Saturday 12 February 2011

নতুন আলোর দিশারীরা (তিন)

বালুচরী শাড়ি আমরা অত্যন্ত ভালোবেসে পড়ি, ভারতে জায়গা বিশেষে যাকে “কাঞ্জিভরম “ নামেও ডাকা হয়। যে আঁচল আর পাড়ের নকশা’র কারণে মেয়েদের কাছে এ শাড়ি এতো আর্কষনীয়, কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি এ পাড় আর নকশায় কি বোনা আছে? পাড় আর নকশায় আছে অন্দরমহলে মেয়েদের টানাপোড়েনের ইতিহাস আর তার সাথে গৌরবময় নারীজাগরনের প্রতীক।

অসংখ্য বাঁধানিষেধ পেড়িয়েই বাঙ্গালী মেয়েদেরকে আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল। এমনকি ঠাকুর বাড়ির মেয়েদেরকেও। তবে ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরা বেশ উদারমনা ছিলেন। মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তারা বাধাতো দেনইনি বরং আরো উৎসাহ দান করেছিলেন। আজ এই মসৃন চলার পথ যারা তৈরী করে দিয়ে গেছেন তাদের অনেকেই সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন, কিন্তু তাদের নাম অনেক ছড়িয়ে পড়েনি। পড়বার হয়তো কারনও নেই কিন্তু তাই বলে তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখবার কোন প্রয়াসও নেই। যেখানে চলবার কোন পথ ছিল না, কাঁটা সরিয়ে সেখানে পথের সৃষ্টি তারাই করে গেছেন। আজ তেমন কিছু মহিয়সীর কথাই লিখবো।

তবে একথা অস্বীকারের কোন জো নেই যে মেয়েদের পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা সেসময় অনেকেই উপলব্ধি করেছেন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, রাজা নবকৃষ্ণ, রাধাকান্ত দেববাহাদুর, ব্রক্ষানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা বৈদ্যনাথ রায়, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মদনমোহন তর্কালংকার, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার পুত্ররা। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতের মেয়েদের সাথে বারবার ভারতবর্ষের মেয়েদের জীবন পদ্ধতির তুলনা করতেন, বোঝাতে চাইতেন এগোতে হলে মেয়েদের ফেলে সেটা সম্ভব হবে না। হেমেন্দ্রনাথ বাড়ির মেয়েদের নিয়ম করে লেখাপড়া শিখাতেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেশি বিদেশী ভালো ভালো বই পড়ে শোনাতেন। শিখবার ইচ্ছা মেয়েদেরও কম ছিল না আর তার সাথে ছিল নতুন কিছু করে দেখানোর সাহস আর শক্তি।

দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাবার সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা পড়তে শুরু করেন বৈষ্ণবীর কাছে। দ্বারকানাথ যখন পাঠশালায় বানান শিখছিলেন তখন তাঁর দশ বছরের দিদি বানান করে বই পড়তেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদা আর গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়াকে মাইনে করা বৈষ্ণবী এসে লেখাপড়া শিখাতেন। তারা রামায়ন - মহাভারত পড়তেন, কলাপাতায় হাতের লেখা অনুশীলন করতেন। সে সময়ে তাই রীতি ছিল। শোনা যায় সারদা অবসর সময়ে হাতের কাছে অন্যকিছু না পেলে অভিধান খুলেই পড়তে বসে যেতেন। “চাণক্যশ্লোক” তার প্রিয় পাঠ্য ছিল। যোগমায়া নানান ধরনের বই পড়তেন। মালিনী আসতো বইয়ে ঝাঁকা নিয়ে সেখান থেকে মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো লাইলী - মজনু, হাতেমতাই, আরব্য রজনী, ল্যম্বস টেল ইত্যাদি নিতেন। মহর্ষির বড়মেয়ে সৌদামিনীও পরবর্তীতে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

ঠাকুরবাড়ি ছিল সে সময়ের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানকার মেয়েরা অন্যান্যদের তুলনায় একটু বেশি সুবিধা পাবেন তাতে আর নতুন করে কি ভাবার থাকতে পারে। কিন্তু যারা গ্রামে ছিলেন? সুদূর পল্লীগ্রামের গৃহবধূ রাসসুন্দরী একটু আধটু পড়তে শিখেছিলেন। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম আত্মজীবনী লিখেছিলেন। রাত্রিতে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে তাকে পড়াশোনা করতে হতো, কারো চোখে পরলেই ছিল নানা ধরনের তিরস্কার। শিবনাথ শাস্ত্রীর মা গোলকমণি দেবীও লুকিয়ে নানা উপায়ে লেখাপড়া শিখেছিলেন। পাবনার প্রমথ চৌধুরীর দিদি প্রসন্নময়ী ছেলেদের সাজে পাঠশালায় যেতেন। তার পিসিদের মধ্যে তিনজন ভগবতী, কৃষ্ণসুন্দরী ও মৃন্ময়ী ভালো লেখাপড়া জানতেন। তার ছোটপিসি বাল্যবিধবা কাশীশ্বরীর সাথে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে যেতো। চন্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের মেয়ে দ্রবময়ীর নামও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তবে এরা ছিলেন ব্যতিক্রম। গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েই পড়াশুনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কোলকাতার অবস্থা সে তুলনায় ঢের ভালো ছিল। প্রথমে বৈষ্ণবীরা এসে পড়ালেও সে জায়গা অতি দ্রুত দখল করে নেন ইংরেজ গৃহ শিক্ষিকারা।

প্রসন্নকুমারের মেয়ে হরসুন্দরী ও পুত্রবধূ বালাসুন্দরী অত্যন্ত বিদুষী ছিলেন। অকালমৃত্যু না হলে হয়তো জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্ত্রী বালাসুন্দরী বাংলাদেশের স্ত্রী স্বাধীনতার সূচনা করে যেতেন। তিনি সকাল নটা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত শিক্ষিকার কাছে পড়াশুনা করতেন। ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারতেন। যদিও অন্তপুরের বাইরে তিনি যাননি কিন্তু তার প্রস্তূতি শুরু করেছিলেন। এ সময় অনেকেই মেয়েদের জন্য স্কুল খোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। যদিও জেনানা মিশনের উদ্যেগে কিছু স্কুল ছিল কিন্তু সেখানে অভিজাত পরিবারের মেয়েরা যেতেন না। সে সময় প্রচন্ড বাধার মুখেই স্থাপিত হয়েছিল “বেথুন স্কুল”। প্রথমে অবশ্য নাম ছিল “হিন্দু ফিমেল স্কুল”। দেশীয় পন্ডিতদের সাহায্যে স্কুলটি স্থাপন করেছিলেন জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন। প্রথমে স্কুলটি খোলা হয়েছিল রাজা দক্ষিণারঞ্জনের সুখিয়া স্ট্রিটের বাড়ির বৈঠকখানায়। স্কুলের প্রথম ছাত্রী ছিলেন মদনমোহন তর্কালংকারের দুই মেয়ে কুন্দমালা ও ভুবনমালা। মেয়েদের স্কুলে পাঠাবার অপরাধে তাকে তার নিজ গ্রামে সমাজচ্যুত করা হয়। ওই দুজনের সাথে আরো উনিশটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হন।

১৮১৯ সালের মে - জুন নাগাদ খোলা হয় “জুভেনাইল স্কুল”। প্রথমে ছাত্রী ছিল আটটি, পরে দাঁড়ায় বত্রিশটিতে। ১৮২১ সালে মেরী অ্যান কুক কোলকাতায় কতগুলো অবৈতনিক স্কুল খোলেন। এক বছরের মধ্যেই তিনশো মেয়ে লেখাপড়া শুরু করে। ১৮৭২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ছ’শোতে। শ্রীরামপুর, ঢাকা, বীরভূম, চট্টগ্রামেও মেয়েদের স্কুল খোলা হয়। সংবাদপত্রে তুমুল বাধা দিয়ে সংবাদ ছাপা হতে থাকে। সরলমতি বালিকারা স্কুলে গেলে ব্যভিচার হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে। তারপরও যখন আস্তে আস্তে পড়াশোনার প্রসার বাড়তে লাগলো তখন বেথুনে পড়া তথা স্কুলে পড়া বিপথগামিনী বালিকাদের নিয়ে নানা ধরনের প্রহসনমূলক কবিতা, গল্প, নাটক লেখা শুরু হলো। “স্বাধীন জেনানা”, “পাশকরা মাগ”, “বৌবাবু”, “বেহদ্দ বেহায়া” ইত্যাদি ইত্যাদি।

(চলবে)
জানুয়ারীর কোন এক সময় ড্রাফট করা। ২০১০।

No comments:

Post a Comment