সেদিন একটা আড্ডায় আমির
খানের নতুন মুভি, “সিক্রেট সুপারস্টার” নিয়ে কথা হচ্ছিল। সবাই খুব প্রশংসা করছিলো,
আমির খানের সিনেমা বলে কথা। এই ভাল – সেই ভাল ইত্যাদি। আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর
বলেই ফেললাম, আমার কাছে খুব ফরম্যাটেড ফিল্ম মনে হয়েছে, তেমন আলাদা কিছু লাগে নি। ইরানীয়ান
মুভি গুলোতে সাধারণতঃ এই ঘটনা গুলো খুব অন্যরকম ভাবে চিত্রায়ণ করা
হয়, সিনেমা মনেই হয় না, মনে হয়, পাশের বাড়িতেই কাউকে দেখছি। আ সেপারেশান, দ্যা
কালার ওফ প্যারাডাইস, এম ফো মাদার, আ মোমেন্ট অফ ইনোসেন্স, হেয়ার উইথাউট মি সিনেমা
গুলো দেখলে কখনোই মনে হয় না সিনেমা দেখছি। সিনেমা সুলভ কোন ব্যাপারই থাকে না, থাকে
কিছু হৃদয় নিংড়ানো কষ্টকর বাস্তবতা। যারা চুপচাপ ছিলো তারাও তখন বলেই ফেললো, হ্যাঁ,
“সিক্রেট সুপারস্টার” তাদেরকেও হতাশ করেছে। তারা কিছু তামিল, মারাঠি সিনেমার কথা
বললো, যেগুলোতে আরও গভীরতা ছিলো কাহিনী’র। কাহিনীর যে গভীরতা ছিলো, হতে পারত মা ও সন্তানদের
সংগ্রামের একটি বাস্তবচিত্র সেদিক থেকে “সিক্রেট সুপারস্টার” একটি সম্ভাবনার
অপমৃত্যু।
এক বাসায়
হালিম খাচ্ছিলাম। “আসল হালিম”, আমার গলা দিয়ে কিছুতেই নামছিলো না কিন্তু অন্যরা
বাটি ভরে ভরে খেতে খেতে প্রচুর প্রশংসা করছিলো। আমি বাটি আর চামচ নেড়ে চেড়ে
যাচ্ছি, গৃহকর্ত্রী বেশ কয়েকবার বলে গেলো, খেয়ে নাও, জীবনে ভুলবে না, মামা হালিম
খাওয়া জেনারেশান, আসল হালিম তো কি জিনিস জানো না। কিন্তু ক্রমাগত আমার বাটি চামচ নাড়াচাড়া
দেখে পাশের জন বললো, কি রে, খেতে পারছিস না। আমি ভয়ে কোন “টু” শব্দ না করে, মাথা
নেড়ে জানান দিলাম, না পারছি না। পাশের জন উঠে আমার বাটি নিয়ে সিঙ্কে ঢেলে দিয়ে
এলো, সাথে নিজের বাটিও ঢেলে দিয়ে এলো। এসে বসে তার পাশের জনকে চোখ ট্যারিয়ে জিজ্ঞেস
করলো, খেলি পুরোটা? পাশের জন নিপাট ভদ্র, প্রথমে বুঝতে পারে নি, বেশ গদ গদ বলতে
থাকলো, তখন আবার সে জিজ্ঞ্রেস করলো, পুরোটাই খেলি, খেতে পারলি? বোধহয় এন্টেনায় কিছু
ধরা পরলো, আমতা আমতা শুরু করলো, কি করবো? ভদ্রতা, দিয়েছে, খেতে তো হবেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিছু দিন
আগেই ফরিদ কবির ভাই তার আর ঝর্ণা আপা’র একটা ছবি পোস্ট করলেন তাজমহলের সামনে সাথে
তার স্মৃতিকথা। স্মৃতিকথা পড়তে অপূর্ব লেগেছে, সবাই তার প্রশংসা করছে, সাথে
তাজমহলেরও। আমি শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, “তাজ” আমাকে টানেনি। জীবনের বড় একটি
আশাভঙ্গ’তার নাম হল “তাজমহল”। মসজিদ আকৃতির এই ইমারতটি দেখে আমি হতাশ হয়েছি। আমার
অন্য কিছু আশা ছিলো। বরং আগ্রা ফোর্ট, যেখানে আওরঙ্গজেব, সম্রাট শাহজাহান আর তার
কন্যা জাহানারা’কে আটকে রেখেছিলেন সেটি আমার অনেক মন ছুঁয়েছে, যমুনার তীর ঘেঁসে,
এখনো কি বিষন্ন, যেনো পুরো নদী আর প্রাসাদে এখনও তাদের কান্না মিশে আছে। প্রথমে আমাকে বেশ কয়েকজন বললো, “তাজমহল” মানে
শুধু পাথর আর ইমারত নয়, চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখলে তো তাই দেখবো, মনের চোখ দিয়ে যদি দেখি,
ভাবি, উপলব্ধি করি তাহলে এর আসল সৌর্ন্দয বুঝতে পারবো। আমি সারেন্ডার করে বললাম, অন্য
কোন জনমে হয়ত, এবার আর হলো না। অবাক হয়ে দেখলাম তারপর, নেহাত মন্দ নয়, আরও অনেক বন্ধু
নিজ থেকে এসেই বললো, তারাও চর্ম চক্ষুতে “তাজমহল” দেখেছে এবং হতাশ হয়েছে।
মা হয়েও
আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। সিনেমায় দেখেছি, আজ বাচ্চা হলো, কাল শর্মিলা ঠাকুর, বাচ্চার
কান্না শুনে আকাশ পাতাল এক করে ফেললো। নিজের বেলায় তেমন কিছু হচ্ছে না দেখে নিজের
মনুষ্যত্ব বোধ নিয়ে খুব হীনমন্যতায় ছিলাম। এর বেশ অনেকদিন পর বান্ধবী’রা আমাদের দেখতে
এলে, একদিন কথায় কথায় সাহস করে বলেই ফেললাম, দেখি আস্তে আস্তে অন্যরাও তাদের মনের কথা
বলছে। মা হওয়া, একটি অন গোয়িং প্রসেস। মা আর বাচ্চা যত সময় একসাথে কাটাবে, যত সুখ
দুঃখের স্মৃতি এক সাথে জমা হবে, বাচ্চার কান্না, বাচ্চার হাসি, বাচ্চার খেলা এ সবই
মা’কে বাচ্চার কাছে টেনে আনে আর মায়ের এই নিঃশর্ত কাছে আসা টেনে আনে বাচ্চাকে তার মায়ের
কাছে।
সত্যি কথা
মাঝে মাঝে বলে ফেলার রিস্ক অনেক কিন্তু একটা গেইন থাকে, পোশাকী গল্পের বাইরে কিছু
আটপোড়ে সত্যি গল্প শুনতে পাওয়া যায় যেখানে রঙচঙ থাকে না। নিজেকে যাচাই করা যায়,
ঝালিয়েও নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে সত্যি উচ্চারনে এই সাহসটা আমি পেয়েছিলাম, খুব ছোট
একটা বাচ্চার থেকে।
একবার এক
বাসায় মিলাদ হচ্ছিল, হুজুর ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে তো বলেই যাচ্ছে, কিছুতেই শেষ
হচ্ছে না। বড়রা কেউ বসে আছে তো কেউ এই ঐ উছিলায় এদিক ওদিক করছে, মহিলা’রা মাঝে
সাঝে টুকটাক কথা সেরে নিচ্ছে, ছোট’রা এই অবসরে একটু দুষ্টুমি করছে। মিলাদ শেষ
হওয়ার পর বাচ্চাটির মা, বাচ্চাটিকে খুব বলছিলো, হুজুর ভাল ভাল সব কথা বলছিলো, তুমি
শুনছিলে না, দুষ্টুমি করেই যাচ্ছিলে, ঠিক করছিলে কাজটা? বাচ্চাটা এমনিতে লক্ষী,
বাবা মায়ের কথা শোনে, পড়াশোনায়ও ভাল। মায়ের কথা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে বলে উঠলো,
আমি জানি হুজুর ভাল ভাল কথা বলছিলো, কিন্তু ভাল কথা শুনতে বেশিক্ষণ ভাল লাগে না
আম্মু।
এই সাধারণ
কিন্তু সহজ আর সত্য কথাটি উচ্চারন করতে একটা বাচ্চা মেয়ে’র অনেকটাই দৃঢ়তা আর
আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। সমাজের বেশি’র ভাগ মানুষই সুযোগ
সন্ধানী। সুবিধা যেখানে পাবে সেখানেই গলা মিলিয়ে ফেলে। সেখানে খুব ঠান্ডা, বিনম্র,
আস্তে কিন্তু দৃঢ় গলা’র এই কথা গুলো কিন্তু কিছুতেই ফেলনা নয়। কারো না কারো কানে তো
পৌঁছবে, সেটাই সার্থকতা। আওয়াজটা খুব অল্প থাকে কিন্তু থাকে। হয়ত ঝাঁকের কই হয়ে ক্ষণিক সুবিধে আনন্দ নিয়ে হারিয়ে যায় কিন্তু
মৃদ্যু আওয়াজটা থেকে যায়।
১৫/১১/২০১৭