Sunday 26 December 2010

সেন্ট মার্টিন (দুশো বছর পরে)

মুখবন্ধঃ ২০০৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর সেন্ট মার্টিনে ছিলাম দুদিন। আরো থাকার খুবই ইচ্ছে ছিলো কিন্তু নিরন্তর ব্যস্ততা দিলো না আমায় অবসর। “ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড” এ ধরতে গেলে প্রায় রিমোট অঞ্চলে যেয়ে আমার মন প্রশান্তিতে ভরে ছিলো। গাড়ি নাই, কারেন্ট আসে মাত্র দু এক ঘন্টার জন্যে, গরম পানি নাই, মোবাইলের নেট ওয়ার্ক নাই, ল্যাপটপ নাই, ফেসবুক নাই, ব্লগ নাই আহা কি শান্তি কতোদিন পর। এই মুগ্ধতার রেশ বহুদিন আমার মনে ছিলো আরো বহুদিন থাকবে আমি জানি। আমি স্বভাবগত ভাবেই ক্ষ্যাত টাইপের মানুষ, বহুদিন বিদেশে থেকেও ক্ষ্যাতত্ব ঘুচে নাই। কয়লা ধুলে যা হয় আর কি। আমার কেনো যেনো ওয়েল এ্যরেঞ্জড ভ্যাকেশেনের থেকে এসব খাওয়ার ঠিক নাই, শোওয়ার ঠিক নাই টাইপ ভ্যাকেশন খুব ভালো লাগে। নীল দিগন্ত নামে এক রিসোর্টে গেছি রিসোর্ট দেখতে, পাশে লেকমতো কেটেছে তারা তাতে দেখি সাপ দৌড়াদোড়ি করে খেলছে, পানির ওপর থেকে দেখে প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেলো। আমি খুশি হয়ে অন্যদের দেখাতে, তারা চেহারা বাংলা পঞ্চম করে রিসোর্ট বাতিল করে দিলো, বেক্কল আমি আবার ধরা।

কিন্তু সেই চাঁদনী রাত, রিসোর্টের বারান্দা থেকে শোনা সমুদ্রের গর্জন, আর প্রায় গ্রাম্য লোকদের কন্ঠে শোনা অতি আধুনিক গান, “মনে বড়ো জ্বালারে পাঞ্জাবীওয়ালা”, পাশে কয়লায় বারবিকিউ হচ্ছে, নানা রকমের তাজা সামুদ্রিক মাছ, যান্ত্রিক আমার জীবনের জন্য একটি অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য। একটা ঝড় এলে আমাদের আর কেউ কোনদিন খুঁজ়ে পাবে না এই অনুভূতি ছিলো স্বর্গীয় আমার কাছে। অনেকদিন ভেবেছি আচ্ছা সেন্ট মার্টিনটা কি অযত্নে বাংলাদেশে পরে রয়েছে। এখানের লোকজন টুকটুক করে বার্বেডোজ, সেসেলস, মরিশাস, ইবিজা আইল্যান্ডে ছুটিতে যায়। সেন্ট মার্টিনটা বাংলাদেশে না হয়ে যদি পশ্চিমের কোথাও হতো তাহলে সেটা দেখতে কেমন হতো? সময় আর আলসিতে লেখা হয়ে ওঠে নাই এ ভাবনাগুলো এতোদিন। সেদিন শনিবার রাতে আয়োজন করে সিনেমা দেখতে বসলাম “নাইট এট দি মিউজিয়াম” এডভেঞ্চার কমেডি মুভি। ছবিটা দেখে আবারো “এমন হলে কেমন হতো” লেখাটা লেখার ইচ্ছাটা কুটকুট করতে লাগলো মনে। এবার তাই লিখেই ফেললাম।

আচ্ছা “সেন্ট মার্টিন” দ্বীপটি যদি ইউরোপে হতো তাহলে আমরা কিভাবে সেখানে যেতাম? কিংবা আজ থেকে দুইশ বছর পর আমরা কিভাবে সেন্ট মার্টিন যাবো? সবচেয়ে সস্তার উপায় সম্ভবত থাকতো, “শাটল ট্রেন”। টেকনাফ থেকে মাটি খুঁড়ে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত সমুদ্রের নীচ দিয়ে ট্রেন রাস্তা বানানো হতো। গাড়ি নিয়ে শাটলে ওঠে যাবে লোক, গাড়ি প্রতি ৫০০০ টাকা। কিছু দেখতে পাবে না, গরীবের বেশি দেখাদেখির দরকার নাই। সমুদ্রের এদিক থেকে গাড়ি নিয়ে ডুববে, ঐদিক থেকে ভুস করে ওঠবে। আধ ঘন্টায় সেন্ট মার্টিন। যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত তারা যেতে পারবেন বোটে। “ডিজিটাল কেয়ারি সিন্দাবাদ”, কিংবা “দি রয়্যাল ঈগল এক্সপ্রেস”। নীচে সবাই গাড়ি রেখে, ওপরে ডেকে যেয়ে বসবেন। দু – ঘন্টার জার্নি। দিনের বেলা গাড়ি প্রতি ১০.০০০ হাজার টাকা আর রাতের বেলা গেলে ১৮.০০০ হাজার টাকা। রাতের বেলা নীচে থাকবে নিকষ কালো সমুদ্র, ওপরে খোলা নীল আকাশ, আকাশের সারা গায়ে ফুটে থাকবে অসংখ্য দুধ সাদা বেল ফুলের মতো তারা, পূর্নিমা হলে “নিশি রাত সাথে নিয়ে তার বাঁকা চাঁদ”। তার সাথে মৃদ্যু মন্দ ঠান্ডা বাতাস, সুদূরে চারপাশ নীরব নিঝুম, ঝিম ধরা। অসহ্য একটা ভালো লাগায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এখুনি মরে যাচ্ছি এমন একটা অনুভূতি হবে। এগুলোতো ফ্রী হতে পারে না। তাই রাতের ট্রিপ দামি।

বোটে থাকবে রেষ্টুরেন্ট লাং লীং লাংলা, এর মধ্যে পাওয়া যাবে সেট মেন্যু। ফ্রায়েড রাইস প্লাস প্রন টেম্পুরা আর ভেজটেবল কারি ৩৫০০ টাকা প্রতি প্লেট, ড্রিঙ্কস এক্সক্লুডেড। কিংবা প্লেইন নাসি উইথ সুইট এন্ড সাওর বিফ বল উইথ স্পিনাচ ইন থাই সস ৩০০০ টাকা প্রতি প্লেট। পাশের সাউথ ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে পাওয়া যাবে মাশালা দোসা ১৫০০ টাকা অথবা শাহি পানির উইথ রুমালি রুটি ১৮০০ টাকা প্রতি প্লেট। লাচ্ছি আর জিরা পানি অর্ডার দিলে বানানো হবে তাজা তাজা। আর অবশ্যই থাকবে পকেট ফাঁকা কিন্তু পোজপাজিয়া ষ্টুডেন্টদের জন্য কফি কর্নার। এক কাপ চা/কফি ১৫০ টাকা, দুটো সমুচা কিংবা রোল ৫০০ টাকা, ক্লাব স্যান্ডউইচ ৩০০ টাকা । সফট ড্রিঙ্কস ২৫০ টাকা প্রতি ৩০ সিএল এর বোতল। বড়লোকেরা যাবেন প্লেনে চেপে। ফরেনাররা যাবেন ফার্ষ্ট ক্লাশে নইলে ফার্ষ্ট ক্লাশ ফাঁকা যাবে, কারন বাংলাদেশের অতি বড়লোকেরা সেন্ট মার্টিন যান না তারা যান সিঙ্গাপুর। আর ঘুষ খাওয়া কিংবা সদ্য এক্সিকিউটিভ, সিইও পদে পদোন্নতি পাওয়া বড়লোকেরা যাবেন ইকোনোমী ক্লাশে বউকে সঙ্গে করে। ফার্ষ্ট ক্লাশ ৬৫.০০০ হাজার টাকা আর ইকোনোমী ৪০.০০০ টাকা। প্লেনে তারা হালকা/ফুলকা স্ন্যাকস/ড্রিঙ্কস পাবেন কারন এতো কাছের ফ্লাইটে মিল দেবার নিয়ম নেই।

সেন্ট মার্টিন পৌঁছানোর পর বেশির ভাগ সবাই চলে যাবেন আগে থেকে ইন্টারনেটে বুকিং দেয়া রিসোর্টে কিংবা হোটেল ও মোটেলে। বেশির ভাগ হোটেলেই সুইমিং পুল, সাওনা, জিম ও ডিস্কো আছে। দিনের বেলা সব চলছে চলবে ঢিলেঢালা। কেউ কেউ গায়ে লোশন মেখে সমুদ্র স্নান করবেন, কিংবা সাঁতার, ডাইভিং, বাঞ্জি জাম্প, সেইলিং, সার্ফিং। যারা পরিবার কিংবা বান্ধবী নিয়ে যাবেন তারা সৈকতে বসে বালির রাজপ্রাসাদ বানাবেন আর ভাংগবেন, পরদিন আবার বানাবেন। জমে ওঠে দ্বীপ সন্ধেবেলা থেকে। রোদের তাপ কমে গেলে সবাই তাদের বেষ্ট আউটফিটে বেরোবেন। ডিস্কোগুলোও তাদের লাল নীল নিয়ন বাতি জ্বালিয়ে দিবে। মাঝে মাঝে কেউ যখন দরজা খুলে ঢুকবে কিংবা বেরোবে তখন হালকা আওয়াজ পাওয়া যাবে, “মনে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবীওয়ালা”র সুরের। তখনো ডিস্কো সব ঢিলাঢালা থাকবে। ভীড় থাকবে রেষ্টুরেন্ট আর বারবিকিউ ক্যাফেগুলোতে। বড় বড় লবষ্টার, তেলাপিয়া, রুই, ইলিশ একদিকে গ্রীল হবে অন্যদিকে খাসির রান, মুরগী। সাথে ফিলার হিসাবে আলু, আপেল, ভুট্টা, বেগুন, টম্যেটো। দ্বীপের অথরিটি ট্যুরিষ্টদের জন্যে খোলা আকাশের নীচে বারবিকিউ এর সুন্দর ব্যবস্থা রেখেছেন। একসাথে দু’শ লোক বারবিকিউ করতে পারবেন কিন্তু তারপরো এখানে সমুদ্রের পাড়ে এতো ভীড় হয়ে যায়, আগে থেকে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, জায়গা দখল করার জন্যে। গ্রীল দেয়া আছে, বাকি কয়লা, প্লেট – গ্লাস, মাছ – মুরগী সব নিজেকে যোগাড় করে নিতে হবে। তাতেও সমস্যা নেই, কাছে অনেক সুপারমার্কেটের এরকম রেডি প্যাকেজ আছে মিট প্যাকেট ফর টু কিংবা ফিশ প্যাকেজ ফর ফোর ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনেকেই মাংসকে পুড়তে দিয়ে নিজে গিটার নিয়ে বসে পরবেন। পাশ থেকে গান ভেসে আসবে, “ঐ দূর পাহাড়ে লোকালয় থেকে দূরে, মন কেড়েছিলো এক দুরন্ত মেয়ে সে কবে……”। গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে গান শুনবেন। কেউ কেউ তার সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীকে জড়িয়ে ধরে সামান্য নাচবেন। এ জায়গাটুকু মাছ – মাংসের গন্ধে, গানে, চুড়িং টুংটাং, ফিসফাস, কাপড়ের খসমস, হঠাৎ কেঁদে ওঠা শিশুর শব্দ, আধো হাসি আধো কথায় ভরে থাকবে। যারা ভীড় ভাট্টা পছন্দ করেন না তারা কাঁচ দেয়াল ঘেরা বারবিকিউ রেষ্টুরেন্টে চলে যাবেন তাদের পার্টনারকে নিয়ে। কাঁচ ভেদ করে কোন গন্ধ কিংবা শব্দ তাদের কাছে পৌঁছুবে না। মৃদ্যু আলোয়, খুব কম ভলিউমে বাজবে সেখানে রবির সেতার কিংবা বিটোফোন বা মোর্জাৎ। ক্রিষ্টালের গ্লাসে ফ্রেঞ্চ কিংবা ইটালিয়ান – স্প্যানিশ ওয়াইনের সাথে ওয়েল সার্ভড ডিনার সারবেন তারা।

(চলবে)

তানবীরা
২৭.১২.২০১০.

Wednesday 22 December 2010

কার্পেট ব্যাপারীর জাহাজের খবর

আদিম যুগে যখন মানুষ বাড়িঘর তৈরি করতো তখন আমাদের পিতা আমাদের জন্য ঢাকা শহরের কোন এক কোনায় একটা মাথা গুজবার ঠাঁই তৈরি করেছিলেন। এখন মর্ডান যুগ, চারদিকে হাল ফ্যাশনের ফ্ল্যাট আর আমাদের বাড়িঘর নিতান্তই পুরানো। আমরা বুকে দীর্ঘশ্বাস চেপে একষ্ট ভাইবোনেরা মেনে নিয়েছি, সবার ভাগ্যে সব থাকে না। কিন্তু আমার মা জননী এই কষ্ট সহ্য করতে পারেন না। ওনার বান্ধবীদের নতুন চকচকা ঝকঝকা ফ্ল্যাট, কিচেন ক্যাবিনেট, টাইলস, স্লাইডিং ডোর আরো কতোকি। আর আমাদের প্রায় ছাল ওঠা মেঝে, ঘুনে ধরা দরজা। জননীর দীর্ঘ শ্বাসে প্রকম্পিত হয়ে আমি বললাম, ঠিকাছে টাইলস করাতো আপাততঃ সম্ভব নয়, তোমার ঘরটাকে পুরো কার্পেট করে নাও, তাহলে মেঝে দেখতে হবে না, তোমার বান্ধবীদের কাছেও প্রেষ্টিজ ঠিক থাকবে।

যে কথা সেই কাজ। বাসার বিল টিল দেয়া, খুচরো কাজের জন্য একজন আছেন। তাকে বললাম মা জননীর ঘরখানা মেঁপে দিতে। মাঁপা শেষ হলে আমি পিতাজি আর আমাদের বাহিনী রওয়ানা হলাম এলিফ্যান্ট রোড, বহুদিন পর। চার – পাঁচ দোকান ঘুরে কার্পেটের কোয়ালিটি আর দাম সম্বন্ধে যাচাই বাছাই সেরে এক দোকানে বসলাম অর্ডার করতে। কাগজ পত্র, টাকা পয়সার কাজ শেষ হওয়ার পর তখন চলছিলো কার্পেট কাটার পর্ব। দোকানদার মালিক অমায়িক ভদ্রলোক। মাশাল্লাহ আমার মতো কথা না বলে থাকতে পারেন না।

তিনি পিতাজিকে জিজ্ঞেস করলেন, অফিসের জন্যে?

পিতাজি মাথা নেড়ে না করলেন।

তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে কি জন্যে?

পিতাজি বিরক্ত গলায় বাসার জন্যে।

আজকাল হয়তো টাইলসের যুগে লোকে এমন ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট লাগান না। তাই কি উদ্দেশ্যে আমরা এই ভর দুপুরে ওনার কার্পেটের দোকানে হানা দিয়েছি তা জানতে ওনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। আর ঐদিকে রোজায়, কারেন্ট ছাড়া গরমে আমার পিতাজি ছিলেন ত্যাক্ত বিরক্ত ও ক্লান্ত। পিতাজি ঘাড় আর মাথার ওপর দিয়ে আলোচনা সংক্ষেপ করতে যেয়ে করলেন সেই বিপত্তি।

পিতাজি কথা বলছেন না দেখে ফিরসে শুরু করলেন তিনি। উপায়নন্তর না দেখে আমাকে দেখিয়ে বললেন, মেয়ের বাসায় কার্পেট লাগায় দিচ্ছেন?

পিতাজি চরম বিরক্তের গলায় বললেন, মেয়ে থাকে বিদেশ, ওকে কার্পেট লাগায় দিবো আবার কি?

কিন্তু পিতাজি জানেন নাই, তিনি কি অধ্যায়ের সূচনা করলেন। কার হাতে বন্দুক দিলেন? তিনি এখন পিতাজিকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে পড়লেন

তিনিঃ আপনে বিদেশ থাকেন

আমিঃ মাথা নেড়ে “হ্যা”

তিনিঃ কুন দেশ, লন্ডন না আমেরিকা

আমিঃ পিতাজির দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আস্তে বল্লাম, হল্যান্ড

তিনিঃ বিগলিত গলায় “মাশাল্লাহ” “মাশাল্লাহ”। কতোদিন আছেন?

আমিঃ প্রায় এক যুগ

তিনিঃ ঐখানের পাসপোর্ট আপনাদের?

আমিঃ মাথা নাড়ালাম আবার “হ্যা” সূচক

তিনিঃ আবার বিগলিত “মাশাল্লাহ” “মাশাল্লাহ”। জামাই বাবাজি কি করেন?

আমিঃ চাকরী।

তিনিঃ ছেলে মেয়ে কয়জন

আমিঃ এক মেয়ে

তিনিঃ কতো বয়স

আমিঃ সাত

তিনিঃ চরম দুঃখিত গলায়, আর একটা ছেলের দরকার না? মেয়ের বয়স সাত হয়ে গেলো, এইটা কি করছেন? এইটা কি ঠিক হইতেছে?

আমিঃ নিশ্চুপ

তিনিঃ ঈদ করতে আসছেন, বাবা মায়ের সাথে?

আমিঃ না, ঈদের আগেই চলে যাবো

তিনিঃ বিস্মিত, ঈষৎ ক্রোধিত, এইটা কি কইলেন আপনে, মুরুব্বীর সাথে ঈদ না কইরা মুরুব্বীর মনে কষ্ট দিয়া আপ্নে ঈদের আগেই চলে যাবেন। দেশে আসছেন, মা বাপের সাথে ঈদটা অন্তত করে যান।

আমিঃ নিশ্চুপ

তিনি এরপর অন্যদিকে মন দিলেন।

তিনিঃ বাবারে কার্পেট লাগায় দিচ্ছেন?

আমি টাশকিত, আকাশ থেকে ধপ্পর। আমরা কি সেই ছেলে মেয়ে যে বাবা মাকে কিছু করে দিবো? আমরা হলাম সেই ছেলে মেয়ে যারা বাবা মাকে দিয়ে যতো পারি করায় নিবো।

আমিঃ দ্রুত “ইধার উধার” না সূচক ঘাড় নাড়া দিলাম।

তিনি তখন আমাকে ক্ষান্ত দিয়া আবার পিতাজিকে নিয়ে পরিলেন।

তিনিঃ মুরুব্বী কি করেন?

পিতাজিঃ তিক্ত মুখে ব্যবসা

তিনিঃ কিসের ব্যবসা

পিতাজিঃ জাহাজের

তিনিঃ উৎসাহিত কন্ঠ “মাশাল্লাহ” “মাশাল্লাহ” কোথায় যায় জাহাজ, কিসের জাহাজ প্যসেঞ্জার না কার্গো?

পিতাজিঃ সংক্ষেপ কার্গো।

তিনিঃ উদ্বেলিত কন্ঠে, কতো ফুট বাই কতো ফুট?

পিতাজিঃ আছে

তিনিঃ কেমন দাম? কয়টা?

পিতাজিঃ আমারগুলা অনেক পুরান, চলে আর কী।

তিনিঃ উৎসাহিত গলায় মার্কেট রেট কতো?

পিতাজিঃ ………।

তিনিঃ নতুন বানাইলে কেমন খরচা পরব

পিতাজিঃ ………………।

তিনিঃ মাসে খরচা দিয়া কেমুন থাকে আপনার?

এসময় আমাদেরকে খবর দিলো কার্পেট প্যাকড হয়ে গাড়িতে উঠেছে। আমরাও উঠতে পারি

জীবনে অনেক সার্কাস এর সম্মুখীন হয়েছি এবং ভবিষ্যতেও হবো। কিন্তু বাগধারা মিলে যায় এমন সার্কাস খুব কমই কমন পরছে।

ডিং ডং

তানবীরা

২৩.১২.২০১০

Sunday 19 December 2010

গভীর ভাবের পোষ্ট

প্রবাসে আমার দশা অনেকটা “ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলা”, “নাই বনে শিয়াল রাজা” কিংবা “আলু”র মতো। “আলু” মানে সব তরকারীতেই যায় আর কি। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে কেউ নেই, ঠিকাছে “ওনি, কাচ্চা বাচ্চাদের নাচ দেখিয়ে দেয়ার কেউ নেই, ঠিকাছে “ওনি”, সেমিনারে বিদেশী গেষ্ট আসবে, ইংরেজী - ডাচ বলতে একজন মেয়ে দরকার, তাইলে “ওনি”, প্রধানমন্ত্রী আসবে মানপত্র পাঠ করতে লাগবে, আচ্ছা আর কাওরে না পেলে “ওনি”তো আছেনই। সবার লাষ্ট চয়েস। এহেন আমি কয়দিন ধরে গভীর ভাবে আছি।

প্রথম ভাব অবশ্য আসার আগেই কেটে গেছে। ঢাকা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছি ফকিরের মতো অসহায় হয়ে নিজের স্যুটকেসের আশায়। এ্যমেরিকানদের ঢাউশ ঢাউশ লাগেজের ভিতরে আমার রোগা পটকা স্যুটকেসের আর দেখা নেই। ঘন্টা পার হয়ে গেলে দেখা যাচ্ছে আমরা অনেক ইউরোপীয়ানই কনভেয়র বেল্টের চারপাশে লাট্টু খাচ্ছি আর ইয়া নফসী ইয়া নফসী করছি। ঐদিকের কাঁচের জানালা পাশ দিয়ে কয়শো টাকার জানি টিকেট কেটে ছোটবোন আর ভাইঝি ঢুকে হাত নেড়ে যাচ্ছে। মেয়ে ষোল ঘন্টার জার্নির শেষে এই কষ্ট আর নিতে পারছে না, এক ঠ্যাঙ্গে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা এক জায়গায় তাও যখন ঐপারে মধুর হাতছানি। কেঁদে কেটে, ঘ্যান ঘ্যানিয়ে চরমভাবে সে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। এমন সময় এক তীক্ষন ভাষিনী কানের পাশে বলে উঠলেন, “আপনাদের স্যুটকেস পাইছেন”? আমি ফিরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম না ওনি কাকে বলছেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য জানতে চাইলাম আমাকে বলছেন? তিনি মাথা নেড়ে নিশ্চিত করলেন, আমাকেই বলছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না হঠাত আমাকে কেনো?

তিনি আমার প্রশ্নবোধক মুখভঙ্গী লক্ষ্য করে বললেন, আমাকে চিনতে পারেন নাই, আমি আমষ্টারডাম থাকি। ঐ যে বৈশাখে আপনার সাথে দেখা হলো, আপনি নাচলেন অনুষ্ঠানে। আমি আমার স্মৃতির মনিকোঠায় বারি মেরেও কিছু বের করতে না পেরে, চুপচাপ মাথা নেড়ে সায় দিলাম। মহিলা তাতেও দমলেন না, তিনি বললেন, আপনে না চিনলেও সমস্যা নাই, ভাইয়ের সাথে পাশের বেল্টের কাছে দেখা হইছে, কথা হইছে, ওনি চিনছেন আমাকে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, পরিবারের কেউতো ভদ্রতা রক্ষা করেছে। তখন আমি আমার স্যুটকেস আর ঐ আজাবখানা থেকে বেরোনো ছাড়া কিছু ভাবতে না পারলেও পরে ঘটনাটা মনে পরে বেশ ভাব ভাব ভাব আসলো মনে। “ইষ্টার ইষ্টার” ভাব।

দ্বিতীয় বারের অবস্থা আরো খারাপ। আমরা বড় গ্রোসারী করতে পাশের দেশে বেলজিয়ামে যাই। সেখানে তুলনামূলকভাবে সস্তা প্লাস অনেক বেশি চয়েস থাকে। কিন্তু বাংলা বাজার যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কি এর বিরাট সমস্যা। আমরা বিশ কেজির বাশমতি, রুই, কই, ইলিশ, পাবদা, কাকরোল, পটল, আলাদ্দিনের মিষ্টি, প্রানের ঝাল চানাচুর, খেজুরের গুড় ইত্যাদি কিনে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি গেছেন গাড়ি আনতে। শনিবার একেতো অনেক ভীড় সাথে ঠোলাদের আনাগোনা। এচাল থেকে বেচাল মানেই জরিমানা, টিকিট। সাধারনতঃ দোকান থেকে কেউ আমাদের বাজার গাড়িতে তুলতে সাহায্য করেন, সেদিন অনেক ভীড় তাই দোকানের কেউ গা করছেন না। আমিই একবার মেয়ে দেখছি, আর একবার প্যাকেট দেখছি ভীড়ের মধ্যে কেউ যেনো আমার লটকে শুটকি না নিয়ে যায় আর একবার দেখছি গাড়ি এলো কি না। এরমধ্যে একজন বেশ গোলগাল ভুড়িওয়ালা ভাইজান এসে বললেন, “স্লামালিকুম আপা, কেমন আছেন, মেয়েতো দেখি মাশাল্লাহ অনেক বড় হয়ে গেছে।“ টাশকিত আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞেস্ করলাম, আমাকে বলছেন? তিনি বিমলানন্দে বললেন, “হ আপনারেই। কয়দিন আগে না আপনের নাটক দেখলাম, মনে নাই আমারে?”

আমি আমতা আমতা করছি চরম বিরক্ত নিয়ে। ওনি বিরাট হাসি দিয়া বললেন, অসুবিধা নাই, না চিনলে, পরের প্রোগ্রাম যেনো কবে, আবারতো দেখা হইবো। এবার কি করবেন, নাটক না নাচ? সেই মূহুর্তে গাড়ির টেনশান বিরক্তি আর ইলিশ মাছ পটলের মাঝে আমাকে কেউ “ইষ্টার” হিসেবে সনাক্ত করুক তা আমি কিছুতেই চাইছিলাম না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না। ফোনে আমার ভাইকে এ গল্পটা এটুকু একদিন বলতেই ভাই বিরক্ত হয়ে বললো, চরম বেকুবতো তুই। তুই বলবি না, হ্যা চিনসি আপনারে, এখন আমার চালের বস্তাটা একটু গাড়িতে উঠায় দেন। কিন্তু তখন সেই বুদ্ধি মাথায় যোগায় নাই। পরে মাছ তরকারী সমেত শান্তিতে গাড়িতে বসার পর আবার আমার মনের মধ্যে ভাব খেলা করতে লাগলো। এই ভাব সহ্য করতে না পেরে এই পোষ্টের অবতারনা।

ডিং ডং

একটি অতিরিক্ত ভাবমূলক ছড়াঃ

ডুবে আছি বরফের তলে

কষ্ট যন্ত্রনা প্রতি পলে

বাসার ভিতরে হিটিং জ্বলে

এটাকে কি সুখে থাকা বলে?

মেঘলার স্মৃতিতে ছড়াখানি আজ এরূপে ধরা দিয়েছে

হাট্টিমা টিম টিম

তারা গাছে মারে ডিম

তাদের ঘাড়ে দুটো শিং

তারা হাট্টিমা টিম টিম

তানবীরা

Wednesday 15 December 2010

তারানা হালিমের সাথে কিছু কথা

বাসুগ আয়োজিত "মাইগ্রেশন ও রেমিট্যান্স" শীর্ষক সেমিনারে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য মহিলা সাংসদ তারানা হালিম। তার সাথে একান্ত কথাবার্তার কিছুটা এখানে পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম।

১. বাসুগের আজকের কার্যক্রম “ মাইগ্রেশন ও রেমিট্যান্স” সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।

আমার খুবই ভালো লাগছে এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে দেখে। “রেমিট্যান্স” এর সুব্যবহার নিশ্চিত করা এবং এ সম্পর্কে জানা সবারই কতর্ব্য। দেশে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা খরচ করে কিভাবে উৎপাদনশীলতা আরো বাড়ানো যায় সে নিয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। বাসুগের এই উদ্যেগকে তাই আমি স্বাগত জানাচ্ছি।

২. নেদারল্যান্ডস প্রবাসী বাংলাদেশীদের সর্ম্পকে বলুন।

প্রবাসী বাংলাদেশীদের আমার সবসময়ই বেশি ভালো লাগে। দেখা যায় দেশের বাইরে থেকেও অনেক বেশি তারাই বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করেন, সংস্কৃতিটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। অনেক অতিথিপরায়ন ও আন্তরিক হন তারা।

৩।. মুক্তচিন্তা আর মুক্তভাষনের জন্য বাংলাদেশ কতোটুকু নিরাপদ?

আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে আমি “মুক্তচিন্তা” আর “মুক্তভাষনে”র জন্যে নিরাপদ বলবো। বিগত সরকারগুলোর সাথে এ সরকারের অনেক পার্থক্য আছে। এ সরকারের সময় প্রত্যেকে তার নিজের বক্তব্য প্রকাশের অধিকার আছে।

৪. আজকের এই অবাধ প্রচার মাধ্যমের যুগে, যেকোন কারনে ওয়েব সাইট ব্লক করা, কিংবা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, কিংবা সত্যকে রুখতে বিভিন্নভাবে বাধা দিতে চেষ্টা করা কতোটুকু নৈতিক?

এ ধরনের কিছু হয়েছে এ সরকারের আমলে আমিতো স্মরন করতে পারছি না। অনেক পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে, সবাই যার যার মতো সংবাদ পরিবেশন করছেন, কাউকে বাধা দেয়া হয়েছে বলে জানি না।

তানবীরাঃ জ্বী বাঁধা দেয়া হয়েছে
তারানাঃ আপনি যদি স্পেসিফিক কিছু উল্লেখ করেন
তানবীরাঃ ইউটিউব আটকে দেয়া হয়েছিল
তারানাঃ দেশের সার্বভৌমত্ব কিংবা সুরক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ কিছু থাকলে সেটার জন্য হয়তো বাধা দেয়া হতে পারে কিন্তু এমনিতে ............
তানবীরাঃ কিন্তু সেটা কি নৈতিক? কোন না কোন সোর্স থেকে লোকে সংবাদতো ঠিকই পাচ্ছেন, আর দেশের সুরক্ষার ব্যাপারে জানার অধিকারতো জনগনের আছে
তারানাঃ জ্বী না, আমার মতে নৈতিক না কিন্তু অনেক সময় সেই সময় উদ্ভূদ পরিস্থিতির বিচারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

৫. বাংলাদেশে আজকে “নারী’র অবস্থান কি সন্তোষজনক?

নারীর ক্ষমতায়নের কথা যদি বলেন তাহলে হ্যা সন্তোষজনক। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রনালয়ে নারী মন্ত্রী আছেন। সংসদেও যথেষ্ঠ নারী সাংসদ আছেন। অনেক সরকারী গুরুত্বপূর্ন পদেই আজকাল নারীরা কাজ করছেন।

তানবীরাঃ ক্ষমতার বাইরে?
তারানাঃ এইতো সবে জাগরণের শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে সেটা আরো বাড়বে সে আশা রাখি। এখন নারীর ক্ষমতায়নের কথা শুরু হয়েছে, তবে সেটাকে আইন করে পঞ্চাশভাগে নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যেকোন কিছুতে নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহন নিশ্চত করতে হবে।

৬. জঙ্গীবাদের আশঙ্কা কি নারী উন্নতির অন্তরায় বলে আপনি মনে করেন?

অবশ্যই। তাদের উদ্দেশ্যই থাকে উন্নয়নের পথে বাঁধার সৃষ্টি। নারী পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই তবে তাদের সূত্রনুযায়ী নারীরা হয়তো বেশি তাদের শিকার।

৭. অভিনয়, আইন কিংবা রাজনীতি কোনটাকে আপনি বেশি উপভোগ করেন?

প্রত্যেকটা কাজের আলাদা আলাদা আনন্দ আছে আমার কাছে। অভিনয় আমার শখ, আইন আমার পেশা আর সংসদ আমার দেশের মানুষের কাছাকাছি থাকার, তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার সবচেয়ে উত্তম জায়গা।

১০. একসময় আপনি ভালোও গানও করতেন, সেটি ছেড়ে দিলেন কেনো?

হাসতে হাসতে, সবাই তাই ভাবে কিন্তু গানটা আসলে আমার গাওয়া নয়। গানটি ছিল সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া। আমি শুধু লিপ্সিং করেছিলাম তাতে। আমার গলায় গান ......... তবে আমি ভালো নাচ করতাম। কিন্তু সংসারের এতো ব্যস্ততা, মা হিসেবে, আইনবিদ হিসেবে, রাজনীতি নিয়ে কিছুতো স্যাক্রিফাইস করতে হয়, তাই নাচটা ছেড়ে দিয়েছি।

১১. আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।

ভবিষ্যতেও আমি দেশের মানুষের পাশে থাকতে চাই। নারীর সমঅধিকার নিয়ে, সমাজে নারীর অবস্থানকে আরো শক্ত করতে, তাদের মর্যাদা নিয়ে যে কাজ আমি করে যাচ্ছি সেটাকে পূর্নাংগ রূপ দিতে চাই। দেশের জন্য কিছু করব এটুকুই আমার চাওয়া।

১৪. আজকাল দেশে ধর্মের উগ্র চর্চা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এটিকে কি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতি হুমকিস্বরূপ মনে করছেন?

অবশ্যই হুমকিস্বরূপ। উগ্রমৌলবাদ কোন জাতির জন্য ভালো কিছু আনতে পারে না। তাই এ সময়েই এর মোকাবেলা করে একে বাঁধা দিয়ে, রুখে দিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে জাতি আরো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। সরকার এ ব্যাপারে অনেক সচেতন। পুরনো হামলার অনেক জাল এখন খুলছে। যেমন ধরুন একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা। দেশের একজন মন্ত্রীর সাথে যদি জঙ্গী হামলার সরাসরি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে আর কিইবা বলার আছে।

১৫. ধর্মনিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্বেও কবি “তাসলিমা নাসরিন” কেনো দেশে ফিরতে পারছেন না? একজন মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আপনার মত জানতে চাই।

একজন মানুষকে তার দেশে ফিরতে বাঁধা দেয়া অবশ্যই অমানবিক কিন্তু আসলে আমি ঠিক জানি না তার অন্যদেশের নাগরিকত্বে কারনে দেশে ফিরতে তার আইনগত কোন বাঁধা আছে কি না কিংবা

তানবীরাঃ আইনগত বাধা থাকলে বাংলাদেশের যেসব কনস্যুলেট বাইরে আছেন তারা সেটার সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন নাকি এটাকে আমরা সরকারের সদিচ্ছার অভাব বলে দেখব
তারানাঃ আসলে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, এতো দ্রুত জাতিকে বড়ো একটা ঝাকি দিতে চেয়েছেন, এই একই কথাগুলো কিন্তু আমরাও বলছি, আমাদের উদ্দেশ্যও কিন্তু তাই, কিন্তু আমরা এগোচ্ছি ধীর লয়ে
তানবীরাঃ একজন লেখক কিভাবে লিখবেন সেটাকি তার নিজের স্বাধীনতা নয়
তারানাঃ আসলে তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না, একজন মানুষ হিসেবে এ ব্যাপারটা আমার কাছেও খুবই দুঃখজনক।

সময়ের সংক্ষিপ্ততার কারনে আমাদের আলাপচারিতা এখানেই শেষ করতে হলো।

তানবীরা
১৪.১১.২০০৯

ফাহমিদা নবীর সাথে কিছুক্ষন

বাসুগের আয়োজনে তৃতীয় বারের মতো “বাংলাদেশ ডে” উদযাপিত হলো নেদারল্যান্ডসে। এবারের আয়োজনের মূল আকর্ষন ছিলেন সুকন্ঠী গায়িকা “ফাহমিদা নবী”। বাসুগের পক্ষ থেকে তার সাথে করা কিছু একান্ত আলাপচারিতার অংশ বিশেষ পাঠকদের জন্য।

১. নেদারল্যান্ডসে এসে আমাদেরকে দেখে কেমন লাগছে?

এতোদূরে যদিও আপনারা অল্প সংখ্যক বাঙ্গালীই আছেন কিন্তু দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি, সংসস্কৃতির আপনাদের এতো টান, দেখে খুব ভালো লাগছে।

২. প্রবাসীরা অহরহ মাতৃভূমিকে ছেড়ে আসার যন্ত্রনায় পোড়ে, দেশের মানুষরা কি সেটা অনুভব করতে পারেন?

জ্বী বুঝতে পারেন। আপনারা অনেক কষ্ট করেন, তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবেন, এতোদূর থেকে তাদের সুখ সুবিধার কথা ভেবে টাকা পয়সা পাঠান, তারা সেটা অনুভব করেন।

৩. গানের হাতেখড়ি কি বাবার কাছেই?

না, ঠিক তা নয়। বাবা আমাদের জন্য ওস্তাদ রেখে দিয়েছিলেন, ওস্তাদ আমানউল্লাহ খান।

৪. কতো বছর বয়েস থেকে গান করছেন?

ঠিক মনে নেই। খুব ছোটবেলা থেকেই। জন্মের পর থেকেই বলতে পারেন

৫. কোন ধরনের গান গাইতে আপনি নিজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

মেলোডিয়াস। যাতে ভালো সুর আছে। হৈ চৈ গান আমার দ্বারা হয় না আর শ্রোতারা তা ঠিক গ্রহনও করেন না।

৭.বাবার প্রেরনাই কি গানকে পেশা হিসেবে নিতে উৎসাহিত করেছে?

না ঠিক তা নয়। আমার মাও ভালো গান করতেন। বাবার সম্মানটা আমার হয়ে কাজ করেছে। কিন্তু গানের প্রতি আমি নিজেই খুব টান অনুভব করতাম। ছোটবেলা থেকেই শাহনাজ রহমতুল্লাহ, আশা - লতার বাংলা গান শুনতাম। আমি নিজের মধ্যেই সুরের আনাগোনা টের পেতাম। সে জন্যই আমি গান করছি।

৮. বাবাকে খুব মনে পড়ে নিশ্চয়ই? বাবাকে নিয়ে মধুর একটি স্মৃতি আমাদের পাঠকদেরকে বলুন।

সব স্মৃতিই মধুর স্মৃতি। বাবা খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। স্বাস্থ্যগত কারনে মা বাধা দিতেন। প্রায়ই বাবা আমাদেরকে বলতেন, রুমা সুমা চল বাইরে থেকে হেটে আসি। তখন আমরা এ্যালিফ্যান্ট রোডে থাকি। বাসা থেকে কয়েক কদম হাটলেই সামনে মরণ চাঁদের মিষ্টির দোকান। বাবা আমাদের নিয়ে চলে যেতেন মিষ্টির দোকানে। বসে মিষ্টিত অর্ডার দিতেন। নিজেও খেতেন আমাদেরকেও খেতে সাধতেন। আমরা যদি সবটা না খেতে পারতাম, জিজ্ঞেস করতেন, কি রে খেতে পারছিস না ? আমাদের প্লেটে যতোটুকু থাকতো তাও খেতে নিতেন। অনেক সময় হয়েছে, দোকানে বসে থাকা অবস্থায় পরিচিত কাউকে পেলেন কিংবা অপরিচিত কেউ এসে বললো আপনার গান আমার ভালো লাগে নবী ভাই। তিনি তাদেরকে ডেকেও মিষ্টি খাওয়াতেন। তারাও যদি সবটা না খেতে পারতো তাদের প্লেটের অবশিষ্টাংশও বাবা খেয়ে নিতেন।

আর বাবা ছিলেন খুবই ভুলো মনের মানুষ। সব ভুলে যেতেন। বাড়িতে হয়তো কোন মেহমান এসেছেন, মা বললেন যাও দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে এসো। বাবা মিষ্টি আনতে গিয়ে দেখা গেলো আর ফিরছেন না। সন্ধ্যায় মেহমান এসেছিলো হয়তো, মা তাদের রান্না বান্না করে খাইয়ে বিদায় করেছেন। রাত এগারোটায় বাবা বাইরে থেকে ভক্তদের সাথে আড্ডা মেরে, গান গেয়ে টেয়ে, মিষ্টি খেয়ে দেয়ে ফিরেছেন। বাড়ি ফিরে মেহমানদের কথা মনে পড়েছে তার আবার।

৯. একজন গায়িকাকে বাংলাদেশের সমাজ কি চোখে দেখেন?

আমি আমার কথাই বলছি। খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। আমি যদি কাউকে কিছু বলি তারা আমার অনুরোধ রাখেন, কথা শুনেন। কিন্তু সেই সম্মান, শ্রদ্ধার আসন আমি নিজে দিনে দিনে তৈরী করে নিয়েছি।

১০. গানকে পেশা হিসেবে নিতে মেয়ে হিসেবে কোন সামাজিক কিংবা ধর্মীয় বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি?

আসলে বাবা - মা গান করতেন বলে আমি এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছি যে আমি এগুলোর সম্মুখীন হইনি। আর নিজে গান গাওয়ার আজকের এইযে অবস্থান সেটা আমি তিলে তিলে নিজেই তৈরী করে নিয়েছি।

১১. সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের মেয়েদের আজকের অবস্থান ব্যাখা করুন।

আজকে মেয়েদের অবস্থান হয়তো আগের চেয়ে ভালো কিন্তু আশাপ্রদ হওয়ার মতো কিছু না। শহরে কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেনীর মেয়েরা হয়তো সুযোগ পাচ্ছেন কিন্তু গ্রামে গঞ্জের সাধারণ মেয়েরা আজো তাদের অনেক ধরনের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

১২. জঙ্গীবাদ কি বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চার পক্ষে বাধাস্বরূপ? যেমন একুশে ফেব্রুয়ারী কিংবা পহেলা বৈশাখ?

অবশ্যই। ধর্ম একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার কিন্তু জাতীয়তাবাদের চেয়ে বেশি নয়। আজকে আমাদের পরিচয় কি বিশ্বে, আমরা বাঙ্গালী। আমাদের ভাষা আমাদের সংস্কৃতিইতো আমাদের পরিচয়।

১৩. গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কি?

বাবার গানের স্কুলটাকে আরো বড় করবো তাতে ভালো গান শেখানোর ব্যবস্থা করবো।

১৪. ধর্মনিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্বেও কবি “দাউদ হায়দার” ও “তাসলিমা নাসরিন” কেনো দেশে ফিরতে পারছেন না? আপনার অনুভব কি?

আমি এটাকে অত্যন্ত অমানবিক একটা ব্যাপার বলে মনে করি। কখনো কখনো ভাবি, আমরা কি এখনো আদিম যুগে পরে আছি যেখানে মানুষ চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালাতো? একটা মেয়েকে তার মা-বাবা, পরিজন থেকে দিনের পর দিন বিচ্ছিন্ন রাখা।

তাসলিমা ভুল বা অন্যায় কিছুতো বলে নাই যে তাকে নির্বাসন দিতে হবে। তাসলিমার বাবা মারা গেলেন একটি বারও মেয়েকে চোখের দেখা দেখতে পেলেন না, মায়ের অবস্থাও ভালো না। এটি অত্যন্ত অনৈতিক।

১৫. দেশের জাতীয় সমস্যাগুলোতে সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিবর্গের প্রতিবাদের কন্ঠস্বর সীমিত ও ক্ষীন থাকে, এর কারন কি?

এ কথাটা মোটেও ঠিক না তানবীরা। আমরা সমস্যাগুলো অনুভব করি এবং তার পাশেই থাকি। কিন্তু আমরা যখন এর একটা সমাধান করতে বা বলতে যাই, দেশের মানুষ সেটা নিতে চায় না। আমরা সাংস্কৃতিক ব্যাক্তি বিধায় তারা ভাবেন আমরা অতি আধুনিক। আমাদের সমাধানের ধরনটাও হয়তো “অতি আধুনিক” চোখেই তারা দেখে থাকেন। তারা অনুভব করেন না, একজন শিল্পী একই সাথে মা, স্ত্রী, মেয়ে সবই। তারাও বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যান হয়তো অন্যদের থেকে একটু আলাদা ভাবে।

অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ফাহমিদা।
তোমাকেও তানবীরা।

তানবীরা
১৪.১১.২০০৯

Wednesday 8 December 2010

একখানি ক্রিয়া পদ দিয়ে

আমাদের বাসায় একজন হাফ বিদেশিনী থাকেন। গায়ের রঙ, খাওয়া – দাওয়া সবই দেশি শুধু মুখ খুললে সমস্যা। তার বাবা মায়ের মাতৃভাষা বাংলা হলেও তার জন্য এটি দ্বিতীয় ভাষা। তিনি তার পছন্দের ভাষাতেই কর কর করতে চান কিন্তু মায়ের আবার বাংলা বাংলা বাতিক আছে। তাই বাসায় রফা হয়েছে, বাবার সাথে অন্য ভাষার চর্চা চললেও মায়ের সাথে শুধু বাংলা আর বাংলা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চর্চা করতে মা বদ্ধপরিকর। তিনিও কম যান না। একখানা ক্রিয়া পদ ব্যবহার করে তিনি সর্ব ধরনের বাংলা ভাষা ম্যানেজ করে ফেলছেন। তার সাথে থেকে থেকে তার মা, খালা, মামা সবার বাংলা বলার ধরন পালটে যাচ্ছে। নিজে থেকে ডাচকে বাংলায় ভাষান্তর দিয়ে তিনি আজব কিছু বাক্যও গঠন করেন। যেমনঃ স্কুলের বন্ধুর জন্মদিনে গিয়েছেন তিনি। ফিরে এসে বলছেন, মা এভির আম্মু আমাকে অনেক সুন্দর পেলো। কেউ কিছু দিলে, আন্টির জন্য এটা আমি পেতে পারলাম।

তবে বিশেষ সেই ক্রিয়াপদের কিছু নমুনা এখানে। মেঘ তুমি গোসল করেছো? না, তোমাকে আমাকে হেল্প করতে হলো। মেঘ তুমি বই পড়েছো? না তোমাকে লাইব্রেরী থেকে নতুন বই আনতে হলো। দুষ্টামী করলে পিট্টি পরলে, তিনি গম্ভীর মুখে আমাকে বলবেন, সেজন্য তোমাকে আমাকে মারতে হলো না। কি করছো মেঘ? আব্বুর জন্য আমাকে এখন দশটা অঙ্ক করতে হলো। মেঘ কি খাচ্ছো? আম্মির জন্য এখন আমাকে দুধ খেতে হলো। এই জামা পরেছো কেনো? আব্বুর জন্য এখন আমাকে শীতের জামা পরতে হলো। এখন কি করবে? এখন বই পড়তে হলো, আব্বুর জন্য এখন আমাকে টিভি দেখতে হলো না। কার সাথে কথা বলছো? আব্বুর জন্য এখন আমাকে ফোনে কথা বলতে হলো।

সব হলো দিয়ে শুরু আর হলো দিয়ে শেষ।

আর আছে তার যুগান্তকারী ভাব, কিছু না হতেই মুখ কালো করে বলবে আমার কিছু বালোওওওওও লাগে না।

কিছু কিছু সুমধুর প্রশ্নও আছে, ছোতবেলায় কেনো আমাকে ডিনে ডুইবার ডুদ খেটে হলো? সকালে মুখ ধুতে বললে সে সমানে কুলকুচা করে যায়। আমি বকা দিলেই বলবে তাহলে কেনো দুতোই মুখ হলো বাংলায়। আমি কিচু বুজতে পারি না। তখন আমাকে শুদ্ধ করে বলতে হয়, একবার মুখ ধোও আর একবার চেহারা ধোও।

এখানে কথায় কথায় লোকের প্রচুর “ওকে” শব্দটি ব্যবহার করেন। আমি “ওকে”র বিকল্প হিসেবে “ঠিক আছে” কথাটি বলি। তিনিও বলেন, “থিক” আছে আম্মি, থিক।

বাংলা ভাষার যা হচ্ছে তাতো হচ্ছেই কিন্তু বিদেশিনীর মুখে বাংলা শুনতে খুবই “সুইট” লাগে।

তানবীরা

০৮.১২.২০১০

Thursday 2 December 2010

অহনার অজানা যাত্রা (আট)

ভিন দেশে অচেনা পরিবেশে স্বল্প পরিচিত একটা ছেলের সাথে জীবন কাটানো অহনার জন্য সব সময় সোজা ছিলো না। একবার এখানের অনেক কিছু চিনেছি বুঝেছি ভেবে মানসিক যে শক্তি সে অর্জন করতো পর মুর্হূতেই অন্য একটা ঘটনায় সেটা উবে যেতো। আশা নিরাশার দোলায় সে দুলতো সারাবেলা। ছোটখাটো অনেক ঘটনা, যেগুলো বিশ্লেষন করলে কোন যুক্তিতেই হয়তো গুরুতর নয় কিন্তু সেগুলোও সে সময় মনে প্রচন্ড প্রভাব ফেলতে লাগলো। যার কারনে অনেক সময় আপাতঃ সামান্য ব্যাপারেও অহনা অনেক অস্বাভাবিক আর তার স্বভাবের চেয়ে অনেক বেশি রুক্ষ আচরন করে বসতো। একবার অহনা বাসে করে স্কুলে যাচ্ছিলো। বাসে খুব আনমনা ছিলো সে। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজের মনে আকাশ পাতাল সব ভেবে যাচ্ছিলো। যখন লক্ষ্য করলো তখন দেখলো বাস এক অজানা জায়গা দিয়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে অহনা পরের স্টপেজে নেমে, রাস্তার পাশের ফোন বুথ থেকে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে অর্নকে ফোন করে বললো, “আমি হারিয়ে গিয়েছি, আমায় নিয়ে যাও।“ অফিসে হঠাৎ অহনার এধরনের ফোন পেয়ে হতবিহ্ববল অর্ন ওকে বার বার জিজ্ঞেস করছিলো, কোথায় তুমি এখন, কোথায়? কোথায় তা কী সে জানে? জানলে আর হারাবে কেনো? অহনা কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি জানি না আমি কোথায় এখন, তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। এর মধ্যে পয়সা শেষ ফোন কেটে গেলো।

ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে শীতের সেই প্রায় অন্ধকার দিনে নির্জন সেই রাস্তায় অহনা দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন একা একা কাঁদলো। কেউ নেই তার পাশে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার এই দেশগুলোতে কাজ ছাড়া সাধারণতঃ কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না। বাংলাদেশে যদি বাসস্ট্যান্ডে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতো নিশ্চয় তাহলে অন্ততঃ দেখার জন্য হলেও দশটা লোক দাঁড়িয়ে পরতো। এখন বিধি বাম আর এখানে বিধিই নেইতো আর তার ডান বাম। একটু পর যখন আর একটা বাস উলটো দিক থেকে ফিরছিল তখন অহনা বাস কাউন্টারে গিয়ে সেই বাসে উঠে পরলো। কার আশায় আর কতোক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবে। আধ ঘন্টা পর পর একখানা বাস যায়। এবার বেশ বড় বড় চোখ করে বাইরে তাকিয়ে অহনা হারিয়ে যাওয়ার রহস্যটা আবিস্কার করার চেষ্টা করতে লাগলো। দেখলো তার অসাবধানতায় বাসটা স্কুল ছাড়িয়ে বেশ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলো এবং জায়গাটা অপরিচিত বলে সে হারাবে কেনো এই লজিক্যাল চিন্তার বদলে অনেক বেশি ভয় পেয়েছিলো। ততোটা ভয় পাওয়ার আসলে কিছু হয়তো ছিলো না। অচেনা দেশ আর নতুন পরিবেশ অকারনেই ভয় খাইয়ে দেয়। এখন আর কি করবে, দেরীতেই স্কুলে ঢুকে, বাকি ক্লাশ করে বাড়িতে এলো সে। এসে দেখলো এন্সারিং মেশিনে বেশ কটি ম্যসেজ জমে আছে। বাটন টিপতেই শুনলো, অর্নের গলা। সে বাড়ি ফিরেছে কীনা তা নিয়ে অর্নের বেশ উদ্বিগ্ন গলা। বাড়ি ফিরেই যেনো ফোন করে জানায় বেশ কবার অর্ন তাকে সে তাগাদা দিয়ে রেখেছে।

ভিন্ন একটা পরিস্থিতি থেকে একা ফিরে এসে ফোনের ম্যাসেজ শুনে অহনার মাথায় রাগ চড়ে গেলো। সে অর্নকে কিছুতেই ফোন করে জানাবে না ঠিক করলো। একটু পরেই আবার ফোন বাজলো। মনে হলো সে বাড়ি ফিরেছে কিনা এটা চেক করার জন্য হয়তো অর্ন ফোন করেছে। তাই সে সারাদিন ফোন ধরবে না এটাও ঠিক করে ফেললো। অহনা এতো কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে পারলে অর্নও যাক কিছু টেনশানের মধ্যে দিয়ে। আর টেনশান না ছাই, সে এতো কাঁদলো কাটলো, অর্ন কি তাকে সাহায্য করতে কিংবা নিতে এলো। এতোক্ষন অহনার মধ্যে যতো ধরনের যুক্তি আর চিন্তা কাজ করছিলো না কেনো, মেশিনে অর্নের গলা পেয়ে সে যুক্তি চিন্তা সব অন্য স্রোতে বইতে শুরু করে দিলো। এতোবড়ো একটা বিপদে পরল সে কিন্তু অর্ন একটু এগিয়েও এলো না? এই ছেলের সাথে তাকে থাকতে হবে? কিছুই না করে তার জন্য, অফিসে বসে আরাম করে টেলিফোনের ফুটানী ঝাড়ছে। বিকেল পর্যন্ত অর্ন ফোন করে করে ক্লান্ত হলো, ম্যসেজের পর ম্যসেজ রাখলো কিন্তু অহনা গোঁজ হয়েই রইলো। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে অর্ন রেগে গেলো অহনার এই গোয়ার্তুমীর কারনে। তারপরো সে যতোই ব্যাখা করতে লাগলো, হারিয়ে গিয়েছি বলে ফোন রেখে দিলে, সে তাকে কোথায় খুঁজতে যাবে, কিভাবে? অর্ন জানে স্কুল কোথায় কিন্তু বাস রুট সে জানে না। সে জানে ড্রাইভ রুট, দুটো আলাদা। এতো বড়ো শহরের কোন পাশে খুঁজতে বের হবে তার একটা সামান্য ধারনাতো লাগবে নাকি? সারাদিন এতো টেনশান ক্রিয়েট না করে, অর্নকে তার জানানো উচিত ছি্লো সে ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছেছে। অফিসেতো অর্ন খেলতে যায় না, তাকে কুল মাইন্ডে কাজ করতে হয়। একেতো অর্ন কোন সাহায্য করেনি তার ওপর এসে আবার শুরু করেছে রাগারাগি!!!

প্রথমে অহনার হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে নীল হওয়ার ধকল, তারপর কোথাও কেউ নেই তাকে সাহায্য করার সেই মানসিক কষ্ট, আর এখন এই রাগারাগি তাকে বিধ্বস্ত করে ফেললো। কার দোষ আর কার না সেটা চিন্তা করার ক্ষমতাও উধাও হলো। সে আশপাশ ভুলে চিৎকার করে মা মা বলে কাঁদতে শুরু করে দিলো। অর্নও যেহেতু অনেক রেগে ছিলো সেও অহনাকে কিছু বলতে এলো না। কাঁদলে কাঁদো টাইপ ভাব। চিৎকার করে কান্নাকাটি করে কিছুক্ষন পর সে নিজে নিজে কিছুটা শান্ত হলো বটে কিন্তু এখানে আমার কেউ নেই। আমি একা, একান্তই একা এই ভাবনার একটা নিষ্ঠুর ছাপ তার মনের মধ্যে পার্মানেন্ট হয়ে গেলো। যা মানসিকভাবে অহনাকে অনেক দুর্বল করে ফেললো। একেইতো বাংলাদেশি সমাজে তার তেমন ঠাঁই নেই তারওপরে হারিয়ে গেলে খুঁজে নিয়ে আসারও কেউ নেই। রান্নাবান্না পুড়ে গেলে নষ্ট হয়ে গেলে অর্নের সোজা হিসেব ফেলে দাও। নতুন করে রাঁধো কিংবা কিনে খেয়ে নিবো এই হলো অর্নের সাহায্য। রান্নাটা ঠিক করে কি করে করতে হবে সেটা বলে দেয়ার মতো কেউ নেই। সংসারের টুকিটাকি ছোটখাটো কোন সমস্যায় আটকে গেলে নির্ভেজাল উপদেশ দিয়ে সাহায্য করবেন তেমন কেউ নেই তার পাশে। নতুন জীবনে তথা এই পুরো পৃথিবীতে সে নিজেকে প্রচন্ড একা মনে করতে লাগলো। আস্তে আস্তে বিষন্নতা গ্রাস করলো। বিষন্নতা মন থেকে শরীরেও প্রবেশ করতে লাগলো।

অহনার প্রায়ই জ্বর হতে লাগলো। ঠিক জ্বর নয় কিন্তু জ্বর জ্বর অনুভূতি, দুর্বল লাগা, ক্ষিধে না থাকা ইত্যাদি। তার গলা থেকে উচ্ছাস, প্রান ঝরে গেলো। টেলিফোনে তার গলার নিষ্প্রান স্বর তার বাবা মাকে দিন দিন উদ্বিগ্ন করতে লাগলো। ডাক্তার বিভিন্ন রকম পরীক্ষা আর ঔষধ দিয়ে নিশ্চিন্ত করলেন এই রোগ আসলে অহনার দেহের নয় মনের। সে প্রচন্ড হোম সিকনেসে ভুগছে। সে সুস্থ না হলে তাকে বিষন্নতার ঔষধ দেয়া হবে। এভাবে বেশ কয়েক মাস চললো। আবেগী অহনার মনে আবেগ আসতে সময় নেয় না কিন্তু যেতে অনেক সময় নেয়। কিন্তু তারপরো এক সময় সংসারের নানান কাজে, চাপে, উৎসবে অহনা মনের গ্লানি ভুলে আবার সামনের দিকে তাকাতে শুরু করলো। সময় হলো মহাষৌধ যা তার নিয়মে অনেক কিছুকে ম্লান করে দেয়। আপাতত ভাবি ভুলিয়ে দেয় কিংবা কষ্ট কমিয়ে দেয়। আসলে হয়তো তা নয়। কষ্ট আগেরটাই থাকে শুধু সহ্য শক্তি বেড়ে যায়। কিছু কিছু ধাক্কা মানুষকে অনেক সময় কিছুটা শক্ত করে তুলে। আরো অনেকেই এই পৃথিবীতে একা বেঁচে আছেন, বেশ লড়াই করে, শক্তভাবে সুন্দর ভাবে বেঁচে আছেন, আমাকেও থাকতে হবে এ কথাটা মনে মনে অনেকভাবে আওরে নিজেকে শক্তি দিতে চাইতো সে। কখনো কখনো তাতে কিছুটা শক্তি মনে সঞ্চয় হতোও বটে। কিন্তু ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে সরাসরি তারাহীন সেই নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকালে বুক ফেঁটে একটা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসতো, সব শক্তি উবে যেতো শুধু মনে হতো “একা আমি এতো দূরে, আমার নিজের পৃথিবী ছেড়ে।“

তানবীরা
০৩.১২.২০১০।