Tuesday 11 December 2018

নির্জন প্রবাস ও কিছুটা একাকীত্ব

প্রবাসীদের জীবন ভর্তি হাজারও সমস্যা, ঠিক দেশী মানুষদের মতই, তাই কোনটা ফেলে কোনটা নিয়ে লিখবো তালগোল পাকাচ্ছি।সমস্যা তো হাজারও জানি, কিন্তু সমাধান জানি না একটারও।কলেজে অর্থনীতি ছিলো, অর্থনীতির মধ্যে আবার ছিলো“বাংলাদেশ অর্থনীতি”, নামেই পরিচয়।বাংলাদেশের অর্থনীতি মানেই নানা প্রকার সমস্যা কিন্তু আশা’র কথা হলো, সেখানে সমস্যার পাশাপাশি সমাধানও লেখা ছিলো।অবাক হয়ে টিচারদের জিজ্ঞেস করতাম, সমাধান তো সব বইয়ে লেখা আছে, তাহলে আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না কেন? আমাদের বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে টিচাররা হয়ত মনে মনে হাসত, মুখে বলত, পড়বা, মুখস্থ করবা, পরীক্ষা দিবা, এর চেয়ে বেশী চিন্তা করার দরকার নেই। জীবনে কত থিওরি, এন্টি থিওরি, ইউটিলাইজেশান, এক্সেপশান মুখস্থ করলাম, পরীক্ষা দিলাম আবার ভুলেও গেলাম। পৃথিবী তার নিজের গতিতেই চলছে, এসব থিওরি তার কিছুই পরিবর্তন করতে পারে নি। তাই আমিও কোন সমাধানের কথা লিখছি না, আমার দৃষ্টিতে, “সমাধান” শব্দটা খানিকটা প্রতারণা কিংবা দুর্বলকে সান্ত্বনা দেয়াও বলা যেতে পারে।
সব প্রবাসীদের জীবন যেহেতু একই ছন্দে ঘোরে না, সবার সমস্যাও এক রকম না। অর্থনীতির চাকা কোথাও স্থির নেই, ক্রমাগত ঘুরছে, নতুন নতুন ব্যবসা, কর্মসংস্থান, পুরনোকে বাদ দেয়া ইত্যাদি চলছেই। অনেক প্রবাসীর দিন কাটে আতঙ্কে, চাকুরীটা টিকে থাকবে তো, জীবন যাত্রা’র এই মান টিকিয়ে রাখতে পারবো তো? এই বয়সে না আবার কোন ঝামেলায় পড়ি। আবার অনেক প্রবাসীর দিন কাটে পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পাওয়ার টেনশানে, চলে তো এসেছি, এখন টিকে থাকতে পারবো তো? পাসপোর্টটা পাবো তো হাতে।এত মানুষের জায়গা হচ্ছে, শুধু আমাদের কি আর জায়গা হবে না।আবার অনেকেরই আছে টাকা পয়সার টেনশান, ঠিক দেশি কায়দায়।মাস শেষ হলে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে, বাড়ির মানুষ অপেক্ষা করে বসে আছে তার আশায়।এখানে যতটা বাঁচিয়ে চলা যায়, যত বেশি জমাতে পারবে, তত বেশি পাঠাতে পারবে,বাবা-মা পরিজনেরা ভাল মন্দ দু চারটে খেয়ে বাঁচতে পারবে, পরিবার পরিজন আর একটু ভাল থাকতে পারবে।
গ্লোবাল সিটিজেন অর্গানাইজেশান প্রবাসীদের সাতটি সমস্যাকে ক্রমিকনুসারে সাজিয়েছে। তারা অবশ্য তাদের গবেষনার স্থান হিসেবে “এমেরিকা”কে বেছে নিয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এই সমস্যা গুলো সারা পৃথিবীর প্রবাসীদের ক্ষেত্রেই সমান সত্য। তাদের গবেষনায় উঠে এসেছে, ভাষা শেখা এবং বলতে পারা প্রবাসীদের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।  এ সমস্যার মোকাবেলা করতেই প্রবাসীরা হিমশিম খেয়ে যায়। বাচ্চারা অনেক দ্রুত ভাষা শিখতে পারে, মানিয়ে নিতে পারে, তবে বড়দের অনেক সময় লেগে যায়। তারপর আসে বাচ্চা বড় করা, তাদের স্কুলের পড়ায় সাহায্য করা এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করা। অনেক সময় বাচ্চারা স্কুলে অন্য বাচ্চাদের দ্বারা বর্ণ বিদ্বেষ, নানা ধরনের হয়রানীর শিকার হয়, অনেক বাচ্চা ক্লাসে, পরীক্ষায় রেজলাট খারাপ করে, তাদেরকে পিছিয়ে দেয়া হয়, বয়সের তুলনায় তারা ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পরে।  এরপর থাকে কর্মসংস্থানের ব্যাপার। সংসার এবং জীবন বাঁচিয়ে রাখতে অনেকেই যে কাজ পায় তাই দিয়ে জীবন শুরু করে তারপর আস্তে আস্তে উন্নত কাজের সন্ধান করে। সেই কারণেই দেখা যায় আজকে যে ট্যাক্সি চালক সে গতকাল হয়ত কোন স্কুলের টিচার ছিলো কিংবা ইঞ্জিনিয়ার আবার আগামীকালও তাকে অন্য পেশায় দেখা যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রেও প্রবাসীরা বর্ণ বিদ্বেষ এবং নানা ধরনের হয়রানীর শিকার হয়। কিছু কিছু কাজই আছে যেগুলো অন্যরা হয়ত করবে না, সেগুলোর জন্যে প্রবাসীদেরই বাছাই করা হয়ে থাকে।
আছে আবাসন সমস্যা। এ সমস্যাটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আর এমেরিকায় আলাদা রুপে আসে। ইউরপের বিভিন্ন দেশে পরিবারের  সদস্যনুসারে বড় বা ছোট বাড়ি সরকারের তরফ থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়। ভাড়ার অর্ধেকটা ভর্তুকি দেয়া হয়। আবার অনেক জায়গায় প্রবাসীরা নিজেদের সার্মথ্যনুযায়ী বাড়ি ভাড়া করে। এখানে বাড়ি ভাড়া যেহেতু খুব বেশী, অনেক সময় দেখা যায়, ঘিঞ্জি-কোলাহলপূর্ণ এলাকায়, ছোট বাসা ভাড়া করে শুরুর দিকে অনেকেই দিনযাপন করে।  বৈধ কাগজ ছাড়া প্রবাসীরা সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। অনেক সময় ডাক্তার দেখাতে পারে না, সামাজিক কাউন্সিলিংয়ের সুবিধা নিতে পারে না। অন্যান্য মানুষদের দ্বারা নানারকম হয়রানী ও নিপীড়নের শিকার হয়, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাও ঘটে। এ সময়টাতেই অনেক বেশী মানসিক সমর্থণ বা সাহায্যের দরকার হয় যেটা থেকে তারা দিনের পর দিন বঞ্চিত থাকে। ভাষার সমস্যার মত ড্রাইভিং লাইসেন্স ও এখানে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। গাড়ি চালানোর অনুমতি পেতে এখানে লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে হয় এবং বেশীর ভাগ সময়ই এই পরীক্ষাগুলো হয় ইংরেজি কিংবা সে দেশের মাতৃভাষায়। যে অব্ধি ভাষা শেখা সম্পন্ন না হয় সে অব্ধি ড্রাইভিং এর কাগজ থেকে প্রবাসীরাবঞ্চিত থাকে এবং বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়া, কাজে যাওয়া ইত্যাদিতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যায়।  যানবাহন সমস্যার কারণে প্রবাসীদের মধ্যে রাজধানীতে থাকার প্রবণতা অনেক বেশী, যতই শহরতলীর দিকে যাওয়া হবে ততই পাবলিক যানবাহনের সুবিধা কমে যাবে। সেদিকে প্রায় সবাই নিজের গাড়ি নিজে চালিয়ে অভ্যস্ত। অনেকেই নতুন এসে রাস্তা চেনে না, এলাকা চেনে না, ভাষা জানে না বলে অনেক সময় কারো সাহায্যও নিতে পারে না, রাস্তায় বেরোতে বা বাড়ি থেকে বের হতে তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে থাকে।
দেশের মানুষের মতো প্রবাসেও মানুষ হাজারও সমস্যার মধ্যেই বেঁচে থাকে।পার্থক্য হলো, জীবন এখানে আরও নির্মম, আরও সাদা-কালো।মন খারাপের দিনে জড়িয়ে ধরে কাঁদার কেউ নেই, মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার কেউ নেই, বলার নেই কেউ, সব ঠিক হয়ে যাবে,মন খারাপ করিস না।সকল জাগতিক সমস্যার সাথে অনেক মানসিক সমস্যাও থাকে।ফেলে আসা প্রিয়জনদের জন্যে মনটা হু হু করে কাঁদে, শরীরটা থাকে বটে প্রবাসে কিন্তু মন তো ঘুরে বেড়ায় সেই চেনা আঙিনায়। এমনি দিন যদিও কোন রকম কেটে যায়, উৎসব-পার্বেনের দিন গুলোতে দেশকে ভেবে চোখের জল গোপন করে না এমন খুব কম প্রবাসীই আছে। আর তো আছে দুটো ভিন্ন দেশের ভাষা, সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে, পরিবারকে মানিয়ে নেয়ার নিত্য দিনের টানা পোড়েন। “পাস্তা-পিজা”সহজ লভ্য, বানাতেও সোজা, দামেও আরাম, ছেলেমেয়েরা খুব ভালবেসে খেয়ে নেয় কিন্তু তাদের স্বামী-স্ত্রীর একবেলা ভাত না হলে চলেই না। একটু ভর্তা, ভাজি মেখে, ডাল দিয়ে অন্তত দু গ্রাস দু গ্রাস ভাত না খেলে দিনের শেষে মনে হয় দিনের আসল কাজটাই করা হলো না। কেউ কেউ ছেলে মেয়েকে বাংলা গান, নাচ শেখায়, দূর থেকে দূরে যায়, মনে গোপন আশা নিয়ে, ছেলে মেয়েরা বাংলা জানুক, শিখুক, রবীন্দ্রনাথ – নজরুলের পরিচয় অন্তত জানুক। দিনের শেষে সকলেই নাড়ী’র টান খুঁজে বেড়ায়। অনেক সময় বাচ্চারা দুটো সংস্কৃতির টানাপোড়েনের মধ্যে পরে দ্বিধান্বিত হয়ে পরে। স্কুল, বন্ধু, খেলা, দিন যাপন সব হয় এক রকম পরিবেশে কিন্তু বাড়িতে এলে হয়ে যায় অন্য দেশ অন্য সংস্কৃতি আর অন্য পরিবেশ। কোনটা বাস্তব আর কোনটা পরাবাস্তব তাই নিয়ে সমস্যায় পরে যায়। অনেক বাবা-মা চান সন্তান খুব দেশীয় আদব-কায়দা, সংস্কারে বড় হোক, এখানে বাস করলেও অন্তরে যেনো বাংলাদেশ লালন করে, তাদের দৃষ্টিতে তাদের সন্তানরা খুব দ্রুত বিদেশী হয়ে উঠছে, বাচ্চারা এর সাথে তাল মিলিয়ে পারে না, শুরু হয় মত পার্থক্য, মনোমালিন্য। অনেক সময় এই সমস্যা এতটা প্রকট আকার ধারণ করে যে পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনার অনেক ইতিহাস আছে। এ সমস্যাগুলো শুধু যে বাংলাদেশের প্রবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, প্রায় প্রতিটি দেশের প্রবাসীরাই কম বেশি এ সমস্যাগুলোর ভেতর দিয়ে যায়।  শুধু এমেরিকা নয় প্রবাসীদের নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন গবেষনায়ও উঠে এসেছে, ভাষার ভিন্নতা, সংস্কৃতির ভিন্নতা, ফেলে আসা জীবন আর নতুন করে বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আবার জীবন শুরু করার যে মানসিক ধকল সেটাই প্রবাসীদের অনেক বড় সমস্যা (CMAJ)
যারা গান-নাচে আস্থা রাখে না, তারা মসজিদে নিয়ে যায় বাচ্চা, বিদেশে থেকেও যেনো বাচ্চা আল্লাহর নাম জানে, রাসুলের ইতিহাস জানে, দ্বীনের পথে থাকে। মসজিদে দান খয়রাত করে, পরকালের ভাবনা ভাবে। অনেকেই আছে এ দুটোর কোনটাই হয়ত করে না। যতটা সম্ভব যে দেশে থাকে তার সংস্কৃতির সাথেই মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে তারপরও দেখা যাবে, দেশ থেকে বাচ্চাদের জন্যে সুন্দর সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবী কিনিয়ে আনিয়েছে, কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে সেসব পরে সবাই সাজগোজ করে ছবি তুলে, ফেসবুকে বা ইন্সট্রাগ্রামে দিচ্ছে। যতদূরে, যে অবস্থায় থাকে না কেন মানুষ, হৃদয়ে দেশ তো লালন করেই, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হতে পারে কিন্তু ভালবাসা নিরবিচ্ছিন্ন। দেশ কখনও ছেড়ে যায় না, ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মনসতাত্ব্বিক সমস্যা।বিদেশে মানুষ এমনিতেই একাকীত্বে ভোগে, ব্রিটেনে কয় দিন আগে এ সম্বন্ধে মানুষকে সাহায্য দেয়ার জন্যে আলাদা মন্ত্রনালয় খোলা হয়েছে।এখানে জন্ম নেয়া, বড় হওয়া স্থানীয়দেরই যদি এ অবস্থা সে জায়গায় প্রবাসীদের মানসিক কষ্ট বর্ননাতীত।“বিসর্জন” নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “একাকীত্ব কারে বলে? যবে বসে আছি ভরা মনে,দিতে চাই, নিতে কেহ নাই”। এখানে প্রবাসীরা মোটামুটি উন্নত জীবন যাপন করে, ছিমছাম বাড়ি, গাড়ি, সাজানো গোছানো জীবন। কিন্তু এই সুখ ভাগ করে নেয়ার মত পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। একা একা ভালো থাকা, কি নিদারুণ স্বার্থপরতা। ফেসবুকে ছবি আপলোড দিয়ে কিংবা মোবাইলে বাড়িতে ছবি পাঠিয়ে কি একসাথে বসে সবাই খাওয়া দাওয়া করার, গল্প গুজব করার সেই তৃপ্তি আসে?প্রতিদিনের ছোট ছোট দুঃখ সুখ ভাগ করে নেয়ার আনন্দ কি ছবিতে পরিপূর্ণতা পায়, পায় না।দেশ থাকে সব সময় প্রবাসীদের হৃদয়ের গহনে, হারানো প্রেমের মত, কখনো ছেড়ে যায় না।
“একাকীত্ব” ব্যাপারটিকে আমরা যতটা অবহেলার চোখে দেখি আসলে কিন্তু ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এই লক্ষনটি অন্যান্য অনেক অসুস্থতা কিংবা অস্বাভাবিকতা তৈরী করে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক জীবনে।অনেকেই সিজোফ্রেনিয়া’র মত মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে একাকীত্বকে দায়ী করে।একাকীত্বের অনুভূতি থেকে বড় ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যার হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে মন্ত্রী ট্রেসি ক্রাউচ বলেন, “এই ধরণের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি সে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করা উচিত যেভাবে কিনা ধূমপান বা স্থূলতা মোকাবিলা করা হয়।” দুনিয়া কাপানো গায়িকা ম্যাডোনা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ভাগ্যের অন্বেষণে একদা তিনি নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে এসেছিলেন, লন্ডন শহরে তিনি এতটাই একাকীত্বে ভুগছিলেন যে এক বছরের মধ্যে তিনি আবার নিউইর্য়কে ফিরে যান। মনোবিজ্ঞানী মাইক লুহম্যান এবং লুইস.সি.হওকলি সামাজিক অর্থনৈতিক প্যানেল ২০১৩এর প্রতিনিধিত্বমূলক একটি জরিপ চালান। সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলো ১৬,১৩২ জন মানুষ। জরিপের ফলাফল, “বয়স্ক ব্যক্তির একাকীত্বের অন্যতম প্রধান কারণ তাঁদের সামাজিক সম্পর্ক কমে যাওয়া। মাঝেমাঝে আয় কমে যাওয়াও এর একটি কারণ।“ মনোবিজ্ঞানীরা বলেন,“একজন ব্যক্তির অর্থনৈতিক আয় যত বেশি, তার একা হওয়ার সম্ভাবনা তত কম। এই সম্পর্কটি মধ্যবয়সে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মধ্যবয়সে অর্থ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বয়সের প্রভাবটা একাকীত্বের ক্ষেত্রে বেশি থাকে। এর সাথেও স্বাস্থ্য বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারটিও জড়িত।“
একাকীত্ব কাটানোর জন্যে প্রবাসীদের অনেকেই একটা অবলম্বন খোঁজে, এবং তাকে অস্বাভাবিক ভাবে আকড়ে ধরে।অনেকে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে, জীবনের সমস্ত জায়গায় বাড়াবাড়ি রকম ভাবে ধার্মিক রীতি নীতির প্রয়োগ করতে থাকে।কেউ কেউ নেশাজাতীয় দ্রব্যের শরনাপন্ন হন।অনেকের দেখা যায়, বাস্তবতা থেকে দূরে থাকতে অন্তর্জাল আসক্তি বাড়াবাড়ি রকমভাবে বেড়ে যায়।ওপরের এই প্রত্যেকটি কারণকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় অসুস্থতা হিসেবে দেখা হয় যার অন্যতম প্রধাণ কারণ হিসেবে একাকীত্বকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যরকমও আছে, কেউ কেউ সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন,ভলান্টিয়ার সোশ্যাল ওয়ার্ক, তবে বাংলাদেশী প্রবাসীদের মাঝে শেষের ব্যাপারটি কম দেখা যায়। একাকীত্ব বোধের এই যন্ত্রণার জন্যে অনেক সময় আবহাওয়া ও একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। ঠান্ডা, বৃষ্টি, বরফ, তুষার দিনের পর দিন এই বৈরী আবহাওয়া ও মানুষের মনোজগতে বিরাট প্রভাব ফেলে। জন্মস্থান আর প্রবাসের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে মানুষ হিমসিম খেয়ে ওঠে।  তার ওপর বন্ধুহীনতা, আত্মীয়হীনতা, পরিজনহীনতা জীবনকে আরও বেদনাদায়ক করে তোলে।
প্রতিটি মানুষ আলাদা, তার ভাবনা চিন্তা সবই আলাদা।একজনের কাছে যেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, অন্যজনের কাছে সেটা হয়ত কোন সমস্যা না।আবার জীবনের এক স্তরে যেটা অনেক গুরুত্ব বহন করে অন্য পর্যায়ে এসে সেটার আর তেমন গুরুত্ব থাকে না।ধর্ম, সংস্কৃতি, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ইত্যাদি বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের জীবনে।এসকল কারণ আছে বলেই তো দেশ ছেড়ে প্রবাসজীবন গ্রহণ করতে মানুষ বাধ্য হয়। এসব দৃশ্যমান সমস্যার সাথে জড়িয়ে থাকে হাজারও অদৃশ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক সমস্যা। দৃশ্যমান সমস্যা চিহ্নিত থাকে বলে তার কিছু সুরাহা হয়ত হয় কিন্তু অদৃশ্য সমস্যার সমাধান খুঁজতে অনেক বেশী ভেতরে উঁকি দিতে হয়। সেটা হয়ে ওঠে না বলে, সেগুলো থেকে অধরা আর অব্যক্ত। তবে আশার কথা এই যে, অনেকেই এই নিয়ে আজকাল কথা বলছেন, এগুলো এখন ওপরে উঠে আসছে আশাকরছি কখনও এগুলোও নিয়েও অনেক কাজ হবে, কিছু না কিছু আলো বেরিয়ে আসবে।

Tanbira Talukder is an accountant by profession. She is a novelist, reciter and human rights activists based in The Netherlands.

Monday 3 December 2018

ডিপ্রেশন

কবিবর শ্রীজাত বলেছেন,

ডিপ্রেশনের বাংলা নাকি নিম্নচাপ? -
বৃষ্টি এল। সঙ্গে কফি এক-দু' কাপ
কেবল মুঠোয় বন্দি কফির একলা কাপ -
ডিপ্রেশনের বাংলা জানি । মনখারাপ ।

ট্রেনে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয়, মাঝে মাঝেই ট্রেন লেট, কারণ ট্রেনের নীচে কেউ ঝাঁপ দিয়েছে। এখানে বলে, “পাতা ঝরার মুহূর্ত থেকে নতুন পাতা আসার আগের মুহূর্ত” পর্যন্ত মানুষের বিষাদগ্রস্ততা অনেক বেড়ে যায়।

প্রায়ই আজকাল খবর দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের আত্মহত্যা, তরুণ/তরুণীদের আত্মহত্যা।

“বিষাদ-হতাশা” ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতই একটি মারাত্বক রোগ। এর সম্পর্কে প্রচার হওয়া জরুরী। এর চিকিৎসা হওয়া জরুরী, সর্বোপরি সমাজে এ অসুখটি নিয়ে সচেতনতা আরও জরুরী। বিষন্নতা শুধু মানসিক জায়গাতেই আটকে থাকে না। শরীরে এর প্রচন্ড প্রভাব পরে, ঘুম কমে যাওয়া, ঘুমের মধ্যে ঘেমে ওঠা, দুঃস্বপ্ন দেখা, প্রচন্ড পেটে ব্যথা হওয়া, ক্ষিদে না পাওয়া কিংবা অনেক বেশি ক্ষিদে পাওয়া, কাজ করার আগ্রহ এবং শক্তি কমে যাওয়া, দ্রুত রেগে যাওয়া, আবেগতাড়িত আচরন, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া সবই এর লক্ষণ। চুল পরে যাওয়া, শারীরিক লাবন্য কমে যাওয়া সহ বহুবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে। 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও ওষুধ তো আছেই, সাথে ইয়োগা, মেডিটেশান, ব্যায়াম, বিষন্নতাকে নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। বিষন্নতার ওপর প্রচুর গবেষনা হয়েছে এবং হচ্ছে, নেটে বিনামূল্যেই এ নিয়ে বিস্তর তথ্য পাওয়া যায়।


জীবনের মৌলিক ব্যাপার গুলো নিয়ে যারা খুব সচেতন এবং স্পর্শকাতর থাকেন তারা যখন সমকামিতাকে একটি অসুস্থতা কিংবা বিষন্নতা ফ্যাশন ভাবেন তখন খুব বেদনাদায়ক। আপনার ক্যান্সার হয় নি বলে আর একজনের ক্যান্সার কোন উপহাসের বিষয় নয়। এক এক জন এক এক ব্যাপারে স্পর্শকাতর। মানসিক ধকল সবাই এক ভাবে সামলাতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-খ্যাতিহীন ছাত্রের আত্মহত্যা যেমন সত্যি তেমনি খ্যাতির শিখরে থাকা এমেরিকার প্রেসিডেন্টের প্রেমিকা মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যাও ততটাই সত্যি। তাই আসুন “উপহাসে”র পথে না যেয়ে – সাহায্যের পথে যাই। একটি প্রাণ বাঁচলেও বাঁচলো পৃথিবী।

02/12/2018

Thursday 29 November 2018

BLOCKADE

টেলিফোনের ওপারে বাবার গলা শুনতে পেয়ে উদ্বিগ্ন সুলতানা আকুল গলায় জিজ্ঞেস করলো, বাবা তোমরা কেমন আছো? ওদিকের কি খবর? সুলতানার প্রশ্ন শুনে বাবা আরও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ফোনটা দিলেন সুলতানা’র মায়ের হাতে। সুলতানা মা’কেও একই কথা জিজ্ঞেস করলো, মা ওদিকে কি খবর? মা’ও নিরুত্তর। সুলতানা টের পাচ্ছে, ফোন আবার হাত বদল হচ্ছে। চারবার ফোন হাত বদল হওয়া পর, সুলতানার মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, চুপ করো তুমি, এই নিয়ে কোন কথা নেই। সুলতানা মায়ের অসহায়ত্ব টের পেলো। পঁচিশে মার্চের ভয়াল খবর পেনিসিলভিনিয়াতে পৌঁছলো উনিত্রিশে মার্চ। এক সন্তানের জননী সুলতানা টিভিতে, অসহায় না খেতে পাওয়া, মৃত্যু ভয়ে ভীত বাচ্চাদের মুখ দেখতে দেখতে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলো, বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে এই অন্যায়ের কথা, এ হয় না, এ হতে দেয়া যায় না। বিভিন্ন জায়গায় তিনি রোজ “একশ”টি ফোন করবেন এই ছিলো তার প্রতিজ্ঞা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তার এই প্রতিজ্ঞা অনেক মানুষের জীবন রক্ষা’র কাজে এলো।

পি।এইচ।ডি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষিকা সুলতানা আলম চেষ্টা করতে লাগলেন প্রবাসী বাঙালি, অবাঙালি বন্ধুদের মধ্যে খবর পৌঁছে দিতে, সচেতনতা তৈরী করতে, তাদের করনীয় ঠিক করতে। অবশেষে জনা পনের মানুষ এক সন্ধ্যায় পেনিসিলভিনিয়ার এক বাড়িতে একসাথে হয়ে শুরু করলেন তাদের যুদ্ধ। প্রথমে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে প্রটেষ্ট, মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা। দেখলেন ব্যানারে তেমন কাজ হচ্ছে না, তারা টিভিতে যেমন দেখেছিলেন, সেরকম জামা কাপড় পরে, সে সব অসহায় ভঙ্গীতে এই ঠান্ডায় রাস্তায়, ঘাসের ওপর শুয়ে থাকলেন। তাতে কিছুটা কাজ হলো। তারপর ঠিক করলেন, হোয়াইট হাউজের সামনে কাগজ দিয়ে সুয়ারেজ পাইপের আদলে বানিয়ে তাতে বসবাস করবেন। যেমন ভাবা ঠিক তেমনই কাজ। ঠান্ডার মধ্যে দুই দিন কয়েকটি পরিবার কাগজের সুয়ারেজ পাইপে থাকার পর হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র তাদের ডাকলেন। মিডিয়া’র অনেকের নজরে আসলো। নিক্সন সরকার, দুইবার করে তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে বাধ্য হলেন। এপ্রিলে একবার তারা জানালেন, পঁচিশে মার্চের পর পাকিস্তানের কাছে তারা কোন অস্ত্র বিক্রি করে নি। জুনে আবার জানালেন, পঁচিশে মার্চের পর তারা পাকিস্তানকে কোন ধরনের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে নি। যদিও কিসিঞ্জার তখন চীন সফর করে চীনকে হাতে রাখতে ব্যস্ত ছিলেন, চীন বরাবরই পাকিস্তানের ভাল বন্ধু।

Quackers ধর্মে বিশ্বাসী রিচার্ড টেয়লার বলেন, যদি সত্যিকারের কোয়েকার হতে চাও, তাহলে তোমাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। ফিলিস টেয়লার আর রিচার্ড টেয়লার দম্পত্তি করাচী বন্দর থেকে যেসব জাহাজ ছেড়েছে বাঙালি আর পাকিস্তানী নাবিকদের নিয়ে, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর জাহাজে অবস্থান করা বাঙালি নাবিকরা ভীত সন্ত্রস্ত দিন যাপন করছিলো। জাহাজ এমেরিকায় এসে নোঙর করার পর ভীত বাংলাদেশি নাবিকরা স্থানীয় মানুষদের কাছে সাহায্য প্রার্থণা করে। এক ব্যাঙ্ক থেকে তাদেরকে টেয়লার দম্পত্তির ফোন নম্বর দেয়া হয়। টেয়লার দম্পত্তি তাদের আরও বন্ধুদের সাথে নিয়ে এক একবার ছয় গাড়ি পযর্ন্ত মানুষদের উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, নিজের হাতে রুটি বানিয়ে, পরিবেশন করেছেন। অনেক নাবিকদের তারা এখান থেকে টিকেট কেটে দেশে পাঠিয়েছেন। নাবিকরা নিরাপদে দেশে ফিরে চিঠি লিখে জানিয়েছেন পরিবারের সাথে তাদের সেসব বেদনাবিধুর আর মধুর মিলন দৃশ্যের কথা। পরিবার ধরেই নিয়েছিলো তারা আর বেঁচে নেই, পাকিস্তানীরা জাহাজেই হয়ত তাদের হত্যা করেছে।

এরকম অমূল্য অনেক বাস্তব ঘটনার সমন্বয়ে আরিফ ইউসুফ তৈরী করেছেন, দু-হাজার সতেরো’র TWIFF এওয়ার্ড বিজয়ী ডকুমেন্টরী “BLOCKADE”. ডকুমেন্টারীর সবকিছু নিয়ে বিশদে লিখতে গেলে, আয়তন অনেক বড় হবে, ফেসবুক-টুইটারের এই অনু-পরমানু গল্পের যুগে কারই বা ধৈর্য্য আছে এত বড় একটা লেখা পড়ার। ধারনা দেয়ার মত করে খুব ছোট পরিসরে এই লেখার অবতারণা। যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ঝরে গেছে সত্যি কিন্তু বিদেশে থাকা অনেক প্রবাসীদের অক্লান্ত চেষ্টায় ও অনেক বিদেশীদের মানবিক সাহায্যে রক্ষা পেয়েছে অন্তত আরও বিশ লক্ষ প্রাণ। বাংলাদেশ অবশ্য এসকল বন্ধুদের মনে রেখেছে এবং তাদেরকে অবদানকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দান করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

আরিফ ইউসুফ যিনি পেশায় একজন আই।টি স্পেশালিস্ট, নিউ জার্সিতে বাস করলেও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশে আই-টি সেক্টরের প্রসারেও কাজ করছেন। পেশাগত কাজের বাইরে তার সময় যায় সত্যের পেছনের সত্যকে খুঁজে বের করতে, তাকে তুলে ধরতে। এই ডকুমেন্টারীটি তৈরী করতে তাঁর সময় লেগেছে আট থেকে নয় বছর। এবং তিনি জানিয়েছেন, এটি তার কাজের শুরু, শেষ নয়। আরও এমন অনেক জানা -অজানা তথ্যের সমন্বয়ে তার নতুন নতুন কাজ দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা। অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো তার জন্যে।

নেদারল্যান্ডসে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রদূত শেখ মোহামম্মদ বেলালকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই তথ্যচিত্রটি আমাদের কাছে তুলে ধরার জন্যে। শীতের এই নিসস্তব্ধতা ভেঙে গরম চা-কফি’র সাথে ছোলা-পেঁয়াজু আর পায়েসের কোলাহল ও আড্ডামুখর একটি অপরাহ্ন উপহার দেয়ার জন্যে দূতাবাসের সকল কূটনীতিক কর্মকর্তাদের ও অশেষ ধন্যবাদ।

২৯/১১/২০১৮

স্ট্যাপহোর্স্ট---দ্যা_আননোউন_স্টোরি

“নেদারল্যান্ডস”– যাদের নিয়ে প্রবাদ আছে, “গড ক্রিয়েটেড দ্যা আর্থ, বাট দ্যা ডাচ ক্রিয়েটেড দ্যা নেদারল্যান্ডস”। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে, সমুদ্র থেকে দেশ রক্ষাই করে নি শুধু, একের পর এক পোল্ডার তৈরী করেছে। পানি সরিয়ে, ভূমি বের করে নতুন নতুন শহর বানিয়ে চলছে, আজও কাজ চলছে, শেষ হয় নি। মানুষ বাড়ছে, সমুদ্র থেকে ভূমি বেশি প্রয়োজনীয়, তারা ভূমি বাড়িয় চলছে। সমুদ্রের পাশের ঐদিক গুলোতে ড্রাইভে গেলে এত ভাল লাগে, মানুষের জয়, বিজ্ঞানের জয়, প্রযুক্তির জয়, হার মানে নি মানুষ প্রকৃতির কাছে, নিয়তি বা ভাগ্য বলে মেনে নেয় নি, থেমে যায় নি তারা।

ছোট এই দেশটিতে হাজার হাজার “এক্সপার্ট” এর আনাগোনা। যদিও এখানে কারখানা বলতে তেমন কিছু নেই, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন, রুটি, ডিম, দুধ, মাংস এগুলো বাদ দিয়ে দিলে ধরতে গেলে বাকি সব আমদানী করা হয় বাইরে থেকে। প্রায় সব ধরনের শিল্প-কারখানাই নিম্ন মজুরীর দেশ, এশিয়া, আফ্রিকা, সাউথ এমেরিকাতে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সাথে সরিয়ে দেয়া হয়েছে আইটি ফার্ম, ফাইন্যান্স এগুলোও। ব্যাঙ্গলোর, পুনে, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড কোথায় নয়, একমাত্র শ্লোগান “খরচ বাঁচাও”। তাহলে এত এক্সপার্ট এখানে কি করে? শুধুই রয়ে গেছে, “রিসার্চ এন্ড ডেভেলাপমেন্ট”, নতুন নতুন প্রযুক্তির পেছনে মরিয়া। তারপরও বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত মজবুত ছোট এই দেশটি যাদেরকে মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া ভার।

এখন কেউ যদি বলে, নেদারল্যান্ডসে একটি শহরতলী আছে যেখানে আজও মানুষ ঔষধে বিশ্বাস করে না, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে না, ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাকে তাদের জীবন চলে। শহরতলী’র গন্ডী ছেড়ে অনেকেই বাইরে বের হয় না। ওর মধ্যেই জীবন কাটায়, কাজ করে, বেঁচে থাকে। আধুনিক সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওরা নিজেদের রাজ্যে নিজেরা আছে নিজেদের মতো। বিশ্বাস করা যায়? গল্পের মতো শোনালেও, গল্প নয়, সত্যি। 

স্টাপহোর্স্ট – একটি গ্রামের নাম যেখানে লোকজন “ঘৃণা করতে ভালবাসে”, তারা তাদের শেকড় আকড়ে ধরে থাকতে পছন্দ করে। আধুনিক ডাচ সমাজ হয়ত তাদের বিভিন্ন রকম সামাজিক ভাতা, সেক্স আর ড্রাগস এর প্রতি উদার মনোভাবের জন্য বিখ্যাত কিন্তু আমস্টার্ডাম থেকে আশি মাইল উত্তরপূর্বে কেউ যদি যায়-সেখানে এক অন্য পৃথিবী। এখানের লোকজন সব ধরনের বীমা, সামাজিক ভাতা আর তাদের ভাগ্যের ওপর হস্তক্ষেপ করাকে প্রত্যাখান করে। টেলিভিশন দেখাকে অধর্মীয় মনে করে, এড়িয়ে চলে।

এই গ্রামের মুখপাত্র ইয়ান উইলিয়াম স্টক বলেন, গোটা নেদারল্যান্ডস জুড়ে স্টাপহোর্স্ট এর এমন একটা ছবি যে সবাইকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। পুরো ডাচ জাতি, সমকামিতা, যন্ত্রণাহীন মৃত্যু, গর্ভপাত সব কিছুর প্রতি উদার শুধু স্টাপহোর্স্ট বাদে। আধুনিক সংশোধিত ডাচ সমাজ থেকে দূরে তিনশ হাজার মানুষ নিয়ে, দ্যা বাইবেল বেল্ট গোষ্ঠী উত্তর ওস্টব্রুঘ এর উর্ক শহরে, দক্ষিন পশ্চিম থেকে একশ বিশ মাইল দূরে, আলাদা একটি সমাজ গঠন করেছিলো। চৌদ্দ হাজার অধিবাসী নিয়ে প্রোটেস্টান্ট ধর্মে অগাধ আস্থা রাখা একটি কৃষিকাজ ভিত্তিক গ্রামের নাম “স্টাপহোর্স্ট”। নেদারল্যান্ডসে বাইবেলে অবিচল আস্থা রাখা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি তারা। এখনো মেয়েদেরকে চাষীদের ঐতিহ্যবাহী লম্বা স্কার্ট, ফুল ছাপা ব্লাউজ পরে মাথায় টুপি লাগিয়ে গ্রামের সাতটি চার্চের সামনে প্রতি রোববারে তাদের ঘরের পুরুষদের সাথে হাঁটতে দেখা যায়।

পনেরশ বাষট্টি সালে একজন খুব ধার্মিক ব্যক্তি লুথেরানিজাম (Lutheranism) এবং কালভিনিজাম (Calvinism) বিশ্বাস এর মাঝামাঝিতে একটি মিশ্র ধর্ম আবিস্কার করেন, যার মূল কথা ছিলো, নিয়তিকে মেনে নিতে হবে, বিশ্বাসীকে ভুগে ভুগে তার সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। আর এই বিশ্বাসের নাম “হাইডেলবার্গ ক্যাটেসিজাম” – যা নিয়ে স্টাপহোর্স্ট এর মানুষ বেঁচে আছে। অন্যান্য দেশের মত ডাচ রাজনীতিতেও ধর্ম বিরাট ভূমিকা রাখে। ডাচ রাজনীতিতে একটি শব্দ আছে “স্টাপহোর্স্ট ফ্যাক্টর”। কট্টরবাদী বিশ্বাসীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদে সবসময় পাঁচ ভাগ আসনে জয়ী হয়। 

স্টক বলেন, বহু বছর আগে অনেক অনেক ডাচ গ্রাম এই রকম ছিলো, এখানে ঐতিহ্য অনেক দিন ধরে চালু রয়েছে কারণ এই গ্রামের অধিবাসীরা সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। গ্রামের বেশীর ভাগ অধিবাসীই পুরনো ঐতিহ্যের কারণে, সরকারের সামাজিক ভাতা নিতে অনিচ্ছুক, সরকারকে কর প্রদানেও তাদের অনীহা। তারা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্যে নিজেরাই অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে। কারো বাড়ি পুড়ে গেলে, প্রতিবেশীরা নতুন বাড়ি বানিয়ে দেয়। কেউ মারা গেলে আত্মীয়রা তার কফিন বানিয়ে দেয়। স্টাপহোর্স্ট এর ঐতিহ্য হলো, একজন কৃষক মারা গেলে তার জমি ছেলেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যেসব ছেলেরা উত্তরাধিকার সূত্রে জমি পাবে না, সে অন্যদের জমির পেছনে নিজের খামার বাড়ি বানিয়ে নেবে। এই কারনে সেখানকার চাষের জমি গুলো খুব সরু আর লম্বা – পনেরশ বাই চল্লিশ মিটার। আদিতে এগুলো একশ পঁচিশ মিটার প্রশস্ত ছিল। এ অঞ্চলের কৃষকেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী লো স্যাক্সন এর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এই গ্রামের বাড়ির জানালা-দরজা সব সবুজ। এখন যে বাড়ি গুলো দেখা যায় তার বেশীর ভাগই আঠারশো পঞ্চাশ সাল থেকে উনিশো দশ সালের মধ্যে তৈরী করা হয়েছিল।

এ গ্রামের অনেক অধিবাসীই ওষুধ খায় না এমন কি টিকাও নেয় না। তারা বিশ্বাস করে অসুস্থতা হলো ঈশ্বরের শাস্তি আর সুস্থতা তার পুরস্কার। উনিশো একাত্তর সালে পোলিও মহামারীর সময় স্টাপহোর্স্ট বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। উনচল্লিশ জন পোলিও আক্রান্ত হয়েছিল যাদের বেশীর ভাগই শিশু। অনেকেই প্রতিষেধক নিতে অস্বীকার করে, পাঁচ জন মারা যায় আর তের জন শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। শতকরা বিশ জন টিকা ছাড়াই রয়ে যায়। WHO স্টাপহোর্স্ট এবং নেদারল্যান্ডসের এ ধরনের কয়েকটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে ঘোষনা করে। ইউরোপের মধ্যে জন্মহার এখানে সবচেয়ে বেশী। মোট উর্বরতার হার (total fertility rate, TFR) এখানে দুই দশমিক সাত, দুই হাজার তিন সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটা চতুর্থ সর্বোচ্চ।

অন্যান্য বাইবেল আশ্রয়ী গ্রামের মত স্টাপহোর্স্ট ও এখন রুপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এই ছবির মত সুন্দর গ্রামের দৃশ্যটি ক্রমশঃ পরিবর্তন হচ্ছে। জমি আস্তে আস্তে দুর্লভ হয়ে উঠছে আর যতই দিন যাচ্ছে তরুণ – তরুণীরা শহরের কল কারখানায় কাজের সন্ধান করছে। দু’বছর আগে গ্রামে একটা চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে, ধর্মীয় শিক্ষা ক্রম হ্রাসমান, এখন বড়রা বাড়িতে ছোটদের এই শিক্ষা দিচ্ছে। চাষীদের ঐতিহ্যবাহী জামা আজকাল কেউ পরে না বললেই চলে। গরমের সময় পর্যটকদের এড়াতে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা থেকে নিজেদের বিরত রাখে। স্টক এর ভাষায়, অন্যান্য সাধারণ গ্রামের মত আমরা এখন শুধুই একটি গ্রাম। শতকরা মাত্র চল্লিশ ভাগ অধিবাসী এখন কৃষক। দীর্ঘ দিনের অধিবাসী শতকরা ষাট জন, আর শতকরা তিন ভাগেরও কম মানুষ এখন অতিরিক্ত ধর্ম বিশ্বাস করে। কিন্তু গ্রামটিকে এখনও ঐতিহ্যই শাসন করে।

উনিশ বছরের কার্লো স্পাইক যে এ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে বড় হয়েছে, তার মতে, একজন প্রকৃত স্টাপহোর্স্টার হতে হলে, তোমার দাদা এবং পর দাদাকেও এই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করতে হবে, নইলে তুমি প্রকৃত স্টাপহোর্স্টার নও। গ্রামের অনেকেই কার্লোকে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আজও অনেক মান্যগন্য করে।


তথ্যসূত্রঃ অন্তর্জাল

বিপ্লব

সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয়,
এই চান্দের রাইতে তোমার হইছে গো সময়
আজ চল্লিশ দিন হয়ে গেলো, এভাবেই দিন গড়াবে মাসে আর মাস গড়াবে বছরে ।
আমাদের মধ্যে তুই প্রথম। হয়ত অনেক ব্যাপারেই তুই প্রথম ছিলি, এম-এস-এন, ইয়াহু। হারিয়ে গিয়েও যে সবার মধ্যে এখনও কিছুটা যোগাযোগ রয়েছে তার কারণটাও অনেক ক্ষেত্রে তুই। একে ফোন দেয়া, তাকে ডাকা, তুইই তো করতি, আমরাও জানতাম তুই করবি।
জীবনটা তারপর অগোছালো হয়ে গেলো, অবশ্য সে আমাদের সবারই। কে আর ঠিকমতো গোছাতে পারলাম বল, গোছানোর চেষ্টা করতে করতে যাওয়ার সময় হয়ে এলো কিন্তু ঠিকমত গোছানোই হয়ে উঠলো না। ওপারে কোন জীবন থাকলে আশাকরি ভাল থাকবি, অন্তত চেষ্টা করিস গুছিয়ে নিতে, ভাল থাকতে।
একসাথে আমরা ষোলজন এস।এস।সি দিলাম, সারা পাড়া গরম, বায়োলজি খাতা আঁকা, নোট দেয়া নেয়া, সাজেশান, কোচিং। নিজের মেয়ের এস।এস।সি দেয়ার সময় হয়ে এলো, অথচ মনে হয়, এই সেদিনের কথা। তোর গাঢ় লাল সোয়েটার, জীন্স এর প্যান্ট, কেডস, সদ্য উঁকি দেয়া গোঁফ। তখন খুব ব্যান্ডের যুগ, ব্যান্ড বানালি, ঐ দূর পাহাড়ে ---- লোকালয় থেকে দূরে ------
অনেকদিন পর তোর চলে যাওয়া উপলক্ষ্যে আমরা বন্ধুরা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বললাম, এমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া। তোকে নিয়ে কথা হলো, নিজেদের কথাও হলো, অসংখ্য উচ্চারণ করা শব্দের মধ্যে যে শব্দগুলো অনুচ্চারিত থাকলো, তা হলো, কাউন্ট ডাউন হ্যাজ স্টারটেড, উই আর অন আওয়া ওয়ে
যারা চলে যায় তারা চলে যায়, পেছনের কথা ভাবে না, যেমন তুই ও ভাবিস নি, তোকে ছাড়া চাচা-চাচী’র দিনগুলো কতটা লম্বা হবে। মেঘকে নিয়ে তোদের বাড়ি গেলে, চাচা দরজা খুলেই হাসি মুখে বলতে থাকতো, মেয়েতো আমার পছন্দ হয়ে গেছে স্বাতী, আমিতো মেয়ে রেখে দেবো। মেঘ এসব রসিকতার কিছুই বুঝতো না, সে শুধু জানতো এই বাড়িতে তার অধিকার অনেক। সে তার ছোট ছোট পা ফেলে, ডাইনীং থেকে খাবার তুলতো, নির্দ্বিধায় ফ্রীজ খুলে দেখতো আর কি কি নেয়া যায়। দিন বাড়ি যায় – চড়ে পাখির ডানায়
দেখা হবে বন্ধু, হয়ত কিছুদিনের অপেক্ষা, চলে যাওয়াই নিয়তি, তবে তোর মত যেনো এক শটে চলে যেতে পারি, কেউ লক্ষ্য করার আগেই, দশ থেকে পনর সেকেন্ডের মধ্যে। তুই চিরদিনই বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা ভালবাসতি, শেষ বিদায়ে সবাইকে পাশে পেয়েছিস, তোর শেষ যাত্রা ছিলো রাজকীয় কিন্তু আমরা যাবো একা একা – কেউ থাকবে না শেষ যাত্রায়
একদিন এই পৃথিবীর কোথাও কোন অস্তিত্ব থাকবে না জেনেও যে রোজ এই বেঁচে থাকা, এর নামই কি জীবন!

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ফুলের মেলা

নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বব্যাপী ‘টিউলিপের দেশ’ বলা হয়, যদিও এই ফুলটি ওদের নিজেদের নয়। এমন নয় যে ডাচরা এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়, ফুলের জন্য ভালোবাসা ওদের হৃদয়ের অনেক গভীরে অবস্থান করে।
এটাকে বিশদভাবে ব্যাখা করতে গেলে প্রথমে আমাদের সতেরশো শতাব্দীর আমাস্টার্ডামের খালের পাশের একটি বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে হবে। একজন ধনী সওদাগর একটি চেয়ারে বসে আছেন, তন্ময় হয়ে আছেন তার ভাবনায়। না, তার ভাবনায় ফুলেল ডিজাইনের কোন দেয়ালপেপার ছিলো না, ছিলো ফুলদানিভর্তি ফুল। যদিও আমরা এখন যে ফুলদানিটা দেখতে পাই সেটির সঙ্গে কিন্তু আগের সেই ফুলদানির কোনো মিল নেই।
যেটাতে ফুল থাকে সেটাতে একটি ফুটো থাকে, রঙ ও ছাঁদে প্রতিটিই আলাদা। আমরা যদি হরেক রঙের মিশ্রণে একটি রঙিন ফুলের তোড়া বলি, সতেরশো শতাব্দীতে এটিই ছিলো সর্বোচ্চ প্রশংসার জিনিস।
তখন থেকে, ফুলের প্রতি গভীর আবেগ ডাচ সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে উঠলো। অনেক ডাচ নাগরিক বাড়িতে টেবিলের ওপর এক গোছা ফুল না থাকলে সে বাড়িটিকে বসবাসের যোগ্য বলে ভাবেন না, এবং অনেকেই বসন্তে আর গ্রীষ্মে বাগানের ফুলের রঙ দিয়ে দঙ্গল না বাঁধিয়ে বিশ্রাম নেন না।
এমনকি কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে, এক গোছা ফুল নিয়ে যাওয়া ডাচদের রীতি, শুধু অনুষ্ঠানে বা জন্মদিনই নয়, ফুল এখানে প্রথাগত, খুবই নৈমিত্তিক ব্যাপার। ডাচরা ফুল নিয়ে একথাটি খুবই বলে, ফুলের বিজ্ঞাপনেও এই স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়।
ফুলচাষের এই নেশাকে অনুশীলন করতে অগুনিত ফুলের দোকানের প্রয়োজন। শুধু ফুলের জন্য এখানে আলাদা বিশেষ বাজার আছে, যদিও আমস্টার্ডামের বাজারটাই পৃথিবীবিখ্যাত কিন্তু উইটরেক্ট বাজারের পরিবেশ ভালো।
বসার ঘরে সাজিয়ে রাখার চেয়ে ফুলচাষের এই সংস্কৃতিতে তাদের উৎপাদন ও ব্যবসায়ী মনোভাব বেশি পরলক্ষিত হয়। ফুলের রাজ্য শাসনকারী উদীয়মান ব্যবসায়ী ও সওদাগররা নিজেরাও বিরাট পুষ্পপ্রেমিক। বিলিয়ন ইউরোর ওপরে ফুল ও ফুলের বীচি চাষের এই বাজারে প্রতি হাজার জনে দশ জন ডাচ নাগরিক জীবিকা নির্বাহ করেন। বেশির ভাগ উৎপাদনের লক্ষ্যই থাকে দেশের বাইরে রপ্তানি। প্রায় পাঁচ দশমিক চার মিলিয়ন ইউরো প্রতি বছর ফুল আর ফুলের চারা বিক্রি করে আয় হয়।
ফ্লোরাহল্যান্ড এর নিলাম হলো এই ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র, এটি ফুলের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিলাম কেন্দ্র। বিশ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় ফুল ও চারার নিলাম হয় এখানে, পাঁচ হাজার চাষীর হাতে উৎপন্ন প্রায় সাড়ে বারো হাজার বিলিয়ন চারা আর ফুল হাতবদল হয় এখানে। বড় স্তুপটি চলে যায় দেশের বাইরে। বলা হয়ে থাকে, সারা পৃথিবীতে যত ফুল ও ফুলের গাছ কাটা হয় তার অর্ধেক কাটা হয় হল্যান্ডে।
আলসমেয়ার এর ফ্লোরাহল্যান্ড হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল বাণিজ্যকেন্দ্র। পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, ফুলের গেঁড় এর মাঠ দেখতে যাওয়া। ষোলশ শতাব্দীর শেষ থেকে নেদারল্যান্ডসে ফুলের গেঁড় উৎপন্ন করা হচ্ছে। পঁচিশ হাজার হেক্টরের বিশাল প্রান্তর রঙ-বেরঙের ফুলের গেঁড় দিয়ে যেনো মোজাইক করা আছে।
সবচেয়ে বেশি ফুলের গেঁড় করা হয় টিউলিপ, লিলি, নার্সিসাস, গ্ল্যাডোলিয়া আর হিয়াসিন্ট দিয়ে। ফুলগুলো ফুটে গেলে, ফুলের মাথাটা যান্ত্রিকভাবে কেটে ফেলা হয়, তাতে করে গেঁড়গুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফুলের গেঁড় রপ্তানি করে প্রায় সাতশো মিলিয়ন ইউরো আয় করা হয়। উত্তর আলকামার শহরের হার্লেম আর লাইডেন হলো গেঁড় চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
সাম্প্রতিক কোইকেনহোফ বাড়িটি- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান। প্রতি বছর মিলিয়নের ওপর পর্যটক আসেন ওখানে। ব্লুমকোরসোতে ফুল দিয়ে নতুন ধরনের বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন প্রতিকৃতি তৈরি করে কার্নিভাল এর মতো শোভাযাত্রা করে নর্ডওয়াইক থেকে হার্লেম যাওয়া এখানের প্রচলিত প্রথা। এধরনের ফুলের শোভাযাত্রা অবশ্য পুরো বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হতে থাকে। ওয়েস্টল্যান্ড- যেটা গ্রীন হাউজ চাষের কেন্দ্র ‘গ্লাস-সিটি’ বলে পরিচিত, সেখানে প্রতি গ্রীষ্মের ‘ভাসমান শোভাযাত্রা’ খুবই প্রশংসিত।
সবোর্পরি, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সারা বিশ্বে নেদারল্যান্ডস ফুলের জন্যে বিখ্যাত। বিশেষ করে টিউলিপ নেদারল্যান্ডসের সবকিছুরই প্রতীক। উনিশো আশি আর নব্বই দশকের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ফুটবলার রুড গুলিত, মার্কো ভান বাস্টেন আর ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড যারা এসি মিলানে খেলতো, তাদেরকে ইটালিতে ‘টিউলিপানি’ কিংবা ‘টিউলিপ্স’ নামে ডাকা হতো।
টিউলিপের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের এই একাত্বতাকে মূলধন করে ডাচ ব্যবসায়ীরা বিশ্বে আধিপত্য গড়তে চান, যেমন বিশ্বজুড়ে হোটেল গোল্ডেন টিউলিপের চেইন খোলা হয়েছে। যদিও, ডাচরা অন্যের আকর্ষণ নিজেরা জাঁকালো ভাবে প্রদর্শন করছে, কারণ টিউলিপ ওদের নিজেদের দেশিয় গাছ নয়, ষোলশ শতাব্দীতে তুর্কীর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে এটি আমদানি করা হয়েছিল।
এমনকি টিউলিপ শব্দটিও টার্কিস টুলব্যান্ড (টারবান) শব্দের অপভ্রংশ হয়ে আমদানি করা হয়েছে। ঘটনাক্রমে, আমদানিকৃত ফুল থেকে ডাচেরা সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নতুন ধরনের টিউলিপের চাষ করেন, যেগুলো সতেরশো শতাব্দীতে টার্কিতে খুব প্রশংসিত হয়।
নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ সত্যিকার অর্থেই প্রাণবন্ত ব্যবসার প্রতিকৃতি হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ষোলশ ছত্রিশ আর ষোলশ সাইত্রিশ সালে এত বেশি গেঁড় উৎপাদিত হয়েছিল যে অনেক মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছিলো এসব করতে গিয়ে। দুর্লভ গেঁড় এর চাহিদা অবশ্য আমর্স্টাডামের খালের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পুরো পৃথিবীজুড়েই আছে।
অনেকের মধ্যে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ইয়ান ফান গোয়েন যিনি চিত্রশিল্পী ইয়ান স্টেইন এবং পোলাশ পোটারের শিক্ষক ছিলেন, তিনিও কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান। এখন আর ডাচেরা এত ঝুঁকির মধ্যে নেই, কারণ পৃথিবীর কোথাও এই সবচেয়ে বড় বাজারের চেয়ে সুলভ দামে ফুল বিক্রি হয় না।  
*মূল প্রবন্ধটি মারটাইন ড্যা রোই এর লেখা ‘দ্য ডাচ আই প্রিজ্যুম’ বই থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে। লেখাটি গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন লেখক। 

বনফুল

১.


আজকাল আমরা “অনুগল্প” কিংবা “পরমানু” গল্পতে খুব অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সময় কোথা আমাদের অনেক বেশি পড়বার? কত কি করার আছে, সময় বড্ড কম। আমরা অনেকে ভাবি ব্লগ কিংবা ফেসবুক আধুনিক সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই ঝরঝরে মেদহীন বর্ননায়, টু দ্যা পয়েন্ট লেখার প্রচলন করেছে। আসলে কি তাই? একটু পেছনে তাকালে ইতিহাস কিন্তু অন্যকথা বলে। বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প পড়তে পড়তে ভাবছি, অধুনা “অনুগল্প” এর পথ প্রদশর্ক তিনি কি? “লিপিকা”য় গ্রন্থিত করা কবিতা গুলো’র জন্যে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “গদ্য কবিতা”র পথ প্রদর্শক বলা হয় তাহলে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নিসন্দেহে “অনুগল্প” এর দিক দিশারী।
আয়তনে হয়ত অধুনা অনুগল্পের কাছাকাছি কিন্তু বিষয়, বর্ননা আর তার শান দেয়া ধার, তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা যেগুলো আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে আজও চরম বাস্তব। অনুগল্পের চেয়ে আয়তনে বড় নয় বটে – এত স্বল্প পরিসরে এত কঠিন বক্তব্য কিংবা বিদ্রুপ বা হাস্যরস অবিশ্বাস্য। আমরা আজকাল এত লেখা পড়ি, হোমফীড ভরা স্ট্যাটাস, নোট, বিভিন্ন সাহিত্যের গ্রুপ কিংবা দৈনিক পত্রিকা গুলোর সাহিত্য পাতাগুলোই ধরি না কেন, রাতে যখন ঘুমোতে যাই, কটা লেখা আমাদের পুরোপুরি মনে থাকে? কিন্তু বনফুল আপনার মাথায় ঘুরবে, ঘুরেই যাবে, আপনাকেও ঘোরাবে, বিশ্বাস হয় না? পড়ে দেখুন তবে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প নিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্যের আলোচনা।
[[[স্বপ্নে আর বাস্তবে, মানুষের আশা আর প্রাপ্তিতে যে অসামঞ্জস্য এবং সেই অসামঞ্জস্য সত্বেও মানুষ যে ভাবী জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলেছে, জীবন-দার্শনিকের কাছ তাও কম হাসির বিষয় নয়। “সুলেখার ক্রন্দনে”র কথা মনে পড়ছে। জ্যোৎস্নামদির গভীর রাত্রে স্বপ্নময় আবেষ্টনীর মধ্যে দুগ্ধফেননিভশয্যায় একটি ষোড়শী তণ্বীকে কাঁদতে দেখে কবিকল্পনায় প্রশ্ন জেগেছে, কেন এ ক্রন্দন? – পুত্রশোক? সিনেমায় না যেতে পারার অভিমান? শাড়ির পাড় পছন্দ করা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মতভেদের পরিণাম? না কুমারী-জীবনের মধুর পূর্ব-রাগের স্মৃতিমথিত বেদনা? অমন চাঁদনীরাতে কৈশোরের সেই অর্ধ-প্রস্ফুটিত প্রণয়-প্রস্থান সহসা পূর্ণ- প্রস্ফুটিত হতে পারে না কি? দূরে “চোখ-গেল” পাখি অশ্রান্ত সুরে ডেকে চলেছে। সম্মুখের বাগানে রজনীগন্ধাগুলি স্বপ্নবিহবল-চারিদিকে জ্যোৎস্নার পাথার! এমন দুর্লভক্ষণে হারানো প্রেমের কথা মনে হওয়া কি অসম্ভব, না অপরাধ? কাল্পনিক যখন এমনি কল্পনার জাল বুনে চলেছেন তখন সুলেখার ক্রন্দনের সত্য কারণটি আবিস্কৃত হল। সুলেখা কাঁদছে দাঁতের ব্যথায়। - কল্পিত সত্যের সঙ্গে বাস্তব সত্যের কত তফাত!]]]


২.

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ, কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক-দাঁত ভাল থাকে। হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এল। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলে শুধু।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষী বউটির ঠিক এই দশা।
বনফুলের “নিমগাছ” গল্পটি পড়তে পড়তে বহুকাল আগে দেখা অর্পণা সেনের সিনেমা, “পরমা” চোখের পাতায় ভেসে উঠল। বলাই থেকে অপর্ণা, বদলায় নি কিছুই, জীবনের কঠিন বাস্তবতার কাছে, সব বিপ্লব কেমন যেনো হার মেনে যায়

Thursday 1 November 2018

মীটু


পৃথিবী জুড়ে ছুটে চলা “মী টু” এর ধাক্কা অবশেষে বাংলাদেশেও লেগেছে। সাহসী কেউ কেউ লিখছেন, তাদের এতো দিনের বয়ে চলা যন্ত্রণার কথা। মেয়ে মাত্রই আমরা জানি, সেসব স্পর্শ, চাহনী, নিপীড়ন, নিগ্রহের কথা। এটা বৈশ্বিক সমস্যা, বাংলাদেশের একার নয়। ছোট সে বয়সে বিশ্ব জুড়ে মেয়েরা, অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেরা এই নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যায় বলেই, এত “এওয়ারনেস” ভিডিও, প্রবন্ধ সমস্ত লেখা হয়, প্রচারণা চালানো হয়। মানুষের মধ্যে বিবেক এবং চেতনা জাগরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ছোটবেলায়, মা ভীষণ পাহারা দিতেন, বকা দিতেন, এদিক গেলি কেন? ও ডাকলেই যেতে হবে, তখন বিরক্ত হতাম, মা এত সন্দেহ করে, পাহারা দেয়, আজ জানি, বিশ্ব জুড়ে মা মাত্রই পাহারা দেয়, সবাই সন্তানের “ওয়েলবিং” নিয়ে কনসার্ণ। বহু বছর আগে এই নিয়ে লিখেছিলাম “সাবধানতাঃ সন্তানের জন্যে”, ফেসবুক ও ব্লগের কল্যানে তখন এই লেখাটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু হায়, এত সাবধানতার পরেও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

প্রতিবার যা হয়, এবারও তাই হচ্ছে, “মী টু” নিয়ে বাংলাদেশে দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে, এক পক্ষ ভিক্টিমদের পাশে আর অন্য পক্ষ ভিক্টিমদের ব্যবচ্ছেদ করছে, তাদের জামা-কাপড়, চাল-চালন, কেনো গেছিলো, এত দিন পরে কেন, এত বছর কোথায় ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ বলছেন, “মী টু” ধরতে গেলে, কারো, বাবা-চাচা-দাদা ও বাদ যাবে না। এই পয়েন্টটাতে অবশ্য আমিও একমত। “মী টু” এই জেনারেশনই থাকা ভাল, বাবা-চাচা-দাদা’দের ধরলে “মী টু-টু দ্যা পাওয়ার টেন” এ চলে যাবে। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি এর সাক্ষী, আমাদের ইতিহাস, যৌতুকের কারণে বউ পুড়িয়ে মারার ইতিহাস, তালাক দেয়ার ইতিহাস, একাধিক বিয়ে করার ইতিহাস, সতীদাহের ইতিহাস। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, কেশব চন্দ্র সেন এরকম হাতের আঙুলে গোনা দু’চার জনকে ছেড়ে দিলে পূর্ব পুরুষদের কারো ইতিহাসই উইম্যান ফ্রেন্ডলি নয়। ধর্মের কাহিনী গুলোও যদি ধরি, সীতার বনবাস, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, দ্রৌপদী’র বস্ত্রহরণ, বিবি মরিয়মের নিগ্রহ, কিংবা বিবি আয়েশা’র (রাঃ) সত্বীত্বের পরীক্ষা কোনটাতেই নারীর গৌরবের কিছু নেই, সবই অবমাননার ইতিহাস।

পয়ত্রিশ বছর আগে পৃথিবীতে “মী টু” কনসেপ্ট ছিলো না। কেউ মুখ খুলতো না। এখনও মুখ খুলে কেউ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। নেদারল্যান্ডসের বেস্ট সেলার লেখক, সাস্কিয়া নোর্ট তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “স্ট্রমবলি”তে তের বছর বয়সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া “মী টু” লিখেছে ২০১৭ সালে। তাতে তার ছেলে তাকে রোজ অপমান করে, মা তাকে ধিক্কার দেয়, কেন লিখতে গেলো এতদিন পরে আবার এসব। পয়ত্রিশ বছর পরে মুখ খুলে যে মানুষটা চরিত্র ব্যবচ্ছেদের সম্মুখীন হচ্ছে দিনরাত, পয়ত্রিশ বছর আগের কথাটা ভাবুন, প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষের বিরুদ্ধে নিতান্ত একজন নাবালিকা যার ধরতে গেলে কোন সহায়-সম্বল কিংবা পরিচয় নেই। বাঘা বাঘা মানুষেরা আজ তাকে যেভাবে পেড়ে ফেলছে তখনকার পরিস্থিতি ভাবুন।

এখন কথা হলো, এত দিন হয়েছে বলে, চির জীবনই একই থাকবে, বদলাতে দেবো না কিছু? বাবা-চাচা-দাদা’রা অন্যায় করেছেন বলে, সব অন্যায় জায়েজ হয়ে যাবে! প্রতিবাদ হবে না? পরিবর্তন চাইবো না? তাহলে আদিম যুগে ন্যাংটো হয়ে থাকা, শিকার করে পশু পুড়িয়ে খাওয়া থেকে, আজ এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ফেসবুকে তর্ক করা কি, পরিবর্তন, বদল না সেই সনাতনতা? “মী টু” বাংলাদেশের জন্যে না, যারা বলছেন, তারা কোন সোশ্যাল প্যারামিটারে সেটা মেপে বলছেন, সেটা অবশ্য জানাননি। আইফোন টেন এক্স, বিএমডব্লু গাড়ি, লিভাইস এর জীন্স, কেভিন ক্লাইন এর টি শার্ট, মাইকেল কোরস এর পার্স সবই বাংলাদেশের জন্যে শুধু সামাজিক কোন পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্যে নয়! মজার তো বটেই। সামাজিক পরিবর্তন বাংলাদেশের বাইরের সারা পৃথিবীর জন্যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের মত বাংলাদেশ যে কোন পরিবর্তনের আওতামুক্ত থাকবে।

আলোচিত “শাজনীন” হত্যা’র ঘটনা হয়ত আমরা অনেকেই ভুলে যাই নি। গুলশানে নিজের বাসায়, নিজের ঘরে খুন হয়েছে শাজনীন। শাজনীন রাত পোশাকেও ছিলো না, বাইরেও যায় নি কাউকে প্রলুব্ধ করতে, যারা মেয়েদের চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করতে ব্যস্ত, দয়া করে জানান, শাজনীন এর “মী টু’ এর ব্যাখা কি হতে পারে? তাসলিমা মুন শেখ তার “পাথরনদী কথন” বইতে লিখেছেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার সময়, পরিচিত এক পরিবারকে রূপাদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়, তাদের মেয়েটির পরীক্ষা, তাদের কোথাও থাকার জায়গা নেই এই কারনে। রূপা’র সাথেই মেয়েটি রাতে শুয়েছে, সেই বিছানায়, আশ্রিত সেই মেয়েটির ভাই, বোনের পাশে শুয়ে থাকা, ঘুমন্ত রূপার গায়ে হাত দেয়। এই “মী টু”র ব্যাখা জানতে চাই। রূপা সালোয়ার-কামিজ পরেই শুয়েছিলো, কোন উত্তেজক রাত পোশাকে নয়। কুঙ থ্যাঙ লিখেছেন, তার পরিচিত বোনটি এপেন্ডিসিটাইস এর অপারেশনে বিছানায় শুয়ে, স্যালাইন হাতে, প্রতি রাতে তাকে ইন্টার্নী ডাক্তারদের হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে হাসপাতালে, সেই অসুস্থ মেয়েটি কি কি পন্থা অবলম্বন করে ইন্টার্নী ডাক্তারদের তার দিকে আমন্ত্রণ করেছিলো কে জানে। “মী টু” এর ব্যবচ্ছেদকারীরা এর ব্যাখা দিতে পারবেন। অজস্র এরকম উদারহণ লিখতে পারবো, কিন্তু দরকার আছে কি? আমরা কি নিজেরাই জানি না, নিজেদের কথা?

“মী টু” এর দরকার আছে কি নেই, সেটা সময় বলে দেবে। এক সময় পৃথিবীর কোন প্রান্তেই মেয়েরা স্কুলে যেতো না, চাকুরী করতো না, দশ চড়ে রা করতো না, কিন্তু প্রয়োজন সব বদলে দেয়। “মী টু” এর চেয়েও শক্ত কোন ঝড় সময়ের প্রয়োজনেই হয়ত তৈরী হবে। আমরা চাই কিবা না চাই। তাই বরং সমস্যাকে ঢেকে না রেখে, চলুন সেটাকে স্বীকার করে নিয়ে, সমাধানের দিকে কিংবা নিদেনপক্ষে পুনরাবৃত্তি রোধের কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সেই দিকে সবাই হাতে হাত ধরে আগাই। কথায় আছে, “সমস্যা চিহ্নিতকরণ” সমাধানের দিকে আগানোর প্রথম পদক্ষেপ।

সবশেষেঃ বাংলা ব্যাকরণ পড়েছিলাম, “যিনি রাজা তিনিই ঋষি” – এই লাইনটির সাথে অবশ্য চলমান “SAD” বিতর্কের কোন সম্পর্ক নেই।


তানবীরা
০১/১১/২০১৮
 



Saturday 13 October 2018

ডিজিটাল বাংলাদেশ

ডিজিটাল বাংলাদেশে কাউকে ইমেইল পাঠালে আবার অন্য মাধ্যমে খবর জানাতে হয়, মেইল করেছি - চেক করো, নইলে মেইল চেক করে না। এখানে ফোনের বিল, অফিসের বেতন, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান, মেয়ের স্কুলের চিঠি, বাস থেকে নেমে গেছি ভুলে চেকাউট না করে কিসের মেইল না আসে। প্রতিদিন কয় বার মেইল চেক করতে হয়!


প্রতিটি অফিসে সরকারী কিংবা বেসরকারী, ফোন করলেই যান্ত্রিক গলায় যেই বার্তাটি বেজে ওঠে সেটি হলো, প্রয়োজনীয় সব তথ্য ওয়েবসাইটে দেয়া আছে, পড়ে নাও, তারপরও যদি না বোঝো তবে মেইল করো, একান্তই যদি কারো সাথে কথা বলতে চাও, তাহলে লাইনে থাকো, তোমার সিরিয়ালের অপেক্ষা করো, টেলিফোন করতে মানুষকে নিরুৎসাহী করতে অনেক সময়ই এই টেলিফোনগুলোতে পয়সা চার্জ করা হয়, পুরো নেদারল্যান্ডসে ল্যান্ড ফোন প্রায় ফ্রী, এমনকি মোবাইলও আনলিমিটেড। পুরো ইউরোপকে জোনে ভাগ করে নিয়ে, এখন ওদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে ইউরোপের মধ্যে আনলিমিটেড টক টাইম দেয়া নিয়ে।


এখানে যদিও যানজট এত প্রকট নয়, তারপরও বিশেষ কোন প্রয়োজন না হলে কোন অফিসে কোন এপয়ন্টমেন্ট দিতে চায় না, যতটুকু সম্ভব ইমেইলের মাধ্যমেই সমাধান করে দিতে চায়। এর অবশ্য আর একটি কারণ, সময় বাঁচানো, খরচ বাঁচানো। অথচ বাংলাদেশে প্রতিটি জিনিস নিয়ে মৌখিক আলোচনা হয়। মেইলের সুবিধা হলো, ভুলে গেলে লেখা আছে, আবার দেখে নেয়া যায়। লিখিত থাকে বলে, কথা ঘোরানোর সুযোগও অনেক কম থাকে। প্রতিটি শহরে যে পরিমান যানজট, মানুষের প্রতি নিয়ত হয়রানী অথচ মেইল এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান দিতে পারে। কিন্তু হায় --- লেখালেখিতে কেউ নেই


বাংলাদেশের প্রায় কোন শপিং মলেই এটিম কার্ডে পে করার সুযোগ নেই। এর বদলে আছে ডেবিট কার্ড, তাতে যত পয়সা চার্জ করা আছে, তার বেশি খরচ করার সুযোগ নেই, যাকে বলে পকেটের টাকার একটা লিমিটেড ভার্সন। কিন্তু ডিজিটালি পুরো ব্যাঙ্ক হাওয়া হয়ে দেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে! আজব কারখানা। দেশে ছিনতাই এর এত প্রকোপ, দিনরাত মানুষ আহত এবং অনেক ক্ষেত্রে নিহতও হচ্ছে, তারচেয়ে ও কষ্টকর বিদেশে’র এই ব্যাঙ্কিং সিস্টেমগুলো’র ইনোভেশান এবং ডেভেলাপমেন্টে বাংলাদেশের অনেক তরুণ/তরুণী প্রশংসনীয় অবদান রাখছে অথচ বাংলাদেশের নাগরিকরা এই সুবিধার কোন ছিটেফোঁটা ও উপভোগ করতে পারলো না! তাদেরকে ময়লা –ছেড়া নোট ঘসতে ঘসতে, গুনে গুনেই জীবন কাবার করতে হবে। দুর্নীতিবাজ দেশের যে তকমা গায়ে সাঁটা আছে তার থেকে বের হতে “ট্রান্সপেরেন্সি” এর প্রয়োজন আর নগদ লেনদেন করে সেটা থেকে কখনও উত্তরণ সম্ভব কি? ডকুমেন্টবিহীন লেনদেন সবসময় ম্যানিপুলেট করা যায় এমনকি পাড়ার কনফেকশনারীতেও


তাই তো বলি, সতের কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, ফেসবুক দিয়েছো কিন্তু ডিজিটাল করোনি।


*** মাল্টিন্যাশনাল, ইউএন, বা পুরোপুরি বিদেশী কনসার্ণে যারা কাজ করেন শুধু তারাই এর ব্যতিক্রম। তারা রোজ মেইল চেক করে এবং জবাবও দেয়। ***


Friday 7 September 2018

পাথরনদী কথন

প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম, শেখ তাসলিমা মুনের লেখা উপন্যাস “পাথরনদী কথন”। যদিও লেখক “মুখবন্ধ”তে বলেছেন, উপন্যাসটি প্রচন্ড একরৈখিক, রুপার কারণে অন্য কোন চরিত্র এটিতে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় নি। বইটি পড়তে যেয়ে রুপার মা শাহানা, ভাই সুমন, বোন শম্পা কিংবা রুপার নানা, রহিমা ফুপু, রুপার নাটক পাগল মুক্তিযোদ্ধা বাবা সবাইকে যেন আমি চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছিলাম। এরা আমাদের খুব চেনা, আমাদের আশেপাশের মানুষ।


আর দশটা এই আমাদের সাধারণ মেয়েদের মত রুপার সংগ্রাম এতটাই বাস্তব, এতটাই তিক্ত, রুঢ়, বইটি পড়তে শুরু করলে কখন এর সাথে মিশে যাবে পাঠক তা নিজেও অনুভব করবে না। একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা অনেক কঠিন হবে। রুপা একাই যথেষ্ঠ বইটি সামনে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কুয়াশা, দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা কিংবা সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান বা বায়োনিক ওম্যান কারো কাছ থেকে রুপা কিছুতেই কম নয়, একটা বই টেনে নিয়ে যাওয়ার মত পুরো ক্ষমতা আর আর্কষন বইটিতে আছে। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে ক্লাশ সিক্স-সেভেনে প্রায় বিয়ে হয়ে হয়ে যাওয়া রুপার ডিভোর্সের পর একা ইংল্যান্ডে মাস্টার্স পড়তে আসার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে লোভনীয় ছোট বেলার প্রেম এসে ডাক দিয়ে গেছে, রুপা’র ভাষায়, “ছেলেটির প্রতি প্রেমের যে আগ্রহ তার জন্মেছিল সেটিকে দমন করার আত্মশক্তিও রুপা অর্জন করেছিলো”।


রুপার সাথে কোথাও আমার দেখা হয়েছিল। তপ্ত গ্রীস্মের এক সবুজ শ্যামল প্রকৃতি পুড়িয়ে দেয়া দুপুরে, ভারী পর্দা টেনে আধো আলো আধো অন্ধকার ঘরে যখন আমরা মুখোমুখি নির্ভেজাল টুকটাক গল্প করছিলাম, রুপা আমাকে বলেছে, ইংল্যান্ডে আসার পরের সংগ্রাম নিয়ে রুপার চতুর্থ বইটি লেখা হচ্ছে এখন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, মেদহীন, বর্ণনার বাহুলতাহীন, ঝরঝরে ভাষায় লেখন পটিয়সী রুপার সেই সংগ্রামের ইতিহাস জানতে। কিছুটা তো আমরা সবাই কম বেশি, জানি। রুপা, অহনা, কিংবা আরও অনেকেই আছে যারা এই বিদেশে নিজের মাটি খুঁজে পেতে অহরহ কত লড়াই চালাচ্ছে, একাকী, ইথারে হয়ত কোথাও তার দাগ থাকবে না কিন্তু তারপরও তারপরও কোথাও কালির আচঁরটুকু অন্তত থাকুক।


পুরো বই জুড়ে মায়ের সাথে রুপার সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে। যুদ্ধে বিধবা দিশেহারা তরুণী মা তিনটি সন্তান নিয়ে তার প্রায় সমস্ত “নিরাশা আর গ্লানি” রুপাকে মেরেই মেটাতে চেয়েছেন। তারপরও রুপা অনেক ভাগ্যবতী, বার বছর বয়সে প্রতিবেশী কাকুর দ্বারা “ধর্ষিতা” হওয়ার পর তার সহায় সম্বলহীন, একাকী মা পিছিয়ে যান নি, লোক লজ্জার ভয় পান নি, মেয়ের সো কলড ভবিষ্যত কি হবে সে ভেবেও পেছোন নি। আনুষ্ঠানিক ভাবে সে পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। সে যুগে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি বিরল ঘটনা। ভাশুরের দ্বারা নির্যাতনের পরেও ডিভোর্সের জন্যে মেয়ের পাশে থেকেছেন। মায়ের মরু সম রুক্ষতা ভুলে যাওয়ার জন্যে হয়ত রুপার কাছে এগুলো ঝর্ণা’র কাজ করবে।


সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত লেখক সাসকিয়া নোর্ট ফোল্কসক্রান্তে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, তের বছর বয়সে প্রতিবেশীর ছেলের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনাটি তিনি এতদিন প্রকাশ করার সাহস পাননি। “মি টু” ক্যাম্পেইনের কারণে এখন যখন তার বইতে এটি তিনি লিখেছেন, প্রায়ই তার নিজের ছেলে কিংবা মায়ের কাছ থেকে এ নিয়ে নানা তির্যক মন্তব্যের শিকার হন তিনি। দেশে বা বিদেশে, কোন পরিবারে, কোন সমাজে মেয়েরা নির্যাতিতা নয়? বৈষম্যের স্বীকার কোথায় হয় না? কোথাও বেশি কোথাও কম। কোথাও খালি চোখে দেখা যায় আর কোথাও দূরবীক্ষণ দিয়ে দেখতে হয়।


লাজুক মুখচোরা কিশোরী রুপার আত্মবিশ্বাসী রুপাতে পরিনত হওয়ার চিত্রও এসেছে খুব নির্ভরযোগ্য ভাবে। নিজেকে লুকাতে লুকাতে আর যখন লুকানোর কোন স্থান রইলো না, তখন ধীরে ধীরে লাজুক রুপা পরিবর্তিত হলো স্বনির্ভর এক তরুনীতে। যার অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, পেছনে কে কি বলছে সেই সংকোচ কাটিয়ে উঠেছে, শুরু করেছে দৃঢ় পায়ের পদক্ষেপ। কিশোর বেলার ভয়কে জয় করা শুরু করেছে তার তারুন্য।


আমি সবসময় আত্মজীবনী, ইতিহাস, বাস্তব থেকে তুলে নেয়া গল্পের প্রতি তীব্র আকর্ষন বোধ করি। বিখ্যাত সব মানুষদের সাজানো গোছানো, খুব পরিনতি পরিকল্পনা করে লেখানো আত্মজীবনী নয়, এরকম আমাদের পাশে থাকা লড়াকু মানুষদের, খুব আটপৌঢ়ে, নিজেকে খুলে বিছিয়ে দেয়া আত্মজীবনী। অনুপ্রাণিত হই, সাহস যোগায় মনে, এত হেরে যাওয়া গল্পের মাঝে কিছু কিছু বিজয়ীরা থাকুক আমাদের মুখ উজ্জল করে।


একশ চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠার পুরো বইটিতে অসংখ্য (বানান) মুদ্রণ প্রমাদ রয়েছে যা একটানা পড়ার সময় খানিকটা বিরক্তির উদ্রেক করে বই কি। রুপা কে রুপো, ওপো, সেগুলোকে সেগল বারবার করে হয়েছে। এটুকু মেনে নিলে, আশাপূর্ণা দেবী’র উপন্যাসের মত ঝরঝরে বাংলায় এই উপন্যাসের মাঝে নিজেদের আশপাশের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যায় ।

Monday 27 August 2018

চন্দ্রমুখী

খুব সম্ভব প্রথম আলোতে রবি’র লেখা একটি ছোট গল্প প্রথমে পড়ি, যতদূর মনে পড়ে তখনও হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে আছেন। চমকে উঠেছিলাম, একদম হুমায়ূন আহমেদের ধারা পুরোই অনুকরণ। সেই গল্পের রিভিউ তে আমি লিখেছিলাম, এই ভদ্রলোক তো হুমায়ূনে আহমেদে’র নায়িকার নামও নিয়ে নিয়েছে। একজন তখন মন্তব্যে জানালো, না, সত্যিই ওর বউয়ের নাম নীতু। তারপর কিছু দিন পরেই রবি’র সাথে আলাপ হলে, আমার স্বভাব মত প্রথম আলাপেই, রবিকে আমি বলেও ছিলাম সে কথা। রবি ব্যাপারটা সহজ ভাবে নেয় নি। না, নামের ব্যাপার নয়, রবি’র অগোচোরে রবি’র সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। আমি বললাম, পত্রিকায় গল্প ছাপা হলে আলোচনা ত হবেই, সব জায়গায় কি আপনি থাকবেন নাকি? তখন থেকেই আমাদের আলোচনা অম্ল-ক্ষারে যায়, কখনই আর মধুর দিকে বাঁক নেয় নি। হুমায়ূন আহমেদ নেই কিন্তু তার যোগ্যউত্তরসূরী রেখে গেছেন – আসিফ এন্তাজ রবি।
এবারের বইমেলায় এসেছে রবি’র লেখা উপন্যাস “চন্দ্রমুখী”। রবি’র ক্লাশমেট গৌতমের পড়া হয়ে গেলে আমাকে উপহার দিয়ে গেছে বইটি। যথারীতি, কড়া জ্বরের সহজ পাচ্য পথ্য হিসেবে এক বসাতেই মেরে দিলাম। গল্পের নায়িকার নাম মুনা, নায়কের নাম ফরিদ আর নায়কের মায়ের নাম ফরিদা। আশাকরি এখানে আর বিশেষ না বললেও চলে। হূমা আহমেদ রবি।
ভালবাসা বিশারদ রবি নিজের অভিজ্ঞতা বেশ জুত করে লিখেছেও,
“ চাকরি হচ্ছে স্ত্রীর মতো আর ব্যবসা নতুন প্রেমিকা। একটায় দায়িত্ব লাগে, আরেকটাতে নিবিষ্ট মনোযোগ।“
মুনা এবং ফরিদের প্রেমেও যথারীতি পাঞ্জাবী ছিলো যার রঙ ফরিদের পছন্দ হয় নি তাই এখানেও মুনাকে পাঞ্জাবী পুড়িয়ে ফেলতে হলো। ফরিদের বাবা আর পুলিশ থানা’র বর্ণনা বলাই বাহুল্য। এরকম হুবহু মিলিয়ে লেখা সহজ কর্ম কিছুতেই নয়।
উপন্যাসের শেষটি আমার ভাল লেগেছে, সত্যি বললে বেশ ভাল লেগেছে। ফরিদকে এমন জায়গায় রাখা হলো যেখান থেকে জীবন মুনার কাছেও যেতে পারে কিংবা অন্য কোথাও। পাঠক যেভাবে চান সেভাবেই উপন্যাসের শেষটি ভেবে নিতে পারে। বাস্তবতার নিরিখেই আমি ভেবে নিয়েছি, ফরিদ সিএনজি খুঁজে পেয়েছে এবং কমিউনিটি সেন্টার পার হয়ে বাড়ি চলে গেছে। পরিশিষ্টটি পড়ে মনে হলো, এসব ভাবাবেগ কেন শুধু বইয়ে থাকে। পুলিশ-ডিবি দিনরাত মানুষ তুলে গুম করে দিচ্ছে, গুম কি শুধু পেশাজীবি অপরাধীরা করে? তারপরও পরিশিষ্টটি আরও একটু বড় হতে পারত। চন্দ্রমুখী বইটিও আরও একটু বড় হতে পারত। এক ঘন্টা বিশ বা ত্রিশ মিনিটে একটা বই পড়া হয়ে গেলে, বই পড়ছি, বই পড়ছি আমেজটা কোথায় যেনো কেটে যায়।
আমাদের বাংলার ম্যাডাম মকবুলা মঞ্জুর, হুমায়ূন আহমদে সম্বন্ধে বলেছিলেন, সহজ কথা গুলো সহজ ভাষায় লেখা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। রবি’কেও তাই বলবো, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা তার পায়েও লুটাক, সহজ ভাষায় আরও সহজ গল্প-উপন্যাস লেখা হোক। পাঠকরা সারাদিনের যন্ত্রণা-বঞ্চনা থেকে রবি’র লেখায় দু দন্ড মুক্তি খুঁজে পাক, কেনো যাবে সবাই সব এত মাথা খাঁটিয়ে কঠিন কঠিন বই পড়তে। যারা নিবিষ্ট পাঠক তারা হাতের কাছে বই পেলেই উলটে পালটে কখনও মাঝ থেকে, কখনও শেষ থেকে পড়তে থাকবে কিন্তু যারা অ-পাঠক, মোবাইল নিয়ে টেপাটেপি জেনারেশান তাদের পাঠক করে তুলতে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন কিংবা আসিফ এন্তাজ রবি’র জুড়ি নেই। বাংলা সাহিত্যে আমি রবি’র উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতি যে এত আর্কষনীয় হতে পারে বইটি হাতে না নিলে আমি জানতেই পেতাম না। পরে অবশ্য জুড়ে দেয়া আছে, লেখক নিজেই নিজের ঢোল পিটিয়েছেন। বইটি না পড়লেও লেখক পরিচিতিটি পড়া অবশ্যই পাঠকদের কর্তব্য। নির্ভুল ছাপায় বইটি পড়তে বেশ আরামদায়ক।

Wednesday 22 August 2018

বিরিয়ানি -- যাত্রা থেকে গন্তব্য


https://arts.bdnews24.com/?p=19189

যদিও বিরিয়ানি এখন আমাদের নিজস্ব খাদ্য হিসেবেই পরিচিত কিন্তু তারপরও কি জানতে ইচ্ছে করে না কিভাবে কখন কোথা থেকে এ খাবারটি আমাদের দেশে এসেছে?

বিরিয়ানি' যাত্রা ইরান থেকে শুরু হয়েছে নিয়ে খুব বেশি সন্দেহের অবকাশ নেই, পার্সিয়ান শব্দ "বিরিয়ান" যার আক্ষরিক মানে রান্নার আগে ভেজে নেওয়া আর পার্সি শব্দ ব্রিনিজ মানে হচ্ছে চাল এ শব্দটি যে বিরিয়ানি নামের উৎস সে ব্যাপারে মোটামুটি সবাই নিশ্চিত। পক্ষের দাবি বিরিয়ানিটা পশ্চিম এশিয়া থেকেই যায় ভারতে এসেছে এটি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করে ইরানে "ডেগ" মানে হাড়ি যাতে মসলা মাখানো মাংস খুব কম জ্বালে বসিয়ে রেখে মাংসের ভেতরের নিজের রসেই এটিকে
সেদ্ধ করা হতো যাকে বলা হতো "দমে" দেয়া আর তার সাথে স্তরে স্তরে দেয়া থাকতো চাল আর সুগন্ধি মশলা বিরিয়ানিতে কমপক্ষে ১৫ ধরনের মসলার ব্যবহার হয় যার মধ্যে কেওড়া পানি, জাফরান, গোলাপ জল কিংবা আতর থাকেই হাড়িতে দেয়ার আগে চাল মৃদ্যু ভাজা হত 

ইতিহাসের পাতায় খাবারের ব্যাপারটা বেশ গুরুত্ব দিয়েই উল্লেখ করা থাকে পনেরশ শতাব্দী থেকে উনিশো শতাব্দী পর্যন্ত মুঘল শাসনামলে ভারতে, পোলাও, কাবাব, বিরিয়ানি ইত্যাদি'র আগমন চর্চা হয় ব্যাপক আকারে নিয়ে একটি গল্পও প্রচলিত আছে, বলা হয় সম্রাট শাহজাহানের বেগম মমতাজ (পনেরশ তিরানব্বই-ষোলশ একত্রিশ) একবার সেনাদের ছাউনি পরিদর্শনে যান এবং সেনাদের দেখে তাঁর মনে হয়েছিলো, সৈন্য'রা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তিনি তখন সৈন্যদের বাবুর্চিকে তাদের জন্যে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে বলেন, সেই থেকেও হয়ত চাল, মাংস, ঘি তে রান্না এই সুস্বাদু খাবারটি' প্রচলন হয়ে থাকতে পারে মুঘলরা সারা বিশ্বে চরম বিলাসি জীবন যাপনের জন্যে বিখ্যাত এই খাবারটি সাধারণত মুঘলদের বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশন হত নিঃসন্দেহে ভারতে এই খাবারটি বিভিন্ন স্বাদে বৈচিত্র্যে  প্রচার প্রসার লাভ করে


তবে বিরিয়ানি মুঘলদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিলো কথাও কিন্তু হলফ করে বলা যায় না অনেকের মতে দক্ষিণ ভারতের মালাবার তীরে প্রচুর আরব বনিক'রা আসতেন বানিজ্যের উদ্দেশ্যে সেটা বহু আগের কথা, ২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তামিল সাহিত্যে উল্লেখ আছে, চাল, মাংস, তেজপাতা, ঘি, সুগন্ধি মশলা, ধনেপাতা, মরিচ, হলুদ দিয়ে  " ওন সরু (Oon Soru)" বলা হতো যে খাবারটিকে সেটি' স্বাদও বিরিয়ানি' কাছাকাছি আরব বনিক'রাও তাদের সৈন্য সামন্তদের এই খাবারটি পরিবেশন করতেন মালাবার এবং মোপলা বিরিয়ানি অনেক সময় মাছ বা চিংড়ি দিয়েও তৈরি হত তবে এটি অনেক বেশি মশলাযুক্ত ছিলো  

আর একটি সূত্র মতে, তুর্কি মঙ্গল তৈমুর তেরশ আটানব্বই খ্রীস্টাব্দে যখন ভারত আসেন, তার সৈন্যদের জন্যে খাবারের জন্যে একটি হাড়িতে চাল, ঘি, মশলা এবং যা মাংস থাকতো সব এক সাথে দমে দেয়া হত, সেটিরই আজকের রুপ বিরিয়ানি

যেকোন সূত্রকেই আমরা মানি না কেন, সেসময়ের সৈন্যদের পুষ্টি রক্ষার খাবার ছিলো বিরিয়ানি! যা আমরা আজকাল অনেকেই  স্বাস্থ্য হানিকর বলে অনেক সময়ই এড়িয়ে যেতে চাই


লক্ষ্ণৌ-এর নিজাম প্যালাসেও বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছিল মারাত্মক নিজাম পরিবার থেকে ও রকমারি বিরিয়ানির আত্মপ্রকাশ ঘটে রকমারি সুস্বাদু বিরিয়ানি রান্না’র জন্যে নিজাম পরিবারের বার্বুচিদের সারা পৃথিবী জুড়ে সুনাম ছড়িয়ে পরে। বিরিয়ানি’র স্বাদ আরও ভালভাবে উপভোগ করার জন্যে তারা সাথে আরও নানা রকম পদের উদ্ভাবন করেন, যেমন, মরিচের তরকারি, ধানশাক, বাহারে বেগুন ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম স্বাদের বিরিয়ানির সাথে অন্যান্য পদ জনপ্রিয় হয়। যেমন বাংলাদেশে বিরিয়ানির সাথে বোরহানি একটি আবশ্যকীয় পদ মাংস এবং সব মশলা দুঘন্টার বেশি পানিতে মৃদ্যু জ্বাল দিয়ে আখনিবানানো হয়। সে আখনি সহযোগে বানানো হয় কম মশলার, হালকা স্বাস্থ্যকর আওয়াধি বিরিয়ানি, যেটাকে অনেক  লক্ষ্ণৌ বিরিয়ানিও বলে। লক্ষ্ণৌ ছাড়াও উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।



আওরংজেব হায়দ্রাবাদের শাসক হিসেবে নিজামে মুলককে নিয়োগ দেয়ার পর থেকে সেখানে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি’র প্রচলন। আজও হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি ভারত জুড়ে এক নম্বর। মাওয়া, বিভিন্ন রকম বাদাম ভাজার সমাহারে বানানো দুধ বিরিয়ানি সেখানে বিখ্যাত। চিংড়ি, বিভিন্ন রকমের মাছ, কাকড়া, হরিন, কোয়েল ইত্যাদি সহযোগে প্রায় পঞ্চাশ রকমের স্বাদের  বিরিয়ানি বানানো হত তার প্রাসাদে। তবে যত বাহারি রকমেরই হোক না কেন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়দম পুখতবিরিয়ানি কাচ্চি বিরিয়ানির ধরনটা এখান থেকেই আসে বলে জানা যায়।



আজমীর শারিফের গরীব নেওয়াজের দরগায় তৈরি রাজস্থানী বিরিয়ানি’র স্বাদের কথা সেখানে মুখে মুখে ফেরে। আঠারশো ছাপ্পান্ন সালে ব্রিটিশরা অযোধ্যা থেকে বের করে দিল নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে। কলকাতায় এলেন তিনি। নিয়ে এলেন পছন্দের খাবার বিরিয়ানি। ক্যালকাটা বিরিয়ানিতে আলু থাকে। আর এ আলুর জন্যই বিরিয়ানির স্বাদ অন্যদের চেয়ে আলাদা। মজার কথা হলো, অর্থনৈতিক মন্দার সময় মাংসের পরিমান কমিয়ে আলু দিয়ে সেটিকে পূরণ করার ধারনা থেকে আলু ব্যবহার করা হলেও, এটি চিরস্থায়ী হয়ে যায়। সিন্ধ-গুজরাট এলাকায় খাওয়া হয় প্রচন্ড ঝাল মশলাযুক্ত সিন্ধি বিরিয়ানি । অন্যান্য বিরিয়ানির তুলনায় এরা খাবারে রঙ ব্যবহার করে খুব পরিমিতি। খাসির মাংস, দই, পেয়াজের বেরেস্তা আর আলু দিয়ে তৈরী হয় মেমোনির সিন্ধি বিরিয়ানি। পেশোয়ারি বিরিয়ানিতে লাল আর সাদা ডাল, কাবুলি চানা, মটরশুটি ইত্যাদি চালের সাথে স্তরে স্তরে দেয়া হয়। সাথে থাকে, জাফরান, কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম আর গোলাপ জল।


ঢাকার নবাবদের বিরিয়ানিও কম সুস্বাদু ছিলো না সেটি'র আগমন হেতু অবশ্য মুঘল রাজপুত্র বলে ইতিহাস উল্লেখ করে তবে ঢাকাই বিরিয়ানির নাম উঠলে অবধারিতভাবে যে নামটি চলে আসবে সবার আগে সেটি হল হাজীর বিরিয়ানী। ১৯৩৯ সালে হাজী গোলাম হোসেন সাহেবের হাত ধরে যাত্রা শুরু হওয়া এই বিরিয়ানির রেসিপির কদর আজও ঢাকা শহরে মানুষের মুখে মুখে। তিন প্রজন্ম ধরে সুনামের ব্যবসা করে আসছেন হাজীর বিরিয়ানির স্বত্বাধিকারীরা এবং বলতে গেলে হাজীর বিরিয়ানির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার বিরিয়ানি শিল্প। চানখাঁর পুলের হাজী নান্নার বিরিয়ানি, ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি, নারিন্দার ঝুনুর বিরিয়ানিসহ আরও অসংখ্য বিরিয়ানি হাউজ গড়ে উঠেছে নতুন ও পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে। শুধু তাই নয় ঢাকাই বিরিয়ানি দেশের সীমা ছাড়িয়ে এখন পেট ও মন ভরাচ্ছে সুদূর প্রবাসে।

পোলাও ও বিরিয়ানি দুটো খাবারই সুগন্ধি চাল ও গোশত দিয়ে রান্না করা হয়। তারপরও এদের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আমাদের দেশে যেটা আমরা পোলাও হিসেবে চিনি সেটাতে গোশত দেওয়া বা না দেওয়া ঐচ্ছিক। তবে পোলাও এর উৎপত্তি সেন্ট্রাল এশিয়ায়। সেখানে পোলাও গোস্তের সাথেই রান্না করা হয়। এমনকি ভারত এবং পাকিস্তানেও অনেকটা এভাবেই পোলাও রান্না করা হয়। মুঘলরা ছিলেন সেন্ট্রাল এশিয়ার মানুষ।


পোলাও এর সংস্কৃতি তারা নিয়ে এসেছিলেন মাতৃভূমি থেকে। তবে পোলাও বিরিয়ানির মূল পার্থক্য যতটা না রান্নার প্রণালীতে তার চেয়েও অনেক বেশি মশলার ব্যবহারে। বিরিয়ানির মশলায় উপাদানের বৈচিত্র্য অনেক বেশি, মশলাও ব্যবহার করা হয় তুলনামূলক বেশি পরিমাণে। এখনও সেন্ট্রাল এশিয়ার উজবেকিস্তান বা তুর্কমেনিস্তানে গেলে দেখা মেলে এখনকার পোলাও এবং বিরিয়ানির আদিরূপের। তবে মজার ব্যাপার হল আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ এত বেশি মশলার ব্যবহারে অভ্যস্ত যে সমরখন্দ বা বুখারার সেই আদিম পোলাও আমাদের কাছে বেশ পানসে ও জৌলুসহীন মনে হয়। অন্তত বাস্তবে যারা দুটোই চেখেছেন তাদের প্রায় সবাই একই কথাই বলেছেন। তবে পোলাও এবং বিরিয়ানির আরেকটি বড় পার্থক্য লুকিয়ে আছে তাদের মৌলিক রন্ধন প্রণালীতে। পোলাও রান্নার আগে চাল ধুয়ে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখা হয় ও পরে পানিতে ফুটিয়ে সেদ্ধ করা হয়। কিন্তু বিরিয়ানিতে চালের সুঘ্রাণ অবিকৃত রাখতে চাল বেশি ধোয়া হয় না



তেহারিকে বিরিয়ানির একটি বিশেষ পরিমার্জিত ধরণ বলা চলে। তেহারীতে গোশতের পরিমাণ থাকে কম। আলু ও হাড় থাকে বেশি। বেশির ভাগ জায়গাতেই ঘি এর পরিবর্তে তেল দিয়ে তেহারী রান্না হয় মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চড়া দামের কারণে খরচ বাঁচাতে এই বৈচিত্র্য আনা হয়েছিল। তবে প্রেক্ষাপট বদলে গেলেও এখনও আবেদন বদলে যায়নি তেহারীর। কাশ্মীরে তেহারী একটি অতি জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড।

বিরিয়ানি মূলত দুই ভাবে রান্না করা হয়। পাক্কি বিরিয়ানি, মাংস আর চাল আলাদা করে রান্না করা হয় তারপর তাদের স্তরে স্তরে মিশিয়ে দমে দেয়া হয়। কাচ্চি বিরিয়ানি, বেশির ভাগই খাসি বা ভেড়ার মাংস দিয়ে রান্না করা হয়, যেখানে মাংস দই আর মশলা দিয়ে মাখিয়ে হাড়ির নীচে রাখা হয়। তারওপর আলু আর চাল দিয়ে মুখটা খুব ভাল করে কাপড় আর আটা মেখে বন্ধ করে দিয়ে কয়লার আঁচে বসানো হয়। ভাপে মাংস, আলু, চাল সব এক সাথে রান্না হয়। 


মুঘল সম্রাট হুমায়ুন যখন রাজ্য হারিয়ে ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তাকে পারস্য সম্রাট লালগালিচার উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। খাবার পরিবেশনে দরবারি রীতিগুলোতে রূপালি পাত্রের খাবারগুলোর জন্য লাল কাপড় আর ধাতব ও চিনামাটির জন্য সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে নিয়ে আসা হতো, যা মুঘলরাও তাদের দরবারে চালু করেন। শুধু তাই নয়, সম্মানিত ব্যক্তি বা আধ্যাত্মিক সাধকদের জন্য ছিল লাল পাগড়ির ব্যবস্থা। মুঘল আমলের রীতি অনুযায়ী খাবার পরিবেশনে লাল কাপড় ব্যবহারের কারণে এখনো বিরিয়ানির হাঁড়িতে লাল কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং বলা যায় আভিজাত্য বা ঐতিহ্য রক্ষার জন্যই বিরিয়ানির হাড়িতে লাল কাপড় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাজার, উরস শরিফে বাঁশের মাথায় লালসালুর পতাকা ঝোলে। হালিমের হাঁড়িতে  লাল কাপড়, পান ও পনিরওয়ালারাও লালসালু ব্যবহার করেন।


বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন রীতি গোষ্ঠীর মানুষের গবেষনা আর মশলার বিভিন্নতায় বিরিয়ানি আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। সাধারণ সৈন্যদের খাবার থেকে রাজ দরবারে। চাল ভেজে তাতে মাংস, মাছ, সব্জি মিশিয়ে খাওয়ার এই পদ্ধতিটি পুরো এশিয়াতেই খুব জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত যেটা আজকে পুরো পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পরেছে। বিভিন্ন দেশের আছে তাদের নিজস্ব পদ্ধতির ফ্রাইড রাইস, নাসি ইত্যাদির ঐতিহ্য। তবে বিরিয়ানির স্বাদের কাছে পৌঁছতে পেরেছে খুব কম কুজিন।


তানবীরা তালুকদার