Friday 20 May 2011

ছুঁয়েছে এ গান আমার কান্নার সাত সুর

If you love something, set it free; if it comes backs it's yours, if it doesn't, it never was. রিচার্ড বাক’এর এই উক্তিটিকে মন্ত্র করে তিতলি সারাক্ষণ মনে মনে আউরাতে থাকে। নিজেকে শক্তি দিতে চেষ্টা করে। দশ বারের মধ্যে আট বার সে হেরে যায় নিজের কাছে আবার দু’বার জিতেও যায়। সে অপেক্ষা করে থাকবে সায়ানের ফিরে আসার। সায়ানতো তার নিজের অংশ, পথ ভুলে যায় না লোকে? সায়ান পথ হারিয়ে ফেলেছে, পথ খুঁজে ফিরে এসে তার সায়ান তাকে খুঁজবে তিতলি জানে। তিতলি তার সমস্ত দরজা, জানালা, ঘুলঘুলি খুলে দিয়ে সায়ানের ফেরার অপেক্ষায় রইলো। কতদিন করবে অপেক্ষা? দশ বছর? বিশ বছর? পুরো জন্ম কিংবা জন্মান্তর? কিন্তু তাকে যে অপেক্ষা করতেই হবে। কোন একদিন সায়ান যখন খুব ক্লান্ত হবে তিতলির কথা তার নিশ্চয়ই মনে পড়বে। তখন তিতলির দরজায় এসে যেনো দরজা বন্ধ না পায় তারজন্যে সব খুলে রাখবে সে। ক্লান্ত সায়ানের মুখ মুছিয়ে দিবে নিজের ওড়না দিয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে দিবে। মগ ভর্তি গরম কফি নিয়ে দুজনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোস্ন্যা দেখবে আর সায়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রিয় কবিতার প্রিয় লাইনগুলো গুন গুন করবে। হাত নেড়ে নেড়ে অনেক গল্প করবে সেদিন তিতলি সায়ানের সাথে, অর্থহীন সব গল্প, যার আসলে কোন মানেই নেই। সায়ানের ভাল না লাগলেও সেসব শুনতে হবে। ওর কোন চয়েস থাকবে না তখন তিতলির কাছে। এটাই হবে তার শাস্তি। চুপ কর, বক বক শুনে মাথা ব্যাথা করছে বললেও তিতলি থামবে না। কাতুকুতু দিয়ে আরো খোঁচাবে সে সায়ানকে। সে অপেক্ষা করে আর স্বপ্নের জাল বুনে যায়, সায়ানের ফিরে আসা বা না আসা হলো তার নিয়তি। আবার এটাও ভাবে তার কাছেই সায়ানের ফিরে আসাটা বড় কথা নয়। সায়ান যেখানেই থাকুক, যার কাছে থাকুক আনন্দে থাকুক আর ভালো থাকুক সেটা বড় কথা। সে শুধুতো সায়ানের সুখ চায়।

যার জন্যে তিতলি জগত জুড়ে এতো চুরি করেছে, সে যখন চোর বানিয়ে তার হাত ছেড়ে দিল, মানসিকভাবে তিতলি একদম একা হয়ে গেলো। তার দিনরাতের সব কাজের বাইরে বাকি সময়টা জুড়ে শুধু সায়ান ছিল। এখন নিজের মনে সে একলা থাকে, ফাঁকা অবসর। কোথাও আর সেই প্রিয় মুখ সেই হাসি নিয়ে উঁকি দেয় না। সেই মায়াভরা চোখ নিয়ে কেউ তাকানোর নেই। সেই হাত আর তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিবে না। কেউ আর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার চুলের গন্ধ নিবে না ভাবলেই তার এক এক সময় কষ্টে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কি করে লোকে সব ভুলে যেতে পারে? কিন্তু তিতলি কিছুতেই হেরে যাবে না, নিজের কাছে সে নিজে এই প্রতিজ্ঞা নিল। এই যুদ্ধে তাকে জয়ী হতেই হবে। যতোই অস্থির লাগুক, নিঃশ্বাস বন্ধ হোক, মন কেমন করে করুক, চোখের পানিতে গাল ভিজেতো ভিজুক সায়ানের কাছে আর নিজেকে সে ছোট করবে না। ভালবাসাতো বেঁধে রাখার জিনিস নয়। হাত ছেড়ে যে চলে গেছে ফিরে তাকেই আসতে হবে। পৃথিবীর কারো কাছেই সে দুর্বল হবে না, ভেঙ্গে পড়বে না। নিজের আগুনে সে নিজে জ্বলবে। এতো জ্বলবে যে চোখের পানিকে সে বাস্প করে আকাশে উড়িয়ে দিবে। যেটা মেঘ হয়ে উড়ে গিয়ে ঝরে পড়বে সায়ানের বুকে। শুধু সায়ান জানতে পারবে না এই উড়ো মেঘের নাম কি ছিল।

মুরগী কেঁটে ছেড়ে দিলে যেমন ছটফট করতে করতে একসময় নিথর হয়ে যায়। কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করে করে একদিন সেও নিথর হয়ে যাবে এটুকু তিতলি জেনে গেল। কষ্ট হলে লোকে কষ্ট পায়, কিন্তু মরে যায় না, এটাই নিদারুন সত্যি। যদিও মরে গেলেই হয়তো কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যেতো। তারপরও মনে ক্ষীণ আশা খেলা করে তার, কখনও ক্লান্ত মুহূর্তে সায়ান যখন একা থাকে, আনমনে জানালা গলিয়ে তার দৃষ্টি বাইরে দেয়, হয়তো তখন তার মনের নীল আকাশেও ভেসে ওঠে তিতলির মুখ। তিতলির জীবনের কাছে চাওয়ার বেশি কিছু নেই। নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে ধরা যায় শুধু এমন দুখানি হাত ছাড়া। আজ মনে হয় আনকন্ডিশনাল আসলে পৃথিবীতে কিছু নেই। আনমনে বকে যাওয়ার মতো বন্ধুও কেউ হয় না এ পৃথিবীতে। এগুলো সব আসলে কথার কথা। শুধু কবিতার জন্যে এগুলো বলা হয়। ইদানীং আনমনে যখন বকতে ইচ্ছে করে, সায়ানের হাত ধরে যখন উড়ে যেতে ইচ্ছে করে, সায়ানের ঘাড়ে নাক ঘষে দিতে ইচ্ছে করে, তিতলি সায়ানের নামের উইন্ডো খুলে সেগুলো টপটপ লিখে ফেলে। কিন্তু সে চিঠি কখনো সে সেন্ড বাটনে চাপ দিয়ে সায়ান পর্যন্ত পাঠায় না। সায়ান কোনদিন জানতেও পারবে না তিতলির এই খেলার কথা।

শেষের দিকে যখন কথা হত, সায়ান তিতলির দোষ ছাড়া আর কিছুই বলতো না। আপন মনেই হাসে তিতলি। তার চারপাশের সবাই তাকে এতদিন ধরে সহ্য করছে,ছোটখাট সমস্যা হলেও সেটা কখনো তার সাথে লোকে থাকতে পারবে না, সে পর্যায়ের নয়। কিন্তু যে তার একান্ত আপন, তার সবচেয়ে ভালোবাসার লোক পৃথিবীতে তার স্বভাব মেনে নিতে পারলো না। হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। কোন এক দুর্বল মুহূর্তে তিতলি সায়ানকে ম্যাসেঞ্জারে গ্রীন দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।
জিজ্ঞেস করে ফেললো, আমাকে কোন দোষে তুই ছেড়ে গেলি যদি একবার বলতি
সায়ান তার স্বভাবসুলভ ইগো নিয়ে বললো, তোর কোন কিছুই আমার মনের মতো নারে। তুই কখনো ইনফ্যাক্ট আমার মনের মতো হতেও পারবি না।
কি লাভ? তাই ............ আসলে কি জানিস তুই কখনো আমার মনের মতো ছিলিও না।
তুই ছিলি আমার মনের এক সময়ের ঘোর লাগা বিভ্রান্তি মাত্র।

আপন মনে হাসে তিতলি, তার মন মজেছে অন্য জায়গায় কিন্তু সে দূরে গেল তিতলির দোষ দেখিয়ে। কেন সায়ান তাকে বলতে পারলো না, তার অন্য কাউকে চাই এখন? এটুকু সৎ সাহস দেখালে সে তিতলির কাছে ছোট হত না। তিতলি কি টের পাচ্ছে না আসলে সায়ানের পৃথিবী কেনো দুলছে? সেদিনও দেখলো ফেসবুকে সায়ান অনেক ছবি আপলোড করেছে তার ডিপার্টমেন্ট এর আউটিং এর। এক ছবিতে মেরুন রঙের টপস পড়া এক স্বর্নকেশির খুব কাছে সায়ান দাঁড়ানো, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সায়ানের এ হাসি যে তিতলির চিরচেনা। আগে এ হাসি শুধুমাত্র তার জন্যে হাসতো সায়ান। তিতলি অনুভব করতে পারে, অনেক দূর থেকে এতো কঠিন হওয়া আসলে সোজা। দুজন মানুষ যখন কাছে থাকে, একজনের দৃষ্টি অন্যজনকে ছুঁয়ে যায়, একজনের স্পর্শ আর অন্যজনের হৃদয় ভিজিয়ে দেয়। ঠোঁট ঠোঁটকে আবেশে চেপে ধরে তখন এতো কঠিন হওয়া যায় না একজনের প্রতি। তিতলিকে চাবুক দিয়ে কেউ আঘাত করলেও হয়তো সে এতোটা কষ্ট পেতো না। চোখের জল মুছে সে প্রতিজ্ঞা করলো, কারো মনের মতো হওয়ার চেষ্টা সে করবে না আর, যথেষ্ঠ করেছে। বরং যে তাকে পেতে চাইবে, তাকেই তিতলির মনের মতো হতে হবে। দুঃখকে সে আস্তে আস্তে শক্তিতে বদলে দিবে। একদিন অবাক হয়ে তিতলি লক্ষ্য করলো, সায়ানের ম্যাসেঞ্জার - ফেসবুক যেসব জায়গায় তিতলির অবাধ বিচরণ ছিল, সায়ান তাকে বিতারিত করে দিয়েছে অবলীলায়। সে হতবাক হয়ে গেলো সায়ানের এই ক্ষুদ্রতায়, সে সায়ানের জান হয়তো নয় আর কিন্তু বন্ধুও কি নয়? আর দশটা সাধারণ বন্ধুর মতো সে কি সায়ান কেমন আছে এটুকু জানতে পারে না? সে অধিকারও কেড়ে নিতে হলো তার কাছ থেকে? কিন্তু পরে সে সায়ানকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে লাগলো এজন্যে। অতীতকে মুছে সামনে যাওয়া এখন তিতলির জন্যেও সহজ হবে। যদিও জানে তিতলি তার চুলের গন্ধ পেলে, তার চোখের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পেলে, তার আঙ্গুল সায়ানের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলে এতো তাড়াতাড়ি সায়ান তাকে মুছতে পারতো না সবকিছু থেকে। তবুও তিতলি নিজেকে টেনে তুললো হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ভঙ্গুর স্তুপ থেকে। ফিরে দাড়ালো কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে আজ থেকে গানের সাধনায়, ছবি আঁকায় আর পড়াশোনায় নিজেকে আকন্ঠ ডুবিয়ে দিবে সে। হাঁটবে একা, বাঁচবে একা, হারিয়ে যাবে না কিছুতেই।

তানবীরা
২০.০৫.২০১১

উৎসর্গঃ আমাদের সবার আদরের “ছোটমা’কে”
লুকিয়ে ভালবাসবো তারে জানতে দিব না

No comments:

Post a Comment