Thursday 15 March 2012

কিছু কিছু প্রোডাক্ট এর কোন এক্সপায়ারী ডেট থাকে না

আর সব লেখাপড়া জানা মানুষদের মতো (লেখাপড়া জানা মানে বলতে চাইছি যারা লিখতে ও পড়তে জানেন, শিক্ষিত নয়। লেখাপড়া জানা আর শিক্ষিত দুটো আলাদা ব্যাপার। ) সকালে ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকার লিঙ্কে ক্লিক করার একটা অভ্যাস জন্মে গেছে। অভ্যাসে রোজ শিরোনামগুলোতে চোখ বুলাই আর বিরক্তি নিয়ে পড়া শেষ করি। সংবাদতো বটেই শিরোনামগুলোও এক, কোন পরিবর্তন নেই, শেষ নেই এর কোথাও। লঞ্চডুবিতে নিহত একশ বারো জন, স্বজনহারাদের আর্তনাদে আকাশ ভারি, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রীর গভীর শোক প্রকাশ। সংসদে শোক প্রস্তাব পাস। সংসদের শোক প্রস্তাব নিহত কিংবা নিহতদের পরিবারের কি কাজে লাগে কে জানে? ভাবি তাই, কতো কম জানি .........।

ফেসবুকে এলোমেলো একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, যেমন অহরহ দেই। ভাস্করদার সাথে আলাপ করতে করতে মনে হলো, কথাটাকে কোথাও ধরে রাখি। সেই হাসিনা – সেই খালেদা – সেই সাহারা – সেই মতিয়া – সেই এরশাদ। কোন অদল বদল নেই আজ একচল্লিশ বছর ধরে। সেই শাড়ি, সেই সাজ, সেই কাজ (নেই কোন লাজ)। সেই গালি সেই বুলি। সেই পোড়া রাজনীতি। এখন প্রশ্ন উঠবে এদের লালন করে কারা? অবশ্যই আমরা। আমরা সুশীলরা যাদের মুখে মানবতার বাণী, অন্তরে সীমাহীন লোভ। আমাদের লোভকে পুঁজি করে খেলেন রাজনীতিবিদরা। নতুন নতুন মুখ, কঁচি কঁচি লোভ, তার মাঝে ফেলে যান, রাজনীতির টোপ। মুখে যতই নীতি বাক্য ছাড়ুক না কেন সুযোগের অভাবে সৎ থাকা এই সুশীলেরা, তেল আর ঘুষে (উপহারে) ভিজে না এমন উদাহরণ বিরল। উদাহরণ নেই বলছি না বলছি বিরল।

রাজনীতি আর দেশপ্রেম দুটো দুই জিনিস। যারা রাজনীতি করেন তারা কি কোথাও বলেছেন যে তারা দেশপ্রেমিক? আমরা ধরে নেই তারা দেশপ্রেমিক। এটা আমাদের মূর্খতা। সেধে সেধে ধোকা খেলে কি রাজনীতিবিদদের দোষ? রাজনীতি হলো পেশা আর দেশপ্রেম হলো ধর্ম। সত্যের লড়াই বলো, ন্যায়ের লড়াই বলো আর অস্তিত্বের লড়াই বলো, লড়তে হয় একা। কেউ পাশে থাকে না, ইতিহাসের শিক্ষা। সুশীলতার ধর্ম হলো অন্যের ঝামেলায় না জড়ানো, পাশ কাটিয়ে যাওয়া। তবে লড়াইতে জিতে গেলে তখন হয়তো কেউ কেউ পাশে থাকবে। রাজনীতিবিদেরা কেন যেনো কোথায় থামতে হবে জানেন না। কিন্তু তাদেরকে থামানো দরকার। বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? নাকি আমরা অসহায় হয়ে হাতে হাত রেখে রোজ ফেসবুক আর পত্রিকায় এ খেলার দর্শক আর সাক্ষী হয়ে থাকবো?

অর্থ দেখলেই সুশীলদের চোখ চকচক করে। মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয় অর্থের দ্বারা। কিন্তু এই অর্থের উৎস কোথায়, কে তা ভাবতে চায়? দুজন সমপেশার লোকের যখন একের অন্যের তুলনায় অর্থের ছড়াছড়ি দেখা যায়, তখন একটা সিগন্যাল বাজার কথা মনে। বাজে কি মনে? না থাক বেশি ভাবার দরকার নেই, ব্রেইনে চাপ পড়বে। উৎস যাই হোক, আমি প্রসাদ পেলেই হলো। তারচেয়ে চলেন ফার্মভিল খেলি। চোরতো হবে আর রবে গরীবরাই, তাদের যে পেটের দায়। বড়লোকরাতো এগুলো এমনে এমনেই করে ............

তানবীরা
১৫/০৩/২০১২

Wednesday 14 March 2012

আমার অনুভব আমার অনুভূতি

1. ছোটবেলা থেকেই আমি বুদ্ধু। কেউ আমার মাথায় হাত রাখলে, আমাকে দুটো মিষ্টি কথা বললে আমি মোম হয়ে গলে গলে পড়তাম। অনেক সময় নিজে টিফিন না খেয়ে পুরোটাই প্রশংসাকারীকে খাইয়ে দিতাম। নিজে সারাদিনের উপোস থাকতাম। মানুষ আমার বোকামীর সুযোগ নিত ও তার সদ্বব্যবহার করতো। আমার বাবা আমার এই স্বভাব নিয়ে খুব ভাবতেন। আমাকে অনেক বোঝাতেন, ভুল বন্ধু বান্ধব আমাকে অনেক বিপদে ফেলতে পারে। কিন্তু আমি বেপরোয়া, নিজের ওপর অগাধ আস্থা আমার। অনেকবার বিপদে পড়েছি। দেখেছি চেনামুখ কি অচেনা আচরণ করে।

তাতে কি আমার শিক্ষা হয়েছে? না হয় নি। এই একই কথা আমার স্বামীও আমাকে অসংখ্য বার পই পই বলেছেন, বুঝিয়েছেন। আমি ভেবেছি, আমিতো কোন অন্যায় করছি না, আমার কেন বিপদ হবে? শুধু একটু বন্ধুত্ব বই কিছুতো না। আমার কাছে আসলে, আমাকে ডাকলে প্রয়োজনে, আমি না করি কিভাবে?

আজ জানি – মানি, নিজে অন্যায় না করলেও শুধুমাত্র ভুল মানুষের সংস্পর্শ একজনকে অর্থনৈতিক, মানসিক, সামাজিক, পারিবারিক সবভাবেই ধ্বংস করতে পারে। কিংবা অপূরণীয় ক্ষতি করে দিতে পারে। যে দাগ জীবনে কখনো মুছবে না।

তাতে কি আমার শিক্ষা হয়েছে? ভবিষ্যত বলে দিবে শিক্ষা হয়েছে কি হয় নাই।

তানবীরা
১৪/০৩/২০১২

Tuesday 13 March 2012

সেই পাহাড় আর নদীর গল্পটি


টিক টিক টিক টিক শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোন শব্দ নেই এই মুর্হূতে। সারা বাড়িটাকে একটা মৃত্যু শীতল নীরবতা ছুঁয়ে আছে। এ বাড়িতে এখনো কিছু বেঁচে আছে, প্রাণপনে সেটা জানান দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে হাবা কালা এই ঘড়িটি। কোথায় কি হচ্ছে, বাড়িতে কার মনের কি অবস্থা, কিছুই বুঝতে পারে না, বোকার মতো কাটা ঘুরিয়েই যায় সারাবেলা। ভর দুপুর হলেও এঘরটাতে এখন সন্ধ্যা নেমে আছে যেনো,আলোছায়ার খেলায়। এই বসার ঘরটার সামনের জানালায় বসলে বাইরের রাস্তাটা সরাসরি দেখা যায়। আর জানালাটার ঠিক পাশেই গোলাপী বোগেনভিলার ঝাড়। ঝাড়টা বড় হয়ে গেলেই ঝুঁকে এসে জানালাটার অনেকটা ঢেকে দেয়। তখন বসার ঘরটা অনেকটা অন্ধকার দেখায়। এতে একটা সুবিধে হয় রাস্তা থেকে ঘরটাকে আর সরাসরি দেখা যায় না যদিও ঘর থেকে রাস্তাটাকে ভালোই দেখা যায়। জানালার উপর আছে গাঢ়ো মেরুন রঙের ভেলভেটের পর্দা। সকালটা যখন পেকে উঠেছিলো, তখন চোখে অনেক আলো লাগছিলো বলে পর্দাগুলো আধা আধা টেনে দেয়া হয়েছিলো। রিয়ার অবশ্য উজ্জল আলো, অনেক রোদ খুব ভালো লাগে। অরন্য আপত্তি করলেও রিয়া প্রায়ই লোক ডাকিয়ে বোগেনভিলার ঝাড় কাটিয়ে দেয়। অনেকদিন হয়ে গেলো বাড়িঘরের সাজসজ্জার দিকে তাকানোর কথাই মনে পরেনি রিয়ার। অন্য একটা জগতে ছিলো যেনো সে। যা আগে একসময় সারাক্ষণ তার চোখে পড়তো কিংবা চোখে বিঁধতো, সেগুলো তার মনেই পড়েনি। সোফার পাশে একটা ইজি চেয়ার রাখা আছে, তাতে বসে বই পড়তে পড়তে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়া ছিলো এক সময় রিয়ার প্রিয় কাজগুলোর একটি। আনমনে রাস্তার লোকজনের ব্যস্ত হাটাচলা দেখতে কতো কি ভাবত সে। কিন্তু মাঝখানের দিনগুলো যেনো অন্যরকম ছিলো। ক্লান্ত হয়ে পরা রিয়ার আজ কেনো যেনো হঠাআলোর চেয়ে ছাঁয়াটাকেই অনেক বেশি আপন লাগছে।

সাজগোজে, হাটা, চলা বলায় সারাক্ষন অনেক সর্তক থাকা রিয়া এখন আলুথালুভাবে সোফার এককোণে চোখ বুঁজে পরে আছে। লম্বা চুলগুলো আজ আর কোন বিশেষ ভঙ্গীমায় বাধা নেই, কোন রকমে জমিয়ে একসাথে হাত খোঁপায় বন্দী। এক এক সময় মনে হচ্ছে ডাক ছেড়ে কাঁদতে পারলে হয়তো কিছুটা আরাম হতো কিন্তু কান্নাও পাচ্ছে না। শুধু বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে ব্যথায়, মাঝে মাঝে এমন ব্যথা হচ্ছে যে ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না রিয়া। গলা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে আছে। এসময় স্বপ্নটাও কাছে আসছে না। কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে? বাচ্চা হলেও ঠিক টের পেয়েছে আজকের দিনটা, অন্যসব দিনের মতো আলো ঝলমলে দেখালেও কোথাও কিছু ঠিক প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক নয়। আজ ছন্দহীন, সুরহীন একটা দিন। কাছে থাকলে স্বপ্নকে বলতো রিয়া, এক গ্লাস পানি এনে দিতে। ছোট হলেও এসব খুঁটিনাটি কাজ স্বপ্ন ভালোই পারে। আর মা তাকে কোন কাজের কথা বললে, সে খুব খুশী হয়, মা তাকে বড় ভাবছে, কাজের ভাবছে। সত্যিই বড় হচ্ছে সে। অথচ এই বড় হওয়ার জন্যই মা - বাবা যতো সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলুক না কেনো, যতো নিজেদেরকে স্বপ্নের সামনে চেপে রাখুক না কেনো, স্বপ্ন ঠিক টের পেয়ে যায়, কখন তাদের কাছে থাকতে হবে আর কখন নিজের ঘরে কার্টুন চালিয়ে, ছবি আঁকতে হবে। কখন মা ভাত দিলে, চুপ করে গিলে গিলে খেয়ে নিতে হয় আর কখন মায়ের কোমড় জড়িয়ে লাজানিয়ার বায়না করতে হয়।

কলেজের ডাক সাইটে সুন্দরী রিয়া, পড়াশোনায় ফার্ষ্ট - সেকেন্ড না হলেও ভালো ছাত্রদের কাতারেই পরে। ভালো গান করে, কলেজের ছেলেরাতো বটেই, তরুন শিক্ষকরাও রিয়াকে দেখে মনে মনে অনেক কল্পনার জাল বুনেন। গোলাপের পাপড়ির মতো ফিকে রঙের মসৃন ত্বক, ছিপছিপে গড়নের, বাঙ্গালী মেয়েদের চেয়ে বেশ অনেকটা লম্বা রিয়া এই তাকে করা বিশেষ খাতিরটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে যদিও মুখে কখনো কিছু বলে না। ঘন কালো চোখের তারায় সব সময় একটা হাসির ঝিলিক লেগেই থাকে। সে সুন্দরী, লোকে তাকে সুন্দরী বলে এটা নতুন কি? তারুন্যের আনন্দে ভরপুর তার প্রতিটি মুহূর্ত। বাবা মা অবশ্য অনেক দিন থেকেই একটা ভালো ছেলের সন্ধানে ছিলেন। রিয়ার মতো মেয়ের জন্যতো আর সুপাত্রের অভাব নেই তবুও বাবা মা যতোটুকু সম্ভব জেনে বুঝে আগাতে চান। পরে যেনো আফশোস করতে না হয়, আর একটু দেখে কিংবা দেরী করে দিলেই ভালো হতো। একদিন এক আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রবাসী পাত্র অরন্যের জন্যে প্রস্তাব এলো, মেধাবী অরন্য যে শুধু ভালো চাকুরীই করছে তাই নয়, দেখতেও দারুন ভালো। মেধা, উজ্জল পৌরুষদৃপ্ত চেহারা, পারিবারিক আভিজাত্য সব মিলিয়ে অরন্যের মধ্যে অন্য একটা দ্যুতি খেলে সারাক্ষণ। অরন্যের সাথে দেখা হতে শুধু বাবা মাই নয়, রিয়াও মনে মনে বুঝতে পারলো এই সেই, যার জন্য দিনরাত তার এতো সাজসজ্জা, এতো ধ্যান।

শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এক শুভক্ষণে দুই পরিবারের সবার আর্শীবাদ নিয়ে বিয়ে হয়ে গেলো রিয়া আর অরন্যের। পাড়া প্রতিবেশী থেকে আত্মীয় স্বজন সবাই চোখ ট্যারা করে দোয়া করলেন আর ঘটা করে আয়োজন করা বিয়ের ভালো ভালো খাবার দাবারও পেট ভরে খেলেন। কেউ মুখে না বললেও মনে মনে স্বীকার করলেন, জুটি হয়েছে বটে একটা, যাকে বলে রাজযোটক। যেমন বর তেমনি কনে। রূপকথার গল্পের মতো। সত্যিই তাই ছিল। কোথা দিয়ে সময় উড়তে লাগল অরন্য আর রিয়া বুঝতেও পারল না। আজকে এখানে ঘুরতে যাচ্ছেতো কালকে ওখানে। শ্বশুর - শাশুড়ি, গুরুজন কেউ কাছে নেই, নেই কোন বাধা নিষেধ, উদ্দাম আনন্দে কাটছে দিন। দুজন দুজনকে আবিস্কারের নেশায় ব্যস্ত। প্রথম শারীরিক ভালোবাসার স্বাদে উন্মাতাল দুজনেই। রিয়া যা রান্না করছে তাই অরন্যের মনে হচ্ছে, এমন ভালো রান্না সে আগে আর কখনো খায়নি। অরন্য অফিস থেকে এসে রিয়াকে জড়িয়ে ধরলেই রিয়ার মনে হয়, এমন ভালো রিয়াকে কেউ আর এ জীবনে বাসেনি। জীবন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এরমধ্যেই দুবছর গড়িয়ে গিয়ে স্বপ্ন এলো রিয়ার কোল জুড়ে। নতুন আনন্দে ভরপুর রিয়া বসে গেলো ছেলে নিয়ে তারা আলাদা পৃথিবী সাজাতে। ছেলে কি খাবে, কখন ঘুমাবে, তাকে গোসল দেয়া, ঘুম পাড়ানো এই করে এখন রিয়ার বেশিরভাগ সময় কাটে।

অত্যন্ত মাত্রায় ক্যারিয়ার সচেতেন অরন্য জানে অনেকদিন এক জায়গায় কাজ করাটা, তার ক্যারিয়ারের জন্যে ততোটা সুবিধাজনক নয়। চাকরী বদলে নতুন কোম্পানী আর সাথে নতুন শহরে চলে এলো সবাইকে নিয়ে। নতুন শহরে অরন্য এবার বাড়ি কিনে নিলো। পরে আবার শিফট করলে বেঁচে দিবে এই ভেবে। আগে অফিসের ফার্নিশড ফ্ল্যাটে থেকেছে। আর এ হলো রিয়ার নিজের সংসার। সংসার পাওয়ার আনন্দে আর অন্য দশটি মেয়ের মতো সেও আজ মাতোয়ারা। কোন পর্দার সাথে কোন কালারের ফার্নিচার ম্যাচ করবে, বাগানে কোন কোন রঙের ফুলের গাছ লাগাবে সব নিয়েই সে রীতিমতো দিনরাত ছবি এঁকে যাচ্ছে। অফিসের বাইরের অনেকটা সময়ই অরন্যকে আজকাল পড়াশোনার পেছনে দিতে হয়। চাকুরীতে উন্নতি করতে হলে, অধঃনস্তদের উপর অধিকার ফলাতে হলে, অনেক পড়াশোনা করতে হয় আজকাল। ঘন ঘন ট্যুর থাকে। রিয়ার অবশ্য তা নিয়ে তেমন অভিযোগ নেই, সবইতো অরন্য তার আর স্বপ্নের জন্যে করছে। নতুন শহরে নতুন নতুন লোকের সাথে বন্ধুত্ব করে সময় কাটতে লাগলো রিয়ার। বাড়িটাও খুব সুন্দর। মনের মাধুরী ঢেলে প্রতিটি সেন্টিমিটার সাজাচ্ছে, সযতনে। অরন্য খরচে কোন বাধা দেয় না। বরং রিয়ার এই নিপুনতায় মুগ্ধ সে।

**********

অরণ্যকে ঠকানোর কষ্টটা আজকাল রিয়ার মনে খুব বাজে। বিবেকের এই চাপ সে আর সহ্য করতে পারছে না। অনেক ভেবে সে ঠিক করল যাই হয় হোক, এভাবে আর না। সে সব অরন্যকে খুলে বলবে, তারপর অরন্য যে শাস্তিই দিক, তাই মেনে নিবে। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর অরন্য স্বভাবমতো তার স্টাডিতে গিয়ে বসলো সেদিনও। রিয়া স্বপ্নকে শুইয়ে দিয়ে এসে অরন্যের চেয়ারের পাশে হাটু মুড়ে বসল। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ। রিয়া এ ঘরে আসার সময় হলের বাতিটাও নিভিয়ে দিয়ে এসেছে, আলো পাগল রিয়া এখন যতোটা সম্ভব অন্ধকার চায়। মুখ লুকিয়ে আজ অরন্যের কাছে তাকে আসতে হবে। আলোতে, অরন্যের চোখে চোখ রেখে একথা কিছুতেই রিয়া তাকে বলতে পারবে না। এভাবে পায়ের কাছে নতজানু হয়ে রিয়ার বসে পরা অরন্যকে হতভম্ব করে তোলে। কি হয়েছে রিয়া, বলে রিয়ার মুখে হাত রাখতেই দেখতে পায় অঝোরে রিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। দ্রুত রিয়াকে তুলে পাশের সোফায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঢাকায় কথা হয়েছিল আজকে? রিয়া মাথা নীচু করেই ঘাড় নেড়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়। আবার অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো, সব খবর ভালো সেখানে? রিয়া আবারো মাথা কাত করলে, অরন্য বুঝতে পারে না তাহলে কেনো রিয়া এতো কেঁদে যাচ্ছে। আর কি হতে পারে। কি হয়েছে রিয়ার? শরীরে খারাপ কিছু বাসা বাধেনিতো কিংবা স্বপ্নের কি কিছু হয়েছে? অস্থির হয়ে অরন্য ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। নিশ্চয়ই স্বপ্নকে নিয়ে কিছু। সংসারের কোন খবরইতো সে রাখে না। সব বেচারী রিয়া একা সামলায়। সংসারে সময় দেয় না বলে এখন তার নিজের ওপর রাগ লাগতে লাগলো। সাথে সাথে অমংগলের আশঙ্কায় সে রীতিমতো ঘামতে লাগলো।

অনেকক্ষন কেঁদে আর বার বার অরন্যের অস্থির প্রশ্নের মধ্যে রিয়া এক সময় বলে ফেললো, “ I’m in love with some one else”. প্রথমে কিছুক্ষণ অরন্য বুঝতেই পারলো না রিয়া আসলে কি বলছে। এতোই অপ্রত্যাশিত এই কথাটি তার জন্য যে কিছুক্ষণেরর জন্য মনে হলো তার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু কথাটি বলে ফেলতে পেরে রিয়ার বেশ হালকা লাগছে। চুপচাপ চারধার, একই ঘরে বসা দুটো প্রানী নিজেদেরকে পরবর্তী পর্বের গুছিয়ে নিয়ে তৈরী হচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর এবার অরন্য সরাসরি রিয়ার দিকে চোখ রেখে প্রশ্নের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রইলো। রিয়া চোখ না তুলেই বুঝতে পারলো, অরন্যে অপেক্ষা করছে তার বক্তব্যের। মুখ নীচু করেই রিয়া কথা বলে গেলো। একটি প্রশ্নও করেনি অরন্য তাকে একটিবারের জন্য, একবার থামায়নি কথা বলার সময়। হঠারিয়ার মনে হলো, সব শুনছেতো অরন্য? মুখ তুলতেই রিয়া ভয় পেলো, অরন্যের মুখ পুরোই ছাই রঙের, বুকে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে। রিয়া দৌড়ে এসে ধরতেই ধপাস করে অরন্য সামনের সোফায় বসে পরে অনেক কষ্টে উচ্চারন করল পানিই, পা - নি - ই। দৌড়ে রিয়া পানি আনতেই অরন্য ঢকঢক করে সেটা এক নিশ্বাসে খেয়ে নিলো। একটুক্ষন চুপ থেকে কথা বলার শক্তি অর্জন করে রিয়াকে বললো, তুমি শুতে যাও। রিয়া আস্তে জিজ্ঞেস করলো, তুমি শোবে না। অরন্য, হুম। বিছানায় শুয়ে রিয়া অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো কিন্তু অরন্য এলো না শুতে। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো রিয়া। সকালে এ্যার্লামের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অভ্যস্ত হাত অরন্যকে খুঁজলো। না পেয়ে উঠে বসতেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা।

পায়ে পায়ে নীচে স্টাডিতে যেয়ে দেখে অরন্য ঠাই বসে আছে সেই সোফাটায়। আজ পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে তাদের, অরন্য বাড়ি থাকলে কোনদিনও তারা আলাদা শোয়নি কোন কারনেই নয়। বিয়ের পরে আজ প্রথম এভাবে তাদের রাত কাটল। অরন্য খুব নিয়ম মেনে চলতে ভালোবাসে। যতো ইন্টারেষ্টিং বইই হোক না কেনো কিংবা ডিস্কোভারীতে নতুন কিছু রাত দশটার মধ্যে সে বিছানায় চলে যাবেই। আজ নির্ঘুম রাত পার করে দিলো সে। রিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে অরন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর রোজকার মতো ফ্রেশ হয়ে অফিসে চলে গেলো। একটু পরেই সুজনের ফোন এলো রিয়ার মোবাইলে। অরন্য বেড়িয়ে যাওয়ার সময় সে জানে। সেভাবেই মর্নিং কল দেয় সুজন রিয়াকে। সমস্ত ঝড় একা মোকাবেলা করে পর্যুদস্ত রিয়া সুজনের গলা পেতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। হড়বড় করে বলে দিলো, সে অরন্যকে সব বলেছে। সুজন বেশ রেগেই গেলো এটা শুনে। কয়দিন ধরেই রিয়া যখন পাপ - পূন্য, নৈতিকতা - অনৈতিকতা নিয়ে কথা বলছিলো, সুজন তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে এগুলো আসলে কথার কথা। দুজন মানুষ দুজন মানুষকে ভালোবাসলে এরমধ্যে পাপ কিছুই নেই। রিয়াকে আরো ঘনিষ্ট করে তার কাছে টেনে নিয়ে বলেছে, মানুষকে ভালোবাসা কখনো পাপ না। ভালোবাসার কোন সময় - অসময় নেই, যেকোন পরিস্থিতিতেই মানুষ যে কারো প্রেমে পড়তে পারে। নিজের স্ত্রী - পরস্ত্রী এগুলো সবই মানুষের সৃষ্টি করা ভুল ধারণা মাত্র। এ নিয়ে অপরাধ প্রবনতায় ভোগারও কিছু নেই আর অরন্যকে জানানোরও কিছু নেই। ভয়ে ভয়ে তখন রিয়া জিজ্ঞেস করেছে, তাদের দুজনকেতো বাইরে অনেকেই দেখেছে। কেউ যদি বলে দেয়, অরন্য রিয়াকে জিজ্ঞেস করলে তখন কি হবে? রিয়ার চোখে মুখে ঠোঁটে আদর করে আঙ্গুল ছুইঁয়ে দিতে দিতে বলেছে, অস্বীকার করবে, স্রেফ অস্বীকার করে যাবে। রিয়া বুঝতে পারে না, দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নিজেদের ইচ্ছায় নিজেদের ভালোবাসছে, তাহলে কেনো সব্বাইকে মিথ্যে বলে ঠকাতে হবে? কেনো সত্যি সত্যি বলা যাবে না।

এতো নিষেধের পরেও রিয়া অরন্যকে সব বলে দেয়াতে সুজন রেগে ফোন কেঁটে দিলো। রিয়া বুঝতে পারলো না, কি হলো ব্যাপারটা। ভাবলো লাইন কেঁটে গেছে হয়তো। রিয়া পাগলের মতো সুজনকে ফোন করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই সুজন ফোন তুলছে না। মীটিং, জরুরি কিছু? মেইলে করল তাড়াতাড়ি, লিখল মিস ইউ বেবি, কল মি ব্যাক, এজ আরলি এজ পসিবল। সারাদিন একটু পর পর মেইল চেক করলো কিন্তু সুজনের কোন পাত্তা নেই সারাদিন। এভাবেই কিছুটা সুস্থতায় কিছুটা অসুস্থতায় দিন কাটলো রিয়ার। বিকেলে অরন্য এলো অফিস থেকে। সবাই একসাথে ডিনার করলো যেন সবকিছু এ বাড়িতে চরম স্বাভাবিক। অরন্য টুকটাক সংসারের কেজো কথার বাইরে কোন কথা রিয়ার সাথে বললো না। স্বপ্নের সাথে সে স্বাভাবিক রইলো। রাতে সে স্টাডিতে ঘুমালো। এভাবে তিন দিন গেলো। মৃত্যু যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ রিয়া সুজনের ব্যবহারে হতভম্ব। সে কি মরে গেলো না বেঁচে আছে সে খোজঁও কি করবে না সুজন? দিনের মধ্যে পাঁচবার রিয়ার গলা না শুনলের সুজন চার্জ হতো না, কোন কাজের এনার্জি পেতো না বলতো থাকা সে একদম নিপাত্তা। এদিকে অরন্যের কাছ থেকে কঠিন শাস্তি কিংবা কটু কথা কিছুই আসছে না, যেনো বরফ শীতল এক মানুষ। শনিবারে আর সহ্য হলো না, অরন্যের কাছে আবার গেল,

জিজ্ঞেস করলো, কি করবো অরন্য?

অরন্য জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে শান্ত গলায় বলল, কি করবে তুমি, তোমার সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়ইতো আমি আছি রিয়া। তুমি জানাও তুমি কি চাও

আমি জানি না অরন্য, আমি জানি না। আমার মন আমার বশে নেই। আমি কি করবো? কেঁদে কেঁদে রিয়া বলতে লাগল, আমি তোমাকেও শ্রদ্ধা করি, স্বপ্নকে ছাড়া আমি আমার জীবন কল্পনা করতে পারি না কিন্তু তবুও আমার মনকে আমি বেঁধে রাখতে পারছি না

রিয়ার কান্নাতে অবিচল থেকে অরন্য বলে উঠলো, চলে যাও তুমি, দু নৌকায় পা দিয়ে চলবে না রিয়া। মন আর শরীরকে একসাথে করে যাও। একজনকে শরীর আর একজনকে মন, ছিঃ রিয়া।

এবার রিয়া স্বামীর ভালোমানুষীতে কঁকিয়ে কেঁদে উঠলো। বললো, তার সাথে আমার শরীর-মন সবকিছুরই মিলন হয়েছে অরন্য। আমি শুধুই আর তোমার রিয়া নেইগো ......

হতবিহ্বল অরন্য উঠে এসে রিয়ার হাতদুটো ধরে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, কেন রিয়া কেন? কি কমতি ছিল আমার মধ্যে? কি সেটা তুমি অন্যের মাঝে পেলে যা আমার মাঝে ছিল না? তোমাকে অদেয়া কি ছিল আমার রিয়া?

মাথা নীচু করে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে রিয়া বলে গেল স্বগোক্তির মত। তোমার কোন দোষে এটি হয়নি অরন্য, হয়েছে আমার জন্যেই। আমিই পারিনি নিজেকে সামলে রাখতে।

কিন্তু কেন? আমাদের মাঝেতো ভালবাসার কোন ফাঁক ছিল না? কোন উষ্ণতা কমে গেল, কিভাবে আমি টেরই পেলাম না? কি করে রিয়া? কি করে? অরন্য সমানে রিয়ার কাধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে গেল

**********

কি করে সেটা বলবে কোন মুখে রিয়া? অগাধ বিশ্বাস রিয়ার ওপরে অরন্যের। রিয়া যখন ইচ্ছে যেখানে যাচ্ছে, পার্টিতে, ডিস্কোতে। কোন বাঁধা নেই, কোন টোকা নেই, রোখা নেই। সুন্দরী অরক্ষিত রিয়ার সাথে তখন অরন্যের আড়ালে একটু আধটু অনেকেই ফ্ল্যার্ট করছে। এদিক সেদিক অনুষ্ঠানে রিয়া গান গাইছে। প্রচন্ড সুনাম সমাজে তখন তাদের। সুন্দরী গুনী বউ আর প্রতিষ্ঠিত স্বামী। সেরকম এক গানের অনুষ্ঠানে সুজনের সাথে দেখা। তারপর প্রায় ঘন ঘন এদিকে সেদিকে দেখা হতে লাগল। সুজন নানা জায়গায় অনুষ্ঠানে ছুতো করে রিয়ার সঙ্গী হতে লাগলো। বিশেষ দৃষ্টিতে সে রিয়ার দিকে তাকাত। রিয়ার গান, সাজ, রান্না, ঘর সাজানো ইত্যাদির ভূয়সী প্রশংসা করত। রিয়া যে সুজনের মনের ভাব বুঝতে পারতো না একেবারে তা নয়। প্রথম দিকে সেটা সে উপভোগ করত। ভাবত নির্দোষ এই আর্কষনে আর কিইবা ক্ষতি হতে পারে? তার আর অরন্যের মাঝে কোন ফাঁক নেই যা গলিয়ে তৃতীয় কেউ তাদের মাঝে আসতে পারে। কিন্তু সেই আকর্ষন এক জায়গায় থেমে থাকেনি। অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার বাইরে আস্তে আস্তে মোবাইলে কথা, গল্প, ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট। একসময় রিয়া অনুভব করলো পুরোটা ব্যাপার আর একতরফা নেই। আর সমস্ত কথা নিছক বন্ধুতেই আবদ্ধ নেই। রিয়া তবুও প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসে অটুট। মনকে প্রবোধ দিতে লাগলো, বন্ধু কেউ থাকতেই পারে, নিছক বন্ধুত্ব নিয়ে সে বেশি ভাবছে।

মাঝে মাঝে নানা কারণে সুজন খুব ক্যাজুয়ালি রিয়ার হাত ধরতে লাগল। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিত, নাক টিপে দিত। প্রথম দিকে রিয়ার একটু কেমন গায়ে শিরশিরানি হলেও সে স্বাভাবিক ভাব করারই চেষ্টা করত। কিন্তু যেদিন ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো, ধরেই রাখলো যতোক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ না হয়ে আসলো, তখন রিয়া অনুভব করল ভাসতে ভাসতে সে অনেক দূর চলে এসেছে। এ জবরদস্তি রিয়ার খারাপতো লাগেইনি বরং বেশ ভালোই লাগল, মনে হল সে যেন আজীবনের তৃষ্ণা নিয়ে এ মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করছিল। প্রথমে কদিন সর্বাংগ জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া চলছিল। চোখে, কপালে, নাকে, ঘাড়ে, গলায়, গালে। কিন্তু রিয়ার সারা শরীর উন্মুখ হয়ে থাকতো আর কিছুর জন্যে। মনে মনে অধীর অপেক্ষায় সে প্রহর গুনতো যদিও সুজনকে সামনাসামনি সে কপট রাগ দেখাত। এ অনুভূতি যেমন সত্যি আবার সুজন পাশে না থাকলে, এক গভীর অপরাধবোধের বিষন্নতায় আক্রান্ত হত সে, সেটাও সমান সত্যি। কিন্তু সুজনের আকর্ষনকে সে উপেক্ষা করতে পারত না। চেষ্টা যে করেনি তা নয়। ফোন বাজলে ধরবে না ভেবে রেখেও ধরে ফেলে, মেইলের উত্তর দিবে না দিবে না করেও দিয়ে ফেলে। নিষিদ্ধ এই আকর্ষনকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় নিজেকে ফালা ফালা করে কিন্তু সুজন সামনে এসে দাঁড়ালেই সব চেষ্টার গোঁড়ায় জল।

সেরকমই মেঘ রৌদ্রের আলোছায়ার দিনে সুজনের সাথে ছল কপটের খেলায় আর নিজেকে সে ধরে রাখতে পারেনি। নিজেকে উজার করে সুজনের কাছে সমর্পন করল। পায়ের আঙ্গুল থেকে মাথার চুল অব্ধি রিয়ার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে সুজন অত্যন্ত যত্নের সাথে নিজের ভালোবাসার মোহর এঁকে দিল। রিয়ার ব্যাকুল তৃষ্ণায় সুজন তার এক কলসী জল ঢেলেও কুলোতে পারছিল না। রিয়া আরো ব্যাকুল, আরো কামার্ত আরো হিংস্র। রিয়ার বুকে, নাভিতে, কোমরে, পেটে সুজন মুখ ঘষেই যেতো। শিহরনে গলিত রিয়া আশ্লেষে সুজনের কান কামড়ে ধরতো, ঘাড়ে নাক ঘষতে থাকতো। ভালবাসার নিরন্তর এ খেলায় রিয়া কিংবা সুজনের কোন ক্লান্তি ছিল না। সুজন কাছে এলে চলত তার পাগলামি, চলে গেলেই শুরু হত অনুতাপ। কিন্তু কোন মুখে বলবে সেসব অরন্যের কাছে। রিয়া নিজের অন্তরে জানে তার প্রতি ভালবাসা, যত্নে অরন্যের কোন ফাঁক ছিল না। যতো দুর্বলতা, পাপ সব রিয়ার মাঝে। কিসের অভাব ছিল তার, কি বলবে অরন্যকে সে? না, কোন অভাবে নয়, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই আগুন সুজনের কাছে রিয়া মোম হয়ে গলে গলে পড়েছে। সুজনের পাগলামি মত্ততায় সে শুধু ভেসে গেছে।

********

নিশ্চুপ থেকে অরন্য বললো রিয়াকে, চলে যাও রিয়া তুমি চলে যাও তোমার ভালবাসার কাছে। স্বপ্নকে নিয়ে ভেবো না। আমি ওকে ঠিক সামলে নিব। যখন চাইবে স্বপ্নকে তুমি দেখতে পাবে। কিন্তু এভাবে আমি তোমাকে চাই না। আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমার আনন্দই আমার সুখ রিয়া। বুকে যতো কষ্টই থাকুক অরন্যের, সে নিজের কষ্টের ওপর পাথর চাপা দিয়ে রিয়াকে মুক্তি দিল।

রিয়া অল্পক্ষণ চুপ থেকে সুজনকে মেইল আর এস।এম।এস পাঠাল, সুজন আমি স্যুটকেস গুছিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। এসো তুমি তোমার রিয়াকে নিয়ে যাও আজ। যে ক্ষণটির জন্যে তোমার এতো অপেক্ষা ছিল, সে মূহুর্তটি আজ এসেছে, এসো তুমি। তুমি তোমার রিয়াকে একান্ত আপনার করে পাবে আজ থেকে। আমি শুধুই তোমার।

এতো ভালোবাসে যে সুজন তাকে, সে এলো না আজ!!! শুন্য দৃষ্টিতে মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে রিয়া, না কোথাও কোন মিসড কল কিংবা এস এম এস নেই। প্রতি দশ মিনিটে এস এম এস করা সুজন আজ তাকে দিনভর একটি মেসেজও পাঠায়নি। নেই সেটা রিয়াও জানে, সুজনের প্রত্যেক ডাক যেনো শুনতে পায় সেজন্য সে তার মুঠোফোনের রিঙ্গার সবচেয়ে ওপরে তুলে রেখেছে। ফোন বেজে ওঠা মাত্র সে শৃঙ্গাররতা হরিনীর ন্যায় ছুটে এসে ফোনের ওপর ঝাপিয়ে পড়তো। রিয়াকে ছাড়া কতো কষ্টে কাটে সুজনের সারাবেলা, সেকি রিয়া জানে না। তাই তার মেসেজের জন্য সুজনকে যেনো অপেক্ষার প্রহর না কাটাতে হয়, মেসেজের এ্যার্লাম টোনটা তাই কন্টিনিউশনে দিয়ে রেখেছে। যতোক্ষন রিয়া মেসেজ ওপেন করে না পড়বে ততোক্ষন এ্যার্লাম বেজেই যাবে।

একদিন, দুদিন, চারদিন, দশদিন রিয়া মনে মনে অপেক্ষা করে থাকে। সুজন আসবেই, আসবে। পাগলের মতো ভালবাসার সেই উত্তাল সব মূহুর্ত, সেগুলোতো সব মিথ্যে ছিল না। প্রতিটি দিন তার কাছে এক যুগের মতো লম্বা মনে হয়। কখনো কোন কিছুর জন্য এভাবে অপেক্ষা করে থাকেনি। অপেক্ষার জ্বালা তার অজানা ছিলো। আরো অনেক কিছুই হয়তো ছিল অজানা। নিজ থেকে হ্যাংলার মতো সুজনকে আর ফোন করবে না রিয়া, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে। কিন্তু সুজন কি হারিয়ে গেলো নাকি তাকে ভুলিয়ে দিল? রিয়ার পৃথিবী থেকে সুজন একেবারে যে নাই হয়ে গেল। অরন্য খুব স্বাভাবিকভাবে অফিসে যায় আসে, স্বপ্নের সাথে খেলে, সুর তাল না থাকলেও রিয়ার সাথে এক রকম স্বাভাবিকভাবেই সংসারের কেজো কথা কথাবার্তা বলে যায়।

এক মাস কেটে গেলে রিয়া এক ছুটির দিনে দুপুরবেলা অরন্যের স্টাডিতে যেয়ে বসে।

অরন্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে, অসহায় রিয়া নিরুপায় গলায় জিজ্ঞেস করে, আমি তাহলে এখন কি করবো?

যতোটা সম্ভব গলাটাকে নিস্পৃহ রেখে অরন্য জানতে চাইলো, সেটা তুমি ঠিক করবে, কি করতে চাও তুমি?

অরন্যের ভাবলেশহীন এই ভঙ্গীতে হঠাৎই রিয়ার খুব কান্না পেয়ে গেলো। কিন্তু চোখের পানি ও কিছুতেই অরন্যকে দেখতে দিতে চায় না। কান্নার দমকে শরীর ফুলে ফুলে উঠতে লাগলেও, গলাটাকে যতোটা সম্ভব পরিস্কার করে বলল, আমি বরং দেশে ফিরে যাই, এখানেতো আর কোন কাজ পাবো না। পড়াশোনা শেষ করিনি, অনেকদিনের ব্রেক ওভ স্টাডি।

ঠান্ডা গলায় অরন্য বললো, দেশে গেলে কাজ পাবে?

মরিয়া রিয়া বললো, তাহলে???

অরন্য উঠে এসে রিয়ার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, স্বপ্নকে ছেড়ে থাকতে পারবে রিয়া?

এবার আর কান্না বাঁধ মানলো না। ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলো রিয়া।

অনেকক্ষন কাঁদতে দিল রিয়াকে, তারপর অরন্য বললো, সব ভুলে যাও, ভাবো কোন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলে।

আর তুমি কি করবে, প্রশ্ন করলো রিয়া।

আমিও ভুলে যাবো সব, স্বপ্নের জন্যে, তোমার জন্যে, আমাদের সবার জন্যে। ভুল ত্রুটি মানুষই করে। ক্ষমাও মানুষ করে।

********

আস্তে আস্তে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস পার হয়। ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। রিয়ার সংসারে আবার প্রানের হাওয়া লাগছে। ছন্দ ফিরে আসছে। রিয়া ব্যস্ত স্বপ্নকে স্কুলের হোমওয়ার্ক করাতে, ফুলদানিতে নতুন ফুল সাজানো নিয়ে, তানপুরায় সুর সাধতে। অরন্যের যত্ন আত্তিতে। সুজনের জ্বর থেকে নিজেকে সে বহু কষ্টে সামলে নিপুনা গৃহকর্মীর মতো আবারো সংসারে মন দিয়েছে। লড়ে যাচ্ছে আপ্রাণ নিজের মতো করে বাঁচার জন্য। তার ভালবাসার এমন নিখাদ অপমান যে করেছে তার কথা না ভাবার, তাকে ভুলে যাবার। নিঃস্বার্থ ভাবে নিজেকে উজার করে দিয়ে ভালোবেসেও যখন প্রতিদান শুন্য, তখন আপনা থেকে মন হিসেব কষতে বসে। কি দিয়ে কি পেলো। যতোই হাজারবার মনকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলা হোক না কেনো, আমিতো কিছু পাওয়ার জন্য ভালোবাসিনি, কিংবা আমিতো কোন দাবি রাখিনি, তবুও অন্য মনটা বাধন না মেনে বলে চলে, আমার কি দোষ ছিলো? আমি কেনো ভালোবেসে ঠকবো?

এই হিসেব নিকেষ পর্ব চুকিয়ে দিয়ে রিয়া অপমানের গ্লানি ভুলে সোজা হয়ে ওঠার পর এক অলস দুপুরে কৌচে গড়াচ্ছিল। দুপুরের ঘুম তাড়াতে ব্ল্যাক কফি নিয়ে আনমনে বসে টিভির রিমোট কন্ট্রোল চাপছিল। দেখছিল না কিছুই এ চ্যানেল থেকে ও চ্যানেলে ঘোরাঘুরি করছিল। চোখ তার টিভির পর্দায়, মন তার অন্যকোথাও। হঠা সামনের টেবলে রাখা তার সেল ফোনে সেই পরিচিত সুর বেজে গেল। বিস্ফোরিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো রিয়া, হ্যা তাইতো। গ্রীন স্ক্রীনে জ্বলছে নিভছে “ডোন্ট কল হিম” ......। হতম্ভব রিয়া। রিয়া অনেকবার ভেবেছে কখনো কোথাও হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে নিজেকে অনেক শক্ত রাখবে সে। কিছুতেই আর নরম হবে না, পিছনের দিকে তাকাবে না। তার জীবন শুধু অরন্য আর স্বপ্নেই আবর্তিত হবে। ভুল একবারই যথেষ্ট। একবার বাজলো ফোন, দুবার বাজলো, রিয়া উঠালো না। কিন্তু তার শরীরের রক্তকনায় কিসের যেনো অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। সারা গায়ে এক অজানা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। তিনবারের বেলায় আর পারলো না, ফোন তুলে বললো, হ্যালো ......।

তানবীরা

০৯/০১/২০১২

গল্পটির প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক

Sunday 11 March 2012

বইমেলা কড়চা – (তিন) মাঠার স্বাদ মালাইয়ে


বইমেলা শেষ হয়ে গেছে। আমাদের মাসুম ভাইয়ের ভাষায় “বইমেলা আর নেই”। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই উল্লেখযোগ্য ইভেন্টটি শেষ হয়েছে। দাদাভাই মাঝপথে অভিমান করে কড়চা বন্ধ করে দিলেন, কেউ কেউ “মুরগা” হবার কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। কিন্তু এখনের পর্ব হলো শেষ হয়েও হইলো না শেষ পর্ব। জনপ্রিয় কথাসাহ্যিতিকদের লেখার ধরন নিয়ে ছিল আমার এই নাদান কড়চা। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের পর এবার আর একজন এযুগের জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হকের উপন্যাসের প্যটার্ন নিয়ে আজকের কড়চা। প্রথমে অনেক লেখকের লেখার মধ্যেই ভার্সেলাইটি থাকলেও, যে মাত্র তারা জনপ্রিয় হয়ে যান, যে লেখাটির কারণে জনপ্রিয় হয়ে যান, পরে সেই স্টাইলটিকেই আকড়ে ধরে বেশির ভাগ লেখা লিখেন। আনিসুল হকের এ উপন্যাসটির নাম ধরা যাক সাড়ে তিপান্ন।

ফয়সল বিদেশি কোম্পানীর উচ্চপদস্থ ব্যস্ত কর্মকর্তা। সারাটাদিনের অনেকটা সময় তার অফিসেই কাটে। বউ প্রচন্ড হিন্দি সিরিয়াল ভক্ত। দুই ছেলে মেয়ে পদ্য আর কাব্য। একদম ইঁচড়ে পাঁকা যাকে বলে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। ফয়সলের ছোটভাই ফাহাদ। এখনো বিয়ে করেনি। পাশ করে বাসা থেকেই টুকটাক সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্টের কাজ করে। মাঝে সাঝে ভাল আয় হলে বাসার সবাইকে রেষ্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যায়। বড়বোন ফারহানা বিদেশে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকেন। আর ছোটবোন ফারিয়া মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। বাবা রিটায়ার করেছেন, সারাদিন খবরের কাগজ পড়েন আর দেশের বর্তমান হাল নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকেন। মা আছেন তার সংসার নিয়ে। ধানমন্ডিতে নিরিবিলি তাদের সংসার।

সকাল বেলায় টেলিফোন বাজছে ক্রিং ক্রিং। নাস্তা খেতে খেতে বিরক্ত মুখে ফারিয়া টেলিফোন ধরল। বাসার সবাই এখন খুব ব্যস্ত। কাব্য পদ্য যাবে স্কুলে, ভাইয়া অফিসে যাওয়ার পথে তাকে কলেজে ড্রপ করবে। এখন কি কারো বাড়িতে ফোন করার সময়?

কিন্তু ফোন তুলতেই তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী মৌ এর গলা। ফারিয়া, কিরে কলেজের জন্য কখন বেরোবি?

ফারিয়া সামান্য বিরক্তির গলায় এইতো নাস্তা খেয়ে এখুনি বেড়োব। তুই?

মৌ, নারে আমি আজ কলেজে যাবো না। ভীষন গলা ব্যথা, কাঁশি। এর আগের বার যখন ফ্লু হলো তখন ছোট ভাইয়া কি যেন একটা ওষুধ দিয়েছিলো না আমাকে, যেটা খেতেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম, সে ওষুধের নাম জানতে ফোন করেছি। তুই জানিস নামটা?

ফারিয়া বিরস গলায়, না, দাঁড়া ছোট ভাইয়াকে দিচ্ছি। হেটে হেটে কর্ডলেস নিয়ে ফাহাদের ঘরে প্রবেশ করে, ফাহাদকে ফোনটা দিয়ে ফারিয়া বেড়িয়ে গেলো।

মৌ, আচ্ছা ভাইয়া সর্দি জ্বরের সেই ওষুধটা জানি কি ছিল?

ফাহাদ, জ্বর কি বেশি নাকি? কলেজে যাচ্ছো না আজকে?

মৌ, না, খুব চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে, কোথায় ভাল চটপটি পাওয়া যাবে এখন বলতে পারেন?

ফাহাদ, আচ্ছা তুমি রেডি হও আমি আসছি। দেখছি কোথায় ভাল চটপটি পাই।

রান্নাঘরে যেয়ে দেখেন মা দুপুরের রান্নার এখনো কোন যোগাড় হয়নি। তিনি বিরক্তমুখে ডাকছেন শিউলি এই শিউলি, কই গেলি? শিউলি বেশ একটু সেজে গিয়েছে ড্রাইভার কাম বাড়ির বাজার সরকারের ঘরে তাকে নাস্তা দিতে।

ড্রাইভার ফিরোজ শিউলিকে দেখে বিগলিত গলায় বললো, তোমাকে আজ বেশ সুইট লাগতাছে। বেগুনি রঙটায় তোমারে মানায় ভালো।

শিউলি মনে মনে খুশি হলেও মুখটা যতোদূর সম্ভব গম্ভীর করে বললো, এসব কথায় কাম নাই। যান নাস্তা শেষ করে দোকানে দৌড় দেন। তেল না আনলে রান্না বসানো কঠিন হইবো। খালাম্মায় আবার আমাকে ডাকতাছে।

তা যাইতেছি কিন্তু দোকান থেকে তোমার জন্য কি আনমু কইয়া দাও, হেসে হেসে বলছে ফিরোজ

শিউলি, উহ, ঢং কত দেখোনা বুইড়ার।

শিউলি যাই খালাম্মা বললেও সে রান্নাঘরে না গিয়ে গেলো ভাবীর ঘরের দিকে। রাতের হিন্দী সিরিয়াল যেগুলো মিস হয়ে যায়, রাতের খাবার দেয়া বা অন্যান্য ফুট ফরমাশের কারণে, সেগুলো আবার সে সকালে ভাবীর ঘরে বসে দেখে নেয়। ভাবী মুখে মসুর ডাল বাটা আর চোখে শশা দিয়ে শুয়ে আছেন, টিভি চলছে। শিউলি নিঃশব্দে দাঁড়ালো, ভাবীর মেজাজের কোন ঠিক নেই, কখন আবার খ্যাঁক করে তাড়িয়ে দিবেন তার নেই ঠিক। টিভিতে সালোনি হচ্ছে, নাহার আর সালোনির প্রেম দেখতে শিউলির খুব ভালো লাগে। যদিও সালোনি মেয়েটার গায়ের রঙ শিউলির থেকেও কালা। শিউলি লুকিয়ে লুকিয়ে ডাল বাটার থেকে একটু সরিয়ে রেখে রেখে, শশা থেকেও সরিয়ে রাখে। বাথরুমে যখন নিজে গোসল করতে ঢুকে তখন বড় ভাবি, ফারিয়া আপা যেমন করে তেমন নিজেও রুপচর্চা করে। এখন তার চেহারা সুরৎ মাশাল্লাহ ভালোই, বাড়িতে নতুন কেউ এলে, সে যে এখানে কাজ করে তাইই চট করে ধরতে পারে না।

ফারিয়া দুটো ক্লাশ শেষ করে হাটছিলো ক্যাফেটারিয়ার দিকে। তখন তাদের এ্যানাটমির স্যার পিছন থেকে তাকে ডাকলেন।

ফারিয়া শোন, তুমি বোধহয় আজকের লেকচারটা ঠিক করে বুঝতে পারোনি, তোমাকে বোধহয় আলাদা একটু টিউশন দিলে ভালো হয়, না?

এ্যানাটমির এই স্যার গত বছর পাশ করেই জয়েন করেছেন। স্যারকে বেশ পছন্দ ফারিয়ার। সে সানন্দে সম্মতি দিয়ে মাথা কাত করলো।

স্যার বললো, তোমরা বোধহয় ধানমন্ডি আট নাম্বারের ব্রীজের ওপারে থাকো না? আমি কাল বিকেল পাঁচটায় আসব, বাড়ি থাকবেতো।

ফারিয়া হাসি মুখে বললো, জ্বী স্যার থাকবো, আপনি চলে এসেন। এই আমার মোবাইল নাম্বার, বাড়ি চিনতে অসুবিধে হলে ফোন দিয়েন।

ওদিকে কাব্য পদ্য স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দুপুরে কি হৈ চৈ। আজকে ওরা বাড়িতে খাবে না। কেএফসিতে নিয়ে যেতে হবে ওদেরকে। কাব্যের দাদা রিটায়ার্ড মানুষ দুইবেলা বাড়ির পাশে ওয়াক করা ছাড়া আর বাড়ি থেকে বেরই হননা। তিনি এসব চিনেন না।

কাব্য ফট করে বলে উঠল, দাদু তুমি ক্ষ্যাত। মর্ডান কিচ্ছু জানো না। কেএফসি, পিজা হাট, থ্রী ডি, আইম্যক্স মুভি, এর্নাজি ড্রিঙ্ক এসব না হলে চলে আজকাল?

আইম্যাক্স মুভি সেটা কিরে? অবাক হয়ে বললেন দাদা

আইম্যাক্স মুভি হলো, শুধু সিনেমা দেখলে হবে না সেটাকে অনুভব করতে হবে। ধরো, সিনেমাতে দেখাচ্ছে কোথাও ঝড় হচ্ছে সব কাঁপছে, তখন মুভি হলে তোমার চেয়ারও কাঁপবে, বুঝলে।

এমন সময় ফোন এলো। পদ্য বিরক্ত মুখে ফোন ধরলো, হ্যালো কাকে চাই।

অপরপ্রান্ত, ইয়ে মানে তুমি কে?

পদ্য, কেন আপনার নাম বলছেন না কেনো?

ইতস্তত গলায়, আমি আমি আসলে সাকিব

পদ্য বেশ গম্ভীর গলায়, ওহ তাই নাকি? আমি তাহলে ডোরা, রাখছি সাকিব ভাই, বাই বাই।

রাতে ফয়সল খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে ফিরে দেখলো, তার স্ত্রী সেই সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে আছে। একটু কেঁশে আস্তে আস্তে বললো, এভাবে সিরিয়াল গিললে হবে, বাচ্চাদুটো বড় হচ্ছে, ওদের ওপর বাজে প্রভাব পড়বে। সন্ধ্যায়তো ওদেরকে একটু পড়াটড়া দেখিয়ে দিলে পারো।

স্ত্রী তিক্ত গলায়, একটা ইম্পট্যার্ন্ট এপিসোড দেখছি এর মধ্যে কথা বলবে নাতো। আর বাচ্চা কাচ্চা কি খালি আমার একার নাকি? তুমি পড়াতে পারো না?

না মানে বলছিলাম কি এতো সিরিয়াল দেখলে

হ্যা, বার বার আমার টিভি দেখা নিয়ে কিসের এতো কথা শুনি? তুমি যে সারা দিনরাত বাইরে টো টো করে ঘুরে বেড়াও, সংসারের কোন খেয়াল রাখো না, তাই নিয়ে আমি কথা বলি কখনো?

অবাক গলায় ফয়সল, আমি টো টো করে বাইরে ঘুরে বেড়াই, আমিতো অফিসে

আমাকে আর অফিস দেখাতে হবে না, অফিসের নাম দিয়ে কি করো সব আমার জানা আছে। কিছু বলছি না বলে ভাবছো

স্ত্রীর সাথে কথা বলা বেকার দেখে, চাঁদর টেনে ফয়সল, বেড সাইড ল্যাম্প অফ করে শুয়ে পড়ল।

কিছু কিছু সংসারে এভাবেই দিনরাত তাদের হাসি আনন্দ, ঝগড়া মতভেদ নিয়ে এগিয়ে চলে। তাদের গল্প কখনো শেষ হয় না, এগিয়েই চলতে থাকে

তানবীরা
১১/০৩/২০১২

Thursday 1 March 2012

সাগর আর রুনি

সাগর আর রুনিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। এ ঘটনা না ঘটলে কোনদিন তাদের নাম সেভাবে জানতাম কি না তাও জানি না। যদিও ফেসবুকে অন্যান্যদের স্ট্যাটাস আর কথোপকথন থেকে বেশ বুঝতে পারি, অনেকেই তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। আবছা আবছা ভাবে মনে পড়ে, হয়তো কোন টিভি কভারেজে কখনো মেহরুন রুনি শব্দটা শুনেছিলাম। তারা বিখ্যাত কিংবা সংবেদনশীল পেশার লোক হন বা না হন, সর্বোপরি তারা বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। দেশকে ভালবাসতেন, বিদেশের মোহ মায়া কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন।

আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আটচল্লিশ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন, ফলাফল জানাবেন বলে। সেই আটচল্লিশ ঘন্টা পর তন্ন তন্ন করে যতো দেশি সংবাদ সাইটে ক্লিক করেছি, আর কোনদিন কোন ব্যাপারে করেছি কী না জানি না। আর একবার ভীষন অস্থির ছিলাম বাংলাদেশের ওয়ান ইলাভেনের দিন। তবে এটুকু বলতে পারি রুনি-সাগর থেকে অনেক কম টেনশন ছিল সেদিন। ফেসবুকটা তন্ন তন্ন করেছি যদি কোন নোট পাওয়া যায় কিংবা খবর পাওয়া যায় যা সংবাদ মাধ্যমে আসেনি এখনো। আজকে অনেক দিন হয়ে গেলো। সবাই রহস্যজনকভাবে চুপ। বারবার একই আশ্বাস সরকারের, একই বুলি পুলিশ থেকে। কিন্তু কাজের বেলায় লবঘন্ট।

অথচ ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি বাংলাদেশ পুলিশ চাইলে পারে না এমন কোন কাজ নেই। তাহলে কি পুলিশ আন্তরিকভাবে চাইছেন না? নাকি তার পারছেন না। তারা হেরে গেছেন অপরাধীদের শাতিলতার কাছে। যদি না পারেন তাহলে তারা কেন বিদেশী এক্সপার্টদের সাহায্য নিচ্ছেন না? অতীতেও অনেক ঘটনায় বিদেশী সাহায্য নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও তারা হয়তো অনেক ব্যাপার সমাধানের জন্য বিদেশী এক্সপার্টদের সাহায্য নিবেন, তাহলে এখন নয় কেন? খুন হওয়া মানুষদুটো কি যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ন নন? নাকি এ ঘটনাটি যথেষ্ঠ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেনি দেশে? প্রধানমন্ত্রী – স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাক্তিগত তদারকি ও আশ্বাসের পরও এতোদিন ধরে শূণ্যগর্ভ ফলাফলে কি মনে এ প্রশ্ন জাগায় না যে

১. পুলিশ আসলে সব জানে। তারা মুখ খুলছেন না। কারণ অনেক বড় কোন রাঘব বোয়াল এর সাথে জড়িত। অনেকের গোমর ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা আছে।

২. তারা টাকা পয়সা দিয়ে পুলিশ - সরকার সব ম্যানেজ করে ফেলেছেন।

৩. পুলিশ অপেক্ষা করছে কখন পাবলিক সেন্টিমেন্ট থিতু হবে। এ অভাব যন্ত্রনার দেশে কার কথা কে কতোক্ষণ মনে রাখে। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে রুনি সাগর হারিয়ে গেলে, যাহোক একটা জজমিয়া নাটক মঞ্চস্থ করে দিবেন।

আমরা এখন কি করতে পারি? আমরা সেসব জনগন যাদের বেডরুমে নিরাপত্তা দিতে সরকার অপারগ বলে স্বীকার করেছেন। আমরা যারা হয়তো খুন হওয়ার অপেক্ষায় আছি আমাদের বেডরুমে তাদের এখন নিজেদের ভেবে ঠিক করতে হবে, আমরা নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তা কি করে নিশ্চিত করতে পারি? সাগর রুনি খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে সরে গেছেন। টিভির নিউজে অনেক শেষে চলে গেছেন। ব্লগেও প্রায় নেই। এভাবেই কি চলবে? আমি প্রস্তাব করবো খবরের কাগজে আগে যেমন প্রতিবাদের জন্য কলাম খালি রাখা হতো সেরকম ব্লগের একটা পোষ্টের জায়গা খালি রাখা হোক। যতোদিন সুস্পষ্ট বক্তব্য না আসে যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে, আমরা রুনি – সাগরকে হারাতে দিব না। আমাদের প্রতিবাদ আমাদের প্রচেষ্টা অব্যহত থাকুক।

তানবীরা
০১/০৩/২০১২

প্রসংগ ভারতীয় পন্য বর্জন

সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধের প্রসঙ্গে সরকার যখন বাণী দিলেন, সীমান্ত সমস্যা দুই সরকারের সর্ম্পকে কোন প্রভাব ফেলবে না। তখন বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে একথাটিকে অকেজো করতে সাধারণ মানুষজন এগোনোর কথা ভাবলেন। প্রতিবারই তাই হয়। সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি ব্যস্ত তাদের নিয়ে, জনগনকে তাদের অধিকার রক্ষার জন্যে নিজেদেরকেই রাস্তায় নামতে হয়। কিন্তু এখনতো রাস্তায় নেমেও কোন লাভ নেই। তাই তরুন সমাজ নতুন কিছু ভাবলো। প্রথমে কিছু ভারতীয় ওয়েবসাইট হ্যাক করলো আর সাথে ১লা মার্চ ভারতীয় পন্য বর্জনের সিদ্ধান্ত। অনেক বুদ্ধিজীবি মুরুব্বীরাই হাসছেন আমাদের এই বালখিল্যতায়। একদিনের পন্য বর্জন করে আর কি হবে? ভারত হলো পরাশক্তি। তাদের সাথে শক্তি বুদ্ধিতে পেরে ওঠা কি এতো সহজ?

না আসলেই সহজ নয়। তারা যে বুদ্ধিমান তা প্রমানে আজই এয়ারটেল বিজ্ঞাপন দিল, আজ রিচার্জ করলে দ্বিগুন লাভ। বাঁকা হাসি দেয়া বুদ্ধিমানদের জন্যেই লিখছি আজকে, একদিনের পন্য বর্জন একদিনেই থেমে থাকবে না। সচেতনতা – গনসচেতনতা তৈরী, নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া এগুলো একদিনেতো হয় না। এগুলো অভ্যাসের ব্যাপার। আজকের স্বাধীনতা একাত্তরের ফসল, যার বীজ রোয়া হয়েছিল ১৯৫২তে। শুরুতো কোথাও করতে হবে? তারপর দিন দিন প্রচারণা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যেনো সাধারণ মানুষ মনের অজান্তেই নিজের দেশি জিনিসের প্রতি হাত বাড়ায়। সর্বাংশে ভারতীয় পন্য হয়তো বর্জন করা সম্ভব হবে না। এতোটা স্বয়ংসম্পূর্নতো আমরা নই। আরো জানি ভারত মহাশক্তিধর। তাই বলে কি আমরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির পরিচয় ধরে রাখতে পারি না? মুড়ি মুড়কির মতো মানুষ মেরে ফেলার প্রতিবাদের প্রতিফলন কোথাওতো দেখাতে হবে। বাংলাদেশ ভারতের বড় বাজার। এখানের পন্য বর্জন ভারতকে অনেকদিকে ভাবাতে পারে। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে ভারতকে বাধ্য করার সময় এখন এসেছে। নইলে আজকের তরুনরা যে প্রতিবাদ শুরু করেছে দশ-কুড়ি-তিরিশ বছর পর এর মাশুল ভারতকে টানতেই হবে।

যারা বাঁকা চোখে ছেলেমানুষীপনা দেখে হাসছেন তাদের বলি, খোরগোশ চিরটা কালই দৌড়ে অনেক আগে চলে যায়। কিন্তু তাই বলে অতি কষ্টে, পরিশ্রমে, স্বমহিমায়, স্বস্থানে কচ্ছপের টিকে থাকার লড়াই এর গৌরবটা কিন্তু এতোটুকুও ছোট নয়। যতো তুচ্ছই হোক বিজয় কচ্ছপদের জন্যেই। আজকের ভারতীয় পন্য বর্জনের সাফল্যের সাধুবাদ জানাই। ভবিষ্যতের জন্য অগ্রীম শুভ কামনা রইলো।

তানবীরা
০১/০৩/২০১২