১.
ছোটবেলায় পড়াশোনার করার সময় খুব আদর্শ মানুষ হওয়ার একটা স্বপ্ন দেখতাম,
দেশের দশের জন্যে কিছু করব, অন্যায় করব না টাইপ ইত্যাদি। কালের আর্বতনে সব এখন
গর্তে চলে গেছে। ভাইবোনদের মধ্যে এনিয়ে কখনো সরব প্রতিজ্ঞা হয়নি কিন্তু মনে মনে
আমরা সবাই জানতাম, আমরা সবাই খুবই আদর্শ কিছু হবো। আমি বিয়ে করে দেশ ত্যাগ করে
এলেও, দেশে যারা আছেন তাদের কাছে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা রেখে দিয়েছিলাম নিজের
অজ্ঞাতেই হয়তো। একবার ঈদ করতে দেশে গিয়েছি। একদিন দেখি আম্মি ভাইয়াকে বলছে, ঈদে
কিছু কিনে নাই কেনো? কালকে ঈদ? ভাইয়া বললো হাতে টাকা পয়সা নাই কি দিয়ে কিনবে? এই
কথা শুনে মাতৃদেবীর কলিজা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তিনি তাড়াতাড়ি তিনার ব্যক্তিগত
রিজার্ভ ভেঙ্গে পুত্রকে ঈদের কাপড়ের যোগাড় দিতে ছুটলেন। চার কন্যা ইস্টু এক পুত্র
বিধায়, পুত্রের পাল্লা অলওয়েজ এই ভদ্রমহিলার কাছে ভারী। ঠিক হলো, আমিও যাবো কাপড়
পছন্দ করে দিতে আর বাইরের ভাল মন্দ খেতে। রেডী হয়ে এসে দেখি বারান্দায় চোখ মুখ
কুঁচকে মাতৃদেবী আর তার পুত্রজান দাঁড়িয়ে আছেন। নীচে এক ভদ্রলোক বেশ আনন্দিত
ভঙ্গীতে চলে যাচ্ছেন। ভাইয়া কষে একখানা গালিও দিলো। ব্যাপার কি?
তখন বাসায় দস্তুর হয়ে গেছে, সবকিছু আমাকে না জানানো। আমি চিল্লাপিল্লা
করবো, শান্তি ভঙ্গের দরকার কি? কয়দিনের জন্যে মাত্র যাই। কিন্তু কোন এক কারণে সেই
মুহূর্তে আর লুকাতে পারল না, নীচে মিটার চেক করার লোক এসে ঈদের বখশীস কাম ঘুষ যে
নামেই ডাকা হোক না কেন, ভাইয়ার ঈদের কাপড়ের টাকা নিয়ে চলে গেছে। ভাইয়া ঘুষ দেয়
শুনে আমার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। আমি বললাম ইউ টু ব্রুটাস? ভাইয়া বললো, উপায় নাইরে
গোলাম হোসেন। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, একদিন এসে বলে মিটার বদলান, তারপর দিন এসে বলে
রিডিং ঠিক না, তারপর দিন অফিসে ডাকে, চেক ঠিক না, সই ঠিক না এই ভং চঙ্গের মধ্যে
দুইমাস চলে গেছে, তারপর আসে বিল বাকি বলে, লাইন কেটে দিতে। ভাইয়া বললো, এক বিল
দেয়ার চক্করে আমার চাকরী যাওয়ার উপক্রম। এখন মাস কাবারী সেটেল বিজনেস। তারাও খুশি
আমিও শান্তি। এদের এমন সিন্ডিকেট ওপর থেকে নীচ অব্ধি, তুই পারবি না কিছুতেই
কুলাতে। পকেটে হাত না ঢুকিয়ে কোন উপায় নেই। শুধু আজকেরটা উপরি নিয়ে গেলো, ঈদ
সামনেতো তাই।
২.
দেশে গেলে কিছু রুটিন বেড়ানো থাকে, দেখা করতে যাওয়া মুরুব্বীদের সাথে।
যানজটের যা অবস্থা, তাতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো মুরুব্বীদের সাথে দেখা করতে যাওয়াও
একটা অভিজ্ঞতা বটে। একদিন ঠিক হলো শুক্রবার খুব সকালে উঠে দূরের দেখাগুলো করে
আসবো, জ্যাম শুরু হওয়ার আগে। তাই সকালে ভাইবোন মিলে বের হয়েছি। পান্থপথ এসে দেখি
দুই সার্জন প্রত্যক গাড়ি, সিএনজি, হোন্ডা, বাস, ট্যাক্সি থামিয়ে কাগজপত্র সব
পরীক্ষা করছেন, জরিমানা লিখছেন ঘসঘষ করে। আমি অবাক হয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
কিরে আজকে কি ট্রাফিক সপ্তাহ টাইপ কিছু নাকি? এই অবস্থা, সাত সকালে জ্যাম। মুখ
তিতা করে ভাইয়া বললো, আরে কিসের ট্রাফিক সপ্তাহ। সকালে সার্জন ঘুম থেকে উঠছে, তার বউ
ঝাড়ি দিছে, টাকা পয়সা কিছু নাই হাতে, শুক্রবার দিন শপিং যেতে পারছি না, তুমি কি
করো? ব্যস, সার্জন এসে এখন লাগাইছে এখানে, দুই ঘন্টা পর পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে
হাসিখুশি বউরে নিয়ে শপিং এ যাবে। মাঝখানে সবার ভোগান্তি। কার গাড়ির কি আছে না নাই
তা ব্যাপার না, ব্যাপার হলো কার থেকে কতো খেতে পারবে।
৩.
এবার ঢাকা গেছি। বসুন্ধরা শপিং মলের একটু আগে প্রিমিয়ামের সামনে দুই সার্জন
গাড়ি থামিয়েছে। ড্রাইভারের সাথে কথাকতি আর শেষ হচ্ছে না। ব্লু বুক নিয়ে মুখ চুন
করে ড্রাইভার বেড়িয়ে গেলো আবার। ছোটবোন দেখি মোবাইলে ফেসবুক করে যাচ্ছে। আমি বার
বার ড্রাইভার আর ছোটবোন দুজনকেই জিজ্ঞেস করলাম, সমস্যা কি? কেউই কোন উত্তর দেয় না।
আমি বিদেশ থাকি, দেশের কি বুঝবো, ভাব তাদের। আমি গাড়ি থেকে নামতে চাচ্ছি বারবার কি
ব্যাপার দেখার জন্যে। ছোটবোন মহাবিরক্ত হয়ে ধমক দিলো, চুপ করে বইস্যা থাকো। এমন
মাসে দুই একবার ধরবেই। হাজার টাকা ফাইন দিয়ে ছেড়ে দিবে। কিন্তু ফাইন কেনো দিবে?
ওদের ইচ্ছা দিবে আর নইলে এখন তুমি ক্যাশ পাঁচশো দাও, এমনিই ছেড়ে দিবে। আমি ভাবলাম
যাই ক্যাশই দেই আবার আব্বুর থেকে তিনগুন নিয়া নিবোনে। যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জনাব
সমস্যা কি? জনাব বললো, গাড়ির নাম্বার প্লেট ঠিক মাঝখানে লাগানো হয় নাই, একটু সাইডে
চাপা, এটা সমস্যা। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে সত্যি নাকি? ড্রাইভার ভয়ে বললো,
আপা সত্যিইতো মনে হচ্ছে, এতোদিনতো খেয়াল করি নাই, কিন্তু আমি স্যারকে বলছি, এখনি
আপনাদেরকে নামিয়ে দিয়ে নাম্বার প্লেট ঠিক করে লাগাচ্ছি, স্যার শুনছে না, ফাইন
দিচ্ছে। আমি জনাবকে বললাম, নাম্বার প্লেটতো আমরা লাগাই নাই, গ্যারেজ লাগিয়েছে, কিন্তু
এটা কি ক্রাইম পর্যায়ে পড়ে? তিনি আমাকে অনেক কিছু বুঝালেন কেনো, গাড়ির নাম্বার
প্লেট মাঝখানে থাকা আবশ্যক। আমি বললাম, ভুল হয়েছে এবং সে ভুল স্বীকার করে ঠিক করার
প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাহলে সমস্যা কি? ব্লুক বুক আটকাচ্ছেন কেনো?
জনাব অনেককিছু ততোমতো বললেন যা আমার বোধগম্য হয়নি। দেখি ব্লু বুক
ড্রাইভারকে দিয়ে সে অন্যদিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, অন্য কাউকে ডেকে আনতে
যাচ্ছে বা কিছু ব্যাপার। পুলিশ সম্পর্কে যা যা পড়ি পত্রিকাতে তাতে নিস্তার পাওয়ার
আশা মনে রাখি নাই। ড্রাইভার এসে বলে, আপা গাড়িতে উঠেন। আমি বললাম, কথাতো শেষ হয়
নাই, ওনি কই গেলেন, আসবেন। ড্রাইভার বলে, কথাতো শেষ, সার্জন চলে গেছে। আমি বুঝতেই
পারলাম না কি হলো, চলে গেলো মানে? ভাইয়াকে অফিসে ফোন করে বললাম, নাম্বার প্লেট ঠিক
জায়গায় লাগানো হয় নাই। ভাইয়া হাসে, এখনো সেই নাম্বার প্লেট ব্যঁকাই আছে কিন্তু
পুলিশের চোখে হয়তো আর পড়েনি। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার আমার বীরত্বে খুবই খুশি
হয়েছে, আপা পুলিশকে ভাগায় দিছে এই গল্প সেই পাড়াশুদ্ধ সবাইকে করেছে কিন্তু আমি
এখনো জানি না পুলিশ কি কারণে আমাকে জবাব না দিয়ে বিদায় না নিয়ে চলে গেলো?
৪. সেই সত্যযুগে একবার বেনাপোল চেকপোষ্ট দিয়ে কোলকাতা গিয়েছিলাম। বাস থেকে
নেমে সবচেয়ে আগে পাসপোর্ট নিজের হাতে জমা দিয়েছিলাম। তখন নিয়ম ছিল, দালালের কাছে
পাশপোর্ট জমা দিবেন, সাথে টাকা। তারা সব করিয়ে এনে আপনার হাতে দিলে আপনি ট্যাক্সি
চেপে কোলকাতা যাবেন। ব্যাস, যা হওয়ার হয়ে গেলো। ভোর পাঁচটায় নিজের হাতে পাশপোর্ট
জমা দেয়ার অপরাধে ফেরত পেয়েছি সকাল আটটায়। যখন বাংলাদেশ থেকে কাক-পংখী সব কোলকাতা
পৌঁছেছে তখন আমাদের পাশপোর্ট ফেরত দিয়েছে। এর আগে পাশপোর্টে – ভিসায় চিরুনী
তল্লাশী চালানো হয়েছে, কোথাও কোন ছিদ্র যদি পাওয়া যায় তাহলে বেয়াদপ ছেলেমেয়েগুলোকে
আটকে দেয়া যায়। আমাদেরও গোঁ, যা করার কর কিন্তু ঘুষ দিবো না। তবে দেরীতে ফেরত
দেওয়াও খারাপ কিছু হয় নাই। সকালে যেই ট্যাক্সি সাতশ টাকায় যেতো আর যাত্রী পাবে না
তাই দেরী হওয়াতে সেই ট্যাক্সি চারশো টাকায় গেলো। দুইজোড়া নাগরা কেনার পয়সা বেঁচে
গেলো।
আসার সময় আরো মজার খেলা। যাই করেছি কিছু বাজার টাজারতো করেছি। স্যুটকেস প্রতি
দুশো টাকা এমন একটি রেট ধার্্য্য করা আছে বাংলাদেশ কাস্টমসে। আমরা আরো উলটা হম্বি
তম্বি, স্যুটকেস খুললে খুলেন, কি আছে দেখেন, রেখে দেন, টাকা নাই, দিতে পারবো না।
এমন হই চই যে উলটা পার্টি তারা আরো আমাদেরকে কাইন্ড অফ এপোলজি দিয়েছে।
৫. ব্যাঙ্কে বহু আগের আমলের একখানা হিসাব খোলা ছিলো। তার একটা বই খুঁজে
পেয়ে গেলাম ব্যাঙ্কে খোঁজ নিতে। তিনারা পাথর মুখ করে জানালেন, দুই বছর লেনদেন না
করলে বনলতা সেন থুক্কু হিসাব “ফ্রীজ” হয়ে যায়। আমি বললাম আমি দেশে থাকি না, আর পাস
বইও খুঁজে পাচ্ছিলাম না, একাউন্ট নাম্বারতো মুখস্থ নাই। কিছুতেই তাহাদের মন গলে
না। “ফ্রীজ” হিসাবকে “থ” করতে আমারে বহু লাল কার্ড দেখানো হলো। আমি সোজা
ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বললাম, আমার টাকা আমি নিবো, আপনি ব্যবস্থা করে দেন।
ম্যানেজার আমার ডু অর ডাই ভাব দেখে, একজনকে ডেকে আনলেন। তিনি ব্যবস্থা করে দিবেন
কিন্তু সময় লাগবে। আমি বললাম সময় নেই, আজকেই, যতক্ষণ লাগে। ম্যানেজার আমাকে শান্ত
করলেন, আর একদিন আসতেই হবে। ওনাদের নিয়ম। আমার সাত বছর আগের হাতের লেখার সাথে
এখনকার স্বাক্ষর মিলানোর প্রাণান্তকর পরিস্থিতি দেখে খুবই ভয় লাগছিলো, নিজেকেই
স্বাক্ষর জালকারী চোর চোর মনে হচ্ছিল। ছবির ক্ষেত্রেও সেই একই দশা। এই পুলসিরাত
পার হয়ে পরদিন টাকা ক্যাশ করতে গেছি, দেখি এই দশ হাজার টাকা ক্যাশ হওয়ার খবর সবাই
জানে ব্যাঙ্কময়। সবাই আমারে ধরে, আপনি বিদেশ থাকেন, এই টাকা দিয়ে আপনি কি করবেন,
আমাদেরকে দিয়ে যান আমরা মিষ্টি খাই। এতো মিষ্টি খায়, এদের ডায়বেটিস হয় না? আবার
বলে, দুলাভাইরে নিয়ে আসলেন না কেনো? তাহলেতো এই টাকা নিয়ে আপনাকে যেতেই দিতাম না।
খাইছে!!!!! আপার লগে দেখা নাই, দুলাভাই লইয়া টানাটানি।
তানবীরা
১৫/০১/২০১৩
১৫/০১/২০১৩
No comments:
Post a Comment