাই তাদের অজানা ছিল এতোদিন। মহানন্দে চৌধুরী গিন্নী সংসার সাজাইতে মন দিলেন এইবার। বিবাহ হইয়াছে সেই কবে, কিন্তু সংসার পাইলেন তিনি আজ। তাহার নিজের সংসার, যাহার তিনি একচ্ছত্রী কর্ত্রী। এতোদিন বাপের সংসার ভাইয়ের সংসারে ভাসিয়া বেড়াইতেছিলেন তিনি। এইবার খুঁটির নাগাল পাইলেন।

চৌধুরী আলমও তাহার নিজের কাজে কর্মে আস্তে আস্তে মনোনিবেশ করিলেন। ওপরে বাসা নীচে দোকান সমস্ত কিছুই তাহাদের হাতের মুঠোয়। দোকানে ভিড় হইলে স্ত্রীকে ওপর হইতে ডাকাইয়া পাঠান, স্ত্রী আসিয়া সব্জি ওজন করিয়া, মাছ কাটিয়া দিয়া তাহাকে সাহায্য করিয়া থাকেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চৌধুরী আলম দেখিলেন বউকে যাহা ভাবিয়াছিলেন অবলা অকর্মন্য তিনি মোটেই তাহা নহেন। বউ বেশ চটপটে, গুণী। সুন্দর করিয়া মানুষের সহিত গুছাইয়া কথা কওয়া, নিজে নিজে কাজ করিবার মতো বুদ্ধি সে ধরে। প্রথমে স্ত্রী কন্যা আসিলে খরচ বাড়িয়া যাইবে, ভাষা জানিবে না, পড়াশোনা জানে না, ইহাদেরকে কে দেখাশোনা করিবে, তিনি ইহাদের দেখাশোনা করিলে দোকানদারী কখন করিবেন ইত্যাদি ভাবিয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছিলেন। এখন দেখিলেন বাস্তবে তাহার বহু ভাবনায় উলটো ফল হইয়াছে। রান্নাবান্না, কাপড় ইস্ত্রী, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, দোকানদারী বহু কিছুতেই স্ত্রী কন্যার সাহায্য পাওয়া যায়। তাহার আর আগের মতো কষ্ট নাই বরং বেশ খানিকটা আরাম করিতে পারেন। আগে দোকান ফেলিয়া অনেক সময় বাজার করিতে যাওয়াও কষ্টকর ছিল, কাহাকে বসাইবেন দোকানে নইলে দোকান বন্ধ করিয়া যাইতে হইতো। আর আজকাল তিনি মাঝে মধ্যে বেশ এদিকে ঐদিকে ঘোরাফেরা করিয়া আড্ডা দিয়া আসেন। পঞ্চব্যাঞ্জন সহকারে ভোজন করিয়া পরিপাটি বিছানায় সুখের নিদ্রা যান এই ভাবিতে ভাবিতে জীবনটা আসলে খারাপ নহে। সত্যি কহিতে কি তাহার সুখে পরিচিত অনেকে এখন ঈর্ষা করিতেছে তিনি বেশ অনুভব করিতে পারেন। আরো দশ বছর পূর্বে হইতে স্ত্রী নিয়া বসবাস করিতেছেন, এমন অনেকের স্ত্রীই এখনো মানুষের সহিত ঠিক করিয়া কথা কহিতে পারেন না, আর তাহার স্ত্রী দোকান সামলাইতেছেন ছয় মাসের মধ্যে, ঈর্ষার ব্যাপার বইকি তো নয়।

যেইরকম ভাবিয়াছিলেন কন্যাকে স্কুলে দিবেন না, বাসায় পড়াইবেন। সেইরকম কন্যা বাসায় থাকে। টিভিতে, ভিসিআরে সারাক্ষণ হিন্দী সিনেমা, সিরিয়াল দেখিতে থাকে। মাঝে মধ্যে অবশ্যই বাবা মায়ের তাড়া খাইয়া সে পুস্তক নাড়াচাড়া করিয়া থাকে, পাঠ করে না ধ্যান করে তাহা খুঁজিয়া তলাইয়া দেখিবার কেহ নাই। কন্যা বইপুস্তক সামনে রাখিয়া টেবিলে বসিয়া থাকিলেই পিতামাতা তাহারা তাহাদের কর্তব্য করিতেছেন ভাবিয়া অত্যন্ত খুশী। এইভাবেই দিন কাটিয়া যাইতে ছিল হাসিখুশী আর আনন্দে। কিন্তু এইখানে বাধ সাধিল ভিলেন জার্মান সরকার। ষোল বছর বয়স অব্ধি এইখানে স্কুলে যাওয়া প্রত্যেক বাচ্চার জন্য বাধ্যতামূলক। সেই অনুযায়ী সরকার স্কুলকে বাৎসরিক অর্থ প্রদান করিয়া থাকেন, কোন স্কুলে কতোজন বাচ্চা। বাচ্চার বাবা মা কতোদূর পড়াশোনা করিয়াছেন, তাহারা বাচ্চাকে বাসায় কি ধরনের সাহায্য দিতে পারিবেন, বাচ্চার অন্যকোন ধরনের শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যা আছে কিনা, সেই সমস্তের ওপর ভিত্তি করিয়া স্কুলের বাৎসরিক বাজেট নির্ধারণ করা হইয়া থাকে। সরকারের খাতায় শিশুর নাম উঠাইয়া দিয়া, সরকারের ঘর হইতে বাচ্চার ত্রৈমাসিক ভাতা উঠানো হইতেছে বটে কিন্তু সরকার এই শিশুকে কোন স্কুলে খুঁজিয়া পাইতেছেন না। বছর শেষে যখন শিশুভাতা আর বিদ্যালয়ের হিসাব মিলিতেছে না তখন সরকার ঘটনা কি খুঁজিতে পুলিশ লাগাইলো।

এক প্রাতে পুলিশ বেল টিপিয়া দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইলো। দুয়ারে পুলিশ দেখিয়া হৃদকম্পন শুরু হইয়া গেলো চৌধুরী আলমের। কি কারণে কি অপরাধ কিছুইতো বুঝিতে পারিতেছেন না। আজকালতো মোটামুটি সামান্য হলেও নিয়মিত আয়কর তিনি পরিশোধ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঘটনা কি? কন্যা লইয়া পুলিশের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নাস্তানাবুদ হইয়া গেলেন, কন্যা ভাষা জানে না, দেশের কায়দা কানুন রীতিনীতি জানে না, সেজন্য তাহাকে এখনো স্কুলে দেন নাই, দিবার কথা ভাবিতেছিলেন, ইত্যাদি ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা কহিলেন বিপদ সামলানোর জন্যে। সামনের সেশন হইতে কন্যাকে স্কুলে দিবেন স্বীকার আসিয়া তিনি মুচালেকা দিলেন। আর জার্মান নাগরিক হইয়া কন্যাকে স্কুলে না পাঠাইয়া রাষ্ট্রের যেই আইন তিনি ভঙ্গ করিয়াছেন তাহার জন্য তাহার বিস্তর জরিমানা হইবে সেইটা কোর্টে তাহাকে বুঝিতে হইবে বলিয়া রিপোর্ট করিয়া পুলিশ বিদায় হইলো। জরিমানা আর মামলার ভয়ে চৌধুরী আলমের বক্ষ ভাঙ্গিয়া পড়িলেও তাহার কন্যা মনে মনে খুবই পুলকিত হইলো। আসিয়া অবধি সে কোথাও যাইতে পারিতেছে না। এক এই ঘর আর দোকান আর দোকান আর ঘর। একা কোথাও ঘুরিয়া দেখিবার অবকাশ নাই, কাহারো বাটিতে যাইবার অনুমতি নাই, কি এক বন্দী জীবন। এইবার হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। হোক বিদেশী, রঙ অন্য, ভাষা জানে না তাহাতে কি, শিখিয়া লইবে। তবুওতো সমবয়সী, একসাথে পড়াশোনা করিলে নিশ্চয় কেহ কেহ তাহার বন্ধু হইবে, তাহাদের সহিত গলাগলি করিয়া মনের ভাব আদান প্রদান করিবে। তের বছর বয়সে সারাক্ষণ মা-বাবা আর বাবা-মা কাহার ভালো লাগে? প্রথমে জার্মান আসিয়া চকচকে গাড়ি, পরিপাটি সাজানো বাড়ি, ঝলমলে শপিং মল ইত্যাদি দেখিয়া যতো ভালো লাগিয়াছিল, দিনের পর দিন একা থাকিয়া সেই মুগ্ধতা এখন অনেকটাই হ্রাস পাইয়া গিয়াছে।

ইহার মধ্যে একদিন চৌধুরী আলম প্রত্যুষে বাড়ি হইতে টেলিফোন পাইয়া খুবই অবাক হইলেন। টেলিফোন সাধারনতঃ একতরফা উনি বা উনারাই করিয়া থাকেন আত্মীয় পরিজনদের। ঐদিক হইতে টেলিফোন আসে না কহিলেই চলে। প্রথমে তিনি খুবই ঘাবড়াইয়া গেলেন, বাবা মাকে লইয়া কোন অশুভ সংবাদ নহে তো আবার।

অপরপ্রান্তে খুশীর আওয়াজ পাইয়া কিঞ্চিত শান্ত হইয়া ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসিলেন, কি সংবাদ। অপরপ্রান্তে তাহার বড় ভ্রাতা ছিলেন। তিনি কহিলেন, তাহার বড় কন্যার বিবাহ ঠিক হইয়াছে। পাত্র জেলা সদরে থাকে, ওখানকার বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক, মানী বংশের গুণী ছেলে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুনিয়া চৌধুরী আলম খানিক দমিয়া গেলেন, ইহা কি আর এমন ভালো পাত্র। মাস্টার মানেই ভাতে পানিতে মরা। বেতন পায় কি পায় না, ইহার কি কিছু ঠিক আছে?

বড় ভ্রাতা আশ্বস্ত করিলেন, সেই সমস্ত দিন আর নাই। এখনকার শিক্ষকরা বড়ই সুপাত্র, কোচিং প্রাইভেট করাইয়া অনেক রোজগার করিয়া থাকেন। কন্যা ইষৎ বেটে তাহার ওপর নকলের ঝাঁজে ম্যাট্রিকের দুয়ার পাড়ি দিলেও সামনে আর আশা নাই। এই কন্যার জন্য এই পাত্র মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।

এমন মানী পাত্রকে মানসম্মানমতো কিভাবে সম্মান করিবেন সেই বুদ্ধি করিতে তিনি ফোন করিয়াছেন। তাহারা নিজেরা এতো উচ্চবংশ, এলাকার বিশিষ্টজন, তাহাদের বড় কন্যার শুভবিবাহ, এভাবেতো ছাড়িয়া দেওয়া যায় না। কাহার ভাতিজি তাহাতো সকলেই জানে নাকি?

চৌধুরী আলম এই কথা শুনিয়া আমতা আমতা করিয়া কহিলো, তাহাকে কি করিতে হইবে?
বড় ভ্রাতা উৎফুল্ল কণ্ঠে কহিলেন, তাহাকে বিশেষ তেমন কিছুই করিতে হইবে না। এখানে সকলেই আছেন, তাহারা সবাই মিলিয়া যোগাড়যন্ত্র যা হয় করিয়া ফেলিবেন। তিনি যদি লাখ তিনেক টাকা অতিসত্বর পাঠাইয়া দেন তাহা হইলে বড় উপকার হইতো। বিবাহ মানে শত কাজ আর পয়সা ছাড়াতো কেহ নড়িবে না।

এককথায় এতো টাকা অতিসত্বর তিনি কোথায় পাইবেন? তিনি এখন পরিবার লইয়া থাকেন, রোজগারতো একই আছে কিন্তু খরচ বাড়িয়া গিয়াছে তিনগুণ। মন চাইলেও এতোটাকা এতো কম সময়ে পাঠানো তাহার পক্ষে সম্ভব নহে, আকুল কণ্ঠে কথাগুলো কহিলেন চৌধুরী আলম।
বড় ভ্রাতা, তাহাকে ভুল বুঝিলেন। সংসারের এই সময়ে তাহার কাছে এইরকম ব্যবহার তিনি প্রত্যাশা করেন নাই। এতো বছর চৌধুরী আলম বিদেশে থাকেন, সংসারের কতোজনের জন্য তিনি কতো কি করিয়াছেন, বড়ভাই হিসাবে কি মুখ ফুটিয়া তিনি কোনদিন কিছু তাহার কাছে চাহিয়াছেন? আজ যখন পরিবারের সম্মানের জন্য তাহার কাছে মুখ খুলিলেন তাহার এই ব্যবহার? ঠিক আছে, চাই না তাহার টাকা, পারিবারিক জমিতে তো তাহারও অধিকার আছে, সেই অধিকার এইদিনে কাজ আসিবে নাতো কোনদিন আসিবে? সম্মান বাঁচিলে বাকি সব দেখিয়া লইবেন তিনি। রাগত ও আহত হইয়া ফোন ছাড়িয়া দিলেন।

চৌধুরী আলম ফোন ছাড়িয়া দুঃখে স্তব্ধ হইয়া লক্ষ্য করিলেন, বড়ভাই তাহাকে একবারের জন্যও দেশে আসিতে, বিবাহে উপস্থিত থাকিতে কহিলেন না, ডাকিলেন না। অথচ সবার বড় ভাতিজি, কতো না আদরের সহিত তাহাকে লইয়া চৌধুরী আলম হাটে গঞ্জে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ঘাড়ে লইয়া ছড়া কাটিতেন। বুকের সহিত মিশাইয়া কলিজায় করিয়া আপন কন্যা জ্ঞানে স্নেহ করিয়াছেন তাহাকে। সবাই শুধু টাকার দরকারে তাহাকে স্মরণ করে, উৎসবে তাহার উপস্থিতি অনাবশ্যক? তাহার কি মন চাইতে পারে না অন্যান্য ভাইদের সহিত মিলিয়া কন্যাকে বধূ সাজাইয়া বিদায় করেন?

বিশাল মনোকষ্টে তাহার বক্ষ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু মুখ খুলিবার উপায় নাই। মুখ খুলিবেনতো কোথায় খুলিবেন? এমনিতেই খরচাপাতি লইয়া সংসারে নানান খিটিমিটি চলিতে থাকে। স্ত্রী যদিও বা কিছুটা বুঝেন কিংবা বুঝের ভাব দেখান, কন্যার সাথেতো কথাই কওয়া যায় না, ফসফস জ্বলিয়া ওঠে। সারাক্ষণ ঘরে হিটিং জ্বালাইলে কতো বিল আসিবে তাহা সম্পর্কে কোন ধারণা তো নাই উলটা বলিয়া ওঠে, আমাদের খরচের এতো গা জ্বালা হইলে আনিলা কেনো জার্মান, এতো জনম যেইভাবে ফেলাইয়া ছিলা, সেইভাবেই রাখিয়া দিতা। তোমার কাছেতো টাকাই সব, স্ত্রী কন্যা কি? চৌধুরী আলম দিনে রাতে অনুভব করিতে লাগিলেন, হঠাৎ করিয়া তের বছরের কন্যার পিতা হইয়া যাওয়া কোন সহজ কর্ম নহে। তাহার কোন ধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছিল না এই সম্বন্ধে। টেলিফোনে কন্যার খোঁজখবর রাখিয়া আর্দশ পিতা হওয়া আর একসাথে বাস করিয়া কন্যাকে মানুষ করা পুরাই ভিন্ন ব্যাপার। তিনি আর নির্দয়ের মতো কহিতে পারেন না, আনিতে তো চাহি নাই, তোমাদের পীড়াপিড়িতে রাজি হইতে হইলো। এতো যে চৌধুরী আলম খরচের ব্যাপারে কহেন, কন্যার ভ্রূক্ষেপও নাই। সমানে বাথটাবে পানি খরচ, বিভিন্ন কারণে বিদ্যুৎ খরচ চালাইয়া যাইতেছে। কথায় কথায় বাক্যবান এড়ানোর জন্য বরং তিনি কিছুটা চুপ থাকার চেষ্টা করেন। কিছু না হইতেই কন্যার ভালো লাগে না, পরদেশে তাহার মন বসে না। মাঝে মাঝে চৌধুরী আলমের সন্দেহ হয়, এরমধ্যে স্ত্রীও হয়তো কিছুটা জড়িত আছেন। কি করিলে ভালো লাগিবে?

তাহারা সাজিয়া গুজিয়া বাহির হইবেন বাজারে। ভালো লাগার ইহাই প্রধান স্থান। প্রথমে কহিবেন, কেনাকাটা কিছুই করিবেন না। দোকানে ঘুরিবেন আর ঘুরিবেন, দেখিবেন। কিন্তু পরে দেখা যাইবে বহুবিধ জিনিস তাহাদের সত্যিই দরকার, যাহা ছাড়া চলা যাইতেছে না কিংবা চলা ভীষণই মুশকিল। ইহার পর দেখা যাইবে দুইজনে দুই দুই চার ব্যাগ বাজার লইয়া দোকান হইতে বাহির হইতেছেন। তাহার পর তাহাদের আইসক্রিম কিংবা ম্যাকডোনাল্ডস কিংবা ডোনার কাবাব জাতীয় কিছুর ক্ষিদা পাইয়াছে। আর ইহার মধ্যে সারাক্ষণই ছবি তোলার হিড়িক লাগিয়া রহিয়াছে। দোকানের রংবেরং এর ডেকোরেশনের সামনে, এলিভেটরের ওপর দাঁড়াইয়া, কফির কাপ সামনে লইয়া, সিটি সেন্টারের ভিতরে–বাইরে কোথায় না ছবি না তুলিলেন তাহারা। নতুন সাজ পোশাক ক্রয় করা আর উহা পরিধান করিয়া ছবি তোলা প্রায় রেওয়াজে দাড়াইয়া গেলো। তিনি অবাক হইয়া প্রথম প্রথম জিজ্ঞাসিতেন, এতো ছবি কি হইবে? স্ত্রী কন্যা গম্ভীর মুখে উত্তর দিতেন, দেশে পাঠাইবেন। তাহারা যে বিদেশে সুখে শান্তিতে আছেন, এই ছবিগুলো হইলো তাহারই প্রতিচ্ছবি। সবাইকে সেই সুখ দেখাইতে হবে না? এই সমস্ত খরচাপাতি যে সব নগদ পয়সায় করিতে হয়, আর সপ্তায় সপ্তায় এতো নগদ খরচ করিবার মতো আয় যে তাহার দোকানে হয় না ইহা বুঝিবার মতো মানসিকতা তাহাদের কিছুতেই হয় না যার ফলশ্রুতি অশান্তি, মনোমালিন্য আর চোখের পানি। এইদিকে কন্যা সারাক্ষণ মুচরাইতে থাকে, তাহাকে এখনো জার্মান দেশখানা ঘুরাইয়া দেখানো হইলো না। বান্ধবীগণদের নিকট কতো গল্প শুনিয়াছে, বইতে – টিভিতে কতো ছবি দেখিয়াছে আর এইখানে আসিয়া আজ এতো দিন হইতে চলিল কোন দর্শনীয় স্থানের মুখ দেখিতে পারিল না।

একদিকে স্ত্রী কন্যা অন্যদিকে পরিবারের চাপ। কিছুটা লুকাইয়া কিছুটা গোপন সঞ্চয় ভাঙ্গিয়া আর কিছুটা ধার করিয়া দুই লক্ষ টাকা পাঠাইয়া বড় ভাইয়ের বাড়িতে ফোন করিলেন, ক্রুদ্ধ বড়ভাই ফোন ধরিলেন না। ক্রন্দন বুকে চাপিয়া রাখিয়া চৌধুরী আলম বড় ভাবির সহিত কুশলাদি বিনিময় করিলেন ও দুই লক্ষ টাকা পাঠানোর সংবাদখানা পৌঁছাইলেন। কিরূপে কি কার্য সমাধা হইতেছে, সব ঠিক করিয়া হইতেছে কিনা খুটাইয়া খুটাইয়া সেই সংবাদগুলানোও সংগ্রহ করিলেন। আর অবাক বিস্ময়ে আবারো লক্ষ্য করিলেন, না ভাবি না ভাতিজি একবারের তরে কহিলেন, “তিনি আসিলে কতো না ভালো লাগিত। কিংবা তিনি কি আসিতে পারেন না জাতীয় কিছু? টাকা পয়সা ব্যাতিরেকে কি সকল সর্ম্পকই ফুরাইল তাহার পরিবারের সহিত? মায়ের জন্যে এতো মন পুড়িয়া যায়। মাকে টেলিফোন করিয়া স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, মা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বাতের বেদনা, পিত্ত দাহ, ডাক্তার, ওষুধ, চিকিৎসা ব্যয়, গ্রামে চিকিৎসা আর চিকিৎসকের অপ্রতুলতা নিয়া কতো শত কথা কহিয়া যান। কিন্তু তাহার কান দুইখানি অপেক্ষা করিয়া থাকে, তিনি কেমন আছেন এইকথা মা কখন জিজ্ঞাসিবেন সেই আশায়। কিন্তু মা নিজের কথা কহিতেই ব্যাকুল তাহাকে শুধান না তেমন কিছুই। হয়তো ধরিয়াই নিয়াছেন বিদেশ মাত্রই সর্বসুখ, পুত্র ভালোই আছে।

কয়দিন ধরিয়াই চৌধুরী আলমের স্ত্রীর শরীরখানা তেমন ভালো যাইতেছে না। খাওয়া দাওয়ার রুচি কমিয়া গিয়াছে, গা ম্যাজ ম্যাজ ভাব, কিছু না হইতেই মেজাজ করিয়া ওঠেন, এমনিতে তিনি যথেষ্ট নম্র স্বভাবের। কয়েকদিন অপেক্ষা করিলেন, ভাবিলেন আপনি সারিয়া যাইবে। একদিন দুর্বলতার কারণে মাথা ঘুরিয়া যাইতে চৌধুরী আলম ভাবিলেন অপেক্ষা করিয়া কাজ নাই, ডাক্তারের নিকট যাওয়াই ভালো হইবে। বলাতো যায় না কিসের মধ্যে কি হইয়া যায় আবার। ডাক্তার এর নিকটতো গেলেন কিন্তু স্ত্রী ঠিক করিয়া তাহার সমস্যা ডাক্তারকে বুঝাইয়া কহিতে পারিতেছেন না। স্ত্রী না কহিতে পারেন জার্মান ভাষা আর না কহিতে পারেন ইংরেজি। তারপর তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি ও জার্মান মিলাইয়া ডাক্তারকে বুঝাইয়া কহিলেন। ডাক্তার সব শুনিয়া প্রস্রাব, রক্তচাপ পরীক্ষা করিয়া, নিশ্চিত হইলেন যে তাহার স্ত্রী আবার মা হইতে চলিয়াছেন। এই সংবাদের চৌধুরী আলম যারপর নাই আনন্দিত হইলেন। অনেকদিন ধরিয়া একখানা পুত্রের আশা তাহার। মেয়ে পরের জিনিস, পরের ঘরে চলিয়া যাইবে, মেয়েতে তাহার আর কি উপকার হইবে? পুত্র পাশে থাকিয়া কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া তাহাকে ব্যবসা বানিজ্যে সাহায্য করিবে। তবেই না সন্তান। আশেপাশের ভাবিদেরকে সুসংবাদ জানাইয়া, অন্য দোকান হইতে মিষ্টি ক্রয় করিয়া সবাইকে বিতরণ করিলেন। এইবার তাহাদের দুইজনেরই একখানা পুত্রের আশা। সেইজন্য নিয়ম করিয়া দুইজনেই পাঁচবেলা নামাজ পড়িতে লাগিলেন, খোদার কাছে কাকুতি মিনতি করিতে লাগিলেন, একখানা সুপুত্র আমাদেরকে দাও রাহমানুর রাহিম। বলা তো যায় না কাহার ডাক তিনি কবুল করিবেন। আশায় বুক বাঁধিয়া অপেক্ষায় দিন গুনিতেছেন চৌধুরী পরিবার।

চৌধুরী আলমের গল্পখানা (তৃতীয় পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=5993f554cae2c2e223665fb434e22aab

চৌধুরী আলম শেষ পর্যন্ত এক বড় ভাইকে ম্যানেজ করিলেন তাহার দোকান পাহারা দিবার জন্যে। ঐ বাঙালি বড় ভাই বহুদিন ধরিয়া জার্মানি আছেন। বেকার সাজিয়া সরকারের ঘর হইতে সরকারি ভাতা তুলেন আবার এমনি বাহিরে অন্যান্য সকলের বিপদে আপদে পয়সার বিনিময়ে সাহায্য তথা উপকার করিয়া থাকেন। বিশ্বস্ততার জন্যে বাঙালি সমাজে উনার প্রায় আলআমিন পর্যায়ের খ্যাতি আছে। মাসিক একখানা মাসোহারার মৌখিক চুক্তি করিয়া, অন্যান্য বন্ধুবর্গের আশ্বাসে কিছুটা নিশ্চিন্ত হইয়া, সারাজীবনের সম্বলখানি অন্যের জিম্মায় রাখিয়া, নানাবিধ উপহার সামগ্রী লইয়া প্রায় সাত বছর পর চৌধুরী আলম পরিবারের সহিত দেখা করিবার উদ্দেশ্যে স্বদেশের পানে রওয়ানা হইলেন। প্লেনে বসিয়া নানাবিধ কল্পনা তাহার মনে রঙ ছড়াইলো, স্ত্রী তাহাকে দেখিয়া কিরূপ ব্যবহার করিবে? সাত বছর হইয়াছে বটে বিবাহের কিন্তু সাত মাসও একসাথে সংসার হয় নাই। সেকি এখনো সেই লাজুক বধূটি আছে? কন্যা তাহাকে চিনিতে পারিবে কি পারিবে না? পিতামাতার সাথে এতোদিন পর সাক্ষাৎ, কেমন আছেন তাহারা? অনেক কি বুড়িয়ে গেছেন? এইরকম সাত পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে তাহার চোখ কখন যেনো লাগিয়া আসিল। আধো ঘুমে আধো জাগরণে পুরো যাত্রা কাটিয়া গেলো আশা আর আকাঙ্ক্ষার দোলাচলে।

বিরাট কোন ঝামেলা ছাড়াই সমস্ত মালপত্র বুঝিয়া পাইয়া তিনি এয়ারপোর্ট হইতে বাহির হইলেন। তাহাকে বরণ করিতে পিতামাতা, শ্বশুর শ্যালক, স্ত্রী কন্যা সকলেই এয়ারপোর্টে উপস্থিত হইয়াছেন দুই গাড়ি সমেত। দেখিয়া তাহার প্রাণ ভরিয়া গেলো। কন্যাকে কাছে ডাকিলে লাজুক মুখে আগাইয়া আসে আবার লজ্জা পাইয়া পালাইয়া যায়। বুকে জড়াইয়া ধরিতে পারিতেছেন না। সকলেই সান্ত্বনা দিলেন, নতুনতো পরিচিত হইলেই বাবার কোলে ঝাপাইয়া পড়িবে। বাবা বলে কথা, রক্তের টান, যাইবে কোথায়? তাহাকে বরণ করিতে তাহার বাটি হইতেও সবাই শ্বশুর বাড়িতে জড়ো হইয়াছেন। রান্না খাওয়া সারা বাড়িতে উৎসবের আমেজ লাগিয়া রহিয়াছে। নিরিবিলিতে যে একটু স্ত্রীর সহিত কথা কহিবেন সে সুযোগও পাইতেছেন না। তিন চারদিন এইভাবে কাটিয়া গেলে, পিতামাতা কহিলেন, কখন বাড়ি যাইবে সে? দুই চারিদিনের মধ্যেই স্ত্রী কন্যা নিয়া বাড়ি আসিবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিতামাতাকে বাড়ি পাঠাইয়া দিলেন চৌধুরী আলম।

আরো দু’চারি দিন বিশ্রাম লইয়া চৌধুরী আলম স্ত্রীকন্যাসহ একখানা মাইক্রোবাস ভাড়া করিয়া নিজ গ্রামে উপস্থিত হইলে, তাহাকে দেখিতে সমস্ত গ্রাম ঝাটাইয়া লোক আসিল। বিদেশ ফেরত চৌধুরী আলম ও তাহার শহরবাসী স্ত্রীকন্যাকে দেখিয়া অনেকেই গোপন ঈর্ষায় লাল হইলেন, মুখে যদিও অন্য কথা কহিলেন। আন্তরিকতার সহিত তাহার খোঁজ খবর লইলেন, তাহাকে কারণে অকারণে তাহাদের কতো মনে পড়ে সেই গাঁথাও জানাইলেন। শ্রেণীভেদে এই শ্রেণীর লোকদের তিনি পঞ্চাশ টাকা-একশ টাকা নজরানা দিলেন। এইভাবে প্রথম কয়েকদিন কাটিয়া গেলো। পিতা আগেই খোঁজ রাখিয়াছিলেন কোথায় কোথায় ধানি জমি বিক্রয় হইবে। একটু অবসর হইতেই পুত্রের সহিত সেই সমস্ত নিয়া বিস্তর আলোচনা করিলেন। পুত্রকে সাথে করিয়া সেইসব জমি দেখিয়া দরদস্তুর করিয়া বায়না করিলেন। পকেটে অনেক কাঁচা টাকাতো ছিল, জমিই ভবিষ্যত পিতার এই অমূল্য উপদেশ স্মরণ করিয়া তাহাতে কোন দ্বিধা রাখিলেন না। আশে পাশে দশ গ্রামে ছড়াইয়া গেলো, চৌধুরী আলম প্রায় জমিদারি খরিদ করিতেছেন, টাকা কোন বিষয় না তাহার কাছে। এরমধ্যেই গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব আসিলেন তাহার কাছে। মসজিদের উন্নতির জন্যে তাহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। সেইখানেও নগদে পঞ্চাশ হাজার টাকা সাহায্য করার ওয়াদা দিলেন। ইহা শুনিয়া চৌধুরী আলমের পিতা কিঞ্চিৎ গোস্বা হইয়া পুত্রকে প্রশ্ন করিলেন-
আমাকে না জানাইয়া এরকম ওয়াদা দিবার মানে কি?

পুত্র উত্তর দিলেন- পিতাজী, শুধু জমি কিনিলেই চলিবে? অত্র এলাকায় মানসম্মান ইজ্জত কামাইতে হইবে না? মসজিদে দান করিলে যতো দ্রুত সমাজে বিশিষ্ট ব্যক্তি হইবার সুযোগ থাকে, শত বিঘা জমি কিনিয়াও তাহা পারিবেন না।

পুত্রের বুদ্ধি দেখিয়া পিতাজী গর্বে আর রা করিতে পারিলেন না। দুইহাত খোদার দরবারে তুলিয়া শোকরানা আদায় করিলেন।

হুজুর তারপরের জুম্মাবারের খুতবায় বারংবার চৌধুরী আলমের নাম স্মরণ করিলেন। জুম্মা শেষ হইতেই সমাজের বিশিষ্টজনের সামনে চৌধুরী আলম তাহার পিতাজীকে সাথে লইয়া পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল মসজিদের ইমাম হুজুরের হাতে দিলেন। ঠিক হইলো, মসজিদের বাইরের দেয়ালের একপাশে চৌধুরী আলমের নাম দানবীর হিসাবে খুদিয়া রাখা হইবে। সমাজে তাহার তথা চৌধুরী পরিবারের ইজ্জত আর একদফা আকাশ স্পর্শ করিল।

চৌধুরী আলমের এইরূপ টাকার খোলামকুচি খেলায়, টাকা দিয়া ইজ্জত কিনিবার নেশায় তাহার স্ত্রী মনে মনে বেশ অসন্তুষ্ট হইতেছিলেন। গ্রামে এসব করিয়া কি লাভ হইবে? সব যাইবে বারো ভূতের পেটে। তাহারা কি গ্রামে আসিবেন? অথচ স্বামী আসিবার পূর্ব হইতেই বাবার সহিত কতো শলা-পরার্মশ ছিল তাহার, এই ঢাকার এককোনে ছোট একফালি জমির, মেয়ে বড় হইতেছে, তাহার ভবিষ্যত। ইহা লইয়া এক প্রত্যুষে স্বামীর সহিত তাহার কিঞ্চিৎ বচসা হইয়া গেলো।

স্ত্রী গম্ভীর মুখে কহিলেন, এইখানে জমি কিনিয়া কি হইবে? আপনার কি ভবিষ্যতে গ্রামে চাষবাস করিবার ইচ্ছা নাকি? তাহা হইলে শহরের কন্যা বিবাহ করিবার কি প্রয়োজন ছিল?
কোন ব্যাপারে প্রায় রা না করা স্ত্রীর মুখ হইতে এহেন বাণী শুনিয়া চৌধুরী আলম প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেলেন প্রথমে। তাহার পর নিজেকে সামলাইয়া লইয়া কহিলেন, জমিজমা না কিনিলে, আমি যে এখন এতো ধনী হইয়াছি, তাহা দশগ্রামের লোকে জানিবে কি করিয়া? নাম কামাইতে হইলে, সমাজে বিশিষ্ট স্থান পাইতে হইলে কি লোককে জানাইতে হইবে না? বিষয় সম্পত্তি লাগিবে না?

কান্না মাখা গলায় স্ত্রী কহিলেন, শুধু লোকের জানাই আপনার কাছে সব? আমার আর আমার কন্যার ভবিষ্যত?

এইবার কিঞ্চিৎ বিপাকে পড়িয়া গেলেন চৌধুরী আলম। আস্তে আস্তে কহিলেন, আস্তে ধীরে টাকা পয়সা জমাইয়া শহরে বাড়ি তিনি নিশ্চয়ই করিবেন। ইহা নিয়া এতো ব্যস্ত হইবার এখনই কিছু নাই। জীবনতো আর শেষ হইয়া যায় নাই। শহরে বাড়ি করিলেতো আর এখানকার মতো সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তি হইতে পারিবেন না। শহরের পাড়ায় পাড়ায় নিশ্চয়ই তাহার ধন সম্পদের চর্চা লোকে করিবে না।

স্ত্রী খানিক বুঝিলেন খানিক বুঝিলেন না। খানিক মানিলেন আর খানিক মানিলেন না। এইখানে বাধা দিয়া পারিবেন না বুঝিতে পারিয়া ছল করিয়া চৌধুরী আলমকে লইয়া বাপের বাড়ি আসিয়া উঠিলেন আবার। বাবাকে ধরিয়া পড়িয়া কহিলেন স্বামীকে বুঝাইতে। স্বামী বুঝিলো বটে কিন্তু সাথে আনা টাকার বিরাট অংশ তিনি গ্রামে জমিদারী জুটাইতে খরচ করিয়া ফেলিয়াছেন, হাতে যাহা আছে তাহাতে ঢাকায় জমি হইবে না। তাহার পরেও শ্বশুরের পরামর্শে আর স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে তিনি একখন্ড জমি দেখিতে গেলেন। জমি পছন্দ হইয়া গেলো, পরে যদি না পান, কিংবা দাম বাড়িয়া যায়? তাই শ্বশুরের পরামর্শে হাতে থাকা বাকি টাকা দিয়া তিনি সেই জমি বায়না দিলেন, জার্মানি যাইয়া বাকি টাকা পরিশোধ করিবেন এই অঙ্গীকারে। এইভাবে মনের সুখে, বড়লোকি আয়েসে কাটিয়া গেলো তিন চার মাস। এইবার আবার ফিরিয়া যাইবার পালা।

ফিরিয়া গিয়া আবার সেই পরিশ্রম, দোকান, ব্যবসা। যদিও এখন মানসিকভাবে অনেক সুখী। যাহাই হোক জীবনে কিছু অর্জন করিয়াছেন তিনি, কঠোর পরিশ্রম কাজে লাগিয়াছে। জমিজামার বিস্তর ছবি উঠাইয়া সাথে লইয়া গেছেন, সুযোগ পাইলেই গুনগুন করিয়া একা একা গান করেন আর ছবি দেখেন, নিজে দেখেন, পরিচিত কেউ দোকানে আসিলে তাহাদিগকেও দেখান। কারো বাড়িতে অনুষ্ঠানাদিতে নিমন্ত্রিত হইলে সেখানেও লাজুক মুখে ছবির এ্যালবামখানি সাথে লইয়া যান। তিনি এখন আর একজন অগাবগা কেউ নন, এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি বলিয়া কথা। কঠিনভাবে কৃচ্ছ সাধন করিয়া পয়সা জমাইতে লাগিলেন আর দেশে পাঠাইয়া ঢাকার জমির দাম পরিশোধ করিতেছিলেন। কিন্তু সবকিছু সবসময় নিজের ইচ্ছামাফিকতো হয় না, বিধির বিধানও থাকে। হঠাৎ করিয়া বিরাট কোন রোগ শোক ছাড়াই চৌধুরী আলমের শ্বশুর ইন্তেকাল করিলেন। জমির মালিকের দিলে রহম কম, তিনি এখন আর অপেক্ষা করিতে চাহিলেন না, বাকি টাকা এককালীন পরিশোধ করিতে তাগাদা দিলেন, নইলে তিনি জমি অন্য জায়গায় বিক্রয় করিয়া দিবেন বলিয়া জানাইলেন। তিনিতো আর তাহাকে জমি বিক্রি করেন নাই, তিনি চিনিতেন তাহার শ্বশুরকে। ভীষণ বিপদে আবার চৌধুরী আলম। শ্বশুরবাড়িতে তাহার মানসম্মানের ফালুদা বাহির হয় হয় অবস্থা। স্ত্রী কান্নার হেঁচকির জন্যে ফোনে কথা কহিতে পারেন না। ভাইয়ের বউদের সামনে তাহার এমন লজ্জা অপমান। উপায়ন্তর না পাইয়া স্থানীয়ভাবে ঋণ করিয়া ঢাকার জমির ধাক্কা সামলাইলেন চৌধুরী আলম।

জমির পর শুরু হইলো আর এক নয়া ঝামেলা। স্ত্রী বাপের বাড়িতে আর থাকিতে চাহেন না। বাবা না থাকিলে আবার কিসের বাবার বাড়ি। ভাইদের সংসারের গলগ্রহ হইয়া কি তিনি আর তার কন্যা জীবন পার করিয়া দিবেন? বিদেশের মুখ, সংসারের মুখ দেখিবার সাধ কি তাহাদের হয় না? চৌধুরী আলম বার বার বুঝানোর চেষ্টা করিলেন, বিদেশ বলিতে দেশ হইতে মানুষ যাহা বুঝে আসলে সেইরকম কিছু ব্যাপার নহে। প্রচুর খাটুনি ও খরচ। কিন্তু তাহার স্ত্রী নাছোরবান্দা। মাঝে মাঝে কন্যাও সেই গানে যোগ দিয়া পিতাকে আরো বিপদে ফেলে। উপায়ন্তর না দেখিয়া চৌধুরী আলম কহিতে বাধ্য হইলেন, ঢাকার জমির ঋণ শোধ না হইবা পর্যন্ত তাহাদের জার্মান আনিয়া বাসা করিয়া রাখার সামর্থ্য তাহার নাই। মনোমালিন্যের মধ্যে কয়েক বৎসর পার করিলেন। জমির ঋণ শোধ করিলেন। চৌধুরী আলমের কি ইচ্ছা করে না পরিবার সাথে রাখিতে? কিন্তু আবার নানান কথা ভাবিয়াও থাকেন তিনি। এখানে আনিলে কন্যা জার্মান ভাষা শিখিবে, ইহুদি নাসারাদের মতো পোশাক আশাক পরিধান করিবে, বাবা মাকে হয়তো মান্য করিবে না, দেখা যাইবে গোরার সহিত ভাগিয়া গিয়াছে, উহ আর কল্পনা করিতে পারেন না। স্ত্রীকে এইগুলা বুঝাইবার বহু চেষ্টা করিয়াছেন। আল্লাহপাক তাহাদেরকে ছেলে সন্তানতো দেন নাই, বংশের মর্যাদা ভাবিতে হইবে না? ঢাকাতেই বাপের বাড়ির কাছে আলাদা বাসা ভাড়া লইয়া দিবেন কহিয়াছেন, মেয়ের ইজ্জত তাহাদের ইজ্জত নিয়া কহিয়াছেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হইলো না। স্ত্রীর এক কথা, আরো মানুষ কি থাকিতেছে না? শীঘ্রই লইয়া যাও।

চৌধুরী আলম বহুভাবে বলিবার চেষ্টা করিলেন, পরিবার সাথে থাকিলে এখন যেমন তরতর আগাইতেছেন, পয়সা জমাইতেছেন, সেই সুযোগ আর থাকিবেনা। পরিবার থাকা মানেই বহু খরচ। ইহাতে ফল হইলো উলটা। স্ত্রী কাঁদিয়া কাটিয়া সন্দেহের তীর ছুড়িয়া কহিলো, তিনি শুনিয়াছেন, বিদেশে অনেক পুরুষই একখানা করিয়া বিদেশী বউ রাখে আর দেশে রাখে একখানা। তাহার কি সেইরকম কেইস নাকি? তাহা হইলে যেনো তিনি জানাইয়া দেন, স্ত্রী আর তাহাকে কাঁদিয়া পেরেশান করিবে না। চৌধুরী আলম সুখে যেনো বিদেশী বউ লইয়া ঘরকন্না করেন, তিনি আর পথের কাঁটা হইবেন না। চৌধুরী আলমের চরম অনিচ্ছা থাকা সত্বেও দাম্পত্য কলহের কারণে তাহাকে পরিবার আনতে রাজি হইতে হইলো। স্ত্রীর কান্নায় পরাস্ত হইয়া তাহাদেরকে আনিবার কাগজপত্র ঠিক করায় মনোনিবেশ করিলেন। তাহাকে এখন সরকারের ঘরে বহু টাকার কর গুনিতে হইবে, মূর্খ মেয়েছেলে তাহার কি বুঝিবে? এতোদিন তিনি ব্যবসায় লোকসান দেখাইয়া আয়কর থেকে স্বাস্থ্যবীমা, বাড়িভাড়া, তাহার জ্ঞানের মধ্যে যাহা আছে সবকিছু ফাঁকি দিয়াছেন। এখন প্রথমে তাহাকে পরিবার আনিবার অনুমতি করানোর জন্য সরকারকে দেখাইতে হইবে তিনি স্বচ্ছল। একমাসের আয় দেখাইয়া এই অনুমতি মিলিবে না। কমপক্ষে তিন থেকে ছয়মাসের কাগজপত্র চাহিবেন তাহারা। সন্দেহ করিলে আরো বেশিদিনেরও চাহিতে পারেন। একমাসে আয় যেমন অনেক বাড়াইয়া দেখাইতে পারিবেন না, পরের মাসে আবার আয় অনেক কমও দেখাইতে পারিবেন না। পরিবার পালন করিবার মতো যথেষ্ট আয় না থাকিলে পরিবার আনার অনুমতি মিলিবে না। আর এই যথেষ্ট আয়কে সেট করিতে বহুটাকার আয়কর গুনিয়া তাহাকে আপাতত ফতুর হইতে হইবে। এতোদিন জার্মান সরকারের সহিত ইঁদুর বিড়াল খেলিয়া চলিয়া গিয়াছে। সেইদিন এখনকার মতো ফুরাইলো। এইসব ভাবিলেই তাহার মুখ তিতা হইয়া বুকে বুকে চিন চিন ব্যথা শুরু হইয়া যায়।

দোকানের ওপরের ফ্ল্যাটখানার জন্যে বহুদিন ধরিয়া বাড়িওয়ালার নিকট ধর্ণা দিয়াছিলেন তিনি। এতোবছর বাদে আল্লাহ মুখ তুলিয়া চাহিলেন। ভাড়াটিয়া বিদায় হইলে বাড়িওয়ালা তাহার আবদার পূরণ করিলেন। এইবার প্রায় পাঁচ বছর বাদে দেশে আসিয়াছেন তিনি। স্ত্রী কন্যাকে সাথে লইয়া যাইবেন, পাসপোর্ট ভিসার হাঙ্গামা লইয়া ব্যস্ত তিনি। কন্যার বয়স এখন বারো, ক্লাশ ফাইভে পড়ে। বারো বছরে কন্যার সহিত তাহার এই লইয়া দুইবার দেখা। কন্যাকে দেখিলে তাহার বুক ধড়ফড় করে। বাড়ন্ত গড়ন, বয়স বারো কিন্তু দেখায় চৌদ্দ পনের। কি করিবেন, কি বিপদে পড়িবেন এই সমস্ত দুঃশ্চিন্তায় তাহার ঘুম হারাম। ঐদিকে স্ত্রী কন্যা মনের সুখে বাজার করিতেছেন বিদেশ যাওয়াকে উপলক্ষ্য করিয়া। স্ত্রী’র সহিত আলোচনা করার চেষ্টা করিয়াও তিনি ক্ষান্ত দিয়াছেন, তাহার এই সমস্ত সম্পর্কে কোন ধারণাই নাই বলিয়া আলোচনা আগাইতে পারে না। এমনিতে ইহুদি নাসারাদের ওপরে তাহার সেইরকম ঘৃণা নাই, সবাই আল্লাহর তৈরি। শুধু আখিরাতে কেউ যাইবে বেহেস্তে আর কেউ যাইবে দোজখে, এটাই কথা। কিন্তু তিনি তাহার পরিবার নিয়া সর্বাবস্থায় ঈমানের রাস্তায় থাকিতে চান। তারচেয়েও বড় কথা, কন্যাসন্তান হইলো পরিবারের মর্যাদা। তাহা নষ্ট হইলে কিভাবে সমাজে মুখ দেখাইবেন? এতো বড় চৌধুরী বংশের সম্মানের কথা তিনি ভাবিবেন নাতো কে ভাবিবে?

শুয়োর খাওয়া ছেলেমেয়ের সহিত একসাথে পড়িয়া তাহার কন্যার মতিগতি কোন দিকে যাইবে কে জানে? ইসলামিক মনোভাব কায়েম থাকিবেতো? কিছু কিছু দেশী পরিবারের এই অশান্তিতো তিনি নিজ চোখে দেখিতেছেন। আর এই নাছারা স্কুলে নিজের অধিকার, মর্যাদা, কোথায় গেলে কি সাহায্য পাওয়া যাইবে, বিপদে পড়িলে কোথায় যাইতে বা ফোন করিতে হইবে সব শিখাইয়া পড়াইয়া দেয়। ছেলেমেয়েকে ঠিকমতো শাসনও করা যায়না ইহাদের জ্বালায়। বাবামায়ের সাথে মনোমালিন্য হইলেই ছেলেমেয়েরা আঠারোতে পা দিয়াই বাটির বাহিরে থাকিতে শুরু করে। বাধা দিবার কোন উপায় নাই, তাহারা পুলিশের সাহায্য নিবে দরকার হইলে। বাবামায়ের কোন শাসন বারণই শোনে না। এইসব ভাবিয়া ভাবিয়া তিনি ঠিক করিলেন, স্কুলই যেহেতু সকল নষ্টের গোড়া, তিনি কন্যাকে স্কুলে পড়াইবেন না। বাটিতে বসিয়া সে নিজে পড়াশোনা করিবে, তাহার পর দেশে আসিয়া ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়া যাইবে। যাহা ভাবা তাহাই কাজ। দেশ হইতে এস.এস.সি পরীক্ষা পর্যন্ত যতো বই, নোটবই আছে সব কিনিয়া সাথে লইলেন। তাহার পর এক প্রত্যুষে তাহারা পুরো পরিবার জার্মান দেশের উদ্দেশ্য প্লেনে উড়িলেন।

চৌধুরী আলমের গল্পখানা (দ্বিতীয় পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=d42674673d236f835ca995dc02d372c3&nttl=147292

আপনজনের নিকটে যেই স্নেহ ভালোবাসা আশা করিয়া আসিয়াছিল চৌধুরী আলম তাহার কোনো প্রতিফলন দেখিতে পাইলো না সে কোথাও। যাহা হউক মনের কষ্ট কাহাকেও বুঝিতে না দিয়া এক প্রকার হাসিমুখেই সে সকলের সহিত দিন কাটাইতে লাগিল। কিছুদিন বাদে পিতামাতা জিজ্ঞাসিলেন, কি অবস্থা, কয়দিনের ছুটি, কি করিতে চায়? সে বলিল, ছুটির সমস্যা নাই। কাজের জায়গায় বলিয়া আসিয়াছে, বিবাহ সম্পন্ন করিবে সুতরাং তাহার ফিরিতে বিলম্ব হইতে পারে। তবে কাজ না করিলে বেতনও পাইবে না। তাহাতেও সমস্যা নাই, সাথে যাহা নিয়া আসিয়াছে আপাতত: বিবাহ পর্যন্ত সে ম্যানেজ করিয়া লইতে পারিবে। এইবার পিতাজী বলিলেন, কতো লইয়া আসিয়াছে সাথে। কতো বলিতে গিয়া হঠাৎ চৌধুরী আলমের কি জানি মনে হইল, সে এদিক ঐদিক করিয়া হাত কচলাইয়া কেনো জানি কথা এড়াইয়া যাওয়ার চেষ্টা করিতে লাগিল। ইহাতে পিতাজী নাখোশ হইয়া কহিলেন, বিবাহের খরচ আর আয়োজনের ব্যাপারে যেনো সে তিনার আশা না রাখেন। মুখ ভোঁতা করিয়া চৌধুরী আলম চক্ষু নীচের দিকে নামাইয়া বসিয়া রহিলো অধোবদনে। পিতাও কিঞ্চিৎ রাগত হইয়া প্রস্থান করিলেন।


এদিকে চতুর্দিকে বার্তা রটিয়া গেলো এবার চৌধুরী আলম বিবাহ করিতে আসিয়াছে। সঙ্গে করিয়া বহু কিছু আনিয়াছেন তাহার হবু বধূর জন্যে। কে হইবে সেই ভাগ্যবতী। পিতা জড়াইবেন না জড়াইবেন না করিয়াও তাহার বিবাহে জড়াইয়া গেলেন। কিছুটা পুত্রস্নেহ আর কিছুটা বাহিরের মানুষের ধরাধরি। বাহিরের মানুষতো আর তাহাদের অন্তরের কথা জানেন না। নিকট আত্মীয়স্বজন হইতে শুরু করিয়া দুঃসম্পর্কীয়, পাড়া প্রতিবেশী হইতে শুরু করিয়া দশ গ্রাম দূরে প্রত্যেকের সন্ধানেই দেখা গেলো এক কিংবা একের অধিক সুকন্যা আছে। প্রত্যকেই তাহার ভাইঝি, বোনঝি-এর গুণগানের বিস্তারিত বিবরণ গাহিয়া গেলো। এরচেয়ে সুকন্যা যে আর কিছুতেই পাওয়া যাইবে না তাহাও জোর দিয়া বলিয়া গেলেন। কোনো কন্যা ম্যাট্রিক পাশতো কোন কন্যা ফেল করিয়া আবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আবার কেউ কেউ ক্লাশ সেভেন এইটে আছেন, উচ্চবংশ, সুন্দরী, রন্ধনে নিপুনা ইত্যাদি। তবে তাদের প্রত্যেকের মাঝেই একটা জিনিস আছে, তারা সবাই পর্দানশীন ও সবাই বার কয়েক করিয়া কোরান খতম দিয়াছেন। এই সমস্ত সম্বন্ধের মধ্যে হইতে পিতাজী বাছিয়া খুঁজিয়া যাহাকে যাহাকে পুত্রের উপযুক্ত মনে করেন তাহাকেই চৌধুরী আলম পিতাজীর সহিত দেখিতে যান। খানিকটা রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পের অপূর্বের মতোন সাজিয়া বাছিয়া তিনি বাহির হন। কিন্তু কিছুতেই তিনি তাহার মনের মতো পাত্রী খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না। ইহাদের মধ্যে কি জানি নাই যাহা তাহার চাই।


পিতাজী দিনের পর দিন পুত্রের মতি না খুঁজিয়া পাইয়া রাগান্বিত হইতেছিলেন। সম্ভ্রান্ত সমস্ত লোকদের তিনি কি জবাব দিবেন? উপায়ান্তর না দেখিয়া চক্ষুলজ্জা কাটাইয়া চৌধুরী আলম কহিয়া ফেলিলেন, তিনি শহুরে মেয়ে বিয়ে করিতে চান। গ্রাম্য ললনা তাহার প্রবাস জীবনে পোষাইবে না। পিতা আর কি করিবেন, একে ছেলে সাবালক তায় আবার প্রবাসী হইয়াছে। কিন্তু দুঃশ্চিন্তায় পড়িলেন শহরের লোকেরা প্রবাসী পাত্রের কদর কতোখানি বুঝিবেন কে জানে? মনের মতো যৌতুক আদায় করিবার বাসনা পিতাজীকে আপাতত শিকায় তুলিয়া রাখিয়া পুত্রের জন্যে শহুরে কন্যার সন্ধান করিতে হইতেছে। মনে মনে পিতাজী বাসনা রাখিয়াছিলেন, গ্রামের সম্ভ্রান্ত স্বচ্ছল ঘর দেখিয়া পুত্রকে বিবাহ করাইয়া দিবেন, পুত্র চলিয়া গেলে তিনি এইটা ওইটা উছিলা করিয়া পাত্রী পক্ষ হইতে জিনিসপত্র আদায় করিতে থাকিবেন। যাউক গুড়েতো বালি পড়িয়া গেলো, কি আর উপায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করিয়া, ঘটকদের মোটা টাকা সালামি প্রদান করিয়া শেষ পর্যন্ত পুরান ঢাকাতে চৌধুরীদের বংশ মর্যাদার সহিত খাপ খায় এমন একটি উচ্চবংশীয়, ইসলামিক ভাবধারার সুন্দরী গুণবতী কন্যার সন্ধান মিলিলো। কন্যা পর্দা ঢাকা রিকশায় করিয়া স্কুলে যাইতো আসতো, কাক পক্ষীও তাহার বদন দেখিতে পাইতো না। এইবার ম্যাট্রিক দেবার কথা ছিল কিন্তু বিবাহের পর আর মেয়েদের পড়াশুনার কি দরকার আছে? আর আলেমদের কথা মতো, স্বামীকে চিঠি লিখিবার মতো বিদ্যা থাকিলেই মেয়েদের জন্য যথেষ্ঠ, এর বেশি দরকার নাই। বেশি পড়াশোনা জানা কন্যা স্বামীকে মান্য করিবেন না, বেয়াদব হইবে এই ব্যাপারে কন্যার পিতা আর পাত্রের পিতা দুজনেই একমত পোষন করিলেন।


সকলের সম্মতিতে, আনন্দের সহিত চৌধুরী আলম দেশে ফিরিয়া আসার প্রায় তিন মাসের মাথায় শুভ পরিণয় সম্পন্ন করিলেন। কন্যার পিতা তাহার সাধ্যমতো মেয়েকে জামাইকে সাজাইয়া গুছাইয়া দিলেন। একে প্রবাসী পাত্র তায় আবার চৌধুরী বংশ। কন্যার পিতা কোন কসুর রাখলেন না। ঐদিকে বিবাহের খরচাপাতি নিয়া পিতা পুত্রের মধ্যে আর একদফা মনোমালিন্য হইয়া গেলো। চৌধুরী আলমের সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বিবাহে এইভাবে উৎসব করিবে যে দশ গ্রামের লোক জানে, জার্মান প্রবাসী চৌধুরী আলমের বিবাহ হইতেছে। অনেকদিন লোকের মুখে মুখে তাহার বিবাহ উৎসবের গল্প আলোচনা ফিরিবে। সেরকম বন্দোবস্ত তথা টাকার যোগাড়ও সে রাখিয়াছিল। কিন্তু পিতাজী চান যতোটা সম্ভব নিজেদের বাঁচাইয়া কন্যার বাপের ওপর দিয়া পার করিয়া দিতে। একেতো শহরে বিবাহ, পুলিশের ভয়ে যৌতুকের নাম মুখে আনিতে পারিতেছেন না তাহার ওপর পুত্রের এরকম নাদানী, কাঁহাতক সহ্য হয়। চৌধুরী আলম পিতার চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করিয়া যতোদূর সম্ভব ধুমধাম করিবার চেষ্টা করিলেন। পরে ভাবিলেন অশান্তি করিয়া কি লাভ? একবার বিবাহ হইয়া যাক, পিতাজীতো তখন কাছে বসিয়া থাকিবে না, তখন বউকে ইচ্ছামতো কেনাকাটা করিয়া দিলেই হইবে। বিবাহসম্পন্ন হওয়ার পর নানা উছিলায় নববধূকে নিয়া চৌধুরী আলম শ্বশুরালয়েই দিন কাটাইতে লাগিলেন। বাড়ির সহিত যোগাযোগ বলিতে মোবাইল ফোন। তবে তিনি নিয়ম করিয়া প্রত্যেক দিন মাতাকে ফোন করিতেন, এই নিয়ম চৌধুরী আলম কিছুতেই ভঙ্গ করিতেন না।


এদিকে চৌধুরী আলমের পিতাজী দুঃশ্চিন্তায় পড়িয়া গেলেন, চার মাস গত হইয়া পাঁচ মাসে পড়িতে চলিলো এখনো ছেলে ফিরিয়া যাবার নাম করিতেছেনা, ঘটনা কি? তিনি পুনঃ পুনঃ তাগাদা দেয়া সত্বেও পুত্র বাড়িতে আসিতেছে না উল্টা তিনাকে এড়াইয়া চলিতেছে, এহেন নাফরমানি পিতার সহিত পুত্রের কি করিয়া সম্ভব? মুখে প্রকাশ করিতে না পারিলেও ইহার জন্যে তিনি মনে মনে নতুন বউমার ওপর খানিক নাখোশ হইলেন। চৌধুরী আলমই বা কি করিবেন? বিবাহ করিয়াছেন মাত্র দুইমাস। নতুন বউকে ছাড়িয়া যাওয়া সম্ভব? আবার কবে না কবে আসিতে পারিবেন তাহার কি ঠিক আছে? কবে আবার বউয়ের মুখখানি করতলে লইয়া এইভাবে চুম্বনে আবিষ্ট করিতে পারিবেন? নতুন বউয়ের অনাঘ্রিত সুঘ্রাণ আহরণে চৌধুরী আলম এখন মাতোয়ারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তবু চলিয়া যাইতে হইবে। তাহার ছুটি প্রায় ছয় মাসে যখন পড়িল পিতা রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে তাহার শ্বশুরালয়ে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখা গেলো শ্বশুরও মুখে কিছু না বলিলেও ইষৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, প্রবাসী জামাইয়ের ঘরজামাই হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা লইয়া। পিতাজী শ্বশুরালয়ে এমন কুৎসিত দৃশ্যের অবতারণা করিতে পারেন তাহা যদি চৌধুরী আলমের ধারণায় থাকিতো তাহা হইলে বহু আগেই বাক্স প্যাটরা লইয়া সে উধাও হইয়া যাইতো। অপমানে লজ্জায় সে আর তাহার অর্ধাঙ্গীনি মাটিতে মিশিয়া গেলো।


নববধূকে অশ্রুজলে ভাসাইয়া দিয়া, নিজের অশ্রু কোটের খুঁটায় মুছিয়া ভগ্ন হৃদয়ে সকলের নিকট হইতে বিদায় নিয়া প্রায় ছয় মাস পর এক সকালে চৌধুরী আলম আবার জার্মারির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলেন। এবারের যাত্রা পুরাই ভিন্ন। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী আর আনন্দে ভরপুর। যদিও পুরা শরীর পুড়িয়া যাইতেছিল নবপরিনীতার লাগিয়া। বিরহ শব্দটি পুস্তকে পড়িয়াছিলেন বটে আজ উপলব্ধি করিলেন। জার্মানি পৌঁছিয়া শুরু করিলেন আবার সেই জীবনযুদ্ধ। কাজ খুঁজিয়া বাহির করো, বাসা খুঁজিয়া বাহির করো, মাথা গোঁজার ঠাই চাই ইত্যাদি। ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল। ইহার মধ্যে দেশ হইতে একখানা সুখবর আসিল। তাহাদের সন্তান হইবে। তিনি দেশে থাকিতে বুঝিতে পারেন নাই তাহার স্ত্রী কিন্তু এখন লক্ষণ একেবারেই স্পষ্ট। তিনি, তাহার পিতামাতা ও শ্বশুরকূল সকলেই আনন্দে ভাসিয়া যাইতে লাগিল। সকলেই পরম করুনাময়ের কাছে হাত উঠাইয়া কহিলেন, একখানা পুত্র সন্তান দিও খোদা। আনন্দে পাগল চৌধুরী আলম বারংবার করিয়া স্ত্রীকে নিজের স্বাস্থ্যের আর খাওয়া দাওয়ার প্রতি যত্ন রাখিতে বলিলেন। তিনি কাছে নাই, থাকিলে না জানি কি করিতেন এই সময়ে। কিছুতেই যেনো কোনো অবহেলা না হয় আর সাবধানে চলাফেরা করিতেও বলিলেন। টাকা পয়সার চিন্তা করিতে না করিলেন, তাহার জন্যে তিনি আছেন।


যথাসময়ে তাহাদের ঘর আলো করিয়া তাহার স্ত্রী ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। যদিও পুত্র সন্তানের জন্যেই কামনা ছিল কিন্তু কন্যা সন্তানেও তিনি খুশী হইলেন। তাহার শ্বশুরকূলও আনন্দিত হইলো। শুধু চৌধুরী আলমের পিতা একটু মনক্ষুণ্ন: হইলেন, বোউটি কোনো কর্মের নহে। চৌধুরী আলম প্রবাসে থাকেন বলিয়া বোউ মাঝেসাঝে শ্বশুরবাড়ি যাইয়া বেড়াইয়া আসিতেন, কিন্তু পাকাপাকিভাবে থাকিতেন বাপের বাড়িতে। শ্বশুর এই সুযোগ কাজে লাগাইয়া, বউয়ের খরচাপাতি সবই বউয়ের বাপের ওপর গছাইয়া দিতেন। এতোদিন চৌধুরী আলমের বউ লজ্জায় মুখ ফুটিয়া স্বামীকে কিছু বলিতে পারিতেন না আবার ঐদিকে পিতৃকূলের কাছেও ছোট হইয়া থাকিতেন, শ্বশুরের এইরকম ছোটলোকিপনায়। কিন্তু এখন সন্তানের জন্মের পরে খরচ বাড়িয়া গেছে কয়েকগুন, এখন আর স্বামীকে নালিশ না করিয়া উপায় রইলো না। নালিশ শুনিয়া চৌধুরী আলম তেলে বেগুনে জ্বলিয়া গেলেন নিজ পিতামাতার ওপর। বৌ আর কন্যার জন্যে তিনি আলাদা মানিঅর্ডার করিলেন। এই কথা আবার চার কান ঘুরিয়া চৌধুরী আলমের পিতাজীর কানে পৌঁছাইয়া গেলো। তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া ছেলের মুখ দর্শন না করার কথা ঘোষণা দিলেন। আর বউকেও ফোন করিয়া যাহা নয় তাহা কহিলেন। এমতো পরিস্থিতিতে চৌধুরী আলমের সাথে তাহার পরিবারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া গেলো। হতাশায় তাহার চোখ গড়াইয়া পানি বাহির হইতে থাকে, এতোকিছু করিবার পরও কোনো দোষে আজ সে পিতামাতার নিকট পাতক হইয়া গেলেন? এদূর প্রবাসে কাহাদের সুখের জন্যে পড়িয়া থাকিয়া তিনি এই কষ্ট করিতেছেন?


এদিকে তিনি কি খুব সুখে কালাতিপাত করিতেছেন? যেই রেস্টুরেন্টে তিনি কাজ করেন, সেইখানে প্রতিনিয়ত তাহাকে ঠকানো হইতেছে। তাহার ন্যায্য বেতন যদি হয় একশত টাকা, তাহাকে দেয়া হয় ষাট হইতে সত্তর টাকা। তাহাছাড়া খারাপ ব্যবহারতো আছেই। যেহেতু খুব ভালো করিয়া জার্মান বলিতে পারেন না তাই চট করিয়া অন্য কোনো ধরনের চাকরি পাওয়ার সম্ভবনাও খুব কম। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন? বয়স হইতে চলিল, এই অনিশ্চয়তার সহিত এই পরিশ্রম আর শরীর নিতে চাহে না। বেতন যে কম দেয় শুধু তাহাই নহে, এই কম টাকাখানি দিতেও মালিক প্রায় সময়ই গড়িমসি করিতে থাকেন। একমাসের বেতন দিতে তিনমাস ঘুরান। তাহা নিয়ে চৌধুরী আলম আর তাহার মালিকের মধ্যে মনোমালিন্য বাড়িতেই থাকিল। কিন্তু করিলেই বা কি করিবেন। সব মালিকপক্ষই এরকম, গরিব ঠকানোর তালে থাকেন। ঐদিকে দেশ হইতে স্ত্রী কন্যার খরচার চাপও আছে। শেষমেষ অনেক ভাবিয়া, বন্ধু বান্ধব আর পরিচিতজনদের নিকট বিস্তর ধার দেনা করিয়া নিজে একখানি মনোহারি দোকান দিয়া বসিলেন। বাংলাদেশের তাজা শাক সব্জি, মসলা আর মাছ বিক্রি করিবেন। বাঙালি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি তথা এশিয়ান আছে প্রচুর এ তল্লাটে, দোকান না চলার কোনো কারণ তিনি প্রথমে দেখিতে পান নাই। দোকান দিয়া তাহার পর বুঝিলেন, মানুষ আছে প্রচুর আর দোকানও আছে প্রচুর। পয়সা কামানো আসলে ততো সহজ কিছু নহে।


নানাবিধ ঝামেলায় পড়িয়া, বিভিন্ন প্রকারের ট্যাক্স, দোকানের মালামালের কোয়ালিটি চেক, এক্সপায়ারি ডেট চেক, সব্জি পঁচিয়া যাওয়া ইত্যাদির লোকসান সহকারে জানিলেন ব্যবসা আসলে সহজ চিজের নাম নহে। বাহির থেকে যেমন মনে হয়, আমার মতো আমি পসরা সাজাইয়া দোকান নিয়া বসিয়া গেলাম ঘটনাটা পুরোপুরি তাহা নহে। তাহার পরেও মুরুব্বিদের আশীর্বাদে বিস্তর জুঝিয়া শেষ পর্যন্ত মনে হয় টিকিয়া গেলো চৌধুরী আলম তাহার দোকান নিয়া। কিন্তু ইহার মধ্যে বছর কয় গত হইয়া গিয়াছে। এতো অত্যাধিক পরিশ্রম আর দুঃশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে কালাতিপাত হইয়াছে যে, কখন দিন গত হইয়া মাস আর মাস গত হইয়া বছরে পড়িয়াছে তাহার হিসাব চৌধুরী আলমের কাছে আর নাই। ইহার মধ্যে ছিল ক্রমাগত পাওনাদারদের তাগাদা। কিন্তু এখন দিন কিছুটা ঘুরিয়াছে। আস্তে আস্তে ঋণও শোধ হইয়া আসিয়াছে। এখন মাঝে মাঝে মন চাহিলে মুক্ত হাওয়ায় মন ভরিয়া নিঃশ্বাসগ্রহণ করিতে পারেন সে। দেশে যাইতে পারেন নাই আর এই সময়ের মধ্যে। টাকা পয়সার টানাটানিতো ছিলই, সাথে ভয় কাহার কাছে তাহার দোকান গচ্ছিত রাখিয়া যাইবেন? এই ব্যবসা তাহার সারাজীবনের সম্পদ, কামাই, ভবিষ্যত। কিন্তু টেলিফোনে সবসময় দেশের খবরাখবর রাখিতেন। তাহার কন্যার বয়স এখন ছয়। স্কুলে ভর্তি করিয়া দেয়া হইয়াছে। টেলিফোনে তাহার সহিত টুকুর টুকুর কথা কহে। ছবিতে ছবিতে পিতা কন্যার পরিচয়। আর কন্যার কথা কহিয়া কি লাভ? সেই সাত বছর আগে মাস তিনেকের সংসার স্ত্রীর সহিত। স্ত্রী স্বয়ং সামনে আসিয়া দোকান হইতে কেনাকাটা করিয়া গেলেও সে ছবি ছাড়া চিনিতে পারিবে কিনা সন্দেহ। বাকি ঘর সংসারতো সে টেলিফোনেই করিল। তবে টাকা পয়সার দুরবস্থা এখন কাটাইয়া উঠিয়াছে সে। এবার কিছুদিনের জন্যে বাড়ি যাইবে বলিয়া মনস্থির করিয়াছে। বিশ্বস্ত বন্ধু বান্ধবের দ্বারস্থ হইতেছে সে দোকান নিয়া। একটা না একটা কিছু উপায় হইয়া যাইবে এই আশা মনে রাখিয়া সে দেশে যাইবার যোগাড়যন্ত্রে আঁটগাঁঠ বাঁধিয়া নামিল।

জীবন থেকে নেয়া (টুকরা টাকরা গল্প)



আজকাল সাংবাদিকরা সবাই একযোগে এক কাজ করেন। বিশেষ করে কোন একটা কিছু হিট হয়ে গেলেতো কথাই নাই। সবাই তার পিছনেই ছুটবেন। ফেব্রুয়ারীতে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় যেয়ে বাচ্চা আর বাচ্চার মায়েদের প্রশ্ন করা কেনো এই বইমেলা, একুশে ফেব্রুয়ারী মানে কি জানেন কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময়ই যেসব মায়েরা বা তাদের বাচ্চারা সঠিক উত্তর দিতে পারে না, তাদের সাক্ষাতকার চ্যানেলে প্রচার করা, সব চ্যানেলেই মোটামুটি এই কাজটা গেলো দু/তিন বছর ধরে যত্নের সাথে করে যাচ্ছে। এই কাজটা করা তাদের নৈতিক সাংবাদিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে। মেয়ের বাবা বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাসের জ্ঞানের এই বহর দেখে, এই পরিনতি নিয়ে যারপর নাই হতাশ। বিদেশে বসে নৈতিক হতাশা জ্ঞাপন করেন আর দেশের কি হবে ভেবে নিয়মিত আফসোসায়িত হন। আমি একদিন বল্লাম, চ্যারিটি বিগিনস এট হোম, তোমার মেয়েকেতো এতো একুশের প্রোগ্রামে নিয়ে গেছো, একুশে নিয়ে জ্ঞান দিয়েছো, কাঠ বিড়ালী কাঠ বিড়ালী আবৃত্তি করিয়েছো সাড়ে তিন বছর বয়েসে, তখনো বাংলা অক্ষর জ্ঞান নেই, কিন্তু ছড়া মুখস্থ করিয়েছি, জিজ্ঞেস করোতো ডেকে একুশে ফেব্রুয়ারী কি ব্যাপার? মেয়ের বাবা মেয়েকে ডাকলেন। মেয়ে নিনটেনডোতে গেম খেলতে খেলতে নিতান্ত অনইচ্ছুক গলায় বললো, জানিতো, পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল। ব্যাস, শুধু মাথায় এটাই আছে যে পাকিস্তানিরা খুব খারাপ, বাংলাদেশীদের সাথে যুদ্ধ করেছে তাই যেকোন প্রশ্নে এই কুমীর ছানা প্রদর্শন হয়ে যায়। মেয়ের বাবা যখন বলতে গেলেন আবার একুশের ফেব্রুয়ারী আসলে কি ব্যাপার তখন আবার আরো ব্যস্ত গলায় জানিয়ে দিলো কন্যা, আমিতো জানি জানি।

কিন্তু হরতাল কি সেটা জানে বিদেশে বসে। নিজ দায়িত্বেই জানে। মিছিল দেখে, ধাওয়া পালটা ধাওয়া দেখে, বানান করে ব্যানার পড়ে আর জিজ্ঞেস করে এরা কি হরতালের পক্ষে বলছে না বিপক্ষে বলছে? কেনো একজন বাংলাদেশী আর একজন বাংলাদেশীকে মারছে? বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সালাম – নমস্কার। প্রবাসে থাকা বাচ্চারাও জানে বাংলাদেশে কিছু একটা হয় যার নাম “হরতাল”। এখানে বসে বাচ্চাদেরকে “হরতাল” কি বস্তুর নাম তা ব্যাখা করা মুশকিল। আসলে তারচেয়েও বড় কথা হরতাল কি তাতো নিজেও জানি না। এটার উদ্দেশ্য বিধেয়ওতো জানি না। জানি কথায় কথা না মিললে মারামারি করার উছিলার নাম হলো হরতাল। হরতাল মানে ছোটবেলা থেকে দেখেছি, টায়ার পোড়ানো, কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া, দু চারজন টোকাই আর ছাত্র মারা যাওয়া, তা নিয়ে আবার মিছিল, বাসে আগুন, হল খালি, পরীক্ষা পিছানো, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, যার সাথে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী কিংবা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষদের আসলে কোন যোগাযোগ নেই। প্রতিবাদ এখানেও হয় তবে তার গড়ন ধরন এতো অন্য যে বাচ্চাকে কিছু বুঝাবো তো কি বুঝাবো? এপার থেকে ওপারের ঘটনা দেখলে অনেক সময় ছোটবেলায় দেখা টারজান সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। নেংটি পড়া জংলীরা যে তীর ধনুক নিয়ে মারামারি করতো, এখানে নেংটির বদলে আলখাল্লা পড়া থাকে এই যা পার্থক্য।

আমাদের ছয় বছরের আরভিন তার মায়ের সাথে শান্তিনিকেতন বেড়াতে গেছে। আমাদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে তার মাকে জিজ্ঞেস করেছে, এতো বড় বাড়ি কার? কে এই ভদ্রলোক? তার মা তাকে ব্যাখা করেছে পড়ে সে অবাক হয়ে বলেছে, শুধু স্টোরি লিখে এতো বড় বাড়ি পাওয়া যায়? স্টোরিতো আমিও কতো লিখি!!! আমারতো কিছুই নাই। মা বলেছেন, লিখতে থাকো বাবা, দেখো একদিন তুমিও.........

এবার বইমেলায় আমার প্রথম বই প্রকাশ হলো। আমি বাসায় ফোন করেছি, আমাকে আরভিন বলেছে, তোমাকে কনগ্রেচুলেশন্স। আমি বললাম কেনো বাবা? সে বললো, এবারের বুক ফেয়ারে তুমি একটা বুক পেয়েছো, তাই। আমি হেসে বললাম, কে বলেছে তোমাকে? আরভিনের নিরুত্তাপ জবাব, আম্মু।
এর ওপরে আর কি কথা থাকতে পারে?

এ পোষ্টটা আমাদের ছোট ভাই আরাফাত শান্তকে উৎসর্গ করা হলো। উৎসর্গের বিবিধ কারণ আছে

০১/০৬/২০১৩