Sunday 11 March 2012

বইমেলা কড়চা – (তিন) মাঠার স্বাদ মালাইয়ে


বইমেলা শেষ হয়ে গেছে। আমাদের মাসুম ভাইয়ের ভাষায় “বইমেলা আর নেই”। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই উল্লেখযোগ্য ইভেন্টটি শেষ হয়েছে। দাদাভাই মাঝপথে অভিমান করে কড়চা বন্ধ করে দিলেন, কেউ কেউ “মুরগা” হবার কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। কিন্তু এখনের পর্ব হলো শেষ হয়েও হইলো না শেষ পর্ব। জনপ্রিয় কথাসাহ্যিতিকদের লেখার ধরন নিয়ে ছিল আমার এই নাদান কড়চা। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের পর এবার আর একজন এযুগের জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হকের উপন্যাসের প্যটার্ন নিয়ে আজকের কড়চা। প্রথমে অনেক লেখকের লেখার মধ্যেই ভার্সেলাইটি থাকলেও, যে মাত্র তারা জনপ্রিয় হয়ে যান, যে লেখাটির কারণে জনপ্রিয় হয়ে যান, পরে সেই স্টাইলটিকেই আকড়ে ধরে বেশির ভাগ লেখা লিখেন। আনিসুল হকের এ উপন্যাসটির নাম ধরা যাক সাড়ে তিপান্ন।

ফয়সল বিদেশি কোম্পানীর উচ্চপদস্থ ব্যস্ত কর্মকর্তা। সারাটাদিনের অনেকটা সময় তার অফিসেই কাটে। বউ প্রচন্ড হিন্দি সিরিয়াল ভক্ত। দুই ছেলে মেয়ে পদ্য আর কাব্য। একদম ইঁচড়ে পাঁকা যাকে বলে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। ফয়সলের ছোটভাই ফাহাদ। এখনো বিয়ে করেনি। পাশ করে বাসা থেকেই টুকটাক সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্টের কাজ করে। মাঝে সাঝে ভাল আয় হলে বাসার সবাইকে রেষ্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যায়। বড়বোন ফারহানা বিদেশে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকেন। আর ছোটবোন ফারিয়া মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। বাবা রিটায়ার করেছেন, সারাদিন খবরের কাগজ পড়েন আর দেশের বর্তমান হাল নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকেন। মা আছেন তার সংসার নিয়ে। ধানমন্ডিতে নিরিবিলি তাদের সংসার।

সকাল বেলায় টেলিফোন বাজছে ক্রিং ক্রিং। নাস্তা খেতে খেতে বিরক্ত মুখে ফারিয়া টেলিফোন ধরল। বাসার সবাই এখন খুব ব্যস্ত। কাব্য পদ্য যাবে স্কুলে, ভাইয়া অফিসে যাওয়ার পথে তাকে কলেজে ড্রপ করবে। এখন কি কারো বাড়িতে ফোন করার সময়?

কিন্তু ফোন তুলতেই তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী মৌ এর গলা। ফারিয়া, কিরে কলেজের জন্য কখন বেরোবি?

ফারিয়া সামান্য বিরক্তির গলায় এইতো নাস্তা খেয়ে এখুনি বেড়োব। তুই?

মৌ, নারে আমি আজ কলেজে যাবো না। ভীষন গলা ব্যথা, কাঁশি। এর আগের বার যখন ফ্লু হলো তখন ছোট ভাইয়া কি যেন একটা ওষুধ দিয়েছিলো না আমাকে, যেটা খেতেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম, সে ওষুধের নাম জানতে ফোন করেছি। তুই জানিস নামটা?

ফারিয়া বিরস গলায়, না, দাঁড়া ছোট ভাইয়াকে দিচ্ছি। হেটে হেটে কর্ডলেস নিয়ে ফাহাদের ঘরে প্রবেশ করে, ফাহাদকে ফোনটা দিয়ে ফারিয়া বেড়িয়ে গেলো।

মৌ, আচ্ছা ভাইয়া সর্দি জ্বরের সেই ওষুধটা জানি কি ছিল?

ফাহাদ, জ্বর কি বেশি নাকি? কলেজে যাচ্ছো না আজকে?

মৌ, না, খুব চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে, কোথায় ভাল চটপটি পাওয়া যাবে এখন বলতে পারেন?

ফাহাদ, আচ্ছা তুমি রেডি হও আমি আসছি। দেখছি কোথায় ভাল চটপটি পাই।

রান্নাঘরে যেয়ে দেখেন মা দুপুরের রান্নার এখনো কোন যোগাড় হয়নি। তিনি বিরক্তমুখে ডাকছেন শিউলি এই শিউলি, কই গেলি? শিউলি বেশ একটু সেজে গিয়েছে ড্রাইভার কাম বাড়ির বাজার সরকারের ঘরে তাকে নাস্তা দিতে।

ড্রাইভার ফিরোজ শিউলিকে দেখে বিগলিত গলায় বললো, তোমাকে আজ বেশ সুইট লাগতাছে। বেগুনি রঙটায় তোমারে মানায় ভালো।

শিউলি মনে মনে খুশি হলেও মুখটা যতোদূর সম্ভব গম্ভীর করে বললো, এসব কথায় কাম নাই। যান নাস্তা শেষ করে দোকানে দৌড় দেন। তেল না আনলে রান্না বসানো কঠিন হইবো। খালাম্মায় আবার আমাকে ডাকতাছে।

তা যাইতেছি কিন্তু দোকান থেকে তোমার জন্য কি আনমু কইয়া দাও, হেসে হেসে বলছে ফিরোজ

শিউলি, উহ, ঢং কত দেখোনা বুইড়ার।

শিউলি যাই খালাম্মা বললেও সে রান্নাঘরে না গিয়ে গেলো ভাবীর ঘরের দিকে। রাতের হিন্দী সিরিয়াল যেগুলো মিস হয়ে যায়, রাতের খাবার দেয়া বা অন্যান্য ফুট ফরমাশের কারণে, সেগুলো আবার সে সকালে ভাবীর ঘরে বসে দেখে নেয়। ভাবী মুখে মসুর ডাল বাটা আর চোখে শশা দিয়ে শুয়ে আছেন, টিভি চলছে। শিউলি নিঃশব্দে দাঁড়ালো, ভাবীর মেজাজের কোন ঠিক নেই, কখন আবার খ্যাঁক করে তাড়িয়ে দিবেন তার নেই ঠিক। টিভিতে সালোনি হচ্ছে, নাহার আর সালোনির প্রেম দেখতে শিউলির খুব ভালো লাগে। যদিও সালোনি মেয়েটার গায়ের রঙ শিউলির থেকেও কালা। শিউলি লুকিয়ে লুকিয়ে ডাল বাটার থেকে একটু সরিয়ে রেখে রেখে, শশা থেকেও সরিয়ে রাখে। বাথরুমে যখন নিজে গোসল করতে ঢুকে তখন বড় ভাবি, ফারিয়া আপা যেমন করে তেমন নিজেও রুপচর্চা করে। এখন তার চেহারা সুরৎ মাশাল্লাহ ভালোই, বাড়িতে নতুন কেউ এলে, সে যে এখানে কাজ করে তাইই চট করে ধরতে পারে না।

ফারিয়া দুটো ক্লাশ শেষ করে হাটছিলো ক্যাফেটারিয়ার দিকে। তখন তাদের এ্যানাটমির স্যার পিছন থেকে তাকে ডাকলেন।

ফারিয়া শোন, তুমি বোধহয় আজকের লেকচারটা ঠিক করে বুঝতে পারোনি, তোমাকে বোধহয় আলাদা একটু টিউশন দিলে ভালো হয়, না?

এ্যানাটমির এই স্যার গত বছর পাশ করেই জয়েন করেছেন। স্যারকে বেশ পছন্দ ফারিয়ার। সে সানন্দে সম্মতি দিয়ে মাথা কাত করলো।

স্যার বললো, তোমরা বোধহয় ধানমন্ডি আট নাম্বারের ব্রীজের ওপারে থাকো না? আমি কাল বিকেল পাঁচটায় আসব, বাড়ি থাকবেতো।

ফারিয়া হাসি মুখে বললো, জ্বী স্যার থাকবো, আপনি চলে এসেন। এই আমার মোবাইল নাম্বার, বাড়ি চিনতে অসুবিধে হলে ফোন দিয়েন।

ওদিকে কাব্য পদ্য স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দুপুরে কি হৈ চৈ। আজকে ওরা বাড়িতে খাবে না। কেএফসিতে নিয়ে যেতে হবে ওদেরকে। কাব্যের দাদা রিটায়ার্ড মানুষ দুইবেলা বাড়ির পাশে ওয়াক করা ছাড়া আর বাড়ি থেকে বেরই হননা। তিনি এসব চিনেন না।

কাব্য ফট করে বলে উঠল, দাদু তুমি ক্ষ্যাত। মর্ডান কিচ্ছু জানো না। কেএফসি, পিজা হাট, থ্রী ডি, আইম্যক্স মুভি, এর্নাজি ড্রিঙ্ক এসব না হলে চলে আজকাল?

আইম্যাক্স মুভি সেটা কিরে? অবাক হয়ে বললেন দাদা

আইম্যাক্স মুভি হলো, শুধু সিনেমা দেখলে হবে না সেটাকে অনুভব করতে হবে। ধরো, সিনেমাতে দেখাচ্ছে কোথাও ঝড় হচ্ছে সব কাঁপছে, তখন মুভি হলে তোমার চেয়ারও কাঁপবে, বুঝলে।

এমন সময় ফোন এলো। পদ্য বিরক্ত মুখে ফোন ধরলো, হ্যালো কাকে চাই।

অপরপ্রান্ত, ইয়ে মানে তুমি কে?

পদ্য, কেন আপনার নাম বলছেন না কেনো?

ইতস্তত গলায়, আমি আমি আসলে সাকিব

পদ্য বেশ গম্ভীর গলায়, ওহ তাই নাকি? আমি তাহলে ডোরা, রাখছি সাকিব ভাই, বাই বাই।

রাতে ফয়সল খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে ফিরে দেখলো, তার স্ত্রী সেই সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে আছে। একটু কেঁশে আস্তে আস্তে বললো, এভাবে সিরিয়াল গিললে হবে, বাচ্চাদুটো বড় হচ্ছে, ওদের ওপর বাজে প্রভাব পড়বে। সন্ধ্যায়তো ওদেরকে একটু পড়াটড়া দেখিয়ে দিলে পারো।

স্ত্রী তিক্ত গলায়, একটা ইম্পট্যার্ন্ট এপিসোড দেখছি এর মধ্যে কথা বলবে নাতো। আর বাচ্চা কাচ্চা কি খালি আমার একার নাকি? তুমি পড়াতে পারো না?

না মানে বলছিলাম কি এতো সিরিয়াল দেখলে

হ্যা, বার বার আমার টিভি দেখা নিয়ে কিসের এতো কথা শুনি? তুমি যে সারা দিনরাত বাইরে টো টো করে ঘুরে বেড়াও, সংসারের কোন খেয়াল রাখো না, তাই নিয়ে আমি কথা বলি কখনো?

অবাক গলায় ফয়সল, আমি টো টো করে বাইরে ঘুরে বেড়াই, আমিতো অফিসে

আমাকে আর অফিস দেখাতে হবে না, অফিসের নাম দিয়ে কি করো সব আমার জানা আছে। কিছু বলছি না বলে ভাবছো

স্ত্রীর সাথে কথা বলা বেকার দেখে, চাঁদর টেনে ফয়সল, বেড সাইড ল্যাম্প অফ করে শুয়ে পড়ল।

কিছু কিছু সংসারে এভাবেই দিনরাত তাদের হাসি আনন্দ, ঝগড়া মতভেদ নিয়ে এগিয়ে চলে। তাদের গল্প কখনো শেষ হয় না, এগিয়েই চলতে থাকে

তানবীরা
১১/০৩/২০১২

No comments:

Post a Comment