Friday 14 June 2019

সত্যজিৎ রায়ের জানা-অজানা


খুব ছোট বয়সে, হয়ত বারো কি তের, ভিসিআরে বাসায় সিনেমা দেখলাম ‘তিন ভুবনের পারে’। সারা বাসা, আত্মীয়, বান্ধবী মহল যখন উত্তম কুমারের ফ্যান আমি তখন ‘সৌমিত্র’ প্রেমে দিওয়ানা। দিনরাত আমার মাথায় নেচে যায় ছিপছিপে সেই তরুণের টুইস্ট ‘জীবনে কি পাবো না, ভুলেছি সেই ভাবো না’। সৌমিত্রের সিনেমা খুঁজে খুঁজে দেখা শুরু হলো। যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেখানে সত্যজিৎ রায় অবধারিত। সৌমিত্রকে খুঁজতে যেয়ে হয়ে গেলাম সত্যজিৎ রায়ের আজীবনের ফ্যান। অপুর সংসার, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত কিংবা জয়বাবা ফেলুনাথ। অনেকেই বলে থাকেন সত্যজিৎ রায় নিজে লম্বা বলে, সৌমিত্রের প্রতি তার এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব ছিল কিন্তু অভিনয় দক্ষতা দেখার পর সেটাকে কি নিছক পক্ষপাতিত্ব বলার সুযোগ কি থাকে? সত্যজিৎ রায় নিজে গুণী আর মেধাবী ছিলেন, তাই তার কাজ ভাষায় কে ফুটিয়ে তুলতে পারবে তাকে খুঁজে নিতে পেরেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের বেশির ভাগ সিনেমার প্রধান পুরুষ চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র। আর যার সিনেমার হাতেখড়ি হয়ে যায়, সৌমিত্র, সত্যজিৎ রায়ের সাথে তার সিনেমা দেখার মোড় সারা জীবনের জন্যে ঘুরে যায় অন্যরকম স্বাদের সব সিনেমাতে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর একজনের মাঝে এরকম বহুমুখী প্রতিভা বাংলা ভাষায় বিরল। লেখা, শিশু সাহিত্য, চলচিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, আঁকা, প্রকাশক, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক। প্রতিটি জায়গায় ছিল সমান দক্ষতা। উনিশো একুশ সালের দোসরা মে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে এই কিংবদন্তির জন্ম। কাছের মানুষদের কাছে সত্যজিতের ডাকনাম ছিল ‘মানিক’। ওই বাড়িটিকে এককালে বলা হতো ‘পূর্ব বাংলার জোড়াসাঁকো’। বাংলা সাহিত্যের তীর্থভ‚মি হিসেবে স্বীকৃত এই বাড়িতে জন্মেছেন প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, শিশু সাহিত্যের আরেক অমর নাম সুকুমার রায় চৌধুরীসহ অন্যান্য যোগ্য উত্তরসূরি। এই বাড়িতেই একদা কবি, সাহিত্যিক ও জ্ঞানী-গুণীদের মিলনমেলা বসত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঐতিহাসিক এই বাড়িটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।


মাত্র ৫ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে প্রথম এসেছিলেন বাংলাদেশে। ১৯৭২ সালে আবারো এসেছিলেন মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে। সেদিন পল্টন ময়দানে প্রধান অতিথির প্রদত্ত ভাষণে বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেন ‘আমার কুড়ি বছরের চলচ্চিত্র জীবনে বিশ্বের বহু স্থান থেকে এবং আমার নিজ দেশ থেকে অসংখ্য পুরস্কার, পদক এবং সম্মান লাভের সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু আজ বাংলাদেশে যে সম্মান, যে ভালোবাসা আমি পেলাম তা সবকিছুর কাছে ¤øান হয়ে গেছে। আমি কোনোদিন এই জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলব ভাবতে পারিনি। আমি বক্তা নই। আমি থাকি নেপথ্যে। ছবি আঁকি, পরিচালনা করি। আজ সকালে ঢাকায় এসে আমি যা দেখেছি তাতে আমি অভিভূত। আমি বহুদিন থেকে শহীদ দিবসের কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানে এসে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না আপনারা বাংলাভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন।’


এই সতেরই মার্চ ‘থেস্পিয়ানস নেদারল্যান্ডসের’ আমন্ত্রণে এসেছিলেন সত্যজিৎ পুত্র প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায়, তাঁর স্ত্রী ললিতা রায়, অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী আর প্রযোজক সামিয়া জামান। ঠাণ্ডা, বৃষ্টি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোববারের সন্ধ্যায় এত মানুষের সমাগম দেখে, সন্দীপ রায় ঘরোয়া আড্ডায় যাকে বাঙালির চিরাচরিত ডাক নামের ঐতিহ্য ধরে সবাই ‘বাবুদা’ নামে ডাকে, অভিভ‚ত হয়ে বলেই ফেললেন, ‘বাবাকে সবাই এত ভালোবাসে আমি কল্পনাই করতে পারিনি, এই আবহাওয়া দেখে আমি ভাবিনি যে গোটা পঞ্চাশেকের বেশি লোক হবে, অথচ হল কানায় কানায় পূর্ণ।’ সন্দীপ রায় সাথে নিয়ে এসেছিলেন, সোনার কেল্লা, জয়বাবা ফেলুনাথের স্কেচ ও বুকলেট, আগ্রহীরা পরম যত্নে তা সংগ্রহ করেছেন। এমস্টেলভিনের এক থিয়েটারে সামিয়া জামানের প্রাণবন্ত পরিচালনায় এক ঘরোয়া আড্ডায় জানা গেলো অনেক অজানা তথ্য। সত্যজিৎ রায় যাকে বাংলার আগাথা ক্রিস্টি বলে অনেকে আর তার লেখা অনবদ্য চরিত্র ‘ফেলুদা’ যাকে স্কটিশ লেখক ও চিকিৎসক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের সমকক্ষ বাংলা চরিত্র বলে ধরে নেয়া হয়, সেই ‘ফেলুদা’কে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়ার জন্যে প্রযোজক পেতেন না। শিশুতোষ চলচিত্রের প্রতি প্রযোজকদের অপরিসীম অনীহা কাজ করতো। স্রেফ টাকার জন্যেই তাঁর অদম্য ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও ‘ফেলুদা’ সিরিজের আরও সিনেমা বানানো বাদ থেকে গেলো। কালজয়ী এই চরিত্রের এ বছরে ৫০ বছর পূর্তি হলো। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে সন্দেশ পত্রিকায় ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্প ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি প্রকাশিত হয়। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ওই সিরিজের ৩৫টি সম্পূর্ণ ও ৪টি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়।


তবে অবস্থার এখন অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, এখন বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ‘ফেলুদা’ এক জনপ্রিয় চরিত্রের নাম আর তিনি শুধু শিশু-কিশোরদের কাছেই আটকে নেই, বড়দের পৃথিবীতেও তার অনবদ্য বিচরণ। সন্দীপ রায় পিতার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে তৈরি করে যাচ্ছেন একের পর এক ‘ফেলুদা’। প্রযোজকরা নাকি এখন বলেন, ‘একটা অন্য সিনেমা বানিয়ে দিন আর দুটো ফেলুদা।’ সেই নিয়ে গল্প করতে যেয়ে সন্দীপ রায় বললেন, তাঁর বাবার সময় থেকেই অন্য সব সিনেমার শুটিং যেমন হোক হয়ে যায় কিন্তু ‘ফেলুদা’ করতে গেলে একটার পর একটা বাধা আসবেই। কখনো দ্বিগুণ কিংবা কখনো তিনগুণ খরচা হয়ে যায় ‘ফেলুদা’র শুটিংয়ে। দেখা যাবে লোকেশনে কিছু না কিছু সমস্যা হবে, নইলে অভিনেতা-অভিনেত্রী অসুস্থ, নইলে পুলিশের ঝামেলা ইত্যাদি। একবার ব্যাংকক থেকে শুটিং শেষে ফেরার পথে দমদমে কাস্টমস তাদের নেগেটিভ আটকে দেয়। সেই নেগেটিভ কাস্টমস থেকে বহু কষ্টে উদ্ধার করে পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পাঠানো হলেও পঁচাত্তর শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছিল বলে আবার শুটিং করতে হলো।

‘ফেলুদা’ এখন শুধু বাংলায় আটকে নেই। হিন্দি সিনেমার প্রযোজকরাও ‘ফেলুদা’ নিয়ে সমান আগ্রহী। একটি সিনেমা হিন্দিতে তৈরি হওয়ার পর বাবুদা দেখলেন, একটা সুন্দর সিনেমা হলো বটে কিন্তু ‘ফেলুদা’ হলো না। ‘ফেলুদা’ বলতে যে টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বাঙালি আমেজ আছে সেটি হিন্দিতে কিংবা অন্য কোনো ভাষায় আনা প্রায় অসম্ভব। যেমন- লুচি, আলুর দম আর গুড়ের সন্দেশ কিংবা সুক্তো আর ইলিশ ভাজা’র যে সংস্কৃতি, বাঙালির প্রাণে যে আবহটা তৈরি করে সেটিকে অন্য ভাষায় আনতে গেলে, ‘ফেলুদা’ আর ‘ফেলুদা’ রইলো কোথায়! সে তো অন্য এক চরিত্র দাঁড়িয়ে গেলো। তাছাড়া কিছু কিছু কথা’র সে স্বাদ, রস যা বাঙালি’র কাছে এক ধরনের দ্যোতনা তৈরি করে সেগুলোকে অন্য ভাষায় রূপান্তর করলে তার অর্থই হারিয়ে যায়, যেমন :

তবে রে
কিংবা বটে

এর হিন্দি বা ইংরেজি পাওয়া যায়? না আক্ষরিক অনুবাদ সেই স্বাদ এনে দিতে পারে? তাই বাঙালির ‘ফেলুদা’ বাঙালি হয়ে রয়ে গেছেন বাংলাতেই। সন্দীপ রায়ের সাথে বর্তমানে ফেলুদা হিসেবে আছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। অভিনেতা হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার কিন্তু আমার কাছে ফেলুদা সৌমিত্রই। ছোটবেলার পছন্দ বলে কথা। সত্যজিৎ রায় ছাড়া সে সময় তার মানের যে চলচ্চিত্র পরিচালকরা ছিলেন বিশ্বজুড়ে, কেউ শিশুদের নিয়ে কাজ করেননি। তিনিই এই ব্যাপারে এক মাত্র ব্যতিক্রম। অর্থনৈতিক ব্যাপারটা তিনি বরাবরই কম গুরুত্ব দিতেন, কাজটাই তার কাছে মুখ্য ছিল। সোসাইটি ফর দ্য প্রিজারভেশন অব সত্যজিৎ রায় আর্কাইভস প্রতি বছর ফেলুদা প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। কলকাতার মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুসারে দক্ষিণ কলকাতার লি রোডের নাম পাল্টে হয়েছে সত্যজিৎ রায় ধরণী। এই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক তাঁর জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছিলেন লি রোডের কাছের রাস্তা বিশপ লেফ্রয় রোডে। কাজেই, সেই সুবাদে লি রোডের নাম পাল্টে তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।


তবে শুধু ফেলুদা নিয়েই নয়, সত্যজিৎ ঠিক করেন যে, বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী ‘পথের পাঁচালী’ই হবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য। ১৯৫২ সালের শেষদিকে সত্যজিৎ তাঁর নিজের জমানো পয়সা খরচ করে দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন প্রাথমিক দৃশ্যগুলো দেখার পর হয়তো কেউ ছবিটিতে অর্থ লগ্নি করবেন। কিন্তু সেই আশার গুড়েবালি। সে ধরনের আর্থিক সহায়তা মিলছিল না তাঁর। ‘পথের পাঁচালী’র দৃশ্যগ্রহণ তাই থেমে থেমে অস্বাভাবিকভাবে প্রায় দীর্ঘ তিন বছর ধরে সম্পন্ন হয়। কেবল তখনই দৃশ্যগ্রহণ করা সম্ভব হতো, যখন সত্যজিৎ বা নির্মাণ ব্যবস্থাপক অনিল চৌধুরী প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান করতে পারতেন। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটি নির্মাণ সম্পন্ন হয় এবং ওই বছরই সেটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে এবং সেই সঙ্গে বহু পুরস্কার জিতে নেয়। বহুদিন ধরে ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রদর্শিত হয় ছবিটি। ছবিটি নির্মাণের সময় অর্থের বিনিময়ে চিত্রনাট্য বদলের জন্য কোনো অনুরোধই সত্যজিৎ রাখেননি। এমনকি ছবিটির একটি সুখী সমাপ্তির (যেখানে ছবির কাহিনীর শেষে অপুর সংসার একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’ যোগ দেয়) জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধও তিনি উপেক্ষা করেন।


অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, সত্যজিতের মতো বরেণ্য মানুষের নিজের কোনো বাড়ি ছিল না; মা, মামা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে এক ভাড়া বাড়িতেই সারা জীবন কাটিয়ে দেন তিনি। তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায় ও ছেলে সন্দীপ রায় দুজনেই সত্যজিতের কাজের সঙ্গে ছিলেন জড়িয়ে। বেশির ভাগ চিত্রনাট্য বিজয়াই প্রথমে পড়তেন এবং ছবির সঙ্গীতের সুর তৈরিতেও তিনি স্বামীকে সাহায্য করতেন। আয়ের পরিমাণ কম হলেও নিজেকে বিত্তশালীই মনে করতেন সত্যজিৎ। কেননা পছন্দের বই বা সঙ্গীতের অ্যালবাম কিনতে কখনোই কষ্ট হয়নি তাঁর।


চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তাঁর কাজের পরিমাণ ছিল বিপুল। তিনি নির্মাণ করেছেন ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তাঁর কাজের ‘ভার্সেটাইল’ রূপটি চির স্মরণীয়, অরণ্যের দিনরাত্রির পরিচালককে হীরক রাজার দেশেতে মিলিয়ে ফেলা শক্ত। অরণ্যের দিনরাত্রিতে চার শহুরে তরুণ ছুটিতে বনে ঘুরতে যায় এবং একজন বাদে সকলেই নারীদের সাথে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে যা তাদের মধ্যবিত্ত চরিত্রের নানা দিক প্রকাশ করে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে তিনি চলচ্চিত্রে রূপ দেন যদিও এই নিয়ে আমার সামান্য অনুযোগ আছে রায় সাহেবের প্রতি, চলচ্চিত্রে রূপ দিতে যেয়ে প্রায়ই তিনি মূল লেখা থেকে সরে যেতেন। হীরক রাজার দেশে নির্মাণ করেন, যেটিতে তাঁর রাজনৈতিক মতামতের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ছবিটির চরিত্র হীরক রাজা ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণাকালীন সরকারের প্রতিফলন। সত্যজিতের ছেলে স›দ্বীপের অনুযোগ ছিল তিনি সবসময় বড়দের জন্য গম্ভীর মেজাজের ছবি বানান। এর উত্তরে ও নতুনত্বের সন্ধানে সত্যজিৎ ১৯৬৮ সালে নির্মাণ করেন তাঁর সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি গুপী গাইন বাঘা বাইন। এটি ছিল সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্র কিশোরের লেখা ছোটদের জন্য একটি গল্পের ওপর ভিত্তি করে বানানো সঙ্গীতধর্মী রূপকথা। গায়ক গুপী ও ঢোলবাদক বাঘা ভ‚তের রাজার তিন বর পেয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে ও দুই প্রতিবেশী রাজ্যের মধ্যে আসন্ন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করে। ছবিটির নির্মাণকাজ ছিল ব্যয়বহুল, অর্থাভাবে সত্যজিৎ ছবিটি সাদা-কালোয় তৈরি করেন। অশনি সংকেত ছবিটির পটভ‚মি ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বৃহত্তর বাংলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ করলে বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে ৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই দুর্ভিক্ষ কিভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল তা-ই এই ছবির মূল উপজীব্য। বর্তমানে এই ছবিটি ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস গাইড টু দ্য বেস্ট ১,০০০ মুভিজ এভার মেড’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে একটি ছবি তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু পরে এ পরিকল্পনা ত্যাগ করেন এই মন্তব্য করে যে একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে তিনি শরণার্থীদের বেদনা ও জীবন-অভিযাত্রার প্রতিই বেশি আগ্রহী ছিলেন, তাদের নিয়ে রাজনীতির প্রতি নয়।


যদিও বহুবিধ নান্দনিক শাখায় তাঁর পদচারণা ছিল কিন্তু তাঁর স্বীকৃতি আর পুরস্কার এসেছে চলচ্চিত্র পরিচালনার মাধ্যমেই, সারা বিশ্বের মানুষ তাকে ধ্রুপদী চলচিত্র পরিচালক হিসেবেই জানে। চিত্রসজ্জা বা ভিজ্যুয়াল ডিজাইন সত্যজিতের পছন্দের একটি বিষয় ছিল এই দিয়েই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। সত্যজিৎ তাঁর জীবদ্দশায় পেয়েছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ডের ডিলিট পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎকে সে দেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার ‘লেজিওঁ দ’নর’ ভ‚ষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস এন্ড সায়েন্সেস তাঁকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করে। ওই সময়টায় ভারত সরকার তাঁকে দেন দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’। সেই বছরেই মৃত্যুর পর তাঁকে মরণোত্তর ‘আকিরা কুরোসাওয়া’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রয়াত পরিচালকের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর।


No comments:

Post a Comment