Thursday 23 April 2020

দ্যা করোনা ডায়রী অফ তাতা ফ্র্যাঙ্ক – ৪ (এপ্রিল)


ষোলই মার্চের পর একুশে এপ্রিল প্রিমিয়ে রুতে আবার টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিলেন। বেশির ভাগ মানুষ যদিও অন্য কথা শুনতে চাইছিলো, কিন্তু তিনি সবার আশায় বাসন মাজা পানি ঢেলে দিয়ে গেলেন। সবাইকে তিনি আবারও এনশিওর করলেন, ভাইরাস সবাইকে আঘাত করবে, কেউ রক্ষা পাবে না। কিন্তু সময় নিতে ও দিতে হবে। হসপিটালগুলো মাত্র রোগী, সরঞ্জাম আর কর্মীদের সামঞ্জস্য ফিরে পেতে শুরু করেছে, কারণ আমরা সবাই বাড়ি আছি। যদি বাড়ি না থাকি তাহলে সামঞ্জস্য নষ্ট হবে, আবার চাপ পরবে যার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে আর সেটা হবে বোকামি। আমাদের এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না যার জন্যে পরে আমরা সবাই আফশোস করি। একজন করোনা রোগী যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, একজন ক্যান্সার পেশেন্টও সমান গুরুত্বপূর্ণ, সবার চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগটুকু রাখতে হবে। করোনার কারণে অন্য অপারেশান, অন্য জরুরী চিকিৎসা যেমন হার্ট, লাংগস এগুলো তো দিনের পর দিন বন্ধ রাখা যাবে না। তাই সবার চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে বাড়ি থাকার বিকল্প এ মুহুর্তে নেই।

প্রিমিয়ে রুতে আর তার বিশেষজ্ঞরা এই ক্রাইসিস পিরিওডকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছে। যার প্রথম ভাগ হলো শিক্ষা। মে ভ্যাকেশান শেষ হলে, এগারোই মে থেকে প্রাইমারি স্কুল শুরু হবে। বিগত মাসের অবজার্ভেশানে দেখা গেছে, বারো বছর পর্যন্ত বাচ্চারা এই ভাইরাসে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। তাদের সোশ্যাল ডিসটেন্স ততোটা না মানলেও চলবে। প্রাইমারি স্কুলের সাথে ডে কেয়ারও খুলে যাবে। তবে নিয়ম হবে, একদিন অর্ধেক বাচ্চা স্কুলে আসবে তারপর দিন বাকি অর্ধেক। যেকোন ধরনের হাঁচি, কাশি, সর্দি, জ্বরে পরিবারের সবাইকে বাড়ি থাকতে হবে। স্কুলের টিচার, ডে-কেয়ারের কর্মীরা সবাই করোনা টেষ্টের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল কর্মীদের মতো অগ্রাধিকার পাবে এবং তাদেরকে প্রায়ই টেষ্ট করানো হবে। আর প্রাইমারি স্কুল যেহেতু বাড়ির পাশেই থাকে, বাচ্চারা হেঁটেই যায় সেক্ষেত্রে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ওপরও কোন চাপ থাকবে না। যেসব বাবা-মায়েরা বাড়িতে থেকে কাজ করছে, ছোট বাচ্চার কারণে কাজে সমস্যা হচ্ছে তাদের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত। স্কুল খোলার রেটের সাথে ডে কেয়ার তার রুটিন ও ক্যাপাসিটি এডজাস্ট করবে। হাইস্কুল বন্ধ থাকবে পহেলা জুন পর্যন্ত। তাদের দেড় মিটার সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকবে, স্কুলকে সে হিসেবে সব এরেঞ্জ/রিএরেঞ্জ করতে হবে।

মেঘ যথারীতি ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই শুরু করলো, আমি কোথাও যেতে চাই, আমি বন্ধুদের সাথে কোথাও যেতে চাই।
আমি বললাম, চলো সাইকেল চালিয়ে আসি, প্রিমিয়ে তো বলেছে, সাইকেল চালাতে বাঁধা নেই।
মেঘ, তোমাকে আমি রোজ দেখছি, তোমার সাথে যাবো না।
আমি বললাম, বাহ! আর আমি যে রোজ তোমাকে রেঁধে খাওয়াচ্ছি তার বেলায়!
জানি তবুও, আমি অন্যদের সাথে কিছু করতে চাই।
তখন বললাম, আমরা যারা বাসায় থেকে “ভাল লাগে না” বলে কমপ্লেইন করি, তাদের আসলে ভাইরাসে না, লজ্জায় মারা যারা উচিত। হসপিটালে কিংবা মেডিক্যাল সেক্টরে যারা দিনরাত কাজ করে কুলাতে পারছে না, তাদের কথা ভাবার কি এখনও আমাদের সময় আসে নি? তাদের ভ্যাকেশান কোথায়? তাদের পরিবার, ছেলেমেয়ে?
প্রিমিয়ে তো বলেছে, সবাই একবার করোনা পাবে, না মানে বেশিও পেতে পারে, তাহলে বাইরে গেলে প্রব্লেম কি?
বললাম, যা, বাইরে যা, যেয়ে ফাইন খেয়ে আয়।

প্রায় বারোশো লোককে নিয়ম ভাঙার দায়ে জরিমানাও করা হয়েছে।

স্কুল মেইল করেছে, পহেলা জুন স্কুল শুরু হলেই সবাইকে স্কুলে যেতে হবে না। যারা পড়াশোনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল, যাদের দরকার বেশি, শুধু তারাই স্কুলে যাবে, বাকিরা অনলাইনে লেসন ফলো করবে। কেউ যদি স্কুলে আসতেই চায় সেটা আলাদা কথা। পনেরই জুন থেকে ফাইন্যাল
এক্সাম হবে, এবার দু’সপ্তাহ ধরে এক্সাম হবে, দেড় মিটার সোস্যাল ডিসট্যান্স মেইনটেইন করে। মানুষ দ্রুত দৌড়াতে চাইলেই হবে না, ন্যাচার হ্যাজ স্লো ডাউন দ্যা প্রসেস।

দুই নম্বরে আছে, স্বাস্থ্য। এখন যেহেতু সবাই বাড়ি আছি, স্বাস্থ্য সচেতন থাকা সবার জন্যেই খুব জরুরী। সবাইকে হাঁটতে, দৌড়াতে, সাইকেল চালাতে বলা হয়েছে, যার যেটা ইচ্ছে তবে একা একা। কারো সাথে নয়। বারো বছর পর্যন্ত বাচ্চারা এক সাথে খেলতে পারবে, টীম করে তাদের খেলা অনুশীলন করতে পারবে তবে কোন টুর্নামেন্ট এরেঞ্জ করা যাবে না শুধুই অনুশীলন। বারো থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত বাচ্চারা দেড় মিটারের দূরত্ব বজায় রেখে টীমে খেলা অনুশীলন করতে পারবে কিন্তু পহেলা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন টুর্নামেন্ট হবে না।

তৃতীয়তে রেখেছে অনুষ্ঠান, পহেলা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আপাতত সব অনুষ্ঠান বন্ধ। পরবর্তী সময়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু ভ্যাকেশান নিয়ে কিছুই বললেন না। সন্ধ্যা সাতটায় প্রিমিয়ে রুতে ভাষণ দেবেন, টিভি ছেড়ে বসে আছি, নানারকম ভ্যাকেশানের এড দেখাচ্ছে, আমি তো ভাবলাম, হয়ত সুদিন সামনে আসছে, নইলে এই দুর্দিনে পয়সা খরচা করে কেন ওরা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেবে। কিসের কি, স্পিকটি নট এবাউট ভ্যাকেশান। পুরা ডাচ ইউনিক কায়দা। খারাপ খবর যত দেরীতে দেয়া যায়, হাউকাউ তত কম হবে। ধরেই নেয়া যায়, ইউরোপ তার বর্ডার বা রিক্রেয়াশান পার্ক ইত্যাদি কিছুই খুলবে না, সো নো “সামার ভ্যাকেশান”। প্রিপেয়ার ইয়োসেলফ ফো “স্টেকেশান”। উইন্টারে কোথাও যাই নি, স্প্রিঙ্গে আর সামারে যাবো বলে, এই শিক্ষা হলো, আর কিছু ফেলে রাখবো না। যখনের ভ্যাকেশান তখনই করে ফেলবো। প্রিমিয়ে আবার বিশে মে টিভিতে আসবে, আগেও হতে পারে যদি উল্লেখযোগ্য কিছু থাকে, পরবর্তী করনীয় জানাতে। মনে হচ্ছে, প্রতি মাসেই একবার আসবে আপডেট নিয়ে।

সুরক্ষিত কোন উপায় পাওয়া না পর্যন্ত সব ধরনের বিউটি, চুল, নখের সেলুন আপাতত বন্ধ। সুরক্ষিত উপায় খুঁজে পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করা হচ্ছে। পাওয়া গেলেই পরবর্তী নির্দেশনা আসবে বলেছে চার নম্বর পয়েন্ট। রেস্টুরেন্ট, বার, থিয়েটার যথারীতি বন্ধ আছে এবং থাকবে। যাদের কালো ইনকাম ছিলো তাদের এখন লাগগায়ি ওয়াট। যতটুকু সরকারকে দিয়েছে ততটুকুই ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারবে, যা কোনদিন দেয় নি তার কোন দাবীও নেই। দাঁতের ডাক্তার বন্ধু বললো, তারা তাদের প্র্যাক্টিস শুরু করবে, নিয়ম এসেছে সরকারের কাছ থেকে, বারবার সবাইকে এপ্রণ এবং আদার এক্সেসারিজ পরিবর্তন করতে হবে, একজন পেসেন্ট এর ট্রিটমেন্ট এর পর পয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, তারপর সারা রুম পরিস্কার করে, মেঝে অব্ধি পরিস্কার করে পরবর্তী পেসেন্টকে ডাকা যাবে, গড সেইভ দ্যা কিং।

আর পাঁচ নম্বরে আবারও বলা হলো, স্টে এট হোম, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, একা বাজারে যাও, একা হাঁটতে বের হও, নিজে সুরক্ষিত থাকো, অন্যকে সুরক্ষিত রাখো। সতের মিলিয়ন মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে, সরকারের পক্ষে একা সম্ভব না। সবাই সহযোগিতা করছে বলেই স্থিতি এসেছে, এখন স্থিতি ধরে রাখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রোজ গড়ে একশো জনের ওপর মারা যাচ্ছে, কোথায় স্থিতি এসেছে বলে বারবার বললো কে জানে।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুনে আমি পার্সোনালি রিলিভড ফীল করেছি। ঘুম থেকে উঠে নীচে এসে ল্যাপি অন করে চা বানাই, ফোন টিপি, নিউজ দেখি, তারপর নাস্তা বানাই, দাঁত ব্রাশ করি, বিছানা গুছাই কি আরামের দিন যাপন। মাঝখানে দু’দিন সকালে অফিস যেতে হলো, ঘুম থেকে উঠেই ব্রাশ করো, জামা কাপড় বদলাও, রেডি হও, সাইকেল বের করো, দরজা লক করো আর করো তাড়াহুড়া দৌড়াদৌড়ি। মানুষ সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়, এই বাড়ি থাকা, রান্নাবান্না, মুভি দেখা এতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি বেশ। নাকি মেয়েরা অনেক বেশি মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় কে জানে। প্রথম প্রথম সপ্তাহান্তের আড্ডা মিস করা বাদ দিলে, আমি স্টে এট হোম মোটামুটি এঞ্জয় করেছি বা করছি বলা চলে, যদিও এঞ্জয় করছি বলা হয়ত এ সময়ে সুন্দর নয়।

সুখ নাই হতভাগা দিল ম্যায় - সুখ থাকে সব রঙিন ফ্লিমে

অনলাইন অর্ডারে উন্নতি হয়েছে, এক থেকে দেড় সপ্তাহের মধ্যেই ডেলিভারী দিচ্ছে। ডাচ আর চায়নীজ সুপার মার্কেট পরিস্কার ট্রলি দিলেও, টার্কিশ, এরাবিয়ান, ইন্ডিয়ান সুপার মার্কেটে এসবের কোন বালাই নেই। অনেকেই ফেবুতে লিখছে, করোনা শেষ হলে প্রথমে কি করবে? আমি জানি প্রথমে কি করবো, হেড না টেল টস করবো, ঢাকা না নিউইয়র্ক? মন আর প্রাণ দুটোই ছুটে গেছে। পরিবারের বাইরে থাকার জন্যে এক বছর অনেক লম্বা সময়।এরপর পরিবারের সান্নিধ্যে মাস্ট।


(ক্রমশ)

Thursday 9 April 2020

দ্যা করোনা ডায়রী অফ তাতা ফ্র্যাঙ্ক ১-৩ (মার্চ)

ফার্স্ট কোয়ার্টার ক্লোজিং শেষ, হাতে এখন অখন্ড অবসর ফেবুকিং করার। না আছে টার্গেট আর না আছে এচিভের কোন তাগাদা। যদিও রেজাল্ট এখনো পাব্লিশ করে নাই, ম্যানেজম্যান্ট কি ম্যানিপুলেট করতেছে, আল্লাহই জানে। রেজাল্টের অবস্থা হলো ঐ কৌতুকের মত, এক বিষয়ে ফেল করলে দুইটা ঘন্টা বাজবে, দুই বিষয়ে ফেইল করলে চারটা ঘন্টা কিন্তু এখন সারা বাড়ি চব্বিশ ঘন্টাই ঘন্টা বাজে। এটা হলো সাধারণ সেক্টরে। ঐদিকে ডেটল, স্যাভলন, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, প্যারাসিটামল, টয়লেট পেপার ইত্যাদি কোম্পানীর সারা বছরের টার্গেট এই প্রথম কোয়ার্টারেই এচিভড। তিন শিফটের জায়গায় হয়ত পাঁচ শিফটে প্রোডাকশন চলছে। ডেটল, স্যাভলন এগুলো ল্যাবে নিয়ে চেক করা দরকার, আমাদের দেশের দুধে পানি মেশানোর মত, তাড়াতাড়ি করার জন্যে এরাও পানি মিশিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে কিনা কে জানে। এদের একাউন্ট ম্যানেজাররা মোটা বোনাস পাবে ফো শিওর। রিসিশনে সবার আগে রিয়েল এস্টেটের দাম পরে, বাড়ির দাম পরবে, পার্টনার নিয়ে এরা হয়ত অলরেডি বাড়ি দেখা শুরু করছে, স্ট্যান্ড ফ্রী বাংলো কিনে ফেলবে এই চান্সে। এদের এখন ঠিক টাইমে প্রোডাক্ট ডেলিভারী হবে কিনা সেই টেমশন।

ঐদিকে নিউজে এসেছে, কনস্ট্রাকশান ম্যাটেরিয়ালের দোকানে যাচ্ছে রমরমা। প্রথম কোয়ার্টারের যা ফোরকাস্ট ছিলো তারচেয়ে আরও পঞ্চাশ ভাগ বেশি এচিভ হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, বাড়ি বসে মানুষ বোরডোম কাটাতে, ফার্নিচারপত্র নতুন রঙ করা, বাড়িঘর মেরামত, সারাই, সাজানো, নতুন কাজ যা যা সামার প্ল্যানিং এ ছিলো কিংবা ছিলো না সব করে নিচ্ছে। প্রিমে রুতে বলেছে, ভ্যাকেশানে যেনো কেউ বাড়ির বাইরে না যায়। তাই ইন্ট্রাটাউন নতুন আইডিয়া এনেছে “স্টেকেশান”, হয়ত অন্য দোকানও এনেছে, সব দেখা হয়নি। নিজের বাগানকে ভ্যাকেশানের জন্যে সাজিয়ে নিয়ে, বাড়িতেই ভ্যাকেশান করার নতুন টার্ম “স্টেকেশান”। করোনা নতুন নতুন অনেক শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। নতুন বিজনেস, নতুন আইডিয়া, নতুন লিভিং স্টাইল ইভলভ করছে।

করোনা উপলক্ষ্যে মানুষের স্টোর করার নেশায়, সুপারমার্কেট কিছু নিয়ম দিয়েছে। পার পার্সান একবারে কুড়িটার বেশি (দু প্যাকেট) ডিম কিনতে পারবে না। টয়লেট পেপার, আরও অন্যান্য জিনিসেও কি জানি এরকম রুলিং। একদিকে করোনার জন্যে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ আবার অন্যদিকে একবারে বেশি বাজার করতে পারবে না। তাজা সব্জি, ফল, দুধ, ডিম, রুটি নিয়ে বেশ সজাগ থাকতে হয়। আমরা রেকর্ড ভঙ্গ করে একখানা বিস্কুটও এক্সর্টা কিনি নাই। নাই। সবাই যেভাবে সারভাইভ করবে আমরাও সেভাবেই করবো। সময়ের সাথে চলবো, এই পন।করোনা উপলক্ষ্যে গেছিলাম প্যারাসিটামল আর হ্যান্ডস্যানিটাইজার কিনতে। দুইটাই সুপারমার্কেটে শেষ, ফার্মেসি থেকে দুইটাকার জিনিস চার টাকায় কিনতে হলো। একদিন সুপারমার্কেটে রুটি ছিলো না, পরের দিন যেয়ে আনতে হলো তবে ইন জেনারেল তাজা ফল আর সব্জির ভ্যারাটাইটিস কমে গেছে, একবার এটা পাওয়া গেলে আর একবার অন্যটা নেই। সাপ্লাই চেইন চাপে আছে, তবে দিন চলে যায়।

এদিকে এখানে প্রতিদিন করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলছে সেই সাথে মৃত্যুর হার। অনেকদিন হলো স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, এখন এই পদ শূন্য। নেদারল্যান্ডস চায়না মেডিক্যাল ইকুইপম্যান্ট রিজেক্ট করেছে, নন কোয়ালিফায়েড বলে দিয়েছে। এনাদার টেমশাম। কারণ চায়না ছাড়া এত দ্রুত এত ভেজাল কোথায় উৎপন্ন হইবে। নেদারল্যান্ডস ইকুইপম্যান্ট কোথা থেকে কিনবে সেটা জানায় নি। কিন্তু ইকুইপম্যান্ট শর্ট আছে সেটা বলেছে। ইকুইপমেন্ট এন্ড মেডিকেশান এর বন্দোবস্ত ঠিক না হলে হয়ত স্টে এট হোম আরও লংগার করে দেবে। পার্কে যাই জগ করতে, মানুষের উপস্থিতি বেশ কম। জগিং, এক্সারসাইজ, কুকুরের অভিভাবক ছাড়া কাউকে তেমন সে সময় বাইরে দেখা যায় না। ঈর্ষনীয় রোদ উঠছে এবার মার্চের শুরু থেকেই, ঠান্ডা থাকলেও চোখের আরাম, মন ভাল থাকে। বছরের প্রথম ভ্যাকেশান পিরিওড শুরু হওয়ার কথা ছিলো, প্রিমে রুতে বলেছে, ইস্টার আর স্প্রিং কোন ভ্যাকেশানেই তিনি চান না, কেউ বাড়ি থেকে বের হোক। নর্থ হল্যান্ডের লোক সাউথ হল্যান্ডে আসুক কিংবা এর উল্টোটা কোনটাই তিনি চান না। রাজার জন্মদিনের অনুষ্ঠান, ইস্টারের অনুষ্ঠান সব বাতিল করা হয়েছে। এদিকে প্রায় সব ভ্যাকেশান এজেন্সিই বলেছে, বুক করা ভ্যাকেশনের টাকা ফেরত দেবে না তবে ছুটি বাতিল হলেও, পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ছুটিতে গেলেই হবে, টাকা তাদের কাছে জমা থাকবে। আমার অবশ্য এই পদ্ধতি ভালোই মনে হয়েছে, সমানে সব ব্যাঙ্ক-ক্রাফট হওয়া কোন কাজের কথা না, টিকে থাকার পলিসি বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

বাসায় থাকি সারাদিন, ঘোরাফেরা নেই। ভাইয়া টেমশমে আছে, আল্লাহ না করুক, তার বোনের হাতে না আবার টাকা জমে যায়। আমি অভয় দিয়ে বললাম, টেমশাম নিও না, এত প্রিমিটিভ চিন্তা করলে হবে? ঘরে বসেই তো টাকা খরচা করা যায়, বাইরে যাওয়ার কি দরকার! আমি সেদিকে ভালোই খেয়াল রাখছি। একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম, যে কয়টা ডাচ ওয়েবসাইটেই কিছু অর্ডার করতে গেছি, সবাই ডেলিভারি ডেট বলছে উনত্রিশে এপ্রিলের পর। সব ওয়েবসাইট দেখি নি তাই সবারটা বলতে পারছি না। প্রিমে আবার “স্টে এট হোম” ডেট এক্সটেন্ড করলে হয়ত ডেলিভারি ডেট ও চেঞ্জ হবে। চেক করে দেখতে হবে পরে। তবে এবার “স্টে এট হোম” ডেট এক্সটেন্ড করার পদ্ধতিতে হয়ত কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, দেখা যাক, অপেক্ষা।

দশই মার্চ শেষ অফিস করেছি, সেদিনই দুপুরে ডাচ সরকার ঘোষনা দেয়ার পর থেকে হোম অফিস। ত্রিশে মার্চ থেকে জগিং শুরু করেছি। এর মধ্যে বের হওয়া বলতে যা বোঝায় তা হয়নি। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বলতে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে খবর পড়া, ফেবু আর হোয়াটসএপ। অবশ্য সেই অর্থে করোনা বাদ দিলেও অফিস ছাড়া বাইরের যোগাযোগ এটুকুই ছিলো অন্তত উইক ডে’তে। সযতনে সব জায়গায় করোনা বিষয়ক খবর বাদ দিতে চাই, তারপরও চোখে পরবেই। অফিস শেষ করে মুভি দেখি, মুভি থেকে আবার অফিস। এক এক সময় মনে হয়, স্ট্রেস ফ্রী আইডিয়াল লাইফ লীড করছি। স্থবির এই জীবনযাত্রায় খানিকটা বৈচিত্র্য আনতে ভার্চুয়াল জগতে অনেকেই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরীতে, খেলতে ব্যস্ত। এক্টিভলি পার্টিসিপেট করি আর না করি, ট্যাগড হতে, সবার ক্রিয়েটিভিটি দেখতে, ছবি দেখতে দারুণ লাগে। সবচেয়ে ভাল লাগে যেটি, যত বড় বিপদই হোক, মানুষ বাঁচতে ভালবাসে, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত “সো মাচ কমিটেড টু লাইফ”।

ম্যানেজার বলছে, একটানা কাজ করছো, একদিন ছুটি নাও। নতুন টেমশাম, করোনা কালের এই "স্টে এট হোম" সিচুয়েশনে ছুটি দিয়া কি করিবো। “স্টে এট হোম” শুরু হলে হোম অফিস থাকলেও স্কুল তারপরও আরও দু’তিন দিন খোলা ছিলো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ঠিকাছে, বিপদ কম হবে। কিন্তু স্কুল বন্ধ হওয়ায় রিয়েলি টেন্সড হয়েছিলাম, সবাই এক সাথে বাসায় দিনের পর দিন, প্যানডেমিক কোথায় না নিয়ে যায়। স্কুল, বন্ধু, আড্ডা ছাড়া, মেয়ে কি রকম রিয়াক্ট করে কে জানে। মেঘের সাথে কনভারসেশানে গেলাম, পজিটিভ সব সাইড দেখালাম, বললাম, এরকম তো সহসা হবে না, "ওয়ান্স ইন আ লাইফ টাইম চান্স, লেটস মেইক প্লেজেন্ট স্টে এট হোম, লেটস মেইক ভেরি বেস্ট অফ ইট”। সবসময় কথায় কাজ হয় না, আমার বিস্ময়ের এপার ওপার করে দিয়ে, এখনও এটি মোর অর লেস ওয়ার্ক করে যাচ্ছে। ছোটখাট দু একটা জিনিস বাদ দিলে। একটা কাগজে কালার পেন দিয়ে লিখে রেখেছি, ট্যাও ক্যাও করলে দেখাই, “প্লেজেন্ট স্টে এট হোম”, সামহাও মেনে যায়।

মেঘের স্কুলে মাঝে মাঝেই এই বয়সী বাচ্চাদের হ্যান্ডেল করার ওপরে প্যারেন্টসদের জন্যে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ এরেঞ্জ করে। মানসিকভাবে বাচ্চারা ভাল না থাকলে ঠিক করে পড়াশোনা করতে পারে না, পারবে না তাই এই ব্যবস্থা। বিভিন্ন প্রফেশনাল সাইকোলজিক্যাল অগার্নাইজেশান থেকে স্পেশালিস্টদের নিয়ে আসে। সবচেয়ে ভাল লাগে অডিয়েন্স থেকে কোয়েশ্চেন এন্ড সিচুয়েশান নিয়ে তারা প্রফেশনাল ড্রামা কোম্পানীর এক্টর এন্ড এক্ট্রেসদের দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সেই সিচুয়েশানকে চার পাঁচ ভাবে এক্সপ্লেইন করে অভিনয়ের মাধ্যমে। কোন সিচুয়েশানে প্যারেন্টস কিভাবে রিয়াক্ট করলে বাচ্চা কিভাবে রিয়াক্ট করবে। সেখানে একসময় উঠে এসেছিলো, নেদারল্যান্ডসে কিশোর-কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতা কেন কমে গেছে, কেনো তাদের সংশোধানাগার বন্ধ করে দিয়েছে? তার কারণ তারা বললেন, “সোশ্যাল মিডিয়া”, বাচ্চারা এখন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, হোয়াটসএপ, ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটে। তাই শপ লিফটিং, স্টকিং এসব এখন প্রায় নেই। হয়ত কিছু সাইবার ক্রাইম আছে কিন্তু সংখ্যায় নগন্য। আমারও তাই মনে হচ্ছে, অফিস, স্কুলের টাইম বাদ দিলে সবাই ব্যস্ত থাকে, নানা পদের খাবার বানানোতে আর যার যার ডিভাইসে, তাতে গৃহ শান্তি বজায় থাকে। পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন খাবারের অভাবে মানুষের মিছিল দেখছি মিডিয়াতে, ঠিক সেই সময় অন্য প্রান্তে আমরা, কিছু করার নেই তাই তিন বেলা নানা ধরনের নতুন নতুন আইটেম বানিয়ে খাচ্ছি। সত্যিই হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র আমাদের এই পৃথিবী আর কি প্যাথেটিক এই জীবন।

রাস্তায় লোক চলাচল বেশ স্বাভাবিক। সামনের জানালা দিয়ে শহরের একটা বড় রাস্তা চোখে পরে সেখানেও গাড়ির ব্যস্ততা আছে। উইক ডে’তে কমবেশি হলেও উইকএন্ডে বেশ ব্যস্তই। করোনা আর না-করোনা সময়ের পার্থক্য ঠিক আলাদা করতে পারলাম না। চমৎকার রোদ বলে বাড়ির পাশের পার্কেও সপ্তাহান্তের কিচিরমিচির টের পাওয়া যায়। আগের মতই আগন্তুকদের গাড়ি পার্কের ভীড় লেগে আছে। প্রতিদিন গড়ে এক লিটার তাজা দুধ খাওয়া, আপেল আর চীজের ওপর বেঁচে থাকা, সাইকেল আর জিম করা ডাচেরা ভেবেছিলো, পৃথিবীর মধ্যে তাদের ইম্যুন সিস্টেম সবচেয়ে ভাল, করোনা তাদের ইম্যুনের কাছে পরাজিত হবে। জরিপে উঠে এসেছে, নব্বই শতাংশ জনসংখ্যা চেয়েছিলো, তাদের করোনা হয়ে যাক, তারা ইম্যুন বিল্ড করে ফেলবে। এখন যে হারে করোনার কাছে ধরাশয়ী হচ্ছে তাতে তো ইম্যুন আইডিয়ার বারোটা। তারপরও ডাচেরা গা করছে না, বাইরে যাচ্ছে হরদম, সোশ্যাল ডিসটেন্স ক্ষেত্র বিশেষে মানছে। প্রিমে ও বলেছে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিই ভরসা। আর আছে বেঈমান ডাচ ওয়েদার, মে মাস পর্যন্ত যেখানে কদাচিত রোদের দেখা মেলে, প্যাঁচপ্যাচে বৃষ্টি আর ঠান্ডাই থাকে এখন মার্চের শুরু থেকে ফাল্গুনের হাওয়া আর রোদ। যেমন করোনা বাড়ছে তেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোদ্দুর। ভাসিয়ে নিচ্ছে চারধার আর ডাচেরাও আছে “ডোন্ট কেয়ার করোনা” মুডে।

করোনায় যখন ইউরোপের প্রায় সব দেশ স্টে এট হোম থেকে, লকডাউন টু কার্ফিউতে গেছে, সে সময় সুইডেন আছে বিন্দাস। তারা নিয়েছে “Herd Immunity” পলিসি। খানিকটা ডারউইনের ইভালুশেয়ান থিয়োরীর মত না, "Survival of the fittest"? সবাই যখন আমরা বাড়িতে ভয়ে অর্ধেক মরে আছি, তখন বন্ধুদের পোস্ট করা ছবিতে দেখছি, এরা বাইরে টেরাসে বসে ড্রিঙ্ক এঞ্জয় করছে!

করোনায় প্রিমে সব ধরনের বিউটি, নেইল, হেয়ার সেলুন বন্ধ রাখতে বলেছেন। চুল বেশ লম্বা হয়েছে। ভেবেছি, যতদিন অফিশিয়াল না হেয়ার সেলুন ওপেন হয়, চুল কাটবো না, বেশ একটা করোনা স্মৃতিচিহ্ন থাকুক। অফকোর্স যদি বেঁচে থাকি আর কি
  
আজ প্রায় ছাব্বিশ দিন পর প্রথম সুপারমার্কেটে গেলাম। সুপারমার্কেটে যেয়ে নিজেকে প্রায় এলিয়েন মনে হচ্ছিলো। কোনদিকে যাবো, কি ধরবো আর ধরবো না বুঝতেই পারছি না। ঢোকার মুখে সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। ক’জন ভেতরে আছে আর ক’জন ঢুকতে পারবে রীতিমত চেক হচ্ছে, মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টে চেক-ইন করছি। সবাইকে বাধ্যতামূলক ট্রলি নিয়ে ঢুকতেই হবে। আগের মত কয়েন দিয়ে ট্রলি নিতে হয় না, কয়েন ছাড়াই ট্রলি দিচ্ছে। দুজন দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ সব ট্রলি স্যানিটাইজার দিয়ে ক্লিন করছে। এই কিপ্টের দেশে যেখানে সব “ডু ইট ইয়োসেলফ” দিয়েছে, ক্যাশিয়ার তুলে দিয়েছে, নিজের শপিং নিজেকে স্ক্যান করে নিজেকে পে করতে হয় সেখানে দুজন মানুষ আলাদা রেখেছে ট্রলি স্যানিটাইজড রাখার জন্যে, খুব অবাক ব্যাপার। সরকার কোন নির্দেশনা দিয়েছে কি না এ নিয়ে সেটা চেক করে দেখা হয় নি। বাজারের ব্যাগ সব তুলে নিয়েছে ক্যাশ থেকে। ছোঁয়াছুঁয়ি এড়ানোর যত রকম ব্যবস্থা নেয়া যায়। সবদিক লাইন এঁকে, ফিতে দিয়ে ডিভাইড করে দিয়েছে। কোনদিক দিয়ে যেতে হবে, কোথা দিয়ে বের হতে হবে, দেড় মিটার ডিসটেন্স রাখতে হবে তার কথাও বারবার বোর্ডে লেখা আছে লাল কালি দিয়ে। চীজ, বিস্কিট, রুটি কিংবা নতুন খাবার যেখানে দেয়া থাকতো টেস্ট করার জন্যে সেসব সব বাসন শুদ্ধ উধাও। আগে বোনাস কার্ড, আলবার্টাইন কার্ড ইত্যাদি ক্যাশিয়াররা পাঞ্চ করতো, এখন মেশিন বাইরে দিয়েছে, নিজে পাঞ্চ করো, ক্যাশিয়াররা ছোঁবে না। ঠিকাছে, ক্যাশিয়ারদের সেইফটি। ক্যাশমেমোও বাইরে বের হবে, যার ইচ্ছে নিজেরটা নিজের হাত দিয়ে নাও, না নিলে না নাও, ক্যাশিয়ারের সাথে হাত ছোঁয়ার কোন ব্যাপার নেই। জামা কাপড়ের দোকানে গেলে দেখা যেতো তারা কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে। ইন্ট্রাটাউনে দেখলাম ঢোকার মুখে তারা হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর টিস্যু রেখেছে, হাত ক্লীন করে ঢোকো আবার বের হয়েও আর একবার হাত ক্লীন করো। সাথে দেয়া আছে, শপিং রুলস, ডিসন্টেন্স, ক্লীনিং, পেয়িং সবকিছুর জন্যে সোশ্যাল সেইফটি রুলস।


আমরা অনেকেই হয়ত ভাবছি, করোনা ওভার হয়ে গেলে আমরা আবার করোনা পূর্ববর্তী জীবন ধারায় ফিরে যাবো। না, সেটা কখনোই আর হবে না। প্যান্ডেমিক করোনা ইউরোপের সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনে যে ধাক্কা রেখেছে সেটার দাগ আর কখনোই মুছবে না। যা একবার পেছনে চলে যায় সেটা স্মৃতিতে থাকে কিন্তু ফিরে আসে না। আমরা আস্তে আস্তে করোনা এফেক্টের সাথে কিংবা তার আফটার এফেক্টের সাথে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলবো। সেটাই তখন আমাদের স্বাভাবিক জীবন হবে। যদি বেঁচে থাকি, “আমরা গল্প করবো, ইউ নো উই ইউজ টু ডু থিংগস লাইক দ্যাট বিফো করোনা, অর উই ইউজড টু লিভ লাইক দ্যাট বিফো করোনা।“ এই যে কেউ হাঁচি দিলে, কিংবা কাশি দিলে তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাই, পার্কে জগ করার সময় খুব পাশ দিয়ে কেউ দৌড়ে গেলে ভয়ে গা শিরশির করে, করোনা নেই তো আবার, ইনফেক্ট করে দিয়ে যায় নি তো, এই সন্দেহ মন থেকে সহসা আমাদের কারোই যাবে না। এই হাত ধোয়া, এই স্যানিটাইজ, এই সুপারমার্কেটের কিংবা দোকানের বদলানো পরিস্থিতি সহসা সব আবার আগের জায়গায় চলে আসবে না। এখান থেকে যাত্রা শুধু সামনের দিকেই যাবে, পেছনে আর ফিরবে না। দেখা যাবে, ম্যালেরিয়া, যক্ষা, প্লেগ রোগের টিকার মত করোনা টিকাও হয়ত একটা সাধারণ জিনিস হয়ে যাবে, বাচ্চা জন্মের পর আর সব টিকার সাথে করোনা টিকাও দেয়া হচ্ছে।


ধার্মিকরা বলছেন, ইশ্বরের শাস্তি, ইশ্বর তার ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ প্রকৃতিকে দিনের পর দিন অনেক মিসইউজ করেছে, প্রকৃতির প্রতিশোধ। খানিকটা সত্যি তো বটেই, যে হারে এবং যে দ্রুত প্রকৃতি তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনছে, নিজেকে হীল করছে, অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মানুষ অন্যান্য জিনিসের সাথে প্রকৃতিরও বড় শত্রু। নিজের আনন্দের জন্যে আমরা ডলফিন, কাকড়া, কচ্ছপের বিচরণ ক্ষেত্র পর্যন্ত দখলে নিয়ে নিয়েছি।  ইউ এস এক্সপার্টদের মতে, দুহাজার একুশের শেষ অব্ধি এই তান্ডব হয়ত চলবে। চলুক, মানুষই পেছনে নামুক, প্রকৃতি রাজত্ব করুক তার আপন রাজ্যে। 










#journey_twentytwenty
০৪/০২/২০২০


Monday 6 April 2020

চন্দ্রনিবাস


চন্দ্রনিবাস

প্রায়ই আক্ষেপ শোনা যায় ফেসবুক জুড়ে, আকাশ খালি করে নক্ষত্রেরা সব ঝরে পরছে, কেউই তো রইলো না, স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, কাকে অনুসরণ করবো। আচ্ছা, সবাই তো আমরা যথেষ্ঠ বড় হয়েছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি না? নিজের মন আর চিন্তা, অনুভূতি যা বলে সেটা অনুসরণ না করে একজন নির্দিষ্টি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, মতবাদকে কেন অনুসরণ করতে হবে?

যাদের লক্ষ লক্ষ অনুসারী, সারা পৃথিবী জুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় যারা, যাদের দর্শন, কাজ, ব্যক্তিত্ব এর মোহে আমরা ভুলি, চলুন তো তাদের জীবনটা একবার দেখি।

বাইবেল মতে দাউদ ৭০০ থেকে ৭০০০ মানুষ হত্যা করেছিলেন। তবু তিনি মহান নবী। শুধু কি তাই? এই নবী তার প্রাণপ্রিয় পুত্র আবাসালুমকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, কারণ- পুত্র বিদ্রোহ করেছিলেন।  মৃত্যুর আগে নিজেই নিজের মন্দির গড়ে রেখে গিয়েছিলেন। যদিও দাউদের মন্দির একসময় শত্রুপক্ষ গুড়িয়ে দেয়, তার স্থাপত্যের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া দায়। দাউদের ছিল সাতজন স্ত্রী। সাতজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি তার এক সেনার স্ত্রী বাতসেবাকে রক্ষিতা হিসেবে গ্রহণ করেন। যদিও পরে তিনি বাতসেবাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন আর বাতসেবার পুত্র সলোমনই হন দাউদ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। 

দাউদপুত্র সলোমনের হারেমে ছিল ৭০০ রাণী আর তিনশ রক্ষিতা (সূত্র: জেরুজালেম ইতিহাস, সলোমন টেম্পল ) বুও তারা নবী, তাদেরকেই অনুসরণ করে যাবে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে।

কলির অবতার বলে যিনি খ্যাত সেই কৃষ্ণের রাধার সাথে প্রেমের কথা কে না জানে? বিদর্ভ রাজ্যের রাজকন্যা রুক্মিনীকে বিয়ে করার পরও তার ১৬০০০ অধিক পত্নী ছিলো। যাদের মধ্যে আটজন খুব উল্লেখ যোগ্য ছিলেন যাদের অষ্টভার্যা নামেও অভিহিত করা হয়। এঁরা হলেন রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দি, মিত্রবৃন্দা, নগ্নাজিতি, ভদ্রা এবং লক্ষণা।

কৃষ্ণ ছিলেন প্রখর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ এবং মহাভারতের যুদ্ধ ও তার পরিণতিতে তাঁর প্রগাঢ় প্রভাব ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন যখন উপলব্ধি করলেন যে যাঁরা তাঁর প্রতিপক্ষ তাঁরা তাঁর আত্মীয়বর্গ এবং অত্যন্ত প্রিয়জন তখন তিনি যুদ্ধের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি সমস্ত আশা ত্যাগ করে তাঁর ধনুক গাণ্ডীব নামিয়ে রাখলেন। তখন অর্জুনের মোহ দূর করার জন্য কৃষ্ণ অর্জুনকে সেই ধর্মযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উপদেশ দেন যা ভগবদ্গীতা নামে খ্যাত এছাড়াও কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা জয়দ্রথকে বধ করতে অর্জুনকে সহায়তা করেন। কৃষ্ণ কৌরবদের সেনাপতি দ্রোণাচার্যের পতনও সম্পন্ন করেছিলেন। কৃষ্ণের নির্দেশে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে গিয়ে চতুরতার সাথে বলেন যে অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন এবং তারপর খুব মৃদুস্বরে বলেন যে সেটি একটি হাতি। কিন্তু যেহেতু যুধিষ্ঠির কখনও মিথ্যাচার করতেন না তাই দ্রোণাচার্য তাঁর প্রথম কথাটি শুনেই মানসিক ভাবে অত্যন্ত আহত হন ও অস্ত্র পরিত্যাগ করেন। এরপর কৃষ্ণের নির্দেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের শিরশ্ছেদ করেন।

কর্ণের সাথে অর্জুনের যুদ্ধের সময় কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যায়। তখন কর্ণ যুদ্ধে বিরত থেকে সেই চাকা মাটি থেকে ওঠানোর চেষ্টা করলে কৃষ্ণ অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দেন যে কৌরবেরা অভিমন্যুকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে যুদ্ধের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাই তিনি নিরস্ত্র কর্ণকে বধ করে অর্জুনকে সেই হত্যার প্রতিশোধ নিতে আদেশ করেন। এরপর যুদ্ধের অন্তিম পর্বে কৌরবপ্রধান দুর্যোধন মাতা গান্ধারীর আশীর্বাদ গ্রহণ করতে যান যাতে তার শরীরের যে অঙ্গসমূহের উপর গান্ধারীর দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হবে তাই ইস্পাতকঠিন হয়ে উঠবে। তখন কৃষ্ণ ছলপূর্বক তার ঊরুদ্বয় কলাপাতা দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেন। এর ফলে গান্ধারীর দৃষ্টি দুর্যোধনের সমস্ত অঙ্গের উপর পড়লেও ঊরুদ্বয় আবৃত থেকে যায়। এরপর যখন দুর্যোধনের সাথে ভীম গদাযুদ্ধে লিপ্ত হন তখন ভীমের আঘাত দুর্যোধনকে কোনভাবে আহত করতে ব্যর্থ হয়। তখন কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম ন্যায় গদাযুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করেন ও তাকে বধ করেন। এইভাবে কৃষ্ণের অতুলনীয় ও অপ্রতিরোধ্য কৌশলের সাহায্যে পাণ্ডবেরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয় করে।

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথম পত্নী খাদিজার মৃত্যুর পর  আরও ১০ জন (মতান্তরে ১২ জন) স্ত্রী গ্রহণ করেন। অর্থাৎ তার স্ত্রীর সংখ্যা সর্বমোট ১১ জন (মতান্তরে ১৩ জন)। এছাড়াও দাসীরা ছিলো। খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, সাওদা বিনতে যামআ, আয়িশা বিনতে আবু বকর, হাফসা বিনতে উমর, যয়নাব বিনতে খুযাইমা, উম্মে সালামা হিন্দ বিনতে আবী উমাইয়্যা, রায়হানা বিনত যায়েদ, যয়নাব বিনতে জাহশ, জুওয়াইরিয়া বিনতে হারিছ ইবনে আবি যারার, রামালাহ বিনতে আবী-সুফিয়ান, সফিয়্যা বিনতে হুওয়াই, মাইমুনা বিনতে হারিছ ইবনে হাযন, মারিয়া আল-কিবতিয়া (ইবনে কায়িম আল-যাওজিয়া সহ আরও বহু সূত্র দাবি করে যে, তিনি মুহাম্মাদের একজন উপপত্নী ছিলেন, অর্থাৎ তিনি মুহাম্মাদের কৃতদাসী ছিলেন কিন্তু স্ত্রী নয়। এর কারণ ইসলামী আইন মুসলিম পুরুষদেরকে দেনমোহর প্রদানকৃত বিবাহিত নিজ স্ত্রী এবং নিজ অধিকৃত দাসীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করার অনুমতি দেয়ায় তিনি দাসী হয়েও মুহাম্মাদের স্ত্রীগণের পাশাপাশি তার পরিবারের সদস্য ছিলেন। ইবনে ইসহাক রচিত মুহাম্মাদের জীবনী হতে সম্পাদিত ইবনে হিশামের সংকলনে তাকে মুহাম্মাদের স্ত্রীগণের তালিকায় উল্লেখ করা হয় নি।)

এ ছাড়াও মুহাম্মদ আর যে সমস্ত নারীকে বিবাহ করেছিলেন, তাঁরা হলেন:

সানা (অথবা সা'বা) বিনতে আসমা বিন আল-সালত;  আল-শানবা বিনতে আমর আল-গিফারিয়া;  ঘাযিয়া বিনতে জাবির; আসমা বিনতে আল-নুমান;  রায়হানা বিনতে আমর বিন খুনাফা, বানু কুরাইজা গোত্র আক্রমণকালে যাকে তিনি হস্তগত করেছিলেন, শারাফ বিনতে খালিফা; আল-আলিয়া বিনতে যাবিয়ান; কুতায়েলা বিনতে কায়েস; ফাতিমা বিনতে শুরাইয়া, আমরা বিনতে ইয়াজিদ ও  লাইলা বিনতে খাতিম।

এ ছাড়াও তাঁর ছিল আরও রক্ষিতা (Concubine):

মারিয়া আল-কিবতিয়া ছাড়াও আরও তিন জন, তাঁরা হলেন: রায়হানা বিনতে যায়েদবিন আল-কুরাইজা, বলা হয় তিনি ছিলেন বানু নাদির গোত্রের; যয়নাব বিনতে জাহাশ-এর দানকৃত এক দাসী ও অন্য একজন যুদ্ধবন্দিনী (যার নাম জানা যায় না)।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার জীবদ্বশায় মোট ২৭টি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর সরাসরি মোট ৯টি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন যে সকল অভিযানে নবীজী স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন সেগুলোকে নবীজীবনী রচয়িতা ও জীবনীবিশারদদের পরিভাষায় বলা হয় গাযওয়া, যেসব যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করেননি, কোন সাহাবীকে দলপতি নির্ধারণ করে অভিযানে পাঠিয়াছেন সেগুলোকে বলা হয়সারিয়্যাবাবা ১. গাযওয়ায়ে বদর ২. গাযওয়ায়ে উহুদ ৩. গাযওয়ায়ে আহযাব ৪. গাযওয়ায়ে বনী কুরাইয়া ৫. গাযওয়ারে বনী মুস্তালিক ৬. গাযওয়ায়ে খাইবার ৭. গাযওয়ায়ে ফাতেহ মক্কা ৮. গাযওয়ায়ে হুনাইন ৯. গাযওয়ায়ে তায়িফআর সারিয়্যা’র সংখ্যা চেতাল্লিশ।  

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সুস্পষ্ট সম্পর্ক ছিলো তিন জন নারীর, তারা হলেন, সৈয়দা খানম, প্রমীলা সেনগুপ্তা, ফজিলাতুন্নেসা জোহা। এছাড়া ঢাকার মেয়ে রানু সোম, ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র, বর্ষবানী পত্রিকার সম্পাদক কোলকাতার মেয়ে জাহানারা বেগম চৌধুরী (মীরা) ও বিখ্যাত শিল্পী কানন বালা দেবীর সাথেও তার প্রেমের গুঞ্জন শোনা গেছে।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদি কাদম্বরী দেবীর সাথে প্রেমের কথা সর্বজন বিদিত। শুধু তিনিই একমাত্র প্রেমিকা ছিলেন? না, দেশে বিদেশে ঠাকুর মশাই এর প্রেম ছিলো। মুম্বাইতে প্রেমে পরেন মারাঠি কন্যা আন্না তড়খড়ের, আর্জেন্টিয়ান প্রেমিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমন্তবালা রায় চৌধুরীর সম্পর্কের কথাও তুলে এনেছেন রবীন্দ্রজীবনী বিষয়ক গবেষকরা। স্ত্রী মৃণালিনীর সমবয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার জন্যও রবীন্দ্রনাথের মন পুড়তএমনটা বলেন অনেকে। নিজের ভাতিজির সাথেও তার অনুরাগ মিশ্রিত চিঠি আদান প্রদান হত। আরও ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত রাণু অধিকারী।

শামসুর রহমান
প্রেম, নারী ও কবিতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ ও শামসুর রাহমানের কথপোকথন :
হুমায়ুন আজাদ : আপনি যে প্রেমের কবিতা লিখছেন এগুলো কি কোনো বাস্তব প্রেরণা থেকে উদ্ভুত হচ্ছে, না কল্পনা থেকে?
শামসুর রাহমান : কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তব।
হুমায়ুন আজাদ : আশা করি আপনার অনেক প্রেমিকা ছিল। এদের মধ্যে কে সবচে অনুপ্রেরণা দিতে পেরেছে আপনাকে?
শামসুর রাহমান : এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয়, আমি সবার কাছেই ঋণী।
হুমায়ুন আজাদ : আপনার প্রেমের কবিতায় আপনি কোন ধরনের আবেগ প্রকাশ করেন? অর্থাৎ হৃদয়ের আবেগের ওপর আপনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, না শারীরিক আবেগের ওপর?
শামসুর রাহমান : দুটোতেই।
হুমায়ুন আজাদ : শরীর কতটা ভূমিকা পালন করে?
শামসুর রাহমান : শরীর তো আছেই, কেননা প্রেম যেখানে আছে, সেখানে শরীর থাকবে, হৃদয়তো শরীরের বাইরের কিছু নয়, ভেতরেরই জিনিস যেমন হীরে থেকে যে দ্যুতি বেরোয় সেটাই হলো আমাদের হৃদয়ের ব্যাপার আর সেই প্রস্তরখণ্ডটি হলো আমাদের শরীর। আমি দেহাতীত প্রেমে বিশ্বাস করি না। তবে শরীরটাই সব নয়। প্রেম শুধু শরীর-নির্ভর নয় এবং শুধু হৃদয়নির্ভরও নয়। দুটির মিশ্রণে প্রেমের জন্ম বলে আমি মনে করি। তবে আমার কবিতায় বিভিন্ন ধরনের আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রিয় লেখকের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ থেকে আমার কিছু ভাল লাগা অংশ তুলে ধরলাম, “সুনীল ছিলো রমনীমোহনমেয়েদের কাছে ভারী প্রিয়এ কথা সবাই জানে। মেয়েরা ওর জীবনে এসেছে। আমি ছাড়াও অন্য নারীর প্রতি সে অনুরক্ত হয়েছে, তা-ও আমি জানি। কিন্তু যদি অন্য কোনো নারীকে ওর ভালো লাগলেও থাকে, ও আমাকে কখনো তার সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। আমি রাগ করেছি, কারো নাম করে প্রশ্ন করেছি ওকে। কিন্তু ও কখনো আমাকে কারো নাম বলেনি। আমি মানুষ, আমারও অভিমান হতো। অনেকভাবে আমি রাগ দেখিয়েছি, ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। আবার এ-ও জেনেছি যে, আমার প্রতি সুনীলের যে ভালোবাসা আছে, বিশ্বাস আছে, আমাদের যে সম্পর্ক আছে, তা নষ্ট হওয়ার নয়। সে ভালোবাসা অনেক কিছুর উপরে।
কবি ও লেখক হিসেবে নারীমহলে সুনীল ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তারপরও ভালবাসা নিয়ে এক ধরনের অতৃপ্ততা ছিল তার মধ্যে। একবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কোন থিমের কবিতা লিখতে পছন্দ করেন?
এর জবাবে তিনি বলেন, “ব্যর্থ প্রেম।
আবার প্রশ্ন করা হয়, জীবন থেকে নেওয়া?
সুনীল বলেন, “হ্যাঁ, সব সময় মনে হচ্ছে ব্যর্থ, সবকিছু ব্যর্থ। একটু ভালবাসা চেয়েছিলুম কেউ দিল না।
লন্ডনের সেই কথার আরও কয়েক বছর পর সানন্দার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যক্তি জীবনের প্রেম ও ভালবাসা নিয়ে সুনীল বলেন, “ওটা (ভালবাসা) পুরোপুরি পাওয়া যায় না। এ কষ্টটা থেকে যাবে। এ ছাড়া আর কী? আর সবই তো পেয়েছি।
শুধু নীরার জন্য : সুনীল লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। তরুণ বয়সে পাশের বাড়ির একটি মেয়েকে ভালবেসে ছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে কিছুতেই তার ভালবাসার কথা বলতে পারছিলেন না। অতঃপর সেই মেয়েটিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেন তিনি। মেয়েটিদের বাসায় দেশপত্রিকা রাখা হতো। সুনীল তার কবিতাটি দেশপত্রিকায় পাঠিয়ে দেন এবং একদিন সেটা ছাপাও হয়। কিন্তু কবিতা ছাপা হলে কী হবে? মেয়েটি তখন কিছুতেই বিশ্বাস করেনি যে, এটি সুনীলের লেখা কবিতা। সে বলত, এ নামের অন্য কেউ কবিতাটি লিখেছে।

নিজের লেখক হওয়ার বিষয়ে সুনীল তার একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি লেখক কিংবা কবি হওয়ার পেছনে ওই মেয়েটির কাছে ঋণী। সে কবিতা পছন্দ করত বলেই আমি কবিতা লিখেছিলাম। সে যদি খেলাধূলা বা অন্যকিছু পছন্দ করত তাহলে আমি হয়ত তা-ই হতে চাইতাম।
তবে এ মেয়েটি-ই নীরাকিনাএ বিষয়ে স্পষ্ট করে কখনো কিছু বলেননি তিনি। তার কবিতার নীরাকে তিনি আড়ালেই রেখেছেন সারাজীবন। নীরা প্রসঙ্গে যতবারই জানতে চাওয়া হয়েছে সুনীল বলেছেন, “কবিতায় যা বলেছি এর বেশী বলতে চাই না। কবিতার মধ্যে যেমন সে আছে, সেভাবেই সে থাক। প্রত্যেক পাঠকেরও নিশ্চই একজন নীরা আছে। কোনো পাঠকের কল্পনায় যদি কোনো নীরা থাকে, তাহলে সে তাকে তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে।
কারো কারো ধারণা, সুনীলের স্ত্রী স্বাতী-ই হয়ত সে-ই নীরা। কিন্তু তিনি নীরা নন। এ প্রসঙ্গে স্বাতী লিখেছেন, “আমি কিন্তু মোটেই নীরানই। সুনীল যে নীললোহিত’, তা যেমন বলা যায়, আমাকে কথনোই নীরাবলা যায় না। নীরা থাক নীরাহয়েই। থাক রহস্যে ঢাকা, থাক সকলের অচেনা।
ঢাকায় একবার সুনীলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, এই যে নীরার প্রতি তার অসীম দুর্বলতা ও নীরাকে নিয়ে তিনি এত কবিতা লিখেছেন, এতে করে নীরার প্রতি তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় কখনো ঈর্ষা বোধ করেন কি না?’
হঠাৎ এ প্রশ্নের জন্য সুনীল আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। একটু থমকে গিয়ে তিনি বলেন, “আরে স্বাতীতো তাকে কখনো দেখেইনি, দেখলে নিশ্চয়ই আপত্তি করত।”— কথাটা বলেই হাসতে লাগলেন সুনীল।
সুনীলের নীরাবিষয়ক সব কবিতা যে শুধু নীরাকে নিয়েই লেখা হয়েছে; ঠিক তা নয়। প্রথম দিকের প্রায় সব কবিতায় হয়ত নীরাই ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে নীরার আদলে আরও অনেকেই তার কবিতায় এসেছেন। এ অভিমত সুনীলের ঘনিষ্ঠজনদের। সুনীল নিজেও এ কথা স্বীকার করেছেন।
সুনীলের স্ত্রী স্বাতীর মতে, “আমার মনে হয়, নীরার মধ্যে অনেক মেয়ে মিশে রয়েছে। আমার কোনো অংশ আছে কি তার মধ্যে? তা-ও জানি না ঠিক করে। আমি কখনো নিজেকে নীরার সঙ্গে মেলাতে চাইনি। তবে বিশ্বাস করতে ভাল লাগত যে, সুনীলের সব প্রেমের কবিতাই আমাকে নিয়ে লেখা। তা অবশ্য মোটেই নয়।
মার্গারিট—— হঠাৎ আলোর ঝলকানি : কিশোর বয়সে অপরিপক্ক প্রেমের অভিজ্ঞতার পর পরিণত বয়সে সুনীল যাকে ভালবেসে ছিলেন তিনি ছিলেন একজন ফরাসী তরুণী। নাম মার্গারিট ম্যাথিউ।মার্গারিটের আগ্রহ ছিল ভারতীয় পুরাণ ও সংস্কৃতিতে। অন্যদিকে সুনীলের গভীর অনুরাগ ছিল ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যে। দুজনে ছিলেন দুজনার পরিপূরক। সুতরাং খুব দ্রুত তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কথনো বা সারাদিন দুজন একই ঘরে গল্প করেছেন, ড্রিঙ্ক করেছেন, খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছেন, এমন কী মাসিক খরচও শেয়ার করেছেন। দুজন এতটাই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন যে, কেউ কাউকে ছাড়া দীর্ঘ সময় থাকতে পারতেন না।
এই সহজ মেলা-মেশার মধ্যে একটা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটল। একদিন সুনীলের বাসায় ড্রিঙ্ক ও কবিতা পাঠের পর এক আবেগীয় মুহূর্তে সুনীল মার্গারিটকে বললেন, “তোমাকে একটা চুমু খাব?”
না, এ ঘটনায় সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়নি। মার্গারিটও বুঝতে পেরেছিলেন সুনীলের মনোভাব। এ ঘটনার কয়েকদিন পর মার্গারিট সুনীলকে বলেন, “আমি আজ গীর্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার সময় অনুমতি চাইব। যদি কোনো সাড়া পাই…”
মার্গারিটের এ কথায় সুনীল জানতে চাইলেন, “কীসের জন্য প্রার্থনা করবে বললে?”
লাজুক কণ্ঠে মার্গারিট তখন বললেন, “তুমি যা চেয়েছিলে…”
পরবর্তীকালে সুনীল মার্গারিটকে চুমু খেয়েছিলেন কি-না সে কথা না লিখলেও এ কথা জানিয়েছেন যে, “মার্গারিটের ভগবান আমার প্রতি সদয় হয়েছেন, যদিও সবটা নয়, একটুখানি।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
লাখো লাখো ভক্তের অংশ গ্রহনে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় রুদ্র মেলা। সেই রুদ্রকে লেখা তসলিমার খোলা চিঠি, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘবছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলীখালার সঙ্গে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন ! তুমি যেদিন বললে তোমার নেলীখালার সঙ্গে তুমি শুয়েওছিলে, আমার ইচ্ছে হয়েছিল আত্মহত্যা করি। আমি কারও সঙ্গে মিশেছি জানলে যদি তোমার কষ্ট হয় তবে তুমি কেন বুঝতে চাইবে না যে আমারও কষ্ট হয় তুমি যখন আমাকে একা রেখে লালবাগ যাও, বাণিয়াশান্তা যাও! শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিল। তুমি শিমুলকে নিয়ে কী কী কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে, আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে- কেমন হয়েছে? তোমাকে ছাড়া আর দুটো পুরুষ ছুঁয়েছি বলে লোকে আমাকে চরিত্রহীন বলে। তুমি যে মালিটোলায়, লালবাগে, টানবাজারে, বাণিশান্তায় এত নারী ছুঁয়েছ তোমাকে কিন্তু কেউ চরিত্রহীন বলে না। মেয়েদের বেলায় যত ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার।

তাই বলছিলাম কি, যাদেরকে আদর্শ মেনে পথ চলার জন্যে সকলে ব্যস্ত, তারা বাস্তবে আপনার চিন্তা আর মূল্যবোধের কতটুকু কাছে, সেটা কখনো ভেবে দেখেছেন কি?

তানবীরা
০৮/০২/২০১৮