Saturday 5 February 2011

বকুলকথা (শেষ পর্ব)

খোঁজ নিয়ে কাকিমার অনুমতি নিয়ে বকুল পাড়ার কাছাকাছি একটা পার্লারে ঢুকলো কাজ শেখার জন্য। মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে বকুল কাজ শিখতে লাগলো। ভুরু প্লাক দিয়ে শুরু করে খুব দ্রুতই স্কীন কেয়ারে পৌঁছে গেলো সে। কাজের জায়গায় আস্তে আস্তে অনেকের সাথে তার বেশ ভাব হলো। ভাগ্য বিড়ম্বিত অনেকেই আছে এ পৃথিবীতে তাহলে সে শুধু একা নয়। দুর্ভাগিনীরা দায়িত্ব নিয়েছে সুখী মানুষদের সুন্দর করে সাজিয়ে গুজিয়ে তোলার। অন্যদের দুঃখের কথা শুনে, নিজের দুঃখ ভাগ করে এক রকম দিন কেটে যাচ্ছিলো। সেখানে একটা আলাদা পরিবার তৈরী হলো তার। সবচেয়ে বেশি ভাব হলো ঝর্ণাদির সাথে। গোপন থেকে গোপন দুঃখও দুজন দুজনের মধ্যে ভাগ করে নিতে লাগলো। স্বামী সন্তান নিয়ে ঝর্ণাদিকেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় দৈনন্দিন জীবনে। একদিন ঝর্ণাদি বকুলকে বললো, এতো ভালো কাজ শিখে এখানে কেনো পড়ে থাকবি তুই? আমি চলে যাচ্ছি ভালো পার্লারে, তুই যাবি সাথে? অনেক ভেবে বকুলও ঝর্ণাদির সাথে যাবে ঠিক করলো। মোটা বেতনে বকুল শহরের নামকরা পার্লারে এখন কাজ করছে। সকালে পার্লারে কাজে যায় সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে বাড়ির কাজ করে, কাকু-কাকিমার দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে বস্তিতে গিয়ে মা বাবাকে দেখে আসে। তাদের ওষুধ পথ্য, সংসারের কি প্রয়োজন দেখে শুনে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসাধ্য পূরণ করার চেষ্টা করে। বকুলের ভবিষ্যৎ ভেবে মা বাবা দুঃখিত হন, তাদের সাধ্য সীমিত এই বলে বকুলকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন। বকুলের মাঝে মাঝে কেনো জানি বিশ্বাস হতে চায় না। তার মনে হয়, বিয়ে হলে সে যদি পর হয়ে যায়, মা বাবাকে না দেখে, এ ভয়েই কি মা বাবা তার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পিছিয়ে থাকেন। এভাবেই ঘুরছিলো ঘড়ির কাটা, ক্যালেন্ডার তার পাতায় রঙিন ছবির সাথে বছরের সংখ্যা বদলে যাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে মাথার ঘন চুল পাতলা হতে শুরু করেছে, চোখের কোলে ভাঁজ জমতে শুরু করেছে।

রাতে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। দু চোখের পাতা জুড়ে থাকে হতাশা, বিষাদ আর ক্লান্তি। জানালার বাইরের অন্ধকার আর তার দু চোখের অন্ধকার এক সাথে মিশে যায়। বাইরের অন্ধকার ক্ষণস্থায়ী, আহ্নিক গতিতে ভোরের আলো রাতের অন্ধকারকে খেয়ে নিবে কিন্তু তার জীবনের অন্ধকারের কি হবে? আজকাল ঝর্ণাদি বলছেন বাবা মা, কাকু-কাকিমার আশা ছেড়ে দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিতে, ঝর্ণাদি সাহায্য করবেন। সেদিন ষ্টুডিওতে গিয়ে তিন / চার রকমের পোজে ফটো তুলে এসেছে সে, পাত্র পক্ষকে পাঠাবার জন্যে। ভয়ও লাগে, পত্রিকা দেখে একদম অচেনা অজানা লোক আসবেন, তারা মানুষ কেমন হবেন। যদি ঠকে যায়, তাহলে কার দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে সে। তারপরও মরিয়া হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিল পাত্র চাই শিরোনামে। খুব বেশি কিছু নিজের সম্পর্কে বলারতো ছিল না, খুব বেশি সাড়া পড়েওনি। যারাও বা বিজ্ঞাপণ পড়ে এসেছিল তারাও তার আশ্রিত অবস্থা জানার পরে আর তেমন আগ্রহী হননি। বোস বাড়ির আশ্রিতা না হয়ে যদি দত্তক মেয়ে হতো সে তাহলে হয়তো সাধারণ একটা আটপৌড়ে ঘরের, শিক্ষিত মার্জিত একটা ছেলেকে সে স্বামী হিসেবে পেতে পারতো। রাজপুত্র কিংবা ধনী কিংবা বিরাট কোন চাকুরীজীবির আশাতো সে রাখেনি মনে। তাকে শুধু একটু বুঝবে, শিক্ষিত, মার্জিত এইটুকু স্বপ্ন দেখে সে তার কাঙ্খিত স্বামী নিয়ে। দু একজন বয়স্ক বিপত্নীক সামান্য আগ্রহ প্রকাশ করলেও বকুল নিজেই কেনো যেন তার মন থেকে সাড়া পেলো না।

পার্লারের অনেকেই বলে তুই কেনো কারো সাথে ভাব করার চেষ্টা করিস না? কিন্তু ভাবটা কখন করবে বকুল আর কার সাথে? সেতো অফিসে কাজ করে না, কোন ছেলের সাথে যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ কোথায় তার জীবনে? রাস্তায় হাটার মাঝে কতো জনকেইতো দেখে কাকে বলবে এসো ভাব করি? আর বলবেইবা কোন মুখে, আশ্রিতার প্রতি কেবা আগ্রহী হবেন? আর ভাবের কান্ড নিয়ে পাড়া থেকে মাঝে মাঝে যে ধরনের ঘটনা কানে আসে তাতে তার সাহসেও কুলায় না। এগুলো বড়লোকের ছেলে মেয়েকে মানায়, তাদেরকে না। কাকু-কাকিমাকে গোপন করে পাড়া থেকে দু একজন চেষ্টা করেছিল তার বিয়ের জন্য কিন্তু কোন শিক্ষিত ছেলে, সে যতো ছোট চাকরীই করুক, কারো বাড়িতে আশ্রিত থাকে এমন মেয়েকে বিয়ে করলে সমাজে লোকে কি বলবে সে কথা ভেবে বকুলের দিকে মুখ তুলে চাইলো না। আজকাল বকুল ভাবে তাহলে সে কোন শ্রেণীতে রইলো? ভদ্রলোকের সমাজে সে গৃহিত নয়, আর ছোটলোকদের সমাজে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। বোস বাড়িতে এসে আজ সে কূল হারা। কীইবা ক্ষতি হতো যদি সে রাঙা কাকিমার মতো ছোট টিপ না আঁকতে জানতো কপালে কিংবা চিকন পাড়ের ডুরেশাড়ি না পরতো। কপালে আজ থ্যাবড়ানো সিঁদুর নিয়ে কোন সস্তার শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে, কারো আদরে সোহাগে দিনতো কাটিয়ে দিতে পারতো। তার কোল জুড়ে কেউ থাকতো যে হয়তো কারণে অকারণে তাকে মা বলে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতো।

আজ মনে হয় বৃথাই এই রবীন্দ্র সদনে যাওয়া, এই রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া। বৃথা এই রান্নার বই দেখে নানা রকম স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করা। মার্জিত দেখানোর জন্য নিজের প্রতি এতো যত্ন নেয়া। বাবা মাকে দেখতে বস্তিতে যখন যায়, ছোট বেলার খেলার সাথিদের সাথে দেখা হয়ে যায় কখনো সখনো। এক পলক দাঁড়িয়ে কুশল সংবাদ আদান প্রদানের ফাঁকে তৃষিত নয়নে সে তাদের ভিতরটা কেটে কেটে দেখে নিতে চায়। সস্তার শাড়ি, অমার্জিত সাজগোজ, তেল চুপচুপে চুল কিন্তু মুখে অন্যরকম একটা লাবন্য। এর নাম কি সুখ? কোলে ছেলে নিয়ে যখন সংসার সম্বন্ধে হাজারটা অনুযোগ করে, গলার স্বরটা ওদের কেমন যেনো পালটে যায়, এটাই কি আনন্দ? তারা যখন তাকে বলে ঘর বর হয়নি তার, বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে, তার ভিতরটা কাঁপতে থাকে। সে কম্পনে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কাকে বলবে এ কষ্টের কথা। কি হতো বোস বাড়িতে না থেকে যদি দিদিদের মতো মায়ের কাছেই থেকে যেতো। যা জানতো না কোনদিন সেটা হারাতো না। এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, হেমন্ত, মান্নার চেয়ে এই বস্তির আকাশে ভেসে যাওয়া হিন্দী গান প্যায়ার কা তোফা তেরা, পাড়ার ছেলেদের খিস্তি গালি, বারোয়ারী পূজার মন্ডপ এগুলোও একটা জীবন চালিয়ে নিতে কম কিছু না। বড় কিছু পেতে গিয়ে আজ সে নিঃস্ব হয়ে গেলো।

কী কী অন্যায় করেছে এ জীবনে? কী কী খারাপ কাজ করেছে? জ্ঞানত কার কার ক্ষতি করেছে? কার দুঃসময়ে হেসেছে, কার দুর্ভাগ্যে খুশি হয়েছে? ছোটবেলায় কত পাখির সংসার ভেঙে দিয়েছে গাছের ডাল থেকে, সেই কি ঘোর পাপ হল? সিনেমায় দেখা নায়ককে মনে মনে তার নিজের বলে কল্পনা করতো তাতেই কি তার চিত্ত অশুদ্ধ হল? তাই কি বিশেষ কারো ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো? কিন্তু সজ্ঞানে বড় কিছুর প্রতি হাত বাড়িয়েছিল কি? কি পাওয়ার জন্য আজ সব হারালো বকুল? কার কাছে এর প্রতিকার চাইবে? আজকে তার এই নিয়তির জন্য তার কি অপরাধ? কেন পৃথিবী তাকে তার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করলো? দিনটা কাজের মধ্যে কেটে যায়। ভয়াবহ লাগে একলা থাকা রাতগুলোকে। একাকিত্বকে চেনা যায় এই দুঃসহ দীর্ঘ রাতের দিকে তাকিয়ে। তারায় তারায় খুঁজে বেড়ায় সেই মুখ যা শুধু তার একান্তই নিজের। একাকিত্ব ফালা ফালা করে কাঁটে তাকে। দেহের তাপ তবুও সহ্য করে নেয়, মনের চাপ বয়ে বেড়ানোই দায় এখন।

নিজের ভাবনা থেকে হঠাৎ করে বাস্তবে ফিরে এলো। সকালে এসেছিল সবাই কিন্তু প্রায় দুপুর হয়ে এলো। দুপুরে কি সবাই এখানে খাবে? খাবার তাহলে বাইরে থেকে আনতে হবে, এতো লোকের খাওয়ার যোগাড়তো করেনি বকুল। কি আনবে মোগলাই না চায়নীজ? কাকিমাকে ডেকে জেনে নিতে হবে। বকুল সবসময় সব ম্যানেজ করে নেয় তাই হয়তো কাকিমা এসব নিয়ে ভাবছেন না। অভ্যাসবশতঃ নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে চুলে সামান্য চিরুনি বুলালো, শাড়িটা গুছিয়ে আঁচল ঠিকঠাক করল, মুখটায় ভালো করে পাউডার পাফ করে পায়ে পায়ে বসার ঘরের দিকে এগুলো। মনে যতো কষ্টই থাকুক, তার ছায়া মুখে পড়তে দিবে না। কালো মুখে পাউডার ঘষে ঘষে সুখের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসবে। বকুল এখনো খাবার ব্যবস্থা করেনি শুনে কাকিমা অবাক হলেন। বললেন শীগগীর খাবার নিয়ে আসতে। খাবার এনে বকুল টেবিল রেডী করে সবাইকে ডাকতেই হই হই সবাই এলেন খেতে। খাওয়ার টেবিলে বেশ খুঁনসুটি করে আনন্দময় পরিবেশে খাওয়া হলো। বকুলও সবার সাথে হাসি আনন্দে যোগ দিল, হ্যা হ্যা করে হেসে গড়িয়েও পড়ল মজার সব কথায়। বিকেলে সবাই বিদায় নিলেন আলোচনা যা হলো তা উকিল ডেকে শীঘ্রই উইল করে ফেলবেন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে।

ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে থালা বাটি গোছাতে গোছাতে অনেক কথা শুনেছে বকুল। কিন্তু আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সন্ধ্যেবেলা ক্লান্ত গলায় রাঙা কাকিমা জানালেন, কাকুর প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা, ব্যাঙ্কে জমানো টাকা, কাকিমার পারিবারিক গয়না সব কাকু আর কাকিমার ভাই বোনের ছেলেমেয়েরা সমান ভাগে পাবে। যতোদিন তাদের দুজনের কেউ বেঁচে থাকবেন, ততোদিন বকুল এ বাড়িতে থাকতে পাবে। আরো কি কি যেন বলেই যাচ্ছিলেন কাকিমা কিন্তু বকুলের কান দিয়ে সেসব কথা আর ঢুকছে না। তার পৃথিবী টলছিল তখন। মনে মনে ক্ষীণ আশা ছিল তার, এ বাড়িতে জীবনের বত্রিশ তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলো, আপনজনের সামান্য স্বীকৃতি হয়তো পাবে সে তাদের কাছে। কিন্তু একি শুনলো, কাকু-কাকিমা না থাকলে তারপর তারপর তারপর তাকে কে জানে তারপর ............। মনে মনে চিৎকার করে ভগবানকে বললো, তুমিতো জানতে ঠাকুর কাকু-কাকিমা আমি তাদের মন থেকে ডেকেছি, মন থেকে মেনেছি, মনে কোন পাপ, লোভ ছিল না ভগবান। আমার এ সমস্ত ভক্তি ভালোবাসার বদলে আমি সামান্য স্বীকৃতি কেনো পেলাম না ? কি পাপে তুমি আমায় এই সাজা দিলে? আমি এই পৃথিবীতে কেন কারো আপন হলাম না।

তানবীরা
০২.০২.১১

কৃতজ্ঞতাঃ বকুলকথা গল্পের বানান বিভ্রাট ও ভাষা বিভ্রাট সামলে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় নাজমুল ভাই ও বন্ধু আমার প্রিয় নুশেরা

No comments:

Post a Comment