Wednesday 23 February 2011

খুঁজবো কোথায় তাকে, দুচোখে হারাই যাকে

যখন থেকে সায়ান পড়তে গেলো এ্যামেরিকা তখন থেকেই দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি চরম আকার ধারন করেছে। ঝগড়া করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তিতলি। দুজনের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান আর সময়ের ব্যবধানতো আছেই তার সাথে আছে নিদারুন মানসিক চাপ। চব্বিশ ঘন্টা যার ভাবনায় সে বুঁদ হয়ে থাকে সারা পৃথিবী থেকে তাকে লুকিয়ে রাখার যন্ত্রনা। সারাদিন মনে মনে যাকে ভেবে তার সময় কাটে, মুখে কখনো তার নাম উচ্চারন না করতে পারার ব্যাথা। প্রাত্যহিক জীবনের সাথে লুকোচুরি খেলে কতো কষ্টে সায়ানের জন্য সময়টুকু সে যোগাড় করে রাখে তা সায়ান যেন আজকাল বুঝতেই পারে না। সায়ানের সবকিছুতেই দেরী হয় নইলে সে ব্যস্ত, সময় নেই, নাকি তিতলিকে এড়িয়ে যাওয়ার বাহানা এগুলো তার। তবে কি বদলে যাচ্ছে তার সায়ান একটু একটু করে? আগেতো এতো ইনকনসিডারেট ছিল না, তিতলির সুবিধাই ছিল সায়ানের বড় চাওয়া, তিতলির সান্নিধ্যই ছিল তার বড় পাওয়া। কি করবে সে? সেই মিষ্টি সময়গুলোর কথা ভাবলেই তিতলির কান্না পায় আজকাল। কখন যে নিজের অজান্তে চোখ ভিজে ওঠে, সে বুঝতেই পারে না। যখন লোনা জল তার গাল বেয়ে ঠোট স্পর্শ করে তখন খেয়াল হয়, সে কাঁদছে। অস্থির লাগে আর নিজের চারপাশে আরো বেশি করে সায়ানকে হাতড়ে বেড়ায় সে।

এখনতো আর চাইলেই সায়ানকে হাতের কাছে পায় না যে রেগে গেলে দুই হাতে ওর ঝাকড়া চুল মুঠো করে ধরে ওর মাথা ঝাঁকিয়ে দিবে কিংবা কান মলে মলে লাল করে দিবে। সারাক্ষণ মনে মনে রেগে থাকে আর ভাবে পাইতো তোকে একবার হাতের কাছে, খবর করে দিব বাঁদর ছেলে কোথাকারের। আগে ঝগড়া হলেই সায়ানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো সে, নখ দিয়ে আঁচড়ে, পিঠে কিল মেরে সায়ানকে শুইয়ে ফেলতো। মুখে সায়ান লাগছে লাগছে বললেও আসলে মজা পেতো, হাসতো। এমনিতেতো তিতলিকে কাছে টানা যায় না, হাতটা ধরলেই ঝট করে ছাড়িয়ে নিবে, আমায় ধরবি না বলে। কিন্তু মারামারির সময় তার হুঁশ থাকতো না। এলোচুলের খোঁপা খুলে পড়ছে, কি গা থেকে ওড়না খসে পড়ছে, কিংবা সায়ানের মুখের কতো কাছে তিতলির মুখ তখন সেদিকে তার নজর নেই। মারামারিতে হাপাতে হাপাতে তিতলির বুকের দ্রুত ওঠানামা আর রাগে নাকের পাটা কাঁপানো দেখতে সায়ানের ভীষন ভালো লাগতো। সে তখন আলতো করে তিতলিকে জড়িয়ে নিতো, ঠোট চেপে আদর দিয়ে রাগ কমিয়ে দিতো। আচমকা এ আদরে তিতলি লজ্জা পেয়ে তখনের মতো মারামারি থামিয়ে দিতো। সায়ান সারাবেলা সেই শান্ত তিতলির হাত নিজের মুঠোয় ধরে থাকতো। ঘেমে যেতো তিতলির হাত তার মুঠোর উত্তাপে কিন্তু তারপরও কখনো ছাড়িয়ে নিতো না।

পড়াশুনা, চাকরি আর নিজের রান্নাবান্নাসহ সমস্ত কাজের চাপে জেরবার সায়ানের কাছে মাঝে মাঝে তিতলির এই অবুঝপনা বেদনাদায়ক লাগে। সারাটাদিন কিসের মধ্যে দিয়ে ও যায় মেয়েটা কি একবারও বোঝার চেষ্টা করে। এই কি সেই তিতলি যে তার ঘুম খাওয়া নিয়ে অস্থির হয়ে যেতো। কি বদলে যাচ্ছে মেয়েটা। ম্যাসেঞ্জারে আসতে দেরী হলে, মেইল করতে ভুলে গেলে কিংবা এস,এম,এস বা ফোনের সময় একটু এদিক সেদিক হলে বেহুশের মতো রাগারাগি করে, কেঁদে কেটে সীন করে ফেলবে। অনেক সময় ফোনের লাইন পাওয়া যায় না, সব কি সায়ানের ইচ্ছে আর হাতে থাকে? আজকাল আর এক নতুন বাতিক যোগ হয়েছে, সন্দেহ। সায়ানের কি কোন বিদেশিনীর সাথে ভাব হয়েছে কি না এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত। ম্যাসেঞ্জারে কথা হলেই সেটা একভাবে না একভাবে ঝগড়ায় যেয়ে পৌঁছাবে আর কথা না হলে মনে হয় আজ দিনটা কাটছে না। খেয়ে শুয়ে বসে কিছুতেই সে শান্তি পায় না। চরম ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে তার জান। এতো মায়া হয় মেয়েটার জন্য তার। মেয়েটা দিনরাত তাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না, এই সত্যিটা জানে সে। বাইরে থেকে দেখাবে অনেক শক্ত, ভেতর ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে গেলেও মুখে কখনো স্বীকার করবে না, একা একা নিজে কষ্ট পাবে। কিন্তু তার কাছেতো তিতলির আর কিছু লুকানো নেই, সেতো জানে ওপরে যতো শক্ত ভাবই দেখাক, ভিতরটা পুরো হাওয়াই মিঠাই। তার স্পর্শ পাওয়া মাত্র গলে গলে পড়ে।

এ সমস্ত ঝগড়ার মূলে যে শুধুমাত্র তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করে সেটা আজকাল বেশ বুঝতে পারছে সায়ান। তিতলিকে তার ওপর, তিতলির নিজের ওপর আস্থা আর বিশ্বাস রাখতে হবে। এজন্য তিতলিকে তাকে হেল্প করতে হবে। মেয়েটাকে শক্ত করে তৈরী করতে হবে নইলে অসুস্থ হবে পাগল হবে মেয়েটা তার জন্য। অনেকদিন ভেবে ভেবে একদিন ভাবল অনেক দেরী হয়ে যাওয়ার আগে এটা বলা দরকার। সায়ান তিতলিকে ফোন দিল, আস্তে ধীরে তিতলির মুড বুঝে অনেক গল্প করলো। তিতলির মনের মেঘ যখন দূর হয়ে সে একটু স্বতঃস্ফূর্ত হলো, সহজভাবে ওর সাথে স্বভাবসুলভ চপলতায় কথা বলছিলো আর দুষ্টুমি করছিলো, সায়ানের পৃথিবী আবার দুলছিলো হারানো তিতলিকে কাছে পেয়ে। কিন্তু তাকে নরম হলে চলবে না। আস্তে আস্তে বললো সায়ান, শোন জান, তোর সাথে একটা কথা আছে, আর কথাটা তোকে মানতেই হবে। সায়ানের গলায় একটা কিছু ছিল যা তিতলিকে অকারণ ভয় পাইয়ে দিল। ভীতা হরিণীর গলায় বললো সে, আগে বল কি কথা। হেসে ফেললো সায়ান ঐপারের ত্রস্ততা টের পেয়ে। বললো, তোর জান তোকে যাই বলুক তুই সেটা রাখতে পারবি না, আগেই জানতে হবে কি কথা?

তিতলি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। নিজেকে সামলে নিয়ে মনে শক্তি যোগাড় করে বললো, বল পারবো রাখতে। সায়ান গভীর গলায় বললো, আজ থেকে রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পঁচিশবার বলবি, এ পৃথিবীতে আমার হারানোর কিছুই নেই, বরং যে আমাকে হারাবে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লুজার। আয়নায় নিজের চোখে চোখ রেখে বলবি এটা। হঠাৎ একী বলছে সায়ান। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। দমকে ওঠা কান্নাটাকে সে গলায় আটকে নিলো, মরে যাবে কিন্তু সায়ানকে তার ভিতরের যন্ত্রনা টের পেতে দিবে না, কিছুতেই না। যতোটা সম্ভব গলাটা পরিস্কার করে বললো, এ কথা কেনো বলছিস, জান কি হয়েছে? সায়ান বললো হাসতে হাসতে, আমার কিছু হয়নিরে, রোজ রোজ তোকে যে ভূতে তাড়া করে বেড়ায়, এটা তার চিকিৎসা। ওতো শক্ত হসনি, একটু ইজি হ গাধি। তিতলি এবার আর সামলাতে পারলো না। সায়ানের তিরস্কার যদিও বা সহ্য করতে পারে কিন্তু আদরে সে গলে যাবেই। সায়ানের ভালোবাসার উত্তাপে তিতলি মোম হয়ে গলে সারাবেলা। কেঁদে কেঁদে বলে, সে ভাবনা আমি সারা পৃথিবীর জন্য রাখতে পারবো কিন্তু তোকে ছাড়াতো আমি বাঁচবো না। তুই জানিস না এ পৃথিবীর কে আমায় পেল আর কে না তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না কিন্তু তোর সমস্ত কথা, ভাবনায় আমার সারা পৃথিবী দুলতে থাকে। সায়ান এবার শক্ত গলায় বললো, তা হবে না তিতলি সোনা, তোকে মনে জোর আনতে হবে, ভাবতে হবে, এ পৃথিবীতে নোবডি ইজ মোর ইর্ম্পট্যান্ট দ্যান ইউ, নেভার। ইউ আর এ জেম, আর এ জেম যে লুজ করবে, হি ইজ এ লুজার। ইভেন ইফ ইট ইজ মি দ্যান আই এ্যাম এ লুজার টু।

তিতলি বললো, আমিতো তোর কথা ভাবছি না, আমি ভাবছি আমার কথা। তোর ভাবনায় আমার দিনরাত যায়, আমার জীবনতো তোকে ঘিরে শুরু হয় তোর কাছেই এসে শেষ হয়। আমি বাঁচবো কি করে তোকে ছাড়া। আমার স্বপ্নেও তুই আমার বাস্তবেও তুই। বিষন্ন গলায় সায়ান বললো, এরকম করলে তুইতো মরে যাবি সোনা। কাউকে এতো ভালোবাসতে আছে নিজেকে ছাড়া। নিজেকে শক্ত কর, আমাদেরকে অনেক দূর যেতে হবে। পড়াশোনা শেষ করতে হবে, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বাবা মায়ের আশা আকাঙ্খার দিকেওতো দেখতে হবে। তিতলি নরম গলায় বললো, আমাকে কি করতে বলছিস? আমি কি তোর বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি। সায়ান হেসে ফেললো, দূর বোকা তাই বললাম বুঝি। বললাম, এতো টেন্স থেকে নিজেকে অতো কষ্ট দিস না সোনা। ভালো করে পড়াশোনা আর খাওয়া দাওয়া কর। যে হারাবে সে হারবে, তুই না। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখ বোকা মেয়ে।

যখন সায়ানের সাথে কথা হয়, গলার শব্দ পায় তখন তিতলির মনের ভেতরে রঙীন প্রজাপতি নাচে। এক ধরনের সজীবতা কাজ করে, অনেক নরম থাকে সে, একদম কাঁদামাটি। তাতে যা আঁকতে চায় তাই আঁকা যায়। কিন্তু ফোনের লাইন কেটে যাওয়া মাত্রই মনে হয় হারিয়ে ফেললো সে আবার তাকে। ফোন ডিসকানেক্ট হওয়া মাত্রই আবার আস্তে আস্তে তিতলির কেমন যেন লাগতে শুরু করে। পৃথিবীটা উলটে পালটে যেতে শুরু করে। সবচাইতে প্রিয় মানুষটিকে প্রচন্ড মিস করতে শুরু করে, হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করে বেড়ায়। কথা হওয়ার পর ঘন্টা দুই তিনেক মনটা ফুরফুরে থাকে। আবার শুরু হয় পরের বারের অপেক্ষা। অসহ্য লম্বা সেই দুঃসহ প্রতীক্ষা। সায়ানকে ছুঁয়ে দিতে না পারার এই অক্ষমতা, এই দূরত্বে তার মাথা গরম হতে শুরু করে, উলটা পালটা লজিক কাজ করে। ইনসিকিউরিটি আর বিরহ তাকে দিয়ে যা করতে চায় না তাই করিয়ে নেয়। সায়ানকে দুম করে উলটো পালটা একটা ম্যাসেজ পাঠায় কিংবা মেইল করে। যা বলতে চায় তা বলতে পারে না, বলে ঠিক তার বিপরীতটা। আগে সায়ান এগুলোতে ভীষণ টেন্সড হয়ে যেতো কিন্তু আজকাল বেশ বুঝতে পারে। সে হাসে আর আদর করে আবার উলটো ম্যাসেজ পাঠায়। ভালোবাসা যেখানে অসীম, ভুল বোঝাবুঝি আর রাগতো সেখানে সামান্য সময়ের দমকা হাওয়া মাত্র। যতো দ্রুত ধেয়ে আসে তারচেয়ে দ্রুত ওড়ে যায়।

তানবীরা
০৫.০২.২০১১

উৎসর্গঃ “জয়িতা” ও “নুশেরা”
মালতীলতা
হায় রাম

Sunday 20 February 2011

তোমার জন্য মিছেমিছি কাব্য লিখি না

মাঝে মাঝে ভাবি তোমায় কিছু উপহার পাঠাবো
না দামি ব্র্যান্ডেড কোন শার্ট কিংবা ঘড়ি নয়
ফরাসি পারফিউম বা ট্র্যান্ডি সানগ্লাসও নয়
খুব সাধারণ কিছু, খুব সাধারণ
ধরো রোজ গায়ে মাখি যে সাবানটা তার কিছু অংশ
কিংবা কিছুটা টুথপেষ্ট, বডিলোশন বা শ্যাম্পু
তা নইলে রোজ যে জ্যাম জেলি খাই
বোয়াম থেকে তুলে দিবো তাদের কিছুটা বা
আমার প্রিয় চকোলেটের বাক্স থেকে একমুঠো চকোলেট।

আমি এখন আর জানি না তোমার প্রিয় রঙ কোনটা
জানি না কোন গান এখন উতলা করে তোমায়
কোন বইটা পড়ে অনেক ভাবো তুমি
যেমন তুমিও জানো না আমার প্রিয় কবি কে এখন
কোন সিনেমা দেখে আমি হাঁপুস নয়নে কেঁদেছি
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে আর ঘুম না এলে
বুক ব্যাথা করলে কি কি সব ভাবি।

একদিন দুজনের সব জানার প্রতিজ্ঞা ছিলো
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আমরা দুজনে দুজনার
ছোট থেকে ছোট দুঃখ, সামান্য থেকে সামান্য আনন্দ
একসাথে ভাগ করে নিবো, পাশে থাকবো।
যারা আমাদের জীবনে ঠিক তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়তো নয়
এই ধরো তোমার অফিসে পিওন কিংবা আমার বাড়ির দারোয়ান
তারা জানে তুমি এখন কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট খাও আর কোন
বেকারীর কেক এখন আমার ভালো লাগে, শুধু আমরা দুজন বাদে

যেখানে যেখানে গেলে তোমার আমার কখনো দেখা হয়ে যেতে পারে
সে সমস্ত জায়গাগুলো আমি খুব সন্তর্পনে এড়িয়ে যাই
আমি জানি তুমিও যাও তাই আমাদের আর কখনো দেখা হয় না
অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নাম জীবন
আমরা তাই রোজ জীবন নিয়ে সামনে এগোই।
তারপরো কেনো যেনো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
দীর্ঘ এই নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে কিছু উপহার পাঠাতে।
কেমন আছো জানতে আর জানাতে ইচ্ছে করে।

********************************

কি করেছো আমার লেখা চিঠিগুলো
সেই আবেগ কাঁপা হৃদয়ের রক্ত মাখা চিঠিগুলো
কোথায় সেগুলো? অফিসের ড্রয়ারে নাকি ব্যাঙ্কের লকারে
নাকি পুড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিত করেছো নিজেকে।
নীল রঙা চিঠিগুলোতে ছিল সাধারণ কিছু শব্দ
যেগুলোর মানে আমরা দুজন বাদে কেউ জানে না।
বারবার পড়তে পড়তে অনেক চিঠিই মুখস্ত ছিলো আমাদের
আজ যখন কাউকে চিঠি চালাচালি করতে দেখি
ভাবি কোথায় হারিয়ে গেলো সেই সুগন্ধি অমূল্য চিঠি গুলো।

*******************

কেমন আছো, কি করছো? গান শুনছো?
নাকি হাঁটতে বেড়িয়োছো বন্ধুদের সাথে
অকারণ আড্ডা আর সিগ্রেট ফোঁকা?
অফিস করছো? নেটে আড্ডা দিচ্ছো?
আকাশের দিকে তাকিয়ে একলা সন্ধ্যায়
তারাদের মাঝে আমাকেই কি খুঁজে যাচ্ছো
মন খারাপ করা বৃষ্টি ঝরা নির্জন পথে হেঁটে
যেতে যেতে আমার কথাই কি ভেবে যাচ্ছো?
নির্মলেন্দুর কবিতার মাঝে তুমি আমায় পাও
প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতগুলো তুমি আমার জন্য গাও
আমরা কোথাও নেই কিন্তু আমরা আছি
কখনো দূরে আবার নিঃশ্বাসের কাছাকাছি

তানবীরা
২৫.০১.২০১১

উৎসর্গঃ পৃথিবীর সব দেবদাস আর কৃষ্ণকলিদেরকে

ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসার গান

Saturday 12 February 2011

নতুন আলোর দিশারীরা (তিন)

বালুচরী শাড়ি আমরা অত্যন্ত ভালোবেসে পড়ি, ভারতে জায়গা বিশেষে যাকে “কাঞ্জিভরম “ নামেও ডাকা হয়। যে আঁচল আর পাড়ের নকশা’র কারণে মেয়েদের কাছে এ শাড়ি এতো আর্কষনীয়, কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি এ পাড় আর নকশায় কি বোনা আছে? পাড় আর নকশায় আছে অন্দরমহলে মেয়েদের টানাপোড়েনের ইতিহাস আর তার সাথে গৌরবময় নারীজাগরনের প্রতীক।

অসংখ্য বাঁধানিষেধ পেড়িয়েই বাঙ্গালী মেয়েদেরকে আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল। এমনকি ঠাকুর বাড়ির মেয়েদেরকেও। তবে ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরা বেশ উদারমনা ছিলেন। মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তারা বাধাতো দেনইনি বরং আরো উৎসাহ দান করেছিলেন। আজ এই মসৃন চলার পথ যারা তৈরী করে দিয়ে গেছেন তাদের অনেকেই সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন, কিন্তু তাদের নাম অনেক ছড়িয়ে পড়েনি। পড়বার হয়তো কারনও নেই কিন্তু তাই বলে তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখবার কোন প্রয়াসও নেই। যেখানে চলবার কোন পথ ছিল না, কাঁটা সরিয়ে সেখানে পথের সৃষ্টি তারাই করে গেছেন। আজ তেমন কিছু মহিয়সীর কথাই লিখবো।

তবে একথা অস্বীকারের কোন জো নেই যে মেয়েদের পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা সেসময় অনেকেই উপলব্ধি করেছেন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, রাজা নবকৃষ্ণ, রাধাকান্ত দেববাহাদুর, ব্রক্ষানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা বৈদ্যনাথ রায়, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মদনমোহন তর্কালংকার, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার পুত্ররা। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতের মেয়েদের সাথে বারবার ভারতবর্ষের মেয়েদের জীবন পদ্ধতির তুলনা করতেন, বোঝাতে চাইতেন এগোতে হলে মেয়েদের ফেলে সেটা সম্ভব হবে না। হেমেন্দ্রনাথ বাড়ির মেয়েদের নিয়ম করে লেখাপড়া শিখাতেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেশি বিদেশী ভালো ভালো বই পড়ে শোনাতেন। শিখবার ইচ্ছা মেয়েদেরও কম ছিল না আর তার সাথে ছিল নতুন কিছু করে দেখানোর সাহস আর শক্তি।

দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাবার সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা পড়তে শুরু করেন বৈষ্ণবীর কাছে। দ্বারকানাথ যখন পাঠশালায় বানান শিখছিলেন তখন তাঁর দশ বছরের দিদি বানান করে বই পড়তেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদা আর গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়াকে মাইনে করা বৈষ্ণবী এসে লেখাপড়া শিখাতেন। তারা রামায়ন - মহাভারত পড়তেন, কলাপাতায় হাতের লেখা অনুশীলন করতেন। সে সময়ে তাই রীতি ছিল। শোনা যায় সারদা অবসর সময়ে হাতের কাছে অন্যকিছু না পেলে অভিধান খুলেই পড়তে বসে যেতেন। “চাণক্যশ্লোক” তার প্রিয় পাঠ্য ছিল। যোগমায়া নানান ধরনের বই পড়তেন। মালিনী আসতো বইয়ে ঝাঁকা নিয়ে সেখান থেকে মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো লাইলী - মজনু, হাতেমতাই, আরব্য রজনী, ল্যম্বস টেল ইত্যাদি নিতেন। মহর্ষির বড়মেয়ে সৌদামিনীও পরবর্তীতে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

ঠাকুরবাড়ি ছিল সে সময়ের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানকার মেয়েরা অন্যান্যদের তুলনায় একটু বেশি সুবিধা পাবেন তাতে আর নতুন করে কি ভাবার থাকতে পারে। কিন্তু যারা গ্রামে ছিলেন? সুদূর পল্লীগ্রামের গৃহবধূ রাসসুন্দরী একটু আধটু পড়তে শিখেছিলেন। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম আত্মজীবনী লিখেছিলেন। রাত্রিতে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে তাকে পড়াশোনা করতে হতো, কারো চোখে পরলেই ছিল নানা ধরনের তিরস্কার। শিবনাথ শাস্ত্রীর মা গোলকমণি দেবীও লুকিয়ে নানা উপায়ে লেখাপড়া শিখেছিলেন। পাবনার প্রমথ চৌধুরীর দিদি প্রসন্নময়ী ছেলেদের সাজে পাঠশালায় যেতেন। তার পিসিদের মধ্যে তিনজন ভগবতী, কৃষ্ণসুন্দরী ও মৃন্ময়ী ভালো লেখাপড়া জানতেন। তার ছোটপিসি বাল্যবিধবা কাশীশ্বরীর সাথে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে যেতো। চন্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের মেয়ে দ্রবময়ীর নামও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তবে এরা ছিলেন ব্যতিক্রম। গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েই পড়াশুনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কোলকাতার অবস্থা সে তুলনায় ঢের ভালো ছিল। প্রথমে বৈষ্ণবীরা এসে পড়ালেও সে জায়গা অতি দ্রুত দখল করে নেন ইংরেজ গৃহ শিক্ষিকারা।

প্রসন্নকুমারের মেয়ে হরসুন্দরী ও পুত্রবধূ বালাসুন্দরী অত্যন্ত বিদুষী ছিলেন। অকালমৃত্যু না হলে হয়তো জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্ত্রী বালাসুন্দরী বাংলাদেশের স্ত্রী স্বাধীনতার সূচনা করে যেতেন। তিনি সকাল নটা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত শিক্ষিকার কাছে পড়াশুনা করতেন। ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারতেন। যদিও অন্তপুরের বাইরে তিনি যাননি কিন্তু তার প্রস্তূতি শুরু করেছিলেন। এ সময় অনেকেই মেয়েদের জন্য স্কুল খোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। যদিও জেনানা মিশনের উদ্যেগে কিছু স্কুল ছিল কিন্তু সেখানে অভিজাত পরিবারের মেয়েরা যেতেন না। সে সময় প্রচন্ড বাধার মুখেই স্থাপিত হয়েছিল “বেথুন স্কুল”। প্রথমে অবশ্য নাম ছিল “হিন্দু ফিমেল স্কুল”। দেশীয় পন্ডিতদের সাহায্যে স্কুলটি স্থাপন করেছিলেন জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন। প্রথমে স্কুলটি খোলা হয়েছিল রাজা দক্ষিণারঞ্জনের সুখিয়া স্ট্রিটের বাড়ির বৈঠকখানায়। স্কুলের প্রথম ছাত্রী ছিলেন মদনমোহন তর্কালংকারের দুই মেয়ে কুন্দমালা ও ভুবনমালা। মেয়েদের স্কুলে পাঠাবার অপরাধে তাকে তার নিজ গ্রামে সমাজচ্যুত করা হয়। ওই দুজনের সাথে আরো উনিশটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হন।

১৮১৯ সালের মে - জুন নাগাদ খোলা হয় “জুভেনাইল স্কুল”। প্রথমে ছাত্রী ছিল আটটি, পরে দাঁড়ায় বত্রিশটিতে। ১৮২১ সালে মেরী অ্যান কুক কোলকাতায় কতগুলো অবৈতনিক স্কুল খোলেন। এক বছরের মধ্যেই তিনশো মেয়ে লেখাপড়া শুরু করে। ১৮৭২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ছ’শোতে। শ্রীরামপুর, ঢাকা, বীরভূম, চট্টগ্রামেও মেয়েদের স্কুল খোলা হয়। সংবাদপত্রে তুমুল বাধা দিয়ে সংবাদ ছাপা হতে থাকে। সরলমতি বালিকারা স্কুলে গেলে ব্যভিচার হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে। তারপরও যখন আস্তে আস্তে পড়াশোনার প্রসার বাড়তে লাগলো তখন বেথুনে পড়া তথা স্কুলে পড়া বিপথগামিনী বালিকাদের নিয়ে নানা ধরনের প্রহসনমূলক কবিতা, গল্প, নাটক লেখা শুরু হলো। “স্বাধীন জেনানা”, “পাশকরা মাগ”, “বৌবাবু”, “বেহদ্দ বেহায়া” ইত্যাদি ইত্যাদি।

(চলবে)
জানুয়ারীর কোন এক সময় ড্রাফট করা। ২০১০।

Wednesday 9 February 2011

হয়তো জরুরী নয় তবুও

কঠিন, তাত্বিক কিছু লেখার জন্য যে ধরনের একাডেমিক পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনার গভীরতার প্রয়োজন হয় তা আমার নেই। লেখালেখি, নাচ, নাটক এগুলো আমার বেঁচে থাকার রসদ, নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া যে না আমি মরে যাইনি, বেঁচে আছি এখনো। তাই আমি এগুলো থেকে আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করি। সারাদিনে অনেক ধরনের স্ট্রেন যায় যেগুলো এড়ানোর কোন রাস্তা নেই, তাই যেই ঝামেলাগুলো এড়ানো সম্ভব সেগুলো অন্তত এড়িয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, একটা খারাপ সম্পর্ক মেনটেন করতে যতোটা এফোর্ড দিতে হয়, ভালো সম্পর্ক মেনটেন করতে ততোটা দিতে হয় না। তাই তাত্বিক কিছু নয়, কিছু উপলব্ধি লিখতে কেন যেন আজ ইচ্ছে করছে। ছোটভাইসম গৌতমকে অনেক বার বলেছিলাম নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখবো। মেয়ের স্কুলকে খুব কাছে থেকে ফলো করেছি একটা সময়, নিজেদের স্কুল জীবনের সাথে পদে পদে তুলনা করেছি কিন্তু লিখবো লিখবো করে কয়েক বছর চলে গেছে লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আসলে লিখে ফেলা খুবই দরকার ছিল মনে হয় এখন।

মেয়ের স্কুল থেকে বছরে তিন বার রেজাল্ট দেয়। এটা প্রাথমিক স্কুলের নিয়ম। প্রত্যেক সাধারণ প্যারেন্টস সময় পান দশ মিনিট আর যাদের বাচ্চাদের সমস্যা আছে তারা বেশি সময় কিংবা আলাদা এ্যাপয়ন্টমেন্টও পান। সমস্যা মানে, বেশি মারামারি করে, পড়ায় অমনোযোগী, স্কুলে দেরীতে আসে, বেশি কামাই করে অসুস্থ হওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য স্কুল আর প্যারেন্টসকে একসাথে কাজ করতে হয়। ফলাফল থাকে চারটা ভাগে ভাগ করা। সিলেবাসের পড়াশোনা, সিলেবাসের বাইরে কি জানে, সোশ্যাল ইমোশোনাল ডেভেলাপমেন্ট ও গ্রস মোটর স্কিলস। প্রতি বছর সরকার থেকে সিলেবাস, এক্সাম পেপার সব প্রত্যেক স্কুলকে দেয়া হয়, সেই এক্সামের ওপর ভিত্তি করে বাচ্চাদেরকে এ, বি, সি থেকে এফ পর্যন্ত গ্রেডিং দেয়া হয়। তারপর থাকে সিলেবাসের বাইরে কি জানে। বাচ্চাদের মেধানুযায়ী সিলেবাসের বাইরে অংক, গ্রামার ইত্যাদি দেয়ার নিয়ম আছে। সেটা দিয়ে তারা মাপে ডেভেলাপমেন্ট আর ইন্টারেষ্ট। কোন বাচ্চা বেশি আঁকতে ভালোবাসে, কেউ অঙ্ক করতে আবার কেউ বই পড়তে। আর একটা পার্ট হলো সোশ্যাল এন্ড ইমোশোনাল ডেভেলাপমেন্ট পার্ট। বাচ্চারা বন্ধুদের সাথে কিভাবে আচরন করে, কোন বন্ধু খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে কিভাবে সাহায্য করে, নিজের অঙ্ক করা হয়ে গেলে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে সাহায্য করে কীনা সে সমস্ত টীচারকে নোট রাখতে হয় প্রতিটি বাচ্চা সম্পর্কে। গ্রস মোটর স্কিলসে থাকে বাচ্চা জিমে, খেলায়, শারীরিক ব্যাপারগুলোতে কেমন রেসপন্স করছে। এনাফ ফিট কীনা। শারীরিকভাবে ফিট না হলে সে ঠিকভাবে স্কুল এঞ্জয় করবে না তাই এটাও সমান গুরুত্বপূর্ন।

ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি পশ্চিমে সব ফ্রী। সেক্স থেকে জীবন, যা ইচ্ছে তাই করা যায়। সাদা চোখে তাই দেখা যায় বটে। এখানে এডাল্টারী প্রমান করতে পারলে পার্টনারের বিরুদ্ধে, এনি থিং ক্লেম করতে পারে হিসাবের বাইরে। বিশ্বাস ভঙ্গ এখানে সবচেয়ে বড় শাস্তি। সম্পর্ক মানে সম্মান। আর সম্মান ভঙ্গের কোন ক্ষমা নেই। এখানে স্কুলের বাচ্চাদের কোন নির্ধারিত স্কুল ড্রেস নেই, বাচ্চাদেরকে ছোটবেলা থেকে ফ্রীডম উপভোগ করার সুযোগ দেয়ার জন্যে কোন স্কুল ড্রেস সিষ্টেম রাখেনি তারা। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেকের “ন্যাক” আর “স্বভাব” সম্বন্ধে কাগজে কলমে অফিসিয়ালি নোট রাখা হয়। কিছুদিন আগে অব্ধি অলিখিতভাবে মেয়েদেরকে ডাক্তারী পড়তে দেয়া হতো না। মেয়েদের নার্ভ দুর্বল এ কারণে। নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে এখনো আমরা নারী ডাক্তারদেরকে হা করে চেয়ে দেখি কারণ জানি ইনি অনেক ঘাটের জল খেয়ে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। ওনাকে আটকানো যায়নি, আটকাতে পারলে আটকে দিতো। এই নার্ভ সংক্রান্ত রিপোর্ট আসে স্কুল থেকে। ডাচ এডুকেশনে কোন ধরনের প্রাইভেটাইজেশন নাই বলে প্রাথমিক স্কুলের এই রিপোর্ট অনেক গুরুত্বপূর্ন। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের সেজন্য অনেক ট্রেইন্ডও হতে হয়। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চার বছর বাচ্চাদের সাইকোলজি ও টিচিং এর ওপর আলাদা পড়াশোনা করতে হয়।

যখন আমি এখানে পড়তাম আমার কাছে এদের অনেক কিছুই হাস্যকর লাগতো। গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের মধ্যে হাউ টু ট্রীট ক্লায়েন্ট ব্যাপার থাকতো। ব্যাপার হলো, কোন একটা সমস্যা সিলেক্ট করে দুজন করে পার্টনার করে দিতো। একবার আমি ক্লায়েন্ট হবো আর একবার আমার পার্টনার। আমরা একজন একজনকে ফোন করবো কিংবা অফিসে যেয়ে দুপক্ষ সেজে সেগুলো আলোচনা করবো। এগুলোর পরীক্ষাও হতো ভিডিও রেকর্ডিং সিস্টেমে। আমি বাসায় এসে বলতাম কি শ্যালো ব্যাপার স্যাপার এগুলো বলো। আমার স্বামী যিনি আমার খুব ভালো বন্ধুও অনেক সময় তিনি আমাকে বোঝাতেন। পড়া এক ব্যাপার আর পড়াটাকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করা আলাদা ব্যাপার। আমাদের দেশে কেউ কেউ নিজ থেকে শিখে নেয় কি করে জীবনে সারভাইভ করতে হবে। আর এদেশে একজন যখন শিখে নিয়েছে তার বিদ্যাটা সবার সাথে শেয়ার করে কি করে প্র্যাক্টিক্যালি পড়াটাকে ব্যবহার করতে হবে কিন্তু তখনো আমি ঠিক করে বুঝিনি আসলে কি বোঝাতে চাইতো। আমি অবাক হতাম, একজন গ্র্যাজুয়েট কি করে একটা ফোন রিসিভ করতে জানবে না, এটা কি শিখানোর বিষয়? আজ জানি হ্যা এটাও একটা শিক্ষা, হাউ টু ট্রীট এ কল, বরং বিরাট শিক্ষা। বিরাট ডিগ্রী থাকলেই সামান্য কল হ্যান্ডল করা যায় না।

আমি ইন্টার্নী করতে ফিলিপ্সে ঢুকেছিলাম, ইন্টার্নী শেষ করার পর সেখানেই চাকরি হয়ে যায়। এদেশের সরকারের নিয়মানুযায়ী বছরে মিনিমাম ষাট ঘন্টা প্রত্যেক কর্মচারীকে আত্ম উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক কোম্পানী কিছু ডেভেলাপমেন্ট কোর্স দিতে বাধ্য। সেটা একাডেমিক হতে পারে কিংবা কম্পিউটার এনি থিং। কিন্তু দিতে হবে। আর অনেক কোম্পানী দক্ষ কারিগর তৈরী করার জন্য নিজেই অনেক সেমিনার ট্রেনিং এর আয়োজন করেন। ফিলিপ্স এর মধ্যে অন্যতম। এদের ট্রেনিং তৈরী করার কায়দাও মজার। অনেকগুলো ফিলিপ্সের অফিস থেকে, বিভিন্ন দেশ থেকে, সেম র‍্যাঙ্কে কাজ করা লোকদের নিয়ে ট্রেনিং সেশনের আয়োজন করেন। কর্তৃপক্ষ ভাবেন যাদের সাথে সারাক্ষণ মেইল আর ফোন হয় তাদের মধ্যে কখনো সামনা সামনি দেখা হয়ে যাওয়া বিরাট ব্যাপার। ফোন বা মেইলে আমরা যে একটা মুখ কল্পনা করি সামনা সামনি বেশির ভাগ সময়ই সেই মুখ কল্পনার সাথে মিলে না। ফিলিপসের এই সেশনগুলোতে অনেক আঙ্কেট থাকতো। একই প্রশ্ন সামান্য একটু অদল বদল করে পাঁচ বার ছয় বার করা হতো। শুধুই মানসিকভাবে কর্মচারীদেরকে যাচাই বাছাই করা। কোম্পানী তাদের থেকে ভবিষ্যতে কতদূর কি আশা করতে পারে। কাকে ছেঁটে দিতে হবে, কে টিকে যাবে। একজন লোক কতবার ফাঁকি দিতে পারবে, নিজের মনোভাব একবার হলেও প্রকাশ হবে সেভাবেই আঙ্কেট সাজানো। কে লীড করতে পারবে, কে ডেস্কে ভালো করবে, কে ক্লায়েন্ট হ্যান্ডল করতে পারবে, কাকে কোথায় সরাতে হবে ঠিক করতো এই আঙ্কেট। ফিলিপ্সে অলিখিত নিয়ম আছে চল্লিশের আগে কাউকে গ্রুপ লিডিং দিতে দেয়া হয় না। একটা গ্রুপকে হ্যান্ডেল করতে যে মেন্টাল ট্র্যাঙ্কুলিটির প্রয়োজন তা নাকি চল্লিশের আগে একজন মানুষের আসে না। এ তথ্যও সব আঙ্কেট গবেষনা করে মনোবিদরা বের করেছেন।

একবার আমি ফিলিপ্স একাউন্টিং প্রিন্সিপালস কোর্সে ডাবলিন ছিলাম এক সপ্তাহ। সপ্তাহের শেষের দিকে এই অন্ধকার ঘরে বসে থেকে প্রজেক্টরে দেয়া প্রেজেন্টশন আমি আর নিতে পারছিলাম না। আমি কিছুই করিনি, রিভলবিং চেয়ার দেয়া হয়েছে সবাইকে। আমি চেয়ারটা অনেক ঘুরাচ্ছিলাম ডান পাশ আর বা পাশ। যথাসময়ে কোর্স শেষ হলে সনদ নিয়ে বাড়ি ফিরে আমি একথা ভুলেও গেছিলাম। কিন্তু বছরের শেষে ইভিলিওন মীটিং হচ্ছিলো বসের সাথে। আমায় জিজ্ঞেস করলেন, কোর্স কেমন এঞ্জয় করেছি, আমি স্বভাবসুলভ মিথ্যে কথা বল্লাম, দারুন। বস বললো, তুমি শিওর। আমিও মাথা নেড়ে, এবস্যুলুট। তিনি তখন আমার কোর্স আচরনের রিভিউ দেখালেন যে আমি অমনোযোগী ছিলাম শেষটায়। এটা কোর্স কোর্ডিনেটর রিভলবিং চেয়ার মোচড়ানো থেকে বের করেছেন এবং আমার ধৈর্য্য সম্বন্ধে রিপোর্ট করেছেন আর আমি জানি, তিনি ভুল বলেননি।

এখন কথা হলো জীবন ভর এতো সোশ্যাল এন্ড ইমোশোন্যাল ডেভেলাপমেন্ট কোর্স করে কি কিছু শিখেছি? না শিখিনি, যা শিখেছি তা শিখেছি ঠেকে।

ফিলিপ্সে চাকরী হওয়ার পর ভাবলাম এখন ড্রাইভিং শিখি। আমার স্বপ্ন, চিন্তা আর পা তখন সাত আসমানে, আমি তখন রীতিমতো হাওয়ার উড়ি। জীবনে প্রথম নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে তখন আমি দিশেহারা। গাড়িতে চাবি দিয়ে এমন জোরে টান দেই যেন এরোপ্লেন। আমার ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর আমায় অনেকদিন সর্তক করেছেন। আমি মনে মনে ভাবি তখন, শালা বুড়া চুপ থাক। তুই বুঝিস কি? ত্রিশ টাকা আওয়ার নে আর পাশে বসে দেখ। অনেকবার বলার পরও আমার কোন পরিবর্তন না দেখে ডেনিস আমায় একদিন বললো, তানবীরা, গাড়ি কতো জোরে চালাও তার এক্সাম কিন্তু তোমার হবে না। চাবি ঘুরিয়ে, গিয়ার দিয়ে এক্সিলেটারে পা চাপলে গাড়ি চলবেই। এটা সব্বাই পারে। পরীক্ষা হবে নিয়ম মেনে, কতোটুকু নিরাপদভাবে তুমি গাড়ি চালাতে পারো। তুমি নিরাপদ কীনা, রাস্তায় অন্যরা তোমার থেকে নিরাপদ কীনা সে পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই তোমার লাইসেন্স পাওয়ার প্রশ্ন আসে। যাকে আমি অশিক্ষিত ড্রাইভার বলে অবজ্ঞা করতাম, সেই সন্ধ্যায় বলা তার এ কথাটা আজ দশ বছর বাদেও আমি রোজ মনে করি। জীবনের প্রত্যেক খাতায় এই হিসাব। একাউন্টেসী সবাই জানে। দুইএর সাথে দুই যোগ দিলে চার হবে। কিন্তু নিয়ম মেনে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে, ঠিকভাবে খাতা ম্যানিপুল্যাট করাকে বলে একাউন্টেসী। প্রত্যেকটা ফাঁকি হতে হবে নিয়ম মাফিক।

আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে মা কোমা থেকে ফেরৎ এলেন, পরে জানলাম অপারেশন করতে হবে, তাতে অপারেশন টেবল থেকে মা ফিরতেও পারেন নাও ফিরতে পারেন। কিন্তু অপারেশন এর কোন বিকল্প নেই। ভাই ইজিপ্টে এম এস করছেন। ঠিক হলো আমরাই যাবো মায়ের পাশে। মেয়ের স্কুল থেকে ফাইট দিয়ে গেলাম। প্রতিবার কেউ না কেউ প্লেনের দোর গোড়ায় থাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। ভাই তার যথাসাধ্য ইন্সট্রাকশন দিয়ে রেখেছে দেশে, বোনের যাতে সমস্যা না হয়। প্লেনের দোর গোড়া থেকে এবার অনাত্মীয় কেউ যখন বাইরে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন, সেই প্রথম বার মনে হলো আমি বড় হয়ে গেছি কারণ আমি এখন একা। ছোট দুইবোন গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে আর কেউ নিতে আসার নেই। মা হাসপাতালে, বাবা জ্বরে কাহিল, ভাই বাইরে। আমাদের বহুদিনের পুরনো ড্রাইভার সালাহউদ্দিন এসে আমার হাতের লাগেজটা নিতে নিতে বড্ড নরম গলায় বললো, বড় আপা আসেন। সেই বলার মধ্যে কী জানি একটা ছিলো। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে সালাহউদ্দিন কেমন চোখে জানি আমার দিকে তাকিয়েছিল। ওকি আমার ভিতরটা তখন পড়তে পারছিলো। দেখছিলো এর আগে প্রতিবার যখন আমি আসতাম এয়ারপোর্টেই উৎসব শুরু হতো। নিরাবরন নিরাভরন এই আগমন আমার আজ। একটা কাকতালীয় ব্যাপার ছিল, এতো বছরে কোনদিন আমার প্লেন সন্ধ্যাবেলায় থামেনি দেশে। শুধু সেই একবার মন খারাপ করা বিষন্ন সন্ধ্যায় আমার প্লেন ল্যান্ড করেছিল। প্রকৃতিও কি বুঝতে পেরেছিল কিছু?

প্রথম সেদিন আমার মনে হলো সালাহউদ্দিন শুধু ড্রাইভার না, যাকে নিয়ে আমরা আড়ালে হাসাহাসি করি। কি মডেলের মোবাইল ওর, কেমন ঘড়ি পরে, ড্রাইভার হলেও স্টাইল আছে সানগ্লাসের আর কাপড় চোপড়ের। এতো ফুটানি কোথা থেকে করে তেল চুরি করে বিক্রি করে কিনা, আমাদের আড়ালে গাড়ির এসি চালিয়ে সিডি বাজায় কিনা। সেদিন আমার প্রথম মনে হল সালাহউদ্দিন আসলে সেই ব্যক্তি যে আমাকে বউ বেশে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে দিনরাত আনা নেয়া করেছে, কলেজে ইউনিতে নিয়ে গেছে, সকল ঝামেলা বাঁচিয়ে। ও আর সেই ছেলেটি নয় যে গাড়ি চালানো শিখতে যেয়ে দিনরাত আমার বাবার বকা খেতো, গাড়ি এদিকে ওদিকে গুঁতো লাগিয়ে এনে ভয়ে ভয়ে থাকতো। আমাদের বাড়ি থাকতে থাকতে ও আমাদের সুখে দুঃখের একজন হয়ে গেছে যাকে এখন আমাদের দুঃখ কষ্ট ভাবায়। সেই প্রথম ওকে আমার ড্রাইভার সালাহউদ্দিন না মানুষ সালাহউদ্দিন মনে হয়েছিল।

মনে হয়েছিল, শুধু বাবা মা ভাইবোন নয়, যারা দিনরাত আমাদের পাশে থেকে আমাদেরকে দেখে শুনে যাচ্ছে তারাও আমাদেরই পরিবার। শুধু বেতন দেয়া আর কাজ করা নয়। মায়ের অসুখ উপলক্ষ্যে অনেকে বাড়িতে এসেছেন, হাসপাতালে এসেছেন দেখা করতে, আমার ভিতরটা তির তির করে কাঁপতো। অনেকেই হয়তো আমাদের থেকে অন্যদিকে অনেক কষ্টে ঝামেলায় আছেন। কিন্তু আমাদেরতো সব থেকেও সব কিছু নাই হয়ে গেলো। আমি বাড়ি এসেছি কি খাবো, কোথায় শোব কেউ দেখার নেই। কেউ নেই আর দিন রাত আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করে। সেদিনে আফিয়া এসে যখন আমার বাবাকে নরম গলায় বললো, খালু বড় আপার জন্যে শুঁটকি মাছ এনে দেন, সাথে দিয়ে দিবো। তখন আমার মনে হলো, আফিয়া শুধু সে নয় যে সেজেগুজে সালাহউদ্দিন আর দারোয়ানের সাথে টাঙ্কি মারে বলে আমরা হাসি। সে আমার বোনের মতোই কেউ, যে আজ আমার মা বাড়ি নেই বলে, বাবার কাছে আমার জন্যে শুটকির আবদার করে দাঁড়িয়ে। মায়ের অসুখ আমাকে একটা জিনিস শিখালো, রোজ দিনের চেনা মুখগুলোকে মানুষ ভাবতে। তাদের পজিশন, শিক্ষা দীক্ষা ছেড়ে দিয়ে তারা যে মানুষ রক্ত মাংসের, আর সে জন্যই যে তাদেরকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিৎ প্রথম বারের মতো সেটা আমি অনুভব করলাম।

মায়ের অসুস্থতার কারণে পুরো চেনা পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে গেলো। পরিচিত মুখগুলোও অপরিচিত হয়ে গেলো। কঠিন কঠিন বাক্য অবলীলায় লোকে বলতে লাগলো। আমাদের যে বুক পিঠ এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে কোন জায়গায় লাগে কথাগুলো, সেটা লোকে অনুভবই করতে পারে না। মা মৃত্যু শয্যায় ঐদিকে পারলে লোকে বাবার বিয়ের পাত্রী খুঁজে। তখন জীবনে প্রথম শিখলাম আসলে কোন কথাগুলো কখনো কাউকে বলতে হয় না। কেনো কথা বলার আগে মানুষের মনের কোথায় বাঁজবে সেটা ভাবা জরুরী। তার চোখে চোখ রাখা জরুরী। কেনো সোশ্যাল আর ইমোশোন্যাল ডেভেলাপমেন্ট জীবনে জরুরী। কেনো নাকের আগে চোখে দেখা জরুরী। সামান্য দুটো কথা যেকোন লোককে সারা জীবনের শত্রু তৈরী করতে পারে। ভুলে গেছি তোমার কঠিন কথা ভাব দেখাব কিন্তু ভুলবো না কখনো। কথা বলার আগে ভাবতে হয়, যে শুনবে তার কেমন লাগবে। নিজে কতো বড় তা জাহির করার আগে অন্যকে কেন ছোট ভাবছি তার কারণগুলো খাতায় গুছিয়ে লেখাও জরুরী। আরেকজনকে হার্ট করে ক্ষণিকের পাশবিক নোংরা আনন্দ কতোটুকু স্বাস্থ্যকর। কি দিচ্ছি আর কি পাচ্ছি তা জানাও জরুরী। ভালোবাসা ভালোবাসা আনবে নোংরামি আনবে শত্রুতা।

কিংবা হয়তো জরুরী নয় তবুও

তানবীরা
০৭.০২.১১

Saturday 5 February 2011

বকুলকথা (শেষ পর্ব)

খোঁজ নিয়ে কাকিমার অনুমতি নিয়ে বকুল পাড়ার কাছাকাছি একটা পার্লারে ঢুকলো কাজ শেখার জন্য। মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে বকুল কাজ শিখতে লাগলো। ভুরু প্লাক দিয়ে শুরু করে খুব দ্রুতই স্কীন কেয়ারে পৌঁছে গেলো সে। কাজের জায়গায় আস্তে আস্তে অনেকের সাথে তার বেশ ভাব হলো। ভাগ্য বিড়ম্বিত অনেকেই আছে এ পৃথিবীতে তাহলে সে শুধু একা নয়। দুর্ভাগিনীরা দায়িত্ব নিয়েছে সুখী মানুষদের সুন্দর করে সাজিয়ে গুজিয়ে তোলার। অন্যদের দুঃখের কথা শুনে, নিজের দুঃখ ভাগ করে এক রকম দিন কেটে যাচ্ছিলো। সেখানে একটা আলাদা পরিবার তৈরী হলো তার। সবচেয়ে বেশি ভাব হলো ঝর্ণাদির সাথে। গোপন থেকে গোপন দুঃখও দুজন দুজনের মধ্যে ভাগ করে নিতে লাগলো। স্বামী সন্তান নিয়ে ঝর্ণাদিকেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় দৈনন্দিন জীবনে। একদিন ঝর্ণাদি বকুলকে বললো, এতো ভালো কাজ শিখে এখানে কেনো পড়ে থাকবি তুই? আমি চলে যাচ্ছি ভালো পার্লারে, তুই যাবি সাথে? অনেক ভেবে বকুলও ঝর্ণাদির সাথে যাবে ঠিক করলো। মোটা বেতনে বকুল শহরের নামকরা পার্লারে এখন কাজ করছে। সকালে পার্লারে কাজে যায় সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে বাড়ির কাজ করে, কাকু-কাকিমার দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে বস্তিতে গিয়ে মা বাবাকে দেখে আসে। তাদের ওষুধ পথ্য, সংসারের কি প্রয়োজন দেখে শুনে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসাধ্য পূরণ করার চেষ্টা করে। বকুলের ভবিষ্যৎ ভেবে মা বাবা দুঃখিত হন, তাদের সাধ্য সীমিত এই বলে বকুলকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন। বকুলের মাঝে মাঝে কেনো জানি বিশ্বাস হতে চায় না। তার মনে হয়, বিয়ে হলে সে যদি পর হয়ে যায়, মা বাবাকে না দেখে, এ ভয়েই কি মা বাবা তার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পিছিয়ে থাকেন। এভাবেই ঘুরছিলো ঘড়ির কাটা, ক্যালেন্ডার তার পাতায় রঙিন ছবির সাথে বছরের সংখ্যা বদলে যাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে মাথার ঘন চুল পাতলা হতে শুরু করেছে, চোখের কোলে ভাঁজ জমতে শুরু করেছে।

রাতে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। দু চোখের পাতা জুড়ে থাকে হতাশা, বিষাদ আর ক্লান্তি। জানালার বাইরের অন্ধকার আর তার দু চোখের অন্ধকার এক সাথে মিশে যায়। বাইরের অন্ধকার ক্ষণস্থায়ী, আহ্নিক গতিতে ভোরের আলো রাতের অন্ধকারকে খেয়ে নিবে কিন্তু তার জীবনের অন্ধকারের কি হবে? আজকাল ঝর্ণাদি বলছেন বাবা মা, কাকু-কাকিমার আশা ছেড়ে দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিতে, ঝর্ণাদি সাহায্য করবেন। সেদিন ষ্টুডিওতে গিয়ে তিন / চার রকমের পোজে ফটো তুলে এসেছে সে, পাত্র পক্ষকে পাঠাবার জন্যে। ভয়ও লাগে, পত্রিকা দেখে একদম অচেনা অজানা লোক আসবেন, তারা মানুষ কেমন হবেন। যদি ঠকে যায়, তাহলে কার দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে সে। তারপরও মরিয়া হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিল পাত্র চাই শিরোনামে। খুব বেশি কিছু নিজের সম্পর্কে বলারতো ছিল না, খুব বেশি সাড়া পড়েওনি। যারাও বা বিজ্ঞাপণ পড়ে এসেছিল তারাও তার আশ্রিত অবস্থা জানার পরে আর তেমন আগ্রহী হননি। বোস বাড়ির আশ্রিতা না হয়ে যদি দত্তক মেয়ে হতো সে তাহলে হয়তো সাধারণ একটা আটপৌড়ে ঘরের, শিক্ষিত মার্জিত একটা ছেলেকে সে স্বামী হিসেবে পেতে পারতো। রাজপুত্র কিংবা ধনী কিংবা বিরাট কোন চাকুরীজীবির আশাতো সে রাখেনি মনে। তাকে শুধু একটু বুঝবে, শিক্ষিত, মার্জিত এইটুকু স্বপ্ন দেখে সে তার কাঙ্খিত স্বামী নিয়ে। দু একজন বয়স্ক বিপত্নীক সামান্য আগ্রহ প্রকাশ করলেও বকুল নিজেই কেনো যেন তার মন থেকে সাড়া পেলো না।

পার্লারের অনেকেই বলে তুই কেনো কারো সাথে ভাব করার চেষ্টা করিস না? কিন্তু ভাবটা কখন করবে বকুল আর কার সাথে? সেতো অফিসে কাজ করে না, কোন ছেলের সাথে যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ কোথায় তার জীবনে? রাস্তায় হাটার মাঝে কতো জনকেইতো দেখে কাকে বলবে এসো ভাব করি? আর বলবেইবা কোন মুখে, আশ্রিতার প্রতি কেবা আগ্রহী হবেন? আর ভাবের কান্ড নিয়ে পাড়া থেকে মাঝে মাঝে যে ধরনের ঘটনা কানে আসে তাতে তার সাহসেও কুলায় না। এগুলো বড়লোকের ছেলে মেয়েকে মানায়, তাদেরকে না। কাকু-কাকিমাকে গোপন করে পাড়া থেকে দু একজন চেষ্টা করেছিল তার বিয়ের জন্য কিন্তু কোন শিক্ষিত ছেলে, সে যতো ছোট চাকরীই করুক, কারো বাড়িতে আশ্রিত থাকে এমন মেয়েকে বিয়ে করলে সমাজে লোকে কি বলবে সে কথা ভেবে বকুলের দিকে মুখ তুলে চাইলো না। আজকাল বকুল ভাবে তাহলে সে কোন শ্রেণীতে রইলো? ভদ্রলোকের সমাজে সে গৃহিত নয়, আর ছোটলোকদের সমাজে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। বোস বাড়িতে এসে আজ সে কূল হারা। কীইবা ক্ষতি হতো যদি সে রাঙা কাকিমার মতো ছোট টিপ না আঁকতে জানতো কপালে কিংবা চিকন পাড়ের ডুরেশাড়ি না পরতো। কপালে আজ থ্যাবড়ানো সিঁদুর নিয়ে কোন সস্তার শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে, কারো আদরে সোহাগে দিনতো কাটিয়ে দিতে পারতো। তার কোল জুড়ে কেউ থাকতো যে হয়তো কারণে অকারণে তাকে মা বলে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতো।

আজ মনে হয় বৃথাই এই রবীন্দ্র সদনে যাওয়া, এই রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া। বৃথা এই রান্নার বই দেখে নানা রকম স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করা। মার্জিত দেখানোর জন্য নিজের প্রতি এতো যত্ন নেয়া। বাবা মাকে দেখতে বস্তিতে যখন যায়, ছোট বেলার খেলার সাথিদের সাথে দেখা হয়ে যায় কখনো সখনো। এক পলক দাঁড়িয়ে কুশল সংবাদ আদান প্রদানের ফাঁকে তৃষিত নয়নে সে তাদের ভিতরটা কেটে কেটে দেখে নিতে চায়। সস্তার শাড়ি, অমার্জিত সাজগোজ, তেল চুপচুপে চুল কিন্তু মুখে অন্যরকম একটা লাবন্য। এর নাম কি সুখ? কোলে ছেলে নিয়ে যখন সংসার সম্বন্ধে হাজারটা অনুযোগ করে, গলার স্বরটা ওদের কেমন যেনো পালটে যায়, এটাই কি আনন্দ? তারা যখন তাকে বলে ঘর বর হয়নি তার, বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে, তার ভিতরটা কাঁপতে থাকে। সে কম্পনে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কাকে বলবে এ কষ্টের কথা। কি হতো বোস বাড়িতে না থেকে যদি দিদিদের মতো মায়ের কাছেই থেকে যেতো। যা জানতো না কোনদিন সেটা হারাতো না। এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, হেমন্ত, মান্নার চেয়ে এই বস্তির আকাশে ভেসে যাওয়া হিন্দী গান প্যায়ার কা তোফা তেরা, পাড়ার ছেলেদের খিস্তি গালি, বারোয়ারী পূজার মন্ডপ এগুলোও একটা জীবন চালিয়ে নিতে কম কিছু না। বড় কিছু পেতে গিয়ে আজ সে নিঃস্ব হয়ে গেলো।

কী কী অন্যায় করেছে এ জীবনে? কী কী খারাপ কাজ করেছে? জ্ঞানত কার কার ক্ষতি করেছে? কার দুঃসময়ে হেসেছে, কার দুর্ভাগ্যে খুশি হয়েছে? ছোটবেলায় কত পাখির সংসার ভেঙে দিয়েছে গাছের ডাল থেকে, সেই কি ঘোর পাপ হল? সিনেমায় দেখা নায়ককে মনে মনে তার নিজের বলে কল্পনা করতো তাতেই কি তার চিত্ত অশুদ্ধ হল? তাই কি বিশেষ কারো ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো? কিন্তু সজ্ঞানে বড় কিছুর প্রতি হাত বাড়িয়েছিল কি? কি পাওয়ার জন্য আজ সব হারালো বকুল? কার কাছে এর প্রতিকার চাইবে? আজকে তার এই নিয়তির জন্য তার কি অপরাধ? কেন পৃথিবী তাকে তার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করলো? দিনটা কাজের মধ্যে কেটে যায়। ভয়াবহ লাগে একলা থাকা রাতগুলোকে। একাকিত্বকে চেনা যায় এই দুঃসহ দীর্ঘ রাতের দিকে তাকিয়ে। তারায় তারায় খুঁজে বেড়ায় সেই মুখ যা শুধু তার একান্তই নিজের। একাকিত্ব ফালা ফালা করে কাঁটে তাকে। দেহের তাপ তবুও সহ্য করে নেয়, মনের চাপ বয়ে বেড়ানোই দায় এখন।

নিজের ভাবনা থেকে হঠাৎ করে বাস্তবে ফিরে এলো। সকালে এসেছিল সবাই কিন্তু প্রায় দুপুর হয়ে এলো। দুপুরে কি সবাই এখানে খাবে? খাবার তাহলে বাইরে থেকে আনতে হবে, এতো লোকের খাওয়ার যোগাড়তো করেনি বকুল। কি আনবে মোগলাই না চায়নীজ? কাকিমাকে ডেকে জেনে নিতে হবে। বকুল সবসময় সব ম্যানেজ করে নেয় তাই হয়তো কাকিমা এসব নিয়ে ভাবছেন না। অভ্যাসবশতঃ নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে চুলে সামান্য চিরুনি বুলালো, শাড়িটা গুছিয়ে আঁচল ঠিকঠাক করল, মুখটায় ভালো করে পাউডার পাফ করে পায়ে পায়ে বসার ঘরের দিকে এগুলো। মনে যতো কষ্টই থাকুক, তার ছায়া মুখে পড়তে দিবে না। কালো মুখে পাউডার ঘষে ঘষে সুখের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসবে। বকুল এখনো খাবার ব্যবস্থা করেনি শুনে কাকিমা অবাক হলেন। বললেন শীগগীর খাবার নিয়ে আসতে। খাবার এনে বকুল টেবিল রেডী করে সবাইকে ডাকতেই হই হই সবাই এলেন খেতে। খাওয়ার টেবিলে বেশ খুঁনসুটি করে আনন্দময় পরিবেশে খাওয়া হলো। বকুলও সবার সাথে হাসি আনন্দে যোগ দিল, হ্যা হ্যা করে হেসে গড়িয়েও পড়ল মজার সব কথায়। বিকেলে সবাই বিদায় নিলেন আলোচনা যা হলো তা উকিল ডেকে শীঘ্রই উইল করে ফেলবেন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে।

ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে থালা বাটি গোছাতে গোছাতে অনেক কথা শুনেছে বকুল। কিন্তু আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সন্ধ্যেবেলা ক্লান্ত গলায় রাঙা কাকিমা জানালেন, কাকুর প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা, ব্যাঙ্কে জমানো টাকা, কাকিমার পারিবারিক গয়না সব কাকু আর কাকিমার ভাই বোনের ছেলেমেয়েরা সমান ভাগে পাবে। যতোদিন তাদের দুজনের কেউ বেঁচে থাকবেন, ততোদিন বকুল এ বাড়িতে থাকতে পাবে। আরো কি কি যেন বলেই যাচ্ছিলেন কাকিমা কিন্তু বকুলের কান দিয়ে সেসব কথা আর ঢুকছে না। তার পৃথিবী টলছিল তখন। মনে মনে ক্ষীণ আশা ছিল তার, এ বাড়িতে জীবনের বত্রিশ তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলো, আপনজনের সামান্য স্বীকৃতি হয়তো পাবে সে তাদের কাছে। কিন্তু একি শুনলো, কাকু-কাকিমা না থাকলে তারপর তারপর তারপর তাকে কে জানে তারপর ............। মনে মনে চিৎকার করে ভগবানকে বললো, তুমিতো জানতে ঠাকুর কাকু-কাকিমা আমি তাদের মন থেকে ডেকেছি, মন থেকে মেনেছি, মনে কোন পাপ, লোভ ছিল না ভগবান। আমার এ সমস্ত ভক্তি ভালোবাসার বদলে আমি সামান্য স্বীকৃতি কেনো পেলাম না ? কি পাপে তুমি আমায় এই সাজা দিলে? আমি এই পৃথিবীতে কেন কারো আপন হলাম না।

তানবীরা
০২.০২.১১

কৃতজ্ঞতাঃ বকুলকথা গল্পের বানান বিভ্রাট ও ভাষা বিভ্রাট সামলে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় নাজমুল ভাই ও বন্ধু আমার প্রিয় নুশেরা

মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো

মাঝে মাঝে তিতলি আর সায়ানের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়ে যায়। পরে ঝগড়ার কারণ দুজনের একজনও খুঁজে পায় না। কখনো খুঁজে পেলেও অবাক লাগে এটা কী এতো তীব্র অভিমানের কোন ব্যাপার ছিল? তিতলি আর সায়ানের মাঝে ঝগড়া হয় কথাটাও বোধ হয় পুরো সত্যি না। ঝগড়া এক তরফা তিতলিই করে। সায়ান শুধু ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে যায়। কিন্তু সে মুহূর্তে সায়ান যা বলে তিতলি তাতেই আরো রেগে যায়। সেটাকেই উলটো করে ধরে, উলটো বকে যায়। বোঝাতে বোঝাতে একটা সময়ের পর ক্লান্ত হয়ে সায়ান থেমে যায়, তিতলিও বকে বকে ক্লান্ত হয়, কাঁদে। দু চারদিন চুপ করে থাকে, মাঝে মাঝে কথা, ম্যাসেঞ্জার, ফোন সব দরজা বন্ধ করে রাখে সায়ানের সাথে। সময়ের সাথে রাগের তীব্রতা কমে গেলে আবার মিস করতে থাকে তার সাথী তার বন্ধুকে, তারপর আস্তে আস্তে আবার নরম হয়। সায়ানের মনে হয় দূরত্ব এ ঝগড়ায় বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সায়ান ব্যস্ত চাকরী নিয়ে, তিতলি পড়াশোনা নিয়ে। সময়ের পার্থক্য আর আছে ব্যস্ত ঢাকার অসহ্য যানজট। শহরের মধ্যে সামান্য একটু পথ অতিক্রম করতে প্রাণান্ত হতে হয়। তাই চাইলেও দুজনের নিয়মিত দেখা হয় না, ম্যাসেঞ্জারই ভরসা। দুজন দুজনের মুখ দেখতে পায় না, অর্নগল কথা বলে যায়। তিতলির রাগের মুহূর্তে সায়ান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে তিতলি কখনোই এতো কঠিন কঠিন কথাগুলো বলতে পারতো না, যা সে অনায়াসে ম্যাসেঞ্জারের উইন্ডোতে লিখে ফেলে।

বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর আকাশ পরিস্কার হলে, মিষ্টি হাওয়া যখন মনকে ছুঁয়ে এপাশ থেকে ওপাশে যায় তখন সায়ান তিতলির মাথার চুল সরাতে সরাতে গাল ছুঁয়ে মাঝে মাঝে বলে, রাগ করলে তুই আমার কোন কথাই শুনিস না, জান। এতো ভয়ানক আক্রমন করে এতো কঠিন কঠিন কথা কিভাবে বলিস তুই? তুই কি তোর নিজের মধ্যে থাকিস না? আমার মুখ তোর মনে পড়ে না একবারও? তিতলি লজ্জা পেয়ে বলে, তুই আমাকে থামিয়ে দিতে পারিস না? মাথা ঝাঁকায় সায়ান। তারপর বলে, তুই এতো দূরের হয়ে যাস তখন যে আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলি, কথা খুঁজে পাই না তোকে মানিয়ে নেয়ার মতো। তুইতো ধরা ছোঁয়ার মধ্যে থাকিস না। কাছে থাকলে জড়িয়ে ধরে তোকে বলতে পারতাম, তুই সব নিজের মতো ভুল ভেবে নিচ্ছিস জান, আমি এমন কিছুই করিনি আসলে। তুই কষ্ট পাস এমন কিছু আমি কেমন করে করতে পারি? তুই ভাবতেও পারবি না, তোর কঠিন কঠিন কথাগুলো আমায় কাঁদিয়ে দেয়, আমার চোখ ভিজে যায়। তিতলিও আস্তে আস্তে ভিজে নরম গলায় বলে তখন, তোর কান্নাই ইম্পর্ট্যান্ট, আর আমি যে কাঁদি তোর কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে, সেটাতো কিছু নয়। তুই কেনো বুঝতে পারিস না, পৃথিবী উলটে গেলেও আমার তেমন কষ্ট লাগে না। কিন্তু তুইতো পৃথিবীর মধ্যে পড়িস না, তোর সামান্য থেকে সামান্যতর জিনিস আমায় এলোমেলো করে ফেলে। সায়ান উত্তর দিতে পারে না, কারণ ইমপালসিভ হয়ে কিছু না কিছু সে করে ফেলে সত্যি কিন্তু তিতলিকে হার্ট করাতো সে মীন করে না।

গাল ফোলা কমে গেলে আবার কুট কুট এস।এম।এস আদান প্রদান চলে দিন ভর। রাতে তিতলি অনেক সময়ই পড়া নষ্ট করে সায়ানের পাশে বসে পড়ে। ম্যাসেঞ্জারে বসাটাকেই পাশে বসা বলে দুজনে। খুঁটখুঁট টাইপ চলে দুপাশের দুজানালায়। সারাদিন কে কি করলো, সমস্ত তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ ব্যাপার দুজনেরটাই দুজনের জানা চাই। কখন দুজনে দুজনের জন্য কি ভেবেছিলো, কি খেতে গিয়ে মিস করছিলো বলতে বলতে ঘন্টা পার হয়ে যায়। কোন গানটা ভালো লাগলো দুজনের সেটা শেয়ার করে শোনা চাই। একটাই সমস্যা তিতলি রাত জাগতে পারে না। ভীষন ঘুম কাতুরে সে। কিছুক্ষণ গল্প হলেই বলবে, আমি যাচ্ছি ঘুমাতে। কি করবে ঘুম না হলে ঠিক করে পরদিনের লেকচার তার মাথায় ঢুকে না। একেতো এত অল্প সময় তিতলিকে কাছে পায় সায়ান। তারমধ্যে কথা না বলতেই বলবে, ঘুমাতে যাই। অভিমান হয়ে যায় সায়ানের। মাঝে মাঝেই বলে ফেলে আমার কি হবে রে? একা একা ঘুমুতে যাচ্ছিস যে বড়, আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তবে যা। তিতলি ফিক করে হেসে ফেলে, বুড়ো ধাড়ি ছেলে তোকে আবার ঘুম পাড়াবো কীরে। অভিমান নিয়ে সায়ান লিখে তখন, সারাটা দিন আমার সময় কাটতে চায় না, তোকে কখন কাছে পাবো সেই আশায় থাকি। তখন ঘড়িটা এতো স্লো চলে। আর তুই কাছে এসে বসা মাত্র লাফিয়ে লাফিয়ে ঘন্টাগুলো মিনিটে আর মিনিটগুলো মুহূর্ত হয়ে চলতে থাকে, নট ফেয়ার, জাষ্ট নট ফেয়ার। সায়ান যখন এমন আদর আদর কথা বলে, তিতলির তখন সায়ানকে রাগিয়ে দিতে ভালো লাগে। বেছে বেছে এমন সব কথাগুলো বলবে যাতে সায়ানের পিত্তি জ্বলে যায়। সায়ানের রাগী মুখটা কল্পনা করে হাসতে হাসতে লিখবে, পৃথিবীতে কিছুই ফেয়ার নারে, কী আর করবি, এসেই যখন পড়েছিস তখন বেঁচে যা। মনে মনে মুখ ভেংচি কেটে বলবে, আমায় যে কষ্ট দিস তারবেলা, যা এখন ভালো করে মিস কর আমায়, বাঁদর ছেলে কোথাকারের।

তানবীরা
০৫.০২.১১

আজ মন চেয়েছে

Wednesday 2 February 2011

বকুলকথা (২)

আস্তে আস্তে বকুল অনুভব করতে লাগলো তার ওপর কাকু-কাকিমার এ নির্ভরতা নিতান্তই স্বার্থ নির্ভর, ভালোবাসা নির্ভর নয়। আগে পাড়ার কেউ যদি বকুলকে ডেকে জিজ্ঞেস করতো, ও বকুল কি খবর তোর? এভাবে বোস বাড়ি পড়ে থাকলেই চলবে? পরের সেবা করেই যাবি? বিয়ে থা, চাকরি কিছুই করবি না? বকুল খুব বিরক্ত হতো। তোদের অতো দরকার কী বাপু, সে হবে যখন সময় হবে। কিন্তু সময়তো বয়ে যাচ্ছে, ষোড়শী বকুল এখন বাইশের তন্বী। কঁচি শরীর এখন অনেক পরিনত। কাকু-কাকিমা তাকে নিয়ে কোন কথা বলছেন না। কাকিমা নিজে যখন কাঁচা হলুদ, মুলতানী মাটি, চন্দন কাঠের গুঁড়োর ফেসপ্যাক বানিয়ে মুখে লাগান তখন যত্ন করে তা বকুলের গায়ে মুখেও লাগিয়ে দেন। পেয়াজের রস, মসুরের ডাল, নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে তার মাথায় লাগিয়ে চুলের যত্ন করা শেখান। তাকে সাথে নিয়ে পরিনীতা দেখতে যান, বইয়ের সাথে সিনেমার চিত্রনাট্যের তুলনামূলক আলোচনাও করেন। কিন্তু এসবের বাইরে তার আর কোন অস্তিত্ব কোথাও নেই। কাকিমার সাথে শাড়ি কিনতে কিংবা ফুঁচকা চটপটি খেতে গেলে কিছু আগ্রহী লোভী চোখ তাকে ঘিরে ঘুরঘুর করে, নতুন হিট ফিল্মের গান গেয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, কারণে অকারণে শিস দেয়, বকুল খুব আশায় থাকে কাকিমার চোখে পড়বে সেসব, কাকিমা নিশ্চয় কিছু বলবেন। এতো দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা কাকিমার নজরে শুধু বকুলই কেনো এড়িয়ে যায় তাই ভেবে সে হয়রান।

বুক ভরা অভিমান নিয়ে একদিন বকুল কাকু-কাকিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাবা মায়ের কাছে চলে গেলো। কাকু-কাকিমা অনেক বাঁধা দিলেন, বোঝালেন তাদের কে দেখবে, তাদের কি হবে, বকুল ছাড়া আর কে আছে তাদের ঘুরে ফিরে সেই কথা। বকুলের কিছু চাই কীনা, তার ভবিষ্যতের কী হবে সেটা কাকু-কাকিমা একবারের জন্যও বলেন না। বাবা মা তার জন্যে বিয়ের চেষ্টা করতে লাগলেন। এদিক সেদিক থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগলো। শুক্রবার শুক্রবার করে ছুটির দিনে, তাদের বস্তির ঘুঁপচি ঘরে তাকে নানা পদের পুরুষ মানুষ দেখতে আসতে লাগলো। সুন্দর করে সেজেগুঁজে তাদের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়ায় সে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যথাসম্ভব নম্র গলায় জবাব দেয়। দাদা বাবা সাধ্য মতো মিষ্টি চা খাইয়ে তাদের আপ্যায়ন করতে লাগলেন। কেউ কোন বাড়ির দারোয়ান, কেউ কোন রেষ্টুরেন্টের বয় কিংবা কেউ বা ফুটপাতের হকার। তাদের সাজ পোষাক, হাবভাব দেখে বকুল ভেতরে ভেতরে সিঁটিয়ে যেতে লাগলো। কোন কোন পাত্র বকুলের সাথে একান্তে কথাও বললো। বকুলের কি পছন্দ, কি চায় সে এধরনের কোন কথা নয়। বিয়ের পর সে কাজ করবে কীনা, সাহেবদের বাড়ি থেকে হঠাৎ চলে এলো কেনো, কোন লটঘটের ব্যাপার আছে কীনা ইত্যাদি জাতীয় প্রশ্ন।

বিয়ে নিয়ে বকুলের দেখা স্বপ্ন ঝনঝন শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ভাঙতে লাগলো। বুকের নিঃশব্দ কান্না রক্ত হয়ে ঝরতে লাগলো যেটা পৃথিবীর কেউ টের পেলো না। সেই ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রক্তের ওপর পা দিয়ে, পণের টাকার পরিমান নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দরাদরি চলতে লাগলো। এতোদিন সাহেবদের বাড়ি থেকে বকুল খালি হাতে ফিরেছে, সেটা পাত্র পক্ষ মানতেই নারাজ। এ কী করে হয়। নিশ্চয়ই সাহেবদের বাড়ি থেকে দেয়া টাকা পয়সা বকুলের বাবা মা রেখে দিতে চাচ্ছেন। বোস বাড়ির পরিবেশের আলোকে বকুলের দেখা চেনা পুরুষদের সাথে এ পুরুষদের কোন মিল ছিলো না। কিন্তু বকুলের নিজেরই বা কী আছে? মা বাড়ির ঝি, তাকে বোসরা তাদের বাড়িতে রেখেছিল মাত্র তার বেশি কিছুতো নয়। দেখতেও তেমন আহামরি নয় আবার বিদ্যের দৌড়ও সেই স্কুল ফাইন্যাল পাশ। সে কতো রকমের কেক বানাতে জানে, কতো সূক্ষ্ণ কুরুশের ঘর তুলতে পারে, সোয়েটার বুনতে পারে, শুনে শুনে সুনীলের কবিতা বলতে পারে কিংবা রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে এসব কথা জানতে এই পরিবেশের কোন লোক আগ্রহী নয়। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিত, সুচিত্রা মিত্র এরা এ পরিবেশে অপরিচিত আর বেমানান। বস্তির ঘরে প্রায়ই দাদা বৌদি, কিংবা বাবা মায়ের সাথে বকুলের ছোট ছোট জিনিস নিয়ে মতান্তর হয়ে যেতো। প্রাথমিক উচ্ছাস কেটে যেতেই দেখা গেলো বকুলকে ফিরে পেয়ে তারাও আনন্দিত নন, ফিরে এসে বকুলও আর সুখী নয়।

রাগ করে চলে এসেছে বটে কিন্তু এখন প্রতি মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে তার পৃথিবী আর এ পৃথিবী পুরোই আলাদা হয়ে গেছে। এ পৃথিবীর সে আর কেউ নয়। জাগতিক আরাম আয়েশ যা রাগের মাথায় তুচ্ছ মনে হয়েছিলো সে সমস্ত যে জীবনে অতি প্রয়োজনীয় বিষয়, তা প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে ধরা পড়তে লাগলো। গা মোছার জন্যে পরিস্কার বাথরুম, চা খাওয়ার জন্যে গ্যাস বার্নার, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার খোলা বারান্দা তাকে প্রতি মুহূর্তে হাতছানি দিতে লাগলো। কিছুদিন পর বকুলের রাগ পড়েছে কীনা দেখতে কাকু-কাকিমা একদিন এলেন তাদের বস্তির ঘরে। রাঙা কাকিমা এসে বকুলকে জড়িয়ে ধরতেই সব অভিমান ভুলে কেঁদে আকুল হলো সে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে অভিমান ভাঙিয়ে তারা বকুলকে সাথে নিয়ে এলেন। এতোদিনে বকুল টের পেয়ে গেছে সে স্বাবলম্বী হলে তাদের ছেড়ে যদি চলে যায় সেজন্য তারা তার কাজ, পড়া কিংবা বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী নন। যা করতে হবে নিজেকেই করতে হবে। ফিরে এসে বকুল এবার কোন একটা কাজের কথা ভাবতে লাগলো। পত্রিকার বিজ্ঞাপণ দেখে দেখে সে ভাবলো পার্লারে কাজ শিখবে। স্কুল ফাইন্যাল পাশ দিয়ে এর চেয়ে ভালো আর কীই বা পাবে সে। তার মতো মেয়েদের বাইরে সব জায়গায় কাজ ততো নিরাপদ কিছু নয় এখনো এদেশে।

পাশের ঘরের হৈ চৈ’তে তার ভাবনার জাল ছিন্ন হলো। কাকুর বাড়ির লোক আর কাকিমার বাড়ির লোকের মাঝে চলছে আলোচনা। দুপক্ষই নিঃসন্তান কাকু-কাকিমার সম্পত্তির হিসাবের চুলচেরা নিয়ে বসেছে। তাদের অবর্তমানে কার কতোটুকু অধিকার, কে কাকু-কাকিমার কতো কাছের, কতো আদরের তার ওপরতো নির্ভর করছে কে কতোটুকু পাবে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় এ ক’বছরে পুড়ে পুড়ে অনেক শক্ত হয়েছে বকুল, না কাঁদবে না কিছুতেই সে। চোখ জ্বালা করে আসলেও সে শক্ত হয়ে থাকবে। চোখের পানিকে সে মনের জ্বলুনিতে বাস্প করে চারধারে উড়িয়ে দিবে। কার জন্যে কাঁদবে বকুল? কার কি হয় সে? সবাই কাকু-কাকিমার অনেক কাছের লোক বটেইতো, শুধু বকুল ছাড়া। এই দূরের বকুল সকালে ঘুম থেকে ওঠে কাকু-কাকিমার নাস্তা বানায়, ওষুধ দেয়, দুপুরে তারা কি খাবেন তা রান্না ঝি’কে বুঝিয়ে দিয়ে পার্লারে যায়। সারাদিন কাজ শেষে ফেরার পথে ঘরের বাজার, ওষুধ আর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে তবে ফিরে। ছুটির দিনে তাদের নিয়ে হাটতে বেরোয়, নাটক দেখতে নিয়ে যায়, কাকিমার অনেক দিনের না দেখা মাসিকে মনে পড়লে তার বাড়ি খুঁজে বের করে সেখানে নিয়ে যায়। অসুখ বিসুখে দৌড়ে ডাক্তার ডেকে আনে। এহেন দূরের বকুলের মনে পাশের ঘরের আপাত রুক্ষ আলোচনা যেমন কোন ছায়া ফেলে না, তেমনি উল্লসিত ধ্বনিও কোন রেখাপাত করে না।

তানবীরা
০১.০২.২০১১

বকুলকথা (১)

বকুল একবার উঠছেতো আবার বসছে বিছানায়। অস্থির লাগছে প্রচণ্ড কিন্তু কিছু করার নেই তার, জানে না কি করলে অস্থিরতা কমবে। টেবিলের ওপরে থাকা বইগুলো উল্টাচ্ছে, বাণী বসু’র লেখা ইদানীং খুব টানে তাকে। বহুবার পড়া “একুশে পা” আবারো খুলে বসলো, যদি মনটাকে ব্যস্ত রাখা যায়। কিছুক্ষণ অক্ষরগুলো চোখের পরে নাচানাচি করলো, অক্ষরগুলোকেই চিনতে পারছে না সে। পড়ার বৃথা চেষ্টা বন্ধ করে আবার বসলো। আজ ছুটির দিন হয়েছে বলেই জ্বালা। কোথাও যাওয়ার নেই তার, বন্ধু নেই বান্ধবী নেই। পার্লার আর বাড়ি আর বাড়ি আর পার্লার এইই জীবন প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বকুলের। কর্মঠ মেদহীন শরীর দেখে কেউ ধারণাই করতে পারবে না আটত্রিশ কাটাচ্ছে বকুল এখন। সবাই ভাবে বড়জোর ত্রিশ। যদিও আজকাল কেশে রূপালী রেখে দেখা দিতে শুরু করেছে। সেদিন ঝর্ণাদিকে বলে মেহেদী রঙে ডাই করেছে নিয়েছে চুল সে। পরিচ্ছন্ন থাকতে বকুল খুবই ভালোবাসে। ছোটবেলার অভ্যাস, রাঙা কাকিমা করিয়ে দিয়েছেন। মুখে মেকাপ লাগিয়ে সাজে না সে খুব একটা কিন্তু সবসময় ম্যাচিং শাড়ি – ব্লাউজ – জুতো। হাতে কানে রঙ মিলিয়ে সামান্য পলার চুড়ি আর দুল। এতেই অন্যদের থেকে আলাদা দেখায় তাকে। মাঝারি গড়নের বকুল যে খুব আহামরি কিছু সুন্দরী নয় তা সে নিজেও জানে। কিন্তু তার ছোট চোখের সাথে মিলিয়ে কিভাবে মোটা করে কাজল পড়তে হবে আর মোটা গড়নের ভুরু প্লাক করতে হবে, মোটা ঠোঁটটাকে কি করে আঁকলে বিশ্রী দেখাবে না সেটাতো সে জানে আর তাতেই প্রায় কালো ঘেষা গায়ের রঙ, আর প্রায় ছোটর দিকের মাঝারী গড়নের বকুল, মোটামুটি দেখতে ভালো এই বিশেষণ পায় অন্যদের কাছে।

প্রিন্টেড জর্জেটের শাড়িটা আবারো ভালো করে পিঠের ওপর দিয়ে এনে শরীরের মাঝে ঠিকঠাক জড়ালো সে। বসে বসে নখ দিয়ে মেঝের ওপর নানা রকম আল্পনা কাটছিলো। ঠাণ্ডা মেঝেতে পা রেখে এই আল্পনা আঁকা খেলাতে তার অনেক অবসর সময় কাটে। তার জীবনের যেমন কোন অবয়ব নেই, নেই এই আল্পনাগুলোরও কোন আকৃতি প্রকৃতি। নেহাত জন্মেছে বলেই যেমন তার বেঁচে থাকা তেমনিই এই আল্পনার অস্তিত্ব, কেটে যাওয়ার জন্যই যাওয়া। মাঝে একবার উঠে পাশের ঘরের সবাইকে আর এক দফা চা নাস্তা দিয়ে এসেছে সে। বাড়িটা খুব বড় নয়, না চাইলেও পাশের ঘরের কথা অনায়াসে এ ঘরে বসে শোনা যায়। আর পাশের ঘরেতো রাখ ঢাক করে কথা বলা হচ্ছে না। সবাই যার যার মতামত জোর গলায় দিচ্ছেন। শুধু বকুল অনাহুত সেখানে, সামনে দিয়ে অনেকবার যাওয়া আসা করলো, কেউ একবার তাকে বললো না বকুল তুইও বোস, গুরুত্বপূর্ন কথা হচ্ছে এখানে, তোর থাকাটা জরুরী। সে যে একটা মানুষ তারও কষ্ট হতে পারে, কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে সেটা তাদের হিসেবের মধ্যেই নেই? কিন্তু সে যে হিসেবের মধ্যে পরে না সেটাতো সে অনেকদিন ধরেই জানে, জানে না? তারপরও তার মনের মধ্যে কীসের ক্ষীণ আশা সে এতোদিন লালন করেছিল?

আজো সেদিনটার স্মৃতি তার চোখে মনে জ্বলজ্বল করে। বোস বাড়ির রাঙাকাকু বিয়ে করে ফুটফুটে রাঙা কাকিমাকে বোস বাড়ি নিয়ে এলেন। বকুল তার জীবনে কখনো এতো সুন্দর মানুষ দেখেনি, মনে হচ্ছে সাক্ষাত দুর্গা প্রতিমা। দুর্গা ঠাকুরের মতো বড় বড় মায়াভরা চোখ, লাল টুকটুক ঠোঁট আর পিঠ ভর্তি একরাশ কালো কোঁকড়ানো চুল। সারা পাড়ায় বলাবলি হতে লাগলো বউ এসেছে বটে বোস বাড়ি উজ্জ্বল করে। বকুল রোজ মায়ের সাথে আসে, মা যখন বাড়ির কাজ করে বকুল তখন রাঙা কাকিমার পাশে পাশে ঘুর ঘুর করে। হাসি হাসি মুখের রাঙা কাকিমাকে দেখে তার মনের আশ মেটে না। রাঙা কাকিমা যদি তাকে কিছু করতে বলেন সে কৃতার্থ হয়ে যেতো। এভাবে দিন যায় রাত আসে আবার রাত কেটে দিন আসে। রাঙা কাকিমার সাথে বকুলের খুব ভাব হয়ে গেলো। কাকিমা তাকে ছবির বই কিনে দিলেন, অ আ ক খ পড়াতে লাগলেন। বকুলের মা অন্য বাড়িতেও যখন কাজে যায়, বকুল এ বাড়িতেই থাকতে লাগলো। শয়নে স্বপনে বকুলের পৃথিবীর ভরে রইল শুধু রাঙা কাকিমা। বছরের পর বছর ঘুরেও যখন রাঙা কাকিমার ঘর উজ্জ্বল করে কেউ এলো না তখন রাঙা কাকু মা’কে বললেন বকুল আমাদের কাছেই থেকে যাক। আমরা ওকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করবো। একথায় বকুল আর শুধু বকুলের মা নয় বকুলের পুরো পরিবার খুশিতে নেচে ওঠেছিল। বকুলদের বস্তির অনেকেই বকুলের ভাগ্য দেখে হিংসা করেছিল, কেউ কেউ হয়তো নিঃশব্দে দুঃখের নিঃশ্বাসও ফেলেছিলো।

সেই থেকে রয়ে গেলো বকুল বোস বাড়ি। বয়স বেশি বলে সে প্রথমেই স্কুলে ভর্তি হতে পারলো না। কাকু কাকিমার কাছে পড়াশোনা করতে লাগলো। দুপুরে কাকিমার সাথে ঘুমোতো, টিভিতে সিরিয়াল দেখতো। কাকিমা কতো গল্প করতো, বই - সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ে শোনাত, রবীন্দ্র সংগীত থেকে আরতি মুখার্জী, লালনের গান থেকে কিশোর সব কাকিমার পাশে থেকে জেনেছে সে। স্যান্ডউইচ বানানো কিংবা জিরা পানি, ইকেবোনা থেকে ঝাড়দানি, কাকিমা পাশে থেকে হাত ধরে ধরে বাড়ির মেয়ের মতো করে শিখিয়ে দিলো তাকে । হাঁটতে, চলতে, বলতে বোস বাড়ির মেয়েদের মতো হয়ে গেলো সে দ্রুত। মাঝে মাঝে মা ভাইবোনদের সাথে দেখা করতে নিজেদের বাড়িতে যায় বকুল, নিজেকে তার সেখানে খুবই বেমানান লাগে। কি চিৎকার করে মুখ খিচিয়ে খিচিয়ে কথা বলে তার মা বাবা, ছিঃ। দুজনের প্রতি দুজনের কোন ভালোবাসাতো নেই, শ্রদ্ধা ভক্তিও নেই। এ ভাষায় কেউ কাউকে কথা বলে। ভাই বোনদের মুখের ভাষা শুনলেতো দুহাতে কান ঢেকে লজ্জায় নুইয়ে পড়তে লাগলো। দাদা দিদিকে কিছু শিখাতে গেলে কিংবা বলতে গেলে তারা তাকে উলটো বিদ্রূপ করে হেসেই খুন হতো। বকুলের ভদ্দরলোকপনা তখন ভাই বোনদের কাছে একটা হাসির উপাদান। সহ্য করতে পারে না, কখন বোস বাড়িতে ফেরত চলে আসবে সেজন্য অস্থির হয়ে ওঠে সে । আর এখানের ইলেক্ট্রিকের পাখা ছেড়ে, ঐ ঘুপচি ঘরে আলো ছাড়া, বাতাস ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসতো। চারধারে আবর্জনার দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আর কতোক্ষণই বা থাকা যায়।

আস্তে আস্তে স্কুলে যেতে শুরু করলো। স্কুলের খাতায় তার বাবা মায়ের নাম এলো আর লোকাল গার্জিয়ান হিসেবে নাম এলো রাঙা কাকুর। পড়াশোনায় বকুলের তেমন মাথা ছিলো না আর পড়াশোনা করার তেমন ইচ্ছেও ছিলো না। ভবিষ্যতের কতোটুকুই কেউ বুঝে সে বয়সে। বোস বাড়ি থাকতে পেয়েই সে বর্তে ছিলো। অনেক কষ্টে কোন রকমে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করলো বকুল। কাকা কাকিমা তার উচ্চতর পড়াশোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন না। তারা বললেন, স্কুল ফাইন্যালতো হলো, ঠিকাছে, এখন বরং কাজ কিছু কর। বকুলের নিজের পড়াশোনায় আগ্রহ কম থাকলেও সে এক কথায় খুবই অবাক হয়েছিল। তখনো বোস কাকুরা সব যৌথ পরিবারে থাকেন। বাড়ির অন্য ছেলে কিংবা মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে সবারই খুব কড়া দৃষ্টি। এই রাঙা কাকিমাই সেজ কাকুর ছোট মেয়ের ইংরেজি ট্রান্সলেশন নিয়ে প্রত্যেক দুপুর পরে থাকেন। কিন্তু বকুলের পড়া কিংবা পরীক্ষা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথাই সে দেখলো না। হলেও ভালো না হলেও ভালো।

বকুল কি করবে কি করবে। তাই নিয়ে বকুলও ভাবছে, বোস বাড়ির কেউ কেউ ভাবছেন আর ভাবছেন বকুলের বাবা মা। বকুলের মা – ভাইয়ের ইচ্ছে, তারা যদি দেখে শুনে বকুলকে পাত্রস্থ করে দেন তাহলেতো একটা হিল্লে হয়ে যায়, একটা বোঝাও নেমে যায়। স্কুল ফাইন্যাল পাশ মেয়েই বা কম কী। তারা ইশারা ইঙ্গিতে বোস বাড়িতে একথাটা অনেকভাবে পাড়ল কিন্তু বোস বাড়ির কেউ তাতে গা করলো না। বোসরা তখন সবাই যার যার অংশ গুছিয়ে আলাদা হওয়ার তালে আছেন, সেই ব্যস্ততায় বকুলের ভবিষ্যত চিন্তা পাথর চাপা পড়ে গেলো। রাঙা কাকিমাতো বকুলকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকার কথা ভাবতেই পারেন না, বিয়ে দিবেন কি? রাঙা কাকিমার বাতের ওষুধ কি মাথা টিপে দেয়া, রাঙা কাকুর অফিসের ভাত বাড়া তো ব্যাংকে গিয়ে বিদ্যুতের বিল দেয়া বকুল ছাড়া সবই অচল। যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে কাকু কাকিমা বকুলকে আরো আঁকড়ে ধরলেন। বকুলের কাঁধে তখন রাঙা কাকিমার সংসারের চাবি, এই কতৃর্ত্ব হাতে পেয়ে বকুল তখন দিশেহারা। ছাদে যেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তরুণী সে গুন গুন গান গায়। কতো শতো স্বপ্ন তার দুচোখ বেয়ে অর্হনিশি উপচে পড়ছে। নিজের সৌভাগ্যে নিজেই ইর্ষান্বিত সে। ছোট বাগানঘেরা মায়া ভরা এই বাড়ির একজন সে। যাকে ছাড়া এবাড়ির কেউ কিছু ভাবতে পারে না।

(চলবে)

তানবীরা
৩০.০১.২০১১