প্রিয় গল্পটি নিয়ে লিখতে বসা বড্ড
কঠিন।
আমি অসংখ্যবার আমার অন্যান্য
লেখায় এ-কথাটি উল্লেখ করেছি যে, এতো এতো মনোমুগ্ধকর লেখা ছড়িয়ে আছে চারপাশে, তার
মধ্যে থেকে একটিকে প্রিয় বলে বেছে নেয়া অনেক শক্ত, অন্তত আমার জন্যে। এছাড়া সময়ের সাথে, মানসিক অবস্থার সাথে, বয়সের সাথেও রুচি, পছন্দ, মন বদলাতে থাকে। দিনে দিনে দেশ বিদেশের নানা
লেখকদের নাম যোগ হয়ে প্রিয় গল্পের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে।
এমনিতে আমি আমার নিজের ভাষার বই
পড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, বাংলা সাহিত্যের বিশাল সম্ভার উপচে পড়ছে বিভিন্ন
কৃতি লেখকদের অসামান্য সৃষ্টিতে। তার ওপর যতোদিন যাচ্ছে ততোই না-পড়া বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। কতো কী জানি না, পড়া হয় নি কিংবা হবে না তার হতাশা জাপটে ধরছে ক্রমশ।
সেই
কঠিন কাজের ভার নিয়ে ভাবতে ভাবতে হারিয়ে গেলাম ছোটবেলায়। প্রিয় যা ছিল, প্রিয় তাই
আছে। কিছুই হারায় নি, হয়তো হারাবেও না। সেই জ্বলে-ওঠা নিভে-যাওয়া জোনাকি পোকা, আমসত্ত্ব, চালতার আচার,
সারা গায়ে সুর মেখে বৃষ্টিতে-ভেজা। না হারিয়েছে গান বা কবিতা, না
সেই কাউকে নাম না-বলা হৃদয়গহিনে লুকিয়ে থাকা মানুষটা, চোখের
কাজল কিংবা খোঁপার কাঁটা, তেঁতুল বনে জ্যোৎস্না দেখা কিংবা
কপালে কারো নামের টিপ-আঁকা। সময়ের সাথে প্রিয় থেকে আরো প্রিয়তর হয়েছে সমস্ত কিছু।
অনেকে
বেশ বলেন, ছোটবেলায় এঁর লেখা আমার ভাল লাগতো, কিংবা গান বা খাবার। আমি এমন কিছু
শুনলে সংশয়ে পড়ে যাই, আমার কি তাহলে কোন অতীত নেই! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়,
ছোটবেলার ভালোলাগার রেশ আজোও আমাকে ছুঁয়ে রেখেছে। উন্মাদ কিংবা টিনটিন সামনে পেলে
না-উলটে পারা যায়? কঠিন সময় হয়তো বদলে দেয় অনেককিছুই, শুধু পারে না হয়তো ভেতরের মানুষটাকে একেবারে
বদলে ফেলতে। তাই
ছোটবেলার ভাল লাগার রেশ কোথাও না কোথাও রয়েই যায়। মানসিকতা, রুচি বদলে গেলেও,
ভেতরে আবেশটা কোথাও রয়ে যায়।
আনমনে
প্রিয় তালিকা ওল্টাতে ওল্টাতে যে-নামটি প্রথম মনে এলো, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা
আমাদের আটপৌরে বাঙালিদের সবচেয়ে কাছের যে-মানুষটি, সেই রবি ঠাকুর। গল্পগুচ্ছের
মোহে বয়ঃসন্ধিকাল কাটায় নি এমন বাঙালি খুব কম পাওয়া যাবে। বিভিন্ন স্বাদের গল্পে
ঠাসা প্রায় সাতশ পৃষ্ঠার এই বইটি নেই এমন খুব কম বুকশেলফ আছে বাঙালি বাড়িতে।
কাবুলিওয়ালা, গুপ্তধন, পোষ্টমাষ্টার, ল্যাবরেটরি, হৈমন্তী, নষ্টনীড়, মধ্যবর্তিনী,
কঙ্কাল, সমাপ্তি প্রায় প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে ফিরে।
সেই
গেরুয়া দুই মলাটের ভেতরে অজস্র কাব্যিক ও বাস্তবের চরিত্রের রূপমহলের চলচ্চিত্রে চোখ
ধাঁধায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেও এখনো যার মুখ সবার প্রথমে আমার মনে ভেসে ওঠে সে হলো
‘মিনু’। মৃন্ময়ী বললেই বেশি কাব্যিক শোনায় কিন্তু তাতে সে বড্ড দূরের হয়ে যায়। ‘মিনু’ বললে বুদ্ধিদীপ্ত দুষ্ট চোখের যে-নিষ্পাপ
চেহারাটি মনে ভেসে ওঠে, সে যেন বড্ড চেনা, পাশের বাড়ির মেয়েটি। পিঠ পর্যন্ত ছোট ঈষৎ কোঁকড়ানো রুক্ষ চুলের
শ্যামলা মেয়েটি উঁচু করে বাঙালি কায়দায় শাড়ি পরে বনে বাদাড়ে, উঠোনে মাঠে, গাছে,
নদীতে, ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আপন মনে নেচে বেড়াচ্ছে যা হলো গেছো মেয়ের রাবীন্দ্রিক
প্রতিকৃতি।
বিভূতিভূষণের ‘দুর্গা’-র
আদল কি খানিকটা ‘মিনু’-তে ছায়া ফেলে? নাকি মিনু সেই লৌকিক দেবী বনদুর্গার রূপায়ণ?
বাংলার
শাশ্বতরূপ মেনে সে বাপের আদরের মেয়ে। কিন্তু গতানুগতিক ধারার চেয়ে আলাদা, সাধারণের
চোখে লক্ষ্মীছাড়া, দুরন্ত। যেসব কাজে সাধারণ মেয়েরা লজ্জা পেয়ে গায়ের কাপড় দিয়ে
নাক মুখ ঢেকে ফেলে, সেসব ঘটনা সে কোঁকড়া চুল পিঠে দুলিয়ে, নিষ্পাপ হরিণ চোখ মেলে,
নিদারুন কৌতূহলী চোখে কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। তারপর নিজের বালক সঙ্গীদের কাছে
নিজের কল্পনার রঙ মিশিয়ে নিজের ভাষায় বর্ণনা করে।
এই
যে শ্রীমান অপূর্বকৃষ্ণ-এর গ্রামে ফেরার ঘটনাটাই ধরা যাক। গ্রামের অবস্থাপন্ন
বাড়ির ছেলে অপূর্ব কোলকাতায় থেকে পড়ে, তাকে গ্রামসুদ্ধ কে না চেনে। ছুটিতে গ্রামে
ফিরে এসে অনেকদিনের অনভ্যস্ততায় সে স্যুটকেস হাতে জুতোশুদ্ধ নৌকোঘাটের কাদায় পড়ে
গেলে অন্য মেয়েরা এ-দৃশ্য দেখে লজ্জায় হয়তো পালিয়ে যেতো কিংবা দেখেও না-দেখার ভান
করতো। কিন্তু মিনুর দ্বিধাহীন বাঁধভাঙা উচ্চহাসিতে অপূর্বই হয়ে গেলো অপ্রস্তুত। সত্যজিতের
চলচ্চিত্রে এই দৃশ্য যেন সরাসরি গল্পগুচ্ছের পাতা থেকে উঠে-আসা।
সমবয়েসি
মেয়েদের সাথে মিনুর ততো ভাব নেই। গ্রামের গুরুজনস্থানীয় পুরুষেরা তাকে স্নেহের
চোখে দেখলেও বয়স্থা নারীরা তার ওপর নিদারুণ বিরক্ত ছিল। মিনুর মা এ সমস্ত নিয়ে
দারুণ বিপাকে ছিলেন কিন্তু মিনুর বাবা দূরে থাকে, মেয়েকে যারপরনাই স্নেহ করে, তাই
মিনুর মা পারতপক্ষে হাত তুলতো না মিনুর গায়ে।
আচ্ছা,
এতো এতো গল্প বা চরিত্র থাকতে হঠাৎ ‘সমাপ্তি’ মানে অপূর্ব-মিনুই বা কেন মনে ভাসলো?
তা কি এই অস্থির সময়ের কারণে?
যে-সময়ের
মধ্যে আমরা এখন বাস করছি তার সাথে সেই সময় কি আসলে মেলানো যায়? অনেকদিনের
চেনাজানা, পছন্দের সহপাঠী কিংবা সহকর্মী যখন জীবনসাথীতে রূপ নেয়, অনেক সময় দেখা
যায় তারপর সে এক ভিন্ন মানুষ। যে-মানুষটিকে চিনে দুজন দুজনের কাছে এসেছিলো, এ আসলে
সে নয়। যে-সময়ে দুজন মানুষ দুজন মানুষকে মতের কিংবা মনের অমিলের কারণে বরদাস্ত
করতে পারে না, সেসময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতেও কষ্ট হয় অপূর্ব একবুক ভালোবাসা নিয়ে
নীরবে তার বালিকা বধূর পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো। অপূর্ব তার বউকে কোন সময় বেঁধে
দেয়নি, শর্ত দেয় নি, দিয়েছে একবুক শর্তহীন ভালবাসা।
কিন্তু
সব ঘটনার সমাপ্তিই কি ঠিক এরকম মধুর?
সমরেশ
মজুমদারের কালজয়ী উপন্যাস ‘সাতকাহন’-এর দীপাবলীও বালিকা বয়সে বউ সেজেছিলো, মাত্র
এগারোতে তাকে বড় ঘরের রুগ্ন একটি পাত্রের হাতে তুলে দেয়া হয় যে নিজের অসমর্থতা
ঢাকতে দীপাবলীর ওপর প্রথম রাতেই হামলা করে। পাত্রের ওপর তার পরিবারের চাপ ছিলো
যেকোনো ভাবেই দীপাবলীকে গর্ভবতী করতে হবে। মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা সে বিবাহিত ছিলো
তারপরই বিধবা। শুরু হলো সংগ্রামী জীবন যা তাকে বালিকা থেকে এক ধাক্কায় পরিণত
মানুষে পরিবর্তিত করে ফেলে। দুঃস্বপ্নের
এই নিষ্ঠুর অতীতের কৃষ্ণচিহ্ন মুছে ফেলে সে শুরু করতে চেয়েছিল নতুন জীবন, জয় করতে চেয়েছে নিজের ভাগ্য। আর সেই চলার পথেও
কাছের মানুষের বীভৎস, লোভী চেহারা তাকে বার বার আঘাত করে,
কিন্তু পারে না পর্যুদস্ত করতে। তার জীবন এসে মেশে নাটকে, আবার জীবন কেবলই ছাপিয়ে যায় নাটকে। মিনু বয়ঃসন্ধিকালের যে
সমস্ত ভালোবাসা আর আনন্দের সমাপ্তির মাঝে দিয়ে গেছে সেরকম কিছুতে কি অধিকার ছিলো
না দীপাবলীরও?
সমরেশ মজুমদারকে একবার জিজ্ঞেস করা
হয়েছিল, ‘দীপাবলী’ তিনি কেন আঁকলেন? লেখক জবাব দিয়েছিলেন, তিনি একবার তরুণ বয়সে
জলপাইগুড়ি জঙ্গলে হাঁটছিলেন, সেখানের চা বাগানে বছর দশ/এগারোর একটি বেশ হাসিখুশী
বিধবা মেয়েকে দেখেছিলেন সপ্রতিভ মুখে হাসছে, বেড়াচ্ছে, ঘুরছে। কেনো যেনো সেই
মেয়েটির ছবিটি তাঁর মাথায় গেঁথেছিলো। সেই মুখটি মনে করেই ‘দীপাবলী’-কে রচনা আর
কিছুতেই তিনি তাঁর উপন্যাসের ‘দীপাবলী’-কে হারতে দিতে চাননি তার জীবন সংগ্রামে,
তাই ‘সাতকাহন’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শান্তিনিকেতনে
জানিয়েছিলেন ‘সমাপ্তি’ গল্পের পটভূমির কথা। রবীন্দ্রনাথ একবার তাঁর জমিদারি দেখা
উপলক্ষে একটি নদীর তীরে নৌকা লাগিয়েছেন। নৌকায় বসে তিনি কাজ করছিলেন। দেখলেন
একটি বেশ বড়ো মেয়ে, অবিবাহিত, নদীর তীর থেকে তাঁর নৌকার দিকে দেখছে। তার সরল সতেজ
দৃষ্টি, চলাফেরার মধ্যে একটি সহজ ফূর্তির ভাব দেখে রবীন্দ্রনাথের খুব ভাল লাগলো। বাঙালি
মেয়েদের মধ্যে সেরকম ভাব তিনি দেখেনই নি বলা চলে। তারপর দিন দেখলেন তাঁর পাশের
নৌকায় চাল, ডাল, তেল, নুন মশলা বোঝাই হচ্ছে আর সে মেয়েটিকে কনে সাজিয়ে অনেকে মিলে
তার পাশের নৌকায় নিয়ে আসছে। মেয়েটি কিছুতেই নৌকায় উঠবে না, তাকে অনেক জোরজার করে
নৌকায় তোলা হলো।
সচরাচর মেয়ে পাঠাবার সময় যে
কান্নাকাটি হয় তার কিছুই সেখানে ছিলো না। বরং অনেকের মধ্যে বেশ আমোদের ভাব ছিলো।
পাশের নৌকাটি ছেড়ে গেলে, তীরের স্ত্রীলোকেরাও চলে গেলেন। দূর থেকে শুধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুনতে পেলেন, একজন স্ত্রীলোক আর একজনকে বলছেন, “ওকে তো জানো
বোন, ও ওই রকমই। কত করে বললাম, পরের ঘর করতে যাচ্ছিস, বেশ সাবধানে থাকিস, ঘাড় হেঁট
করে থাকিস, উঁচু করে কথা বলিস নে, কিন্তু সে কি তা পারবে” ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ঘটনাটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সমাপ্তি’ লেখার পটভূমি। কিন্তু নৌকোঘাটে
দেখা সেই তেজি মেয়েটির ‘সমাপ্তি’ কি রবীন্দ্রনাথের কল্পনার ‘সমাপ্তি’-র মতো
হয়েছিলো? তার স্বামী কি তার মন বোঝার চেষ্টা করেছিলো? নাকি বাকি হাজার হাজার লুকনো
কান্নার গল্পের মাঝেই মিশে গেলো সেই গল্পটি? অজানাই হয়তো রয়ে গেলো সেই কাহিনি।
উপন্যাস কেনো শুধু, যদি
আমাদের চারপাশে তাকাই বাংলাদেশের অনেক মেয়ের জীবনেইতো বয়ঃসন্ধিকালের সমাপ্তি অনেক
করুণ। যদিও আমরা বাঙালি মেয়েরা আমাদের একান্ত ব্যাপারগুলো বাইরে বলতে ভয় পাই,
এড়িয়ে যাই কিন্তু এর ভেতরও কেউ কেউ প্রথা ভেঙে কিছুতো লিখছেন। তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘আমার
মেয়েবেলা’ বইটিতে লিখেছেন তাঁর বয়ঃসন্ধিকালের এবং তারও আগের অনেক নিপীড়নের কথা।
লোভী পুরুষের অনেক অযাচিত স্পর্শ শিশুকালেই নিজের শরীর সম্পর্কে মেয়েদের মনে অজানা
ভয়, ক্ষেত্রবিশেষে খানিকটা বিতৃষ্ণা এনে দেয়। পদে পদে মেয়েদেরকে ঘরেই করা হয়
বঞ্চনা, নিপীড়ন। ছেলে সন্তান আর মেয়ে সন্তানের মধ্যে পার্থক্য করে, মেয়েকে পশ্চাৎপদ
করতে প্রথমে উদ্যত হয় তার একান্ত আপনজনেরা। সবার কি আর মিনুর মতো অবাধ স্বাধীনতায়
পাখা মেলে হাওয়া কাটার সুযোগ হয়? নাকি অপূর্বেরা গল্প উপন্যাস ছেড়ে বাস্তবের
স্ত্রীদের পাশে এসে দাঁড়ায় অপূর্ব-পছন্দ নিয়ে?
এতো বড় ঘরে সেধে বিয়ে
হলো মিনুর, কিন্তু বেচারি বুঝতেই পারে নি কী সে পেলো। বরং তার খেলাধূলা,
ঘোরাফেরাতে বাধা-পড়ায় সে আরো বিরক্ত হয়ে উঠলো। অপূর্বকে সে তার জন্যে দায়ী করে
তাকে দূরে ঠেললো। অপূর্ব মিনুর ভুল ভাঙানোর জন্যে, তার কাছে যাওয়ার জন্যে মিনুর সব
খেলার, কাজের, দুষ্টুমির সহচর হলো। যেভাবেই হোক বউয়ের মন তাকে জয় করতে হবে। মনে
মনে অপেক্ষা করতে থাকলো সে, কখন মিনু বুঝতে শিখবে, সংসারের দায়িত্ব নেবে নিজের মনে
করে। ছুটি ফুরিয়ে আসাতে, মিনুকে তার মায়ের কাছে রেখেই
অপূর্ব কোলকাতা রওয়ানা হলো। যাওয়ার সময় স্ত্রীর কাছে একটি ‘চুম্বনের’ আবদার করেও
অবুঝ মিনুর কাছে নিরাশ হলো। মিনু উপলব্ধিই করতে পারেনি স্বামী তার কাছে কী চেয়েছে।
মিনু জানে অপূর্ব তার সকল দুষ্টুমির সহচারী যে তাকে তার বাবার মতো সবকিছুতে
প্রশ্রয় দিয়ে যাবে, বিনিময়ে কিছুই চাইবে না।
অপূর্ব ও মৃন্ময়ীর তখনকার মানসিক
অবস্থা রবীন্দ্রনাথেরই লেখা “নববঙ্গদম্পতির
প্রেমালাপ”
কবিতা থেকে আমরা অনুভব করতে পারি,
বর। তোমার
অপার প্রেমপারাবার,
জুড়াইতে আমি এনু তাই।
বলো একবার ‘আমিও তোমার,
তোমা ছাড়া কারে নাহি চাই।’
ওঠ কেন, ওকি, কোথা যাও সখী?
সরোদনে
কনে। আইমার কাছে শুতে যাই!
জুড়াইতে আমি এনু তাই।
বলো একবার ‘আমিও তোমার,
তোমা ছাড়া কারে নাহি চাই।’
ওঠ কেন, ওকি, কোথা যাও সখী?
সরোদনে
কনে। আইমার কাছে শুতে যাই!
দু-দিন পরে
বর। কেন সখী, কোণে কাঁদিছ বসিয়া
চোখে কেন জল পড়ে?
বসন্ত কি নাই, বনলক্ষ্মী তাই
কাঁদিছে আকুল স্বরে?
চোখে কেন জল পড়ে?
বসন্ত কি নাই, বনলক্ষ্মী তাই
কাঁদিছে আকুল স্বরে?
কনে। পুষি
মেনিটিরে
ফেলিয়া এসেছি ঘরে।
ফেলিয়া এসেছি ঘরে।
বর। গুন্ গুন্ ছলে কার নাম বলে
চঞ্চল যত অলিকুল?
কানন নিরালা, আঁখি হাসি-ঢালা,
মন সুখস্মৃতি-সমাকুল—
কী করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
কনে। খেতেছি বসিয়া টোপাকুল।
চঞ্চল যত অলিকুল?
কানন নিরালা, আঁখি হাসি-ঢালা,
মন সুখস্মৃতি-সমাকুল—
কী করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
কনে। খেতেছি বসিয়া টোপাকুল।
বর। জগৎ ছানিয়া কী দিব আনিয়া
জীবন যৌবন করি ক্ষয়?
তোমা তরে, সখী, বলো করিব কী?
কনে। আরো কুল পাড়ো গোটা ছয়।
জীবন যৌবন করি ক্ষয়?
তোমা তরে, সখী, বলো করিব কী?
কনে। আরো কুল পাড়ো গোটা ছয়।
বর। তবে যাই সখী, নিরাশাকাতর
শূন্য জীবন নিয়ে।
আমি চলে গেলে এক ফোঁটা জল
পড়িবে কি আঁখি দিয়ে?
শূন্য জীবন নিয়ে।
আমি চলে গেলে এক ফোঁটা জল
পড়িবে কি আঁখি দিয়ে?
বিষাদিনী বসি বিজন বিপিনে
কী করিবে তুমি প্রিয়ে?
বিরহের বেলা কেমনে কাটিবে?
কনে। দেব পুতুলের বিয়ে।
কী করিবে তুমি প্রিয়ে?
বিরহের বেলা কেমনে কাটিবে?
কনে। দেব পুতুলের বিয়ে।
অপূর্ব যখন ছিলো তখন অপূর্বের
জন্যে বিশেষ কিছু অনুভব না করলেও, অপূর্ব চলে যাওয়ার পরে তার শূন্যতা মিনুকে অন্য মানুষে
রূপান্তর করে দিলো। পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলার চেষ্টা করে দেখলো মন বসে না, নিজে
নিজে একা একা বাগানে ঘুরে দেখলো আগের মতো ফুল চুরি কিংবা ফল চুরি কোনটাই তাকে
আনন্দ দেয় না। বন্ধুদের সঙ্গও পানসে হয়ে গেলো। অপূর্বের জন্যে তার সারাবেলা মন
কেমন করতে থাকলো সেটা সে কাউকে বলতেও পারলো না। এই প্রথম সে লজ্জা অনুভব করলো,
জানলো সব কথা সব সময় মুখ ফুটে বলা যায় না।
সংসার কী জিনিস যে কখনো
জানতোই না, সে ঘরের কাজে মন দিলো, শেখার আগ্রহ তৈরি হলো ভেতর থেকে। আস্তে আস্তে
শুরু হলো মিনুর বালিকা বেলার সমাপ্তি। মিনু অপূর্বের চিঠি কিংবা তার ফিরে আসার
অপেক্ষায় প্রহর গুনে যাচ্ছে সারাবেলা। শুধু আচার রোদে দিয়ে আর প্রদীপের সলতে
পাকিয়ে কী করে সারাদিন কাটাবে সে! বিরহে কাতর তার প্রতিটি প্রহর, কাটছে একেলা বিরহের
বেলা, কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারছে না। মনে মনে ভেবে যাচ্ছে হয়তো অপূর্ব তার
ওপর ভীষণ রেগে আছে, অভিমান তো সে অনুভব করতেই পারছে।
অপূর্ব ধনীর তনয়।
ছুটিতে বাড়ি না-আসায় অপূর্বের মা তার স্ত্রীকে নিয়ে কোলকাতা যেয়ে ছেলের মানভঞ্জন
করে। মায়ের সাথে পুত্রের মান অভিমানের সমাপ্তি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অশ্রুসিক্ত
আবেগপূর্ণ চুম্বনে স্ত্রী হিসেবে মিনুকে কাছে পাওয়ার আকুলতার সমাপ্তি। দুরন্ত
মিনুর সদর্প সংসারে প্রবেশের মাঝে দিয়ে কৈশোরের সমাপ্তি। আর তারপর হ্যাপিলি এভার
আফটারল্যান্ডের সুবাতাস।
আর এখন চারদিকে এতো
পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যে দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের জীবন কাটছে। সম্পর্ক মানেই বেশির
ভাগ সময় বিশ্বাস অবিশ্বাসের অম্লতিক্ত দোলাচল। অনেক প্রতীতি নিয়ে শুরু
করা সম্পর্কেরও সমাপ্তি হয় বিচ্ছেদে। তাই কঠিন বাস্তব থেকে ছুটি পেতে গল্প হলেও খুব
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে অপূর্ব মৃন্ময়ীর মিলনমধুর ‘সমাপ্তি’-কে।
তানবীরা
১৮/১১/২০১৪
No comments:
Post a Comment