Sunday 25 February 2018

বায়োস্কোপঃ পদ্মাবত

বানশালি’র ফিকশন সিনেমা “পদ্মাবত” নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে নানা আঙ্গিকে নানা স্তরে। নানা মানুষ নানা মত দিচ্ছেন। নারীবাদী’রা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, সাধারণ মানুষ যারা সিনেমা আর বাস্তবতার তফাৎ বোঝে না তারা পদ্মাবতীর উদাহরণ দিয়ে দিয়ে মেয়েদের জীবন আরও দুর্বিসহ করে তুলবে। তাদের কথায় যুক্তি আছে বইকি, এমনিতেই যেকোন দুর্ঘটনার জন্যে উপমহাদেশে মেয়েদের চাল, চলন, পোশাকআশাককে দায়ী করা হয়, পরিবার থেকেই বলা হয়, মুখপুড়ি, তুই মরিস না কেন? আর এখন তো হাতের কাছে রয়ে গেলো জ্বলন্ত প্রমাণ। “পদ্মাবতী” মরলো তুই মরিস না কেন? এই বাক্যবান কত মেয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় কে জানে। দু’হাজার আঠারো সালে সিনেমার এই এন্ডিং মেনে নেয়া যায় না।

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষজন ও বানশালি’র অবিচারে ব্যাপক ভাবে আহত হয়েছে। পুরো পৃথিবী দুহাজার আঠারোতে থাকলেও বাংলাদেশ এখনও পাঁচশো সত্তর খ্রীষ্টাব্দেই আটকে আছে, আরব বেদুইনদের মরুভূমিতে এলাস খিলজীকে মন্দ বলা বানশালি মোটেই উচিত হয় নি রতন সিং এর কীর্তি কিছুই চোখে দেখে নাই শালা, সাম্প্রদায়িক কোথাকার রতন সিং এর মত অত্যাচারী রাজা আর হয়? তিনি কয়দিন রানীদের সাথে থাকতেন? তার রাজবাড়ি ভর্তি ছিলো রক্ষিতা দিয়ে এসেছে খিলজী নিয়ে মুভি বানাতে

আচ্ছা, খিলজী আর রতন সিং এর তুলনা কোথা থেকে আসে! রতন সিং ভারতের সন্তান আর খিলজি তুর্কি থেকে আসা বহিরাগত যার উদ্দেশ্যই ছিল ভারতবর্ষ লুটেপুটে খাওয়া গতানুগতিক বক্তব্য, “মুঘল সম্রাটরা ভারতবর্ষকে হিন্দু রাজাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছিলেন, সেই সময়ে ভারতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়“  আচ্ছা!!!– সেই প্রভূত উন্নতি গুলো কি কি? বাসস্থান, জীবিকা, স্বাস্থ্য, খাদ্য কোন দিক থেকে সাধারণ জনগন উন্নতির মুখ দেখেছিলো? হ্যাঁ, বড় বড় ইমারত বা স্থাপনা তৈরী হয়েছিল কিন্তু সে তো তাদের নিজেদের প্রয়োজন ছিল ভারত তো মুঘলদের দেশও ছিল না, তারা এটাকে শক্তি বলে হস্তগত করে নিজেদের বিলাসের প্রয়োজনে, কি যুক্তিতেই বা তারা ভারতবর্ষের উন্নতি নিয়ে মাথা ঘামাবেন? বরং মুঘলদের পুরো সময়টা কেটেছে নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসঅবিশ্বাস, মসনদের ষড়যন্ত্র, দ্বন্দ্ব আর কাটাকাটি মারামারি মধ্যে দিয়ে, কে কার চেয়ে বেশি ভোগ করবে এই ছিলো তাদের লড়াই মানছি আমি, হিন্দু রাজারা খুব খারাপ ছিলেন, তাতে কিন্তু বাইরে থেকে এসে কারো ভারতবর্ষ অধিকার করে নেয়া জায়েজ হয়ে যায়?   

যে যুক্তিতে আলাউদ্দিন খিলজী কিংবা মুঘলদের ভারতবর্ষ দখল জায়েজ হয় সেই একই যুক্তিতে এমেরিকার ইরাক কিংবা আফগানিস্তান দখলও জায়েজ হয় তখন আবারএমেরিকা নিপাত যাকশ্লোগানে রাজপথ মুখরিত মুঘলদের থেকে শাসন ব্যবস্থা বা শাসকদের দিক থেকে ইংরেজরা অনেক উন্নত ছিলো। তাহলে কোন যুক্তিতে বৃটিশ তাড়ানো হলো? স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়! উপমহাদেশে কোন ন্যায়, যুক্তি, বিচারের ব্যাপার নেই, একটি শব্দ ধর্মদ্বারা সব বুদ্ধিবৃত্তি পরিচালিত হয়। আবার ট্রাম্প আর সৌদি যখন এক সাথে নাচ গান করে তখন কবি নীরব এদের সব কিছুতে আলাদা বিচার একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্যে চারটি মৌলিক উপদান লাগে, জাতীয়তা, ভাষা, নির্দিষ্ট ভূখন্ড এবং ধর্ম আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ধর্ম এমন কিছু আবশ্যিক উপাদানও নয়, সেটা পৃথিবীর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে না, এমেরিকা-ইউরোপ দেখার দরকার নেই, ভারতই তার উজ্জল দৃষ্টান্ত ধর্ম যদি মূল ভূমিকা রাখতো তাহলে ভারতের আজ খান খান হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো

মুঘল সম্রাট’রা খুবই শিক্ষানুরাগী ছিলেন, নিজেরা ছবি আঁকতে ভালবাসতেন, কবিতা লিখতেন, সঙ্গীতের চর্চা করতেন এবং করাতেন। এমনকি কেউ কেউ গোপনে শাহজাদীদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করিয়েছিলেন। বহু মাদ্রাসা, মক্তব প্রতিষ্ঠিত করেছেন, স্কুল – কলেজ এর সংস্কার করিয়ে বিভিন্ন বৃত্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যেমন হয়নি হাসাপাতাল প্রতিষ্ঠা। তবে প্রচুর রাস্তা ঘাট বানিয়েছিলেন, মসজিদ বানিয়েছিলেন তারা। সেই ঐতিহ্য বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা আজও ধরে রেখেছে। নির্বাচনী এলাকায় রাস্তা আর মসজিদ বানাতে কখনও ভুল হয় না তাদের। কিন্তু কিছু টাউট বাটপার ছাড়া আর কারও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না, সাধারণ জনগন যেই তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই থেকে যান ঠিক মুঘল শাসন ব্যবস্থা’র মত।

(বেশির ভাগ বাংলাদেশীদের মতে) হিন্দু নাপাক অত্যাচারী রাজাদের হাত থেকে মহান মুসলিম বীর আলাউদ্দিন খিলজী ভারতকে উদ্ধার কিংবা রক্ষা করেছিলেন, আসুন আমরা এই বীরের জীবনীটি দেখি এক নজরেঃ আলাউদ্দিন খিলজী নিজের আপন চাচা যিনি তার শ্বশুরও বটে তাকে খুন করে দিল্লীর গদি দখল করেন। তিনি নিজে বেশুমার মদ খেলেও মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন সে সময়। জুয়াখেলা, পতিতা গমন সব নিষেধ করেন, পতিতাদের বলেন বিয়ে করতে নইলে তাদের পাথর ছুড়ে হত্যা করা হবে মর্মে ঘোষনা দেন। তার দুজন স্ত্রী ছিলো। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি পেডোফাইল এবং বাইসেক্সুয়ালও ছিলেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তার হেরেমে সত্তর হাজার মানুষ ছিলো, যার মধ্যে ত্রিশ হাজার স্ত্রী লোক ও বাকি পুরুষ আর বাচ্চা। তিনি এক সময় নিজেকে প্রফেট হিসেবে ঘোষনা দেন এবং মোল্লাদের বাধ্য করেন ইসলাম ধর্মকে ম্যানিপুলেট করে তাকে স্বীকৃতি দান করার জন্যে। ইসলামী সংস্কৃতি মেনে, তার খাস আদমি মালিক কাফুর সিংহাসনের আশায় তার শিরায় বিষাক্ত ইনজেকশান দেন এবং বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু ঘটে এবং মালিক কাফুর খিলজী’র দুই পুত্রকে অন্ধ করে। তাকে মেহরুলির কুতুব কমপ্লেক্স এ কবর দেয়া হয় খুব চুপচাপ ভাবে

 খিলজি শুধু চিতোরই লুটপাট করেন নি, রানথাম্ভোরে দুর্গ, মালোয়া থেকে মান্ডু হয়ে চান্দেরী আর ধার পর্যন্ত দখল করেছিলেন। বেশীর ভাগ যুদ্ধেই প্রথম বারে হেরেছিলেন। তেরশ আট সালে ওয়ারানগাল যুদ্ধে জয় লাভ করেন এবং কোহিনূর হীরা লুট করেন। বালগানা রাজ্যে জয় করে, রাজা রায় করনের কন্যা দেভালা দেবীকে বন্দী করে দিল্লী নিয়ে এসে তার বড় পুত্র খিজির খানের সাথে তার বিয়ে দেন। মংগলদের আক্রমণ থেকে চারবার এই তুর্কি বংশোভূত রাজা ভারতবর্ষকে রক্ষা করেন। বর্গা চাষীদের পঞ্চাশ ভাগ কর তিনি জমি’র মালিকদের ওপর অর্পণ করেন। তারপরও বর্গা চাষীদের হাতে তেমন কিছু বাঁচত না কারণ আলাউদ্দিনকে খুবই উচ্চহারে কর হারে পরিশোধ করতে হত। সমাজে আভিজাত্য যাতে বৃদ্ধি না পায়, সেজন্যে তিনি বিয়ের ব্যাপারে কিছু নিয়ম তৈরী করে দিয়েছিলেন। অভিজাত সমাজে বিয়ের সম্বন্ধ করতে তার অনুমতি লাগত। তিনি দিল্লীতে সৈন্য আর সাধারণদের জন্যে সুলভ মূল্যে খাবার, কাপড়, ওষুধ, ঘোড়া ইত্যাদি কেনার দোকানের ব্যবস্থা করেছিলেন। দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজের পরিচয় সম্বলিত বিভিন্ন ধাতব, তামা, রুপার মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন

মহারাষ্ট্রের টেক্সট বই থেকে মুঘলদের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য বলে খ্যাত “তাজমহল”কে উত্তর প্রদেশ তাদের ট্যুরিজম বুকলেট থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। যদিও তাজমহল বাদ দেয়া আমার দৃষ্টিতে একটু বাড়াবাড়ি। পূর্ব পুরুষরা তাদের মাতৃভূমি রক্ষা করতে পারে নি সেই রাগ এখন ঢেলে আর কি হবে? তার থেকে বরং ট্যুরিস্টদের এই দেখিয়ে দেখিয়ে টু পাইস যা আসছিলো তা দিয়ে দেশে’র যদি কোন কাজ হয়। নিজেদের বুকলেট থেকে বাদ দিলে কি হবে, বিশ্বজোড়া সবাই তো ভারত মানেই তাজমহল আর মুঘল স্থাপত্য ভাবে আর জানে। অন্তর্জালে অনেক আলোচনা খুঁজে পেলাম, ভারতে আলোচনা হয় “মুঘল শাসন না ইংরেজ শাসন ভাল ছিলো এই নিয়ে”কিন্তু বাংলাদেশ? ইয়েস বাংলাদেশ আটকে আছে বাংলাদেশে। আমাদের টেক্সট বই গুলো থেকে হিন্দুদের লেখা বাদ দেয়ার পায়তারা করা হবে কিন্তু যুক্তিশীল চিন্তা ভাবনা নিয়ে লেখা কিছুই পড়ানো হবে না। নির্মোহ ইতিহাস কবে আসবে বাংলাদেশের টেক্সটবুকে কে জানে। স্মৃতি থেকে লিখছি, ভুল হতেও পারে, আমাদের প্রাইমারি টেক্সট বইয়ে শিরোনাম ছিল, “বখতিয়ার খিলজী’র ভারত বিজয়”, আদতে সেটা হত “বখতিয়ার খিলজী’র ভারত দখল”। ট্রেনিং দিয়ে গবেটের পর গবেট জেনারেশান তৈরী হবে। বখতিয়ার খিলজী কিংবা বাবরকে ইতিহাসের পাতায় আঁকা হবে মহান বীর হিসেবে। বেকুব গুলো বীরদর্পে ফেবু ভেঙে লড়াই করবে, রতন সিং আর সব হিন্দু বাজে রাজাদের কাছ থেকে তাদের মাতৃভূমি কেড়ে নিয়ে খিলজী আর মুঘল’রা ভারতে সু’দিন নিয়ে এসেছিলো তুর্কি বংশোভূত এই বহিরাগতদের ভালবাসার বন্যায় ভারতবর্ষের দুকূল প্লাবিত হয়ে গেছিলো। আর হ্যাঁ করবে নাই বা কেন, সেই প্লাবনের কিছু ছিটেফোঁটা তো দিল্লী থেকে বাংলাদেশ অব্ধি এসে কিছু পৌঁছেছিলো বটে।    





তানবীরা
১৩/০২/১৮





Thursday 22 February 2018

ক্লিশে লোকাচার

জীবনের বড়, খুব বড় একটা অংশ কেটে যায় লোকাচার পালন করতে করতে। লোকে কি ভাববে সেটা ভাবতে ভাবতে নিজে কি চাই, সেটাই অনেক সময় ভুলে যাই। আসলে উপমহাদেশের সংস্কৃতিটাই গড়ে উঠেছে এভাবে হাজার বছর ধরে, এর দেয়াল ভেঙেও ভাঙে না, খসেও খসে না। কেউ এই অচলায়তনে আঘাত করতে চাইলেও, রক্ষনশীল’রা গেলো গেলো রব তুলে হুলস্থুল করে তোলে।

আমাদের দেশে প্রায় অনেক স্কুলেই, স্কুল শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর নিয়ম আছে, সেটা প্রায় রোজই। কেন? দেশপ্রেম জোর করে গেলানো’র জিনিস? রোজ জাতীয় সংগীত গেয়ে আমরা খুব দেশ প্রেমিক জাতি তৈরী হয়েছি বুঝি! সিনেমা হলে সিনেমা শুরু’র আগে জাতীয় পতাকা দেখানো, কেন? একবার কিছু শুরু হলে সেগুলো কি স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যেতে হয়? সময়ে কিছু বদলায় না? বদলানো উচিত নয়? পশ্চিমের দেশগুলোতে জাতীয় পতাকা দিয়ে কত কি তৈরী হয়, ফ্রিজ ম্যাগনেট, কাপে, মগে, বাসনে কোথায় নেই জাতীয় পতাকা? এমেরিকায় জাতীয় পতাকা ছাপা শর্টস আছে, বিচ স্যান্ডেল আছে, তোয়ালে আছে। আমাদের দেশে ভাবা’ই যায় না। কেন এই লোক দেখানো দেশ প্রেম? এমেরিকানদের থেকে আমরা বেশি দেশ প্রেমিক জাতি?

শহীদ মিনারে জুতো নিয়ে উঠলে, বসলে টিভিতে, পত্রিকায় হুল্লোড় হতে থাকে, কেন? এমেরিকা, ইউরোপে’র কোন দেশে স্বাধীনতা’র স্মৃতি স্তম্ভ, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মিনার, স্তম্ভ নেই? কোথাও তো জুতো খুলতে হয় না, তাহলে সেসব শহীদদের অপমান হচ্ছে? এসব লোক দেখানো আচারের শেষ কবে কোথায় কে জানে। প্রাচীন যুগে এসব লোকাচার এসেছিলো হয়ত আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে। যার জন্যে গরমের দেশে জনপ্রিয় ধর্ম গুলোতে ধর্মস্থান বা পবিত্র স্থানে জুতো খোলা’র ব্যাপারটা আবশ্যিক ছিলো। যেটা শীতের দেশে আবার নেই। ঠিক যেমন খাদ্যভ্যাস গড়ে নিয়েছিলো মানুষ, যেখানে মাংস দুষ্প্রাপ্য ছিলো সেখানকার মানুষেরা শাকাহারী আবার আরবের দিকে সব্জি দুষ্প্রাপ্য বিধায় তারা মাংসাহারী। আর সেসবই মানুষের ওপর চাপানো হয়েছিলো “ধর্মে”র মোড়ক দিয়ে। সমস্ত উপমহাদেশ শিক্ষা, বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করেছে, বিশেষ করে শেষের দুই দশককে তো এই ক্ষেত্রে রেনেসা ধরা যেতে পারে। কিন্তু যেখানে ধর্মের নামটি আসে, সেখানেই সেই প্রাচীন অচলায়তন। যতটাই আগাই না কেন, এই অচলায়তন ঠেলে আর সামনে আসতে পারে না। এই জায়গায় ফিরে যাই সেই শত বর্ষ পূর্বে।

স্বামী মারা গেলে মেয়েদের শাড়ি বদলাতে হবে, রঙ বদলাতে হবে, গয়না পরা চলবে না,  খাদ্যভাস ত্যাগ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন, মরে গেলে স্বামীর প্রতি প্রেম বেড়ে যায় যে জীবন তাকেই উৎসর্গ করে দিতে হবে? যদি অত্যাচারী স্বামী হয়ে থাকে যে বেঁচে থেকে অনেক কষ্ট দিয়েছে স্ত্রী’কে? তার জন্যেও স্ত্রীকে বাকি জীবনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে মানুষকে নিষ্ঠা দেখাতে হবে লোক নিন্দা’র ভয়ে?

আমি জানি আমার এই লেখার জন্যে হাজার খানা গালি জুটবে, কিন্তু নিজের ভাবনা তো নিজের ভাবনাই। নিজের টাইম লাইনে অন্তত নিজের সাথে সৎ থাকা যায়।



Sunday 11 February 2018

রানী পদ্মাবতী

অবশেষে দেখলাম সঞ্জয় লীলা বানসালি’র বহুল আলোচিত সিনেমা “পদ্মাবত”। কাহিনী যেমনই হোক সঞ্জয় লীলা বানসালি’র সিনেমা দেখা সবসময়ই আনন্দের। তিনি সিনেমাটোগ্রাফী, সেট, মিউজিক, করিওগ্রাফী, ড্রেস ডিজাইন ইত্যাদি’র ওপর খুব নজর রাখেন। তার ভাষায় বলতে গেলে, “Larger than life”. খানিক ক্ষণের জন্যে হলেও রঙিন কল্পনার জগত থেকে ঘুরে আসা, মন্দ নয়। এ ছাড়াও সঞ্জয়ের প্রতি সামান্য একটু দুর্বলতা কাজ করে তার “সারনেম” এর কারণে। সঞ্জয় মানেন তার জীবন এ অব্ধি আগানোতে তার মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। তাই তিনি তার মায়ের নাম “লীলা বানশালি” তার নিজের নামের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। উপমহাদেশ কেন পুরো পৃথিবীতেই মা’কে এভাবে সম্মান জানাতে ক’জন পারে।


সঞ্জয় বারবার আশ্বস্ত করেছে, "পদ্মাবত" ইতিহাস থেকে নয় বরং পনেরশ চল্লিশ সালে সুফি কবি মালিক মুহাম্মদ জয়াসীস এর "আওয়াধি" ভাষায় লেখা মহাকাব্য "পদ্মাবতী - চিতোরের রানী" কবিতা'র ওপর ভিত্তি করে বানানো।

“পদ্মাবত” সিনেমা’র গল্পানুসারে দিল্লী’র দ্বিতীয় শাসক আলাউদ্দিন খিলজী মেওয়ার এর রাজা রতন সিং বা সেন এর স্ত্রী রানী পদ্মাবতী কিংবা পদ্মিনী’র রুপের গল্প লোক মুখে শুনে দিশেহারা হন। তিনি মেওয়ার দখল করে রানী পদ্মাবতী’কে নিজের করে পেতে চান। রাজপুর রাজা রতন সিং তার রাজধানী চিতোরে তার রাজ প্রাসাদ এবং দূর্গ এভাবেই তৈরী করেছিলেন যে ব্যাপারটা খিলজী’র জন্যে ততটা সহজ হয় না। অতঃপর দিল্লী’র নিয়মনুযায়ী বিভিন্ন অসাধু কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া। সেই সময় একটি সংলাপে আমার কান আটকে যায়, দৃশ্যটি এরকম, আলাউদ্দিন খিলজী তার তাবুতে বসে মুরগী’র তান্দুরি সাথে আরও অনেক পদ দিয়ে যখন দুপুরের আহার সারছিলেন তখন তার খাস ক্রীতদাস “মালিক কাফুর” এসে বললো, সৈন্য’রা দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে বিদ্রোহ করছে, দয়া করে ওদের কিছু বলে ওদের মনোবল বাড়ান, ওদের শান্ত করুন।


আলাউদ্দিন খিলজী নিজের তাবু থেকে বেরিয়ে এসে সৈনিকদের বললেন, তিনি দিল্লী’র মসনদের সীমানা আরও বিস্তৃত করার স্বপ্ন আজীবন দেখে আসছেন। কে কে তার সাথে আছে? অনেক বিদ্রোহী শ্রমিকই তখন দেশভক্তি আর রাজভক্তির কাছে পরাজয় মেনে যায়। তখন থেকেই ভাবছিলাম যুগে যুগে একই প্রতারণা! সেই তেরশ চৌদ্দ সালেও যা আজকের দু হাজার আঠার সালেও তাই। এসেছে পেশী শক্তির বদলে নিজের লালসা চরিতার্থ করতে নাম দিয়েছে, দেশ প্রেম। কেউ একজন ও দিল্লী’র সুলতানকে জিজ্ঞেস করে নি, দিল্লী’র মসনদের সীমানা বাড়লে, সাধারণ সৈন্য’রা কি পাবে? তাদের কি জীবন যাত্রা’র মান বৃদ্ধি পাবে? তাদের বাচ্চারা দু’বেলা খেতে পারবে তো? নাকি সব সেই দিল্লী’র কোষাগারে জমা হয়ে কোষাগার উপচে পরবে আর তাদের লালসাময় জীবন ভোগের নিমিত্তে সেই অতল সীমানায় খাবি খাবে। সম্রাট শাজাহান যখন অমরত্বে’র বাসনায় “তাজমহল” তৈরী করছিলেন, তখন দিল্লীতে কিংবা ভারতবর্ষে কত মানুষ না খেয়ে দিন কাটাতেন? কেমন ছিলো তার সৈন্য সামন্ত কিংবা তাজমহল নির্মানে ব্যস্ত থাকা সেই সব নির্মান শ্রমিকদের জীবন?


যুগে যুগে যুদ্ধের লক্ষ্য মেয়েরাই হয়। রানী পদ্মাবতীই শুধু? তুর্কি বংশভূত খিলজী থেকে মুঘল সম্রাট, কার হাত থেকে নারীরা রক্ষা পেয়েছিলেন? যোধা বাই থেকে শুরু করে অসংখ্য রাজকন্যা মুঘল সম্রাটদের রানী হয়েছেন কিংবা হতে বাধ্য হয়েছেন। মুঘলদের নানাবিধ অত্যাচার আর ভোগ বিলাসের মধ্যে এটিও ছিলো উল্লেখযোগ্য। শুধু মুঘলরাই বা কেন? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনী’র বিরাট লক্ষ্য ছিল নারীদের ওপর অত্যাচার করা। হ্যাঁ, অত্যাচারকে অত্যাচারই বলবো, মানুষের জীবন যেহেতু তার ব্যক্তিগত অঙ্গে লুকিয়ে থাকে না তাই এর সাথে সম্মানকে জড়িয়ে ফেলারও কিছু নেই। এর থেকে কি এখনও পৃথিবী মুক্তি পেয়েছে? আজকের লুটেরা বাহিনী আইএস এর হাত থেকে যেসব মেয়ে’রা বেঁচে আসতে পেরেছে তাদের কাছে কি অসংখ্য রানী পদ্মাবতী’র গল্প আমরা শুনি নি? বোকো হারামের হেরেমে কি আজও অসংখ্য রানী পদ্মাবতী আত্মাহুতি দিচ্ছেন না?


হ্যাঁ, সেসব হতভাগীদের নিয়ে এ যাবত কালের সবচেয়ে ব্যয় বহুল সিনেমা’টি তৈরী হয় নি বটে। কিন্তু পৃথিবীর বহু জায়গায় আজও রানী পদ্মাবতী বাস্তব, কোন মাইথলজিক্যাল চরিত্র নয়। বহু মেয়ে নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়ে জওহার না হলেও অন্যভাবে আত্মাহুতি দিচ্ছে। খিলজী’র মত পাপী রাস্তায় রাস্তায় মুখোশ ধরে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তাই ফসলের ক্ষেতে, নদীর পারে, বাড়ির পেছনে, আইএস কিংবা বোকো হারামের কালো কুঠুরীতে রানী পদ্মাবতীদের বিগলিত লাশ পাওয়া যায়।

১২.০২. ১৮