Sunday 27 June 2010

অহনার অজানা যাত্রা (সাত)

অহনা হল্যান্ডে আসার পর এক তরফাভাবে সবাই তার দোষ-গুন, জ্ঞান - বুদ্ধি আবিস্কার করে যাচ্ছিলো। নতুন পরিবেশের ধাক্কা সামলে একটু অভ্যস্ত হয়ে এখন সেও অন্যদের জ্ঞান বিজ্ঞান আবিস্কারে মনোনিবেশ করলো। প্রথম ছমাসের মধ্যে তার আবিস্কারের অর্জন হলো ডাচ লাইফ সমন্ধে অর্নের জ্ঞান। দেখা গেলো অর্নের সব জ্ঞানের ভান্ডার হলো তাদের অফিস সেক্রেটারী। শপিং, বেড়াতে যাওয়া, বাইরে কোথাও ডিনার করতে যাওয়া অথবা অফিসিয়াল কোন ব্যাপার মোটকথা নেদারল্যান্ডসের যেকোন সমস্যার সমাধান আসে সেখান থেকে। অর্ন নিজে এসব ব্যাপারে খুব একটা কিছু জানে না, অবশ্য তার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো অর্নের আগ্রহ একেবারেই নেই এসব ব্যাপারে। সে আছে তার অফিস, পড়াশোনা, কম্পিউটার, ছুটির দিনে সকালে দেরী করে ওঠা, ব্রেকফাষ্ট আর হয় না তখন হয় ব্রাঞ্চ, ব্রাঞ্চ খেয়ে আবার ঘুম, সন্ধ্যেয় ঘুম থেকে ওঠে টিভিতে ডিসকোভারী, ন্যাশনাল জিওগ্রাফ্রী চ্যানেল কিংবা সিএনএন দেখে আবার ঘুমানো এই তালে।

এদিকে এতোদিন হয়ে গেলো বিদেশ এলো একদিনও হিন্দী সিনেমার ষ্টাইলে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হলো না, ছবি তুলে দেশে পাঠানো হলো না অহনারতো প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা । অর্ন একদিন অহনার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে ঠিক বাঙ্গালীদের মতো লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক স্টাইলে তাকে নিয়ে আমষ্টার্ডাম, রোটারডাম আর ডেনহাগ ঘুরে এলো। অহনাতো চারপাশ দেখে মুগ্ধ, যা দেখে তারই ছবি তুলে। বুঝুক না বুঝুক ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। এই ক্লিক ক্লিক ক্লিক বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিলো। বেচারা অর্ন বউকে ভদ্রতায় কিছু বলতে পারে না যে এতো ক্লিক ক্লিকের দরকার আসলে নেই, বছর না ঘুরতে ঘুরতেই আজকের চমক ধমক অনেক সাধারণ হয়ে আসবে। অবশ্য সংসারের বহু কিছুতেই অহনার হুশ নেই। এটুকু অর্ন বুঝতো মাত্র বাড়ি ছেড়ে এসেছে সে, তার ধারনা নেই কিভাবে কি চলে। সেদিন শুধু আস্তে করে বললো, ছবি প্রিন্ট করতে আসলে অনেক টাকা যায়, বেছে বেছে তোল। এতেই অহনার মুখ লাল হয়ে গেলো। ক্যামেরা রেখে দিলো পাশে। যদিও অর্ন বহুভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো এরপর যে ও শুধু এটুকুই বলেছে, একটু বেছে বেছে তুলতে আর কিছু না, কিন্তু অহনা আর ক্যামেরা হাতে নিলো না।

সংসারের আয় ব্যয়, বাড়িভাড়া, গাড়ির খরচ কিংবা হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোন কিছু সমন্ধে যে অহনার কোন ধারনাই নেই তিন মাসের মাথায় সেটা অর্নের কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো। অহনা আসা মাত্র তাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে একটি ব্যাঙ্ক পাশ বানিয়ে দিয়ে অর্ন এটিমে টাকা তোলা শিখিয়ে দিয়েছিলো বটে। আর ভালোবেসে বলেছিল যখন যা দরকার হবে ইচ্ছেমতো খরচ করো। প্রথমে প্রথমে অর্নের সাথেই কেনাকাটা করতো কিন্তু পরে নিজের ইচ্ছেমতোও কিনতে লাগলো। শুধু কোন ধারনা নেই কতো খরচ করছে। আর কোন কারেন্সী খরচ করছে। টাকা ভেবে যেটা খরচ করছে সেটা আসলে টাকা নয়, ইউরো। অর্ন ভদ্রতায় কিছু বলতে পারছে না বটে কিন্তু তার জমানো টাকার ভান্ডার প্রায় শূন্য। বহুভাবে অর্ন তাকে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করছিলো। চলো একটা বাজেট বানাই। কতোটাকা তুমি এমনি শপিং করবে এটার একটা আইডিয়া রাখো মাথায়। কিন্তু যাহা আয় তাহাই ব্যায় মার্কা ব্যাবসায়ী পরিবারে বড় হওয়া অহনা বাজেট মার্কা কথা বইয়ে পড়েছে বটে কিন্তু নিজের জীবনে কোথাও তার প্রয়োগ দেখেওনি শোনেওনি। সে এককানে স্বামীর বোরিং লেকচার শোনে অন্যকানে ভুলেও যায় সাথে সাথেই।

কারেন্সীর পার্থক্য বোঝার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ধরনের ভুল বোঝাবোঝি মনে পুষে রাখতো অহনা। অর্ন ভদ্র সে বউকে দুঃখ দিতেও পারে না, মুখে বলতেও পারে না কিন্তু কি করে ম্যানেজ করবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না। অহনাকে একদিন অর্ন বললো চলো তোমাকে আমি একটা গিফট কিনে দেই। অহনা সারা মল খুঁজে একটা কার্ডিগান পছন্দ করলো, আড়াইশ ইউরো দাম। লজ্জার মাথা খেয়ে অর্নকে বলতে হলো, এখন এতো টাকা নেই, এখন একটা একটু সস্তায় পছন্দ করো, পরের মাসে বেতন পেয়ে তোমাকে এটা কিনে দিবো। তার সেটা খুবই প্রেষ্টিজে লেগে গেলো। বাবা তার একি সর্বনাশ করলেন। আড়াইশ টাকার কাপড় সে জীবনে হাত নিয়ে নেড়ে দেখেছে ঢাকা থাকতে? আর আজকে তাকে শুনতে হচ্ছে স্বামী আড়াইশ টাকার থেকেও সস্তা কাপড় পছন্দ করতে বলছে। এটা অনেক দাম! অহনা অনেক গম্ভীর হয়ে বললো, থাক পরেই কিনবো, এখন আর লাগবে না। অর্ন অনেক বুঝিয়ে অন্য একটা কাপড় কিনে দিলো তাকে। প্রমিস করলো যে সামনে মাসে অবশ্যই সেটা অহনাকে কিনে দিবে। পরদিন অর্ন অফিসে যাওয়া মাত্র বাবাকে ফোন করে তার ঝাড়ি। এরকম একটা কিপ্টে ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিলে, আড়াইশ টাকা যার কাছে এতো দাম লাগে? বাবা এতো দূর থেকে অহনাকে কারেন্সী নিয়ে লেকচার দিতে পারেন না। তিনি যা পারেন তাই বললেন, তোর কি কি লাগবে আমায় চিঠিতে লিখে দিস, আমি পোষ্টে পাঠিয়ে দিবো। এসব নিয়ে তুই অর্নের সাথে ঝগড়া করিস না। তাতে সে আরো রেগে গেলো, সে ঝগড়া করার মতো মেয়ে? ঠাস ফোন নীচে।

তবে বিদেশে ভালো ভালো অনেক ব্যাপারও আছে অহনা সেটাও স্বীকাত করে। এক সময় যে ক্যাডবেরীর জন্য অহনা অস্থির থাকতো সেই ক্যাডবেরীর ডাব্বা এখন হাতের মুঠোয়। একান্নবর্তী পরিবারে যদি একদিন ৫০০ টাকার ক্যাডবেরী কেনা হতো দেখা গেলো ছোট ভাইবোন বাবা চাচা দাদী আত্মীয় আশ্রিত সব ঘুরে মাত্র এক বা দুখানা ক্যাডবেরী হাতে এসেছে যা মুখে দিয়ে স্বাদ বোঝার আগেই শেষ। আর এখন অফুরন্ত ভান্ডার। কিংবা বারো টাকায় একটা মিনি সাইজের চিপসের প্যাকেট কিনেছে মাত্র বসেছে সেটা নিয়ে এসে দাড়ালো ছোট চাচাতো ভাইটা, বড় বড় মায়াবী চোখ তুলে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিপসের অনেকটাই হয়তো তাকে দিয়ে দিলো আর সেই চিপসের জাম্বো প্যাকেট এখন অহনার হাতে, আবদার করে, অহনা বাজি আর একটা, আর একটা করার এখন আর কেউ কাছে নেই। একটা চিপসের লোভ
দিয়ে ছোট ভাইদেরকে দিয়ে কতো ছড়া বলানো, অন্যদেরকে খেপানো কতো কি করাতো তখন অহনা। এখন এতো আছে কিন্তু সেই ক্যাডবেরী বা চিপসের সেই স্বাদ যেনো আর নেই। মনে হয় বড় ভাই বোনদের চড় চাপড় খাওয়া, সেই কাড়াকাড়ি করে খাওয়া দিন গুলোই যেনো ভালো ছিলো।

আগে ডিম ভাজা খেতে এতো ভালোবাসতো, মা কতো বকতেন এই ডিম খাওয়া নিয়ে, অহনা তখন ভাবতো দাড়াও যাচ্ছিতো হল্যান্ড, রোজ দিন তিন বেলা ডিম ভেজে ভেজে খাবো, কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। অথচ একদিনও এখন ইচ্ছে করে না ডিম ভেজে খেতে কি অদ্ভুদ মানুষের মন। এক সময় যে সমস্ত জিনিসের জন্য পাগল ছিল এখন সে সব কিছুর প্রতি আর কোন আগ্রহ জাগে না। যে স্বাধীনতার জন্য আগে তীব্র লালসা ছিল, সেই স্বাধীনতা পাওয়া হয়ে যাওয়া মাত্র স্বাধীনতার প্রতি সমগ্র আগ্রহ হারিয়ে গেলো। যতো রাত ইচ্ছে টিভি দেখো, কম্পিউটারে গেম খেলো কিংবা গল্পের বই পড়ো ডাক দেয়ার কেউ নেই। কারো পায়ের শব্দে এক মূহুর্তের মধ্যে সব লুকিয়ে ঘুমানোর ভান করার কিছু নেই তাই এখন আর রাত জাগার কোন আগ্রহও নেই। এগারোটা বাজলেই লেপ টেনে শুয়ে পরা। এখন থেকে থেকে মনে হয় আহা সে পরাধীন জীবনটা কতো মিষ্টি ছিল।

সামার শুরু হয়ে যাওয়ার পর ডাচ ক্লাশের ছুটি। আজকাল পড়াটরা নেই অহনা প্রায়ই তাই তার বাইক নিয়ে সিটি সেন্টারে চলে যায় আর অকারনেই দোকানে দোকানে ঘুরে উইন্ডো শপিং করে। ইউন্ডো শপিং করতে করতে বহু কিছু আবিস্কার করা শুরু করলো। প্রথম আবিস্কার করলো এক ঘন্টার ডেলিভারীর যে দোকানে থেকে তারা ছবি প্রিন্ট করায় সেটা থেকে ছবি প্রিন্ট করলে অনেক দাম নেয় বটে কিন্তু অনেক দোকানে আছে সুপারমার্কেটে যেখানে তিনদিন পর ছবি ডেলিভারী নিলে খুবই সস্তায় ছবি প্রিন্ট করানো যায়। এ আবিস্কারের আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে সে বাসায় এলো। দ্বিতীয় আবিস্কার ছিলো ফ্ল্যাটের কাছের যে সুপারমার্কেটে তারা রোজকার গ্রোসারী করে সেটা বেশ দাম, একটু দূরে গেলেই এর অর্ধকে দামে অন্য সুপার মার্কেটে তাদের গ্রোসারী হয়। তৃতীয় আবিস্কার ছিল যে ফ্ল্যাটে তারা থাকে সেটি প্রাইভেট এজেন্সী থেকে ভাড়া নেয়া, সরকারী অফিস থেকে বাড়িভাড়া করলে এর অর্ধেক দামে ফ্ল্যাটের বদলে আস্ত বাগানসহ বাড়ি পাওয়া যাবে।

মাত্র ছ’মাসের মধ্যে অর্নের অনেক আবিস্কারকে ভুল প্রমানিত করে অহনা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠল। অর্ন থাকতো অফিসে কিন্তু অহনা রাস্তায় থেকে থেকে ডাচ জীবন আবিস্কারের নেশায় মস্ত হয়ে গেলো। এর থেকে এই ইনফর্মেশন যোগাড় করাতো তার কাছ থেকে সেটা। এক অফিসে কোন দরকারে গেলে অন্য দশদিকের দিক নির্দেশনা তারা দিয়ে দেয়। নতুন অভিবাসীদের সাহায্য করার মানসিকতাও তখনও তাদের মধ্যে ছিল। সরকারী অফিসে বাড়িভাড়ার বিরাট কিউ থাকে। সাধারনভাবে তিন বছর লাগে একজনের বাড়ি পেতে। অহনা অফিসে গেলো, ফর্ম তুললো এবং ডাচ ডিকশনারী হাতে করে ফর্ম ফিলাপ করতে বসে গেলো একা একাই। অর্ন আনন্দ পাচ্ছে, অহনার ব্যস্ততা দেখে। সে এসবে নাক গলালো না, যা ইচ্ছে করুক প্লাস কিছু পয়সা বেঁচে গেলে কার না ভালো লাগে। মাঝে মাঝে নিজের গোঁফে তেল দিয়ে অহনা বসে পড়তো অর্নের কাছে, বাড়িভাড়ার অর্ধকে টাকা বেঁচে গেলে ওরা প্রথমে কি প্যারিস যাবে না রোম না লন্ডন সেই আলোচনা করতে।

(চলবে)
তানবীরা
২৭.০৬.১০




No comments:

Post a Comment