Wednesday 2 February 2011

বকুলকথা (২)

আস্তে আস্তে বকুল অনুভব করতে লাগলো তার ওপর কাকু-কাকিমার এ নির্ভরতা নিতান্তই স্বার্থ নির্ভর, ভালোবাসা নির্ভর নয়। আগে পাড়ার কেউ যদি বকুলকে ডেকে জিজ্ঞেস করতো, ও বকুল কি খবর তোর? এভাবে বোস বাড়ি পড়ে থাকলেই চলবে? পরের সেবা করেই যাবি? বিয়ে থা, চাকরি কিছুই করবি না? বকুল খুব বিরক্ত হতো। তোদের অতো দরকার কী বাপু, সে হবে যখন সময় হবে। কিন্তু সময়তো বয়ে যাচ্ছে, ষোড়শী বকুল এখন বাইশের তন্বী। কঁচি শরীর এখন অনেক পরিনত। কাকু-কাকিমা তাকে নিয়ে কোন কথা বলছেন না। কাকিমা নিজে যখন কাঁচা হলুদ, মুলতানী মাটি, চন্দন কাঠের গুঁড়োর ফেসপ্যাক বানিয়ে মুখে লাগান তখন যত্ন করে তা বকুলের গায়ে মুখেও লাগিয়ে দেন। পেয়াজের রস, মসুরের ডাল, নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে তার মাথায় লাগিয়ে চুলের যত্ন করা শেখান। তাকে সাথে নিয়ে পরিনীতা দেখতে যান, বইয়ের সাথে সিনেমার চিত্রনাট্যের তুলনামূলক আলোচনাও করেন। কিন্তু এসবের বাইরে তার আর কোন অস্তিত্ব কোথাও নেই। কাকিমার সাথে শাড়ি কিনতে কিংবা ফুঁচকা চটপটি খেতে গেলে কিছু আগ্রহী লোভী চোখ তাকে ঘিরে ঘুরঘুর করে, নতুন হিট ফিল্মের গান গেয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, কারণে অকারণে শিস দেয়, বকুল খুব আশায় থাকে কাকিমার চোখে পড়বে সেসব, কাকিমা নিশ্চয় কিছু বলবেন। এতো দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা কাকিমার নজরে শুধু বকুলই কেনো এড়িয়ে যায় তাই ভেবে সে হয়রান।

বুক ভরা অভিমান নিয়ে একদিন বকুল কাকু-কাকিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাবা মায়ের কাছে চলে গেলো। কাকু-কাকিমা অনেক বাঁধা দিলেন, বোঝালেন তাদের কে দেখবে, তাদের কি হবে, বকুল ছাড়া আর কে আছে তাদের ঘুরে ফিরে সেই কথা। বকুলের কিছু চাই কীনা, তার ভবিষ্যতের কী হবে সেটা কাকু-কাকিমা একবারের জন্যও বলেন না। বাবা মা তার জন্যে বিয়ের চেষ্টা করতে লাগলেন। এদিক সেদিক থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগলো। শুক্রবার শুক্রবার করে ছুটির দিনে, তাদের বস্তির ঘুঁপচি ঘরে তাকে নানা পদের পুরুষ মানুষ দেখতে আসতে লাগলো। সুন্দর করে সেজেগুঁজে তাদের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়ায় সে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যথাসম্ভব নম্র গলায় জবাব দেয়। দাদা বাবা সাধ্য মতো মিষ্টি চা খাইয়ে তাদের আপ্যায়ন করতে লাগলেন। কেউ কোন বাড়ির দারোয়ান, কেউ কোন রেষ্টুরেন্টের বয় কিংবা কেউ বা ফুটপাতের হকার। তাদের সাজ পোষাক, হাবভাব দেখে বকুল ভেতরে ভেতরে সিঁটিয়ে যেতে লাগলো। কোন কোন পাত্র বকুলের সাথে একান্তে কথাও বললো। বকুলের কি পছন্দ, কি চায় সে এধরনের কোন কথা নয়। বিয়ের পর সে কাজ করবে কীনা, সাহেবদের বাড়ি থেকে হঠাৎ চলে এলো কেনো, কোন লটঘটের ব্যাপার আছে কীনা ইত্যাদি জাতীয় প্রশ্ন।

বিয়ে নিয়ে বকুলের দেখা স্বপ্ন ঝনঝন শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ভাঙতে লাগলো। বুকের নিঃশব্দ কান্না রক্ত হয়ে ঝরতে লাগলো যেটা পৃথিবীর কেউ টের পেলো না। সেই ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রক্তের ওপর পা দিয়ে, পণের টাকার পরিমান নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দরাদরি চলতে লাগলো। এতোদিন সাহেবদের বাড়ি থেকে বকুল খালি হাতে ফিরেছে, সেটা পাত্র পক্ষ মানতেই নারাজ। এ কী করে হয়। নিশ্চয়ই সাহেবদের বাড়ি থেকে দেয়া টাকা পয়সা বকুলের বাবা মা রেখে দিতে চাচ্ছেন। বোস বাড়ির পরিবেশের আলোকে বকুলের দেখা চেনা পুরুষদের সাথে এ পুরুষদের কোন মিল ছিলো না। কিন্তু বকুলের নিজেরই বা কী আছে? মা বাড়ির ঝি, তাকে বোসরা তাদের বাড়িতে রেখেছিল মাত্র তার বেশি কিছুতো নয়। দেখতেও তেমন আহামরি নয় আবার বিদ্যের দৌড়ও সেই স্কুল ফাইন্যাল পাশ। সে কতো রকমের কেক বানাতে জানে, কতো সূক্ষ্ণ কুরুশের ঘর তুলতে পারে, সোয়েটার বুনতে পারে, শুনে শুনে সুনীলের কবিতা বলতে পারে কিংবা রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে এসব কথা জানতে এই পরিবেশের কোন লোক আগ্রহী নয়। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিত, সুচিত্রা মিত্র এরা এ পরিবেশে অপরিচিত আর বেমানান। বস্তির ঘরে প্রায়ই দাদা বৌদি, কিংবা বাবা মায়ের সাথে বকুলের ছোট ছোট জিনিস নিয়ে মতান্তর হয়ে যেতো। প্রাথমিক উচ্ছাস কেটে যেতেই দেখা গেলো বকুলকে ফিরে পেয়ে তারাও আনন্দিত নন, ফিরে এসে বকুলও আর সুখী নয়।

রাগ করে চলে এসেছে বটে কিন্তু এখন প্রতি মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে তার পৃথিবী আর এ পৃথিবী পুরোই আলাদা হয়ে গেছে। এ পৃথিবীর সে আর কেউ নয়। জাগতিক আরাম আয়েশ যা রাগের মাথায় তুচ্ছ মনে হয়েছিলো সে সমস্ত যে জীবনে অতি প্রয়োজনীয় বিষয়, তা প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে ধরা পড়তে লাগলো। গা মোছার জন্যে পরিস্কার বাথরুম, চা খাওয়ার জন্যে গ্যাস বার্নার, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার খোলা বারান্দা তাকে প্রতি মুহূর্তে হাতছানি দিতে লাগলো। কিছুদিন পর বকুলের রাগ পড়েছে কীনা দেখতে কাকু-কাকিমা একদিন এলেন তাদের বস্তির ঘরে। রাঙা কাকিমা এসে বকুলকে জড়িয়ে ধরতেই সব অভিমান ভুলে কেঁদে আকুল হলো সে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে অভিমান ভাঙিয়ে তারা বকুলকে সাথে নিয়ে এলেন। এতোদিনে বকুল টের পেয়ে গেছে সে স্বাবলম্বী হলে তাদের ছেড়ে যদি চলে যায় সেজন্য তারা তার কাজ, পড়া কিংবা বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী নন। যা করতে হবে নিজেকেই করতে হবে। ফিরে এসে বকুল এবার কোন একটা কাজের কথা ভাবতে লাগলো। পত্রিকার বিজ্ঞাপণ দেখে দেখে সে ভাবলো পার্লারে কাজ শিখবে। স্কুল ফাইন্যাল পাশ দিয়ে এর চেয়ে ভালো আর কীই বা পাবে সে। তার মতো মেয়েদের বাইরে সব জায়গায় কাজ ততো নিরাপদ কিছু নয় এখনো এদেশে।

পাশের ঘরের হৈ চৈ’তে তার ভাবনার জাল ছিন্ন হলো। কাকুর বাড়ির লোক আর কাকিমার বাড়ির লোকের মাঝে চলছে আলোচনা। দুপক্ষই নিঃসন্তান কাকু-কাকিমার সম্পত্তির হিসাবের চুলচেরা নিয়ে বসেছে। তাদের অবর্তমানে কার কতোটুকু অধিকার, কে কাকু-কাকিমার কতো কাছের, কতো আদরের তার ওপরতো নির্ভর করছে কে কতোটুকু পাবে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় এ ক’বছরে পুড়ে পুড়ে অনেক শক্ত হয়েছে বকুল, না কাঁদবে না কিছুতেই সে। চোখ জ্বালা করে আসলেও সে শক্ত হয়ে থাকবে। চোখের পানিকে সে মনের জ্বলুনিতে বাস্প করে চারধারে উড়িয়ে দিবে। কার জন্যে কাঁদবে বকুল? কার কি হয় সে? সবাই কাকু-কাকিমার অনেক কাছের লোক বটেইতো, শুধু বকুল ছাড়া। এই দূরের বকুল সকালে ঘুম থেকে ওঠে কাকু-কাকিমার নাস্তা বানায়, ওষুধ দেয়, দুপুরে তারা কি খাবেন তা রান্না ঝি’কে বুঝিয়ে দিয়ে পার্লারে যায়। সারাদিন কাজ শেষে ফেরার পথে ঘরের বাজার, ওষুধ আর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে তবে ফিরে। ছুটির দিনে তাদের নিয়ে হাটতে বেরোয়, নাটক দেখতে নিয়ে যায়, কাকিমার অনেক দিনের না দেখা মাসিকে মনে পড়লে তার বাড়ি খুঁজে বের করে সেখানে নিয়ে যায়। অসুখ বিসুখে দৌড়ে ডাক্তার ডেকে আনে। এহেন দূরের বকুলের মনে পাশের ঘরের আপাত রুক্ষ আলোচনা যেমন কোন ছায়া ফেলে না, তেমনি উল্লসিত ধ্বনিও কোন রেখাপাত করে না।

তানবীরা
০১.০২.২০১১

No comments:

Post a Comment