এক একটা দিন
এক একটা ঘোরের মধ্যে যায়। নিস্প্রাণ সোমবার সকালে অফিসের একঘেয়ে কাজের মাঝে নিউ ডট
এনএল চাপতেই চক্ষু ছানাবড়া। বাংলাদেশ সবচেয়ে প্রথমে দাঁড়িয়ে আছে, দুর্ঘটনার খবর
নিয়ে। হাত পা গুলো ঠান্ডা ঠান্ডা লাগতে লাগলো। আমাদের ছোটবেলা কেটেছে প্লেন
হাইজ্যাক আর প্লেট দুর্ঘটনার খবরের মধ্যে দিয়ে কিন্তু তখন জানতাম এগুলো পেপারে
থাকা লোকদের হয়, আমাদের মত সাধারণ মানুষদের হয় না। যতদিন না ঘরে ঘটলো উপলব্ধিই
করতে পারলাম না, এরা কারো না কারো ঘরেরই মানুষ, ঠিক এই আমাদের মত।
কাজের কারণে
ভাইকে অনেক ফ্লাই করতে হয়। একদিন দুপুরে বাসায় ফোন করে ভাইয়ের গলা পেয়ে খুব চমকালাম,
অফিসে থাকার কথা। বেজার গলায় বললো, বাইরে যেতে হবে, ফ্লাইট রেডি হলে অফিস থেকে খবর
দেবে, তখন যাবো। আমি হেসে ফেললাম কথা শুনে, ভাই আমার হাসি শুনে বললো, চার্ট এয়ারের
অবস্থা তো জানো না, এসব প্লেনে উঠলে পেটের মধ্যে বাটার ফ্লাই দৌড়াদৌড়ি করে। এতটাই নাইফ আমি, ইউরোপীয়ান স্ট্যান্ডার্ডে অভ্যস্ত যে, ভাইয়ের
টেনশানটা অনুভবই করতে পারলাম না, উলটো বললাম, বাসার বড় কালো ছাতাটা নিয়ে যেও, এসব ফ্লাইট
তো তত ওপরে ওঠে না, সময় মত প্যারাস্যুট না খুললে ছাতা খুললেও কাজ দেবে।
ফোন ছেড়ে যথারীতি আমি
সেসব ভুলেও গেলাম। পরদিন সংবাদপত্রে সংবাদও দেখলাম, ইউনাইটেডের
প্লেন দুর্ঘটনায় পরেছিল, প্লেনের জানালা ভেঙে যায়, ক্রু আহত হলেও, যাত্রীরা শেষ পর্যন্ত নিরাপদে অবতরণ
করতে সক্ষম হন। আমার তাও একবারও মনে আসেনি, এখানে আমার ভাই থাকতে পারে। কারণ,
আমি তো জানি সেসব যাদের হয় তারা শুধু পেপারে থাকে। যতক্ষণ বাসা থেকে আমাকে না জানালো
হলো, আমি জানতামই না কি অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্যে।
কয়েকদিন ট্রমা’র মধ্যে
ছিলাম, আস্তে আস্তে জীবনের নিয়মে ট্রমা কেটে বেড়িয়েছি। "ভাইয়া"
আমার চেনা মাত্র একজন মানুষ যে বিমান দুর্ঘটনা সারভাইভ করেছে। তার অনেকদিন পর
যখন কোন এক নির্জন সন্ধ্যায় ভাইয়ের মুখোমুখি হলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি সেই মূহুর্তে
কি ভেবেছিলে ভাইয়া? ভাইয়া বললো, বেশি কিছু না, এই ভাবলাম, আব্বু কে হিসেব গুলো বুঝিয়ে
দিয়ে যেতে পারলাম না, তুই এটা করে দিতে বলেছিলি, সেটা দেয়া হলো না, ও এটা বলেছিলো,
সে ওটা বলেছিলো, জিনিস গুলো সব হাফ ডান পরে রইলো, শেষ করে যেতে পারলাম না, ক’দিন সবার
একটু সমস্যা হবে। এর বেশি কিছু আর ভাবি নি।
আজ সারাদিন
সেসব কথা মনে আনাগোনা করছে। ফেসবুকের হোমফীড জুড়ে কত মানুষের হাস্যোজ্জল মুখ ভেসে
বেড়াচ্ছে,
নানান ভাষায় চেক ইন দিয়েছে, হানিমুন, ফান, বেড়ানো কত কি? তারা শেষ মূহুর্তে
বুক খামচে ধরে কি এরকম ভাবেই মৃত্যুর অপেক্ষা করেছে? টু ডু লিস্ট ভেবেছে? কি কি
করা হলো না, কত কি করার ছিল, কত পরিকল্পনা ছিল, কত ঘুরবে, ছবি তুলবে, বাড়ি ফিরে নেপাল
থেকে কিনে আনা ওয়াল হ্যাঙ্গিং দিয়ে বসার ঘরটা সাজাবে। কি করে মানা যায় তারা আর এখন নেই!
সব শোকের সান্ত্বনা
হয় না।
আহারে জীবন, আহারে জীবন, আহারে জীবন আহারে আহা..
লেখার শিরোনামটি অনুপম
রায়ের গানের ছায়া থেকে নেয়া
১২/০৩/২০১৮
No comments:
Post a Comment