Sunday, 23 September 2012

তিনশো টাকা

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=ee60fc9abd4f71aaf849f301975553f6&nttl=20120906041509137155




বইসা থাইকা থাইকা অধৈর্য্য হইয়া উঠছিল করম আলী বাদ জুম্মা সালিশ হওনের কতা, এহন বেইল আসরের দিকে গড়ায় গড়ায় কিন্তু মাতবর সাব আর ইমাম হুজুরের দেহা নাই না খাইয়া না দাইয়া তহন থাইকা বইসা রইছে এই ভাদ্দর মাসের গরম মাতায় লইয়া দেহ দেহি! করম আলী গরীব মানুষ তার ডাকা সালিশে মানুষ জন বেশী আসার কতা না ইটা এমুন মজার কুন সালিশও না চ্যাংড়া পুলা মাইয়ার পিরীতের কেস কিংবা পরের বউ লইয়া ইটিশ পিটিশ এর গটনা হইলে মানুষ বেশী হয় সালিশে তয় আজকে জুম্মাবার, বেশীর ভাগ মানুষই জুম্মা পইড়া, জুম্মার দিনের চাইরটা বালা মন্দ খাইয়া এট্টু গড়াগড়ি দিয়া হেরপর বাজারের দিকে কিংবা কামে কাজের সইন্ধানে বাইর হয় হেই হিসেবে আইজকার সালিশে লুক মন্দ হয় নাই মসজিদের উঠান ভইরাও, পুস্কুনির দিকে যাওনের রাস্তার কাছের কাডল গাছটা পর্যন্ত মানুষ হইছে তার আর তার বউয়ের মইদ্যের কাইজ্জার কথাডাতো অল্প বিস্তর হগলতেই জানে মজার না হইলেও গটনা ইটাও খারাপ না দেহার লাইগ্যা হগলতে আইসাই দুইডা বালা মন্দ কতা করম আলীরে জিগাইয়া নিজেদের মইদ্যে খুশগল্পে ব্যস্ত হইয়া পড়ে করম আলী বুঝে তার দিকে কারু টান নাই, অবসর আছে, তার আইছে মজা দেখতে তার দিকে যদি কারু টান থাকতো তাইলে কি আইজ আর তার সালিশ ডাইকতে লাগে? কিন্তু মাতবর সাব আর ইমাম সাব না আইলে ফয়সালা দিবো কেডা?

আইজ একটা ফয়সালা না লইয়া সে বাড়ি যাইপো না। আড় চুখে সে উলটা দিকে চাইলো। এহনো হারামজাদী বউটা তার দিকে পিছ দিয়া বইসা রইছে। ছাপার একখান রঙীন শাড়ি পড়া, মাতায় গুমটা টানা। এইপাশ থেইকা পিছনের শাড়ি আর হাতের কয়টা কাচের সবুজ চুড়ি ছাড়া কিছুই দেহা যায় না। বাপের বাড়ির দ্যাশের তন লগে বাউজ, বুইন লইয়া আইছে, তাগো লগে কতা বারতা কইতেছে। চড়াৎ করে গুস্বাটা তার আবার মাতায় উইঠা গ্যালো। মাতারি তোর এত্তো চুপা। বাতও খাইবি আমার আবার চুপাও দিবি আমারে। কিসসুটি কওয়া যাইপো না তারে। যদি দুইপরে খাইতে বইসা দেখছে তরকারীতে লবন কম, কইলেই খ্যান খ্যান গলায় মাতারী কইবো, তরকারীর লবন ঠিকই আছে, আপনার জিহবাতই লবন কম। কাহাতক আর দিন রাইত সইহ্য করা যায়? হাজার হোক করম আলী একটা পুরুষ মানুষ না? নিজের জমিও আছে, হোক অল্প কিন্তু আছেতো। তার কুনু ইজ্জত নাই এই হারামজাদীর কাছে। এই লাইগ্যাই মাজেই মাজেই চুলের মুঠিত দইড়া দেয় মনের সুখ মিটাইয়া দুই চাইরটা। তাইলেই শুরু হয় বিলাপ। আরে গেরামের কুন পুরুষ মানুষটা মাজে মইদ্যে তার ঘরের বউরে দুই চাইরটা না দেয়? তুই কি মিয়া বাড়ির বিবি, যে তোরে আপনে তুমি জিগাইতে হইবো? মাইর দিলেই এই মাতারী কানতে কানতে বাফের বাড়ি যায়। এদিকে ঘর সংসার কে দেহে?

বুঝলাম পুলাপাইন তিনটারে লগে লইয়া যাস। কিন্তু ওইটাই সংসারে সব? হাস মুরগা গুলারে খাওন দেয় কে? তুই বাড়িতে না থাকলে যে গেরামের পুংটা পুলাপাইন বাড়িত ডুইক্যা লাউটা, কলাটা চুরি কইরা লইয়া যায়, হেই গুলান পইড় দেয় কে? করম আলীরে দুইটা ভাত ফুটায় দিব কে, হেই চিন্তা মাতায় আহে না। স্বার্থপর মাইয়া মানুষ। চিন্তা করতে করতে বেফানা লাগলে করম আলী নিজেরে সান্ত্বনা দেয়, বাবা আদমরে যেই জাতি বেহেস্ত ছাড়া করছে, তাগো কাছে আর চাওনের কি আছে? বজ্জাত মাইয়ালুকের হাড্ডিরে শায়েস্তা করার জইন্যই আজকের সালিশ। হুজুর আইসা আইজকা বন্ননা দিবো, স্বামীর কতা যে সমস্ত ইস্ত্রীরি লুক শুনে না রুজ হাশরের ময়দানে তাদের কি কট্টিন শাস্তি হইবো। হাবিয়ার আগুনে পুড়বো, হাবিয়ার আগুনে

হঠাত সব্বাইরে লইড়া চইড়া বইতে দেইখ্যা করম আলী চাইয়া দেহে উত্তর পুব কোনার জমিনের শ্যাষ সীমানার তাল গাছের তলে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবীর রেখ দেহা যায়। হুমম আট্টু নজর কইরা দেকলো মাতায় ছাতিও আছে। আইতাছে মাতবর সাব আর ইমাম সাব আইতাছে, এক লগেই আইতাছে। ইমাম সাব থাহেন মাতবর সাবের কাচারী ঘরের পাশে, উনারা ভদ্দরলুক মানুষ, উনারা এক লগেই চলাফেরা আর উটা বসা করেন। আবার আড় চুখে চাইলেন সামনের দিকে, উহহহ, এক হাত গুমটা টাইন্না নয়া বউ এর মতো বইছে এহন। কতো লাজরে। গলা ফাইরা ফাইরা যহন সারা পাড়ার কাক পঙ্খী উড়াইয়া ঝগড়া করছ তহন কুতায় থাহে এই লাজ? তাইর লেইগ্যা পাড়ার লুকে কতো দিন কইছে বউটারে এতো মারিস না করম, এতো মারন ঠিক না। ইজ্জতের কতা। গরের কতা সব পরে জানে। মারে কি আর সাধে? তাই চুপ থাকবার পারে না? করম আলীর এট্টু মাতাডা গরম হেইটাতো হগলেই জানে। তাই বইলা কি স্যা লুক খারাপ? সাতেই সাতেই কি আবার তার মাতা ঠান্ডা অয় না ? বউরে কি শাড়ি স্নু দেয় না স্যায়? ইমাম সাব মসজিদে ডুকনের আগেই সবাই সিদা হইয়া জায়গায় বইসা গ্যালো

হুজুর ডুকা মাত্রই সবাই দাড়াইয়া বড় সালামালকি দিলো। করম চেয়ার টাইন্যা ঠিক কইরা দিল একটা মাতবর সাবের আর একটা ইমাম হুজুরের। উনাদেরকে চেয়ার মাপ দিয়া এক্কেরে গাছের নীচের ছায়ার মইদ্যে দিল যাতে কারু গায়ে রোইদ না লাগে। উনারা গইন্য মাইন্য লুক, রোইদ বিষ্টির অইভ্যাসতো উনাদের নাই। উনাদের থিক্যা হাত পাঁচেক দূরে বড় একটা কাঠের বেঞ্চিতে হাই স্কুলের মাষ্টার সাব, পুষ্ট মাষ্টার সাব, আরো গেরামের মাতা যিনারা আছেন তারা বইসছেন। তিনাদের থিক্ক্যা আরো এট্টু দূরে মাটিতে হাটু ভাইঙ্গা করম আলী আর গেরাম বাসী বইছে। সবশেষে মহিলারা। সালাম দুয়া শেষ হইতেই ইমাম সাব গলা খাকারী দিয়া কইলেন, সময় বেশী নাই, বেশী দিরং করন যাইবো না। আসরের জামাত ধরতে হইবো সব মুসুল্লী ভাইদেরকে। এই সবে সময় নষ্ট কইরা নামাজ দিরং করলে আল্লাহ তালা গুস্বা করবেন। সালিশ কে ডাকছে? বিপদে পড়া গলায় করম কইলো, আমি হুজুর। করম আলী মনে মনে কয় এত্তো কইয়া হুজুররে দইড়া সালিশ ডাকাইলাম আর হুজুর কয় সালিশ কে ডাকছে! ইমাম সাব স্বাভাবিক সময়ের থাইক্যা আরো গম্ভীর গলায় কইলেন, কও তুমার আর্জি কও, শুনি, দাড়াইয়া কও

এইবার করম আলী দাড়াইলো সর্ব সম্মুখে। হাতের মইদ্যে এখন তার গলার গামছাটা। সাদারনত সে গেঞ্জী আর লুঙ্গী পইড়া থাকলেও আজকে তার নিজের সালিশ উপলক্ষ্য শ্বশুর বাড়ি বেড়াইতে গ্যালে যে পিরানটা পিন্দে সেই পিরানটা গাও দিয়া আইছে। দূর ছাতা, হাত ক্যান গামায়? গামছায় হাত ঘষতে ঘষতে করম কইলো হুজুর, আমি আবার বউরে কিছু কইতে পারি না, হ্যায় মুহে মুহে অনেক চুপা করে। কতায় কতায় গুস্বা কইরা বাপের বাড়ি যায়। সোয়ামীর খেদমত বলতে কিছুই করে না। আপনে এর এট্টা ল্যায্য বিচার করেন হুজুর। হুজুর সব শুনলেন তারপর কইলেন, একজনের কতায় বিচার করন ঠিক না। এইটা ল্যায্য অয় না। হুজুর গলাটা উঁচা কইরা কইলেন, করম আলীর বউ কি এইহানে উফস্থিত আছো? যদি থাহো তবে পর্দার মইদ্যে থাইক্যা তুমার কিছু কওনের থাকলে কইতে ফারো। করম আলীর বউ উইঠ্যা দাড়াইয়া মাতার গুমটা আবার ঠিক করলো, আরো লম্বা করলো। হুজুর আর মাতবর সাবরে আদাব দিয়া কাইন্দা কাইন্দা কইতে লাগলো, হেতানে বাড়িত আইসা আমারে যিতা মুক দিয়া না আহে হিতা কইতে থাহে। আমি কিছু কইবার গেলে আমারে মারতে আহে, পিডায়। হুজুর আর মাতবর সাব চুপ করে সফুরার কতা হুনলেন। তারা এহন মাতা লিচু কইরে চুখ বন্ধ কইরে ভাবতিছেন। গুরুত্বপুন্ন কতা কওনের আগে করম আগেও দেখিছে মাতবর সাব আর হুজুর চুখ বন্ধ কইরে ভাইবা লয়

করম আলী আরাম কইরা বসলো। এইবার হুজুর বালো করি সফুরারে ধুবেনি। বেশরম মাইয়া মানুষ, সোয়ামীর নামে নালিশ করে, দুজখে যাইবি নিগগাত দুজখ। করম আলী জানে সে অন্যায় কিছু করে নাই। হাদীসে আছে, বেয়াদ্দপ বউরে শাসন করা, মারা ফরজ। সেতো ধম্মের বাইরে কিছু করে নাই। এইবার ইমাম হুজুর শুরু করলেন তার বয়ান। বিচারের রায়ের আগে হুজুর সব সময় কুরানের আয়াত বয়ান করেন। হুজুর কুরান বন্ননা করলেন পরথমে, তারপর তার তফসীর কইরলেন। এবার হাদীসে কিতা কয় সেইগুলাও কইতেছেন। ইস্ত্রীর কি কমম করা দরকার, সোয়ামীর কি রহম ব্যভার করা উচিত এইসব এইসব। করম আলী আস্তে আস্তে আবার অধৈর্য্য হইয়ে উঠতে লাগলো, এইসব ভালু ভালু কতার লাইগ্যেতো সে সালিশ ডাকে নাই। সে আশায় আছে, কহন সফুরারে ধইরে সব্বাই তার পায়ের কাছে আনি ফেলবে, মাপ চাওয়াইবে। সে গাই গুই করপে মাপ দিবে কি দিবে না ভাব করবে। তহন হগলে তাকে চাইপে দইড়ে কবে ভুল তুট্টি সবার থাহে মিয়া, বউটারে মাফ কইরে দেও, গরে নিয়া চলো। সেই সুযোগে সে সফুরারে নিয়ে গরে যাবে। আইজ একটা মাস হইয়া গ্যালো সফুরা বাপের বাড়ি, কে রেন্ধে দেয়, কিভাবে খায় সে? খালি খালি ভাত আর একজন কদ্দিন খাইতে পারে? একজন মুনিষ্যিতো সে। রাইতে একলা ঘুমের কষ্টের কতাতো আর মুহে আনতি পারে না। তার উপড় পুলাপাল তিনটারেও মাস দইড়া চোহে দেহে না

করম ইট্টু পর পর উইঠে দাড়াইয়া হুজুরের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা কইরতে লাগল। করম খালি কইতে চায়, হুজুর আপনে সফুরারে এট্টু ইস্ত্রীর কইরতব্যটা কন। পিছন থাইক্যা সব্বাই তহন তারে থামাইয়া চুপ করাইয়া বসায় দেয়, সে তার কথা শ্যাষ করতে পারে না। রাগে গুস্বায় তার তহন ফাল পাড়তে মন চাইতেছিল। হালার পুত হুজুর তুমি জুম্মাবারে মসজিদে কতো ভালু ভালু খুতবা পড়ো, বয়ান দাও, খোদার পরে ইস্ত্রীর স্বামীরে সেজদা করা উচিত, যে ইস্ত্রীরি সোয়ামীর অব্যাইধ্য হয় ফেরেশতারা তারে অবিশাপ দেয় আর আইজক্যা তুমার জুবান খালি এই দিক হেই দিক কতা কয়? আমি আর বুঝি না, মহিলা দেকছে কয়টা, তাগো কাছ থিকা সময় অসময় বাড়িত যাইবার কালে, চালটা, ফলটা পায়, উনাগো নিয়া উনি আইজকে কিছু আর বইলবোনা। আর হুজুর কি কইতেছে ভদ্দরলুকের ভাষায় তার বেশীর ভাগতো করম আলীই বুঝবার পারতাছে না আর সফুরা বুইঝপে তার কচুটা। বেলা গড়াইয়া আসরের আজানের ওয়াক্ত হইয়া গ্যাছে দেইখ্যা হুজুর সালিশ শ্যাষ গুশুনা করতে চাইলেন। জিগাইলেন, করম, তুমার আর কিছু বলনের আছে? মনে মনে উত্তর দিলো আর কিছু? আরে আপনেতো কিছুই কইলেন না। কিন্তু মুহে কইলো, না হুজুর আর কিছু বলনের নাই। পাশে বসা মাতবর সাব কইলেন, সালিশ ডাকনের খরচা দাও তাইলে, সালিশ শ্যাষ করি। আইশ্চইয্য হইয়া মাতায় হাত দিয়া করম কইলো, সালিশের আবার খরচা কি মাতবর সাব? হুজুর গুয়ামুড়ি হাসি দিয়া কইলেন, আছে আছে খরচ আছে। দুনিয়াতে কুনু বালা জিনিস খরচ ছাড়া হয় নাকি, মিয়া? মাতবর সাবও সায় দিলেন, খাটি কতা, একদম ঠিক কতা। মাতবর সাব কইলেন তখন, তুমার বউতো সালিশে আসপার চায় নাই, তারে যে ইউনিয়ন বোর্ডের দফাদার পাঠিয়া ধরাইয়া আনলাম, নৌকা ভাড়া দিয়া তার খরচ কে দিপো, শুনি?

উফায় না পাইয়া কান্দা কান্দা গলায় কইলো করম, খরচ কতো দেওন লাগবো? হুজুর কইলো, তিনশো টাহা মাত্তর। এমনেতেই ভাদ্দর মাসের গরমে গা পুড়তে ছিলো আর এহনতো মনেও পুড়ানি শুরু হইলো। এক ফুটা বাতাস নাই কুন ধার থাইক্যা। করম হুজুর আর মাতবর সাবের দিকে চাইয়া কইল আমার বিচার এর কি রায় হইলো, বউকি যাইপো আমার লগে? হুজুর কইলো হ্যার যাইবার মন চাইলে হ্যায় যাইপো, আমরাতো আর তারে জুর কইরতে পারি না। টাশকি খাওয়া করম একবার মাতবর সাহেবের দিকে চায় আর একবার ইমাম সাহেবের দিকে। ভয়ে তেষ্টায় করমের বুক থাইকা গলা পর্যন্ত শুকাই গ্যাছে। তারপরও গলার জুর আইন্না আবার কইয়া উঠল, আমি গরীব মানুষ এত্তো ট্যাহা কুনখানে পামু? মাতবর সাব বিরক্ত গলায় কইলেন, কুতায় পাবি তার আমি কি জানি? তোর বউ আননের জন্য দফাদার পাঠাইলাম, তার উপর নৌকা বাড়া, এগুলো কে দিবো শুনি? এগুলা খরচ আছে না? লুঙ্গীর খুটার থিক্কা ট্যাহা নগদ একশো গুইন্না গুইন্না হুজুরের হাতে দিয়া করম বাকী টাকা সত্বর দিয়া দেয়ার অঙ্গীকারও করলো সবার সামনে মাতবর সাবের কাছে। কেউ দিশা পাইবার আগেই এরপর যাইয়া খপ কইরা সফুরার হাত দড়লো। কইলো, বউ গ্যালে গ্যাছে তিনশো ট্যাহা, তুইও বুঝছস আর আমিও বুঝছি। এইবার বাড়িত

মাষ্ট বী ফেল্ট উইথ হার্ট



মাষ্ট বী ফেল্ট উইথ হার্ট

চলার পথে নিজের অজান্তেই জীবনে ছোট ছোট অনেক কিছু ভাল লেগে যায়। জিনিসগুলো হয়তো এতো সামান্য আর অপাক্তেয় যে অন্যে হয়তো ঠিক বুঝেই উঠবে না এরমধ্যে ভালো লাগার কি আছে? পুরনো ডায়রী হাতে পড়লে দেখি একটা গোলাপ ফুল শুকিয়ে আছে কোন একটা পাতায়। ডায়রীতে থাকতে থাকতে পাতায় দাগ লেগে গেছে । পৃথিবীর কারো কাছে এর কোন মূল্য নেই কিন্তু আমার অনেক ভালবাসা ওতে জমে আছে। আমার হাতে ফোঁটা প্রথম গোলাপ সে। ঠিক যেনো হুমায়ূন আজাদের কবিতার মতো, 

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো দোয়েলের শিসের জন্যে শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে

২০০৬তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যত্বত্ত্ব বিভাগের আয়োজনে আন্তর্জাতিক নাট্যসপ্তাহের আয়োজন হয় সেগুনবাগিচার থিয়েটার হলেআমি প্রায় প্রতিদিনই নাটক দেখতে যাই, ভাল লাগে। কখনো কখনো একা, কারণ কারো এতো সময় নেই রোজ সন্ধ্যায় নাটক দেখবে। শেষদিনে সমাপনী উৎসব সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যত্বত্ত্ব বিভাগের নিজস্ব আয়োজন “বেহুলার ভাসান”পুরো নাটকটা লেখা হয়েছে ছন্দ মিলিয়েসারা মঞ্চকে সাজানো হয়েছে গোলাকার করে, প্রদীপ জ্বালা, আলপনা আঁকা, ধূপ ধূনোর গন্ধ, গান, ঢাক আর ঢোলের শব্দ, ড্রেসাপে এমন একটা মাঙ্গলিক আর পৌরণিক আবহাওয়া তৈরী হলো যে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে সে সৌন্দর্যে বিমোহিত হলাম। আমি একা। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করছিল, কাউকে দেখাই এই সৌন্দর্য। অসাধারণ কিছু সৌন্দর্য কেন যেনো একা উপভোগ করতে ইচ্ছে করে না। বারবার আমি ঢাকা থেকে হল্যান্ডে এস এম এস করে যাচ্ছি, বোঝাতে চেষ্টা করছি আমার অনুভূতি কিন্তু আসলে সব ভাল লাগা সবাইকে ভাষার অক্ষরে লিখে বোধহয় বোঝানো যায় না। তাইতো Helen Keller বলেছেন, The most beautiful things in the world cannot be seen or even touched, they must be felt with heart.  এটা বোধহয় শুধু সুন্দরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দুঃখের ক্ষেত্রেও তাই। কেনো কি জন্যে দুঃখ পাই, তা কি অন্যকে ব্যাখা করা এতো সোজা? না ব্যাখা করলেই লোকে তা বুঝতে পারে? 

টুকটাক অনেক জায়গায় ঘোরা হয়। অনেকেই কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন, কোথায় যেয়ে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে এবং কেন? কেন ব্যাখা করা কি এতো সহজ? সব ব্যাখাই কি সবার জন্যে প্রযোজ্য নাকি সবার তা কোন কাজে আসে। 

ছোটবেলা থেকে মুঘল ইতিহাস পড়ে, সিনেমা দেখে, গল্প শুনে মুঘল রাজাদের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ জন্ম নেয়। আমি মুঘল রাজাদের বই যোগাড় করে পড়তাম। জীবনে যখন প্রথম সুযোগ আসলো দিল্লী - আগ্রা - জয়পুর যাওয়ার উৎসাহে চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি না অবস্থা। দিল্লী – আগ্রা – জয়পুর-- রাজস্থান ঐদিকে যারা যায়, তারা বেশির ভাগই আজমীর ঘুরে আসেন। আমরাও আজমীর যাবো বলে রওয়ানা হয়েছি, সন্ধ্যার মুখে মুখে পৌঁছেছি। আমাদের হোটেল ঠিক করা ছিল পুস্কর। আজমীর থেকে দশ বারো কিলোমিটার দূরত্বের একটি ছোট শহর। ভারত সরকার ঘোষনা করেছেন, যাদের একশ বিঘার ওপরে জমি আছে ওপরের বাকিটা দান করে দিতে হবে। কোন পরিবারেরই একক একশ বিঘার ওপর জমির মালিকানা থাকতে পারবে না। এতে অনেক রাজপরিবারই অন্য কৌশল অবলম্বন করেছেন। নিজেদের বসতবাটিকে হোটেল বানিয়ে ফেলেছেন, অন্যের নামে মালিকানা দেখিয়েছেনতেমনি পুস্করের হোটেল, হোটেল মহারাজা প্যালেস। বিরাট সাদা রঙের প্রাসাদ যার দেয়ালে দেয়ালে তলোয়ার, ঢাল, বাঘের চামড়া, বন্ধুক আরো নানা ধরনের অস্র শস্ত্র ঝোলানো। লম্বা করিডোর দিয়ে হেটে যেতে হয়। করিডোর ভর্তি গাছের সমারোহ। বড় বড় পিতলের টবে বড় বড় গাছ। একজন আর একজনের মুখ দেখতে পাবে না এমন অবস্থা। এরকম বাড়ি আমি সিনেমায়ও দেখিনি। এতো কাছ থেকে ঢাল তলোয়ার এভাবে ছুঁয়ে দেখিনি। শাহবাগ যাদুঘর, সোনারগা যাদুঘর, ময়নামতি যাদুঘর যা দেখেছি জীবনে, এগুলোর কাছে সেগুলো দুগ্ধপোষ্য। আমাদের রুম ছিল একতলায়। করিডোর থেকে নীচে নামলেই বিরাট লন আর লনের গা বেয়ে শান্ত স্নিগ্ধ লেক। হোটেলে দুরকমের ডিনারের ব্যবস্থা, এক ডাইনীং এ আর দুই লনে বুফে দেয়া আছে। চেয়ার টেবিল পাতা আছে। কিন্তু চার্জ একটু বেশি। আর লনে কিছু ফেলা যাবে না, পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করা যাবে না এই শর্তও দেয়া আছেতবে না ডিনার করলেও লনে বসে চা খাওয়া বা এমনি হাওয়া খাওয়া যাবে। পুরো পুস্কর শহর নিরামিষাশী। এটা শুনে প্রথমে একটু নিরাশ হয়েছিলাম। কিন্তু যখন লনে বসলাম একদম লেকের গা ঘেষে চেয়ারে, তখনি বুঝলাম আজ এখান থেকে আর কোথাও যাওয়া হবে না। আর খাওয়ার পর জেনেছি এমন রান্না হলে নিরামিষাশী হওয়াও কোন ব্যাপার না। লেকের পাশেই ছোটমতো একটি টিলা। তার ওপরে মন্দির। টিলার বুক কেটে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা বানানো হয়েছে। লেকের পানিতে বিশাল সাদা উঁচু সেই মন্দিরের ছায়া পড়েছে। পুরো মন্দির প্রদীপে সয়লাব। মন্দির থেকে লেকে আসার জন্যে একশ এর ওপর সিড়ি আছে। সমস্ত সিড়ির দুপাশে প্রদীপ দেয়া। সেই সমস্ত প্রদীপের ছায়া লেকের পানিতে কাঁপছে। মন্দিরের মাঝ থেকে সন্ধ্যারতির ধ্বনি এসে সারা শহরকে চিরে দিচ্ছে। আর কোন শব্দ নেই। সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। আমরা দুজন মুখোমুখি নিঃশব্দ। আজো ভাবলে সে ভাল লাগা টের পাই। 



এরপর গেলাম নেপালের পোখরা বলে একটা জায়গায়। রাতে ডিনার করছি হোটেলেরই রেস্টুরেন্টে। খাবার সাথে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় নেপালী ভাষার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নির্দিষ্ট সময় দেয়া থাকা সত্বেও বেশ দেরী করে গেলাম খেতেভাবলাম কি আর হবে, স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় নেপালী ভাষার অনুষ্ঠান। খেতে যেয়েও পিলে চমকে যাওয়ার যোগাড়। আশে পাশের টেবিলে ইয়া ইয়া চেহারার তিব্বতী লোকজন বসে খাচ্ছেন। কিছু কিছু জিনিসের কোন ব্যাখা হয় না। কালোদের যেমন দেখলেই ভয় লাগে, ভীষন ষন্ডা ষন্ডা লাগে অকারণেই। তেমনি তিব্বতীদের দেখে অকারণেই ভাবছি খাবার শেষ করেই লন থেকে দৌড় দিব রুমে। খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি, নেপালীদের গান শুনছি। ভাষা বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারছি লোকগীতি হচ্ছে। সুরের মিল আছে, কিছুটা আমাদের দেশের পাহাড়ী গানের সুরের সাথে। তারচেয়েও ভাল লাগছিল তারা গান গাইছিলেন অভিনয় করে করে। ছেলে মেয়ের মান ভাঙ্গাচ্ছে, ঝগড়া করছে, মেয়ে চলে যেতে চাইছে, তাকে মিনতি করছে। ভাষা বুঝতে না পারলেও বাকি সবই বুঝতে পারছি এবং খুব উপভোগ করছি। আমরা কোন ধরনের কোন আশা নিয়ে ডিনারে যাইনি বলে একদম খালি হাতে গিয়েছিলাম। ওমা দেখি পাশের লোক, আমাকে ষন্ডা তিব্বতীদের মাঝে রেখে রুমে দৌড় দিয়েছে তার ক্যামেরা নিয়ে আসার জন্যে। তারপর দেখা গেলো রাত বারোটা অব্ধি অনুষ্ঠান উপভোগ করে সবাই চলে গেলেও আমরা দুজন তখনো লনে বসে আছি। পুরো জায়গাটা জুড়ে যেনো তখনও সুরগুলো, বাঁশির মূর্ছনা ভেসে বেড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ঠিক করে হাত মেললে যেনো ধরতে পারবো ভেসে যাওয়া সুরের মূর্ছনাকে। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার আর পাহাড়ের ওপর আমরা। নেপাল সম্পর্কে একটা কথা না বললেই না। ছোট একটা দেশ। আকাশ পরিস্কার থাকলে এর যেকোন কোনা থেকে হিমালয় দেখা যায়। নেপালের যে প্রান্তেই যাকনা কেউ মন খারাপ করে থাকার কোন উপায় কারো নেই। হিমালয় তার রুপে মন ভাল করে দিবেই দিবে।



একবার বোনেরা সবাই গিয়েছিলাম সেন্টমার্টিনে। দারুন একটা রিমোট এরিয়া কিন্তু ট্যুরিষ্ট দিয়ে একাকার। হোটেল থেকে জিজ্ঞেস করা হলো রাতে কি বারবিকিউ চাই কিনা। বললাম হ্যা চাই। তারপর তারা জিজ্ঞেস করলেন কিসের বারবিকিউ চাই। আমাদের মাথা ঘুরিয়ে গেলো এমন অফার শুনে। তাদেরকে মাছের অর্ডার দেয়া মাত্র, তারা জেলেদেরকে ফোন দিলেন সেইসব মাছ তাজা হোটেলের কিচেনে পৌঁছে দিয়ে যেতে। রাতে ডাকা হলো বারবিকিউ শুরু হচ্ছে, যেতে। গেলাম, দেখি আরো কয়েক পার্টি আছে। সেসব পার্টিতে কিছু নওজোয়ান আছে, খুবই করিৎকর্মা। তারা স্থানীয় কিছু গায়ক জোগাড় করে ফেলেছেন। শুরু হলো গান বাজনা। পাশেই সমুদ্রের বাজনা আর তার সাথে পুরুষ গায়কের গলায় ওরে সাম্পানওয়ালা আমারে তুই করলি দিওয়ানা। চারদিকে বিদ্যুৎ নেই, দূর দূরান্তে আছে কিছু অচেনা পাখির নিশি পাওয়া ডাক। সারা দ্বীপের যতোদূর চোখ যায় টিম টিম হ্যাজাকের আলোর সাথে এই ছোট একটু ক্যাম্প ফায়ার আর এই বারবিকিউ এর চলার জ্বলন্ত কয়লার আলো। সমুদ্র গর্জে যাচ্ছে রাগত আহত ব্যাঘ্রের মতো। ঢেউ একটু জোরে ধাক্কা দিলেই আমরা তলিয়ে যাবো সমুদ্রের অনেক অনেক নীচে। মাঝে মাঝেতো মনে হচ্ছিল ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বীপ বুঝি দুলে উঠলো। মূল ভূখন্ডের সাথে আমাদের কোন যোগ নেই। সেখানে ছেলের গলায় মেয়ের গানও আসলে কোন ম্যাটার করে না। অদ্ভূদ রকমের একটা গা ছমছম করা পরিবেশ। গান হচ্ছে সাথে পুড়ছে মাছের কাঁটা আর মুরগীর ঠ্যাং। আস্তে আস্তে তারা সে সময়ের হিট ছবি মনপুরার গান গাইছিলেন যাও পাখি বল তারে। এই গায়ক দলে দু একটা কিশোর গায়কও ছিল। তারাও যে আধুনিক দুনিয়ার খোঁজ খবর রাখেন সেটা আমাদের জানাতে তৎপর হয়ে হঠাৎ গাইতে শুরু করলেন, মনে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবীওয়ালা। সাথে সাথে পাশের সিনিয়র গায়ক সেই কিশোরের মাথায় চাঁটি মারতে লাগলেন সবার সামনে। পুরো পরিবেশটাই কেমন যেনো অতিপ্রাকৃতিক বা আনরিয়েল লাগছিলো। অনেক অনেক রাত অব্ধি গান শুনে, সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেটে বেড়িয়ে ঘরে ফিরেছি। মনে হচ্ছিলো সত্যি সত্যি এগুলো ঘটছে না। অসাধারণ এক অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেখান থেকে যা কাউকে ব্যাখা করে বোঝানো যায় না। 




আরোও একবার এরকম অনুভূতির মধ্যে দিয়ে গেছি ভেনিসে। পুরো শহরটিতে কোন রোড কানেকশান নেই। পুরোটা শহর পানির ওপর ভাসছে। শহরের লোকদের যেমন নিজের গাড়ি আছে, ওখানেও আছে নিজের বোট। ওয়াটার বাস, ওয়াটার ট্যাক্সি আর গান্ডোলা। এই চড়ে চড়ে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, লোকে ব্যবসা করছে, কাজে যাচ্ছে। বিখ্যাত মুরানো গ্লাস ফ্যাক্টরীগুলো সেখানেই অবস্থিত, এবং প্রোডাকশান হচ্ছে আর সারা বিশ্বব্যাপী রফতানীও হচ্ছে। হাতের তৈরী ও পেইন্ট করা সুন্দর সব মুরানো গয়নাও সেখানে তৈরী হয়। বলা হয় ভেনিস হলো মার্চেন্ট সিটি। সেজন্যেই এর নাম ভেনিস। অসম্ভব রকমের ধনী লোক ছাড়া কেউ মূল ভেনিসে বসবাস করতে পারে না। যারা ওখানে কাজ করেন, অনেকেই পাশের শহর থেকে ট্রেনে এসে তারপর ফেরীতে করে এখানে কাজ করতে আসেন। ভেনিস ঘুরে দেখার দুরকম ব্যবস্থা। এক হলো ট্যুরিষ্ট ফেরীতে করে, দ্বিতীয় নিজের ওয়াটার ট্যাক্সি হায়ার করে। আমরা সেই ট্যুরিষ্ট ফেরীতে করে এই দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপ, তারপর এদিক তারপর ওদিক সব যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ একটা যত্ন করে ছবি এঁকে রেখেছেন আমরা তার বুক চিরে যাচ্ছি। মাথার ওপরে নীল আকাশ, নীচে নীল সমুদ্র আর মাঝখানে আমরা। সামনে ছবির মত কিছু সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর, স্থাপত্য। মাঝে মাঝেই রাজকীয় নকশার গান্ডোলা যাচ্ছে সমুদ্রকে ভেদ করে। আর নীলের মাঝে কন্ট্রাষ্ট নিয়ে আসছে ঝাকে ঝাকে সাদা পাখির দল। নাম না জানা হরেক রকমের বক। আজো সে সন্ধ্যার কথা মনে পড়লে, গায়ে কাঁটা দিয়ে আসে। মনে হয়, সত্যিই কি ছিল সে সন্ধ্যাটা জীবনে? নাকি সবটাই আমার কল্পনা?

একটা বেশ ঘটনা হলো, অনেক সুযোগ থাকা সত্বেও এ জায়গাগুলোতে এখনো দ্বিতীয়বার যাওয়া হয়নি। যেখানে অনেক কম ভাল লাগা যায়গায় পাঁচ/ছয় বারও যাওয়া হয়েছে। খুব ইচ্ছে করে আবার সে জায়গাগুলোকে ছুঁয়ে দেখে আসতে। কিন্তু আজকাল কেমন যেনো ভয় হয়, মনে হয় না যাওয়াই ভাল হবে, হয়তো মুগ্ধতার সে রেশ কেটে যাবে। হয়তো আগের বারের মতো এতো ভাল লাগবে না। কি দরকার ভাল লাগাটাকে নষ্ট করে, তারচেয়ে আছে থাক না। 



কিছু কিছু মুগ্ধতা বোধহয় চিরন্তন, কখনো কমে না। তিতাস নদীর পারে আমার দাদীর বাড়ি। আগে আমাদের নিয়ম ছিল, কোরবানী ঈদ করতে বছরে একবার সব আমরা বাড়িতে যেতাম। সে উপলক্ষ্যে পাঁচ/ছয় দিন থাকা হতো বাড়িতে। আমাদের বাড়ি ভর্তি ছিল কবুতর। সাধারণ যে কবুতর আমরা খাই, সেগুলোর থেকে এগুলো আকারে বড় আর গা ভর্তি নানা রকমের ছিটা। এগুলোকে বলা হতো জালালী কবুতর আর এগুলোকে পবিত্র কবুতর হিসেবে মানা হতো বলে এগুলো খাওয়া নিষেধ। সকালে ঘুম ভাঙ্গতো কবুতরের বকরম বকরম আর ওদের ডানার ঝাপটা ঝাপটির শব্দে। নদীর পাড়ে বাড়ি বলে, বন্যার কারণে বাড়ি অনেক উঁচুতে বানানো। বিছানায় শুয়ে নদী দেখতে পেতাম। নদীর দুপাশ ঘিরে সবুজ ধানের জমি। যতোদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে বাড়িঘর। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলতে চাইতাম না, ভাবতাম এটা যদি সত্যি না হয়, যদি দেখি ঢাকার বাসায় শুয়ে আছি, সব আমার কল্পনা যদি হয়। যতোবার যেতাম ততোবারই মুগ্ধ হতাম। এখনো যতোবার যাই, ততোবারই মুগ্ধ হই। এ মুগ্ধতা বোধহয় নাড়ীতে পোতা। এ মুগ্ধতার সাথে অবশ্য বিশ্বের অন্য কোথাও বেড়ানোর তুলনা হয় না।
 

তানবীরা
২৩.০৯.২০১২