অনেকদিন পর চেনামুখগুলো দেখলেও হঠাৎ
একটু সময় লাগে সবকিছুতে আগেরমতো হয়ে উঠতে। অনেকদিনের না দেখা, না ছোঁয়ার একটা
প্রতিক্রিয়া আছেই। স্কাইপি, এসএমএস কিংবা দূরালপনী যন্ত্র পুরোটা দূরত্ব মনে হয়
অতিক্রম করতে পারে না। এর রেশ কাটতে কিছুটা সময় যায়। আমি বাড়িতে এলে আমার ছেলে
মেয়েগুলো কিছুদিন একটু দূর দূর দিয়ে ঘুরে ফিরে দেখে। তারপর একসময় জেনে যায়, আমি
এদেরই লোক। তখন ওপরে এসে ঝাপিয়ে ঘুপিয়ে পড়ে। মেঘলার ভাষায় আসো তোমাকে চ্যাপ্টা
ভ্যাপ্টা করে দেই। এবার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটালো আমাদের দুই ছেলে। আমাদের রাজাবেটা
এমনিতে চুপচাপ কিন্তু কোলে ওঠার ব্যাপারে একটু চুজি। সবার কোলে তিনি যেতে চান না। আমি
অনেক রাতে বাসায় ঢুকলেও একটু হাউকাউতো হয়ই। তাতে তার নিদ্রা টুটে গেলো। তিনি তার
মাতৃদেবীর কোলে উঠে ডাইনীং এ এলেন খুবই গম্ভীরমুখ করে। এতো রাতে কিসের উৎপাত।
ছোট্ট আঙ্গুলটা তার চেয়েও ছোট্ট গালে ঢুকিয়ে অবাক বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে
আছেন। হয়তো ভাবছেন এ আবার কে? আমি যেয়ে দুহাত সামনে বাড়াতেই, দু সেকেন্ড ভাবলেন
তারপর আমার কোলে চলে এলেন। সেইযে এলেন, এরপর যতোদিন বাড়ি ছিলাম, শুধু একবার বললেই
হতো, রাজা.........। নির্ভার নির্ভয়ে আমার আঙ্গুল ধরে ধরে পাড়াময় উনি ঘুরে
বেড়িয়েছেন। কতো জনমের চেনা আমি তার।
আরভিনও পাশে পাশে ছিল প্রথম থেকেই।
কিন্তু তার প্রথম ব্যাপারটা ছিল, ঐ বড় বড় স্যুটকেসে কি আছে সেই ভাবনায়। আমি এতো
ক্লান্ত ছিলাম ছুটির আগে এতোটাই ক্লান্ত যে ঢাকা যেয়ে ঐ বড় বড় ঢাউস স্যুটকেস খুলতে
আর ইচ্ছে করছিল না। তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন স্যুটকেস খুলছি না তখন অস্থির
হয়ে আরভিন বলেই ফেললো, কবে খুলবে মিষ্টিমা? কি আছে ওটাতে। আমি কিছু ডিজাইনটাইপ
ক্যান্ডি ফ্লস নিয়ে গেছলাম। যার কিছু কিছু ঢাকনা হয়তো অন্যকিছুর গুঁতোয় ফুটো হয়ে
গেছল। বাতাসে সেগুলো বক্সের মধ্যেই শুকিয়ে অনেকটা কমে গেছল। আমি ভাবলাম বাচ্চার
কেউ খেয়েছে কিনা। বিশেষ করে অরভিন অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে এগুলো কি মিষ্টিমা? আমি
আরভিনকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি খেয়েছো, সত্যি করে বলো? তিনবারের বেলা আরভিন তার
বড় বড় নিষ্পাপ চোখ আমার দিকে তুলে বললো, আমি কি চোর মিষ্টিমা? যে চুরি করে তোমার
জিনিস খেয়ে ফেলবো? আমার শিরদাঁড়া দিয়ে কি যেনো শিরশির করে নেমে গেলো। লজ্জায় আমি মাটির
সাথে মিশে যেয়ে কয়েকবার সর্যি বলেছি আমার আব্বুকে। কিন্তু বাসায় একটা ঝামেলা হয়ে
গেলো। কেউ কিছু খুঁজে না পেয়ে অন্যকে জিজ্ঞেস করলেই, সবাই উত্তর দেয়, আমি কি চোর
যে তোমার জিনিস নিয়ে যাবো? তখন আমাকে বলতে হয়, আমি জানি তুমি চোর না কিন্তু তুমি
কি আমার জিনিসটা দেখেছো?
দুপুরে খেতে বসলে সবগুলো খুটাখুটি করতে
থাকে অকারণেই। ভাইয়ের মেয়েটা তখন অনেক ফ্রী আমার সাথে। রেগে আমি বললাম কথা যে
শুনিস না জানিস আমি কে? তিনি
অবলীলায় উত্তর দেয় হুমম জানিতো, তুমিতো মিষ্টিমা। আমি এখানে ওদের ছাড়া থাকতে থাকতে
কেমন যেনো শুধু নিজের একটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাই। মনে হয় আমার কেউ নেই। আমি মরে
গেলে কারো কিছু আসবে যাবে না। সব ভুল সব ফালতু। কিন্তু বাসায় গেলে খেতে বসলে ওরা
যখন আমাকে টানে, মিষ্টিমা তুমি আমার পাশে বসো কিংবা আমি মিষ্টিমার পাশে বসবো। তাদের
মায়েদের হাতে খায় না। তাদের মায়েদের হাত থেকে রক্ষা করতে আমি নিয়ে আসলে, দিব্যি
আমার কাছে খেয়ে নেয়। এমন করে গায়ে লেপটে থাকবে যেনো সারা পৃথিবীর বজ্রপাতের
একমাত্র আশ্রয় আমি। রাতে শোয়ার সময়ও একই কান্ড। বিছানাপত্র ফেলে রেখে সব মাটিতে
ঢালা বিছানায়। টানাটানি, মিষ্টিমা তুমি আমার কাছে শোও, আমি তোমার পাশে শুবো। শুধু
পাশে শোওয়া না, যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার বুকে মাথা ঢুকিয়ে শুবে তাতে আমিতো
আমি, মেঘ শুদ্ধ অবাক হয়, তাদের মাকে অন্য সবাই এতো ভালবাসে। এতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ
তার মা!
এতো একদিকের কথা।
অন্যদিকেও আছে কারো চাচি কারো মামি। কারো কারো আবার দাদী নানী। কি করবে আমার
জন্যে। কি হলে আমার আরো একটু বেশি ভাল লাগবে কিংবা বেশি আরাম হবে তারজন্যে তারা
ব্যস্ত। আর মেঘকে জানের টুকরা করে কোলে তুলে নাচবে, কি খাবে মেঘ, কি খেলবে। মেঘ এখন সারাক্ষণ প্রার্থণা করছে আমাদের চাকরি চলে যাক কিংবা কিছু একটা হোক
যাতে আমরা দেশে যেয়ে থাকতে বাধ্য হই। বারবার বলে, এখানে আমি একা একা কি করে থাকবো?
আমার খেলারতো কেউ নেই। চলো বাংলাদেশে চলে যাই। সেখানে থাকি সবাই। ভরভরতি এই সংসার
থেকে খালি বাসায় আসলে প্রথম কয়েকটা দিন শরীর চলতে চায় না। শরীর চলবে কিভাবে মন আর
আত্মাতো সেখানে রেখে আসি। ফোনে আমার গলা শুনলে ফোনটা আছরে পাছরে আমাদের রাজাবেটা
নাকি খুঁজে দেখে, মানুষটা কোথায়, তাকেতো সে চেনে। গল্পগুলো যখন শুনি হৃদয় ভেঙ্গে
চৌচির হয়ে যায়। একদিকে আরভিন অন্যদিকে তাহিয়া ধরে, আর কয়েকটা দিন থাকো মিষ্টি মা,
আর অল্প কয়েকটা দিন। আমাদেরতো মেঘ আপুর সাথে খেলাই হলো না। বড়দের কথা শুনে শুনে
বলে, ঈদ করে যাও মিষ্টিমা প্লীইইজ। এক জায়গা থেকে হৃদয়টা তুলে অন্য জায়গায় এনে সেট
করা খুব সোজা কিছু না। লোকে যতোই বলুক নিজের সংসার আর এটা আর সেটা। যদিও জানি
একসময় এক ঘেয়ে জীবনের চাকায় পিষতে পিষতে পেছনের অনেককিছু ভুলে যাবো, অভ্যস্ত হয়ে যাবো
আবার একাকীত্বে। এখন যে প্রিয় ডাকগুলোর জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে, না শুনতে শুনতে
আবার সেই না শোনায় জীবন মন অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এই কষ্ট পাওয়াও যেমন সত্যি ভুলে
যাওয়াও হয়তো ঠিক ততোটাই সত্যি।
কয়েকদিন আগে বাসায় ফোন করলাম, ফোন ধরলো
ভাইয়া। আমি যারপর নাই তার গলা শুনে চমকালাম। একেতো ভাইয়া আব্বুর ঘরের ল্যান ফোন
কখনোই তেমন ধরেন না। দ্বিতীয়ত তার সেদিন বাসায়ই থাকার কথা না। ডেলিগেট নিয়ে বাইরে
যাওয়ার কথা। বল্লাম কখন যাচ্ছো? ভাইয়া বল্লেন, ফ্লাইটের অপেক্ষায় আছেন। ফ্লাইট
রেডি হলে, ফোন করবে, তাহলেই রওয়ানা হবেন। কিন্তু গলাটা কেমন কেমন যেনো? আমি
বল্লাম, তুমি কি হ্যাপি না? ভাবলাম ঈদের ঠিক মুখে যাচ্ছেন তাই কি? ভাইয়া বললো না,
ডোমেষ্টিক ফ্লাইটগুলোর যা অবস্থা, তাতে আমার পেটের মধ্যে মেঘলার মতো বাটারফ্লাই
আসা যাওয়া করে, কখন কি হয়। ভাইয়াকে অনেক ফ্লাই করতে হয় দেশে আর বিদেশে। তাই আমি সেসব
আমলে না নিয়ে আরো মজা করলাম। বললাম বড় দেখে একটা হুজুরের কালো ছাতা নিয়ে যাও,
প্যারাসুট না খুললে, তুমি ছাতা নিয়ে ঝুলে থাকবা। ডোমেষ্টিক ফ্লাইটতো বেশি ওপরে
ফ্লাই করে না। ছাতাতেই ম্যানেজ হয়ে যাবে। এরপরে অন্যকথায় চলে গেছি। পেপারে নিউজও
দেখেছি http://www.amadershomoy2.com/ content/2012/08/17/middle0496. htm
কিন্তু ভাবিনি এর সাথে আমার কোন যোগাযোগ আছে।
যথারীতি ভাই বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু না বলে গতানুগতিক জীবন পার করছিলেন। গোল বাধালো
অফিস ইনকোয়ারী মোবাইলে ফোন করে, তখন ভাইয়া ঈদের ছুটিতে বাসায়। অবশ্যই ভাইয়া কাউকে
কিছু বলে বিব্রত করার বা দুশ্চিন্তা দেয়ার মানুষ নন। এতো বড় ঘটনা বিলকুল গিলে
ফেলতে পারেন। এ ঘটনাটা শোনার পর থেকে আমার মাথা হাত ঝিম ঝিম করে। ঈদ কত অন্যরকম
হয়ে যেতে পারতো আমাদের বাড়িতে। পত্রিকায় পড়ি, সড়ক দুর্ঘটনায় এতোজন কিংবা ততোজন
নিহত। এ সংবাদ্গুলো মনে আর কোন প্রতিক্রিয়াই আনতো না। তাদের বাড়ির ঈদ কি রুপ নেয়
তাও কখনো ভাবতাম না। কিন্তু এখন কেন যেনো খুব দুর্বল লাগে। মানুষের জীবন বদলাতে
বোধহয় মূর্হুত লাগে। আবার ডেলিগেট এসেছে। তাদেরকে নিয়ে ভাইয়াকে সামনের দুই সপ্তাহ
আবার উড়তে হবে। কোন প্রাণে তিনি উড়বেন আর আমরা কোন প্রাণ নিয়ে ধরায় থাকবো, কে
জানে। কতোদূরে কোথায় পড়ে আছি। কেনো আছি কি জন্যে কে জানে? কতো বিপদের মধ্যে দিয়ে
পরিবারের লোকগুলো যায়। কখন কি হয়ে যায় কে জানে? কাউকে ছুঁয়েও দেখতে পারি না। হয়তো
পারবোও না। এভাবেই কাটবে জীবন।
পৃথিবীর সবাই যেনো ভালো থাকেন। এই কামনা।
বহুদিন কিছু না লিখতে লিখতে লেখার হাত, ভাবনা
প্র্যাক্টিস সব চলে যাচ্ছে। তাই এলেবেলে এই লেখাটা। নিতান্তই ব্যক্তিগত হয়তো তাও।
তানবীরা
২৬/০৮/২০১২
২৬/০৮/২০১২
No comments:
Post a Comment