Monday 28 October 2013

যুদ্ধ কান্না শিশু আর আমাদের রাজনীতি

মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি থেকে অনেক শিশুকে ইউরোপে দত্তক পাঠানো হয়েছিল। ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক “যুদ্ধ শিশু” বা “ওয়ার চাইল্ড” দত্তক এসেছে। তাদের বেশীর ভাগের বয়স এখন চল্লিশের কিছু ওপরে কিংবা কিছু নীচে। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর থেকে ধরা যাক ত্রিশ কিংবা মধ্য ত্রিশ থেকে নিজের শিকড় খুঁজে ফিরছেন। কেউ কেউ কাউকে খুঁজে পান, কেউ কেউ বিফল হন। কারো বায়োলজিক্যাল বাবা মা বেঁচে আছেন কিংবা দুজনের একজন আছেন কারো কারো কিছু নেই।

খুঁজে পাওয়ার পর? বায়োলজিক্যাল বাবা মা নিতান্ত গরীব। রিকশা চালক, চায়ের দোকানে কাজ করেন ইত্যাদি। এপারে ছেলেমেয়ে বেশীর ভাগই উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত। তারা বাংলা বলতে পারেন না। বাবা মা ইংরেজী বলতে পারেন না। তখন কাউকে চাই যে দুজনের মাঝে সেতু গড়বে। মাঝে মাঝে আমি তাদের সেতু হই। বেশীর ভাগ বাবা মা, ভাইবোন কথা বলতে পারেন না, কাঁদেন বেশী আর ছেলেমেয়েরা পাথর মুখ করে তাকে নিয়ে বাবা মা, ভাইবোনদের সুখ কিংবা দুঃখ স্মৃতি শুনতে চান। ডাচ প্রকৃতির কারণে এরা কাঁদেন কম কিংবা শিশুকাল থেকে কেঁদে কেঁদে পাথর এখন। এতো আবেগী ঘটনায় জড়িয়ে কি খুব নির্লিপ্তভাবে কাজ করা যায়? একজন একপাশে ফোনে কাঁদেন আর একজন অন্যপাশে স্কাইপে উৎসুক চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। কি বললো আমার কথা? কি বললো? পড়াশোনা না জানা বাবা মা, ভাইবোনদের ভাষা নেই আছে বোবা কান্না। আর উচ্চশিক্ষিত এপারে সন্তানটির অনেক ভাষা চাই, জানার আঁকুতি দিনরাত তার সেখানে সে কেমন ছিল? কি খেয়েছিল সে, কি খেলতো? কি তার ভাল লাগতো? কে তাকে বেশি ভালবাসতো? ভাষান্তর তখন অনেক কঠিন। ভেবে ভেবে বের করতে হয় সন্তানকে মা কি বলতে পারেন।


চল্লিশ বছর নীড় খুঁজে ফেরা বৃন্তচ্যুত মানুষেরা এখনো কেঁদে যাচ্ছেন। এরপর যখন কেউ বলেন আপনারা “গনহত্যা” করিয়েছেন, আপনাদের মুক্তিযোদ্ধারা মানুষ মেরেছে তখন তাদেরকে ঘৃনা করার মত ঘৃনাটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না। 

1 comment:

  1. যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে সে সময় যেসব শিশু দত্তক এসেছে তাদের সবাই মহান বীরাংগানাদের সন্তান নন। অনেক অপুষ্টিতে ভোগা, অসুস্থ, যুদ্ধে পিতামাতা হারানো পথ শিশুও এসেছে। সে সময় অনেক এনজিও বাংলাদেশে এ ব্যাপারে তৎপর ছিল যারা দরিদ্র পিতামাতার সন্তানকে সুন্দর ভবিষ্যত দেয়ার জন্যে এদিকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সবাইকে যুদ্ধশিশু ট্যাগ দেয়া হয়েছে যেটা বৃহত্তর অর্থে হয়তো অসত্য নয়। যুদ্ধ না হলে দেশের অবস্থা এতো বিধ্বস্ততো হতো না আর শিশুদেরও এমন চরম দিন দেখতে হতো না।

    আর আমি মহান বীরাংগনা কথাটা সচেতনভাবে ব্যবহার করেছি, এই শিশুরা নিজেদেরকে সবাই বাংলাদেশী পরিচয় দেন, নিজেকে বাংলাদেশী ভাবেন। পাকিস্তানের জন্যে অপরিসীম ঘৃনা বুকে ধারন করেন যেখানে আমাদের বাংলাদেশে জন্ম আর বড় হওয়া অনেক মানুষ “পাকিস্তানী জ্যায়সা” ক্রিকেটার খুঁজে বেড়ান। এই শিশুরা নিজেদের কর্মের দ্বারা সমাজের উচ্চস্থানে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা বাংলাদেশের জন্যে অত্যন্ত গর্বের। যে বাংলাদেশ তাদেরকে বুকে ধারন করতে অস্বীকার করেছে সে বাংলাদেশে তারা প্রায়ই বেড়াতে ঘুরতে আসেন, কাজে নিয়ে আসেন, সাহায্য নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের জন্যে তারা অপার ভালবাসা বহন করেন।

    ReplyDelete