Tuesday 28 June 2011

অহনার অজানা যাত্রা (বারো)

অনেকদিন পর কোন একটা বড় অনুষ্ঠানে যাবে, এ নিয়ে অহনা মানসিকভাবে খুব উত্তেজিত। দিদির সাথে কি পড়ে যাবে প্রবাসীতে, কিভাবে সাজবে তা নিয়ে আলোচনা করে সেভাবে সে প্রস্তূত হল। লম্বা প্রতীক্ষার পর এলো সেদিন। অনেক লোকজনে গমগম করা হলে তারা ঢুকল। দেশ ছেড়ে আসার পর এ প্রথম প্রায় দেড়শ বাঙ্গালীর সমাগমে ভর্তি কোন জায়গায় অহনা পা রাখল। সুন্দর শাড়ি, সুবেশী সাজগোজ, চুড়ি গয়নার টুংটাং, হাসি উচ্ছাস এ পরিবেশে মুহূর্তেই মন ভাল হয়ে গেলো তার। অনেকের সাথে টুকটাক আলাপ হল। বাংলাদেশি কোলকাতা দুজায়গার বাঙ্গালীরাই আছেন। তবে কোলকাতার বাঙ্গালীর সংখ্যাই সেখানে বেশি। কিছু বাংলাদেশি পরিবারের সাথে আলাপ হলো। কিন্তু আন্তরিকতা বেশি পেলো কোলকাতার লোকদের কাছ থেকেই। বয়সে কাছাকাছি হওয়ার কারণেও হয়তো বন্ধুত্ব জমে উঠলো তাদের সাথে বেশি। সুন্দর অনুষ্ঠান দেখে, ভালো খাবার পেট পুরে খেয়ে অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে বাড়ি ফিরলো তারা। তার কিছুদিন পর থেকেই প্রবাসীতে পরিচয় হওয়া বন্ধুদের কাছ থেকে নিমন্ত্রন পেতে লাগলো। নিমন্ত্রনের সুবাদে এ শহর ও শহর ঘোরা হতে লাগলো। নতুন মানুষদের সাথে চিন্তা ভাবনার আদান প্রদান হতে অনেক নতুন জিজ্ঞাসা মনে জন্ম নিতে লাগলো তার। বাংলাদেশ ও কোলকাতাকে অনেকেই এপার বাংলা ওপার বাংলা বলেন বটে, কিন্তু মুখের ভাষা হতে আরম্ভ করে আমাদের দৈন্দদিন জীবন ধারণে যে কতোটা অমিল তা প্রকটভাবে অহনার চোখে ধরা পড়তে লাগলো।

যেটা বাংলাদেশে মাছের তরকারি সেটা কোলকাতায় মাছের ঝোল। শুধু নামে নয় রান্নায়ও পার্থক্য আছে। তারা সাধারণত মাছ রান্নায় পেয়াজ, রসুন ব্যবহার করেন না। কালোজিরে, সর্ষে কিংবা পোস্ত তাদের দৈনন্দিন রান্নার উপকরণ। আমরা যেমন সব্জিতে মাছ দিয়ে খাই সেটার প্রচলনও নেই কোলকাতায়। বড়জোর আলু দিয়ে মাছের ঝোল। আমরা যেমন বাদামী চামড়া দেখলেই হাই হ্যালো বলতে এগোই, সেটা তাদের মধ্যে নেই। তারা ভাবেন, আমি আগ বাড়িয়ে গেলে আমি ছোট হয়ে গেলাম। উলটো দিকে তাকিয়ে থাকাই তাদের দস্তুর। যেকোন জিনিস অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করতেও তাদের জুড়ি নেই। চলো পার্টি করি তারপর খরচ সমান শেয়ার করে নেই। এধরনের প্রস্তাব আমাদের বাংলাদেশিদের তরফ থেকে দেয়ার কল্পনাও করা যায় না কিন্তু অবলীলায় তারা বলেন এবং করেন। চলো একসাথে অন্য শহরে যাই, গাড়ির তেল খরচটা দুজনে ভাগাভাগি করে নেবোখন। এগুলো যে খারাপ তা নয় কিন্তু বাংলাদেশি সভ্যতায় টাকা পয়সার এধরনের খোলাখুলি ভাগাভাগির প্রচলন এখনো শুরু হয়নি। অহনার সবচেয়ে যে জিনিসটা পছন্দ হলো, এখানে সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে, তুমি করে বলে। দাদা বৌদি, আপনি আজ্ঞে করার কোন ব্যাপার নেই। বয়স ব্যাপারটা এখানে জরুরী নয়, সবাই সবার বন্ধু। আমাদের বাংলাদেশের সভ্যতা ধরলে বিবাহিত মেয়ে মানে সবাই তাকে ভাবী ডাকছেন। কোন অজানা কারণে পুরুষকে দুলাভাই বলা হয় না, তার স্ট্যাটাস অপরিবর্তিতই থাকে। বাবার বয়সী লোকও ভাবী আপনি বলে কথা বলে যান অনায়সে। আশার কথা পরিবর্তনের ঢেউ এখন বাংলাদেশের দিকেও আসছে। এখন অনেকেই এই দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। মেয়েরাও আজকাল সচেতন হয়েছে এ ব্যাপারে।

কোলকাতার লোকেরা পড়তে ভীষন ভালোবাসে। আমাদের বাংলাদেশি নতুন জেনারেশনের মতো পেপারব্যাক কিংবা হুমায়ূন আহমেদ নয়। জ্ঞান অর্জনের জন্যে পড়াশোনা করা যাকে বলে। যেকোন ব্যাপারে ভাসা ভাসা নয়, আদ্যোপান্ত পড়া তাদের স্বভাব। তবে বাংলাদেশের লোকেরা কোলকাতার গানের শিল্পী, সিনেমা, লেখক, কবি সম্পর্কে অনেক খোঁজ রাখেন, কোলকাতার লোকেরা বাংলাদেশের সম্বন্ধে সে তুলনায় কিছুই জানেন না বলতে গেলে। তাদের বাঙ্গাল মিশ্রিত অবজ্ঞা আছে বাংলাদেশের প্রতি। তারা বাংলাদেশকে জানে তাদের পূর্ব পুরুষদের বর্ননা থেকে আর ভাবে এখনো বাংলাদেশ সেখানেই পরে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে বলা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের নিদারুন তাচ্ছিল্য কাজ করে। তাছাড়া প্রবাসে নানা ক্যাটাগরীর বাংলাদেশি তারা দেখেন, তাদের পোশাক আশাক, চলন বলন দেখে তারা আরো বেশি নাক সিঁটকাতে থাকেন। কৃষ্টি কালচারে বাংলাদেশিদের তাদের সমান সমান ভাবতে তারা চান না কিছুতেই। মুসলমান নামের উচ্চারন যদি তারা ঠিক করে বলেনও, কিছুতেই তারা তা ঠিক বানানে লিখবেন না। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে খটকা থাকা সত্বেও নিদারুন একাকীত্বের কারণে অনেক দ্রুতই তাদের সাথে ভাব হয়ে গেলো অহনার। বন্ধুদের গ্রুপে সে একাই বাংলাদেশি। তাই বন্ধুত্ব হলেও কোথাও একটা ফাঁক ছিলই।

আস্তে আস্তে নতুন বছর বরন করার প্রস্তূতি প্রবাসেও শুরু হলো। উইকএন্ড ছাড়া যেহেতু রিহার্সেল দেয়া সম্ভব হয় না তাই প্রবাসে মোটামুটি ফেব্রুয়ারী থেকেই বর্ষবরন প্রস্তূতি শুরু হয়ে যায়। প্রবাসীতে তখন একটা মোটামুটি নিয়ম ছিল নববর্ষে নৃত্যনাট্য আর শারদীয়া সম্মেলনে নাটক হবে। নৃত্যনাট্যের জন্যে লোক পাওয়া একটু মুশকিল হয়। মেয়েদেরকেই অনেক সময় ছেলে সেজে নাচতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলায় জুতসই নৃত্যনাট্য পাওয়াও ভার। সেবার ঠিক হলো শাপমোচন করা হবে। একদিন কারো বাড়িতে ডিনারের পর আড্ডা হচ্ছিল। কে কোন চরিত্র করবে সেসব ঠিক হচ্ছিল। আচমকা কেউ বলে উঠল অহনাকে, তুমি কিছু করছো না? তুমি করছো না কেন? যারা এতোক্ষণ অহনাকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি তারাও হৈ হৈ করে উঠলো। সে খুবই নার্ভাস গলায় মাথা নেড়ে না না বলে উঠল। আমি পারি না, আমি পারবো না। কবে সেই ক্লাশ থ্রী ফোরে প্রজাপতি প্রজাপতি নেচেছে আজ আর কিছুই মনে নেই তার। অহনাকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে তারা অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো। নাচ করার জন্যে প্রাথমিকভাবে যা যা প্রয়োজন মানে সৌন্দর্য, ফিগার, বয়স সবই আছে তাহলে অসুবিধা কোথায়? অহনার অনমনীয়ভাব দেখে পরে ভাবলো মুসলমান ঘরের মেয়ে কিংবা অর্ন বাধা দিতে পারে এ কারণে হয়তো সে রাজি হচ্ছে না। কেউ একথা অর্নকে জিজ্ঞেস করতেই সে মাথা ঝাকিয়ে জানিয়ে দিল, অহনা করতে চাইলে তার কোন সমস্যা নেই।

একথা শুনে স্তিমিত হয়ে যাওয়া হৈ হৈ আবার চড়ে উঠলো। নিরুপায় অহনা জানালো সে সবার সাথে তাল মিলিয়ে হয়তো নাচতে পারবে না। সে কখনো নাচ শিখেনি, জানে না নাচতে। পার্টিতে এলোমেলো নাচা আর রবীন্দ্র নৃত্যতো এক কথা নয়। তখন একজন উঠে দাড়ালো, রাঙিয়ে দিয়ে যাওগো এবার যাবার আগে গানটি বাজানো হলো স্টিরিওতে আর অহনাকে বলা হলো তাকে অনুসরন করতে। নগদ নগদ পরীক্ষা হয়ে যাক সে পারে কি না। দেখা গেলো দেখে দেখে অহনা ভালোই তুলছে। ব্যস, সাব্যস্ত হয়ে গেলো শাপমোচনের কমলিকার সখীদের চরিত্রের একজন সে। এবার রাজপুত্রের সখাদের পালা। তখন স্ত্রীর নাচের প্রতি অতি উৎসাহের দন্ড হিসেবে অর্নকেও সখাদের চরিত্র দেয়া হলো। প্রত্যেক উইকএন্ডে এর বাড়ি তার বাড়ি ঘুরে ঘুরে রিহার্সেল হতে লাগলো, সাথে আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া। অর্ন আর অহনাকে আড্ডার নেশায় পেয়ে বসলো। সেসাথে সিনেমার ক্যসেট, গানের সিডি, বইয়ের আদান প্রদান ও হতো অনেক। বেশির ভাগ অহনাই নিতো, তারই সর্বগ্রাসী জানার ক্ষুধা, অর্নের এতো সময় নেই। অন্যপক্ষের থেকে বাংলাদেশি লেখকদের বইপত্র কিংবা গানের প্রতি আগ্রহ তেমন ছিল না। এরসাথে একটি ইতিবাচক জিনিস চলে এলো অহনার জীবনে। একাকীত্ব তার আর তেমন খারাপ লাগে না। বই, সিনেমা কিংবা নাচে নিবিষ্টভাবে নিজেকে ঢেলে দেয়ার জন্যে মনে হয় একাকীত্বই বেশি জরুরী। একাকীত্বের সাথে সারা জীবনের সখ্যতার সেই হলো শুরু । আস্তে আস্তে অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে এলো। চুড়ান্ত নার্ভাসনেস আর উত্তেজনা উৎকন্ঠার মধ্যে দিয়ে অহনা তার সখী চরিত্র চরিত্রায়ন করলো। পুরো নৃত্যনাট্যটি ভিডিও করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে সবাই একসাথে বসে ভিডিও দেখলো। অবাক হয়ে অহনা উপলব্ধি করল, তার এই নার্ভাসনেসের কিছুই ভিডিওতে আসেনি বরং সে বেশ ভালোই করেছে। নিজের পার্ফমেন্সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলো সে। অন্যদের কাছ থেকেও অনেক বাহবা পেলো।

অনেকেই তার হাতের মুদ্রা, মুখের এক্সপ্রেশান ইত্যাদির ভূয়সী প্রশংসা করল। তাদের মধ্যে কিছু বিদেশীও ছিলেন। বিদেশিরা মিথ্যে বলছেন না এই বিশ্বাস নিয়ে অহনার প্রথম সাফল্যে বেশ মাথা খারাপ হয়ে গেল। সে একজন বিদেশিনীর পরামর্শ্যে কিছুদিন সালসা নাচের ক্লাশ করল। মনে হলো অর্ন ততোটা আনন্দিত নয় তার সালসা নাচ নিয়ে। সে নিজেও সালসার চেয়ে ক্লাসিক্যাল ভারতীয় নাচের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু যে শহরে অহনা থাকে সেখানে সেধরনের কিছু তখন নেই। তখন আবার কিছুদিন নাচ বাদ দিয়ে বাড়ি বসে থাকলো। তারপর এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেয়ে দক্ষিন ভারতীয় শিক্ষিকার কাছে নিয়মিত ভারত নাট্যম শিখতে লাগলো সে। সপ্তাহে একদিন তিনি অন্যশহর থেকে অহনাদের শহরে আসেন নাচ শেখাতে তাও মাত্র দু ঘন্টা। রোববারে সকাল দশটা থেকে বারোটা। প্রেমিক যেভাবে প্রেমিকার জন্যে অপেক্ষা করে, চাতক যেভাবে পানির অপেক্ষায় থাকে ঠিক সেভাবে অহনা প্রত্যেক রোববারের অপেক্ষায় থাকতো। শেখার আনন্দে সে তখন বিভোর। নাচ আর প্রার্থনা অহনার কাছে তখন সমার্থক হয়ে গেল। মন ভালো কিংবা মন খারাপ যেকোন সময়েই সে তার তাট্টি মাট্টি মুদ্রায় দাঁড়িয়ে নাচের অনুশীলনে হারিয়ে যেতে পারতো। অহনা অল্পদিনেই শিক্ষিকার খুব প্রিয় একজন হয়ে উঠল সাথে কারো কারো চক্ষুশূল। চক্ষুশূল হওয়ার কারণ সেই মুহূর্তে সে ধরতে পারলো না যদিও, সে নাচার আনন্দেই বিভোর ছিল। শিক্ষিকার সাথে যখন সে আলারিপ্পুর তাম ধিতাম তেই তা তেই তাম ধিতাম তেই তা তেই করতো, অন্যজগতে হারিয়ে যেতো। মনে হতো সব দুঃখ, কষ্ট পাওয়া না পাওয়া সব মিথ্যে, শুধু সুন্দরের এই সাধনা, সুন্দরের মাঝে হারিয়ে যাওয়া, সুন্দরকে খুঁজে বেড়ানোর এইক্ষণটিই সত্যি। নাচ তার মনের অস্থিরতা কাটিয়ে এক অনাবিল স্থিরতা যাকে বলে প্রশান্তি এনে দিলো। নাচের কম্পোজিশন ভাবার ব্যস্ততা তাকে অনেক কুটিল জটিল ভাবনা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করতো। অর্নের সাথে লাগাতার ঝগড়ায় কিছুটা বিরাম এলো প্রবাসীর আড্ডা আর নাচের কারণে।

চলবে (অনিবার্য কারণে অহনার সবগুলো পর্ব ব্লগে প্রকাশিত হবে না, অগ্রীম ক্ষমা প্রার্থণা করছি পাঠককূলের সাথে সেজন্য, আপনাদের উৎসাহ আর ভালবাসার কাছে আমি চিরঋনী)

প্রিয় সখিঃ শুধু তোমার উৎসাহে .........শুধু তোমার প্রেরণায়, শুধু তোমার কারণে ...............
মামুন ভাইঃ একজন প্রিয় মানুষ, বন্ধু
ভাই

তানবীরা
২৯.০৬.২০১১

Friday 24 June 2011

কাছের মানুষ

রাসেলের “বাবার পোশাক” লেখাটা পড়ে মনটা খুব বিষন্ন হলো। অনেকদিন এমন মন ভিজিয়ে দেয়া ব্লগ পড়িনি। লেখাটা মাথায় ঘুরছিলো থেকে থেকে। হঠাৎ ইচ্ছে করলো আমার বাবাকে নিয়ে কিছু লিখতে। না, আমার বাবা আমার দূরের কোন মানুষ নন। খুব কাছের মানুষ, বন্ধু। মায়ের হাত থেকে বহুবার বাঁচিয়েছেন বাবা আমায়, বহু আবদার পূরন করেছেন, এখনো করেন হাসিমুখে। বাবার সাথে সারাবেলা খেলেছি এমনকি খেলতে খেলতে রেগে গিয়ে মারামারিও করেছি কখনো কখনো। ক্যারাম, ব্যাডমিন্টন, তাস খেলা সবকিছুর হাতেখড়ি বাবার কাছে। বানিজ্যমেলা, বইমেলার পরিচয় বাবার কাছ থেকে। সত্যজিত – মৃনাল সেন জেনেছি বাবার কাছ থেকে। কিন্তু আজকাল কেমন যেনো একটা নাম না জানা দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। ফোনে কেমন আছেন, কি করছেন জিজ্ঞেস করে, এটা কেনো হলো না, সেটা কেনো হয় না, দু / একটা ঝাড়ি মারার পর আর কথা খুঁজে পাই না। যে জায়গায় মায়ের সাথে, বোনদের সাথে ঘন্টায়ও কথা ফুরায় না, সে জায়গায় পাঁচ মিনিটে বাবার সাথে কথা শেষ। অথচ ইচ্ছে করে বাবার সাথে ঘন্টা ধরে আলাপ করি। সেই আগের মতো। বাবা অনেক রাতে বাড়ি ফিরতেন। মা রাগ করে শুয়ে পড়তেন গেট তালা দিয়ে। আমি বসার ঘরে লাইট জ্বালিয়ে বসে গল্পের বই পড়তাম, এটার মানে ছিল বাবাকে জানানো, আমি আছি।

বাবা এসে আওয়াজ দিলেই আমি দারোয়ানকে ডেকে গেট খুলাতাম। তরকারী গরম করে বুয়া খাবার দিলে আমি বাবার পাশে বসতাম। বাবা খেতে খেতে তার প্লেট থেকে ভালো মাংসের টুকরো, মাছের টুকরো আমার মুখে তুলে দিতেন। আমি গল্পের বইয়ে ডুবে ডুবে সেসব খেতাম আর আগডুম বাগডুম ফালতু গল্প করে যেতাম। এখন অনেক কষ্ট হয়, একবেলা বাবা বাসায় খেতেন, তারও সব আমি খেয়ে নিতাম কাছে বসে। কিন্তু ঘটনা হলো এখনো তাই করি। এখনো বাড়ি গেলে বাবা তার প্লেট থেকে খাবার আমার আর আমার মেয়ের মুখে তুলে দেন, আমরা খেয়ে নেই। আমার মেয়েতো বাবা খেতে বসা মাত্র তার পবিত্র দায়িত্ব মনে করে বাবার পাশে যেয়ে দাড়াবেন আর বাটিতে আঙ্গুল দিয়ে বাবাকে দেখাবেন, এটা নাও, ওটা নাও, মাখো, লেবু দাও তারপর ওনার মুখে তুলে দাও। বাবা পরমানন্দ নিয়ে নাতনীকে খাওয়ান। বাবা হলেন আমার সারা জীবনের হিরো। সেলফমেইড ম্যান। বাবা – চাচাদের ছোট রেখে আমার দাদা মারা গেলেন। সংসারে সবার ছোট হয়েও বাবাই নিজ স্বার্থ ত্যাগ দিয়ে সংসারের দায়িত্ব নিলেন। নিজে ধূপ হয়ে পুড়ে গিয়ে আমাদের সবাইকে গন্ধ বিলালেন। এখনো তার নিজের জন্যে কি চাই জিজ্ঞেস করলে জানেন না, জানবেনই বা কোথা থেকে? আমাদের চাহিদা পূরন করতেই যে তিনি অভ্যস্ত। নিজের দিকে যে তাকাতে হয় তাই শিখেননি। কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে আজকের এই অবস্থায় এসেছেন, সাথে সবাইকে টেনে নিয়ে এসেছেন শুধুমাত্র পরিশ্রম করে। কাহানী একদম ফিলমি হ্যায়। তবে হ্যা, এগুলো সব আমি শুনেছি, দেখিনি কিছুই। আমার জন্মের আগেই বাবা তার ভাইদের নিয়ে এ পৃথিবীতে মাথা গোঁজার ঠাই করে নিতে পেরেছিলেন। তার জীবনের আঁচর তার ছেলেমেয়ের ওপর পড়তে দেননি।

বাবা অনেক ডানপিঠে ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। সেজন্যে নাকি অনেক মার খেতেন। এটা শুনলে বাবার টীচারদের ওপর, দাদা – চাচাদের ওপর রাগ লাগে, কেনো আমার বাবাকে তারা মেরেছেন? তবে তার এই ডানপিঠেপনা বহুদিন চালু ছিল। একবার ঈদের সময় বাবার জাহাজের শিডিউল ছিল। পুলিশ অন্যকারো কাছ থেকে পয়সা খেয়ে শিডিউল পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। বাবা তাতে খুব রেগে গেলেন। তিনি কাগজ দেখালেন, তার শিডিউল, টিকেট বিক্রি হয়েছে তার জাহাজই যাবে। এই নিয়ে রাগারাগির এক মূহুর্তে তিনি পুলিশ অফিসারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে জাহাজের ডেক থেকে পানিতে ফেলে দেন ফেলে দিয়ে ঘাট থেকে যাত্রীসহ জাহাজ ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি চলে যান পরে তার খেয়াল হয় পুলিশ নিশ্চয় এতোক্ষণে সব জায়গায় খবর দিয়ে দিয়েছে, তাকে হয়তো অন্যঘাটে ধরতে পারে। তিনি জাহাজে তার কর্মচারী সবাইকে করণীয় বুঝিয়ে দিয়ে মাঝ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে অন্যদিকে চলে যান। একবার সুন্দরবন থেকে রয়েল বেংগল টাইগারের ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে এসেছিলেন পুষবেন বলে। স্বাধীনতার পর পর যখন সবে তিনি খেটেখুটে তার ব্যবসাকে আলোর মুখ দেখাচ্ছেন, ডাকাতের জ্বালায় নাকি তখন রাতের দিকে জাহাজ চালানো দায় হয়ে পড়ে। তিনি নিজে ছোট আর একটা লঞ্চ রেডি করেছিলেন, জাহাজের পাশে পাশে যেতেন ডাকাত ধরবেন বলে। এগুলোর কিছুই আমার স্মৃতিতে নেই। এ গল্পগুলো আমাদের পরিচিত মহলে বাবাকে নিয়ে এতোবার আলোচিত হত যে শুনে শুনেই আমি জানি, মনে হয় আমি যেন দেখেছি সব।

পুরুষেরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না এই অভিজ্ঞতাও বাবাই আমাকে প্রথম দিয়েছেন। তিনি জীবনেও কথা রাখার উদ্দেশ্যে কথা দিতেন না। মায়ের সাথে তার নিত্য ঝগড়া ছিল এই নিয়ে। পরে আমার সাথেও একই দাঁড়ায়। মাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা দিয়ে তিনি পগার পাড় থাকতেন। পরে আমার সাথেও তাই। শিশু পার্ক কিংবা ঈদের কাপড় কিনতে নিয়ে যাবেন। এই আসছি এইতো, বারোটার মধ্যে ফিরছি। দুপুর বারোটা থেকে তিনটে তারপর ইফতারের সময় পার হয়ে যেতো। কোন খবর নেই। আমি কেঁদেকেটে না খেয়ে ঘুম। তিনি বাড়ি এসে ঘুম থেকে তুলে তেল মেখে মেখে আমাকে খাওয়াতেন। একটার বদলে আমার কান্নার হেঁচকির তোড় অনুযায়ী দশটা জামার প্রমিস করতেন সংসার আর সন্তানদের সময় দিতে না পারাটা তিনি পয়সা দিয়ে অনেক সময় পূরন করে দেয়ার চেষ্টা করতেন। ছোট ছোট অনেক অনেক দোষ থাকা সত্বেও আমার বাবা আমার পৃথিবীতে থাকা মানুষদের মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। যার পৃথিবী আমাদেরকে কেন্দ্র করে শুরু হয়, আমাদের মধ্যেই শেষ হয়। আমরা ছাড়া তার আর কোন জীবন কোনদিন ছিল কি না কিংবা আছে কি না জানতেই পারিনি।

জীবনে এতো জায়গায় ঘুরতে গেছি, বন্ধুদের সাথে গেছি, স্বামীর সাথে গেছি কিন্তু বাবার সাথে বেড়িয়ে যে আনন্দ সেটা কখনো অন্যকারো সাথে পাইনি। যে নিশ্চিন্ততা, নির্ভরতা বাবা দেন তা পৃথিবীর আর কেউ দিতে পারেনি। নিজেকেও নিজে দিতে পারিনি। কি খেতে ইচ্ছে করে, শুধু মুখ দিয়ে বের করার দেরী, সীজন থাকুক আর না থাকুক, ঢাকা, কুমিল্লা, খুলনা যেখান থেকেই হোক, বাবা ঠিক কোথাও না কোথাও থেকে ম্যানেজ করে নিয়ে আসবেন। বাবার সাথে দাদুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া কিংবা কাপ্তাই লেক, চিটাগাং, কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার যা আনন্দ তা চাঁদের দেশে বেড়াতে যেয়েও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। নৌকায় চড়ে জ্যোস্না রাতে নদীতে এলোমেলো ঘোরানিশ্চুপ গ্রাম, এখানে ওখানে কোন ঘরে টিমটিম হারিকেনের আলো জ্বলছে আর চারধার শুনশান। থেকে থেকে কোথাও থেকে নাম না কিছু ডেকে উঠতো। কি একটা শান্তি চারধারে মাখানো, পাশে বাবা বসে মানে ভয়ের কিছু নেই। মনে হতো জীবন এখানেই শেষ হয়ে যায় না কেন। বাবার হাত ধরে ভুবনেশ্বর পাহাড়ে চড়ে যে আনন্দ পেয়েছি সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ের সৌন্দর্য তার কাছে অনেক ম্লান।

অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে বাবা আজ অনেকটা পথ এসেছেন। বাবা বোধহয় খানিকটা ক্লান্তও। দুপুরে বাড়ি ফিরেন প্রায়ই, ঢাকা কোলকাতা চ্যানেলের যতো ম্যাটিনি শো আছে সব দেখে ফেলেন, দুপুরে ঘুমাবেন না বলে। আমি পাশে বসি যেয়ে, জিজ্ঞেস করি, আব্বু কি সিনেমা দেখছেন? ঠোঁট উলটে হাসেন। কি দেখছেন নিজেও জানেন না। এক সময় সিনেমা পাগল বাবা এখন টিভির সামনে বসে থাকেন শুধু। হয়তো টিভিতে চোখ রেখে নিজে কোথাও হারিয়ে যান। বসে বসে হয়তো জীবনের হিসাব মিলান। একজন মানুষের সমাজে অনেক পরিচয় থাকে, অনেক মূল্যায়ন থাকে। একজন মানুষ কারো ভাই, কারো ছেলে, কারো বন্ধু, কারো স্বামী। সব ক্ষেত্রে তার সফলতা ব্যর্থতা মূল্যায়ন করা হয় আলাদাভাবে। কিন্তু আমি জানি বাবা হিসেবে আমার বাবা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার কোন তুলনা হয় না। বাবা শুধু বাবা হয়।

তানবীরা
২৫.০৬.২০১১

Saturday 11 June 2011

আকাশ থেকে ফেলছে ছায়া মেঘের ভেসে যাওয়া

একাগ্র চিত্তে তিতলি ডুবে গেলো নিজের মধ্যে। লাষ্ট সেমিষ্টারে নিজের রেজাল্ট দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলো। রেজাল্ট ভালো হওয়াতে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়ে গেলো। মন্দ লাগে না পড়াশোনা করতে বরং বেশ ভালো সময় কেটে যায় তার পড়ার মধ্যে ডুবে থেকে। মাঝে মাঝে এক মনে ইজেলে তুলি ঘষতে থাকে। নানা রঙ এক সাথে মিলিয়ে নিজে একটা আলাদা রঙ তৈরি করে। কল্পনা তার সীমাহীন বিস্তৃত। একদিন ভাবল আকাশটাকে লেমন ইয়েলো করে দিলে কেমন হয়? আকাশকে সবসময় আকাশি রঙের হতে হবে কেন? লেমন ইয়েলো আকাশ একে তার নীচে পিঠ ভর্তি খোলা চুলের ম্যাজেন্টা শাড়ি পড়া এক মেয়ে আঁকলো। বড় বড় চোখের কাজল পড়া সেই মেয়ে হাতে হালকা বেগুনী রঙের ছাতা ধরে রেখে ছাই রঙা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। নিজের সৃষ্টির প্রতি নিজেই অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। আর কি করবে? মোবাইল নিয়ে মুখে খই ফুটিয়ে যা মনে আসে তা বকার মতো এখন আর তার কেউ নেইকখন আকাশে মেঘ ভাসে, কখন রিমঝিম রিমঝিম ছন্দ তুলে বৃষ্টি উথলে কেঁদে পড়ে মাটির খরতাপ শুষে নিয়ে যায় তিতলি জানে না আজকাল আর সেসব। জানলেও এক মুহুর্তের জন্য তার উদাস হতেই মনের বলগা সে চেপে ধরে। না কারো কথা ভাববে না, দুর্বল হওয়া চলবে না তার আর। পিছনে আর না তাকাবে সে শুধু নিরন্তর তার আজ সামনে তাকানো।

বন্ধুদের সাথে প্রচুর হই হই করতে লাগলো। সিনেমা, পিজা, লাইব্রেরী, পিকনিক, আড্ডা সবকিছুতেই যায় আজকাল তিতলি। বরং একা হতেই তার ভয় লাগে। প্রথমে অনেকদিনের অনভ্যাসের আড়ষ্টতা থাকলেও একসময় তার এই হৈহুল্লোড় ভালোও লাগতে লাগল। মনে হতে লাগলো জীবনটা কোথাও আটকে গেছিল তার। তারচেয়ে এই বাঁধনহীনতাই ভালো। এক একবার হালকা লাগে নিজেকে। মুক্ত বিহংগ হয়ে আকাশে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। শিকল কেঁটে গেছে সে আনন্দে বিভোর হতে চায়। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছিল ধীরে ধীরে। নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রন বাড়ছিল। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন ফিরে পেয়ে তিতলির ভাল লাগছিল। কিন্তু ঠিক তার পরের মূহুর্তেই জীবনের সব চাইতে প্রিয় জিনিসটা হারিয়ে ফেলার কষ্টে সে কাতর হয়ে পড়ে। সব কিছু তার শূন্য আর ফাঁকা মনে হতে লাগে। রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, ঘুম আসে না তার চোখে, তখন কেঁদে কেঁদে মনের ভারটা একটু কমিয়ে নেয়। সবকিছু কি আসলেই কখনো হারায়? তাহলে কেন রোজ তিতলি ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে মোবাইলটা চেক করে? জানে কোন ম্যাসেজ কেউ পাঠাবে না তারপরেও অভ্যাসবশত প্রথমেই মোবাইল চেক দিয়ে তার দিন শুরু হয়। শুধু অভ্যাসে করে সেটাও সত্যি নয়। মনে একটা ক্ষীণ আশা উঁকি দিয়ে যায় রোজ ভোরে, হয়তো তার সায়ান তার কাছে ফিরে এসেছে। কিন্তু এসএমএস না দেখে আগের মতো বুক ভাঙ্গা কষ্ট তার আজকাল আর হয় না। রুটিনে ডুবিয়ে দেয় সে নিজেকে। কখনো চোখটা নরম হয়ে এলে হাতের উলটো পিঠে চোখটা মুছে নেয় সে। ভালোবাসা ভুলবে কেনো সে? ভালবাসা ভোলা বা মোছা কোনটাই যায় না। ভুলে গেছি ভাব করা যায়।

মন খারাপ করা বিষন্ন সন্ধ্যায় একা একা ছাঁদে সে হাঁটে। টবে লাগানো দোলনচাঁপা আর বেলির গন্ধে মন আকুল হতে থাকে প্রিয়জনের জন্যে। সায়ানের স্পর্শ পাওয়ার জন্যে কিংবা গলা শোনার জন্য হু হু কাঁদতে কাঁদতে তিতলি ভাবে, কি করে মানুষ বদলে যায়? এই আকাশ, এই মেঘ, এই ফুল, এই বৃষ্টি সবতো একই আছে। এক সময় সায়ানের প্রতিজ্ঞা ছিল, যত যাই হোক, তিতলির গলা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অন্তত একবার তাকে শুনতেই হবে। সায়ান তার গলা না শুনে চব্বিশ ঘন্টা পার হতে দিবে না। অভিমান হলে তিতলি যদি তার ম্যাসেঞ্জার কিংবা মোবাইল বন্ধ করে রাখতো তাহলে সায়ান বার বার বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন করতে থাকতো। বাসার সবাই বিরক্ত হতো কে বার বার ফোন করে কিন্তু কথা বলে না। তিতলিকে তখন বাধ্য হয়েই সায়ানের কাছে ফিরতে হতো। কতো সময় হয়তো একঘন্টা কথা বলে ফোন ছেড়েছে তিতলি আবার আধ ঘন্টা পরেই সায়ানের ফোন। মিস করছে থাকতে পারছে না ওর গলা না শুনে। দিনে দশবার ওর গলা শুনতে হতো। এখন কতো চব্বিশ ঘন্টা কেটে যায় সায়ান তার তিতলির সাথে কথা বলে না। কি করে পারে তার গলা না শুনে থাকতে? ক'দিন দেখা নাহলে পাগল হয়ে যেতো দুজনেই। একবার তিতলি ধুম জ্বরে পড়ল। মাথা তুলতে পারে না আর বাইরে যাবে কী। একদিন সন্ধ্যায় বাবার সাথে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে বাড়িতে ঢুকতে যেই যাবে তার অবচেতন মনটা আচমকা কেমন যেনো দুলে উঠল। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল ল্যাম্পপোষ্টের নীচে কিসের যেন ছায়া নড়ছে। তিতলির মন জেনে গেল কিসের সেই ছায়া। তার হৃদয়ে হাজার তারের বীনার ঝংকার উঠলো। সেই খুশিতে না ওষুধে তার সে রাতেই জ্বর নেমে গেলে, বাড়ির সবার বাঁধা অতিক্রম করে পরদিনই সে জরুরী ক্লাশের বাহানা করে পড়িমড়ি ইউনিতে ছুটে ছিলো। কতোটুকু বদলায় এক জীবনে একজন? তবুও মনকে প্রবোধ দেয় কাটবে যদি দিন এমন করে তবে কাটুক না।

একদিন রাতে সে অবাক হয়ে দেখল ম্যাসেঞ্জারে সায়ান সবুজ নক্ষত্র হয়ে জ্বলে আছে। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। চুপচাপ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো প্রিয় সে নামটির দিকে। তারপর কোন ক্ষুদ্রতাকে মনে স্থান না দিয়ে সায়ানকে নক করলো সে নিজে থেকেই। কিরে কেমন আছিস? শুরু হলো টুকটুক করে কথা। বেশির ভাগই সায়ানের খোঁজ নিল। কতোদিন বাদে জানতে পারছে কেমন ছিল সায়ান আর কেমন আছে এখন। কে বলবে এর মাঝে পাঁচ মাস কেটে গেছে। মনে হচ্ছিল কোনদিন কোন বিচ্ছেদ বুঝি দুজনের মাঝে ছিল না। সায়ানের দুঃখে তার চোখে পানি এসে গেলো। ফেসবুকে দেখা সেই স্বর্নকেশির সাথে সায়ানের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। স্বর্নকেশি নিজেই সায়ানকে ছেড়ে চলে গেছে। সে সায়ানের মধ্যে নাকি তার স্বপ্নপুরুষকে খুঁজে পায়নি। বলেছে, ইট ইজ গোয়িং বাট নট থ্রিলিং ইনাফ টু লিভ উইথ ইউ। স্বর্নকেশির মতে সায়ান অনেক বেশি গৃহি, ঠিক সেরকম রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ নয় যাকে সে খুঁজছে। ও আরো বেশি ম্যানলি, এম্ববিশ্যাস আরো দুর্ধষ কাউকে চায়। প্রত্যাখানের কষ্টে সায়ান এখন বেশ মন মরা। মায়া লাগতে লাগলো তিতলির, বুকটা মুচরে উঠলো তার প্রিয় বন্ধুর কষ্টে। সে সায়ানকে চিয়ারআপ করতে চাইলো নানাভাবে। একজন প্রকৃত বন্ধুর মতো হাত ধরে রইল তার। ভালোবাসে সেতো মিথ্যে নয়।

আজকাল প্রায়ই ওদের দুজনের কথা হয়। টুকটুক দুই জানালায় দুজনের ভাবের আদান প্রদান চলতে থাকে। অস্বীকার করবে না তিতলি মনের কোথাও একটা জ্বলুনি আছে তার। প্রত্যাখানের কষ্ট, অবজ্ঞার জ্বালা তাকে পোড়ায়। তার ভালবাসাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে গেছিল এই পুরুষ, তার সেই একা থাকার কষ্ট, সেই নিংসংগতা, সেকি ভোলার? কিন্তু তিতলি নিজের কষ্টের ওপর ছাই চাপা দিয়ে রাখলো। কিছুতেই সায়ানের কাছে নিজেকে ছোট করবে না সে। বন্ধুর দায়িত্ব পালনে সে ব্যর্থ হবে না, দুর্দিনেইতো লোকের বন্ধুর দরকার সবচেয়ে বেশি। আজকাল সায়ান আবার আগের মতো তিতলিকে মেইল করতে লাগলো। পরীক্ষার রুটিন, রেজাল্ট, কি রান্না করলো নতুন সব জানাতে লাগলো। মেইল বক্সে সায়ানের নাম দেখলেই চোখ নরম হয়ে যায়। কতো দিন রাত ঘন্টা প্রহর কেটেছে তার এই মেইল বক্সের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। দুটো লাইনের জন্যে কতো তড়পেছে তার ভিতরটুকু। কতোদিন জ্বরতপ্ত মাথায় পিসি খুলে ঠায় বসে ছিল সে চোখের পলক না ফেলে, আসবে চিঠি আসবে সেই আশায়। অসহ্য যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে পুরনো মেইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখে, বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়েছে সে। জ্বরের ঘোরেও তারই নাম জপেছে। সেসব মুহূর্ত তার কিভাবে কেটেছে, জানে কি সায়ান নাকি চাইবে কোনদিন জানতে? সেইতো এলো চিঠি কিন্তু বড্ড দেরী হলো তার কাছে পৌঁছতে।

সেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অবাক তিতলি। সারাদিন যেনো তিতলির ভালো যায় সেই উইশ রেখে এসএমএস করেছে সায়ান তাকে। কতোদিন পর!! চোখ পানিতে এভাবে ভরে গেলো ম্যাসেজটাই ঠিক করে পড়তে পারছিল না সে, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল বার বার সবকিছু। আজকাল ম্যাসেঞ্জারে কথা হলেও সায়ান অন্যরকম করে কথা বলে। ফোনেও আবেগে ভরা থাকে সায়ানের গলা। কিন্তু আজ যখন তিতলি সায়ান নামক ঘাতক ব্যধির আক্রমন থেকে প্রায় সেরে উঠেছে তখন তার মনের দরজায় আবার কেনো এই কড়া নাড়া? যে যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে একবার গেছে সে, কোন কিছুর বিনিময়েই আর একবার সে কষ্ট পেতে চায় না। তিতলি এখন কি করবে?

তানবীরা
১২.০৬.২০১১

Friday 10 June 2011

জীবন থেকে নেয়া ------ (ফালতু)

বহুদিন কিছু লেখার সময়, শক্তি, ইচ্ছে, বিষয় কিছুই পাচ্ছি না। আজকে কোন এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অন্য ঘটনা মনে পড়ে গেল, ভাবলাম তাই ব্লগাই। হল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে কোন ডাইরেক্ট ফ্লাইট নেই। দূরত্বও মন্দ না। আগের মতো এক টিকেটে দুই সীটের ব্যাপারও নাই। তাই পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে দশ বারো ঘন্টা বসে দেশে যেতে যেতে দেখা যায় পায়ে পানি এসে পা ফুলে গেছে। কোন এক অজানা কারণে এশিয়ান হিউমিডিটি বা অন্য ব্যাপারে প্লেন থেকে নামার আগেই ফুলে যাই। একবার একটু বেশিই হলো। পা পুরা হাতির পা। কোন স্যান্ডেল পায়ে ঢুকে না। এমনকি আব্বুর জুতাও না। আম্মি অনেক চিন্তিত আমাকে নিয়ে। আমি যতই বলি কিছু না, ততোই তিনি গোস্বান। দেশের ডাক্তারের চেম্বার দেখলে আমার মৃত্যুভয় লাগতে থাকে। আমি এগুলো এড়াতে চাই। কিন্তু আমার মায়ের ধারনা আমি নিজের কোন যত্ন নেই না, বিদেশে পইড়া থাকি আর গাবাই। তাই তিনি আমাকে ধরে বেঁধে তার পোষা বারডেমের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার বেশ চ্যাংড়া এবং স্মার্ট। প্রথমে আমাকে অনেক খাতির করলেন, তুমি তুমি করে বললেন। তারপর তার প্যাড বের করে বয়স জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম। তিনি গরুর চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ তারপর গলা কাশি দিয়ে আপনি আপনি উন্নিত হইলেন।

তিনি এরপর তার মনের সাধ মিটিয়ে আমাকে এই টেষ্ট সেই টেষ্ট সব করতে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেইসটা কি? তিনি বললেন, আমার কিডনী কাজ করছে না ঠিকমতো আর ব্লাড সার্কুলেশন সমস্যা তাই পা ফুলে আছে এমন। এরপর দিন ভোরে কমফোর্ট নিয়ে গেল ভাইয়া টেষ্ট করাতে। আলট্রাসোনো করাতে হবে। সে কারণে মা ভোরে ঘুম থেকে টেনে তুলছে। আমি আবার লেট টু বেড এন্ড লেট টু রাইজ থিওরীতে বিশ্বাসী। আর ছুটিতে ভোরে ওঠা!!!! যাহোক দেড় লিটার বিশুদ্ধ পানি খেতে হল, আলট্রাসোনোর জন্যে। কমফোর্টে বসে আছি আর মনে মনে সিরিয়ালের ক্ষ্যাতা পুরছি কিন্তু আমার নাম্বার আর আসে না। ডায়পার পড়ি নাই। কোনসময় কোন দুর্ঘটনা ঘটে সেই টেনশন। আমি খালি মোচরাই। ভাইয়া জানে, আমি রাস্তার খাবারের দারুন ভক্ত। সে আমার মন ডাইভার্ট করার জন্যে খাবারের লোভ দিতে লাগলো। পাশেই জিঞ্জিরা হোটেল। সেইরকম সব ঝোল তেল মাখামাখা ভাজি, ডাল, পুরী পাওয়া যায়। এখানের কাজ শেষ হওয়া মাত্র সেখানে আমাকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে সেই আশ্বাস দিতে লাগলো। গোঁদের ওপর বিঁষ ফোড়া এক নতুন মোচ গজানো ছাগল সামনে প্রথম আলো নিয়ে পি।এইচ।ডির ভাব দেখাইতে লাগলো। আবার মোবাইল নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে বারবার হাটে আর কথা কয়, মোবাইল টিপে ফুটানী ঝাড়ে, দুই পয়সার মোবাইল কি খাইবো না মাথায় দিব তাই বুঝতেছে না। আমি সকালে আউলা ঝাউলা অবস্থায় পোলার এই দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা সহ্য করতে পারছিলাম না। ভাইয়ারে বললাম, সমস্যা কি? চড় দেই? ভাইয়া হাসতে হাসতে বললো, দিতে পারলে দিয়া ফেল।

হেতার গালে চড় কষানোর অদমিত ইচ্ছা মনে পুষে রাখলাম। তারপর ফন্দী এটে গেলাম, সিরিয়াল ডাকেন যে, সেই ম্যাডাম আপার কাছে। বললাম, আপা বাসা থেকে সমানে ফোন আসতেছে, আমার গ্যাঁদা বাচ্চা কানতেছে। আমারে যদি একটু দয়া করে কাইন্ডলি আগে দিতেন। ম্যাডাম আপা, ভুরু কুঁচকে আমাকে জরিপ করে বললেন, আপনের বাচ্চা মানে কি? আপনের বিয়া হইছে? আমিও আর তখন মেজাজ সামলাতে পারি নাই। সকালের ঘুম শ্যাষ, বেলা হইতেছে জিঞ্জিরার নাস্তা শ্যাষ, ঐ পুলার ক্যাঁদরানি আর নিম্নচাপতো আছেই। বলছি, জ্বীনা বিয়া হয় নাই তবে বাচ্চা হইছে। বিয়ের আগে বাচ্চাতেতো কোন সমস্যা নাই। না আছে? ম্যাডাম আপা, রাগে চিরবির করে আমারে বললেন, জায়গায় যেয়ে বসে থাকেন, সিরিয়াল আসলে ডাকবো।

বহুদিন হীরার দেশে আছি কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোন হীরার গয়না নেই আমার। একটা সেই ধরনের ফোর সি এর হীরার গয়নার আমার খুব শখ। আমি খালি নেটে দেখি আর পড়াশুনা করি এর ওপর। যতোই পড়ি ততোই বাজেট যায় বেড়ে, এই দুমূল্যের বাজারে। বাসার ওনি খালি মোচরান। পরে বললেন, কোন একটা বিশেষ উপলক্ষ্যে তিনি এই আবেদন বিবেচনা করবেন। গরীবের বাড়িতে উপলক্ষ্য সহসা আসে না। মেয়ে হওয়ার পর তিনি ভাবলেন, এবার কিছু বিবেচনা করা যায়। আমরা এন্টওয়ারপেন গেলাম ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্যে। বিভিন্ন রকমের ছাঁটের পাথর গুতাগুতি করে ফাইন্যালি একটা ফাইন্যাল করলাম। তিনি বেজার মুখের ক্রেডিট কার্ড বের করে পয়সা দিলেন। দোকান মালিক জিউ ভদ্রলোক তখন সত্যি বিশ্বাস করলেন এই বাদামি চামড়ার লোকজন খালি হাতাহাতি করে রেখে চলে যাবে না। তিনি তার মুখের অমূল্য হাসি প্রদান করে আমার দিকে হাত বাড়ালেন, হ্যান্ডশেক করার জন্যে। আমি বুঝি নাই। আমি হাত দিলাম। তিনি ফ্লেমিস, ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজি মিশিয়ে বললেন, কনগ্র্যাচুলেশনস ইন এডভান্স। বিয়ের ডেট কবে ঠিক করেছো? একা আংটি কিনতে আসছো যে? ফিয়াঁসেকে কেনো সাথে নিয়ে আসো নাই। খুব মানাবে এই আংটি তোমাকে। পাশের জন মুখ কালো করে দোকানের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখছে। আমি খুঁকখুঁক কেশে বললাম, বহুদিন আগে এই বিল প্রদানকারীর সাথে আমার শুভ পরিনয় সুসম্পন্ন হইয়াছে, এখন কন্যা হইয়াছে। কন্যাকে ডেকেয়ারে রাখিয়া আমরা কেনা কাটায় বেরিয়েছি।

এইবার নন্দনে গেলাম। অনেক গরম দেশে। ঘুরাঘুরি শেষ দিয়ে যেয়ে লম্ফ দিয়ে আমরা পানিতে নামলাম। অনেক ভীড় পানিতে। দুইটা চ্যাংড়া দেখি আমাদের টার্গেট করে পানির মধ্যেই এদিক সেদিক ঘুরে। আমরা আছি আমাদের মতো। আমাদের কাছে পাত্তা না পেয়ে আমার মেয়ের সাথে পুটুর পুটুর গল্প করতেছে। সুইট বেবি, কি নাম তোমার? কি পড়ো? আমার মেয়ে আলহাদে বুঝতেছে না কি করবে। তারপর চ্যাংড়া জিনগায়, তোমার মা কোনটা? আমার মেয়ে আমার কাপড়ের রঙ, চুলের বাহারের বর্ননা দিয়ে দেখাইতেছে তার মা কোনটা এই দলের মধ্যে। আমি আনতে গেছি আমার মেয়েরে, তখন এক চ্যাংড়া থতোমতো খেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপু আপনার বিয়ে হইছে? এইটা আপনার মেয়ে?

তানবীরা
১১.০৬.২০১১

Thursday 9 June 2011

মন খারাপ


টিপ টিপ বৃষ্টিতে
শরীর ভালো নেই
যারে যা কেউ
রান্নাঘরে যা নারে
।।
ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যানিতে
মেজাজ ঠিক নেই
মাইর খেতে না চাইলে
সামনের থেকে সরে যা নারে।।

কে জানে কি জন্যে
মেজাজ আমার ঠিক নেই
যারে যা সবাই
ভেগে যা নারে।।
রান্নাবান্না ঘরকন্না
আর ভালো লাগে না
হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে
যেখানে কেউ খুঁজে পাবে না
কোথায় আছে বল সেই ঠিকানা
যারে যা কেউ খুঁজে দে নারে।।
কোন কাজ করতে ইচ্ছে না
করার দারুন আলস্যে
বৃষ্টির কাঁথা গায়ে মুড়ে
শুয়ে থাকার মধুর আবেশে
কোথায় কবে মিলবে সে
অবসর কে জানে
সে আশাতেই দিন গুনছিরে।।
তানবীরা
০৯.০৬.২০১১