ডাচ শিক্ষা
ব্যবস্থায়, প্রথম – দ্বিতীয় – তৃতীয় ব্যাপার গুলো
নেই। আছে শুধু পাশ – ফেইল। সেটা ও লেখে
অত্যন্ত পরিশালীত ভাষায়। “ভাল” “যথেষ্ঠ” “যথেষ্ঠ নয়”। রেজাল্ট কার্ড হাতে নিয়ে
পিতা মাতাদের একজনের সাথে আর একজনের তুলনা দেয়ার ব্যবস্থাটাও কম। রেজাল্ট হয় দু-
তিন ধরে, প্রতিটি গার্জিয়ানের সাথে আলাদা এপয়ন্টমেন্টের মাধ্যেমে আলোচনা করে
রেজাল্ট হাতে দেয়া হয়, তাই একজন গার্জিয়ানের সাথে আর একজন গার্জিয়ানের দেখা হওয়ারও
সুযোগ হয় না। তার চেয়েও বড় হলো, বাচ্চারা সবাই ইউনিক, একজনের সাথে একজনের তুলনা হয়
না, প্রত্যেকের মধ্যেই ভাল কিছু আছে সেটা সে বয়সেই তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়। মেঘ কে কিছু
বলতে গেলেই গলার রগ ফুলিয়ে বলবে, তুমি আমার সাথে
অন্যের তুলনা করছো, জানো এটা কতো খারাপ?
প্রতিযোগিতাকে
এখানে অসুস্থ মনে করা হয় বিধায় এটাকে অনুৎসাহী করা হয়।
আমাদের শিক্ষা
ব্যবস্থা অনেকটাই পাশ-ফেইল, বেশি নম্বর – কম নম্বর, বই গেলানো
নির্ভর। এ নিয়ে আমাদের
সংস্কৃতির সাথে ওদের সংস্কৃতির যুদ্ধ ও হয়ে যায়।
একবার
মেঘলার ক্লাশে একজন ভারতীয় বাচ্চা পরীক্ষায় নম্বর একটু কম পাওয়াতে কাঁদছিলো।
সাধারনতঃ বরাবর সে বেশ ভাল নম্বর পায়।
টিচার অবাক
হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কাঁদছো কেন?
মেয়েটি বললো, আমি অন্যের চেয়ে নম্বর কম পেয়েছি, মা জানলে অনেক রাগ করবে।
টিচার আরো
অবাক হয়ে বললো, কেন? কেন বকবে তোমাকে? কোন কোন বিষয় কি
থাকতে পারে না যা তুমি অন্যদের থেকে কম জানতে পারো? সব যদি জানবেই তবে স্কুলে আসবে কেন? স্কুলে তো শিখতেই আসো, নাকি?
এমনও হয়েছে, এক ভারতীয় অভিভাবক স্কুলের টিচারকে বলেছে, তোমার ক্লাশে যা পড়ানো হয় সে সব তো আমার বাচ্চা সব জানে।
তুমি ওকে ওপরের ক্লাশে দিয়ে দাও।
টিচার
বিনয়ের সাথে বলেছে, তোমার বাচ্চা অনেক
জানে বটে কিন্তু সব তো এখনও জানে না। তুমি ওকে আরামে আমার কাছে ছেড়ে দাও। ও কি
জানে আর কি জানে না, সেটা আমি দেখে নেবো, সে জন্যে আমি আছি।
হাসতে হাসতে
খেলতে খেলতে প্রাথমিক শিক্ষা বলতে যার গল্প ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি তার চাক্ষুস
কিছুটা রুপ এখানে দেখতে পেয়েছি। একশ তিন জ্বর নিয়েও বাচ্চারা স্কুলে যেতে পাগল
থাকে। নিজের মেয়েকেও ঔষধ সুদ্ধ স্কুলে দিয়ে এসেছি, টিচার বলেছে, বেশি খারাপ হলে আমি
তোমাকে ফোন করে দেবো, এসে নিয়ে যেও।
স্পেন থেকে
বেড়িয়ে এসেছি একবার, প্লেন থেকে নেমে
বাড়ি এসেই মেঘ বললো, মা, এখন তো টিফিন পিরিয়ড, আমি স্কুলে চলে যাই?
সেই দিনটা
ওর ছুটি নেয়া ছিলো স্কুল থেকে। ও বাড়ি থাকতে চাইলো না, আমি দুপুরে স্কুলে দিয়ে এলাম।
মেঘের
ক্লাশে তিনটে গ্রুপ ছিলো। সবুজ, বেগুনি আর কমলা।
আমরা আমাদের দেশীয় কায়দায় এগুলোকে মেধাবী, মাঝারি আর দুর্বল হিসেবে দেখার চেষ্টা করলে মেঘ আমাকে বললো, এরকম কোন ব্যাপার নয় মা।
সবুজ যারা
তারা তাদের পড়া শেষ হয়ে গেলে, বেগুনিদের সাহায্য
করবে। আর বেগুনি যারা তারা তাদের হাতের কাজ শেষ করে কমলা গ্রুপকে সাহায্য করবে।
সবাই ভাল ক্লাশে, সবাই এক সাথে পড়বে, কিন্তু সবাই সবাইকে সাহায্য করবে। সবুজ যারা তারা তাদের
পড়ার বাইরেও টিচার থেকে অন্য পড়া পাবে। ব্যাপারটা আদতে তাই, দুর্বল গ্রুপকে সবল গ্রুপ সাহায্য করবে কিন্তু ছোট বেলাতেই
বাচ্চার ব্রেইনকে সুপারলেটিভ কিছু ঢুকিয়ে দিয়ে ওয়াশ করে দেয়া হয় নি। সবাইকে সমান
সমান রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যার যার ক্লাশ ওয়ার্ক আগে শেষ হয়ে যাবে সে এক্সর্টা
পড়া পাবে মানে সবুজ গ্রুপ তাদের মেধানুযায়ী কিছুটা বেশিই পড়বে। অনেকটা স্বীকৃত
মনটেসরি (Montessori) পদ্ধতি। কিন্তু সবুজ মানেই
মেধাবী এই চিন্তাটা বাচ্চাদের মাথা থেকে সযতনে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রাইমারি স্কুলে
বাচ্চাদের কোন বই খাতা থাকে না। বাড়ি থেকে ছোট একটা স্কুল ব্যাগে ওয়াটার বোটল, জুসের প্যাকেট, আর টিফিন বক্স নিয়ে যায়,
নিয়ে আসে। পড়ার উপাদান (Material) স্কুলেই থাকে, সেখানেই পড়ে, লিখে,
সেখানেই জমা দিয়ে আসে। ছোট ক্লাশে বেশীর ভাগই পাজল মেলানো, লেগো দিয়ে কিছু বানানো, ডুপ্লো, ছবি আঁকা, প্লে ডো দিয়ে বিভিন্ন কিছু তৈরী, রঙ করা, আপেলের সাথে আপেল দিয়ে, পিয়ারের সাথে পিয়ার দিয়ে গুনতে শেখানো, সারি শেখানো হয়। টিচার’রা বলে এ দিয়ে সূক্ষ্ণ ভাবে অঙ্ক শেখানো শুরু হয়। প্রচুর পরিমানে রঙিন
কাগজ সাথে কেঁচি, আঠা দিয়ে বাচ্চাদের
দেয়া হয় ক্লাশে, এসো নিজে বানাই, যেটাকে কারু শিল্প বলি আমরা। প্রতি ক্লাশে বিশ
থেকে পঁচিশটা বাচ্চা থাকে, আর দুজন টিচার। একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত আর একজন
শিক্ষানবীশ, যে তার পড়াশোনার ব্যবহারিক পর্বটি তখন করছে। পাশ করে গেলে হয়ত এখানেই
চাকরি হয়ে যেতে পারে।
কারু শিল্প
ক্লাশের জন্যে মাঝে মাঝে পুরো দুপুরের পরিকল্পনা রাখা হয়। অনেক সময় বাবা মায়েদের
কারু শিল্প দুপুরে সাহায্য করতে বলা হয়। বাচ্চারা আনন্দের সাথে দু হাতে, গায়ের
এপ্রনে রঙ মেখে, আঠা মেখে পাখি, মুরগী, প্লেন, ফুল বানাতে থাকে। কোন বাচ্চার হাতের
কাজ কতোটা পরিস্কার, সে কি ভাবছে, কোন দিকে ঝোঁক, কি দিয়ে খেলতে ভালবাসছে তা খুব
গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে টিচাররা তা লিখে রাখে। এখানে বাচ্চাদের রিপোর্টের তিনটে
ভাগ হয়, সামাজিক উন্নয়ন, মানসিক উন্নয়ন আর পড়াশোনা। ডাচ এডুকেশানে একজন মানুষের
জন্যে এই তিনটা ভাগই অত্যন্ত জরুরী। সামাজিক উন্নয়ন ভাগে থাকে বন্ধুদের প্রতি আচরণ, ক্লাশের অন্যদের সাহায্য
ইত্যাদি, স্কুলের অন্যদের প্রতি ব্যবহার, মানসিক
উন্নয়ন বিভাগে দেখে, বাচ্চার নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা তার বয়সানুযায়ী হচ্ছে
নাকি, তার হাসি, কান্না, রাগ আবেগ তার বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে উঠানামা করছে কি না, শারীরিক
গঠন, উন্নয়ন সব দেখা হয় আর পড়াশোনাতে দেখা হয় তার মেধানু্যায়ী সে আশানুরূপ ফলাফল
করছে কি না। সবুজ গ্রুপের সাথে কমলা গ্রুপের তুলনা নয়, কমলার মধ্যে তার কর্মক্ষমতা
কেমন। এই বয়স থেকেই কোন বাচ্চা ভবিষ্যতে কি ধরনের পড়াশোনা, পেশায় যেতে পারে, সাফল্য
আসবে কোন দিকে সেই দিকটি নির্নয় করা হয় বা দিক নির্দেশনা দেয়া বা ধরা হয়ে থাকে।
যদিও
প্রাইমারী স্কুল শেষ হওয়ার আগে সরকারী ভাবে সারা দেশ জুড়ে একটি মেধা নির্নয়
পরীক্ষা নেয়া হয়। সেই পরীক্ষার ফলাফল আর ক্লাশের পরীক্ষার ফলাফল দুটোকে তুলনা করে
সেকেন্ডারী স্কুলের গ্রেড নির্নয় করা হয়। কেউ যদি কোন কারণে সরকারী পরীক্ষা
রেজাল্ট খারাপ করেও ফেলে তাহলে স্কুলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, সরকারী পরীক্ষার
মার্কস নয় আবার উল্টোও হতে পারে। সেকেন্ডারী স্কুলে মেধাবী, মাঝারী, কম মেধাবী
হিসেবেই ক্লাশ করানো হয়। তবে সেটা যে কোন সময় পরিবর্তন হতে পারে। মেধাবী হিসেবে
কেউ গ্রেড পেয়ে লাগাতার পরীক্ষা খারাপ করলো তবে তাকে মাঝারী’তে নামিয়ে দিতে পারে।
আবার মাঝারিতে ভাল রেজাল্ট করলে মেধাবীতে তুলে দিতে পারে। সব সময় বাচ্চার
ক্যাপাবলিটাকেই দেখা হয়। এটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তই আসলে চলতে থাকে। পারছো না
জায়গা ছেড়ে দাও, তুমিও কমর্ফোটেবল থাকো, অন্যেও সুযোগ পাক। হতাশা দিয়ে, বিষাদ দিয়ে জীবন গড়ো না। পড়াশোনায় হচ্ছে না, টেকনিক্যাল লাইনে
দেখো, কিংবা আরো অন্য কিছু। এতো বড় জীবনটাকে, বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ করে দিও না।
প্রাইমারীতে
বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগ এর একটি নমুনাঃ