Friday 5 August 2011

স্টোরিয়া পোলস্কা (১)

অবশেষে বহুকাঙ্খিত সামার ভ্যাকেশন। ইউরোপের সামার, হায় ভগবান অবস্থা। বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে পুরো ইউরোপ জেরবার এবার। সস্তার প্লেনওয়ালারা টারমাক নেন না পয়সা বাঁচান। আগের দিনের মতো সিঁড়ি বেয়ে কাক ভেজা হয়ে উঠলাম প্লেনে। সুনীলের “মানুষ মানুষ” উপন্যাসের আনোয়ারাকে খুঁজতে খুঁজতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। দুপুরবেলা বহুদিন পর একটা ন্যাপ নেয়া হলো। মেয়ের গুতানিতে উঠলাম, স্যান্ডউইচওয়ালি এসেছে। স্যান্ডউইচ খেতে খেতে আবার ঘুমিয়ে পড়ার দশা আমার। পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা হল্যান্ডের তুলনায় বেশ খারাপ। অনেক পোলিশ স্যাঙ্গুইন ভিসার সুবিধার কারণে হল্যান্ডে জব করেন। সপ্তাহান্তে কিংবা মাসে মাসে তারা বাড়ি যান। আমাদের শহর থেকে কাজ করে গ্রামের বাড়িতে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার মতো। প্লেনে অনেক পোলিশ মেয়ে আছে। ইষ্ট ইউরোপীয়ান মেয়েদের দেখলেই ওয়েষ্ট ইউরোপীয়ান মেয়েদের থেকে আলাদা করে চেনা যায়। এরা অনেক সুন্দর স্কার্ট বা ড্রেস পড়ে, জীন্স টিশার্ট টাইপ না। সাজে, দুল-চুড়ি-কাজল। আমার পাশের জন বারবার বলেই গেলেন, সৌন্দর্য আসলে কমনীয়তায়, নমনীয়তায়, লাবন্যে যা পূর্ব দিকে বিদ্যমান। পশ্চিমের মেয়েরা বড় বেশি রুক্ষ ইত্যাদি। এই আলোচনা শুনতে শুনতে কাহিল হয়ে প্রায় পৌনে দুঘন্টা উড়ে এন্ডহোভেন থেকে ওয়ারসাও পৌঁছলাম। ছোট প্লেনে বড্ড ঝাঁকুনি হয়। গা গুলাতে থাকে আর ইষ্ট নাম জপ করি, হায় ভগবান, সবার সামনে বমিতে ভাসিয়ে দিও না। কি ভাববে লোকে।

P1050100

হোটেল থেকে শহরের ভিউ

P1050406

ছবিতে ইষ্ট ইউরোপীয়ান ললনারা

ট্যাক্সি করে হোটেলে পৌঁছে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার চাঁদর টেনে বিছানায়। বাইরে টিপ টিপ ঝরেই যাচ্ছে। অনেকদিন পর এবার খাবো, ঘুমাবো এই প্ল্যানিং এ ছুটিতে গেছি। পৃথিবী ভর্তি দেখার জিনিসের যেহেতু শেষ নাই, দেখার চেষ্টা বৃথা তাই, ভেবে ঠিক করেছি এবার ছুটি মানে ছুটি। ল্যাপটপ ফেলে গেছি। সবকিছু প্রতিদিন টাইমলি, পার্ফেক্টলি করতে করতে বড্ড ক্লান্ত শরীর মন, কোনটাই আর চলছে না। এবার ব্রেক সব রুটিন থেকে। বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। যতো বয়স হচ্ছে, মুগ্ধতা কমছে সবকিছু থেকে। আগে সুনীল – সমরেশ – শংকর যতোটা মুগ্ধ করতেন, এখন আর করেন না। যদিও এই বইটি বেশ ইন্টারেষ্টিং, সুনীলের ডেইলি লাইফ থেকে লেখা। সুনীলের বউয়ের নাম স্বাতী জানলাম। অনেকটা বই জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশে সুনীলের বন্ধু অর্থ্যাৎ লেখক কবিদের কথা। কিন্তু নামের বানান এতো ভুল যে বিরক্তি হজম করা দায়। পশ্চিম বাংলার লোকেরা এটাযে ইচ্ছাকৃত করেন সে ব্যাপারে আমি প্রায় নিশ্চিত। বন্ধুদের সাথে চিঠি চালাচালি হয়, মেইল হয় আর নিলুফার না নিলোফার তা তারা জানেন না, আবার পাঁচশো পাতার উপন্যাস ফাঁদেন!

বেশিক্ষণ শুয়ে শুয়ে বইপড়া গেল না। বৃষ্টিতেই আশপাশ ঘুরে ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্ল্যান হলো। হোটেল থেকে ম্যাপ আর কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিয়ে ভিজতে ভিজতে বের হলাম। মেঘলা আকাশ বিকেলকে সন্ধ্যার রূপ দিয়ে দিয়েছে। আশপাশে হাটতে হাটতে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। এতোবড় একটা হোটেল যদি আমাদের দেশে কোন আবাসিক এলাকায় হতো তাহলে ট্যাক্সি ড্রাইভার, গাড়ি, হকার এটা ওটার ভিড়ে মানুষের সেই এলাকায় বাস করা দায় হতো। আর এখানে না আছে কোন মানুষ না আছে শব্দ। ট্যাক্সি দরকার হলে হোটেল থেকে ফোন করলে ট্যাক্সি আসবে, দশ মিনিট হলো স্ট্যান্ডার্ড টাইম ট্যাক্সি পৌঁছনোর। বাকিটা ট্র্যাফিক আর পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। হেঁটে খুঁজে যেয়ে ডে টিকেট কিনলাম তার পরের দিনের জন্য। এরপর ডিনার, পোলিশ কুজিন। কোথাও যাওয়ার আগে নেট ঘেটে সে দেশের ফুড, ট্যুরিষ্ট এ্যাট্রাকশন, কফি, শপিং, স্যুভেনীয়র ইত্যাদি সম্বন্ধে একটা ধারনা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এখানেও নোট করে নিয়ে গেছিলাম কিছু খাবারের নাম। তা থেকে ডামপ্লিং, ওসিপেক, ডাকরোষ্ট, চিকেন ইত্যাদি অর্ডার করা হলো। খেয়ে বেড়িয়ে দেখলাম বৃষ্টি থেমেছে আপাতত। পরিকল্পনা আবার বদলালাম। বের হলাম এবার “ওয়ারশাও ইন নাইট” দেখতে।

P1050115

ওসিপেক

P1050122

রোস্টেড ডাক ইন সুইট ক্যাবেজ সস

P1050124

চিকেন ইন আনানাস সস

যেকোন জায়গায় গেলে এটা আমার প্রিয় একটা জিনিস। শিখেছি প্যারিস গিয়ে। প্রতিটি শহরেই দিনের আর রাতের রুপ একেবারে আলাদা হয়। দিনের ব্যস্ত শহরকে রাতে প্রায় চেনাই যায়না বললে চলে। সারাদিন রোম ঘুরে সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার পথে আলোকজ্জল প্যান্থন Pantheon দেখে অবাক হয়ে আমি আমার হাতের লিষ্ট চেক করছিলাম, এটা কি করে বাদ পড়ল, এটাতো দেখিনি। মেয়ের বাবা হেসে আমাদের হাতের লিষ্ট, গাইড আর আমার চোখ এক করে দিয়ে বললেন, এই তোমার প্যান্থন, কলোসিয়াম যা সারাদিন ঘুরে দেখলে। অথচ রাতের নিকষ কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে স্থাপনার আলোকসজ্জা, একদম অন্যরকম করে ফেলে। সেই রাতেই ট্যাক্সি করে আবার বের হলাম রাতের রোম দেখতে। দেখতে দেখতে ছোটবেলায় পোষ্টারে পড়া লাইনদুটো মনে পড়ল আবার হেলেন কেলার বলেছিলন “The best and most beautiful things in the world cannot be seen or even touched. They must be felt with the heart.” রোমের সে রাত আমার মনে দাগ কেঁটে গেলো। ঘুরতে ঘুরতে আমার হদয় ভাষা হারিয়ে পরিপূর্ন হয়ে এলো। এরপর থেকে রাতের শহর আমার ভ্রমন তালিকার মাস্ট আইটেম। তবে সব শহরই যে সমানভাবে মুগ্ধ করে তা নয়। কিছু শহরের ওপর ডিপেন্ড করে কিছু আবার মুডের ওপর ডিপেন্ড করে।

P1050342

রাতের পোল্যান্ড

P1050257

P1050255

P1050140

পোলিশ ট্রাম বাসের রঙ দেখে ছোটবেলায় দেখা গায়ে হলুদের শাড়ির কথা মনে পড়ে গেলো

তানবীরা
০৬.০৮.২০১১

No comments:

Post a Comment