Monday, 28 December 2015

হোয়াইট সান্টা আর ব্ল্যাক পিটের গল্পটি

জিঙ্গেল বেলস, জিঙ্গেল বেলস, জিঙ্গেল অল দ্যা ওয়ে

উত্তর আমেরিকার সান্টা ক্লজের ওলন্দাজ রূপটি হলোসিন্ট নিকোলাসবাসিন্টারক্লাশ যদিও আজকাল আমেরিকার দখলে সান্টা ক্লজ কিন্তু সান্টা ক্লজের আদি দাবিদার কিন্তু ওলন্দাজরা। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সমসাময়িক কাল থেকে, নিউ ইয়র্কের ওলন্দাজ কলোনিতে (নিউ আমর্স্টাডামে) বসবাসকারী অভিবাসী ওলন্দাজ নাগরিকরা সেখানে এই রীতিটির পালন পুনরায় শুরু করেছিলেন। আজকের এই আনন্দময় রীতিটির পেছনের গল্পটিই এখানে বলব। কেমন করে সান্টা সব বাচ্চাদের আপন হলো।
প্রতি বছর শীতের শুরুতে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বাচ্চাদের আর দোকানীদের মধ্যে হুল্লোড় পড়ে যায় সিন্ট নিকোলাসের উপহার আর বড়দিনের উপহার কেনাবেচা নিয়ে। আমিও তখন ভাবি এবার ওলন্দাজ এই রীতিটি নিয়ে কিছু লিখেই ফেলব। তারপর আলসেমি আর নানাবিধ অন্যান্য ব্যস্ততায় দিনটি চলে যায় আর আমিও ভুলে যাই। আবার কখনো ভাবি, ঠিক আছে; সামনের বছর ঠিকই লিখে ফেলব। এই ভাবতে ভাবতেই নিজের মেয়ে বড় হয়ে গেল আর জেনে গেল, সিন্ট নিকোলাস নামের কেউ আসলে ঘোড়ায় চড়ে স্পেন থেকে উপহার নিয়ে আসে না, বাবা-মায়েরা’ই বাচ্চাদের জুতোয় ঢুকিয়ে রাখা উইশ লিস্ট পড়ে বেছে তার থেকে উপহার কিনে দেয় ছেলেমেয়েদের। মাঝখানে দিন সিন্ট নিকোলাস থেকে দ্য ভেরি বেস্ট উপহার পাবে আশায় বাচ্চারা তাদের মারামারি, দুষ্টুমি, মিথ্যে বলা, ঝগড়া করা কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে রাখে।
পাঁচ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা নেদারল্যান্ডসের জাতীয় জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন দূর দূরান্ত থেকে পরিবারের সবাই একসাথে হয়, খাওয়াদাওয়া সেরে তারপর সবাই নিজেদের মধ্যে উপহার বিনিময় করে। এই দিনটিকে ঘিরে বেশ পূর্ব প্রস্তুতি থাকে। সাধারণত যেসব বাড়িতে বাচ্চা থাকে অন্যান্য উৎসবের মতো এই উৎসবটিও সে বাড়িতে বেশি প্রাণ পায়। তবে বাচ্চা বড় হয়ে গেলেও ঐতিহ্য বজায় থাকে। বাচ্চারা প্রি-স্কুলে যাওয়ার সময় থেকে, নভেম্বরের এই সময়ে তাদের স্কুলে পড়ানো ছড়া, গল্প, টিভিতে দেখা কার্টুন থেকে -সম্বন্ধে ধারণা পেতে থাকে। ধরতে গেলে, প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া সব বাচ্চা নভেম্বরের এগার তারিখ থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের চার তারিখ অবধি সিঁড়ির ওপরে জুতো রেখে দেয়। বাড়ির চিমনি দিয়ে সিন্ট নিকোলাস বাড়িতে ঢুকে কিছু উপহার রেখে যাবে সেই আশায়। জুতোর পাশে থাকে নিকোলাসকে লেখা তাদের আধো আধো হাতের চিঠি, ছড়া, গাজর আর চিনির কিউব। নিকোলাসের ঘোড়া চিনি আর গাজর খেতে ভালোবাসে যে
বাবা মায়েদের সে দিন একটু বেশি সর্তক থাকতে হয়। বাচ্চারা ঘুমোলেই গাজর, চিনি, চিঠি সব সরিয়ে রাখতে হয় যাতে বাচ্চারা বুঝতে না পারে। আর জুতোর মধ্যে উপহার রেখে দিতে হয় যাতে সকালে উঠেই উপহার হাতে পায়। এই দিন বাচ্চাদের ঘুম থেকে ওঠাতে বেশি কষ্ট করতে হয় না। নিকোলাসের কথা বললে ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে দৌড় দেয় সিঁড়ির কাছে। আজ রাতে কী পেল উপহার নিকোলাসের কাছ থেকে। বেশিরভাগ সময় হতাশ হয় সেই একই কুকিস কিংবা চকোলেট পেয়েছে বলে। সপ্তাহ জুড়ে কেন একই জিনিস? কেন নতুন কিছু নেই! নিকোলাসের দেয়া অন্যতম উপহারগুলো হলো, চকোলেটের বর্ণ (সাধারণত বাচ্চার নামের আদ্যক্ষর) পেপারনোটেন (pepernoten), ক্রাউডেননোটেন (kruidennoten), স্পেকুলাস (speculas), কমলা, চকোলেট কয়েন্স, ইত্যাদি। সপ্তাহান্তে অবশ্য একটি ছোট খেলনা কিংবা ছবি আঁকার বই, রঙ পেন্সিল ইত্যাদি কিছু পাওয়া যায়। এভাবে করে পাঁচ ডিসেম্বর চলে এলে, বাচ্চাদের উইশ লিস্ট তো আগেই দেওয়া থাকে নিকোলাসকে, সেখান থেকে দেখে নানা-নানী, দাদা-দাদী, চাচা, খালা, বাবা-মা সবাই উপহার কিনে আনে আর তা দিয়ে উদযাপিত হয় উপহার সন্ধ্যা তথা গিফট ইভনিং
এরা ক্রিসমাসে নয়, পাঁচ ডিসেম্বেরই উপহার বিনিময় করে, ক্রিসমাসকে ওলন্দাজরা সিন্টারক্লাশ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে। সন্ধ্যায় প্রথমে বাচ্চাদের পর্ব। সেটা শেষ হয়ে গেলে তারপর বড়রা করে। বাচ্চাদের উপহার পাওয়ার পর্বটা আকর্ষণীয় করার চূড়ান্ত চেষ্টা থাকে বড়দের মধ্যে। সাধারণত দেখা যায় বাসার কোথাও ব্ল্যাক পিট একটা চিঠি রেখে যায়, যেখানে লেখা থাকে উপহার কোথায় রাখা আছে। আসলে আগেই উপহারটি সেভাবে লুকিয়ে রাখা হয়। বাচ্চারা সেখানে গিয়ে খুঁজবে সেই আনন্দে। সন্ধ্যা থেকে বাচ্চারা পিটের অপেক্ষায় তার জন্যে চকোলেট দুধ গরম করে তাতে ক্রিম মিশিয়ে রাখে, গরম কফি বানিয়ে বসে থাকে এবং আরো কত কী! আবার অনেক বাসায় সন্ধ্যে বেলায় প্রতিবেশি পিট সেজে এসে বেল বাজিয়ে উপহারের বস্তাখানি দরজার সামনে সাজিয়ে রেখে যায়। সবার চেষ্টা থাকে নতুন কোনোভাবে উপহার আদান প্রদানের ব্যাপারটিকে উপস্থাপন করার। উপহারগুলো সাজানোতে অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করা হয়। উপহারের সাথে প্রায়ই একটা কবিতা কিংবা গান থাকে। সাধারণত যার জন্যে উপহার তাকে নিয়ে মজা করে কিছু লেখা হয়ে থাকে, তাকে খ্যাপানোর চেষ্টা থাকে।

শুধু বাড়িতে নয় স্কুলেও বাচ্চারা উপহার পায়। সুপারমার্কেটে জুতা রেখে আসতে পারে। সেখানেও ছবি আঁকা, রং করা ইত্যাদি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাচ্চাদের উপহার দেওয়া হয়। অনেক কোম্পানি এই দিনটিকে কেন্দ্র করে একটি পারিবারিক মিলন মেলার আয়োজন করে। কোম্পানিতে কাজ করা সব মানুষকে নিয়ে কিছু ইভেন্ট হয় তারপর খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে উপহার পাওয়ার পালা। পাঁচ ডিসেম্বের অনেক শহরে সন্ধ্যায় দোকানপাট বন্ধ থাকে। অনেক সময় কিছু রেস্তোরাঁও বন্ধ থাকে কারণ পাকইয়েজ আভোন্ড (pakjes avond)দ্যা গিফট ইভনিং কুসংস্কারও আছে ওলন্দাজদের মধ্যে; সিন্টারক্লাশের আগে ক্রিসমাস ট্রি বাসায় সাজাতে হয় না, তাতে অমঙ্গল হয়।

এবার একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই; কোথা থেকে এলো সিন্টারক্লাশ আর ব্ল্যাক পিট? এটি একটি কাল্পনিক ঐতিহাসিক চরিত্র, লোকগাঁথা থেকে উঠে আসা বলা যায়। রোমান ক্যাথলিকদের মতে পাঁচ ডিসেম্বর রাতে নেদারল্যান্ডসে উপহার বিতরণ করে ছয় তারিখ সকালে বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ হয়ে ফ্রান্সের দিকে যায়। তবে আরুবা, বোনার, কুরাসাও ইত্যাদি ডাচ কলোনিগুলোতেও সিন্টারক্লাশ জনপ্রিয় আর পরিচিত চরিত্র। তাকে জনপ্রিয় ক্রিসমাস আইকনও বলা যায়। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইটালি, সুইটজারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, গ্রিস-সহ আরো অনেক দেশের বেশ কিছু অংশে সিন্টারক্লাশ উদযাপিত হয়ে থাকে।

সিন্টারক্লাশ একজন গুরুগম্ভীর মহিমান্বিত বৃদ্ধ যাঁর বেশ লম্বা সাদা দাঁড়ি আছে, মাথার সব চুলও সাদা। তিনি মাথায় একটি খুব দীর্ঘ লম্বা লাল টুপি পরেন, গায়ে থাকে ঐতিহ্যবাহী বিশপের কাপড়। সাথে কখনো কখনো লাল স্টোল, আঙ্গুলে লাল রুবীর আংটি আর সোনালি রঙের বিশপের দণ্ড থাকে তাঁর হাতে। ঐতিহ্যগতভাবে তিনি ঘোড়ায় চেপে আসেন, ঘুরেন, বেড়ান। নেদারল্যান্ডসে ওনার ঘোড়ার নাম—‘এমেরিগো আর বেলজিয়ামে ঘোড়ার নাম—‘স্লেক্ট উইয়ার ভানডাগ সিন্টারক্লাশের হাতে একটি বিশাল বড় খাতা থাকে। কথিত আছে, সেই খাতায় প্রত্যেকটি শিশুর নাম লেখা আছে আর সাথে লেখা আছে, শিশুটি কি সে বছর বেশি দুষ্টুমি করেছে নাকি বেশি লক্ষ্মী ছিলতার হিসাব।

সিন্টারক্লাশের চিরন্তন সহকারী হলো ব্ল্যাক পিট। যার কালো কোঁকড়ানো চুল, গলায় লেস বসানো পোশাক, মাথার টুপিতে পালক গোঁজা ঠিক যেমনটা সতেরশ শতাব্দীর পোশাকগুলো হতো। ১৮৫০ সালে আমস্টার্ডামের স্কুল শিক্ষক ইয়ান স্ক্যাঙ্কারমান প্রথমে ব্ল্যাকপিটের চরিত্রটিকে ঐতিহাসিকভাবে আঁকেন, যদিও তখন ব্ল্যাক পিট নাম তার ছিল না। জনৈক দাস হিসেবে চরিত্রটি প্রথমে আঁকা হয়। ঊনিশ শতকের দিকে ব্ল্যাক পিট নামের চরিত্রটি সিন্টারক্লাশের সহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হেলেন এডেলিন গার্বার (Hélène Adeline Guerber) এবং অন্যান্য আরো অনেকের মতে সিন্টারক্লাশ আর তার সহকারীদের এই গল্পটি কোনো না কোনোভাবে ওয়াইল্ড হান্ট উডেন-এর গল্পটির সাথে জড়িত। ওয়াইল্ড হান্টের গল্পের স্লেপনির চরিত্রটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে বাতাসের বেগে চলাফেরা করত আর তারও দুটো কালো বর্ণের কোঁকড়া চুলের সহচারী ছিল; হাগিন এবং মুনিন। তারা ব্ল্যাক পিটের মতো বাড়ির ছাদের কাছের চিমনিতে বসে থাকত আর তাদেরও কাজ ছিল উডেনকে পৃথিবীর মানুষের ভালো আর মন্দ কাজ নিয়ে অভিহিত করা। তবে এগুলো সবই কল্পনার চরিত্র। ইতিহাসের পাতা কিংবা ধর্মগ্রন্থে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সিন্টারক্লাশ আর ব্ল্যাক পিটের কাজ হলো লক্ষ্মী বাচ্চাদের জন্য বস্তা ভর্তি করে চকলেট নিয়ে আসা আর মুঠো মুঠো করে সেই চকোলেট তাদের বিলানো। আর দুষ্ট বাচ্চাদের পেছনে উইলো গাছের শাখা দিয়ে তৈরি বেত দিয়ে মারা। কথিত আছে লক্ষ্মী বাচ্চাদের চকোলেট বিলানো শেষ হলে সেই বস্তায় ভরেই দুষ্ট বাচ্চাদের স্পেনে নিয়ে যাওয়া হতো।
পিট কেন ব্ল্যাক? হ্যাঁ আধুনিক কালে এই নিয়ে সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, টকশো, বিতর্ক, ডকুমেন্টারি, বিক্ষোভ উৎসবে এমনকি সহিংস সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও আধুনিক কালে বলা হয় চিলেকোঠার চিমনি দিয়ে পিট বারবার উপহার নিয়ে ওঠানামা করতে গিয়ে পুড়ে কালো হয়ে গেছে, কিন্তু সত্যি হয়ত সেটা নয়। পিটকে স্পেনের একজন নিগ্রো ক্রীতদাস ভেবে নিয়েই সেই সময়ে চরিত্রটি আঁকা হয়েছিল। নেদারল্যান্ডসে ছুটি এবং পিট দুটোই সমান জনপ্রিয়। ২০১৩ সালের এক জনমত জরিপে দেখা যায় বিরানব্বই ভাগ ওলন্দাজরা ব্ল্যাক পিটকে দাস কিংবা বর্ণ বৈষম্যের স্বীকার বলে মনে করেন না আর একানব্বই ভাগ ওলন্দাজ পিটের বর্ণ পরিবর্তনের বিপক্ষে। কিন্তু কালো অভিবাসীদের চরম আপত্তির মুখে জাতিসংঘ বলেছে, নেদারল্যান্ডসে এখন ব্ল্যাক পিটের আসর বন্ধ করা উচিত। একবিংশ শতাব্দীতে দাস প্রথা নিয়ে উৎসব প্রার্থিত নয়। ওলন্দাজরা এর ঘোর বিরোধিতা করে যাচ্ছে। তাঁদের মতে, হাজার বছর ধরে চলে আসা এই উৎসবের সাথে বর্ণ বৈষম্যকে মেলানো ঠিক না, বিদেশিরা তাদের সংস্কৃতির মর্ম বোঝে না। এখনো এই দ্বন্দ্ব চলছে; ভবিষ্যতে পিটের রঙ কী হবে? কালো হবে নাকি সাদা? ভবিষ্যতই সেটা ঠিক করবে।
ঐতিহ্যগতভাবে প্রতি বছর সিন্টারক্লাশ এগারো নভেম্বরের পরের শনিবারে স্পেন থেকে বাষ্পচালিত জাহাজে চড়ে নেদারল্যান্ডসের নদী বা সমুদ্র নিকটবর্তী কোনো শহরে অবতরণ করেন। সিন্টারক্লাশ কোন শহর দিয়ে সে বছর নেদারল্যান্ডসে প্রবেশ করবে সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে ঠিক করে দেওয়া হয় বছরের শুরুর দিকে এবং সে অনুযায়ী শহরের মেয়ব আর জনগণেরা সারা বছর প্রস্তুতি নেয়। সাজানো গোছানো শহরে, উৎসব মুখর পরিবেশে ঘোড়ায় চড়ে সিন্টারক্লাশ প্যারেড করে এগিয়ে চলেন। সব বাচ্চারা সিন্টারক্লাশের গান গেয়ে তাকে উৎফুল্ল চিত্তে বরণ করে নেয়। ব্ল্যাক পিট পাশ থেকে সবার মাঝে মুঠো মুঠো চকোলেট, পেপারনোটেন, ক্রাউডেননোটেন ছিটিয়ে দেয়। পুরো অনুষ্ঠানটি নেদারল্যান্ডস বেলজিয়ামের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। যে শহরে সিন্টকে জাতীয়ভাবে বরণ করা হয় সে শহর ছাড়া অন্য শহরগুলোতেও স্থানীয়ভাবে নিজেরা সিন্ট উৎসব পালন করে থাকে। শনিবারে পৌঁছানোর পর রোববারে অনেক সময় সিন্ট ট্রেনে করে, ঘোড়ায় চড়ে কিংবা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে পাশের শহরগুলোতে বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে যায়। আর এভাবেই জিঙ্গেল বেল জিঙ্গেল বেল বাজতে বাজতে এসে পরে ক্রিসমাসনিউইয়ার উৎসব ঘুরে যায়, বদলে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা।
 

Thursday, 12 November 2015

একটি ছহি নুডলসবিক্রেতা কোপানিবৃত্তান্ত

পৃথিবীর এক কোনায় একটি গ্রাম ছিলো, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা। সেই গ্রামের লোকেরা মাছ দিয়া ভাত খাইয়া, জারি-সারি গান গাহিয়া মনের সুখেই দিনাতিপাত করিত। কিছু কিছু মানুষ অবশ্য ভাতের বদলে তখন রুটি কিংবা নুডলস এই জাতীয় দ্রব্যাটি খাইত। যাহারা ভাতে অভ্যস্ত তাহারা তাহাতে আঁৎকাইয়া উঠিতো। রুটি না হয় সহ্য করা গেলো, ভাতের পাশাপাশি তাও চলিয়া যায়, তাহাদের মতই দেখিতে অন্য গোত্রের মানুষরা সেইটা খায়। তাই বলিয়া নুডলস! সেতো পুরোই অশাস্ত্রীয় অনাচার!
জন্মের পর হইতে তাহারা তাহাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি, মামা-খালা-ফুপু, ওমুক তমুক চৌদ্দগোষ্ঠীকে নানা রকমে ভাত খাইতে দেখিয়াছে। পার্বণবিশেষে ভাতকে খিচুড়ি কিংবা পোলাও-বিরিয়ানিতে রূপান্তরিত হইতে দেখিয়াছে, তাহারা তাতেই অভ্যস্ত। বরং মাছের বদলে তাহারা মাংসের দিকে দিনে দিনে আগাইয়া গেলো। বিভিন্ন আবরণে, পর্দায় ঢাকিয়া তাহারা মাংস সহকারে ভাতই খাইবে। যাই হউক, যাহারা নিয়মিত ভাত খাইত তাহারা নুডলস খাওয়া ঠিক সুনজরে না-দেখিলেও ব্যাপারটি সহ্য করিয়া কিংবা মানিয়া লইতো।
কিন্তু হাল্কাপুল্কা নুডলসখানেওয়ালাদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়িয়া যাইতে লাগলো। তিন বেলা ভাত খাওয়ার অপকারিতা সম্বন্ধে এক বেলা নুডলসখানেওয়ালারা লেখালেখি করিতে লাগিল। ভাতে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা থাকে, ডায়বেটিস শরীর নরম করিয়া দিলে অন্য রোগ ব্যাধি জাঁকাইয়া বসিয়া শরীর কাবু করিয়া ফেলিতে পারে, তাহাতে মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়িয়া যায়। ভাত উৎপাদন ও রন্ধনের প্রক্রিয়া মোটেও বৈজ্ঞানিক নহে, অর্থনৈতিকও নহে। ভাত শরীরকে অলস করিয়া দেয়, তাহাতে কর্মক্ষমতা এবং স্পৃহা কমিয়া যায় ইত্যাদি যখন তাহারা যুক্তি সহকারে লিখিতে লাগিল, তখন জনম জনম ধরিয়া যাহারা ভাতের ব্যবসা করিত আর যাহারা ভাত খাইত, তাহারা খুবই ভয় পাইয়া গেলো। তাহারা নুডলসকে বিগ্রামীয় সংস্কৃতি আর খাবার আখ্যা দিয়া উঠিয়া পড়িয়া তাহার বিরুদ্ধে লাগিল।
নুডলসটা দেখিতে কেমন যেনো লম্বা লম্বা কৃমির মতন, কিংবা বাঁকা বাঁকা প্যাঁচানো। মাছ দিয়া সেই ভাবে এইটা ঠিক করিয়া জুইত মত মাখা যায় না। কাঁটাচামচ দিয়া খাইতে হয়, হাতে ঠিক সুবিধা হয় না। আর এইসব এই গ্রামের সংস্কৃতির সাথে ঠিক মানানসই নয় বলিয়া প্রথমে ফতোয়া জারি করিল। প্রাণ যায় যাক, কিন্তু গ্রামের সংস্কৃতি নষ্ট হইতে দেয়া যাইবে না। হাত দিয়া মাখিয়া মাখিয়া ভাত খাইয়াই আমরা জীবনপাত করিব ইহাই আমাদের অঙ্গীকার, কহিল তারা। আর যাহারা এই কথা না মানিবে দরকার হইলে তাহাদের হত্যা করিয়া আমরা আমাদের অঙ্গীকার রক্ষা করিব। গ্রামের এই উত্তেজনা নিয়া গ্রামের জমিদার পক্ষ তখনও উদাসীন।
নুডলসখানেওয়ালারা কিংবা বিক্রেতারা ভাত ব্যবসায়ীদের এই হুমকি ঠিক ততোখানি গুরুত্বের সহিত দেখিলেন না, তাঁহারা তাঁহাদের নিজের চরকায় তৈল দিতে থাকিলেন যেমন পূর্বেও থাকিতেন। ইটালীয় নুডলসের পাশাপাশি বরং চৈনিক বিভিন্ন প্রজাতির নুডলস মিশিয়া তাহাদের মালামালের সম্ভার আরো বাড়িয়া গেলো।
উপায় না-দেখিয়া একদিন সত্যি সত্যিই এক নুডলস বিক্রেতাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় চাপাতি দিয়া কোপাইয়া খুন করিয়া ফেলিলো ভাত ব্যবসায়ী এন্ড করপোরেশন। খুন করিয়া দম্ভভরে ঘোষণা করিয়া জানাইল, ইহা তাহাদেরই কাজ। কথা না শুনিলে এখন থেকে কোপাইয়া মুখ বন্ধ করিয়া দিবে সকলের। নুডলস পক্ষ হতবাক হইয়া গেলো। কিন্তু তাহারা দমিয়া গেলো না, তাহারা তাহাদের মতই নিজের কাজ করিয়া যাইতে লাগিল।
গ্রামের জমিদার তখনও উদাসীন। গ্রামের জমিদার কর্তৃপক্ষ তখন গ্রামের আপামর জনগণের মনোভাব বুঝিতে ব্যস্ত। কে মরিল কিংবা কে থাকিল তাহা দিয়া আসলে তাহাদের কিছু যায় আসে না। যাহারা খাজনা দিবে তাহাদের মধ্যে কাহাদের শক্তি আর সামর্থ্য বেশি, নুডলস না ভাত, ইহাই তাহাদের মুখ্য বিচার্য বিষয়। ভাতখোরেরা ইহা বুঝিয়া সানন্দে একের পর এক নুডলসবিক্রেতা ও ভোক্তা খুন করিয়া যাইতে লাগল।
আগে রাস্তা-ঘাটে, মেলায় তাহারা নুডলসপক্ষের অপেক্ষা করিত। এখন আর তাহার প্রয়োজন নাই বুঝিয়া, নুডলসপক্ষীয়দের বাসা বাড়ি, অফিসে ঢুকিয়া কোপাইতে লাগিল। ভাতের আধিপত্য কমিয়া গেলে তাহাদের ব্যবসায় অসুবিধা হইতে পারে ভাবিয়া, কোপানোর ভয় দেখাইয়া মানুষকে ভাতের দিকে টানিয়া রাখিতে সক্রিয় হইলো ভাত ব্যবসায়ী এন্ড কোং।
এক গ্রামের শান্তি বিনষ্ট হইলে অন্য গ্রামেও তাহার প্রভাব পড়ে। এক গ্রামবাসীর আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব অন্য গ্রামেও আছে। দূরে খুব উন্নত একখানি গ্রাম ছিলো, যেখানে সকলেই যাহা ইচ্ছা খাইতে পারে, নুডলস, ভাত, রুটি, স্যুপ। ইহা লইয়া সেই গ্রামে বসবাসকারীদের মধ্যে তেমন মাথা ব্যথা ছিলো না। সকলেই মিলিয়া মিশিয়া থাকিত। সেই গ্রামে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামের জমিদারের নাতি থাকিত। কারণ, সেইখানে প্রাণ ভয় ছিলো না। তাই সেই গ্রামের সুন্দরী এক নুডলস তরুণীকে বিবাহ করিয়া জমিদার নাতি সেখানেই স্থায়ী হইয়া গেলো।
সেইখানে একদিন তাহাকে কেউ জিজ্ঞাসা করিল, ওহে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামের জমিদার নাতি, তুমিতো এইখানে রয়েছে মহাসুখে অট্টালিকা পরে, ঐখানে তোমার নানার গ্রামে যে লোকে কাঁদিয়া ভাঙিয়া পরে/ খুন হইয়া মরে।
মুখ আমসি করিয়া নাতি চিবাইয়া চাবাইয়া কহিল, আসলে আমার মাতা যাঁহারা নুডলস খাইয়া খুন হইতেছেন তাঁহাদিগের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল, কিন্তু ভাত হইলো আমার মায়ের ভোটের আধার, তাই তাঁহার নির্দেশে এই সকল মৃত্যু নিয়া সকলেই মুখে কুলুপ আঁটিবো বলিয়া ঠিক করিয়াছি। তাহারা মৃত্যুবরণ করুক ইহা আসলে আমরা চাই না, কিন্তু আমরা কী করিব বলুন? আমরাতো তাহাদিগকে নুডলস খাইতে বলি নাই। নুডলস লইয়া কথা কহিয়া আমরা ভেতো গ্রামবাসীর বিরাগভাজন হইতে চাই না। সেই গ্রামে ভাত আছে, ভাত থাকিবে, ভাতই তাহাদের নিয়তি। আমরাতো বাহিরের উন্নত গ্রামে ভিনগ্রামের স্ত্রীর সহিত স্যুপ, পাস্তা, পিজা খাইতে পাইতেছি, আমাদের সমস্যা কোথায়? সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাতখোরদিগের গ্রামে নুডলসপক্ষীয়দের নিজেদেরও সমঝিয়া চলিবার প্রয়োজন আছে বৈকি। গ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন এমনই সংকটাপন্ন যে এইসব লইয়া কথা কহিলে সমস্যা বৃদ্ধি পাইতে পারে। মানি যে ভাতখোরদিগের নুডলসপক্ষীয়দের কোপাইয়া কেষ্টপ্রাপ্তি করানো উচিত হয় নাই, কিন্তু নুডলসপক্ষীয়দিগেরও বুঝিতে হইবে ভাতখোরদিগের অনুভূতি, তাহাদের ভাতানুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা তো মোটেও উচিত কর্ম নহে।
যখন প্রশ্ন করা হইলো, কিন্তু নুডলসপক্ষীয়েরা তো তাহাদের মত প্রকাশ করিতেছে মাত্র, এই অপরাধে কাহাকেও হত্যা করা যায় কিনা! ইহার উত্তরে শ্রীমান নাতি অতি উচ্চাঙ্গের হাসি (যারে কয়, হাই ক্লাস) দিয়া কহিলেন যে, এই অপরাধের ব্যাপারে উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠিত হইয়াছে, অপরাধী ধরা পড়িল বলিয়া, দোষ করিলে কাহাকেও রেহাই দেওয়া হইবে না। তবে নুডলসপক্ষীয়দের অনুরোধ রহিল যেন তাঁহারা ভাতখোরদিগের ভাতানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, এবং ভাতখোরেরাও যেন নুডলসপক্ষীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। এইভাবে, ভাতের ভিতর নুডলস মাখিয়া ও মিশাইয়া হাজার বছরের সংস্কৃতি রক্ষা পাইবে। এই মহাবাক্য শুনিয়া রাজভাতখোর সর্বসেঁচি (ব্যাদড়া বালকগণের মুখে, সর্বখেঁচি) কবি কাব্যকম্বুকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, গ্রামে শান্তির সুবাতাস বহিতেছে। জয় শান্তি, জয় উন্নয়ন, জয় মানবপ্রেম!
প্রথমে গেল নুডলসখানেওলা, তাহার পর নুডলস বিক্রেতা, নুডুলসের সহিত যে টমেটো সস খাওয়া হইতো সেই সস বিক্রেতা, এরপর নুডলস রান্না করার জন্যে কড়াই যাহারা বানাইয়াছিলো, একে একে সবাইকে কোপাইতে লাগিল ভাতখোরগণ, যাহাকে বলে প্রায় বিনা বাধায়। ক্রমাগত কোপাকুপিতে আশেপাশের গ্রামের লোক চিন্তিত হইয়া পড়িল। দশ গ্রামের মুরুব্বিদের তরফ হইতে ঠিক করা হইলো জমিদারতনয়ার সহিত এই ব্যাপারে বাতচিতের দরকার। কিন্তু জমিদার তনয়া নানা সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আন্তর্জাতিক ব্যাপারে ব্যস্ত থাকায়, এই ব্যাপারে সরাসরি কথা কহিতে অস্বীকার করিলে মুরুব্বীরা তনয়ার একান্ত মোসাহেবের সাথে যোগাযোগ করিতে বাধ্য হইলেন।
সে অতি ফাজিল আর স্মার্ট ছোকরা নাম যাহার জালালুল হক কফিল। সে কহিলো, ব্যক্তিগত জীবনে জমিদারতনয়া খুবই সাদামাটা নির্বিরোধী মানুষ। তিনি তিন বেলা নিয়ম করিয়া ভাত খান। মাঝে মাঝে মাঝরাতে উঠিয়াও পানি দিয়া ভিজাইয়া রাখা ভাত নিজের হাতে পেঁয়াজ মরিচ ডলিয়া খাইয়া নেন। শান্তির জন্যে ভাত সম্বন্ধে লেখা যেকোন বই তিনি পড়েন, সুর করিয়া ভাত লইয়া লেখা বই পড়া দিয়া তাহার সকাল শুরু হয়। ভাতকে তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুস্বাদু খাদ্য বলিয়া মনে করেন। কিছু কিছু চাল যখন ভাত হইয়া ফুটিয়া উঠে তখন চারিপাশে মৌ মৌ সুগন্ধে ভরিয়া যায় আর পেটের মধ্যে খিদা কেমন চনমন চনমন করিয়া উঠে। আছে নুডলসে সেই সুগন্ধ? তাহলে কি করিয়া যুগ যুগ ধরিয়া সগৌরবে আর সদম্ভে ভাত টিকিয়া রহিলো পৃথিবীতে?
নুডলসখানেওয়ালাদের ওপর তিনি যথেষ্ট বিরক্ত। নুডলস লইয়া বাড়াবাড়ি না করিতে তিনি কয়েকবার হুশিয়ারি উচ্চারন করিয়াছেন। লম্বা লম্বা কিংবা বেঁকা বেঁকা নুডলস যাহারা খাইবে তাহারা তাহাদের ঘরে বসিয়া চুপচাপ খাইবে, দানা দানা ভাতের লোকমা যাহারা মাংস সহকারে ভক্ষণ করিবে তাহাদের ‘ভাতানুভূতিতে’ আঘাত করা চলিবে না। তাহার ওপর নুডলস একখানি বিদেশি খাবার, ইহা দিয়া এই দেশীয়দের শান্তিভঙ্গ করা চলিবে না।
দশ গ্রামের মানুষজন অবাক হইয়া কহিলো, কিন্তু নুডলসের দেশে যে তাঁহার আত্মীয় পরিজন আছে, তাঁহার ছেলে মেয়ে সেখানে সুখে ঘর করিয়া দিনাতিপাত করিতেছে, তাহার বেলা?
জালালুল হক কফিল রাগিয়া কহিলো, ওতো পাকনা কথায় আপনাদের কাম কী মশাই! ঐগুলো সব রাজরাজরাদের ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আর, তিনি নিজের যোগ্যতাতেই সেখানে থাকিবার ক্ষমতার্জন করিয়াছেন। পারিলে আপনারাও সেখানে হিজরত করুন, কে মানা করিতেছে? কিন্তু এই গ্রামে থাকিতে হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাতখোরদের ভাতানুভূতিতে কোনোক্রমেই কোমল পুষ্পকোরকের টোকাটিও দেওয়া চলিবে না, হুম! যত্তসব! গ্রাম উন্নতির দিকে আগাইয়া যাইতেছে মহাসমারোহে, সেইখানে এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বলিয়া আপনারা কিন্তু গ্রামের শান্তি, উন্নয়ন ও অপরাধীদিগের বিচারকার্য নিয়া বাধা সৃষ্টি করিতেছেন বলিয়া রাখিলাম! ইতিহাস আপনাদিগকে ক্ষমা করিবে না, গ্রামের জনসাধারণও করিবে না।
এইমতে ভিনদেশি বর্গি তাড়াইয়া গর্বে ও বিরক্তিতে নুডলস কোম্পানির বানানো খোমাখাতায় কফিল লিখিল, আর শুনিয়া রাখ ফোপর দালালরা, ভাত হইলো ভাত। নিজের স্বার্থ ও সুবিধানুযায়ী ইহাকে গরম খাওয়া যায়, ঠান্ডা খাওয়া যায়, তেলে ভাজিয়া ফ্রায়েড রাইস করা যায়, ঘিয়ে ভাজিয়া পোলাও রাইস করা যায়, চিনি দিয়া জর্দা, গুড় দিয়া পায়েস কি না করা যায়? ভর্তায় খাওয়া যায়, ভাজায় খাওয়া যায়, তরকারিতে যায়, চাটনিতে যায়, ডালে যায়, অম্বলে যায়, শত শত বছর ধরিয়া কি এমনি এমনি ভাতের গুণগান হয়? ভাতের ওপর খাদ্য নাই। এতসব জানিয়া শুনিয়া বেয়াড়া লোকটি ভাত না-বেচিয়া কেন নুডলস বেচিতে গেলো? শত শত বছরের ভাতৈতিহ্য ভাঙ্গে কোন সাহসে? কেন এই অপরাধে তাহাকে তাহা হইলে কোপানো হইবে না?
ভাতগুরুদিগের সমাবেশে নুডলসপক্ষীয়দের বিপক্ষে বিষোদ্গার পূর্ব হইতেই ছিল, কোপানোর পরও তাহারা থামে নাই, বরং তাহাদিগের কর্মের প্রতিফলস্বরূপই যে তাহার খুন হইতেছে, এই সারসত্য সবাইকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝাইয়া দেওয়া হইল। বেশিরভাগ ভাতখোরেরাই ইহা মানিয়া ভাতের নিচে রক্ত চাপা দিয়া ভাত খাইয়া ও ইহার শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদী জানিয়া হৃষ্টমুখে দিবাভাগে কর্ম ও রাত্রিভাগে নিদ্রাযাপন করিতে লাগিল। উগ্র নুডলসপক্ষীয় বা ভাতখোরদিগের কেহ কেহ বিবেকদংশনে দুচারিটি কথা বলিলেও বাকি প্রায় সবাই “চুপ, চুপ” বলিয়া তাহাদিগের গলা চাপিয়া ধরিয়া, হাজতে পাঠাইয়া, দণ্ডপ্রদান করিয়া গ্রামে কবরের শান্তি আনিয়া উল্লসিত হইল।
বাইরের মুরুব্বিরা ব্যাজার মুখে চলিয়া গেলো। সারা পৃথিবী যখন দ্রুত বেগে নুডলস সঙ্গী করিয়া সামনের দিকে ধাবিত হইতেছে, তখন তাহারা ভাত বুকে করিয়া এক জায়গায় স্থির থাকিতে বদ্ধপরিকর। সামনে যাওয়ার কোন আগ্রহ তাহাদের নাই। কিন্তু তাহাতেই কি রক্ষা পাইলো সকল? সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাতখোরদিগের হাতে একের পর এক নুডলসপক্ষীয় খুন হইবার পর, আর কোন নুডলসপক্ষীয় বাকি রইলো না। কেহ ভিনদেশে পলাইয়াছে, কেহ পাশের দেশ গা ঢাকা দিয়াছে, দেশের ভিতর যাহারা ছিল, তাহারা চুপ থাকিয়া, এমনকি মাফ চাহিয়া ভাতের গুণগান করিয়াও রেহাই পায় নাই। কিন্তু ভাতখোরদিগেরতো ফিনকি দিয়া বাহির হওয়া তাজা রক্তের নেশা চাপিয়া গেছে। ফি সহিহ ভাতমোবারকবারে তাজা রক্ত না দেখিলে নিজেকে পরিপূর্ণ মুজাহিদীন, মুমিন, জিহাদী বলিয়া মনে “জিহাদানুভূতি” আসে না।
তাহার পর শুরু হইলো লাল চাল, মোটা চাল, আতপ চাল, চিকন চালের মধ্যে লড়াই। একের পর এক এই লড়াইতে গ্রামটি একদিন ধ্বংসের শেষ মাথায় অন্ধকারে তলাইয়া গেলো। আলো জ্বালিবার জন্যে কেউ আর রহিল না।
শুধু গ্রামের প্রান্তসীমায়, বনের কাছে একঘর ‍বৃদ্ধবৃদ্ধা তাহাদিগের অন্ধের নড়ি, একমাত্র যুবক সন্তান, সেই নুডলসবিক্রেতার বিয়োগব্যথায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া অন্ধ হইয়া গেল।
তানবীরা
০৯/১১/২০১৫
http://www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/11732