Thursday 5 December 2013

আমার আমি


আমার পরিচিত কাছের মানুষেরা অভিযোগ করেন আমার কাছে, আমি বড় হই না, বাচ্চাদের মতো করি, বয়সটা আমার কোথাও একুশে আটকে আছে। হয়তো পিছনে পিছনে বলেন, আমি যা করি তা হয়তো আমাকে মানায় না। যিনি আমার এই ছেলেমানুষীর সবচেয়ে বেশী ভুক্তভোগী তিনি বলেন, শরীরটা শুধু ডেভেলাপ করেছে, ব্রেইনটা ডেভেলাপ করেনি। তবে তিনিও এটা বলতে বলতে এখন ক্লান্ত হয়ে ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন শুধু আমি যেমন ছিলাম তেমনই রয়ে গেছি। সবার অনুযোগের পরেও আজও নিজেকে সামলে সবার আকাঙ্খা অনুযায়ী নিজেকে বড় করে তুলতে পারিনি।

বদলে যাওয়া বড় হওয়া সব কী নিজের হাতে থাকে? সবাই কী চাইলেই নিজেকে ইচ্ছেমতো বদলে ফেলতে পারে? বড় হয়ে যেতে পারে?

অনেকেই বলেন ছোটবেলায় এই লেখকের বই আমার ভীষন প্রিয় ছিল, ঐ গায়ক বা নায়ককে আমার ভীষন ভাল লাগতো। ঐ খাবারটা খুব মজা লাগতো। আমার কোন অতীত নেই, নেই কোন পাষ্ট টেন্স। আমার তখনো যা প্রিয় তা এখনো প্রিয়, তখনো যা আমার ছিল এখনো তা আমারই আছে। আমি কোন কিছুর দাবী ছেড়ে দিতে শিখি না, যা আমার তা একান্ত আমার। আজো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা চটপটি আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের অনুভূতি দেয়, বসুন্ধরা ফুডকোর্টের দই ফুচকা আমার সে অনুভূতি একটুও কেড়ে নিতে পারেনি। ছোটবেলায় জিতু আঙ্কেলের বা মিঠুন আঙ্কেলের নাচ যে আনন্দ নিয়ে দেখতাম এখনো সেই আনন্দ নিয়েই দেখি, অক্ষয় কুমার কিংবা হৃত্তিক রোশান তার জায়গা ছিনিয়ে নিতে পারেনি। টিনটিন কিংবা ডলুমাসী, টম এন্ড জেরী আজো সেরকমই হাসায় কাঁদায়। যা যা কিংবা যাকে যাকে যতোটুকু ভালবাসতাম তা তা কিংবা তাকে তাকে আরো বেশী ভালবাসি আজো। বেলী কিংবা কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ দেহ মনে সেই সময় যে শিরশিরানি আনতো আজো তেমনই আকুল করে। চওড়া পাড় দেয়া ভাজ ভাঙ্গা বাসন্তী রঙের নতুন তাতের শাড়ি, হাতে রঙ বেরঙের লাল হলুদ সবুজ রেশমী চুড়ি, কপাল জুড়ে বড় চাঁদের মতো কালচে লাল টিপ আর ঘাড় গলা খোঁপা জুড়ে জড়িয়ে থাকবে অজগরসম কাঁঠালিচাঁপার মালা। তখনো প্রিয় এখনো প্রিয়।

দাদুর সাথে কতো দিন দেখা হয় না। কবে আবার কোন পৃথিবীতে দেখা হবে, আদৌ দেখা হবে কীনা জানি না। যদিও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি শক্তির ধ্বংস নেই আবার হয়তো কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যেতে পারে কোন না কোন রুপে, হয়তো দাদু নাতনী হয়ে নই তবুও তবুও। যাকে মন দিয়ে খুঁজে লোকে তা নাকি পেয়েও যায়। আমি কী দাদুকে ভুলে গেছি? কম ভালবাসি? বড় হওয়া মানে কী ছোটবেলা ভুলে যাওয়া? দাদুর জন্যে মন কেমন করলে কান্না না করা? কতো শীতের রাত লেপের নীচে দাদুর গায়ের ওম নিয়ে কেটেছে সেকি চাইলেই ভুলে যেয়ে বড় হওয়া যায়? নাকি শীতবেলায় সেই স্মৃতি মনে পড়লে দু ফোটা গড়িয়ে পড়া অশ্রুকে বড় হয়ে যাওয়ার অনুশাসনের মাঝে আটকে দেয়া যায়?

আজো শেষ বিকেলের গোধূলির সূর্যের লাল আভায় মন জানি কেমন কেমন করে ওঠে, কার জন্যে কীসের জন্যে জানি না। আজো কোকড়ানো চুলের উস্কো খুস্কো বাদামী তরুন দেখলে মনে রিনিক ঝিনিক সুরের দোলা নাচে, এক পলকের জন্যে হলেও আবার ফিরে তাকাই। এখনো শিমূল মুস্তফার কন্ঠে জয় গোস্বামীর “পাগলী তোমার সঙ্গে” কবিতার আবৃত্তি শুনলে নাম না জানা কারো পাগলী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আজো সমুদ্রের উষ্ণ নোনা জলে পা ভেজালে ভাষায় বর্ননা করা যায় না এমন অনুভূতি গা ছুঁয়ে মন ছুঁয়ে যায়। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এখনো মনে হয় হাত বাড়ালেই আকাশটাকে ছোঁয়া যায়। এখনো মায়ের চুলের তেলের গন্ধ সর্বাপেক্ষা প্রিয়, মন মাতায়। এখনো মিতালী মূর্খাজীর ‘আকাশটাতো নীল চিঠি নয়, জানলা খুলে আমার লেখা পড়বে, মনটা কী আর ময়না পাখি? মনটা কী আর ময়না পাখি সোনার শিকল দিলেই বাঁধা পড়বে” শুনলে মনে হয়, এতো আমার কথা, এতো শুধুই আমার কথা, মিতালী কী আমার কথাই গাইছে?

প্রিয় যা ছিল প্রিয় তাই আছে। কিছুই হারায়নি হয়তো হারাবেও না। সেই জ্বলে ওঠা নিভে যাওয়া জোনাকী পোকা, আমসত্ত্ব, চালতার আঁচার, সারা গায়ে সুর মেখে বৃষ্টিতে ভেজা। না গান না কবিতা না সেই কাউকে নাম না বলা হৃদয় গহীনে লুকিয়ে থাকা মানুষটা, চোখের কাজল কিংবা খোঁপার কাঁটা, তেতুল বনে জ্যোস্না দেখা কিংবা কপালে কারো নামের টিপ আঁকা। প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়েছে সমস্ত কিছু, তালিকাটা দীর্ঘ হচ্ছে দিন দিন এই যা। বড় হওয়া হবে না আমার, হলো না আমার আর

কিন্তু তারপরও কী কিছুই বদলায়নি? সবার চাহিদামতো বড় হয়তো আমি হয়ে উঠতে পারিনি কিন্তু খানিকটা বদলে আমি নিশ্চয় গেছি। কারো নজরে সেটা না পড়লেও মাঝে সাঝে যখন অনেক ব্যস্ততার ফাঁকে একটু অবসরে নিজের দিকে ফিরে তাকাই, খুলে দেখি নিজেকে, কোথায় সেই পুরনো আমি? কিছুটা রুক্ষ আর অনেকটাইতো বদলে যাওয়া আমি।

তানবীরা

০৫/১২/২০১৩

No comments:

Post a Comment