
বহুদিন ধরে পড়তে চাওয়া নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা
“আমি বীরাঙ্গনা বলছি” বইটি পড়ে শেষ করলাম। খুব সহজ ভাষায় সাতটি মেয়ের বীরত্বের
কাহিনী এতে লেখা আছে। একশো ষাট পৃষ্ঠার এই বইটি পড়তে খুব বেশী সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু
আমার অনেক সময় লেগেছে। আমি পাঁচ দিনে সাত জনের গল্প পড়লাম কারণ আমি হজম করতে
পারতাম না। অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে হয়, থমকে থাকতে হয়। কীসের মধ্যে দিয়ে গেছেন তাঁরা। কিছু
লিখবো না লিখবো না ভেবেও শেষ পর্যন্ত লিখছি। তাদের নাম-পরিচয়, পুর্নবাসন, তাদের
সংগ্রাম নিয়ে, তথ্য উপাত্ত ভিত্তিক পূর্নাঙ্গ কোন বই আছে কীনা, তাও জানা নেই। আমি
বাংলাদেশের অনেক মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমা দেখেছি কিন্তু শুধু তাদের ওপর করা অত্যাচার
এবং যুদ্ধ পরবর্তী তাদের মানসিক কষ্টের ওপর কারো কোন কাজ দেখেছি বলে মনে করতে
পারছি না। তাদের পুর্নবাসনের কার্যক্রমের ওপরে চমৎকার সব ছবি তৈরী হতে পারতো। তাতে
ভবিষ্যত প্রজন্ম তাদের আত্মত্যাগ নিয়ে জানতো, তাতে করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের উপলব্ধি
ও শ্রদ্ধা বাড়তো। আজকে যুদ্ধ বিরোধী পক্ষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এতো ধোঁয়াশা তৈরী করে
নতুন ছাগু প্রজন্ম তৈরী করতে পারতো না। এই থেকে কিছুটাতো বুঝতে পারি আমাদের সমাজ
বীরাঙ্গনাদের মূল্যায়ন কীভাবে করেছে। যুদ্ধের সময় শারীরিক অত্যাচার আর যুদ্ধ পরবর্তী
বাংলাদেশে মানসিক অত্যাচার নিয়ে বীরাঙ্গনারা ধরতে গেলে একাই লড়ে গেছেন এবং তাদের
অনেকেই এখনো বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে একাই লড়ে যাচ্ছেন।
এই বইটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক আমার চোখে পড়েছে,
জীবন যুদ্ধে যারা শত কষ্টের মাঝেও হেরে যায় নি শুধু তাদের গল্প দিয়েই বইটি
সাজিয়েছেন লেখিকা। আমি সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝতে পারি, সবাই এতো মানসিক, শারীরিক
যন্ত্রনা পোহানোর মত শক্ত ছিলো না। সবাই সাঁতরে তীরে ভিড়তে পারেনি। অনেকেই হেরে
গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। লেখিকা হয়তো ইচ্ছে করেই তাদের কথা
সযতনে এড়িয়ে গেছেন। এই বইটি দিয়ে হয়তো লেখিকা আমাদের একটি
বার্তা দিতে চেয়েছেন, আমরা যারা সহজে হতাশ হই, হাল ছেড়ে দেই, নৈরাশ্যের অন্ধকারে
হারিয়ে যেয়ে মুক্তি খুঁজি তারা যেনো যুদ্ধ করার, লড়ার মনোবল রাখি। আমাদের ইতিহাস
অন্তত তাই বলে। বইটির সাত জন বীরাঙ্গনা ভিন্ন ভিন্ন পারিবারিক অবস্থা থেকে এসেছে।
দর্জির মেয়ে আছে, গ্রামের বিত্তশালী কৃষকের মেয়ে আছে আবার শহরের উচ্চ পদস্থ সরকারী
কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিবিদের মেয়ে আছে। যাদের অনেকেই আজো ঘুমোতে পারে না, আজো সেই
পদশব্দ শুনতে পায়, শরীরে বিভিন্ন রকমের কষ্ট, যন্ত্রনা, ব্যাধি যা মুখ খুলে কাউকে
বলতে পারে না। তারা কী আজও অপেক্ষা করে নেই, তাদের পরিবার কী আজও অপেক্ষা করে নেই,
এই হায়েনাদের বিচারের জন্যে? রাজনীতিবিদগন কবে তাদের আতর্নাদের দিকে কর্নপাত করবে?
আর কত দিন বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদবে? এক মহাসাগর দীর্ঘশ্বাসে আজো বাংলা আকাশ
ভিজে আছে মা। পয়তাল্লিশ বছর আশায় আছেন তাঁরা .........
মেহেরজান চরিত্রটি বলছে, “জীবনটা তো সরল
সমান্তরালরেখায় সাজানো নয়। এর অধিকারী আমি সন্দেহ নেই, কিন্তু গতিপথ নিয়ন্ত্রণ
করেন – কি বললেন আল্লাহ, পাগল হয়েছেন! বাঙালি মেয়ের জীবন পরিচালিত হবে আল্লাহর
নির্দেশে! তাহলে এদেশের মৌলবী মওলানারা তো বেকার হয়ে থাকবেন, আর রাজনীতিবিদরাই বা
চেঁচাবেন কি উপলক্ষ করে? না এসব আমার নিজস্ব মতামত, অভিযোগের বাঁধা আটি নয়।“
“যে কথা তাহের (ফাতেমার স্বামী) জানে না সেই কথাই
চাঁপা ডাক্তারকে বললো। সে নির্মম কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সে নিজেও কেঁদে উঠলো।
ডাক্তার নিচু হয়ে চাঁপাকে প্রণাম করলো। দিদি, আপনারা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আশ্চর্য এতো ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করলো বাঙালিরা, আর মা বোনদের দেয়া
ত্যাগের মূল্য দিতে পারলো না। দূর্ভাগ্য সে দেশের!”
“আমি মাঝে মাঝে ওর ঘরে গিয়ে বসতাম। চোখ নিচু করে
মিনা বেরিয়ে যেতো অথবা ঘরে ঢুকতো। কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কুন্ঠিতভাবে জবাব দিতো।
বলতাম, জেরিনা এই মেয়েগুলোর বুকে আগুন জ্বেলে দিতে পারিস না, ওরা কেন মাথা নিচু
করে চলে? নীলিমাদি তোমাদের এ সমাজ ওদের চারিদিকে যে আগুন জ্বেলে রেখেছে তার
উত্তাপেই ওরা মুখ তুলতে পারে না। বেশি বেশি বক্তৃতা দিও না। ওদের সম্পর্কে জেরিনা
খুব বেশি স্পর্শকাতর ছিল।“
কয়েকবার একটি লাইন ঘুরেফিরে এসেছে বইটিতে,
“পাকিস্তানি সেনারা যখন আমাদের পেয়েছে তখন আমরা রাজাকারদের উচ্ছিষ্ট” --- পুরো
বইটির মধ্যে এই একটি লাইন আমার কাছে যথেষ্ঠ পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। লেখিকা কেন এই
ধরনের শব্দ চয়ন করেছেন, তিনি জানেন। একজন জীবন্ত মানুষ কী করে উচ্ছিষ্ট হতে পারে?
যতো শারীরিক লাঞ্ছনাই তিনি ভোগ করে থাকুন। একজন প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখিকা যিনি
হৃদয় দিয়ে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্যে দিন রাত এক করে খেঁটে গেছেন তিনি কী
অন্য কোন শব্দ চয়ন করে এই পারিপার্শ্বিকতার ছবিটা আঁকতে পারতেন না? কোন মানুষ
সর্ম্পকে এ ধরনের কথা ভাবতে আমার হৃদয় মানে না। শারীরিক কারণে কেউ কী উচ্ছিষ্ট কেউ
হতে পারে? পারে ক্ষতিকর স্বভাব চরিত্রের কারণে যেমন রাজাকাররা।
বইটিতে একটি ব্যাপার বার বার এসেছে, ধানমন্ডি
নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে অনেক বীরাঙ্গনার স্বামী, ভাই, পিতা, নিকটাত্মীয় এসে দেখে
করে গেছে, শাড়ি, খাবার উপহার এনেছে কিন্তু বাড়ি ফিরিয়ে নিতে পারবে না বলে দিয়েছে।
অনেক পরিবার সরকার থেকে যুদ্ধক্ষতিগ্রস্তা এসব বীরাঙ্গনাদের জন্যে পাওয়া অনুদানের টাকা
দিয়ে নিজেদের বাড়িঘর মেরামত করিয়েছে, কিংবা ব্যবসায় নিজেদের স্বচ্ছলতা খুঁজেছে।
তাদের মধ্যে কোন কোন মুসলমান ধর্মালম্বী পিতামাতা তাদের কন্যাকে গ্রহন করলেও মোটামুটি
বলা যায় (বইয়ের তথ্যানুযায়ী) কোন হিন্দু ধর্মালম্বীরা মুসলমান পিশাচ দ্বারা
লাঞ্ছিত তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে নেয় নি। এমন কী যারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে
গেছে তারাও তাদের কন্যার সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কুমারী
পূজা করা সনাতন ধর্মালম্বীরা কত সহজেই আত্মজাকে পাশ কাটিয়ে যায়। বার বার যুদ্ধের
বলি আর ধর্মের বলি কেন মেয়েরাই? প্রসঙ্গতঃ কদিন আগে দেখা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি
“ফিলেমোনা” মুভিটার নাম না উল্লেখ করে পারছি না। “ফিলেমোনা” ক্রিশ্চান ধর্মের বলি।
অথচ ধর্মের আচার নিষ্ঠা পালনে মেয়েদেরকেই বেশি উদগ্রীব থাকতে দেখা যায়। কবে কোথায়
এর শেষ কে জানে ..................
এই বাংলায় একজন মুক্তিযোদ্ধা গর্ব ভরে পরিচয় দিতে
পারেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু একজন বীরাঙ্গনাকে লুকিয়ে যেতে হয় তার চরম দুঃখের
আর নির্যাতনের কাহিনী। আমরা নিজেরা গর্ব ভরে বলি আমার চাচা, মামা, খালু
মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিন্তু চাতুরতার সাথে লুকিয়ে যাই আমার যেই আত্মীয়া ধর্ষিতা
হয়েছিলেন তার কথা। এই পতাকায় কী তাদের আত্মত্যাগের রক্ত লেগে নেই? অনেক মহীয়সী বীরাঙ্গনা
অনেক মনোঃকষ্টে আছেন, তারা দাবী করতে পারেন না যুদ্ধে তাদের অবদানের কথা।
পরিবার-পরিজনদের কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন। কিন্তু এই লজ্জা কেন তাদের হবে? এই লজ্জাতো
স্বাধীন বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির। মানুষ হিসেবে আমাদের লজ্জা হওয়ার কথা। যে দেশ,
জাতি তাদের মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি দায় তাদের .....সে দায় তোমাদের নয়
মা।
https://www.youtube.com/watch?v=qfryIrKdXGU
(লেখাটা হয়তো বেশী আবেগতাড়িত, ক্ষমাপ্রার্থী
সেজন্যে, এরকম একটা বই পড়ে মেয়ে হিসেবে নিজেকে সামলে রাখা কঠিন)
তানবীরা
১৬/০২/২০১৫