Wednesday 21 January 2015

রাত ভ’রে বৃষ্টি

অনেক দেরিতে হলেও পড়লাম বুদ্ধদেব বসুর বহুলালোচিত আর প্রকাশের আগে কিছুটা সময়ের জন্যে নিষিদ্ধ উপন্যাস ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’নিজের বাড়ির বুক শেলফের কোনায় কোনায় কতো না-পড়া বই পড়ে আছে দেখে নিজেই অবাক হই। খুব ছোট বই, খুব অল্প সময়ে পড়া হয়ে গেলো।

পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, সেই সময়ে তিনি বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা, অনুভূতি কী অন্য চোখেই না দেখতেন! নিঃসন্দেহে তিনি গতানুগতিকতার থেকে আলাদা ভাবনা ধারণ করতেনসে-সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর এই লেখাটি আলোচনায় আসার মতো ছিলো বই কিতখন নারীরা নিজেরাই তাঁদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন, লজ্জা পেতেন, দ্বিধা করতেন। সে-জায়গায় তিনি পুরুষ হয়ে তাদের না-বলা কিংবা চেপে-যাওয়া অনুভূতিগুলো নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন। সেই অনুভূতিগুলো ন্যায় কী অন্যায় সেটার বিচার করবে সময়।

এই উপন্যাসের যথার্থতা বিচার করার মতো বোদ্ধা আমি হই নি হয়তো এখনো, তবু নারী হিসেবে উত্তম পুরুষে কথা বলে-যাওয়া এর মূল নারী চরিত্র মালতীর সাথে আমিও একাত্ম হয়েছি অবচেতনায়। ভালো-লাগা শব্দটা বেশ হালকা মনে হয়, আমি মনে-দাগকাটা কিছু কথা অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চাই।

উপন্যাসের নায়িকা মালতীর আত্মোপলব্ধি,

“আমার ছোট্ট শরীরটার তলায় অমন প্রকাণ্ড একটা কালো মেঘ কোথায় লুকিয়ে ছিলো এতদিন? তবে কি নয়নাংশুকে আমি কখনোই ভালবাসিনি? বাসিনি তা নয়, কিন্তু ওকে আমি পুরোপুরি কখনো দিইনি নিজেকে–এতোদিনে সেটা বুঝতে পারছি–একটা অংশ সরিয়ে রেখেছি না জেনে– সেই গোপন গভীর চরম অংশ তোমারই জন্যে আমি জমিয়ে রেখেছিলাম, জয়ন্ত। সে আমার স্বামী, রাতের পর রাত বছরের পর বছর আমি শুয়েছি তার পাশে, তার আর আমারই সন্তান বুন্নি–কিন্তু ও সবে কিছু এসে যায় না। কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে, বিনা চিন্তায়, বিনা ইচ্ছায় বিনা ভালোবাসায় কি স্ত্রীলোকের গর্ভে সন্তান আসে না? আমি এখন বুঝতে পারছি যে সাত সন্তানের মা হ’য়েও কোনো মহিলা কুমারী থেকে যেতে পারেন–হয়তো ঘরে ঘরে এমন গৃহিণী অনেক আছেন যাঁরা একটা বোবা শরীর নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবন। আর তা তাঁরা জানেন না পর্যন্ত। আমিও কি জানতাম আমার গোপন রহস্য, জয়ন্তর সঙ্গে দেখা না হ’লে? অংশু পারেনি–নতুন বিয়ের পরেও কখনো পারেনি আমাকে নিজের মধ্য থেকে এমনি ক’রে টেনে বের ক’রে আনতে, ভাসিয়ে নিয়ে ডুবিয়ে দিতে যেন অঝোর মেঘ ঝ’রে ঝ’রে পড়লো–নিঃশেষে নিঃশেষে।”

অভিমানী স্ত্রী মালতী বলেছে,

“নয়নাংশু আমাকে সভ্যভব্য মালতী ব’লেই ডাকে, আদরের সময় নিজে অনেক কিছু বানিয়ে নেয় কিন্তু লোটন বলে ডাকে না, তার মতে ওটা নাকি মানায় না আমাকে, ওটা ‘ন্যাকা’ নাম, অর্থাৎ আমার বিয়ের আগেকার কুড়ি বছরের জীবনটাকে সে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু তুমি নিলে আমার জীবনের অংশ, আমার অতীতের আর বর্তমানের, আমার কথা শুনে-শুনে ক্লান্তি নেই তোমার; আমি বুঝতে পারলুম তোমার জীবন এখন আমাকে ঘিরে–ঘিরে ঘুরছে। সেটা তুমি খুব সরলভাবে সহজভাবে মেনে নিয়েছো, তা নিয়ে কোনো ভয় নেই তোমার, লজ্জা নেই- কত সহজে আমার হাত ধরেছিলে তুমি, কানে কানে ‘লোটন’ বলে ডেকেছিলে, আড়ালে যখন ‘তুমি’ বলো মনে হয় যেন চিরকাল আমি তা-ই শুনেছি, আর তাই তো যেদিন প্রথম আমাকে জাপটে ধরে চুমু খেলে আমি অবাক হলাম না, ভাবলাম না এটা ভালো হলো না মন্দ হলো, শুরু সারা শরীরে থরথর করে কেঁপে উঠলাম যেন আমি ষোলো বছরের কুমারী।”

আত্মগ্লানিতে ভোগা মালতী বলছে,

“কেউ যেন না ভাবে আমি নয়নাংশুর দুঃখ দেখতে পাইনি বা চেষ্টা করিনি তাকে সান্ত্বনা দিতে। তখন পর্যন্ত জয়ন্তর সঙ্গে কিছুই হয়নি আমার, কিন্তু আমি দেখছি নয়নাংশু কেমন অদ্ভুত বদলে যাচ্ছে, হাসি কমে গেছে মুখের–আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে ভালো করে জবাব দেয় না–অন্তত একজন মানুষের কাছে আমি যে তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি এইটেই ভালো লাগছে না তার। আমি কি তখন কম চেষ্টা করেছি নয়নাংশুকে খোশমেজাজে রাখতে? রাঁধতে আমি ভালোবাসি না, উনুনের আঁচে আমার মাথা ধরে, কিন্তু এই সময়ে আমি নিজের হাতে রান্না করেছি যা-যা তার বিশেষ পছন্দ, ঝি-চাকর থাকা সত্বেও তার শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি ক’রে দিয়েছি নিজের হাতে, জুতো পালিশ ক’রে দিতেও পরোয়া করিনি। সে আরামপ্রিয় মানুষ, তার উপর একটু পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে–আমি অনেক খেটে অনেক যত্নে ঝকঝকে রেখেছি ফ্ল্যাটটিকে, আলোয় নতুন শেড আর সোফায় নতুন ঢাকনা পরিয়ে উজ্জল রেখেছি বসার ঘর–কিন্তু সে-সব যেন চোখেই পড়েনি তার। অথচ আমার হাতের কোনো একটি ছোটো কাজও জয়ন্তর চোখ এড়ায় না, যদি কোনদিন কানের দুল বদল করি তা পর্যন্ত লক্ষ করে সে, আমি যখন টিপট থেকে চা ঢালি তখন টের পাই তার দৃষ্টি আমার হাতের উপর।”

নিজের পক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে মালতী ভেবেছে,

“ও-সব ভালোবাসাবাসি অংশুর মতো লোকদের বানানো ব্যাপার-একটা ধারণা, কল্পনা, হয়তো একটা আদর্শ যার কাছাকাছি পৌঁছতে পারে না কেউ, আর সেই আপসোসে তা নিয়ে শুধু কথা বলে। এমন মানুষ কে আছে যে অন্য একজনের সব ইচ্ছে মেটাতে পারে? অল্প বয়সে এক ধরনের মন থাকে, চনচনে চাঙ্গা থাকে অব্যবহৃত শরীর, হঠাৎ কোনো একজনের সব-কিছুই ভালো লেগে যায়। অন্য সব মানুষ থেকে আলাদা ক’রে নিই তাকে, মনে হয় তাকে পেলে আর-কিছু চাই না-কিন্তু তখন তাকে পাওয়া গেলো, ধরা যাক তারই সঙ্গে বিয়ে হ’লো যখন, তখন মোহাচ্ছন্ন ভাবটা এক গ্রীষ্মেই ঝ’রে পড়ে, এক বর্ষার জলেই ধুয়ে যায়। তারপর থাকে স্বার্থ, থাকে একত্র বসবাসের ফলে মমতা, থাকে অভ্যাস, পুরানো চটিজুতোর আরাম-আর থাকে শরীর। কিন্তু শরীরও কত সহজে ক্লান্ত হয় বিমুখ হয়, কত সহজে অন্য সুখের স্বপ্ন দ্যাখে-যদি না কারো বোকা হ’য়ে জন্মাবার মতো সৌভাগ্য হয়, কিংবা চোখে থাকে এমন ঠুলি যাতে সামনের মানুষটিকে ছাড়া আর-কিছুই সে দেখতে পায় না, জয়ন্ত আমাকে যত কথা বলেছে, তারমধ্যে ‘ভালোবাসা’ কথাটা একবারও উচ্চারণ করেনি-আমি সেজন্য কৃতজ্ঞ তার কাছে...”

স্বামী নয়নাংশুর অভিমানও কাচের বাসনের মতো ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গেছে,

“হায় ভালোবাসাযেন তা মুখের কথার উপর নির্ভর করে-যেন তা চোখে ভেসে ওঠে না, ধরা পড়ে না গালের রঙে, হাতের নড়াচড়ায়, এমন কি পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকার ধরনে, নিচু হ’য়ে চা ঢেলে দেবার ভঙ্গিটুকুতে পর্যন্ত। তা আলোর মতো সহজ, রোদের মতো নির্ভুল-সেখানে কোনো তর্ক নেই, তা চিনে নিতে এক মুহূর্ত দেরি হয় না। এই কথাটাই আমি বলার চেষ্টা করেছিলাম মালতীকে অনেক কষ্টে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে–তুমি যদি সত্যি আমাকে ভালবাসো আমি কেন তা অনুভব করি না? কেন করো না তা আমি কী ক’রে বলবো! ব্যস, এর উপর আর কথা নেই। একটা দেয়াল, বোবা দেয়াল, মাথা ঠুকলে শুধু মাথা ঠোকার প্রতিধ্বনি বেরোবে।”

প্রতি দিনের জীবন পরিক্রমায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কতো অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যায়। এই ক্লান্তিকর নাগরিক ব্যস্ততায় নর-নারীর একান্ত চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব এখন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ব্যক্তিগত হতাশা কতকিছুই আসলে তার কারণ হতে পারে। কোনো জয়ন্ত এখানে একটি উপলক্ষ্য মাত্র তাই বারে বারে মালতী আর নয়নাংশুর অংশ আমরা জানতে পাই, জয়ন্তের অনুভূতি নিয়ে কিন্তু একটি কথাও লিখেন নি লেখক। আমার চোখে দাম্পত্য জীবন নিয়ে মালতীর হতাশা বের করে আনতে জয়ন্তকে সামনে এনেছেন মাত্র লেখক। পতি পত্মী অউর বোহ বা থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারেরা কারোর কাছে নিমিত্ত মাত্র, কারোর কাছে নিয়তিরাত্রি

প্রসঙ্গত, কদিন আগে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড নোট’ পড়লাম। প্রথম অর্ধেকটা বেশ টেনে রেখেছিলো, শেষের দিকটা বিরক্তিকর ছিল। একই কথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এতো বার লেখা। অনেকটা জনপ্রিয় সিনেমা বানানোর জন্যে চিত্রনাট্যকাররা যেমন ‘স্পাইসি মশলা’ ঢোকান সেইরকম। আর এতো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যে নোট লিখবে সে কখনো আত্মহত্যা করতে পারবে না। আত্মহত্যা করে মানুষ ঝোঁকের মাথায়, চিন্তা ভাবনা করে আত্মহত্যা করা আমার দৃষ্টিতে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তারপরও একটা জিনিস আমার মনে হয়েছে, একজন স্বামীর কাছে উপেক্ষিত স্ত্রী, প্রেমিক বা বন্ধুর কাছে অবহেলিত হলে কী ধরনের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যেতে পারে সেধরনের মানসিক অবস্থা চিত্রণে তিনি বেশ অনেকটাই সফল হয়েছেন। যেমন বুদ্ধদেব সফল হয়েছেন, উপেক্ষিত স্ত্রী মনের গুঞ্জরিত গোপন ভাবনাগুলো সামনে বের করে আনতে।

যাঁরা সবকিছু শুধু ন্যায়-অন্যায়ের পাল্লায় বিচার করেন না, যাঁরা জীবনের সাদা-কালোর বাইরের গ্রে পার্টটা অনুভব করেন তারা বইটা পড়তে পারেন। মানুষ যে শুধু আদর্শ বা শুধু অপরাধের রূপকথার চরিত্র নয়, রাক্ষসও হতে পারে শ্রেক আর রাজকুমারও হতে পারে ময়ূরবাহন, সেই বাস্তবতার ঘরোয়া স্বরূপ জানতে কিংবা হৃদয়ের পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থার যুগযুগ সঞ্চিত যাত্রীদল যে-সামাজিক মানুষ, তার অন্তরের অন্দরমহলের ওঠাপড়ার কাহিনি জানতে চাইলেও এই বইটা একটা আবশ্যিক পাঠ্য হতে পারে। প্যাস্কেলের সেই কথাটাও বলে নিতে পারি, হৃদয়ের আছে যুক্তি, যা কেবল হৃদয়ই জানে।

তানবীরা

১৮/০১/২০১৫

No comments:

Post a Comment