Sunday 9 May 2010

অহনার অজানা যাত্রা (দুই)

সারারাত বৃষ্টি হয়ে সকালে খুব মিষ্টি রোদ উঠেছে। চারপাশটা তাই অনেক স্নিগ্ধ। দুরু দুরু বুকে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে অহনা এ্যম্বেসীর ভিতরে গেলো হাতের ফাইল শুদ্ধ, সে টেবিলের একপাশে বসল আর অন্যপাশে বসলেন একজন শ্বেতাঙ্গ আর একজন দেশী ভাই। শ্বেতাঙ্গ ভাই অবশ্য বেশ হেসে তার খোঁজ খবর নিলেন, সে কি করতো, কবে বিয়ে হলো, অর্ন অহনার পূর্ব পরিচিত কিনা, বাবা মাকে ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি, দেশী ভাই অবশ্য তেমন কোন কথা বললেন না শুধু শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে তার ভিতরটা এফোড় ওফোর করে এক্সরে করে দেখার চেষ্টা করলেন। দৃষ্টি দিয়ে উনি বুঝার চেষ্টা করছিলেন সে কি টেররিষ্ট কিংবা কোন ভয়াবহ অপরাধী কী না, যে নেদারল্যান্ডসে চলে যেতে চায় তাকে ফাঁকি দিয়ে। শ্বেতাঙ্গ ভাইয়া অবশ্য খুব আরামদায়ক ভঙ্গীতে ছিলেন, অহনা কফি খাবে কিনা তাও এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন এমনকি চলে আসার সময় তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। এরি মধ্যে ফাইলে থাকা কাগজগুলো দু আঙ্গুলে সামান্য একটু উলটে পালটে দেখলেন, সমস্ত কাগজের মধ্যে থেকে তার পাসপোর্টটাই শুধু রেখে দিলেন আর একটা রিসিট দিয়ে বলে দিলেন দু দিন পর এসে এতো টাকা ভিসা ফি দিয়ে যেনো সে পাসপোর্টটা নিয়ে যায় সাথে সেফ জার্নি টু হল্যান্ডও উইস করলেন। শ্বেতাঙ্গ ভাইয়ের ভদ্রতায় বিমুগ্ধ অহনা ভেবেই পেলো না কেনো লোকে এ্যাম্বেসী নিয়ে এতো খারাপ খারাপ গল্প ছড়ায়। আসলে লোকের খেয়ে দেয়ে কাজতো নেই, কাজ একটাই ভালো ভালো জিনিসের বদনাম দিয়ে বেড়ানো। এরপর থেকে তার যার সাথেই দেখা হলো তাকেই তার এই ‘জার্নি টু এম্বেসী’ গল্প করে শোনাতে লাগল। যথাদিনে ভিসা কাম পাসপোর্ট আনতে গেলো সে, রিসিপশনে বসা সুন্দরী ঘটি (কোলকাতাইয়া) আন্টি মিষ্টি হাসি দিয়ে পাসপোর্ট দিতে দিতে একটু গল্পও করল তার সাথে, কবে যাচ্ছে, শপিং করেছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

পাসপোর্ট হাতে নিয়ে, খুলে অহনাতো অবাক, একটা ঝিকমিক দেয়া ষ্টিকার আছেতো বটে লাগানো কিন্তু সেখানে কোথাও নেদারল্যান্ডস লেখা নেই, আছে ‘বেনেলুকক্স’ লিখা। এই বেনেলুকক্স মানে কি? অহনা অবশ্য অর্নের কাছে শুনে ছিলো বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডসের ভিসা এই এক এ্যম্বেসী থেকেই ইস্যু হয়। কি দিতে কি দিয়ে দিলো চিন্তায় পড়ে গেলো সে। শ্বেতাঙ্গ ভাইয়ার মিষ্টি মিষ্টি হাসি ভদ্রতার পিছনে কি তাহলে এই শয়তানীই লুকিয়ে ছিল? তাহলে কি এ্যাম্বেসী নিয়ে লোকজনের ভয়াবহ সব গল্প সত্যি!? যাই হোক উপায় না দেখে রিসিপশনে বসা আন্টিকেই জিজ্ঞেস করল সে এই ‘বেনেলুক্স’ চীজটি কি? আন্টি দেখতে বেশ কনফিডেন্ট, বেশ সবজান্তা সবজান্তা ভাব আর সাজগোজের বাহারি কারণে তখন তার মনে হয়ছিল পৃথিবীর চলমান সমস্ত ঘটনাবলী আন্টির নখদর্পনে। কথাবলার ভঙ্গীতে আরো মনে হয় আন্টি সব প্রশ্নের উত্তর জানে। কিন্তু তার বিধি বাম। আন্টি আবার চিরকালের চরম সেই সত্যটি প্রমান করলেন, ‘মুখ দেখে ভুল করো না, মুখটাতো নয় মনের আয়না’ । আন্টি দেখা গেলো নিজেও বিশেষ কিছু জানেন না এ ব্যাপারে, তো তো করে যা বললেন তার মানে দাড়ায় এই, যা দিয়েছেন তারা বিচার বিবেচনা করে ঠিকই দিয়েছেন, অহনার এতো কথা বুঝে কাজ নেই, সে যেনো বিসমিল্লাহ বলে প্লেনে ঝুলে পড়ে। এদিকে অহনার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, যাবার আর মাত্র দু সপ্তাহ আছে, প্লেনের কনফার্ম টিকিট, শপিং, আত্মীয় স্বজনের বাসায় দাওয়াত খাওয়া প্লাস বিদায় নেয়া প্রায় সব সারা, এখন যাওয়া না হলে কিংবা এয়ারপোর্ট থেকে ফেরৎ আসলেতো প্রেস্টিজের ফালুদা হয়ে যাবে। উপায়ন্তর না দেখে অর্নের ফোনের অপেক্ষায় রইলো সে।

অর্ন ফোন করতেই কাঁদো কাঁদো গলায় অহনা বললো সর্বনাশ হয়ে গেছে। নেদারল্যান্ডসের ভিসার বদলে কোথাকার কোন ‘বেনেলুক্সের’ ভিসা দিয়েছে তাকে। অর্ন ৫,৮৫ গিলডার উইথ আউট ১৭,৫ পার্সেন্ট ট্যাক্স পার মিনিট এর ফোন কলে মোটেই তার নব পরিনীতা বউ এর সাথে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন কিংবা বেনেলুক্স নিয়ে সেই মূর্হুতে আলোচনায় যেতে কোন আগ্রহ দেখাল না বরং শান্ত গলায় বলল সর্বনাশের কিছু হয়নি, এতো কথা এখন না বুঝলেও চলবে, চুপচাপ প্লেনে চড়ে যেনো সে চলে আসে, অর্ন তার অপেক্ষায় আছে। যদিও অহনা একটু বেকুব হয়ে গেলো সে মুহূর্তে কিন্তু তখনও বেকুব অহনা বুঝতে পারেনি তার জীবনের বেকুব হওয়ার এইতো কেবল শুরু, এখন জীবনই যাবে বেকুব হয়ে হয়ে। সে যাই হোক, এক নিকষ কালো রাত্রিতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে মা, ভাই-বোন, বন্ধু - বান্ধব, চির পরিচিত দেশ আর পরিবেশ পিছনে ফেলে অহনা যাত্রা করলো অজানার উদ্দেশ্য। মায়ামায় বাবা সাথে এলেন তাকে এগিয়ে দিতে, দিল্লীতে এসে প্লেন চেঞ্জ করতে হবে। দিল্লী বিরাট এয়ারপোর্ট, নেমেই মনে হলো তার বাবা সাথে না এলে হারিয়ে সেতো যেতোই এখানে। কিন্তু সাথে বাবা, এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি, অথরিটি আর সিডিউল মনিটরিং বোর্ডের কারণে অহনা হারাতে পারলো না। সেখান থেকে কে।এল।মে চেপে অহনা নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। প্লেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তারায় তারায় ভর্তি নীল কোজাগরী আকাশ দেখছিলো সে চুপ করে। মাঝে মাঝে নাম না জানা কষ্টে হঠাৎ ভীষন চুপচাপ হয়ে গিয়ে কাঁদছিলো। কেনো চোখ ভিজে আসছিলো তা সে জানে না। তখনও সবাইকে ছেড়ে আসার কষ্ট সে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি আবার অর্নের কাছের যাওয়ার আনন্দও ছিল। একটা নাম না জানা ভীতি মিশ্রিত অনুভূতি সে সময়টায় তাকে ব্যকুল করে ফেলেছিল।

সে সময় খাবার দিতে আসা কে।এল।এম এর একজন বেঙ্গলী স্টুয়ার্ডেস পরিস্কার বাংলায় অহনাকে প্রায় ধমক দিয়েই দিলেন, ‘এই মেয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছো একা একা, আবার কাঁদছ’? ষ্টুয়াডের্সের ধমক খেয়ে অহনা একটু ভয় পেলো মনে মনে, আবার প্লেন থামিয়ে নামিয়ে দিবে নাতো? তাহলে হয়েই যাবে, সারা গোষ্ঠীর ধমক খেতে হবে তখন, বলবে, কাঁদতে গিয়েছিলি কেনো তুই? কোন ঝামেলা না হয় সেভেবে কোন উত্তর না দিয়ে সে চুপ করে রইলো। পাশের সীটে এক গুজরাটি কিংবা পাঞ্জাবী ভদ্রলোক ছিলেন অহনার সহযাত্রী, মোটামুটি তরুন বয়সী। তিনি তার কান্নাকাটি দেখে আর হয়ত নিজের কৌতুহল থেকেও খুটিনাটি জিজ্ঞেস করছিলেন। অহনার নিজের বন্ধু - বান্ধব আর তার বাড়ির বাইরের বর্হিবিশ্ব সমন্ধে কোন ধারণা ছিল না বিধায় যা যা তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন সে সবকিছুর উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো, সাধারণ সৌজন্যতা ভেবে।

প্লেন একটানা দশ ঘন্টা উড়ে ক্রিসমাস ইভের এক ঠান্ডা ভোরে নেদারল্যান্ডসে এসে পৌঁছলো। অহনা বোর্ড পড়ে পড়ে হেটে হেটে ইমিগ্রেশন অবধি পৌঁছলো সাথে সেই সহযাত্রী ভদ্রলোক, তিনি তখন তার পিছন ছাড় ছিলেন না, সে অবশ্য ভেবেছিলো পাছে সে যদি কোথায় হারিয়ে যায় সেই জন্য। ইমিগ্রেশনের জন্য কয়েকটা গেট আছে, তার মধ্যে পরিস্কার ইংরেজী ও অন্যান্য আরো কয়েকটি ভাষায় লেখা আছে যারা প্রথমবার নেদারল্যান্ডসে ঢুকছেন তারা যেনো এই পথে আসেন। অহনা সেই বিশেষ কাউন্টারের পাশে যেয়ে তার পাসপোর্ট সেখানে বসা একজন অফিসারকে দিলে, তিনি খুবই হাসি হাসি মুখে সেটি নিলেন, সাথে সাথে অহনার সহযাত্রী ভদ্রলোকও তার পাসপোর্ট দিলেন সেই অফিসারকে। সহযাত্রী ভদ্রলোক এমন ভাব ভঙ্গি করার চেষ্টা করছিলেন বার বার যে তিনি তার সাথেই ভ্রমন করছেন। পাশের যাত্রীর পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পরই সেখানে বসা অফিসার ভদ্রলোক তাদেরকে ওয়েট বলে দাড় করিয়ে দিয়ে পাসপোর্টগুলো নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। একটু পরেই তিনি তার এক সহকর্মীকে নিয়ে সেখানে ফেরত এলেন এবং তাদের বললেন তার সেই সহকর্মীর সাথে যেতে। বেচারী অহনার কোন ধারণাই নেই কেনো কার সাথে কোথায় যাচ্ছে, যেতে বলা মাত্র কোন প্রশ্ন করা ছাড়াই সে সেই ইমিগ্রেশন অফিসারের সাথে হেটে যাচ্ছিল। সবকিছু এতো দ্রুত আর অদ্ভূতভাবে ঘটছিলো যে তার সব তালগোল পাকানো লাগছিল, কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিল না।

(চলবে)
তানবীরা
পরিশোধিত ০৯.০৫.১০

No comments:

Post a Comment