Tuesday 5 February 2013

মন খারাপের দিন



আমার মেয়ে মাত্রই দশে পা দিলো। তাকে আমি সজ্ঞানে কখনো সেভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প করিনি। একটা বিরাট কারণ প্রবাসীনি হওয়ায়। আর মায়ের কাছে সন্তান সবসময় ছোট থাকে। মনে হতো এতো ভয়াবহ ঘটনা বাচ্চার মনে খারাপ প্রভাব ফেলবে, আর একটু বড় হোক সে, তারপর জানবে সব। কিন্তু যা হয়, বাসায় আলোচনা শুনে শুনে, খালা – মামা, গুগল থেকে সে জানে, ৭১ এ পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের সাথে “অনেক খারাপ” করেছিলো। মানুষ মেরে ফেলেছিলো, তাই পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের বন্ধু নয়, আমরা কখনো কোন কাজে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে পারি না, এটা কখনো আর সম্ভব নয়। যেহেতু এটা সে জানেই, তাকে আমি “আমার বন্ধু রাশেদ” সিনেমাটা বেশ কয়েকবার দেখতে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয় আমাদের বাচ্চাদের ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলার এর থেকে সুন্দর উপায় আর হয় না। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে আমি অনেক কারণেই অসম্ভব শ্রদ্ধা করি, তারমধ্যে এটিও একটি কারণ। 


যদিও সিনেমা দেখতে বসার আগে একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা দিয়েছিলাম। তাতে যুদ্ধের সিনেমা শুনে সে খুব ভয় পেয়ে গেছিলো। আগেই জিজ্ঞেস করলো, মা, রক্ত হবে? রক্তকে সে ভীষন ভয় পায়। তার কাছে, বাংলা – হিন্দী সিনেমাতে লোকে অনেক চিৎকার করে কথা বলে, মারামারি করে আর রক্ত হয়। সে খুব একটা পছন্দ করে না, মায়ের মতো ভীতু স্বভাব পেয়েছে। আমার বন্ধু রাশেদ সিনেমাটা দেখে শুধু শেষ দৃশ্যে অনেক ভয় পেয়েছে, তাতে পাকিস্তান সম্পর্কে – মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার ভাবনা আরো গাঢ়ো হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের জন্যে সে পাগল। প্রধান আকর্ষন, মামার বাড়ি, দাদুর বাড়ি তারপর আছে ফুচকা, ঝালমুড়ি, বোরহানী, কাবাব। আর আমিও মনে ধারনা দিয়ে রেখেছি, চাকরী শেষ করে আমরা চলে যাবো, তার প্রিয় বাংলাদেশে। যদিও সে ভেবেই পায়না সব ছেড়ে রেখে কোন আক্কেলে এখানে আমরা চাকরি ফলাইতে এসেছি। 


আজকে কাদের মোল্লার রায়ের প্রেক্ষিতে দেশে কি হচ্ছে, দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি টিভি অন করেছি। কাদের মোল্লা, যুদ্ধ, রাজাকার শব্দগুলো শুনছে বারবার। একবার আমাদের মুখে আবার টিভির মুখে। তারপর জিজ্ঞেস করছে, কি হচ্ছে দেশে, টিভিতে আমরা কি দেখছি? তাকে “রাজাকার” সম্বন্ধে বলা মাত্র, তার প্রতিক্রিয়া ছিলো, “ওরা কি ওদের মাথা খেয়েছিলো”? “কতো বোকা হতে হয় এমন একটি কাজ দেশের লোকের বিরুদ্ধে করার জন্যে?”ওদের অনেক শাস্তি হওয়া দরকার।“ তখন কষ্ট লাগে যারা সব জেনে বুঝে বসে আছেন তাদের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে। তারা যদি বুঝতে পারতেন, এ ধরনের অন্যায় যারা করে তাদের আসলে অনেক অনেক অনেক শাস্তি হওয়া দরকার। চারধারে রাজনীতির কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে মানবতা, পরাজিত হতে হতে আজকাল একধরনের বিষন্নতায় ভুগি। গরীবের রক্ত, আর্তনাদ বিশ্বে কতো ডলারে বিকায়? প্রায় রোজই পত্রিকায় খবর পাই, আবুধাবী, দুবাই, বাহরাইনে, মালোশিয়াতে শ্রমিকের মৃত্যু, লাশ আসছে। স্বাধীনতা কি দিয়েছে তাদের? প্রবাসে আগুনে পুড়ে মৃত্যু? আর যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে অন্তত হাহাকার? কখনো ন্যায় বিচারের জন্যে আর কখনো দুমুঠো খাবার জন্যে? বিচারের বাণী আজীবন নিভৃতেই কেনো কাঁদবে? মাননীয় আদালত, হাতজোড় করছি, ছেলেমেয়ের সামনে মুখ রক্ষা হয় সে ইতিহাস তৈরি করুন। কি করে জানাবো তাদের, এই ঘৃণ্য অপরাধ নিয়ে আমরা রাজনীতি করেছি, স্বজনহারাদের আর্তনাদ মিশে গেছে রাজনীতির গুটির চালে। ন্যায় বিচার হয়ে গেছে শুধু “শেখ হাসিনার” মুখের বুলি আর রাজনৈতিক হাতিয়ার? বিয়াল্লিশ বছর অনেক সময়, শহীদের আত্মারা আজো কেঁদে ফিরছে তাদের প্রাপ্য বিচারের আশায়। একটু কান পাতুন মহামান্য আদালত। 


তারপরও সামনে স্বাধীনতা দিবসকে মাথায় রেখে মেয়েকে গান শেখাই,

আমায় যদি প্রশ্ন করে আলো নদীর এক দেশ
বলবো আমি বাংলাদেশ।
আমায় যদি প্রশ্ন করে কলকাকলীর দেশ
বলবো আমি বাংলাদেশ।

মেয়ে জিজ্ঞেস করে “কলকাকলী” কি মা? এই বিষন্নতার মাঝে কি করে বুঝাই “কলকাকলী” কি? 


তানবীরা
০৬/০২/২০১৩

No comments:

Post a Comment