Sunday 27 June 2010

অহনার অজানা যাত্রা (সাত)

অহনা হল্যান্ডে আসার পর এক তরফাভাবে সবাই তার দোষ-গুন, জ্ঞান - বুদ্ধি আবিস্কার করে যাচ্ছিলো। নতুন পরিবেশের ধাক্কা সামলে একটু অভ্যস্ত হয়ে এখন সেও অন্যদের জ্ঞান বিজ্ঞান আবিস্কারে মনোনিবেশ করলো। প্রথম ছমাসের মধ্যে তার আবিস্কারের অর্জন হলো ডাচ লাইফ সমন্ধে অর্নের জ্ঞান। দেখা গেলো অর্নের সব জ্ঞানের ভান্ডার হলো তাদের অফিস সেক্রেটারী। শপিং, বেড়াতে যাওয়া, বাইরে কোথাও ডিনার করতে যাওয়া অথবা অফিসিয়াল কোন ব্যাপার মোটকথা নেদারল্যান্ডসের যেকোন সমস্যার সমাধান আসে সেখান থেকে। অর্ন নিজে এসব ব্যাপারে খুব একটা কিছু জানে না, অবশ্য তার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো অর্নের আগ্রহ একেবারেই নেই এসব ব্যাপারে। সে আছে তার অফিস, পড়াশোনা, কম্পিউটার, ছুটির দিনে সকালে দেরী করে ওঠা, ব্রেকফাষ্ট আর হয় না তখন হয় ব্রাঞ্চ, ব্রাঞ্চ খেয়ে আবার ঘুম, সন্ধ্যেয় ঘুম থেকে ওঠে টিভিতে ডিসকোভারী, ন্যাশনাল জিওগ্রাফ্রী চ্যানেল কিংবা সিএনএন দেখে আবার ঘুমানো এই তালে।

এদিকে এতোদিন হয়ে গেলো বিদেশ এলো একদিনও হিন্দী সিনেমার ষ্টাইলে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হলো না, ছবি তুলে দেশে পাঠানো হলো না অহনারতো প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা । অর্ন একদিন অহনার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে ঠিক বাঙ্গালীদের মতো লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক স্টাইলে তাকে নিয়ে আমষ্টার্ডাম, রোটারডাম আর ডেনহাগ ঘুরে এলো। অহনাতো চারপাশ দেখে মুগ্ধ, যা দেখে তারই ছবি তুলে। বুঝুক না বুঝুক ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। এই ক্লিক ক্লিক ক্লিক বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিলো। বেচারা অর্ন বউকে ভদ্রতায় কিছু বলতে পারে না যে এতো ক্লিক ক্লিকের দরকার আসলে নেই, বছর না ঘুরতে ঘুরতেই আজকের চমক ধমক অনেক সাধারণ হয়ে আসবে। অবশ্য সংসারের বহু কিছুতেই অহনার হুশ নেই। এটুকু অর্ন বুঝতো মাত্র বাড়ি ছেড়ে এসেছে সে, তার ধারনা নেই কিভাবে কি চলে। সেদিন শুধু আস্তে করে বললো, ছবি প্রিন্ট করতে আসলে অনেক টাকা যায়, বেছে বেছে তোল। এতেই অহনার মুখ লাল হয়ে গেলো। ক্যামেরা রেখে দিলো পাশে। যদিও অর্ন বহুভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো এরপর যে ও শুধু এটুকুই বলেছে, একটু বেছে বেছে তুলতে আর কিছু না, কিন্তু অহনা আর ক্যামেরা হাতে নিলো না।

সংসারের আয় ব্যয়, বাড়িভাড়া, গাড়ির খরচ কিংবা হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোন কিছু সমন্ধে যে অহনার কোন ধারনাই নেই তিন মাসের মাথায় সেটা অর্নের কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো। অহনা আসা মাত্র তাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে একটি ব্যাঙ্ক পাশ বানিয়ে দিয়ে অর্ন এটিমে টাকা তোলা শিখিয়ে দিয়েছিলো বটে। আর ভালোবেসে বলেছিল যখন যা দরকার হবে ইচ্ছেমতো খরচ করো। প্রথমে প্রথমে অর্নের সাথেই কেনাকাটা করতো কিন্তু পরে নিজের ইচ্ছেমতোও কিনতে লাগলো। শুধু কোন ধারনা নেই কতো খরচ করছে। আর কোন কারেন্সী খরচ করছে। টাকা ভেবে যেটা খরচ করছে সেটা আসলে টাকা নয়, ইউরো। অর্ন ভদ্রতায় কিছু বলতে পারছে না বটে কিন্তু তার জমানো টাকার ভান্ডার প্রায় শূন্য। বহুভাবে অর্ন তাকে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করছিলো। চলো একটা বাজেট বানাই। কতোটাকা তুমি এমনি শপিং করবে এটার একটা আইডিয়া রাখো মাথায়। কিন্তু যাহা আয় তাহাই ব্যায় মার্কা ব্যাবসায়ী পরিবারে বড় হওয়া অহনা বাজেট মার্কা কথা বইয়ে পড়েছে বটে কিন্তু নিজের জীবনে কোথাও তার প্রয়োগ দেখেওনি শোনেওনি। সে এককানে স্বামীর বোরিং লেকচার শোনে অন্যকানে ভুলেও যায় সাথে সাথেই।

কারেন্সীর পার্থক্য বোঝার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ধরনের ভুল বোঝাবোঝি মনে পুষে রাখতো অহনা। অর্ন ভদ্র সে বউকে দুঃখ দিতেও পারে না, মুখে বলতেও পারে না কিন্তু কি করে ম্যানেজ করবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না। অহনাকে একদিন অর্ন বললো চলো তোমাকে আমি একটা গিফট কিনে দেই। অহনা সারা মল খুঁজে একটা কার্ডিগান পছন্দ করলো, আড়াইশ ইউরো দাম। লজ্জার মাথা খেয়ে অর্নকে বলতে হলো, এখন এতো টাকা নেই, এখন একটা একটু সস্তায় পছন্দ করো, পরের মাসে বেতন পেয়ে তোমাকে এটা কিনে দিবো। তার সেটা খুবই প্রেষ্টিজে লেগে গেলো। বাবা তার একি সর্বনাশ করলেন। আড়াইশ টাকার কাপড় সে জীবনে হাত নিয়ে নেড়ে দেখেছে ঢাকা থাকতে? আর আজকে তাকে শুনতে হচ্ছে স্বামী আড়াইশ টাকার থেকেও সস্তা কাপড় পছন্দ করতে বলছে। এটা অনেক দাম! অহনা অনেক গম্ভীর হয়ে বললো, থাক পরেই কিনবো, এখন আর লাগবে না। অর্ন অনেক বুঝিয়ে অন্য একটা কাপড় কিনে দিলো তাকে। প্রমিস করলো যে সামনে মাসে অবশ্যই সেটা অহনাকে কিনে দিবে। পরদিন অর্ন অফিসে যাওয়া মাত্র বাবাকে ফোন করে তার ঝাড়ি। এরকম একটা কিপ্টে ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিলে, আড়াইশ টাকা যার কাছে এতো দাম লাগে? বাবা এতো দূর থেকে অহনাকে কারেন্সী নিয়ে লেকচার দিতে পারেন না। তিনি যা পারেন তাই বললেন, তোর কি কি লাগবে আমায় চিঠিতে লিখে দিস, আমি পোষ্টে পাঠিয়ে দিবো। এসব নিয়ে তুই অর্নের সাথে ঝগড়া করিস না। তাতে সে আরো রেগে গেলো, সে ঝগড়া করার মতো মেয়ে? ঠাস ফোন নীচে।

তবে বিদেশে ভালো ভালো অনেক ব্যাপারও আছে অহনা সেটাও স্বীকাত করে। এক সময় যে ক্যাডবেরীর জন্য অহনা অস্থির থাকতো সেই ক্যাডবেরীর ডাব্বা এখন হাতের মুঠোয়। একান্নবর্তী পরিবারে যদি একদিন ৫০০ টাকার ক্যাডবেরী কেনা হতো দেখা গেলো ছোট ভাইবোন বাবা চাচা দাদী আত্মীয় আশ্রিত সব ঘুরে মাত্র এক বা দুখানা ক্যাডবেরী হাতে এসেছে যা মুখে দিয়ে স্বাদ বোঝার আগেই শেষ। আর এখন অফুরন্ত ভান্ডার। কিংবা বারো টাকায় একটা মিনি সাইজের চিপসের প্যাকেট কিনেছে মাত্র বসেছে সেটা নিয়ে এসে দাড়ালো ছোট চাচাতো ভাইটা, বড় বড় মায়াবী চোখ তুলে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিপসের অনেকটাই হয়তো তাকে দিয়ে দিলো আর সেই চিপসের জাম্বো প্যাকেট এখন অহনার হাতে, আবদার করে, অহনা বাজি আর একটা, আর একটা করার এখন আর কেউ কাছে নেই। একটা চিপসের লোভ
দিয়ে ছোট ভাইদেরকে দিয়ে কতো ছড়া বলানো, অন্যদেরকে খেপানো কতো কি করাতো তখন অহনা। এখন এতো আছে কিন্তু সেই ক্যাডবেরী বা চিপসের সেই স্বাদ যেনো আর নেই। মনে হয় বড় ভাই বোনদের চড় চাপড় খাওয়া, সেই কাড়াকাড়ি করে খাওয়া দিন গুলোই যেনো ভালো ছিলো।

আগে ডিম ভাজা খেতে এতো ভালোবাসতো, মা কতো বকতেন এই ডিম খাওয়া নিয়ে, অহনা তখন ভাবতো দাড়াও যাচ্ছিতো হল্যান্ড, রোজ দিন তিন বেলা ডিম ভেজে ভেজে খাবো, কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। অথচ একদিনও এখন ইচ্ছে করে না ডিম ভেজে খেতে কি অদ্ভুদ মানুষের মন। এক সময় যে সমস্ত জিনিসের জন্য পাগল ছিল এখন সে সব কিছুর প্রতি আর কোন আগ্রহ জাগে না। যে স্বাধীনতার জন্য আগে তীব্র লালসা ছিল, সেই স্বাধীনতা পাওয়া হয়ে যাওয়া মাত্র স্বাধীনতার প্রতি সমগ্র আগ্রহ হারিয়ে গেলো। যতো রাত ইচ্ছে টিভি দেখো, কম্পিউটারে গেম খেলো কিংবা গল্পের বই পড়ো ডাক দেয়ার কেউ নেই। কারো পায়ের শব্দে এক মূহুর্তের মধ্যে সব লুকিয়ে ঘুমানোর ভান করার কিছু নেই তাই এখন আর রাত জাগার কোন আগ্রহও নেই। এগারোটা বাজলেই লেপ টেনে শুয়ে পরা। এখন থেকে থেকে মনে হয় আহা সে পরাধীন জীবনটা কতো মিষ্টি ছিল।

সামার শুরু হয়ে যাওয়ার পর ডাচ ক্লাশের ছুটি। আজকাল পড়াটরা নেই অহনা প্রায়ই তাই তার বাইক নিয়ে সিটি সেন্টারে চলে যায় আর অকারনেই দোকানে দোকানে ঘুরে উইন্ডো শপিং করে। ইউন্ডো শপিং করতে করতে বহু কিছু আবিস্কার করা শুরু করলো। প্রথম আবিস্কার করলো এক ঘন্টার ডেলিভারীর যে দোকানে থেকে তারা ছবি প্রিন্ট করায় সেটা থেকে ছবি প্রিন্ট করলে অনেক দাম নেয় বটে কিন্তু অনেক দোকানে আছে সুপারমার্কেটে যেখানে তিনদিন পর ছবি ডেলিভারী নিলে খুবই সস্তায় ছবি প্রিন্ট করানো যায়। এ আবিস্কারের আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে সে বাসায় এলো। দ্বিতীয় আবিস্কার ছিলো ফ্ল্যাটের কাছের যে সুপারমার্কেটে তারা রোজকার গ্রোসারী করে সেটা বেশ দাম, একটু দূরে গেলেই এর অর্ধকে দামে অন্য সুপার মার্কেটে তাদের গ্রোসারী হয়। তৃতীয় আবিস্কার ছিল যে ফ্ল্যাটে তারা থাকে সেটি প্রাইভেট এজেন্সী থেকে ভাড়া নেয়া, সরকারী অফিস থেকে বাড়িভাড়া করলে এর অর্ধেক দামে ফ্ল্যাটের বদলে আস্ত বাগানসহ বাড়ি পাওয়া যাবে।

মাত্র ছ’মাসের মধ্যে অর্নের অনেক আবিস্কারকে ভুল প্রমানিত করে অহনা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠল। অর্ন থাকতো অফিসে কিন্তু অহনা রাস্তায় থেকে থেকে ডাচ জীবন আবিস্কারের নেশায় মস্ত হয়ে গেলো। এর থেকে এই ইনফর্মেশন যোগাড় করাতো তার কাছ থেকে সেটা। এক অফিসে কোন দরকারে গেলে অন্য দশদিকের দিক নির্দেশনা তারা দিয়ে দেয়। নতুন অভিবাসীদের সাহায্য করার মানসিকতাও তখনও তাদের মধ্যে ছিল। সরকারী অফিসে বাড়িভাড়ার বিরাট কিউ থাকে। সাধারনভাবে তিন বছর লাগে একজনের বাড়ি পেতে। অহনা অফিসে গেলো, ফর্ম তুললো এবং ডাচ ডিকশনারী হাতে করে ফর্ম ফিলাপ করতে বসে গেলো একা একাই। অর্ন আনন্দ পাচ্ছে, অহনার ব্যস্ততা দেখে। সে এসবে নাক গলালো না, যা ইচ্ছে করুক প্লাস কিছু পয়সা বেঁচে গেলে কার না ভালো লাগে। মাঝে মাঝে নিজের গোঁফে তেল দিয়ে অহনা বসে পড়তো অর্নের কাছে, বাড়িভাড়ার অর্ধকে টাকা বেঁচে গেলে ওরা প্রথমে কি প্যারিস যাবে না রোম না লন্ডন সেই আলোচনা করতে।

(চলবে)
তানবীরা
২৭.০৬.১০




Monday 14 June 2010

অহনার অজানা যাত্রা (ছয়)

এক দেড় সপ্তাহ সাইকেল নিয়ে কোস্তাকুস্তি ধস্তাধ্বস্তি, সাইকেল থেকে পরে হাত পা থ্যাতলানো শেষ করে অহনা সাইকেল মোটামুটি আয়ত্ব করে ফেললো। সাইকেল শিখে ফেলা তাকে এক ধরনের স্বাধীনতা এনে দিলো। বৃষ্টি না থাকলে ঝকঝকে রোদে সে প্রায়ই তার পছন্দমতো ড্রেসআপ করে সানগ্লাস চোখে কখনো কখনো মাথায় ম্যাচিং কিংবা স্পোর্টস টুপি পরে তার সেকেন্ডহ্যান্ড পঙ্খীরাজ নিয়ে এদিকে সেদিকে মনের আনন্দে ঘুরতে লাগলো। সাইকেল হল্যান্ডের প্রধান বাহন। পুরো হল্যান্ডে সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা রাস্তা আছে, লাল রঙের কার্পেটিং করা। যেগুলো রিঙ রোড (শহরের প্রধান সড়ক) সেখানে সাইকেল চালকদের জন্য রোডের সাইড থেকে সাইকেল চিহ্ন দিয়ে রাস্তা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। অনেক বেপোরোয়া না হলে এক্সিডেন্ট হওয়ার সুযোগ খুব কম। আর এক্সিডেন্ট হলেও একশত বারের মধ্যে নিরানব্বই বার সময় দোষী হন গাড়ি চালক। নেদারল্যান্ডসের গঠনই দুর্বলকে রক্ষা করা তাই যে পরিস্থিতিই হোক না কেনো, গাড়িওয়ালা কেনো সাইকেলওয়ালাকে ধাক্কা দিলো সেটাই হলো দোষ। সাইকেলওয়ালারা এই সুযোগটার পূর্ন সদ্বব্যবহার করেন, লাল লাইট মানেন না, তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া লাইন মানেন না ফুস করে গাড়ির সামনে দিয়ে বের হয়ে যান আর গাড়ি চালকরা তাদেরকে বকতে বকতে গাড়ি চালান। ধাক্কা লেগে গেলে ইন্স্যুরেন্সের পয়সা ভরতে ভরতে গাড়িওয়ালার সারা জীবন কয়লা হয়ে যাবে, তাই তারাও গাড়ি চালানোর অপরাধে অন্যনোপায় হয়ে থাকেন।

অহনাকে এতোদিন সবাই দেখেছে সোশ্যাল গেটটুগেদারে, শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরা অর্নের সাথে, তার বউ হিসেবে। এই পশ্চিমা কাপড় পরা, সাইকেল নিয়ে টো টো করা অহনা তাদের অজানা ছিলো। শহরে থাকা পুরনো বাঙ্গালী বাসিন্দারা যারা মসজিদের মাহফিল, বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনা নেয়া, ডাক্তার আর সুপার মার্কেটের বাইরে মেয়েদের কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে তা জানতেন না। তাও আবার স্কার্ট টপস কিংবা জীন্স টিশার্ট পরে তারা প্রথমে রাগে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। হারাম হালালের বালাই নেই, ম্যাক থেকে বার্গার কিনে খায়। বাংলাদেশের আবার মুসলমানের মেয়ে সাইকেল নিয়ে ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেশের মানসম্মান সব ধূলোয় মিটিয়ে দিচ্ছে, একি করে সহ্য করা যায়? বাংলাদেশের কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে অহনা হুমকির মুখে ফেলে দিলো। ঈমান ধর্মতো আর রক্ষা করা যায় না। প্রথমে তারা কায়দা করে নানা ইশারা ইঙ্গিতে অহনার চালচলন ইসলামিক করার চেষ্টা করলেন তারপর বাগে আনতে না পেরে তাদের বউদেরকে অহনার সাথে মিশতে বারন করে দিলেন। মজার ব্যাপার বার্গার অর্নও খায় কিন্তু সেটা দোষের না। অহনা সবার কাছে ডবল দোষে দোষী হলো, কারন সে স্বামীকে সুপথে ফিরিয়ে আনার বদলে নিজেই কুপথে ঝাপ দিলো।

অহনা সদ্য দেশ থেকে আসা, ধরতে গেলে তাদের বাচ্চা কাচ্চার সমবয়সী। মোটামুটি হাসি খুশী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, মুরুব্বীদের যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা করেই কথা বলে সে। মহিলা কিংবা পুরুষ কারোই অহনা সর্ম্পকে অন্য কোন বিরক্তি ছিলো না শুধু এই পোষাক আশাক আর ঘোরাঘুরি আর হালাল খাবার ছাড়া। তবুও অনেক আন্টিই তাদের বরকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে সাঝে অহনার খোঁজ খবর নিতেন। রান্না করা খাবার দাবার পাঠাতেন। শুধু বাসায় এসো এটাই বলতে চাইতেন না। এই সীমিত যোগাযোগ অহনার জীবনে সাপে বর হয়ে দেখা দিলো। কারো বাসায় যেমন যাওয়ার নেই কাউকে বাসায় ডাকারও নেই। অহনার হাতে অফুরন্ত সময়। ডাচ টিভি, তুর্কী টিভি, জার্মান বিবিসি কোনটাই আর্কষনীয় লাগে না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফী, ডিসকোভারী কিংবা এমটিভি দেখে আর কতোক্ষন কাটানো যায়? এতো সাধের এমটিভি বিদেশে এসে পানসে মেরে গেলো। সে তার ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাশের বই উলটে পালটে চাল্টে পড়তে লাগলো। পড়াশোনা করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার নেই সারাদিন কিংবা সন্ধ্যা রাত ভর। অর্নের অফিস আছে তার সময় কম কিন্তু অহনার সময়ই সময়।

ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাশের প্রথম পরীক্ষার পর অহনাকে মোটামুটি গ্রুপ থেকে বেষ্ট গ্রুপে তুলে দেয়া হলো। সে সময় নেদারল্যান্ডসে যাদের রেজাল্ট বেশ ভালো ছিলো তাদের নাম স্কুল থেকে ক্যারিয়ার গ্রুপের কাছে রিকোমেন্ড করা হতো। ক্যারিয়ার গ্রুপ তাদের সাথে যোগাযোগ করতো, তাদের আগ্রহ থাকলে তাদের ইন্টারভিউ নিয়ে জানতে চাইতো ভবিষ্যতে সে কি করতে চায়? বিনা পয়সায় তাদেরকে পড়াশোনা করার সুযোগ এবং চাকরী খুঁজে দিতো। এই সুযোগটা এখনো আছে তবে অন্য ফর্মে। সেই সময় মাঝ পথে কেউ পড়া থামালে কোন জরিমানা হতো না, আজকাল জরিমানা করা হয়। অনেকেই এসুযোগ হেলাফেলায় নষ্ট করেছেন বলে আজকাল ক্যারিয়ার গ্রুপ এবং সরকার দু’পক্ষই বন্ড সই করান যে গর্ভ ধারন করলেও কোর্স শেষ করতে হবে অন্যথায় জরিমানা সহ পয়সা ফেরত দিতে হবে। সেই থেকে অহনার বিনা পয়সায় পড়ার রাস্তা খুলে গেলো। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

পড়াশোনা নিয়ে তুমুল ব্যস্ততা থাকলেও মাঝে মাঝে একা লাগতো অহনার। চরম আড্ডাবাজ স্বভাবের মেয়ে সে, যৌথ পরিবারে বড় আর এই বিভূইয়ে একদম একা। এর চেয়ে কঠিন শাস্তি তার জন্যে আর কি হতে পারে? দোষ অহনারও অনেক। সে কারো সাথে ঠিক বন্ধুত্ব করে ওঠতে পারছিলো না। দ্রুত রেগে যায় যদিও পরক্ষনে রাগ সে ভুলে যায় কিন্তু পরের সাথেতো ঘরের ব্যাপার আর চলে না। আর এই বিদেশে থাকা মহিলারাও জানি কেমন। অনেকেই ফ্রী হওয়া সত্বেও সাধারন ভাষাটুকু পর্যন্ত শিখেননি। অজুহাত দেন বাচ্চা কাচ্চা দেখে সময় করে ওঠতে পারেননি, সংসারের ঝামেলায় পারেননি ইত্যাদি। মেয়েরা পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্বেও বিজনেক এ্যাডমিনিশট্রেশন কিংবা ডাক্তারী পড়তে মেয়েকে বাইরে পাঠাবেন না। শহরে যে ইউনিভার্সিটি আছে তাতে যে সাবজেক্ট সেটাতেই পড়তে হবে, যোগ্যতা আর সাবজেক্ট থাকা সত্বেও বাইরের শহরে মেয়েদেরকে পড়তে পাঠাবেন না, ছেলেরা হলে ঠিকাছে। ঠিক করে বাংলা বুঝতে পারে না এমন মেয়েদেরকে আঠারোর কাছে পিঠে দেশে নিয়ে ভাশুরের ছেলে কিংবা ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আনবেন। মেয়েকে কোন বিদেশী ছেলের সাথে কোন ধরনের অঘটন ঘটানোর সুযোগ দিবেন না। বিয়ের ব্যাপারে অবশ্য ছেলেদের বেলায়ও তারা সজাগ কিন্তু তাদের ব্যাপারে মনোভাব নমনীয়। অহনা বাংলাদেশে বাংগালী মেয়েদের যে দূরবস্থা চিন্তা করতে পারে না সেটা এখানে হরদম ঘটছে।

এধরনের আন্টি কিংবা ভাবীদের সাথে কথা বলতে গেলে অহনার মধ্যে এক ধরনের কমপ্লেক্স শুরু হয়ে যায়। তাদের জীবন ঘোরে অন্যের চাকায়। মাইনাস শীতের মধ্যে উলেন বা নিদেন পক্ষে জীন্স না পরে তারা সালোয়ার কামিজ পরে বাইরে চলাফেরা করেন। কারন তাদের বরেরা পছন্দ করে না, তাই ইসলামী লেবাস করতে হবে। ঐদিকে বরেরা কিন্তু দিব্ব্যি কাফেরী লেবাস মানে উলেন প্যান্ট, গলা বন্ধ সোয়েটার পরে চলাফেরা করছেন। রান্না করেন তাদের বর যা পছন্দ করেন, টিভি দেখেন বরের যে প্রোগ্রাম পছন্দ সেটা। সবকিছুই কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বলার সময় তারা এভাবেই বলেন যেনো অহনার গায়ে সেটা একটু হলেও লাগে। অহনা কি তাহলে খারাপ বউ? তার যা খেতে ইচ্ছে করে সে অর্নের পছন্দের সাথে সেটাও রান্না করে। তার যা পরতে ইচ্ছে করে কিনে পরে। অর্নের মতামত অবশ্যই সে নেয় কিন্তু অনুমতি নেয়া নয় সেটা মোটেই। সে সব ব্যাপারেই তার বরের সাথে আলোচনা করে, যেকোন জিনিসের পজিটিভ এবং নেগেটিভ দিক নিয়ে আলোচনা হয়, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু অর্ন কোন কিছুই তার ওপর চাপায় না। তার মধ্যে সংসার সম্বন্ধে অপরিপক্কতা আছে জানা সত্বেও অর্ন তার মতামতকেই প্রাধান্য দেয়, তার পছন্দকেই গুরুত্ব দেয়। তার সংসার তার ইচ্ছে মতোই হোক এ ভাবনা অর্নেরও।

একা একা দেশ থেকে দূরে, বহু কারনেই অহনার মন খারাপ থাকতো। কেউ ফোন করে যদি দেখতো অহনার মন খারাপ সমানে প্রশ্ন করতো, ভাই কি কিছু বলছে? তাইলে মন খারাপ কেনো? ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে? এর থেকে বিরক্তিকর আর কিছুই নেই। তার সব মন খারাপ বা ভালোর সাথে অর্নকে জড়িয়ে ফেলার একটা প্রানান্ত চেষ্টা সকলের মধ্যে কাজ করে। যেনো বিয়ে হয়েছে বলে অর্নের সাথে ঝগড়া না হলে অহনার জীবনে মন খারাপের আর কোন কারনই থাকতে পারে না। তাকে পাস করে সবকিছু অর্নকে জড়িয়ে যায়। রাগে একবার ভাবলো এরপর থেকে কেউ যদি বলে গলা এমন কেনো, ও বলবে আমার মাথা খারাপ। মনের সাথে বরকে জড়ানো গেলেও মাথার সাথে আশাকরি কাউকে জড়ানো যাবে না। নিশ্চয় কেউ প্রশ্ন করবে না, মাথায় কি ভাই লাঠির বারি দিলো নাকি? মাঝে মাঝে অহনা অনুভবও করতে পারে, তাদের জীবনের মতো তার জীবনও কেনো বরের মর্জি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, তার একটা পৈশাচিক জিদ কাজ করে অনেকের মধ্যে।

অর্নকে এসব বলতে গেলেই সে হাসে আর বলে ওরা নিজেরা পরাধীন জীবন যাপন করছেন সারা জীবন ধরে, তোমার স্বাধীনতা তারা সহ্য করতে পারছেন না। এসব বাদ দিয়ে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হও। বলে এসব ফোনের পিছনে এতো এনার্জী খরচ না করে কম্পিউটার শিখো, ইংরেজি আরো ভালো করে প্র্যাক্টিশ করো। নিজেকে তৈরী করো ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ভালো কথা কোনদিনই অহনার ভালো লাগে না। সে থাকে তার প্যাচালের ভাবনায়। ও এটা কেনো বললো, সে এটা কেনো করলো। অর্নকে বিরক্ত করতে করতে সে পরে মাকে ফোনে বলা শুরু করলো। আম্মি আমাকে কেনো ও এটা বললো, আমাকে কেনো সে ওটা বললো। আম্মি বিরক্ত হয়ে হয়ে ফোনে বললেন একদিন, খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনাকে রোজ যে পরিমান গালি মানুষ দেয় তাদেরতো তাহলে মিনিটে মিনিটে আত্মহত্যা করতে হতো। তারা কি শোনে? তুই শুনিস কেনো এগুলো?ওরা যেমন নিজের কাজ করে যাচ্ছে, তুইও তোর নিজের কাজ করতে থাক।

(চলবে)
তানবীরা
১৪.০৬.১০


এই পর্বটি ব্লগার শাওন আর মীরকে উৎসর্গ করা হলো। তাদের পুনঃ পুন তাগাদার কারনে ভাত না খেয়ে রান্না না করে আমাকে টাইপ করতে হলো।

.

Saturday 5 June 2010

অহনার অজানা যাত্রা (পাঁচ)

বিদেশ মানে সুন্দর সুন্দর ছবির মতো বাড়ি, বাড়ির সামনে বড় লন যাতে নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। ফুলের ওপর বর্ণিল প্রজাপতি উড়ছে। দামী গাড়িতে করে হাওয়া খেতে খেতে আজ এদিকে কাল সেদিকে বেড়াতে যাওয়া। ভালো রেস্টুরেন্টে ইকরি মিকরি নামের খাবার দিয়ে মোমবাতির আলোয় ডিনার করা, এই প্রাক রোমান্টিক ধারনাকে সর্বাংশে মিথ্যে করে দিয়ে অহনার জীবনে বিদেশ ধরা দিল কঠিন পার্বত্য জীবনের রূপে। অহনার কাছে বিদেশ মানে বাসে করে ডাচ স্কুলে যাওয়া, ভিন্ন ভাষায় লেখা ও অপরিচিত মোড়কে রাখা জিনিসপত্র থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস বাজার করা এবং সে বাজার টেনে বাসায় আনা। রান্না করা, কাপড় ধোয়া এবং ইস্ত্রি করা, বাড়িঘর ডাষ্টিং করার রূপ নিয়ে। অতি অল্প দিনেই হাঁপিয়ে উঠলো অহনা। ইউনিভার্সিটির অবাধ ঘোরাঘুরি, ফুচকা, ঝালমুড়ি, মামা হালিম, গাওছিয়া, ইষ্টার্ন প্লাজা, মহিলা সমিতি সবকিছুর জন্য সে অধীর হয়ে উঠলো। পুরনো দিনের জন্য ব্যাকুল সে প্রায়ই কান্নাকাটির এক শেষ করতো। বাজারে তখন নতুন ফোন কার্ড এসেছে, সস্তায় দেশে কথা বলা যাবে। অর্ন অহনার জন্যে টেলিফোনের কার্ড কিনে আনতো, ভাবতো দেশে সবার সাথে কথা বললে হয়তো একটু ভালো থাকবে। কার্ডে দেশে ফোন করা আর এক ঝক্কি। মনে হয় যেনো ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ওয়্যারলেসে কথা হচ্ছে। শব্দ আসে, আসে না, অর্ধেক শোনা যায়, অর্ধেক শোনা যায় না।

অহনার মা এতো ধৈর্য্য রাখতে পারেন না। মেয়েকে তিনিও অনেক মিস করেন। তাই তিনি প্রায়ই টিএন্ডটিতে বুকিং দিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলেন। একদিন মাঝ রাতে তার মায়ের কাছে ফোন এলো টিন্ডটি থেকে, প্রস্তাব দিলো তিনি চাইলে অহনার সাথে ফোনে কথা বলতে পারবেন প্রতি পনর মিনিট, বাংলাদেশি টাকায় চারশত টাকা। মা ঘুমের মধ্যে হ্যা না বলতে বলতেই তারা তাকে অহনার সাথে ফোনে ধরিয়ে দিলো। এহেন স্বর্গীয় প্রস্তাব ও ঘটনা থেকে অহনার মা আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। ফোন বিল এক ধাক্কায় অনেক কমে গেলো। এরপর এটা অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিনত হলো, প্রত্যেক সপ্তায় বাংলাদেশ সময় রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে মা অহনাকে ফোন করতেন। প্রত্যেক ফোনেই পরের সপ্তাহের ফোনের তারিখ জানিয়ে দিতেন। অহনাও তীর্থের কাকের মতো দিনক্ষন দেখে ফোন নিয়ে বসে থাকতো। এ লাইনে পরিস্কার কথা শোনা যেতো যেনো পাশের ঘরে মা বসে আছেন। শুধু একটা অসুবিধা হতো, ভাইবোনেরা পরদিনের স্কুল কলেজে যেতে হবে সে কারনে রাতে ঘুমাতো বলে, মা বাবা ছাড়া আর কারো সাথে এফোনে কথা হতো না। এঘটনা অনেকদিন চলছিল।

আস্তে আস্তে বরফ কেটে সূর্য উঁকি দিলো। চারধারে রঙ বেরঙের টিউলিপগুলো মাথা তুলে দাড়াতে থাকলো। অহনার এই পরিস্কার আকাশ দেখলেইন বাইরে যেতে ইচ্ছে করে। সারাজীবন সে শুনে এসেছে বাংলাদেশ ভীষন সবুজ। বিদেশীরা বাংলাদেশে বেড়াতে এলে এই সবুজের প্রশংসা করে যান। কিন্তু এখন অহনার মনে হতে লাগলো, হয়তো বাংলাদেশে প্রশংসা করার মতো আর কিছু খুঁজে পান না তারা তাই সবুজ বলে যান। আসলে সবুজতো এই দেশ। ঘাস, গাছ, ফুল, লতা পাতা গুল্ম দিয়ে কি বাড়ি, কি রাস্তা, কি শপিং মল সব যেনো একদম সাজানো। এর মাঝ দিয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে একা একা হেটে যেতে তার খুবই ভালো লাগে। আর এখন এখানে রাত এগারোটা অব্ধি আলো থাকে। অফিসের পর লেকের পাশে পার্কে প্রচুর লোক লেকে ছিপ ফেলে বই নিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে সেটাও দেখতে ভালো। মাথায় টুপি, পাশে মৃদ্যু লয়ে গান বাজছে, কুকুরটা শান্ত হয়ে মনিবের কাছে বসে আছে আর তারা ছিপ ফেলে নিবিষ্ট মনে বসে আছেন। মজার ব্যাপার হলো এতো ঘন্টা অপেক্ষা করে যে মাছটি তারা তুলেন পানি থেকে, তাকে দেখে, তেমন বড় হলে অন্যদেরকে দেখিয়ে ছবি তুলে আবার পানিতে ছেড়ে দেন। যদিও মাছ ধরার জন্য পয়সা দিয়ে তারা লাইসেন্স নেন কিন্তু কে খাবে এতো বড় মাছ, কি করবেন, তাই প্রান নষ্ট না করে পানির মাছকে আবার পানিতেই ফিরিয়ে দেন। বসন্ত আসার পর এদেশটাকে ঠিক তার আর ততোটা অসহ্য লাগছিলো না।

অফিসের পরে অর্ণ সপ্তায় দুদিন ডাচ ক্লাশ করে যখন রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে তখন সে প্রায় বিধ্বস্ত। কিন্তু অহনার একা ঘুরে বেড়ানোর সমস্যা অন্য জায়গায়। মোটামুটি আধুনিক এই ফ্ল্যাটের দরজায় ডাবল লক দেয়া। এক লকের চাবি মিলে দ্বিতীয় লকে যাবে তবে দরজা খুলবে। চাবির খাঁজগুলো সেভাবেই কাটা। যেটা প্রায়ই তারজন্যে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এতো ওজনের চাবি ধরে প্রথম তালা খুলে তারপর দ্বিতীয় তালা পর্যন্ত যাওয়া অহনার অনেক সময়ই সম্ভব হতো না। চাবি লকের ভিতরে ঢুকিয়ে নাড়ানাড়িই সার হতো তার। এই শীতের মধ্যেও সে ঘেমে ওঠে। অপেক্ষায় থাকতো কেউ যদি কোন কারনে সিড়ি দিয়ে ওঠে নামে, তাকে বিপদগ্রস্থ দেখে সাহায্য করে। অহনাদের পাশের ফ্ল্যাটে সেসময় একজন ডাক্তার থাকতেন, যিনি অনেক সময়ই রাতের ডিউটি শেষ করে দিনে বাসায় ঘুমাতেন, তিনিই ছিলেন শেষ ভরসা যার ঘুম নষ্ট করিয়ে দিয়ে অহনা বাড়িতে ঢুকতে পারতো। প্রথম যেদিন এই ঘটনা ঘটলো অহনা অর্নকে বলতে গেলো তার এই দুর্ভোগের কথা। অর্ন তার কথা শুনে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখানোতো দূরে থাক আরো চোখ কপালে তুলে এমন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো যে সে অন্য কোন গ্রহ থেকে এইমাত্র নেমে এসেছে। খরখরে গলায় বললো অহনাকে, ইউনিভার্সিটি পড়া মেয়ে তুমি একটা লক খুলে ভিতরে ঢুকতে পারো না, এ গল্প করতে তোমার লজ্জা করছে না। অহনার খুবই লজ্জা করতো সেটাও যেমন সত্যি আবার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে পারত না সেটাও ছিল সমান সত্যি। আর এ সমস্ত ব্যাপার অর্নকে বলতে গেলে অর্ন চরম বিরক্ত হতো সেটা তার চেয়ে বড় সত্যি। কাউকে বেল করে, তার সাহায্য নিয়ে দরজা খোলা স্বামীর চরম অপছন্দ জানা সত্বেও কখনো কখনো অনন্যেপায় হয়ে অহনা পাশের ফ্ল্যাটেই বেল টিপতো। তিন চার মাস চাবি নিয়ে ধস্তাধস্তির পর এক সময় অহনা নিজেই ডবল লক খোলা ম্যানেজ করতে শিখল।

কনকনে শীত কেটে উত্তর সমুদ্রের কাছে অবস্থিত এই টিউলিপ ভূমি এখন সূর্যের রঙ মেখে উত্তাল। এতোদিন বাসায় বসে বসে অনবরত টিভি দেখে দেখে আর গল্পের বই পড়ে ক্লান্ত অহনা। ইউনিভার্সিটি নেই, পড়াশোনা নেই এমন জীবনে কোনদিন অভ্যস্তই ছিল না সে। অর্ন ব্যস্ত তার অফিস নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে, অহনার কি শুধু আকাশ দেখে দেখে সময় যেতে চায়? অপেক্ষা করে থাকতে হয় কখন শনিবার রবিবার আসবে, অর্নের সাথে একটু কোথাও বাইরে যাওয়ার কিংবা গল্প করার সুযোগ পাবে। কিন্তু দেখা যায় তাও সব সময় হতো না, সারা সপ্তাহ অফিস করে ক্লান্ত অর্ন হয়তো তখন একটু বিশ্রামের জন্য আকুপাকু করছে। সারাক্ষন বাসায় থেকে খেয়ে তাজা সে আর কর্মক্লান্ত অর্ন এ হলো সংসার স্ট্যাটাস। যদিও ডাচ ভাষা শেখার ক্লাশ জয়েন করতে পেরে সে মোটামুটি বেশ আনন্দিত, এতোদিন যেনো কোন এক বিচ্ছিন দ্বীপে ছিল, লোকালয়ের সংস্পর্শে আসাতে সে অভাব পূরন হলো। ভাষা শিক্ষার কোর্স মেটেরিয়ালও বেশ ভালো ছিল, নবাগত লোকজনদেরকে নেদারল্যান্ডসের কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে সাথে রোজকার জীবনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এর মাধ্যমে। ক্লাশের অন্যদের সাথে বেশ দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেলো, নেদারল্যান্ডসের সংস্কৃতি আলোচনার পাশাপাশি অন্যদেশীয় সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা হতো।

বই পড়া কেতাবী জ্ঞানের থেকে চাক্ষুস জ্ঞান অর্জন অনেক আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, হয়তো কোনদিনের পড়ার বিষয় ছিল, খাদ্যাভাস। সেখানে নেদারল্যান্ডসের লোকেরা সাধারনত কোন বেলায় কি ধরনের খাবার খায় সে আলোচনার পাশাপাশি, অন্য দেশের লোকেরা সকালে, বিকেলে, রাতে কখন কি খায় সে আলোচনা হতো কিংবা সে দেশের প্রধান খাবার কী এবং কেনো ইত্যাদি। এভাবে ডাচ কালচারের পাশে পাশে রাশান, ইরাকী, তুর্কী, সোমালিয়া সব দেশ সম্পর্কেই কম বেশি জানা হতো। অহনা বাংলাদেশের খাদ্যভাসের কথা বলতেই টীচার টাশকিত। কি করে কোন দেশের লোক প্রত্যেক বেলায় গরম খাবার খেতে পারে, তাও এমন একটি বিশ্বনন্দিত গরীব দেশ। আমাদের দেশে সকালে রুটি - ভাজি কিংবা পরটা - মাংস নাশতা, কিন্তু পশ্চিমে সেটা রাতের খাবার। এর একটা বাস্তব দিকও আছে ভরপেট এতো খেলে শরীরে আলস্য যেমন আসে তেমনি প্রতিবেলায় এধরনের খাবার তৈরী করার সময়ও এদেশের লোকের হাতে থাকে না।

শুধু ডাচ কথা নয়, ডাচ জীবনে মানিয়ে নেয়ার জন্য অহনা সাধারণ ডাচ লোকদের মতো সাইকেল চালানোও শিখতে লাগল। কাওকে যদি বলা হয় পাঁচটি শব্দের দ্বারা নেদারল্যান্ডসকে বর্ননা করো তাহলে সে হবে, সাইকেল, উইন্ডমিল, দুধ -চীজ, খাল - বিল আর টিউলিপ। এদেশের লোকের সংখ্যা পনর মিলিয়ন কিন্তু কথিত আছে পনর মিলিয়ন লোকের জন্য আঠারো মিলিয়ন সাইকেল আছে। প্রতিটি বাড়িতেই প্রতিটি লোকের সাইকেল আছে, সে চালাক বা না চালাক। যদিও এরা প্রত্যেকেই সাইকেল চালায়। সাইকেল যেহেতু তাদের প্রধান বাহন তাই প্রতি বাড়িতেই দু একটা রিজার্ভ সাইকেল থাকে বিপদের সময়ের জন্যে। পরিবেশের জন্য মানুষের ভালোবাসা কি অকৃত্রিম হতে পারে তা এ জাতির থেকে শিক্ষনীয়। বাড়ির দরজায় গাড়ি লক করে রেখে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুন্দর পরিবেশ উপহার দেয়ার জন্যে সাইকেল চালিয়ে সাধারনত দৈনন্দিন কাজ সারে। সাথে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ব্যায়ামটাও হয়ে যায়। ডাচ শেখা আরামের ছিল কারণ তারা দুজনেই ডাচ বলতে পারত না তাই ভাষার ব্যাপারে দুজন দুজনার ওপর নির্ভরশীল কিন্তু সাইকেল শেখা নিয়ে অর্ন অহনার উপর চড়াও হয়ে পড়ত। এভাবে কেনো সাইকেল কাঁপছে, কেনো পড়ে পড়ে যাচ্ছো, সাইকেল চালানো কি এতো কঠিন যে এতো সময় লাগবে, দু ঘন্টায় লোকে সাইকেল চালানো শিখে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে অহনা দেখল অর্ন পাশে থাকলেই সাইকেল নিয়ে অহনা পড়ে যায়, নইলে একা একা সে বেশ ভালোই ম্যানেজ করতে পারে।

তানবীরা
০৬.০৬.১০
(চলবে)

Wednesday 2 June 2010

কেউ কথা না রাখলেই বা কী

কেউ কথা রাখেনি উনচল্লিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি

জন্মের আগে বংগবন্ধু তার আবেগঘন ভাষণে বলেছিলেন
আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদেরকে স্বধীনতা দিবো।
রক্ত দিলাম, জীবন দিলাম, সম্মান দিলাম
কিন্তু সেই অভীষ্ট স্বাধীনতা আজো এলো না, উনচল্লিশ বছর অপেক্ষায় আছি।

ভোটের আগে বড়আপা বলেছিলেন, আর কিছুদিন অপেক্ষা করো, তোমাদেরকে আমি বিদ্যুতের কষ্ট থেকে মুক্তি দিবো
বড়আপা আমি আর কতো অপেক্ষা করবো
বিদ্যুতের অভাবে যেদিন এসি বন্ধ হয়ে, ফ্যান বন্ধ হয়ে, আইপিএস বন্ধ হয়ে আমার মেকাপ গলে, চামড়ায় ফুসকুড়ি বেরোবে, তারপর তুমি আমায় বিদ্যুত দিবে?

একটাও দামী গাড়ি চড়তে পারিনি কোনদিন
মার্সিডিজ, ক্যাডিলাক দেখিয়ে দেখিয়ে চড়েছে ম্যাডামের ছেলেরা
বাবা আমাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিলেন দেখিস একদিন তোরাও
বাবা এখন বৃদ্ধ, আমাদের চড়া হয়নি কিছুই
সেই মার্সিডিজ, সেই ফেরারী, সেই ক্যাডিলাক
আমাদের কেউ কোনদিন চড়তে দিবে না

মুখের মধ্যে সুগন্ধী ক্রীম মেখে দাদু বলেছিলেন
যেদিন তোমরা হাবিবের পার্সোনায় যাবে
সেদিন তোমাদের চামড়াও এই আমার মতো টাইট হবে
সৌন্দর্য রক্ষার জন্য আজ আমরা হাতে নিয়েছি আড়ংয়ের নিম সাবান
অনন্ত টাকা খরচ করছি ওমেন্স ওয়ার্ল্ডে
তবুও কাজ হচ্ছে না কিছুই, চামড়া এখনো খুলন্ত

উনচল্লিশ বছর কাটল কেউ কথা না রাখলেই বা কী

তানবীরা
০২.০৬.১০