শীতকাল মানেই দেশে অন্যরকম একটা উৎসব উৎসব ভাব।
দেরি করে সকাল হয়, সূর্যের তাপ তখন আর খরখরে
দজ্জাল রমণী নয় বরং মিষ্টি লাজুক কিশোরী। গায়ে এলিয়ে পড়লে কী ভালোটাই না লাগে!
বিকেলে আকাশটা লাল হতে না-হতেই টুপ করে সন্ধ্যায় মিলিয়ে যাবে। সকালে
ভাপ-ওঠা ভাপাপিঠে কিংবা চিতই, পুলি নইলে ছিটারুটি, মানে ঘুরেফিরে এমন কিছু যা সচরাচর হয় না। খেজুরের রস
আর গুড়তো আছেই।
গ্রামে বেড়াতে গেলে দেখা যেতো প্রায় বাড়িতে মাচা
আর তাতে উঁকি দিচ্ছে বেগুনি কিংবা সাদা সিমের ফুল, কোথাও কোথাও আবার ফুলের পাশে
পাশে সিমও ঝুলে আছে। চারপাশের সবুজ মাঠে আগুন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সর্ষে গাছগুলো,
হলুদে আর সবুজে মিশে একাকার, ব্রাজিলের জার্সি হয়ে কিংবা কাঁচা আর পাকার
প্রতিচ্ছবি হয়ে। প্রকৃতিতেও
নিত্যনতুন ফুল যেগুলো সারা বৎসর চোখে পড়ে না। নতুন আলু দিয়ে মুরগি, টমেটো ধনেপাতা
মাখিয়ে ছোট মাছের চচ্চড়ি, নতুন-ওঠা সিমের ভাজি, বরই-এর ডাল, শিকার করে-আনা পাখির
মাংস, কী নয়!
স্যুটকেসে বা আলমারিতে আলাদা কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে
যে-কাপড়গুলো সযতনে মোড়া থাকতো সেগুলো তখন নামতো। সোয়েটার, জ্যাকেট, আলোয়ান, লেপ,
কম্বল। অনেক বাড়িতেই বিয়ের উৎসব। স্কুলে পিকনিক, পাড়ায় পিকনিক, ছাদে পিকনিক, পাড়ার
উঠোনে উঠোনে কোট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা, রাতে লাইট ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে। শুক্রবার
মানেই রাস্তা দিয়ে হইহই করে পিকনিকের বাস যাবে, নতুন রিলিজের আপাত হিট হওয়া কোন হিন্দি
গান বাজিয়ে। স্কুলে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিলে নতুন ক্লাশে-ওঠা
ছেলেমেয়েদের হাসি মুখ আর নতুন বই পুরনো ক্যালেন্ডারের সুন্দর ছবিটি দিয়ে মুড়িয়ে
নেয়ার ধুম আর আনন্দ।
শীতের রাতে বাবা বাড়ি ফিরতেন সাধারণ সময়ের থেকে
কিছুটা আগে। ঢাকায় শীতের রাতে দ্রুত রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। বাবা বাড়ি এলে
আমাদের কী আনন্দ আর স্বস্তি! ঘরে ঢুকেই হাত মুখ ধুয়ে আমাদেরকে নিজের আলোয়ান দিয়ে
মুড়ে দিতেন। আমরা তখন রাত নটার টিভিতে ব্যস্ত। একদিন ম্যাকগাইভার তো অন্যদিন
সাপ্তাহিক নাটক নইলে সিরিজ নাটক। আমাদের নড়াচড়ার সময়তো নেইই আর সে সময় নড়া প্রায় অসম্ভব।
কোন কিছু মিস করা যাবে না।
কোনদিন যদি বাবা সন্ধ্যে থেকে বাসায় থাকতেন, রাত
নটার দিকে তাঁর আলোয়ান যখন আমাদের গায়ে, সেটা থেকে বাবার গায়ের বাবা বাবা গন্ধের
সাথে মিষ্টি একটা বাবা বাবা ওম মিশে থাকতো। বাবার সেই চিকন বর্ডার দেয়া খয়েরি,
বাদামি উলের আলোয়ানগুলো সাধারণ আলোয়ানের থেকে লম্বায় আর চওড়ায় অনেক বড় হতো। কত
পুরনো ছিলো সেগুলো কে জানে। সেগুলোর কিছু বোধহয় তিনিও উত্তরাধিকার সূত্রে
পেয়েছিলেন।
ছোটবেলায় একটা আলোয়ান দিয়ে দুজনকে পেঁচিয়ে ফেলতে
পারতেন, বড় হওয়ার পর অবশ্য আলাদা আলাদা দিতে হতো। কিন্তু পেঁচিয়ে দিতেন সবাইকে,
নিজের গুলোর সাথে দাদুর আলোয়ানও নিয়ে আসতেন। আলোয়ান পেঁচিয়ে প্যাকেট করে তারওপর
কম্বল এনে দিতেন যেনো ঠান্ডা তার আগ্রাসী আঙুলে তাঁর সন্তানদের স্পর্শ করতে না
পারে।
কী অকিঞ্চিৎকর সেই সময়, সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসার
আমাদের। গিজার নেই, হিটার নেই, এয়ারকন্ডিশনার নেই। গরম কাপড়, সুন্দরবন থেকে
বিশ্বাসী কাউকে দিয়ে আনানো মধু, গ্রামের বাড়ি থেকে বানিয়ে-আনা খাঁটি ঘি, বেসিনে,
বাথরুমে গরম পানি বালতিতে করে এই আমাদের ভরসা।
খাবার সময় মানে আনন্দবাজার। বড় একটা বোলে বাবা
ভাত, তরকারি, মাছ, মাংস, ডাল, গরম ঘি, সালাদ, লেবু, আচার সব একসাথে মেখে নিতেন।
মেখে নিতেন বললে আসলে ভুল বলা হয়, ছোট বাচ্চাদের যেমন খিচুড়ি খাওয়ানো হয় সেরকম ক্বাথ
বানিয়ে ফেলতেন। আমরা চারধারে কার্পেটের ওপর গোল হয়ে বসতাম, হাত আলোয়ানের ভিতর আর
পা কম্বলের নিচে, চোখ টিভির ওপর আর সন্তানদের প্রতি একাগ্র আমার বাবা ঘুরে ঘুরে
সবার মুখে লোকমা তুলে তুলে দিতেন।
অনেকসময় মুখে নিয়ে বসে থাকতাম ঠিক বাচ্চাদের মতো,
তখন বাবা বকা দিতেন, চিবানোর তো কিছু নেই তাহলে মুখে নিয়ে চিন্তা করিস কী? মুখে
যাবে গিলে ফেলবি, বাকি যা করার তো আমিই করে দিয়েছি।
রান্নাঘরে গরম পানি ফুটছে, আমাদের মুখ মুছিয়ে দেবেন
বাবা নিজের হাতে আর একটু গরম পানি জগে মিশানো হবে, সবাই খাবে। ইউনিভার্সিটি পড়া
অব্ধি কটা শীতের সন্ধ্যে নিজের হাতে খেয়েছি আঙ্গুলের কড়ে গুনে বলে দিতে পারবো। শীত
বাদেও বহু সন্ধ্যে বাবা খাইয়ে দিতেন, তবে শীতের দিনে সেটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত
ছিলো।
খাবার প্লেটে নিয়ে আমরা এতো দেরি করতাম যে খাবার
প্লেটে ঠান্ডা হয়ে যেতো। অনেকসময় দেখা গেছে, গরুর মাংস প্লেটে ঠান্ডা হয়ে জমে
গেছে। মা চ্যাঁচামেচি করতেন ছেলে মেয়েগুলোকে নষ্ট করছেন আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে এই বলে। বাবা শুনতেন কিনা জানি না, মুখ টিপে হাসতেও পারেন।
সকালে সোয়েটার, মোজা লেপের ভেতর দিয়ে যেতেন বাবা। সোয়েটার গরম হবে তবে সেটা পরে বিছানা
থেকে নিচে মেঝেয় পা দেবো। কিছুতেই ঠান্ডা লাগা যাবে না তাঁর সন্তানদের গায়ে। আহ্লাদী
মেঘ আমার কাছে বায়না করে আমি যেমনটা করতাম, মা, আমি উঠতে পারবো না, আমার ঠান্ডা
লাগে। আমাকে পানি এনে দেবে,
জুস এনে দেবে, মুড়ি মেখে দেবে আরো কত কী। খুব
মায়ায় মনটা ভরে যায়। নিজেকে দেখি মেঘের মাঝে, নিজের শৈশবকৈশোরবেলা।
গ্রীষ্মের দুপুরে গল্পের বই নিয়ে শুয়ে
পড়েছি, ফুল স্পিডে
ফ্যান চলছে। কিছুক্ষণ পরেই আবার একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। উঠে আবার চাদরখানা গায়ে
টানতে কতো রাজ্যের যে আলস্য! অপেক্ষা করে থাকতাম কখন বাবা এইদিকে আসবেন। আমাকে
কিংবা দাদুকে কাউকে না কাউকে দেখতে, কথা বলতে। দেখামাত্রই বলতাম, একটু চাদরটা দিয়ে
দিবেন। কতো রাগতো বাবা, তুই এতো বড় হয়েছিস, তুই সবারটা দেখবি, না তোর চাদর আমাকে
দিয়ে দিতে হয়!
আমি সেসব থোড়াই শুনেছি! গল্পের বইয়ে ডুবে নিদারুণ
আরামে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়েছি, কখন হাত থেকে বই পড়ে গেছে খসে, টেরই পাই নি।
শীতের দিনে কিংবা ঠান্ডার দিনে খিচুড়ি বাবার খুব
পছন্দ তারমধ্যে সব্জি খিচুড়ি আরো বেশি পছন্দ। খিচুড়ি রান্না করার জন্যে সব্জি ধুতে
ধুতে ভাবছিলাম বাবা কি কখনো ভেবেছিলেন তাঁর কন্যারা কোন সুদূরে সাত সমুদ্দুর সতের
নদী পাড়ি দেবে? বরফ শীতল ঠান্ডা পানি ঘেঁটে ঘেঁটে সাংসারিক কাজ করবে?
ঠান্ডা আমার সহ্য হয় না, কিন্তু নিয়তির কারসাজিতে
শীতের দেশে বসবাস। সারা শীত ধরতে গেলে সর্দি, কাশি, জ্বরে ভুগি। প্রায় দিন সূর্য
দেখা যায় না, অন্ধকার চারদিক, টিপটিপ বৃষ্টি নয়তো বরফ আর সাথে উত্তরের হাওয়াতো
আছেই। ঘুরেফিরে সংসারের কাজ করি আর পুরনো স্মৃতি কারণে অকারণে জাবর কাটি। বয়স
হচ্ছে তারই লক্ষণ হয়তো।
ভেবেছিলেন কখনো বাবা আপনি, আমরা বরফের মধ্যে জুতো
পরে অফিসে যাবো, বাজার করবো, মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাবো? মোটা জ্যাকেট আর মাফলার ভেদ
করে কনকনে শীতের হাওয়া আমাদের হাড়ে ঢুকে যাবে আর চকিতে সেই ঠান্ডার আড়াল এড়িয়ে মনে
পড়বে, আপনি কতো যত্নই যে করেছেন আমাদের প্রত্যেককে। একটু ঠান্ডা যেনো আপনার বাচ্চাদের ছুঁতে না পারে,
সেজন্যে আপনার নির্দেশে সকালে পানি গরম করে মগে দিয়ে যেতো, মুখ ধোওয়া থেকে শুরু
করে সমস্ত কাজ গরম পানিতে হবে।
ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলেই আপনাকে মনে পড়ে বাবা,
আপনার ওম, আপনার গন্ধ, আপনার যত্ন আর ভাবি আপনি এখানে থাকলে আপনার আত্মজাদের রক্ষা
করতে কী করতেন! আরো ভাবি আপনার সাধ্যের মধ্যে থাকলে কী না করতেন! শঙ্করের একটা লাইন আছে, কোথায় জানি না। সেটা এরকম, পৃথিবীর সব
ভালোবাসাতেই স্বার্থ থাকে। এমনকি ছেলের জন্যে মায়ের ভালোবাসাতেও কিছুটা স্বার্থ
মিশে থাকতে পারে। একমাত্র যে ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ, সেটা হলো মেয়ের
জন্যে বাবার ভালোবাসা।
এই লেখাটি তাঁদের জন্যে যারা বলে যাচ্ছেন অনেকদিন
কিছু লিখছি না কেনো । কোথায় ডুব
মেরেছি। মনখারাপের পেন্সিল হাতে নিয়ে বোবা বরফ ভেঙে কিছু স্মৃতিকাচের টুকরো রেখে
গেলাম এখানে, অনেকটুক ভালোবাসা আর অনেকটা অসহায়ত্ব সঙ্গী করে।
১৬/০১/২০১৫
No comments:
Post a Comment