পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের সূর্যালোক এসে কনার চোখ
ছুঁয়ে দিল। অভ্যাসমতো হাত তুলে ঘুম চোখ রগড়ানোর জন্যে হাত তুলে চোখের কাছে নিতেই,
কনা তার ভেজা গালটা অনুভব করলো। দশ সেকেন্ড অবাক হয়ে এলোমেলো ভাবতেই মনে পড়লো কাল
রাতের কথা। আর সেটা মনে পড়তেই ভোরের সতেজ মনটা মরে সেখানে জায়গা নিলো এক রাজ্যের
বিষন্নতা। তখন খেয়াল করলো কনা, সারাটা রাত ঠিক করে শোয়নি পর্যন্ত সে, এককোনে পড়ে
আকাশ পাতাল ভাবছিল, কাঁদছিল না, চোখ দিয়ে আপনাতেই জল গড়াচ্ছিল। কখন যে তারমধ্যেই চোখ
লেগে গিয়েছিল টের পায়নি সে। সারাদিনের রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে শোয়, যতোই দুঃখ
থাকুক, কোন এক মুহূর্তে চোখ বন্ধ হয়ে আসে, কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তি মেলে হাজারো
সাংসারিক চিন্তার মাঝ থেকে। কনা আপ্রাণ চায় শুয়ে পড়া মাত্রই তার দুচোখ জুঁড়ে ঘুম
নেমে আসুক। মুক্তি মিলুক কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া এই ভাবনার বেড়াজাল থেকে। কিন্তু চাইলেই
ভাবনা থেকে মানুষের মুক্তি মিলে? যে কথা কাউকে বলা যায় না, সে কথারতো মনই আধার।
ঘুরে ফিরে সে ভাবনা নিজেকেই কুঁড়ে খায়।
যা বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে কিংবা মানুষের জীবনে
স্বাভাবিক তা তার কাছে কেন অস্বাভাবিক হয়ে ধরা দেয়? অমি প্রায় তাকে বলে, তার এ
জিনিসটা স্বাভাবিক নয়। অমির কথা শুনতে শুনতে সে প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিল, হয়তো
এ ব্যাপারটায় সে কিছুটা অস্বাভাবিক। অমিকে না জানিয়ে সে একজন ডাক্তারের কাছে
কয়েকটা সীটিং ও দিয়ে ফেললো। ডাক্তার অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পায়নি তার মধ্যে। তবে
খোলামেলা কিছু উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বললেন, ছেলেদের আর মেয়েদের মানসিক গঠন প্রণালী
একেবারেই ভিন্ন। শারীরিক সম্পর্ক হলো ছেলেদের নিজেদের রিলাক্স করার প্রধান উপায়।
আর মেয়েরা চায় ভালবাসা, আদর। তারা সেটা পেয়ে রিলাক্সড হওয়ার পরই শারীরিক সম্পর্কে
যেতে চায়, তার আগে না। কিন্তু কনার বেলায় সেটা কিভাবে সম্ভব? কনা, অমির বিয়ে করা
স্ত্রী, তার সন্তানের মা। বিশ্বাস – ভালবাসা সবই এখানে উপস্থিত। হ্যাঁ ছোট খাট
মতান্তর ঝগড়া হয়েই থাকে আর সব সাধারণ সংসারের মতো তার সংসারেও, তার বেশি কিছুতো
নয়। তখন ডাক্তার আরো খুঁটিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের খসড়া নিলেন। কনা ব্যস্ত তার
অফিস, সংসার, ছেলে নিয়ে। অমি ব্যস্ত তার ব্যবসা নিয়ে। সকাল সকাল বেড়িয়ে যায়, ফিরে
প্রায় রাত নটা দশটা। মাঝে মাঝেই তাকে ট্যুরেও বেড়োতে হয়। কনা আর ছেলের সাথে দেখা
হয় না বললেই চলে। শুধু রাতটুক অমি বাড়িতে থাকে।
ডাক্তার হয়তো বুঝতে পারলেন সমস্যা কোথায়। তিনি
বললেন, আসলে সারা সপ্তাহ তাদের মধ্যে দেখা না হতে হতে, স্পর্শবিহীন তাদের শরীরটাও
অচেনা হয়ে যায় দুজনের কাছে। তাই রাতে কনা ছেলেকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মাঝে মাঝেই যখন
অমি এসে নিজের প্রয়োজনে কনার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্যে কনার গায়ে হাত রাখে, কনার শরীর
নিজের অজান্তেই কুকঁড়ে যায়। তারপর কনা আর ভালবাসার খেলার সারাটা সময় সহজ হতে পারে
না, আড়ষ্ট হয়ে থাকে। কখন অমি ছাড়বে, সে নিস্তার পাবে, ছেলের কাছে যাবে। এতে অমি
ভীষন রেগে যায়, অপমানিতবোধ করে। বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে, ন্যায্য দাবীর উপেক্ষা আর
অবহেলা তাকে হিংস্র করে। কিন্তু কনা এটা কিছুতেই ইচ্ছে করে করে না। সে সহজ হতে
পারে নাতো কি করবে? ডাক্তার কনাকে উপদেশ দিলেন, অমি বাড়ি ফিরলে কনা যেনো কিছুটা
সময় অমির সাথে কাটায়। দুজনে একসাথে বারান্দায় বসে চা খেতে পারে, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে
টিভি দেখতে পারে, কিংবা বিছানায় শুয়ে প্রথমে কিছু নিয়ে গল্প করতে পারে। হয়তো দুজন
দুজনকে ম্যসেজ দিতে পারে। এতে হঠাৎ ছোয়ার আড়ষ্টতা কেটে শরীরটা সহজ হয়ে যাবে। দিনের
পর দিন স্পর্শ না পেতে পেতে শরীর যতোটুকু অচেনা হয়ে যায়, তা কেটে যাবে।
কনা ডাক্তারের উপদেশ শুনে খুব খুশি হয়েছিল,
সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছে ভেবে। ভাবল এই বুঝি শান্তি ফিরে এলো সংসারে। প্রথম দিকে
সে সেই চেষ্টাও করে দেখলো। কিন্তু অমির সেসব দিকে কোন মন নেই। সে ক্লান্ত হয়ে ফিরে,
খেয়ে দেয়েই তার নিজের কাজ নিয়ে বসে। বারান্দায় বসে চা খাওয়ার চাইতে, টেবলে বসে বসে
ভাত খাওয়ার সময় সাংসারিক আলাপ সেরে নিতে চায় সে। তারপর সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার
ব্যবসায়ের ফোন নিয়ে। বিছানায় শুয়ে গল্প করার চাইতে সে সরাসরি বউয়ের বুকে হাত দিতে
অভ্যস্ত। তাই কনার ডাক্তারী পরামর্শ শেষ পর্যন্ত কোন কাজে আসলো না। কনা মিনমিন
সুরে একদিন অমিকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে যেতে তিক্ত গলায় ধমক দিয়ে অমি ওকে থামিয়ে
দিল। এমনিতেই সব ব্যাপারে কনা বইয়ের রেফারেন্স নিয়ে আসে বলে অমি কনার ওপরে যথেষ্ঠ
বিরক্ত থাকে। বেশি বেশি বই পড়ে যে কনার মাথাটা গেছে, সেটা বলতেও সে দ্বিধাবোধ করে
না। আবারো বলল, একদিন সময় করে সে কনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে, কনার নিশ্চয় কোন
শারীরিক সমস্যা আছে। নইলে একটি যুবতী মেয়ে স্বামী সঙ্গের সময় এতো ঠান্ডা আচরন
করতেই পারে না। অমি পঁচিশ বছরের যুবক না আর কনাও ষোল বছরের খুকি নয়। এতো ছেঁদো
রোমান্টিকতা নিয়ে, বউয়ের সাথে ন্যাকা প্রেম প্রেম খেলার সময় নেই তার এখন। ভয়ে,
দ্বিধা কিংবা লজ্জায় কনা আর কিছু বলে উঠতে পারলো না।
অথচ কনাও এতো শান্ত ছিল না সবসময়। ঘুরেফিরে তারও
মনে আসে পুরনো সেসব দিনের কথা। অমি যখন পাগলের মতো কাছে চাইতো তাকে। কবে জ্যোস্না
হবে পত্রিকায় তারিখ দেখে রাখতো। হাত ধরে দুজনে আকাশ দেখতো, জ্যোস্না দেখতো। চাঁদের
বুকে মাঝে মাঝে অমি কনার আদল খুজে পেতো। কনার কোন সুগন্ধি পাউডার কিংবা পারফিউম
মাখা নিষেধ ছিল। অমি বলতো কনার গায়ের গন্ধে নেশা আছে। তাকে চুম্বকের মতো টেনে তা
নিয়ে আসে বউয়ের কাছে। অমি শুধু সে গন্ধে মাতাল হতে চায়। সারাদিনের কাজের ফাঁকে
সন্ধ্যের প্রতীক্ষা থাকতো। কখন দুজন দুজনকে একান্তে পাবে, নিজের করে। পাছে অন্যকেউ
শুনে ফেলে, কিংবা টের পায়, মাঝ রাতে এরা দুজন বসতো ছাদে। তাই মাঝে মাঝেই কনাকে
গলার স্বর নীচু করে গাইতে হতো “তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা, তুমি আমারো সাধেরও সাধনা”।
আবেশে কনার গলায় ঠোঁট ঘষতো অমি, আর সে স্পর্শের কামনার আগুনে কনাও গলে গলে পড়তো। উন্মত্তা
হরিনী হয়ে সেও অমির সারা শরীরকে প্রতিদিন নতুন করে আবিস্কারের নেশায় থাকতো। কতো
ছোট ছোট জিনিসে সুখী হতো তারা তখন। এক গোছা রজনীগন্ধা, কিংবা এক ডজন রেশমী চুড়ি।
বালিশে ঘুমায়নি বিয়ের পর অনেক দিন কনা। অমির হাত কিংবা বুকই ছিল তার বালিশ। কতো
স্বপ্ন ছিল, যতো যাই ঘটুক দুজনের ভালবাসার মধ্যে কোন দূরত্ব আসতে দিবে না। কিন্তু
কনার অজান্তেই সেই স্পর্শ সেই কামনা ভরা চোখের দৃষ্টি, সেই ভালবাসার স্পর্শ হারিয়ে
যেতে লাগলো।
আজ অফিসে সারাদিন অনেক ঝামেলা ছিল। এমডি স্যার
যাচ্ছেন তার তিন বাচ্চা আর বউকে নিয়ে ছুটি কাটাতে। যদিও প্রাইভেট ট্যুর কিন্তু সব
আয়োজনতো অফিস থেকেই করে দিতে হয় ওদেরকে। সেসব নিয়ে এম্বেসী আর ব্যাঙ্কে ছুটোছুটি
করে বড্ড ক্লান্ত ছিল কনা আজকে। বাড়ি ফিরেই গোসল সেরে ছেলেকে নিয়ে খেতে বসে গেছে।
এই যানযট ঠ্যাঙ্গিয়ে যারা অফিস বাড়ি করেন না রোজ তাদেরকে এ কষ্ট বোঝানো সম্ভব না। কখন
শুয়ে পড়বে বিছানা যেনো টানছে তাকে। বাড়ির মেয়েটাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, অমি এলে
কিভাবে সব গুছিয়ে অমিকে খেতে দিবে। এর মধ্যেই অমি ফিরলো দেখে কনা খুশী হলো। যাক,
কাজ সব নিজের হাতে সেরে রেখেই শুয়ে পড়বে। খাওয়া শেষ করে অমি তার ফোন নিয়ে বসে গেলো
আর কনা শুয়ে পড়লো তার ছেলেকে জড়িয়ে। ছেলে ঘুমের মধ্যে বড্ড হাত পা ছুড়ে, অমি
ঘুমাতে পারে না। আবার বাচ্চা ছেলেটা একা ঘুমাবে, সাত রাজার মানিক ধন, তাই এই
ব্যবস্থা। মা আর ছেলে এক ঘরে আর অমি আলাদা ঘরে। কনা ঘুমে বেহুঁশ তাদের ঘরে। এমন
সময় কনার গায়ে কিসের স্পর্শ। ঘুমের ঘোরেই ক্লান্ত কনা ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো সেই
অনাকাঙ্খিত স্পর্শ। আবার নাড়া পড়তেই আধো ঘুমে আধো জাগরনে কনা চোখ খুললো।
অমিকে দেখে কিছুটা সময় লাগলো ধাতস্থ হতে কনার।
তারপর মিনতি করে বললো, আজ না অমি প্লিজ, আমি ভীষন ক্লান্ত। অমি আবার কনার বাহু
টেনে ধরতেই কনা কঁকিয়ে উঠলো। পাছে ছেলে জেগে যায় তাই সাথে সাথে কনার মুখ চেপে ধরলো
সে। তারপর টেনে কনাকে বিছানা থেকে জোর করে নিজের ঘরে নিয়ে এসে দরজা আটকালো। কনা
মিনতি করছিলো না অমি না, প্লিজ আজ না। অমি বিরক্ত গলায় বলে উঠলো তোমারতো নিত্যই
হরেক বাহানা। বলতে বলতে কনার গাঁয়ে হাত দিয়ে জামাকাপড় খুলতে খুলতে তাকে ধাক্কা
দিয়ে বিছানায় নিয়ে ফেললো। আজ কেন যেনো কনার শরীর কনার অজান্তেই অমিকে বাঁধা দিতে
চাইলো। বাঁধা পেয়ে অমি আরো হিংস্র হয়ে উঠলো তার পাওনা আদায় করে নিতে। শক্তিতে না
পেরে উঠে একসময় নিস্তেজ হয়ে কনা পড়ে রইলো দাঁতে দাঁত চেপে। কিছুক্ষণ নাকি অনেকক্ষণ
পর, জানে না কনা, মনে হলো শরীর থেকে কিছু একটা ভারী নেমে গেলো। তারপর চোখ খুলে
চাইলো কনা। লবনাক্ত কিছুর স্বাদ তার ঠোঁটে লাগতেই অনুভব করলো চোখের জল আজ আর বাঁধা
মানছে না। কিছুটা সরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কনা, অমির বিছানার এক পাশে পরে রইলো।
নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও রহিত যেনো।
শরীরের সাথে মনটাও বিদ্রোহ করছিল, কেন কেন কেন?
বিবাহিতা স্ত্রীর কি ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই? কেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে
তাকে কারণে অকারণে এ লোকটি এ ঘর থেকে অন্যঘরে প্রায়শই মাঝরাতে টেনে নিয়ে যাবে? কি
জানে সে তার সম্বন্ধে? তার প্রিয় রঙ কি, কার কবিতা তার পছন্দ, কার গান সে ভালবাসে,
কোন জিনিসটার খোঁজ এ লোকটা রাখে এখন? পাশে তখন অমি মৃদ্যু গর্জনে নাক ডেকে
ঘুমাচ্ছে। মুখটার দিকে তাকাতেই বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো তার মন। দিনের পর দিন একটা
কাগজে সই হয়েছে বলে, এভাবে মুখ বন্ধ করে এই ঘরে তাকে কাটাতে হবে? সন্ধ্যে রাতে
ক্লান্তিতে ঘুমে তাকাতে পারছিলো না সে কিন্তু এখন শরীর জুড়ে ক্লান্তি থাকলেও ঘুম
কোন দূর দেশে পালিয়ে গেছে। সারা রাত কতো কি ভেবে যাচ্ছে সে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে তার
কান্নায়। শরীরটা চেপে রেখেছে যাতে কান্নার দমকে পাশের জনের ঘুম না ভাঙ্গে। মেয়ে
বলেই কি এ অপমান দিনের পর দিন সহ্য করে যেতে হবে? বিয়ে করা মানে কি আর একজনের
শরীরের ওপর বিনা শর্তে অধিকার করে নেয়া? শরীরের খেলায় সামান্য ভালবাসা কিংবা
সম্মান কি থাকতে নেই? আর পারছে না কনা। আর যেনো পারছে না কিছুতেই। রাতের পর রাত এ
অপমান তার গায়ে হুল বিঁধাচ্ছে। এ কখনো দাম্পত্য হতে পারে না। এ শুধুই নারীত্বের
অপমান। কিন্তু কাকে বলবে কনা একথা? কে বুঝবে তার এ দুঃখ?
তানবীরা
১৯/০৬/২০১২
১৯/০৬/২০১২
No comments:
Post a Comment