Monday 7 March 2022

আমি যাই নির্বাসনে

আমার সুন্দরী কবি বন্ধু লোচন বন্ধুমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম। যারা নিয়মিত লোচনের লেখা পড়েন তারা জানেন, লোচনের গদ্যের হাতও অসাধারণ যদিও লোচন নিজেকে কবি পরিচয় দিতেই ভালবাসে। ব্যাংকার হিসেবে ষোল বছরের কর্মজীবন, রাকিবের স্ত্রী, দীপিতার মা, জীবনের প্রতিটি কণাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা সদা হাসিখুশী আমুদে লোচন অভিমানে অতি সম্প্রতি দেশের মায়া ত্যাগ করে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছে। খুব কম সাহিত্যিকই আছে যার মনের ছায়া তার লেখাতে পড়ে না। কবির প্রেমের উচ্ছাসে যেমন লেখা হয় প্রেমের কবিতা, প্রেম ভেঙে গেলে তেমনি উঠে আসে ব্রেকাপ সঙ। প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দেয়া, করোনা, মহামারি, দুর্নীতি ইত্যাদির প্রভাব কবির কবিতায় পড়বে না, সেকি হয়! গল্প অনেক হলো, আসুন কয়েকটি কবিতার অল্প কিছু পংক্তি পড়ে নেয়া যাক। শুরু করি, “আমি যাই নির্বাসনে” কবিতাটি দিয়ে চোখের সামনে মানুষের উবে যাওয়া দেখেছি ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া শিশুর আহাজারি অন্যায়, অনাচার ধর্ষণ, সব স্বাভাবিক জীবন যাপনের আবহে প্রতিদিন সয়েছি। কোনকিছু দিয়েই যখন পারছি না ঠেকাতে আপন প্রাণ স্বস্ত্বিতে বাঁচাতে, মস্তিকের উলটে যাওয়া রুখতে, নিজের মনের কোণে উচ্চারণ প্রকাশ্য গোপনে আমি যাই “নির্বাসনে”। খুব সহজ ভাষায় কঠিন কিন্তু সত্যিটা লেখা হয়েছে। বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্যে এরচেয়ে বেশি লেখার প্রয়োজন আছে কি? তিনশো পয়ষট্টি দিনে খবরের কাগজের সব কলাম যেসব খবরে পূর্ণ থাকে তার সারমর্ম এই কয়েকটি লাইনেই আছে। কিছু কবিতা আছে মারাত্বক বিপদজনক বাস্তবতা নিয়ে, “জননীর সর্পখেলা” তার মধ্যে একটি জননী তার পোষা সাপ নিয়ে খেলা দেখাচ্ছিলেন মগজ খুলে রাখা এক জনপদে, পারিষদেরা বিনের আওয়াজে দুলছিলেন অর্হনিশ, কে সাপের কতভাবে প্রশংসা করতে পারে কবিতার বাকিটুকু আপনারা বইতে কিংবা কবির টাইমলাইনে পড়ে নেবেন। এবার একটু মিষ্টি প্রেম কিংবা অভিমানের কবিতা পড়ি, “উপেক্ষার এপিটাফ” এসো মৌনতায় বৃক্ষ হই প্রতি শব্দের শেষে দাঁড়িয়ে রই, ক্লেদ-ক্লান্তি সমারূঢ় সমাপতন স্পর্শের ভাষায় করি গ্রহণ। কতকাল এই ত্বকে কেউ আঙুল রাখেনি, কতকাল এই হাত কোনো অভিমান মাখেনি। এই হিমশীতল, বিষণ্ণ, নীরব প্রবাস নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের আর্তনাদের খানিকটা আঁকা আছে কবির খাতায়, “বিষণ্ণতার ক্ষরণ” এ শহর এক চলমান মর্গ চারদিকে তুষারের আগ্রাসন এত ভারী পোশাকের নিচে নিজেকেও ছোঁয়া যায় না কোষে কোষে নীরবে ছড়ায় বিষণ্ণতার গভীর গোপন ক্ষরণ। আমরা যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তাদের জন্যে করোনা এক নিদারুণ যুদ্ধ। এত বড় মহামারী কাব্যে স্থান পাবে না, সেকি হয়! “করোনা করুক প্রাণসংহার” এমন এক সময় আমাদের দেখতে হচ্ছে যেখানে মানুষের প্রাণের চাইতে বানর মূল্যবান যেখানে মানুষের প্রাণের চাইতে বড় কে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান। এই তবে ভালো সুপারপাওয়ারের দেয়া উপহার, করোনা বিভেদ ভুলে করুক সবার প্রাণ সংহার। বোনাস একটি কবিতা রইলো সবার জন্যে, “রাষ্ট্রীয় সার্কাস” প্রতি লাশের নামে ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস আমার মরণে চাই না এমন রাষ্ট্রীয় সার্কাস!
শব্দের পর শব্দ গাঁথলেই কবিতা হয় না। ছন্দে-আনন্দে মিললেই না তবে কবিতার সার্থকতা। সাহিত্যের কাজই হলো সমসাময়িক বাস্তবতাকে তুলে ধরা, ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দেয়া। কবিতাগুলো আজকের পরিস্থিতির আকাট্য দলিল। একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হওয়া “আমি যাই নির্বাসনে” লোচনের এগারোতম কবিতার বই। বারো’তম বইটি এই ফাল্গুনেই আসছে। ভালবাসা অফুরান লোচন এবং সাফল্য এমনি পায়ে পায়ে ঘুরুক।

No comments:

Post a Comment