Saturday 5 June 2010

অহনার অজানা যাত্রা (পাঁচ)

বিদেশ মানে সুন্দর সুন্দর ছবির মতো বাড়ি, বাড়ির সামনে বড় লন যাতে নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। ফুলের ওপর বর্ণিল প্রজাপতি উড়ছে। দামী গাড়িতে করে হাওয়া খেতে খেতে আজ এদিকে কাল সেদিকে বেড়াতে যাওয়া। ভালো রেস্টুরেন্টে ইকরি মিকরি নামের খাবার দিয়ে মোমবাতির আলোয় ডিনার করা, এই প্রাক রোমান্টিক ধারনাকে সর্বাংশে মিথ্যে করে দিয়ে অহনার জীবনে বিদেশ ধরা দিল কঠিন পার্বত্য জীবনের রূপে। অহনার কাছে বিদেশ মানে বাসে করে ডাচ স্কুলে যাওয়া, ভিন্ন ভাষায় লেখা ও অপরিচিত মোড়কে রাখা জিনিসপত্র থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস বাজার করা এবং সে বাজার টেনে বাসায় আনা। রান্না করা, কাপড় ধোয়া এবং ইস্ত্রি করা, বাড়িঘর ডাষ্টিং করার রূপ নিয়ে। অতি অল্প দিনেই হাঁপিয়ে উঠলো অহনা। ইউনিভার্সিটির অবাধ ঘোরাঘুরি, ফুচকা, ঝালমুড়ি, মামা হালিম, গাওছিয়া, ইষ্টার্ন প্লাজা, মহিলা সমিতি সবকিছুর জন্য সে অধীর হয়ে উঠলো। পুরনো দিনের জন্য ব্যাকুল সে প্রায়ই কান্নাকাটির এক শেষ করতো। বাজারে তখন নতুন ফোন কার্ড এসেছে, সস্তায় দেশে কথা বলা যাবে। অর্ন অহনার জন্যে টেলিফোনের কার্ড কিনে আনতো, ভাবতো দেশে সবার সাথে কথা বললে হয়তো একটু ভালো থাকবে। কার্ডে দেশে ফোন করা আর এক ঝক্কি। মনে হয় যেনো ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ওয়্যারলেসে কথা হচ্ছে। শব্দ আসে, আসে না, অর্ধেক শোনা যায়, অর্ধেক শোনা যায় না।

অহনার মা এতো ধৈর্য্য রাখতে পারেন না। মেয়েকে তিনিও অনেক মিস করেন। তাই তিনি প্রায়ই টিএন্ডটিতে বুকিং দিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলেন। একদিন মাঝ রাতে তার মায়ের কাছে ফোন এলো টিন্ডটি থেকে, প্রস্তাব দিলো তিনি চাইলে অহনার সাথে ফোনে কথা বলতে পারবেন প্রতি পনর মিনিট, বাংলাদেশি টাকায় চারশত টাকা। মা ঘুমের মধ্যে হ্যা না বলতে বলতেই তারা তাকে অহনার সাথে ফোনে ধরিয়ে দিলো। এহেন স্বর্গীয় প্রস্তাব ও ঘটনা থেকে অহনার মা আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। ফোন বিল এক ধাক্কায় অনেক কমে গেলো। এরপর এটা অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিনত হলো, প্রত্যেক সপ্তায় বাংলাদেশ সময় রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে মা অহনাকে ফোন করতেন। প্রত্যেক ফোনেই পরের সপ্তাহের ফোনের তারিখ জানিয়ে দিতেন। অহনাও তীর্থের কাকের মতো দিনক্ষন দেখে ফোন নিয়ে বসে থাকতো। এ লাইনে পরিস্কার কথা শোনা যেতো যেনো পাশের ঘরে মা বসে আছেন। শুধু একটা অসুবিধা হতো, ভাইবোনেরা পরদিনের স্কুল কলেজে যেতে হবে সে কারনে রাতে ঘুমাতো বলে, মা বাবা ছাড়া আর কারো সাথে এফোনে কথা হতো না। এঘটনা অনেকদিন চলছিল।

আস্তে আস্তে বরফ কেটে সূর্য উঁকি দিলো। চারধারে রঙ বেরঙের টিউলিপগুলো মাথা তুলে দাড়াতে থাকলো। অহনার এই পরিস্কার আকাশ দেখলেইন বাইরে যেতে ইচ্ছে করে। সারাজীবন সে শুনে এসেছে বাংলাদেশ ভীষন সবুজ। বিদেশীরা বাংলাদেশে বেড়াতে এলে এই সবুজের প্রশংসা করে যান। কিন্তু এখন অহনার মনে হতে লাগলো, হয়তো বাংলাদেশে প্রশংসা করার মতো আর কিছু খুঁজে পান না তারা তাই সবুজ বলে যান। আসলে সবুজতো এই দেশ। ঘাস, গাছ, ফুল, লতা পাতা গুল্ম দিয়ে কি বাড়ি, কি রাস্তা, কি শপিং মল সব যেনো একদম সাজানো। এর মাঝ দিয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে একা একা হেটে যেতে তার খুবই ভালো লাগে। আর এখন এখানে রাত এগারোটা অব্ধি আলো থাকে। অফিসের পর লেকের পাশে পার্কে প্রচুর লোক লেকে ছিপ ফেলে বই নিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে সেটাও দেখতে ভালো। মাথায় টুপি, পাশে মৃদ্যু লয়ে গান বাজছে, কুকুরটা শান্ত হয়ে মনিবের কাছে বসে আছে আর তারা ছিপ ফেলে নিবিষ্ট মনে বসে আছেন। মজার ব্যাপার হলো এতো ঘন্টা অপেক্ষা করে যে মাছটি তারা তুলেন পানি থেকে, তাকে দেখে, তেমন বড় হলে অন্যদেরকে দেখিয়ে ছবি তুলে আবার পানিতে ছেড়ে দেন। যদিও মাছ ধরার জন্য পয়সা দিয়ে তারা লাইসেন্স নেন কিন্তু কে খাবে এতো বড় মাছ, কি করবেন, তাই প্রান নষ্ট না করে পানির মাছকে আবার পানিতেই ফিরিয়ে দেন। বসন্ত আসার পর এদেশটাকে ঠিক তার আর ততোটা অসহ্য লাগছিলো না।

অফিসের পরে অর্ণ সপ্তায় দুদিন ডাচ ক্লাশ করে যখন রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে তখন সে প্রায় বিধ্বস্ত। কিন্তু অহনার একা ঘুরে বেড়ানোর সমস্যা অন্য জায়গায়। মোটামুটি আধুনিক এই ফ্ল্যাটের দরজায় ডাবল লক দেয়া। এক লকের চাবি মিলে দ্বিতীয় লকে যাবে তবে দরজা খুলবে। চাবির খাঁজগুলো সেভাবেই কাটা। যেটা প্রায়ই তারজন্যে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এতো ওজনের চাবি ধরে প্রথম তালা খুলে তারপর দ্বিতীয় তালা পর্যন্ত যাওয়া অহনার অনেক সময়ই সম্ভব হতো না। চাবি লকের ভিতরে ঢুকিয়ে নাড়ানাড়িই সার হতো তার। এই শীতের মধ্যেও সে ঘেমে ওঠে। অপেক্ষায় থাকতো কেউ যদি কোন কারনে সিড়ি দিয়ে ওঠে নামে, তাকে বিপদগ্রস্থ দেখে সাহায্য করে। অহনাদের পাশের ফ্ল্যাটে সেসময় একজন ডাক্তার থাকতেন, যিনি অনেক সময়ই রাতের ডিউটি শেষ করে দিনে বাসায় ঘুমাতেন, তিনিই ছিলেন শেষ ভরসা যার ঘুম নষ্ট করিয়ে দিয়ে অহনা বাড়িতে ঢুকতে পারতো। প্রথম যেদিন এই ঘটনা ঘটলো অহনা অর্নকে বলতে গেলো তার এই দুর্ভোগের কথা। অর্ন তার কথা শুনে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখানোতো দূরে থাক আরো চোখ কপালে তুলে এমন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো যে সে অন্য কোন গ্রহ থেকে এইমাত্র নেমে এসেছে। খরখরে গলায় বললো অহনাকে, ইউনিভার্সিটি পড়া মেয়ে তুমি একটা লক খুলে ভিতরে ঢুকতে পারো না, এ গল্প করতে তোমার লজ্জা করছে না। অহনার খুবই লজ্জা করতো সেটাও যেমন সত্যি আবার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে পারত না সেটাও ছিল সমান সত্যি। আর এ সমস্ত ব্যাপার অর্নকে বলতে গেলে অর্ন চরম বিরক্ত হতো সেটা তার চেয়ে বড় সত্যি। কাউকে বেল করে, তার সাহায্য নিয়ে দরজা খোলা স্বামীর চরম অপছন্দ জানা সত্বেও কখনো কখনো অনন্যেপায় হয়ে অহনা পাশের ফ্ল্যাটেই বেল টিপতো। তিন চার মাস চাবি নিয়ে ধস্তাধস্তির পর এক সময় অহনা নিজেই ডবল লক খোলা ম্যানেজ করতে শিখল।

কনকনে শীত কেটে উত্তর সমুদ্রের কাছে অবস্থিত এই টিউলিপ ভূমি এখন সূর্যের রঙ মেখে উত্তাল। এতোদিন বাসায় বসে বসে অনবরত টিভি দেখে দেখে আর গল্পের বই পড়ে ক্লান্ত অহনা। ইউনিভার্সিটি নেই, পড়াশোনা নেই এমন জীবনে কোনদিন অভ্যস্তই ছিল না সে। অর্ন ব্যস্ত তার অফিস নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে, অহনার কি শুধু আকাশ দেখে দেখে সময় যেতে চায়? অপেক্ষা করে থাকতে হয় কখন শনিবার রবিবার আসবে, অর্নের সাথে একটু কোথাও বাইরে যাওয়ার কিংবা গল্প করার সুযোগ পাবে। কিন্তু দেখা যায় তাও সব সময় হতো না, সারা সপ্তাহ অফিস করে ক্লান্ত অর্ন হয়তো তখন একটু বিশ্রামের জন্য আকুপাকু করছে। সারাক্ষন বাসায় থেকে খেয়ে তাজা সে আর কর্মক্লান্ত অর্ন এ হলো সংসার স্ট্যাটাস। যদিও ডাচ ভাষা শেখার ক্লাশ জয়েন করতে পেরে সে মোটামুটি বেশ আনন্দিত, এতোদিন যেনো কোন এক বিচ্ছিন দ্বীপে ছিল, লোকালয়ের সংস্পর্শে আসাতে সে অভাব পূরন হলো। ভাষা শিক্ষার কোর্স মেটেরিয়ালও বেশ ভালো ছিল, নবাগত লোকজনদেরকে নেদারল্যান্ডসের কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে সাথে রোজকার জীবনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এর মাধ্যমে। ক্লাশের অন্যদের সাথে বেশ দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেলো, নেদারল্যান্ডসের সংস্কৃতি আলোচনার পাশাপাশি অন্যদেশীয় সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা হতো।

বই পড়া কেতাবী জ্ঞানের থেকে চাক্ষুস জ্ঞান অর্জন অনেক আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, হয়তো কোনদিনের পড়ার বিষয় ছিল, খাদ্যাভাস। সেখানে নেদারল্যান্ডসের লোকেরা সাধারনত কোন বেলায় কি ধরনের খাবার খায় সে আলোচনার পাশাপাশি, অন্য দেশের লোকেরা সকালে, বিকেলে, রাতে কখন কি খায় সে আলোচনা হতো কিংবা সে দেশের প্রধান খাবার কী এবং কেনো ইত্যাদি। এভাবে ডাচ কালচারের পাশে পাশে রাশান, ইরাকী, তুর্কী, সোমালিয়া সব দেশ সম্পর্কেই কম বেশি জানা হতো। অহনা বাংলাদেশের খাদ্যভাসের কথা বলতেই টীচার টাশকিত। কি করে কোন দেশের লোক প্রত্যেক বেলায় গরম খাবার খেতে পারে, তাও এমন একটি বিশ্বনন্দিত গরীব দেশ। আমাদের দেশে সকালে রুটি - ভাজি কিংবা পরটা - মাংস নাশতা, কিন্তু পশ্চিমে সেটা রাতের খাবার। এর একটা বাস্তব দিকও আছে ভরপেট এতো খেলে শরীরে আলস্য যেমন আসে তেমনি প্রতিবেলায় এধরনের খাবার তৈরী করার সময়ও এদেশের লোকের হাতে থাকে না।

শুধু ডাচ কথা নয়, ডাচ জীবনে মানিয়ে নেয়ার জন্য অহনা সাধারণ ডাচ লোকদের মতো সাইকেল চালানোও শিখতে লাগল। কাওকে যদি বলা হয় পাঁচটি শব্দের দ্বারা নেদারল্যান্ডসকে বর্ননা করো তাহলে সে হবে, সাইকেল, উইন্ডমিল, দুধ -চীজ, খাল - বিল আর টিউলিপ। এদেশের লোকের সংখ্যা পনর মিলিয়ন কিন্তু কথিত আছে পনর মিলিয়ন লোকের জন্য আঠারো মিলিয়ন সাইকেল আছে। প্রতিটি বাড়িতেই প্রতিটি লোকের সাইকেল আছে, সে চালাক বা না চালাক। যদিও এরা প্রত্যেকেই সাইকেল চালায়। সাইকেল যেহেতু তাদের প্রধান বাহন তাই প্রতি বাড়িতেই দু একটা রিজার্ভ সাইকেল থাকে বিপদের সময়ের জন্যে। পরিবেশের জন্য মানুষের ভালোবাসা কি অকৃত্রিম হতে পারে তা এ জাতির থেকে শিক্ষনীয়। বাড়ির দরজায় গাড়ি লক করে রেখে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুন্দর পরিবেশ উপহার দেয়ার জন্যে সাইকেল চালিয়ে সাধারনত দৈনন্দিন কাজ সারে। সাথে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ব্যায়ামটাও হয়ে যায়। ডাচ শেখা আরামের ছিল কারণ তারা দুজনেই ডাচ বলতে পারত না তাই ভাষার ব্যাপারে দুজন দুজনার ওপর নির্ভরশীল কিন্তু সাইকেল শেখা নিয়ে অর্ন অহনার উপর চড়াও হয়ে পড়ত। এভাবে কেনো সাইকেল কাঁপছে, কেনো পড়ে পড়ে যাচ্ছো, সাইকেল চালানো কি এতো কঠিন যে এতো সময় লাগবে, দু ঘন্টায় লোকে সাইকেল চালানো শিখে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে অহনা দেখল অর্ন পাশে থাকলেই সাইকেল নিয়ে অহনা পড়ে যায়, নইলে একা একা সে বেশ ভালোই ম্যানেজ করতে পারে।

তানবীরা
০৬.০৬.১০
(চলবে)

No comments:

Post a Comment