Monday 14 June 2010

অহনার অজানা যাত্রা (ছয়)

এক দেড় সপ্তাহ সাইকেল নিয়ে কোস্তাকুস্তি ধস্তাধ্বস্তি, সাইকেল থেকে পরে হাত পা থ্যাতলানো শেষ করে অহনা সাইকেল মোটামুটি আয়ত্ব করে ফেললো। সাইকেল শিখে ফেলা তাকে এক ধরনের স্বাধীনতা এনে দিলো। বৃষ্টি না থাকলে ঝকঝকে রোদে সে প্রায়ই তার পছন্দমতো ড্রেসআপ করে সানগ্লাস চোখে কখনো কখনো মাথায় ম্যাচিং কিংবা স্পোর্টস টুপি পরে তার সেকেন্ডহ্যান্ড পঙ্খীরাজ নিয়ে এদিকে সেদিকে মনের আনন্দে ঘুরতে লাগলো। সাইকেল হল্যান্ডের প্রধান বাহন। পুরো হল্যান্ডে সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা রাস্তা আছে, লাল রঙের কার্পেটিং করা। যেগুলো রিঙ রোড (শহরের প্রধান সড়ক) সেখানে সাইকেল চালকদের জন্য রোডের সাইড থেকে সাইকেল চিহ্ন দিয়ে রাস্তা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। অনেক বেপোরোয়া না হলে এক্সিডেন্ট হওয়ার সুযোগ খুব কম। আর এক্সিডেন্ট হলেও একশত বারের মধ্যে নিরানব্বই বার সময় দোষী হন গাড়ি চালক। নেদারল্যান্ডসের গঠনই দুর্বলকে রক্ষা করা তাই যে পরিস্থিতিই হোক না কেনো, গাড়িওয়ালা কেনো সাইকেলওয়ালাকে ধাক্কা দিলো সেটাই হলো দোষ। সাইকেলওয়ালারা এই সুযোগটার পূর্ন সদ্বব্যবহার করেন, লাল লাইট মানেন না, তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া লাইন মানেন না ফুস করে গাড়ির সামনে দিয়ে বের হয়ে যান আর গাড়ি চালকরা তাদেরকে বকতে বকতে গাড়ি চালান। ধাক্কা লেগে গেলে ইন্স্যুরেন্সের পয়সা ভরতে ভরতে গাড়িওয়ালার সারা জীবন কয়লা হয়ে যাবে, তাই তারাও গাড়ি চালানোর অপরাধে অন্যনোপায় হয়ে থাকেন।

অহনাকে এতোদিন সবাই দেখেছে সোশ্যাল গেটটুগেদারে, শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরা অর্নের সাথে, তার বউ হিসেবে। এই পশ্চিমা কাপড় পরা, সাইকেল নিয়ে টো টো করা অহনা তাদের অজানা ছিলো। শহরে থাকা পুরনো বাঙ্গালী বাসিন্দারা যারা মসজিদের মাহফিল, বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনা নেয়া, ডাক্তার আর সুপার মার্কেটের বাইরে মেয়েদের কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে তা জানতেন না। তাও আবার স্কার্ট টপস কিংবা জীন্স টিশার্ট পরে তারা প্রথমে রাগে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। হারাম হালালের বালাই নেই, ম্যাক থেকে বার্গার কিনে খায়। বাংলাদেশের আবার মুসলমানের মেয়ে সাইকেল নিয়ে ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেশের মানসম্মান সব ধূলোয় মিটিয়ে দিচ্ছে, একি করে সহ্য করা যায়? বাংলাদেশের কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে অহনা হুমকির মুখে ফেলে দিলো। ঈমান ধর্মতো আর রক্ষা করা যায় না। প্রথমে তারা কায়দা করে নানা ইশারা ইঙ্গিতে অহনার চালচলন ইসলামিক করার চেষ্টা করলেন তারপর বাগে আনতে না পেরে তাদের বউদেরকে অহনার সাথে মিশতে বারন করে দিলেন। মজার ব্যাপার বার্গার অর্নও খায় কিন্তু সেটা দোষের না। অহনা সবার কাছে ডবল দোষে দোষী হলো, কারন সে স্বামীকে সুপথে ফিরিয়ে আনার বদলে নিজেই কুপথে ঝাপ দিলো।

অহনা সদ্য দেশ থেকে আসা, ধরতে গেলে তাদের বাচ্চা কাচ্চার সমবয়সী। মোটামুটি হাসি খুশী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, মুরুব্বীদের যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা করেই কথা বলে সে। মহিলা কিংবা পুরুষ কারোই অহনা সর্ম্পকে অন্য কোন বিরক্তি ছিলো না শুধু এই পোষাক আশাক আর ঘোরাঘুরি আর হালাল খাবার ছাড়া। তবুও অনেক আন্টিই তাদের বরকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে সাঝে অহনার খোঁজ খবর নিতেন। রান্না করা খাবার দাবার পাঠাতেন। শুধু বাসায় এসো এটাই বলতে চাইতেন না। এই সীমিত যোগাযোগ অহনার জীবনে সাপে বর হয়ে দেখা দিলো। কারো বাসায় যেমন যাওয়ার নেই কাউকে বাসায় ডাকারও নেই। অহনার হাতে অফুরন্ত সময়। ডাচ টিভি, তুর্কী টিভি, জার্মান বিবিসি কোনটাই আর্কষনীয় লাগে না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফী, ডিসকোভারী কিংবা এমটিভি দেখে আর কতোক্ষন কাটানো যায়? এতো সাধের এমটিভি বিদেশে এসে পানসে মেরে গেলো। সে তার ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাশের বই উলটে পালটে চাল্টে পড়তে লাগলো। পড়াশোনা করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার নেই সারাদিন কিংবা সন্ধ্যা রাত ভর। অর্নের অফিস আছে তার সময় কম কিন্তু অহনার সময়ই সময়।

ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাশের প্রথম পরীক্ষার পর অহনাকে মোটামুটি গ্রুপ থেকে বেষ্ট গ্রুপে তুলে দেয়া হলো। সে সময় নেদারল্যান্ডসে যাদের রেজাল্ট বেশ ভালো ছিলো তাদের নাম স্কুল থেকে ক্যারিয়ার গ্রুপের কাছে রিকোমেন্ড করা হতো। ক্যারিয়ার গ্রুপ তাদের সাথে যোগাযোগ করতো, তাদের আগ্রহ থাকলে তাদের ইন্টারভিউ নিয়ে জানতে চাইতো ভবিষ্যতে সে কি করতে চায়? বিনা পয়সায় তাদেরকে পড়াশোনা করার সুযোগ এবং চাকরী খুঁজে দিতো। এই সুযোগটা এখনো আছে তবে অন্য ফর্মে। সেই সময় মাঝ পথে কেউ পড়া থামালে কোন জরিমানা হতো না, আজকাল জরিমানা করা হয়। অনেকেই এসুযোগ হেলাফেলায় নষ্ট করেছেন বলে আজকাল ক্যারিয়ার গ্রুপ এবং সরকার দু’পক্ষই বন্ড সই করান যে গর্ভ ধারন করলেও কোর্স শেষ করতে হবে অন্যথায় জরিমানা সহ পয়সা ফেরত দিতে হবে। সেই থেকে অহনার বিনা পয়সায় পড়ার রাস্তা খুলে গেলো। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

পড়াশোনা নিয়ে তুমুল ব্যস্ততা থাকলেও মাঝে মাঝে একা লাগতো অহনার। চরম আড্ডাবাজ স্বভাবের মেয়ে সে, যৌথ পরিবারে বড় আর এই বিভূইয়ে একদম একা। এর চেয়ে কঠিন শাস্তি তার জন্যে আর কি হতে পারে? দোষ অহনারও অনেক। সে কারো সাথে ঠিক বন্ধুত্ব করে ওঠতে পারছিলো না। দ্রুত রেগে যায় যদিও পরক্ষনে রাগ সে ভুলে যায় কিন্তু পরের সাথেতো ঘরের ব্যাপার আর চলে না। আর এই বিদেশে থাকা মহিলারাও জানি কেমন। অনেকেই ফ্রী হওয়া সত্বেও সাধারন ভাষাটুকু পর্যন্ত শিখেননি। অজুহাত দেন বাচ্চা কাচ্চা দেখে সময় করে ওঠতে পারেননি, সংসারের ঝামেলায় পারেননি ইত্যাদি। মেয়েরা পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্বেও বিজনেক এ্যাডমিনিশট্রেশন কিংবা ডাক্তারী পড়তে মেয়েকে বাইরে পাঠাবেন না। শহরে যে ইউনিভার্সিটি আছে তাতে যে সাবজেক্ট সেটাতেই পড়তে হবে, যোগ্যতা আর সাবজেক্ট থাকা সত্বেও বাইরের শহরে মেয়েদেরকে পড়তে পাঠাবেন না, ছেলেরা হলে ঠিকাছে। ঠিক করে বাংলা বুঝতে পারে না এমন মেয়েদেরকে আঠারোর কাছে পিঠে দেশে নিয়ে ভাশুরের ছেলে কিংবা ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আনবেন। মেয়েকে কোন বিদেশী ছেলের সাথে কোন ধরনের অঘটন ঘটানোর সুযোগ দিবেন না। বিয়ের ব্যাপারে অবশ্য ছেলেদের বেলায়ও তারা সজাগ কিন্তু তাদের ব্যাপারে মনোভাব নমনীয়। অহনা বাংলাদেশে বাংগালী মেয়েদের যে দূরবস্থা চিন্তা করতে পারে না সেটা এখানে হরদম ঘটছে।

এধরনের আন্টি কিংবা ভাবীদের সাথে কথা বলতে গেলে অহনার মধ্যে এক ধরনের কমপ্লেক্স শুরু হয়ে যায়। তাদের জীবন ঘোরে অন্যের চাকায়। মাইনাস শীতের মধ্যে উলেন বা নিদেন পক্ষে জীন্স না পরে তারা সালোয়ার কামিজ পরে বাইরে চলাফেরা করেন। কারন তাদের বরেরা পছন্দ করে না, তাই ইসলামী লেবাস করতে হবে। ঐদিকে বরেরা কিন্তু দিব্ব্যি কাফেরী লেবাস মানে উলেন প্যান্ট, গলা বন্ধ সোয়েটার পরে চলাফেরা করছেন। রান্না করেন তাদের বর যা পছন্দ করেন, টিভি দেখেন বরের যে প্রোগ্রাম পছন্দ সেটা। সবকিছুই কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বলার সময় তারা এভাবেই বলেন যেনো অহনার গায়ে সেটা একটু হলেও লাগে। অহনা কি তাহলে খারাপ বউ? তার যা খেতে ইচ্ছে করে সে অর্নের পছন্দের সাথে সেটাও রান্না করে। তার যা পরতে ইচ্ছে করে কিনে পরে। অর্নের মতামত অবশ্যই সে নেয় কিন্তু অনুমতি নেয়া নয় সেটা মোটেই। সে সব ব্যাপারেই তার বরের সাথে আলোচনা করে, যেকোন জিনিসের পজিটিভ এবং নেগেটিভ দিক নিয়ে আলোচনা হয়, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু অর্ন কোন কিছুই তার ওপর চাপায় না। তার মধ্যে সংসার সম্বন্ধে অপরিপক্কতা আছে জানা সত্বেও অর্ন তার মতামতকেই প্রাধান্য দেয়, তার পছন্দকেই গুরুত্ব দেয়। তার সংসার তার ইচ্ছে মতোই হোক এ ভাবনা অর্নেরও।

একা একা দেশ থেকে দূরে, বহু কারনেই অহনার মন খারাপ থাকতো। কেউ ফোন করে যদি দেখতো অহনার মন খারাপ সমানে প্রশ্ন করতো, ভাই কি কিছু বলছে? তাইলে মন খারাপ কেনো? ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে? এর থেকে বিরক্তিকর আর কিছুই নেই। তার সব মন খারাপ বা ভালোর সাথে অর্নকে জড়িয়ে ফেলার একটা প্রানান্ত চেষ্টা সকলের মধ্যে কাজ করে। যেনো বিয়ে হয়েছে বলে অর্নের সাথে ঝগড়া না হলে অহনার জীবনে মন খারাপের আর কোন কারনই থাকতে পারে না। তাকে পাস করে সবকিছু অর্নকে জড়িয়ে যায়। রাগে একবার ভাবলো এরপর থেকে কেউ যদি বলে গলা এমন কেনো, ও বলবে আমার মাথা খারাপ। মনের সাথে বরকে জড়ানো গেলেও মাথার সাথে আশাকরি কাউকে জড়ানো যাবে না। নিশ্চয় কেউ প্রশ্ন করবে না, মাথায় কি ভাই লাঠির বারি দিলো নাকি? মাঝে মাঝে অহনা অনুভবও করতে পারে, তাদের জীবনের মতো তার জীবনও কেনো বরের মর্জি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, তার একটা পৈশাচিক জিদ কাজ করে অনেকের মধ্যে।

অর্নকে এসব বলতে গেলেই সে হাসে আর বলে ওরা নিজেরা পরাধীন জীবন যাপন করছেন সারা জীবন ধরে, তোমার স্বাধীনতা তারা সহ্য করতে পারছেন না। এসব বাদ দিয়ে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হও। বলে এসব ফোনের পিছনে এতো এনার্জী খরচ না করে কম্পিউটার শিখো, ইংরেজি আরো ভালো করে প্র্যাক্টিশ করো। নিজেকে তৈরী করো ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ভালো কথা কোনদিনই অহনার ভালো লাগে না। সে থাকে তার প্যাচালের ভাবনায়। ও এটা কেনো বললো, সে এটা কেনো করলো। অর্নকে বিরক্ত করতে করতে সে পরে মাকে ফোনে বলা শুরু করলো। আম্মি আমাকে কেনো ও এটা বললো, আমাকে কেনো সে ওটা বললো। আম্মি বিরক্ত হয়ে হয়ে ফোনে বললেন একদিন, খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনাকে রোজ যে পরিমান গালি মানুষ দেয় তাদেরতো তাহলে মিনিটে মিনিটে আত্মহত্যা করতে হতো। তারা কি শোনে? তুই শুনিস কেনো এগুলো?ওরা যেমন নিজের কাজ করে যাচ্ছে, তুইও তোর নিজের কাজ করতে থাক।

(চলবে)
তানবীরা
১৪.০৬.১০


এই পর্বটি ব্লগার শাওন আর মীরকে উৎসর্গ করা হলো। তাদের পুনঃ পুন তাগাদার কারনে ভাত না খেয়ে রান্না না করে আমাকে টাইপ করতে হলো।

.

No comments:

Post a Comment