Sunday 12 August 2018

তুমি এখন বড় হচ্ছো


মনোবিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক রচিততুমি এখন বড় হচ্ছো” পড়লাম। তিনি বাংলাদেশর প্রয়াত বিখ্যাত কবি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিনী। আনোয়ারা সৈয়দ হক নিজের লেখালেখির জন্যে বাংলা ভাষায় অনেকের শ্রদ্ধাভাজন ও নমস্য চিকিৎসক হিসেবে ব্যস্ত দিন কাটানোর পরও সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই অকৃত্রিম টান, নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য  উঠতি বয়সের বাচ্চাদের মানসিক জগত, তাদের দ্বিধা দ্বন্দ্ব, জানা না জানা প্রশ্ন উত্তর নিয়ে লেখা এই বইখানা। বইটি পড়তে পড়তে কিছু কিছু জায়গায় এতটাই খটকা লাগলো যে না উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না। একজন কথাসাহিত্যিক এরকম একটা জটিল ব্যাপার নিয়ে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে বই লিখেছেন যেটি সামাজিক ভাবে জনপ্রিয়ও হয়েছে, সেটা আমাকে রীতিমত পীড়া দিচ্ছে। তার মত বিখ্যাত অবস্থানের উঁচুতলার কারো সমালোচনা করা আমার মত কারো জন্যে ধৃষ্টতা তো বটেই কিন্তু মনের খরখর যায় না কিছুতেই।

বইটির চার নম্বর অধ্যায় “তোমার শরীরের সৌন্দর্য” পৃষ্ঠা নম্বর আটাশ, --- সেখানের একটি অংশে লেখা আছে “প্রতিটি বংশের নিজস্ব কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য আছে থাকে, যা অন্য কারো থাকে না। তোমার গায়ের রঙ সাহেবদের মতো হবে,  নাকি আবলুস কাঠকেও লজ্জা দেবে, এসবই কিছুটা ভাগ্যের খেলা আর বেশির ভাগই বংশগতির খেলা, সুতরাং এর কোনটার ওপরে তোমার হাত নেই।“

ছয় নম্বর অধ্যায়ের নাম “টানাপোড়েন আর টানাপোড়েন” পৃষ্ঠা নম্বর সাইত্রিশ, --- “যদি কুৎসিত কোন মানুষ সত্যি সত্যিই জানতো সে দেখতে কুৎসিত, তাহলে অবশ্যই ভালো জামাকাপড় পরা বা প্রসাধন করা ছেড়ে দিতো, চারখানা গামছাই হতো তার দিন-রাতের পরিধানের সম্বল, মুখের দাঁড়ি-গোঁফ কামাবার প্রয়োজনই মনে করতো না। খামোকা পয়সা খরচ করবে কেন। এমনকি যে মানুষের মাথায় চুল নেই, যার দাঁত নড়বড়ে বা যার রঙ আবলুস কাঠের মতো কালো বা যার মাজা তিন মাইল চওড়া, সে পর্যন্ত নিজেকে আয়নায় সুন্দর দেখে।“ 

বেশীর ভাগ মানুষই লেখালেখি করেন নিভৃতে, একান্তে। নিজের অজান্তেই সেখানে ভেতরের ভাবনা গুলো বেরিয়ে আসে, শালীনতা, ভদ্রতা বা সুশীলতা দিয়ে তা সব সময় চেপে রাখা যায় না। বইটি লেখা হয়েছে এগারো থেকে পনের বছরের বাচ্চাদের জন্যে যারা বয়ঃসন্ধি’র সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। দুই হাজার বারো সাল অব্ধি এটি’র ষষ্ঠ মুদ্রণ হয়েছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো বাচ্চারা যদি গায়ের রঙ নিয়ে আগে চিন্তা না ও করতো এই বই পড়লে তারা চিন্তিত হয়ে যাবে।  গায়ের রঙ মানেই “সাহেব আর আবলুস” এর বাইরে বা মাঝামাঝি কিছু নেই? একজন কথা সাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী যদি এ ধরনের বর্ণ বিদ্বেষ লালন করেন তাহলে বাকীদের কথা বলা বাহুল্য মাত্র গৌড় বর্ণ মানেই সাহেব? উঁচু কিছু? আবলুস মানেই খারাপ? কালোদের মাঝে সৌন্দর্য নেই? সাঁওতাল কিংবা কঙ্গোর মানুষদের দেখেছেন কখনো চোখ মেলে?

 হুমায়ূন আহমেদ তার কোন এক বইয়ে লিখেছিলেন, কিংবা এলেবেলে সিরিজে, বাঙালি ছাপার অক্ষরে যা পড়ে তাই বিশ্বাস করে ফেলে। সে দিক ভাবলে এই বইয়ের প্রভাব মারাত্বক হতে পারে। এমনিতেই বাংলা সাহিত্য জুড়ে শুধুই সৌন্দর্যের বর্ণনা, শ্যামকালিয়া "কৃষ্ণ"কে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যে কোন কালো বর্নের কোন প্রখ্যাত নায়ক নায়িকাই নেই। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য কালো বর্ণের নায়িকা নিয়ে কিছু উপন্যাস লিখেছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ, কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।“ যদিও তাঁর নিজের উপন্যাসের নায়িকারা সৌন্দর্যের দিক থেকে অপ্সরীর কাছাকাছিই থাকতো।   

কিশোরী বয়সে পড়েছিলাম বুদ্ধদেব গুহের “বাবলী”, মোটাসোটা শ্যামলা তরুণী’র সাথে প্রেম হয়েছে এক চৌকষ আইএস অফিসারের। বাবলি নিজেও মেধাবী, ভাল টেনিস খেলে, সে ও ভাল চাকরি পেয়েছে। কিন্তু প্রেম হয়ে যাওয়ার পর সে বাংলার লেখকদের কল্পনার চিরাচরিত নারী হয়ে গেলো, নিজেকে সুন্দরী করে প্রেমিকের সামনে উপস্থাপনে ডায়েট আর ব্যায়ামে লেগে গেলো, ঐদিকে পুলা কিন্তু আছে ঠিকঠাক নিশ্চিন্তে। যে বই পড়ে কিশোরি বয়সে মুগ্ধ হয়েছি সে বই পড়েই আবার পরে বিরক্ত হয়েছি। এমন ছাগল কেমনে ছিলাম, সব কিছুতেই মুগ্ধ কেমনে হইতাম তা নিয়ে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়েছি।  

তোমার অস্তিত্ববোধঅধ্যায়ের সাতান্ন পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “এতোদিন তুমি ছোট্ট ছিলে, পরিবার বা পরিবেশ সম্পর্কে অতো বেশি সচেতন ছিলে না, থাকার দরকারও ছিলো না, কিন্তু এখন তুমি বড় হচ্ছো, এখন তোমার সচেতন হবার সময় এসেছে আগে হয়তো খালি গায়ে, খালি পায়ে রাস্তায় নেমে বস্তির ছেলেমেয়েদের সাথে ডাংগুলি খেলতে, এখন আর ইচ্ছে হলেও তা করতে পারছো না তোমাকে ভাবতে হচ্ছে নিজের সম্পর্কে তুমি আর আগের মতো মিশতেও পারছো না যারতার সঙ্গে

এমন বিদ্বেষমূলক শিক্ষনীয় বই বাংলাদেশে চলাই সম্ভব বস্তির ছেলেমেয়ে, যারতার এর মতো শ্রেণীবৈষম্যমূলক কথাবার্তা বইতে লিখে কিশোর কিশোরীদের হাতে যিনি তুলে দিচ্ছেন তিনি একজন অনুশীলনরত মনোবিজ্ঞানী। তারপরও আমরা একটি সংবেদনশীল, মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন ভবিষ্যত প্রজন্ম আশা করে যাবো। সেটি আমাদের নিজেদেরকে তৈরী করত হবে না, সেটি আকাশ থেকে এমনি টুপ করে পরে যাবে আশা করছি।

“তোমার যৌন কাতরতা” অধ্যায়ের তিরাশি পৃষ্ঠায় তিনি কিশোরীদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, “মানুষের শরীর হচ্ছে পবিত্র এক মন্দিরের মত। এ শরীরও পূতপবিত্র মনে আরতি করতে হয় অর্থ্যাৎ শ্রদ্ধা জানাতে হয়, সে শ্রদ্ধা জানাবে তুমি। শারীরিক সম্পর্ক সামান্য একটু এগোলেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শুরু হবার সময় মনে হয় যেন কি-না-কি হয়ে যাবে, বুঝি পৃথিবীটাই হয়ে যাবে ওলোটপালট। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, মানুষের শরীর এক বদ্ধ জলাশয়, একটুতেই এর জল ঘোলা হয়ে ওঠে। যদি না প্রতিদিন তুমি এর তলা থেকে কাঁদা – পাঁক তুলে ফেলে দাও। পবিত্র শরীর হচ্ছে তোমার এ্যাসেট বা সম্পদ।“ এরকম আরও বহু কিছু লিখেছেন, আমি সামান্য একটু উল্লেখ করলাম মাত্র।

এই বয়সে কিশোরীরা প্রাকৃতিকভাবেই শরীর নিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত থাকে। নানা ছোট ছোট কারণে এরা নিজেদেরকে বড় বড় আঘাত করে, নিজেদের ক্ষতি করে, অনেক সময় আত্মহননের মত সিদ্ধান্ত নেয়সামাজিক কারণে অভিভাবকরাও পরিস্থিতির শিকার হয়ে পরে। সে জায়গায় একজন লেখিকা ও মনোবিজ্ঞানী যদি তাদেরকে আশা’র কথা শুনিয়ে তাদের ভেতরের শঙ্কা বা হতাশা দূর না করে উলটো মধ্যযুগীয় আবেগীয় কথাবার্তা দিয়ে তাদের আবেগ উস্কে দেয় তাহলে অঘটন বন্ধ করে আশার কথা শোনাবে কে?  জীবন চলে জীবনের মত, ছোঁয়াছুয়িতে জীবন শেষ হয়ে যায় বুঝি? সেটা তবে বিশ্বব্যাপী না হয়ে শুধু ভারতবর্ষেই হতে হবে কেন? কিংবা মুসলিম বিশ্বে? এসব কিন্তু এক অর্থে “হনার কিলিং” এর প্ররোচনা। লেখিকা প্রায় আট বছর বিলেত বাস করেছেন কিন্তু তার লেখায় বৈশ্বিক ব্যাপারটা প্রায় অনুপস্থিত। হয়ত তিনি বইটির অর্থনৈতিক সাফল্যের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে যেসব মধ্যবিত্তীয় মানসিকতার কথাবার্তা লিখলে অভিভাবকরা খুশী হয়ে বইটি বাচ্চাদের পড়তে দেবেন, সেই সব কিছুই লিখে গেছেন।

প্রাসঙ্গিক ভাবে নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা আমি বীরাঙ্গনা বলছিবইটির কথা মনে পড়লো। বইটিতে কয়েকবার একটি লাইন ঘুরেফিরে এসেছে, “পাকিস্তানি সেনারা যখন আমাদের পেয়েছে তখন আমরা রাজাকারদের উচ্ছিষ্ট” --- পুরো বইটির মধ্যে এই লাইনটি আমার কাছে যথেষ্ঠ পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। লেখিকা কেন এই ধরনের শব্দ চয়ন করেছেন, তিনি জানেন। একজন জীবন্ত মানুষ কী করে উচ্ছিষ্ট হতে পারে? যতো শারীরিক লাঞ্ছনাই তিনি ভোগ করে থাকুন। একজন প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখিকা যিনি হৃদয় দিয়ে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্যে দিন রাত এক করে খেঁটে গেছেন তিনি কী অন্য কোন শব্দ চয়ন করে এই পারিপার্শ্বিকতার ছবিটা আঁকতে পারতেন না? কোন মানুষ সর্ম্পকে এ ধরনের কথা ভাবতে আমার হৃদয় মানে না। মানুষের দেহ কি খাদ্য বস্তু? শারীরিক কারণে কেউ কী উচ্ছিষ্ট কেউ হতে পারে? পারে ক্ষতিকর স্বভাব চরিত্রের কারণে যেমন রাজাকাররা।

“তোমার লেখাপড়া” অধ্যায়টি আমার ভাল লেগেছে। “তুমি এখন বড় হচ্ছো, তুমি স্কুলে যাও নিয়মিত, তোমার ওপরে লেখাপড়ার চাপ পড়েছে বেশি, ক্লাসের পড়া ছাড়াও তোমাকে স্কুল শেষে আলাদা কোচিং নিতে হয় পরীক্ষায় ভালো করার জন্যে, রেজাল্ট ভালো হলে ভর্তি হবে তুমি বিজ্ঞান শাখায়, আর খারাপ হলে মানবিক-এ। তুমি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করলে তোমার অভিভাবকরাও মাথা থাবড়ে বেড়াবেন দুঃখে, কারণ তাদের ধারণা কেবল বুদ্ধিমান ছেলেরাই বিজ্ঞান পড়ে আর গবেটগুলো পড়ে মানবিক-এ। নিজের কথা ভুলে, অভিভাবকদের কথা চিন্তা করেই তুমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছো পড়াশোনা করার অতিরিক্ত বোঝা, যা তোমার ছোট্ট কাঁধটাকে মাঝে মাঝেই বাঁকিয়ে নিচু করে ফেলে।“

এখানে লেখিকা বাচ্চাদের কে নিজেদের পছন্দের বিষয় নির্বাচন করতে, সর্তক হতে, কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতে, ভবিষ্যত গড়ে তুলতে বেশ কিছু বাস্তবধর্মী উপদেশ দিয়েছেন। শুধু বাবা-মায়ের নয় নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়েও ভাবতে বলেছেন। পড়াশোনায় যারা মাঝারি তারা তাত্বিক পড়াশোনার বাইরে, ব্যবহারিক বিষয়গুলো’র প্রতি মনোযোগ দিতে পারে, সেসব নিয়েও বেশ আকর্ষনীয় ভাবে লিখেছেন।

আঠারোটি অধ্যায়ে ভাগ করে চুরানব্বই পৃষ্ঠার সুধীজন প্রশংসিত, কিশোর কিশোরীদের জন্যে লিখিত মনোবিজ্ঞানের বইটি পড়ে কিছুটা হতাশ  হয়েছি তো বটেই। 

তারপরেও বলবো, বাংলাদেশের সামাজিক ট্যাবুতে এখনও অনেক পরিবারে মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে আছে যারা জীবনের এই কঠিন সময়টা নিয়ে নিজেরা আলোচনা করতে বা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। জীবনের অনেক সহজাত ও স্বাভাবিক জিনিস এড়িয়ে যায়। বাংলা ভাষায় এই নিয়ে লেখাও হয়েছে খুব সামান্য। সেদিকটা বিবেচনা করলে যাদের বাড়িতে এগারো থেকে পনের বছর বয়সী বাচ্চা আছে, তাদের পরিবারের বাবা-মা এবং বাচ্চাদের সবারই এই বইটা পড়ে নেয়া ভাল। ইউরোপের স্কুল গুলো এ ব্যাপারে প্রচুর সাহায্য করে, সে প্রত্যাশা তো দেশে নেই তাই কিছু না থাকার মধ্যে এটিই থাকা।

১০/০৮/২০১৮




No comments:

Post a Comment