খুব ছোটবেলায় যখন গাড়িতে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতাম, প্রায় তিন চার ঘণ্টার এই লম্বা বোরিং জার্নিতে একটাই মজার ব্যাপার ছিলো, মাঝে দুটো ফেরি পার হওয়া। মায়েদের মুখে শুনেছিলাম আরো আগে তিনটে ফেরি পার হতে হতো, আর তখন দুটো।
কিন্তু এই ফেরি পার হওয়া যতোটা মজাদার হওয়ার কথা ছিলো, ঠিক ততোটা কখনোই হতো না। ফেরীতে সেদ্ধ ডিম, ঝালমুড়ি, চানাচুর, ইত্যাদি অনেক মজাদার লোভনীয় খাবার পাওয়া যেতো। অনেকেই সে সব কিনে খেতো, কিন্তু আমাদের যেহেতু বাইরের জিনিস খাওয়া নিষেধ, আমরা লোভী চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে, বিরসবদনে বাড়ি থেকে বয়ে নিয়ে আসা তিতাসের কেক, কমলা, আপেল, কলা এইসব খেতাম।
সেই বয়সে এসব নিয়ে কথা বলার সাহসও ছিলো না। ফেরিওয়ালার সব বাজে খাবার খেলে শরীর খারাপ করবে। আর্মি রুল- নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ার কোন সুযোগ ছিলো না। বড় বয়সেও আর্মি অফিসারের সাথে থাকার কারণে নিয়মানুবর্তিতার পরাকাষ্ঠায় জীবন-যাপন। ওসব সহসা আর ছোঁয়া হয়ে ওঠে না।
বড় হয়ে আরিচায় ফেরি পারাপারেরও একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সারাজীবন সংবাদপত্রে পড়া আর ছবি দেখা, বিখ্যাত সেই আরিচা ফেরি, তাতে চড়ে ইলিশ মাছ খাওয়া। ইলিশ মাছ থেকে শুরু করে মশলা দিয়ে পান পর্যন্ত খেয়েছি- বাদ ছিল না কিছুই!
দু হাজার পাঁচ সালে আমি তখন গরমের ছুটিতে মেঘ’কে নিয়ে ঢাকাতে। তার কিছুদিন আগেই আব্বু’র ওপেনহার্ট সার্জারি হলো দেবী শেঠী’র তত্ত্বাবধানে, তখন চেকাপের সময়। হঠাৎ প্ল্যান হলো সবাই যাবো। গেলাম কোলকাতা, ছোটবেলার মতো ভিক্টোরিয়া, গঙ্গার পাড়, নিউমার্কেট। আব্বু-আম্মি ধানসিঁড়িতে বসে স্বাস্থ্যকর সব লাঞ্চ - ডিনার করে, আর আমরা বোনেরা নিউ মার্কেটে হেঁটে হেঁটে দই বড়া, আলু টিকিয়া, চিকেন রোল, চাওমিন, জুস ইত্যাদি খেয়ে বেড়াই। এই আমাদের লাঞ্চ - এই আমাদের ডিনার। বোনেরা সব একসাথে ঘুরে বেড়াই, মুক্তির বিশাল আনন্দ!
দেবী শেঠী’র হাসপাতাল থেকে আব্বুকে কিছু টেস্ট করতে দেয়া হলো। বললো তিন-চার দিন পর যেতে। চিরচেনা কোলকাতায় তিন-চার দিন কী করবো! ঝট করে ঠিক করলাম, পুরি-ভূবনেশ্বর ঘুরে আসি।
গেলাম বাবা-মেয়ে ট্রেনের টিকেট করতে, টিকেট পাওয়া যাবে, কিন্তু লোকাল; থেমে থেমে যাবে। আর ডিরেক্ট যেতে হলে সে ট্রেনের জন্যে আমাদের আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের তো এক মুহূর্তের জন্যেও তর সইছে না। লোকালের টিকেটই কেনা হলো।
ট্রেনে চড়ে বসার আনন্দই অপার। হোক লোকাল আর হোক আন্তঃনগর। শহুরে কোলাহলকে পেছনে ফেলে সবুজ দিগন্তের বুক চিরে কু ঝিকঝিক ডাকে এঁকেবেঁকে চলছে ছুটে দু’পায়ে ভর দিয়ে। ট্রেন প্রতি স্টেশনে থামছে আর ফেরিওয়ালা উঠছে তাদের পসরা নিয়ে। আমি সেই আবদারের গলায় আব্বুকে বললাম- আব্বু, প্রতি স্টেশনে যা উঠবে, আমি তাই খাবো, তুমি আমাকে খাওয়াবে। না করতে পারবে না। দশ হাজার মাইল দূর থেকে আসা মেয়ের আবদারকে সহসা কী না করা যায়!
যে কথা সেই কাজ। প্রতি স্টেশনে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ডাব, পেয়ারা, আমড়া, বুট ভাজা, সিঙ্গারা থেকে পাঁপড় ভাজা; সব খেতে খেতে যাচ্ছি। দুপুরের দিকে গরমে, দিগন্তজোড়া মাঠ থেকে জানালা দিয়ে বয়ে আসা শীতল বাতাসে, কিংবা হুটোপুটির ক্লান্তিতে দু’চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো। ঘুমিয়ে পরলাম মায়ের কোলে মাথা দিয়ে। বিকেল বিকেল ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। দেখি আব্বু কয়েকটা প্যাকেট হাতে ধরে বসে আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, আব্বু কী এসব?
আব্বু বললো, তুই না বললি, ট্রেনে যা উঠবে সব খাবি? তুই তো ঘুমিয়ে পরলি। তখন যে ফেরিওয়ালারা উঠলো সেসব কিনে রাখলাম। এখন খা।
বললাম, না এখন আর খাবো না।
সেসব বললে তো আর হবে না, আমি কিনে নিয়ে বসে আছি; এখন তোকে খেতে হবে।
সেই ভর সন্ধ্যেয় আবছা আঁধারে গড়িয়ে যাওয়া ট্রেনের কামরায় আবার বাবা মেয়ে’তে এই নিয়ে মধুর কথা’র পিঠে কথা’র খেলা।
জীবনে অনেককিছুই খুব সহজে পেয়ে গেছি বলে অনুভব করতে পারি নি কখনো, আবার অনেক কিছুর বিনিময়েও জীবনে অনেক কিছু মেলে না।
আপনাকে আমাদের ‘তুমি’ করে বলা নিষেধ। আপনার পারিবারিক নিয়ম, বংশের নিয়ম, ‘আপনি’ করে বলতে হবে, কারণ আপনার দাদা’ও আপনাকে আপনি করে বলতেন। যদিও অনেক সময়ই ‘তুমি’ এসে যায়। অন্যান্য অনেক পারিবারিক ঐতিহ্যের মতো ‘আপনি’ করে বলার এই ঐতিহ্যও ধরে রাখতে পারে নি আপনার ছেলে মেয়েরা। মাত্র এক জেনারেশনেই আপনার চোখের সামনে, আপনার নাতি-নাতনীরা তাদের বাবা মা’কে তো তুমি বলেই, আপনাকেও ‘তুমি’ বানিয়ে দেয়।
আব্বু আপনাকে কখনোই বলা হয় নি, আপনার ছেলেমেয়েরা আপনাকে কতোটা ভালো বাসে। যদিও আমরা জানি, আপনি জানেন, আপনি টের পান। আমাদের সংস্কৃতিতে নেই, ‘লাভিউ আব্বু’ বলাটা। হয়তো এখন আছে কিছুটা, কিন্তু আমরা তো পুরনো, তাই বদলাতে পারি না। আম্মি’কে যতোটা দ্রুত বুকে জড়াতে পারি, কাছে টানতে পারি, আপনাকে পারি না; কিন্তু ভালবাসি অনেক-অনেক-অনেক! আপনি আমাদের ‘এক আকাশ ছায়া’। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় বলতে হয়, ‘বটবৃক্ষ’।
মাঝে মাঝে যখন মেঘে’র জন্যে খাবার নিয়ে বসে থাকি, তখন কেবলই সেই ট্রেনের সন্ধ্যার কথা মনে হয়। আর ভাবি, মেয়ে ঘুমিয়ে পরলেও তার আবদার হাতে নিয়ে বাবা জাগে। হ্যাঁ আব্বু, সন্তানস্নেহই জাগিয়ে রাখে।
হ্যাপি ফাদার্স ডে আব্বু- আপনার চেয়ে ‘মায়া-ধরা’ কাউকে এ জীবনে দেখি নি, আর দেখা হবেও না- আর কেউ নেই। শত অপরাধ আপনার কাছে জমা আছে, জানি না চেয়েই ক্ষমা পেয়ে যাবো, আপনার মনের মতো না হয়েও জানি; ভালোবাসা কমে নি একটুকুও। চিরজীবন আপনাকে ঠিক এইভাবেই পাশে চাই। লাভিউ আব্বু, লাভিউ আ লট।
একটুপরেই আপনাকে ফোন করবো, বলবো-‘হ্যাপি ফাদার্স ডে’ আব্বু। আপনি লজ্জা লজ্জা গলায় ‘থ্যাঙ্কু’ বলে চট করে অন্যকথায় চলে যেতে চাইবেন জানি। আমি আবারও জিজ্ঞেস করবো, আজকে কে কী করলো আপনার জন্যে? আপনি খুব লজ্জিত গলায় জানাবেন, বৌমা এইকরেছে, রাজা ওই করেছে, আবার অন্যদিকে কথা ঘোরাতে চাইবেন। জানতে চাইবেন- ‘মেঘ কেমন আছে’। আমিও সবিস্তারে বলবো, মেঘ কী কী করেছে।
সবার জন্যে আপনি দু’হাত উজার করে দেবেন, কিন্তু আপনাকে কেউ কিছু দিতে গেলেই কুণ্ঠিত হয়ে যাবেন। আমাদের সবার অসুখে আপনি রাত জেগেছেন, কিন্তু আপনার অসুখে রাত জাগতে গেলেই বাধা দেন। বলেন, ‘আমি ভাল আছি’, ‘যা গিয়ে ঘুমা, কষ্ট হচ্ছে তোর’। কারো কাছ থেকে কিছু নিতে আপনি খুবই কুণ্ঠিত।
তারপরও ‘হ্যাপি ফাদার্স ডে আব্বু’। আমার ছোট আব্বুদেরকেও ফাদার্স ডে’র শুভেচ্ছা। তোমরা আমাদের জীবনে এসেছিলে বলেই না আমরা আজ কাণায় কাণায় পূর্ণ হয়েছি। মেঘের আব্বুকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা - পৃথিবীর সব বাবাদেরকে অভিনন্দন।
যথারীতি আমাদের ছোট্ট মেঘ, তার বাবাকে "হাউজ এরেস্ট" করে রেখে টুকটুক অনেক আয়োজন করে যাচ্ছে - আমি তাকে সাহায্য করছি আর ঠিক করে কিচ্ছু পারি না কেন, তার জন্যে বকা খাচ্ছি .........
Nice Dear
ReplyDelete