Sunday 12 June 2016

বঞ্চনা থেকে নিজেকে দু'দন্ড সরিয়ে রাখতে সাহিত্যেই বড় অবলম্বন

* আপনার গল্প লেখার শুরু কখন, কীভাবে?

আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা দুইই শহরে। শহর মানেই আবব্ধ, ছেলেধরা নিয়ে যাবে কিংবা অচেনা লোকের কাছ থেকে কিছু খাওয়া নিষেধ, তাদের সাথে কথা বলা নিষেধ এভাবেই শুরু হয় শহুরে বাচ্চাদের জীবন। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। এই বদ্ধতার মধ্যে মনের জানালা খোলার একটি মাত্র উপায় ছিলো “বই”, খুব ছোটবেলা থেকেই পড়তে ভীষন ভালোবাসতাম। ইত্তেফাক পত্রিকায় দাদাভাইয়ের পরিচালনায় কচিঁকাচার আসরের নিয়মিত পাঠক ছিলাম, সাথে শিশু, নবারুণ পত্রিকার। পড়তে পড়তেই আসলে লেখার আগ্রহ জন্ম নিলো, বাড়ি থেকে উৎসাহও ছিল লিখতে চেষ্টা করার। সেসব চেষ্টা থেকে একটি গল্প ছোটবেলায় “শিশু” পত্রিকায় ছাপা হয়, এভাবেই হাতেখড়ি

* গল্প লেখেন কেন?

অক্ষমতার ক্ষোভ মেটাবার জন্যে হয়তো অনেকটা। চারদিকে এতো অন্যায়, অবিচার, ভন্ডামী, মুখোশে মুখোশে ঢাকা মানুষ। সবসময় যতোটা প্রতিবাদ করা উচিৎ ঠিক ততো করতে পারি না বলে, নিজের অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখার চেষ্টা করি। আমি আসলে ঠিক কল্পনা আশ্রিত কোন গল্প লিখি না। আমার চারপাশের জীবনের রোজকার গল্পগুলোই লিখে রাখার চেষ্টা আমার।

কী ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

চেনা জীবনের চেনা বাস্তবতাই আমার লেখার বিষয়। কল্পনা করে বানিয়ে বানিয়ে গল্প আমার লেখা হয়ে ওঠে না। একটু সহজ কিংবা কঠিন করে বললে, চারপাশে যা দেখি আসলে তাই লিখি।


* পাঠকদের ওপর আপনার গল্পের প্রভাব কেমন?

যেসব পাঠকরা বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে চান না তাদের হয়তো একটু রুঢ় সত্যি লাগতে পারে। তবে বেশির ভাগ পাঠকদের ভালো লাগে। কিছুদিন আগে এক পাঠিকার টেলিফোনে শনিবার সকালের ঘুম ভাঙলো। রাতে তিনি আমার “একদিন অহনার অভিবাসন” উপন্যাসটি পড়ছিলেন। প্রথমে ভাবছিলেন এটা আমার গল্প, পড়তে পড়তে তার মনে হলো তার গল্পটি লেখা হয়েছে। সারা রাত পড়ে বইটি তিনি শেষ করেছেন, হাত থেকে রাখতে পারছিলেন না বলে জানালেন। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া লেখক মনকে সজীব করে।

গল্প লেখার সার্থকতা খুঁজে পান?

গল্প লিখে সামাজিক বিল্পব ঘটানোর মত কোন পরিকল্পনা আমার নেই। অনেকসময় নিজের বা নিজের খুব কাছের কারোর দুঃখ, বেদনা গুলো যা প্রকাশ করতে পারা যায় না, লুকিয়ে ফেলতে হয়, সেগুলো লিখে ফেলতে পারলে মনে হয় কাউকে বলতে পেরেছি, মনের ভার নেমেছে, হালকা হয়েছি। সে লেখাটা পড়ে অচেনা অজানা কেউ যখন ইনবক্সে ম্যাসেজ দেয় কিংবা মেইল করে জানায়, মনে হচ্ছে আমার কথাগুলোই লিখেছেন, লেখাটা পড়ে সারাদিন ভাবছি কী করে বুঝতে পারলেন বা জানলেন আমার কথাগুলো, পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি তখন মনের কোথাও প্রশান্তি আসে, মনে হয় লেখার মাধ্যেমে কারো অন্তর ছুঁয়ে তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পেরেছি। তার কাছাকাছি আসতে পেরেছি, কোথাও কিছু রেখে গেলাম হয়তো।  

* প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজে গল্প পাঠের প্রাসঙ্গিকতা কী?

সমাজ যেমন প্রতি নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, সাহিত্যও ঠিক তার তালেই পরিবর্তন হচ্ছে। সাহিত্য হচ্ছে সমসাময়িক সমাজের দর্পন। কোন একটা সময়কে জানার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে সে সময়ের সাহিত্য। বঙ্কিম, শরৎ কিংবা রবীন্দ্রনাথ না পড়লে আমরা কী করে জানতাম সে যুগে বাঙালী তথা ভারতীয় মেয়েদের সমাজে কী রকম দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হতো।


* একজন পাঠক আপনার গল্প পড়বে কেন?

একজন পাঠককে আমার লেখা পড়তেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। পড়ার মূল কথা হলো জানার আগ্রহ। জানতে চাইলে পড়তে হবে, সে আমার লেখাই হোক কিংবা অন্য কারো। সাহিত্য আসলে বানিজ্যের বিষয় নয় যে, উপাদান বর্ননা করে বলা যাবে, এই এই ম্যাটেরিয়াল আছে এই প্রোডাক্টিতে তাই কনজুমারকে এই জিনিসটিই কিনতে হবে। এখানে ঘটনাটা পুরোই মানসিক, যার লেখার সাথে যে নিজেকে রিলেট করতে পারে, তার লেখাই সে পড়ে। পাঠক হিসেবে আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম নই। অনেকেই যারা আমার সহজ সরল ভাষায় লেখা বাস্তব ঘটনাগুলোর মাঝে নিজেকে দেখতে পান, তারা আমার লেখা পড়েন এবং হয়তো ভবিষ্যতেও পড়বেন।

বাংলা সাহিত্যে গল্পের যে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে, সে প্রেক্ষাপটে আপনার লিখন প্রস্তুতি কী রকম?

প্রস্তূতি নিয়ে, প্লট ভেবে, হিসেব নিকেশ করে, চরিত্র এঁকে আমার এখনো কিছু লেখা হয়নি। কোন ঘটনা যখন আমাকে পীড়া দেয়, আমার বিবেককে আহত করে, আমার মনে কিছু গুমরাতে থাকে সেগুলোই একটা সময় আমার খাতায় ঝরে পরে। তাই কোন ধারার সাথে সংযুক্ত হয়ে কিছু লেখা বোধহয় আমার আর হয়ে উঠবে না। আমি আমার ধারাতেই লিখে যাবো হয়তো।

* গল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?

আমি আশাবাদী মানুষ। সাহিত্য আশার নাম, প্রেরণার নাম। দিনে দিনে লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, মানে পাঠক বাড়ছে। অন্তর্জালের কারণে পড়ার সুযোগও অনেক সহজ হয়েছে। সংসারে পাওয়া না পাওয়ার বঞ্চনা থেকে নিজেকে দুদন্ড সরিয়ে রাখতে সাহিত্যের চেয়ে বড় অবলম্বন আর কী হতে পারে? বাংলা সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যতে আরো অনেক এক্সপেরিমেন্ট হবে সে বলাই বাহুল্য।

* বিশ্বসাহিত্যে বাংলা গল্পের অবস্থান কোথায়?

বাংলা গল্পের অবস্থান আসলে বাঙালীদের কাছে। সাহিত্যের আঁধার হলো, ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি। নিজ ভাষার, নিজ সমাজের গল্প মানুষকে যতো কাছে টানবে অন্য ভাষা সংস্কৃতির মানুষের কাছে সেটা কল্পনা করা বৃথা। রবীন্দ্রনাথের “গীতাঞ্জলী” নোবেলের জন্যে অনুবাদ করা ছাড়া বিদেশীদের খুব একটা বাঙলা সাহিত্য নিয়ে মাতামাতি করতে শোনা যায়নি। সেদিক থেকে ব্লগের অবস্থান ভাল। সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ওপর লেখা ব্লগগুলো সেদিক দিয়ে অনেক বেশি বহিঃ বিশ্বের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

* আপনার গল্প লেখার প্রেরণা কী?

আমার বা আমার বন্ধুদের না বলা কথাগুলো কিংবা না বলতে পারা কথাগুলোই আমাকে লিখে ফেলার প্রেরণা যোগায়।

* আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের নেপথ্য গল্প কী?

তেমন উল্লেখযোগ্য কোন গল্প আসলে নেই। অনেকদিন ধরে ব্লগে লেখালেখি করি, কিছু কিছু লেখা মাঝে মাঝে পত্রিকায়ও ছাপা হয়। প্রথম বইয়ের প্রকাশক নিয়মিত ব্লগ পড়ে থাকেন। তিনি ভাবলেন, নির্দিষ্ট কিছু গল্প একসাথে করে একটি বই করা যায়, তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বইটি প্রকাশ করেন, “পাহাড় আর নদীর গল্প”। তবে  হঠাৎ করে তিনি তার এই সিদ্ধান্তটি জানিয়ে বেশ একটি চমক দিয়েছিলেন, সেই অনুভবটুকু অসাধারণ ছিলো। অনেকের সাথে গল্প সংকলনে আমার লেখাও ছিলো আগে কিন্তু শুধু নিজের লেখাগুলো দিয়ে একটা আলাদা বই, বেশ অন্যরকম অনুভূতি বটে।

* আপনার প্রিয় গল্পকার কারা, কেন প্রিয়?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার প্রিয় গল্পকার। তার লেখা ছোটগল্প গুলো বিষয় বৈচিত্র্য ও লেখার গুনে অনবদ্য। বনফুল, প্রতিভা বসু, হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা কিছু অনবদ্য গল্প আছে যা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। কেনো কিছু খুব প্রিয় কেন হয়ে যায় সেটা পোস্টমর্টেম করা আসলে মুশকিল, যা ভাল লেগে যায় তা শুধু ভাল লেগে যায়। এদের প্রত্যেকেই এতো সহজ ভাষায় জীবনের গল্প বলে গেছেন যে তা থেকে দূরে থাকা আমার জন্যে কঠিন।




No comments:

Post a Comment